আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এতে আর নতুন কথা কি? আমরা তো চিরকালই স্বীকার করে এসেছি, সর্বধর্মেই সত্য সমাহিত।
সত্যই কি আমরা তা জীবনে স্বীকার করেছি? ধর্মের বাহ্যরূপে যে বিকট প্রভেদ অহরহ দেখতে পাচ্ছি, সে কি যুগ যুগ ধরে আমাদের ভিতর দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি করেনি? নাহলে চৈতন্য, রামমোহন, রামকৃষ্ণের কী প্রয়োজন ছিল?
দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং ক্ষিতিমোহন এঁদের মতো ধর্মসংস্কারক ছিলেন। এদের প্রধান কর্ম ছিল, যুগ যুগ সঞ্চিত আমাদের ঐতিহ্যের ধন যার প্রায় সবকিছুই আমরা দৈনন্দিন জড় অভ্যাসের ফলে সম্পূর্ণ অবহেলা করে বসে আছি, সাধনাবিহীন মন্ত্রতন্ত্রই সর্বপাপহর বলে বিশ্বাস করে বসে আছি, মুখে ‘সর্বভূতে নারায়ণ’, কর্মে সে ‘নারায়ণ’কে ডোম-চালের কলুষতার ভয়ে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে রেখেছি, স্বর্ণেপর্ণে, ধর্মে-অধর্মে প্রভেদ করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছি– এই নিদারুণ অবস্থায় আমাদের দৃষ্টি সেই সত্যের দিকে আকৃষ্ট করা যে সত্য আমাদের হাতের কাছেই আছে–লালন ফকিরের ভাষায়–
‘হাতের কাছে– পাইনে খবর
খুঁজতে গেলেম দিল্লি শহর।’
যাকে চাইলেই পাওয়া যায়।
ক্ষিতিমোহনের প্রধান কর্ম ছিল, সমাজের তথাকথিত নিম্নতম সম্প্রদায়েও যে সে সত্য যুগপৎ লুক্কায়িত ও উদ্ভাসিত আছে, তারই দিকে তথাকথিত শিক্ষিতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মধ্যযুগের সন্তদের নিয়ে তিনি তাঁর সাধনা আরম্ভ করে নিচের দিকে নেমে এলেন আউল-বাউল এবং সেখানে সেসব মণিমুক্তা পেলেন, তাদের প্রাচীনত্বের সন্ধানে উপরের দিকে গেলেন বেদ-উপনিষদে। এই অবিচ্ছিন্ন তিন লোকে তাঁর গমনাগমন গতিধারা ছিল অতিশয় স্বতঃস্ফুর্ত আয়াসহীন। এটা পণ্ডিতজন-দুর্লভ–ধর্মলোকে বিধিদত্ত স্পর্শকাতরতা না থাকলে এ জিনিস সম্ভবে না।
ক্ষিতিমোহন পথ প্রদর্শন করার পর আরও অনেকেই আউল-বাউল নিয়ে চর্চা করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ক্ষিতিমোহন একক।
তার কারণ ক্ষিতিমোহনের এমন একটি গুণ ছিল যা এ যুগে আর কারও ছিল না–আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর কুত্রাপি আমি এ গুণটি দ্বিতীয় জনে দেখিনি।
কঠিনতম জিনিস সরল ভাষায় মধুর রূপে প্রকাশ করার অলৌকিক ‘খুদাদাদ’-বিধিদত্ত ইন্দ্রজাল-শক্তি।
ক্ষিতিমোহন লিখেছেন যতখানি, বলেছেন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কারণ তিনি জানতেন পুস্তক সর্বগামী নয়, লিখিত অক্ষরের শক্তি সীমাবদ্ধ।
