এমনকি তিনি পয়গম্বর হজরত মুহম্মদকে ‘অবতার’ আখ্যা দিয়ে মোল্লাদের মতে পাপ করেছেন; কারণ মুসলিম শাস্ত্রমতে আল্লা মনুষ্যদেহ গ্রহণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন না, তিনি মানুষদের একজনকে বেছে তাঁকে তাঁর মুখপাত্র করেন। সৈয়দ সুলতান কিন্তু বলছেন–
মুহম্মদ রূপ ধরি নিজ অবতার।
নিজ অংশ প্রচারিত হইতে প্রচার।
আর সবচেয়ে বড় তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন সৈয়দ সাহেব, এই দুইটি ছত্রে–
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষা তাহার, অমূল্য সেই ধন ॥
এই দুটি ছত্রে যে কত বড় সত্য নিহিত আছে, সে তত্ত্ব কি আমরা আজও বুঝতে পেরেছি? এই সৈয়দ সুলতানকে তখনকার দিনের মোল্লা-মৌলবিরা ইসলামের ঐক্য নষ্ট হয়ে যাবে, আরবির মর্যাদা লোপ পাবে এই ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘মুনাফিক’ অর্থাৎ ‘ভণ্ড’ অর্থাৎ ‘ধর্মধ্বংসকারী’ আখ্যা দিয়ে ‘ফতোয়া’ পর্যন্ত জারি করেছেন। সাহসী কবি কিন্তু অকুণ্ঠ ভাষায় তাঁর মাতৃভাষা বাঙলার জয়গান গেয়ে গেছেন। এ লোক যদি প্রকৃত বাঙালি না হয়, তবে বাঙালি কে?
সে শুভবুদ্ধি, সে সাহস কি আজও আমাদের হয়েছে? কেউ বলে ‘রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হিন্দি গ্রহণ কর’, কেউ বলে ‘ইংরেজি বর্জন করলে আমরা বর্বর হয়ে যাব।’ হায়, বাঙলার পদমর্যাদা কেউ স্বীকার করে না।
যখন দ্বন্দ্ব নেই, সংঘাত নেই, তখন মাতৃভাষার গৌরবগান গেয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করে সবাই; কিন্তু যুগসন্ধিক্ষণে, নানা প্রলোভন-বিভীষিকার সম্মুখে মাতৃভাষাকে নিজের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা বলতে পারাতেই প্রকৃত সাহস, প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধির লক্ষণ। সৈয়দ সুলতানের দুইশত বৎসর পরে ইংরেজি ভাষা বাঙালিকে প্রলোভন দেখিয়েছিল আরেকবার। কিন্তু মুসলমান সুলতানের ন্যায় খ্রিস্টান মাইকেল তখন উচ্চকণ্ঠে বাঙলার জয়গান গেয়েছিলেন।
সৈয়দ সুলতানের অনুকরণকারীরা কিন্তু তাঁর মতো বিচক্ষণ ভাষাবিদ ছিলেন না : ফলে বাঙলাতে যে পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ প্রবেশ করতে লাগল তাতে ভাষার বৈশিষ্ট্য বিপন্ন হতে লাগল। ইতোমধ্যে– মোগল যুগের শেষের দিকে–উর্দু ভাষাও বাঙলা দেশে প্রবেশ করেছে। তাই তখন যে বাঙলা পাচ্ছি তার উদাহরণ–
বিশ্বনাথ বিশ্বাসে বুঝায়ে বলে বাছা।
দুনিয়ামে এসাভি আদমি রহে সাঁচা।
ভালা বাওয়া কাহে তো মৃত্যুকাল কাছে।…
রাতদিন যৈসা তৈসা সুখ দুঃখ হোয়ে ॥
জানা গেল বাত যাওয়া জানা গেল বাত।
কাপড়া লেও আও আও মেরা সাথ ॥
যুক্তি নয়, অজুহাত হিসেবে বলা যেতে পারে, আকবরের আমল থেকে বহুল ফারসি শিক্ষাদানের ফলে বাঙলা দেশে তখন প্রচুর লোক বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। এটি কিন্তু কোনও সংযুক্তি নয়। কারণ আজ আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিস্তর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি : তাই বলে সাহিত্যসৃষ্টির সময় বে-এক্তেয়ার হয়ে যত্র-তত্র ভূরি ভূরি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিনে।
