তাঁর আরও বহু গুণ ছিল। তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে। আজ সেদিন নিশ্চয়ই নয়। এই এখন আমার কানে ভেসে আসছে ক্ষিতিমোহনের বিহারক্ষিতি শালবীথিকায় তাঁর স্মরণে শোকতপ্ত আশ্রমবাসীগণের সশ্রদ্ধ ‘আগুনের পরশমণি’ বৈতালিক গীতি।
***
চিত্রে নন্দলাল। সঙ্গীতে দিনেন্দ্রনাথ। শাস্ত্রে বিধুশেখর। শব্দতত্ত্বে হরিচরণ। শিক্ষকতায় জগদানন্দ। রসে ক্ষিতিমোহন।
শুনেছি বিশ্বভারতী এঁদের সম্বন্ধে প্রাথমিক পুস্তক প্রকাশ করেছেন। তার ভিতরই পাওয়া যাবে বিশ্বভারতীর নাতিসম্পূর্ণ ইতিহাস। এ কর্মে সংখ্যাতীত শিষ্যের সহযোগিতার প্রয়োজন। আমি শুধু সেটুকু বলতে পারি যা স্বচক্ষে দেখেছি।
শাস্ত্র এবং রসালোচনায় রবীন্দ্রনাথের দুই বাহু ছিলেন বিধুশেখর এবং ক্ষিতিমোহন।
সকলেই আশা করেছিলেন কাশীর শাস্ত্রী ক্ষিতিমোহন সংস্কৃত চর্চায় যশস্বী হবেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করে দিলেন বাঙলার জনবৈদগ্ধ্য চর্চায়। আজ আর মধ্যযুগের সন্তরা যে পৃথিবীর সর্বসন্তদের সমকক্ষ একথা নিয়ে কেউ তর্কাতর্কি করে না, এদেশের আউল-বাউলরা যে সাধনার গভীরতম অতলে পৌঁছে প্রাচীন যুগের মুনি-ঋষিদেরই ব্রহ্মানন্দ আস্বাদন করেছিলেন সেকথাও কেউ অস্বীকার করে না, এমনকি কোনও কোনও অর্বাচীন ওই বিষয়ে বিরাট গ্রন্থ লিখে এখন সপ্রমাণ করতে চায় যে, সে ক্ষিতিমোহনকেও ছাড়িয়ে গেছে, তার অসম্পূর্ণ জ্ঞান সম্পূর্ণতর করে দিয়েছে! বিরাটকায় ক্ষিতিমোহনের স্কন্ধে দাঁড়িয়ে বামনও হয়তো একটু বেশি দূর অবধি দেখতে পায় অস্বীকার করিনে, কিন্তু সে বামন ক্ষিতি-অতিকায়ের বিরাট মস্তিষ্ক আর বিরাটতর হৃদয় পাবে কোথায়! তবে আজ এই বিতর্কমূলক প্রস্তাব (অবশ্য আমার কাছে নয়) উত্থাপন করব না– আজ শোকের দিন।
এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ক্ষিতিমোহন আউল-বাউল গান নিয়ে আলোচনা করার সময় যে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন সেটি সম্পূর্ণ শাস্ত্র-চর্চা পদ্ধতি। অর্থাৎ উপনিষদ বা গীতার টীকা লেখার সময় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত যেরকম অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাঠোদ্ধার করেন, অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন, ওইসব শাস্ত্রের মূল উৎসের অনুসন্ধান করেন, ঠিক সেই পদ্ধতিতে তিনি আউল-বাউলের ‘শাস্ত্র’ অধ্যয়ন করে, টীকা লিখে তাদের জীবনদর্শন অধ্যাত্মদর্শন লোকচক্ষের সামনে তুলে ধরলেন।
এই কর্মে লিপ্ত হয়ে ক্ষিতিমোহন দেখতে পেলেন, আউল-বাউলের মূল উৎস যে শুধু বেদ উপনিষদ গীতা ভক্তিবাদে রয়েছে তা নয়, তার সঙ্গে মিলে গিয়েছে মুসলিম সুফিবাদ। তিনি তারই অনুসন্ধানে সুফিবাদের এমনই গভীরে পৌঁছলেন যে, বহু সুপণ্ডিত সুফি পর্যন্ত আশ্চর্য হলেন যে, সুফি আবহাওয়ার এত দূর থেকে এই লোকটি একে আপন প্রাণ-নিশ্বাসে ভরে নিল কী করে? রামমোহনকে যদি বলা হয় জবরদস্ত