বিদ্যালয়ের অজাতশ্মশ্রু বালক থেকে আরম্ভ করে শুভ্রকেশ বৃদ্ধ, অভ্যাগত রবাহত সকলকে, সভাস্থলে, বন্ধু-সমাগমে, ট্রেনে-জাহাজে, হিমালয়ের চটিতে, নর্মদার পারে পারে, দেশে-বিদেশে তিনি যেখানেই থেকেছেন, যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তিনি এই অভূতপূর্ব বাচনভঙ্গি দ্বারা তাঁর বক্তব্য নিবেদন করে সকলকেই মুগ্ধ করেছেন। শত শত লোক হাজার হাজার গম্ভীর পুস্তক লিখেও যা করতে সক্ষম হবেন না, কথকসম্রাট ক্ষিতিমোহন একাই তা করে গেছেন তাঁর খুদা-দাদ এই সওগাতের দৌলতে।
সবিনয় নিবেদন করছি, আচার্য ক্ষিতিমোহনের বহুমুখী কর্ম এবং চিন্তাধারার সম্যক বিশ্লেষণ আমার সীমাবদ্ধ শক্তির বাইরে। যেটুকু আছে তা-ও শোকাচ্ছন্ন। তবু আশ্রমবাসী, তাঁর শিষ্যরূপে তাঁরই স্মরণে তাঁর অসংখ্য অনুরাগী পাঠক ও শ্রোতাদের উদ্দেশে এই কথা কয়টি নিবেদন করি।
আমার অক্ষমতার রচনাও তাঁর স্নেহাশীর্বাদ লাভ করত। পুণ্যলোক থেকে আগত তাঁর সে আশীর্বাদ থেকে আমার এ দীন শ্রদ্ধাঞ্জলি অকিঞ্চন গুরুদক্ষিণা বঞ্চিত হবে না– এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আর্ট না আ্যাকসিডেন্ট
আর্ট বলতে আমরা আজকাল মোটামুটি রস-ই বুঝি। তা সে কাব্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে সঙ্গীতে যে কোনও কলার মাধ্যমেই প্রকাশিত হোক না কেন।
এখন প্রশ্ন আর্ট বা রসের সংজ্ঞা কী? সে জিনিস কী? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে চিনব কী করে? অন্যান্য রস থেকে তাকে আলাদা করব কী করে? সরেস আর্ট কোনটা আর নিরসই-বা কোনটা?
প্রাচীন ভারত, গ্রিস এবং চীন– এই তিন দেশেই এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং অধুনা পৃথিবীর বিদগ্ধ দেশ মাত্রেই এ নিয়ে কলহ-বিসংবাদের অন্ত নেই। বিশেষ করে যবে থেকে “মডার্ন আর্ট” নামক বস্তুটি এমন সব ‘রস’ পরিবেশন করতে আরম্ভ করল যার সঙ্গে আমাদের কণামাত্র পরিচয় নেই। এলোপাতাড়ি রঙের পোঁচকে বলা হল ছবি, অর্থহীন কতকগুলো দুর্বোধ শব্দ একজোট করে বলা হল কবিতা, বেসুরো বেতালা কতকগুলো বিদঘুঁটে ধ্বনির অসমন্বয় করে বলা হল সঙ্গীত। বলছে যখন তখন হতে পারে, কিন্তু না পেলাম রস, না বুঝলাম অর্থ, না দিয়ে গেল মনে অন্য কোনও রসের ব্যঞ্জনা বা ইঙ্গিত। তাই বোধহয় হালের এক আলঙ্কারিক মডার্ন ভাস্কর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যখন ভাস্কর এক বিরাট কাঠের গুঁড়ি নিয়ে তার উপর ছ মাস ধরে প্রাণপণ বাটালি চালানোর পর সেটাকে কাঠের গুঁড়ির আকার দিতে পারেন, এবং নিচে লিখে দেন ‘কাঠের গুঁড়ি’– তখন সেটা ‘মডার্ন ভাস্কর্য’।
ইতোমধ্যে এই মডার্ন আর্টের বাজারে একটি নতুন জীব ঢুকেছেন এবং সেখানে হুলস্থূল বাঁধিয়ে তুলেছেন– এর নাম অ্যাকসিডেন্ট, বাঙলায় দুর্ঘটনা, দৈবযোগ, আকস্মিকতা যা খুশি বলতে পারেন।
এঁর আবির্ভাব হয়েছে সুইডেনের মতো ঠাণ্ডা দেশে যেখানে মানুষ ঠাণ্ডাভাবে ধীরেসুস্থে কথা কয়, চট করে যা-তা নিয়ে খামখা মেতে ওঠে না।