কিন্তু সত্য কবি পথভ্রষ্ট হন না। তার প্রকৃত নিদর্শন আমরা পাই, চট্টগ্রামের মহিলা কবি ‘শ্ৰীমতী রহীমুন্নিসা’র (আশা করি ‘শ্রীমতী’ লেখাতে কেউ আপত্তি করবেন না, কারণ তিনি নিজেই তাঁর কাব্যে আপন পরিচয় দেবার সময় লিখেছেন–
‘স্বামী আজ্ঞা শিরে পালি লিখি এ ভারতী।
রহিমুনিচা নাম জান আদ্যে ছিরীমতী ॥’)।
এই মহিলা কবির সঙ্গে হালে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ববঙ্গের বাঙলা একাডেমীর প্রথম ডাইরেক্টর (বাঙলা-একাডেমী পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩৬৩, পৃ. ৫৩)। তাঁর মতে ‘১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই রহীমু’নিসা আবির্ভূত হয়েছিলেন।’ ইনিও সৈয়দ সুলতানের মতো সৈয়দ বংশের মেয়ে এবং পরিবারে প্রচুর আরবি-ফারসির চর্চা থাকা সত্ত্বেও সুস্থ-সবল এবং মধুর বাংলায় কবিতা রচনা করে গিয়েছেন।
এঁর হাতের লেখা খুব সম্ভব সুন্দর ছিল। তাই বোধ করি তার স্বামী তাঁকে কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ নকল করতে আদেশ দেন :
শুন গুণিগণ হই এক মন,
লেখিকার নিবেদন।
অক্ষর পড়িলে টুটা পদ হৈলে
শুধারিত সর্বজন ॥
পদ এই রাষ্ট্র। হেন মহাকষ্ট
পুঁথি সতী পদ্মাবতী।
আলাওল মণি বুদ্ধি বলে গুণী,
বিরচিল এ ভারতী ॥
পদের উতি বুঝি কি শকতি,
মুই হীন তিরী জাতি।
স্বামীর আদেশ মানিয়া বিশেষ
সাহস করিল গাঁথি ॥
রহীমুন্নিসার স্বরচিত কাব্য অল্পই পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে তাঁর একটি ‘বারমাস্যা’ বড়ই করুণ এবং মধুর। পূর্ববঙ্গের কবিরা সচরাচর প্রিয়বিরহে বারমাস্যা রচনা করেছেন– রহীমুন্নিসা ভ্রাতৃশোকে ভার তাঁর নব বারমাস্যা রচনা করেছেন।
আশ্বিনেতে খোয়াময় কান্দে তরুলতায়
ভাই বলি কান্দে উভরায়।
আমার কান্দনি শুনি বনে কান্দে কুরঙ্গিণী
জলে মাছ কান্দিয়া লুকায় ॥
খোয়া = কুয়াশা
অন্য এক স্থলে ‘কন্যাহারা জননী’র শোকাতুরার ক্রন্দন প্রকাশ করেছেন অতুলনীয় সরল বাঙলায়–
নয়া সন নয়া মাস ফিরে বারে বার।
মোর জাদু গেল ফিরি না আসিল আর ॥
এঁর রচনায় সত্যই মধুর কবি-প্রতিভা ‘বারেবার’ ধরা পড়ে। পাঠকদের মূল প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ জানাই।
***
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বন্দ্ব প্রধানত ইংরেজির সঙ্গে। এবং সেই দ্বন্দ্ব বিদ্রোহরূপ ধারণ করল পুব বাঙলার ভাষা আন্দোলনে ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে। বাঙলা আবার জয়ী হল– কিন্তু এবারে তার জয়মূল্য দিতে হল বুকের রক্ত দিয়ে– কিন্তু আব্রু, ইজ্জত, ইমান দিয়ে নয়। পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাঙলার লোক বাঙলাতে আরেক দফে আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করে ভাষাকে ‘পাক’ করতে প্রলোভিত হল না!