মৌলবি, এঁকে তা হলে বলতে হয় ‘খবরদস্ত’ বা ‘খবর-দার-সুফি’। পূর্ব বাঙলার অনাদৃত মুসলিম চাষিকে ক্ষিতিমোহন ছেলেবেলা থেকেই অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন– তিনি প্রমাণ করলেন তার আধ্যাত্মিক সাধনা কুরান ও সুফিবাদের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আশ্চর্য প্রাণশক্তিবলে সে তার চতুর্দিকের ভিন্ন সাধনাও আপন করে নিতে পেরেছে। শুধু তাই নয় হিন্দু সাধকের কাছে সে ঋণীও বটে, উত্তমর্ণও বটে। এই সর্বশেষে সুপ্রমাণ করলেন, হিন্দু-মুসলমান সাধনার মিলন হয়েছে এই ‘চাষাভুষো’দের কল্যাণেই– মৌলভি-ভশচাযে যে ভাবনা-সাধনার আদান-প্রদান অতি অল্পেই হয়েছে সেটা পরিস্ফুট হয়ে উঠল।
গণসাধনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা গভীরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হিন্দু ক্রিয়াকর্মের দিকে আকৃষ্ট হলেন। ‘মেয়েলি’ বলে আমরা যেসব পালপার্বণ ব্রতপূজা অবহেলা করে আসছিলুম। সেগুলো একটি একটি করে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখাতে লাগলেন যে, এগুলোর ভিতরও অতি প্রাচীন ঐতিহ্য লুকোনো রয়েছে, এর অনেকগুলোই চলে যায় আমাদের ধর্মানুসন্ধানের প্রাচীনতম যুগে। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করলেন যে, আমাদের অনেকগুলোই আবার আমাদের প্রতিবেশী অনার্যদের কাছ থেকে নেওয়া।
সে এক বিপরীত দর্পণ! আমরা যেসব পালপার্বণকে ভেবেছিলুম অতিশয় খানদানি ‘আর্য’, ক্ষিতিমোহন প্রমাণ করলেন তার অনেকই ‘অনার্য’ এবং তথাকথিত ‘অনার্য’ ক্রিয়াকর্মের মূল রয়েছে নৈকষ্য আর্য সাধনার গভীরে।
এর সবকিছুই প্রেমী গবেষককে নিয়ে যায় ভারতবর্ষের ধর্মানুপ্রাণিত দর্শনচর্চায়–কারণ একমাত্র দর্শনশাস্ত্রই বহুর বাহ্যরূপ উন্মোচন করে অন্তরের ঐক্যদর্শন করাতে পারে। সেখানে তিনি পেলেন জ্ঞানী দ্বিজেন্দ্রনাথের(১) উপদেশ এবং সহযোগিতা– গুণী রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য যে তিনি অহরহ পেতেন সে জানা কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি। এরই ফলে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন ক্রিয়াকাণ্ড, যোগতন্ত্রের রহস্যবাদ ও দর্শনের মূল তত্ত্বে রয়েছে একই নির্ধ সত্য।
এই সত্যের ভানুমতী-দণ্ড হাতে নিয়ে ক্ষিতিমোহন প্রবেশ করলেন হীনযান, মহাযান এবং তারই ভিন্ন ভিন্ন তান্ত্রিক যান, নেপাল-তিব্বত-চীনের ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মজগতের ভিতর। সেই এক সত্য কখনও বৌদ্ধদর্শনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিন্তাধারায়, তন্ত্রের বিকৃত কর্মকাণ্ডের পিছনেও সেই সত্য ভস্মাচ্ছাদিত, সেই সত্যই চর্যাপদে, সেই সত্যই পূর্ববঙ্গের লোকসঙ্গীতে, পশ্চিমবঙ্গের আউল-বাউলের গানে কখনও স্বপ্রকাশ, কখনও শাস্ত্রানধিকারীর উৎপাতে লুক্কায়িত– কখনও সরলতম ভাষায় স্বচ্ছ, কখনও রহস্যাবৃতরূপকে আস্বচ্ছ কুহেলিকাঘন।