এর উত্তর আমি দেব কী? গৃহিণী যে ক’টা গল্প জানেন সব কটাই আমার সঙ্গে টায়-টায় মিলে যায়। মনে হয় আমার পূজ্যপাদ শ্বশুর-শাশুড়ি ছেলেবেলা থেকে তাকে এই তালিমটুকুই শুধু দিয়েছেন, স্বামীর গোদা পায়ের গোদটি কী প্রকারে বারে বারে দেখিয়ে দিতে হয়। অবশ্য তার জন্য যে বিশেষ তালিমের প্রয়োজন হয় সেটা অস্বীকার করলেও চলে। ওটা তাদের বিধিদত্ত জন্মলব্ধ অশিক্ষিতপটুত্ব। যেসব সমালোচকদের কথা পূর্বে নিবেদন করেছি, তাদের বেলাও এই নীতি প্রযোজ্য।
ব্রাহ্মণীয় আপ্তবাক্য আমি মেনে নিয়েছি। তিনি তালাকের দরখাস্তটি উইথড্র করেছেন– শুনে দুঃখিত হবেন।
***
শঙ্করাচার্য দর্শনরণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে বলেছিলেন, ‘সাংখ্যমল্লকে আহ্বান কর। সে-ই মল্লদের অধিপতি। তাকে পরাজিত করলে অন্যান্য সফরি-গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করে অযথা কালক্ষয় করতে হবে না।’ আমি শঙ্কর নই! তাই সবচেয়ে সরল প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করব।
প্রশ্নটি এই : ‘মপাসাঁ’র ছোটগল্প অপার আনন্দ দেয়, কিন্তু তাঁর অনুকরণকারীদের গল্প এত বিস্বাদ কেন? অপিচ, মপাসাঁ ছোটগল্প লেখার যে কাঠামো তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন তার অনুকরণ না করে গল্প লিখিই-বা কী প্রকারে?”
যাঁরা সঙ্গীত আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরাই জানেন, ওস্তাদ যেভাবে গান গান তারই হুবহু অনুকরণ করতে হয় ঝাড়া দশটি বছর ধরে। ভারতনৃত্য শিখতে গেলে মীনাক্ষীসুন্দর পিল্লের নৃত্য অনুকরণ করতে হত ততোধিক কাল। স্যাকরার শাগরেদকে কত বছর ধরে একটানা গুরুর অনুকরণ করে যেতে হয়, তার ঠিক ঠিক খবর আমার জানা নেই। ভারতবর্ষে এই ছিল রেওয়াজ।
সাহেবরা এ দেশে এসে বলল, ‘এত বেশি অনুকরণ করলে নিজস্ব সৃজনশক্তি (অরিজিনালিটি) চাপা পড়ে যায়। ফলে কোনও কলার আর উন্নতি হয় না।’ কথাটা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মধ্যে অনেকখানি সত্য লুকনো আছে।
কিন্তু তার বাড়াবাড়িতে কী হয়, সেটাও তো নিত্য নিত্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গুণীজনের উচ্চাঙ্গ সৃষ্টি অধ্যয়ন না করেই আরম্ভ হয়ে যায়, ‘এপিক’ লেখা, দু কদম চলতে না শিখেই ডানস্ ‘কম্পোজ’ করা, আরও কত কী, এবং সর্বকর্মে নামঞ্জুর হলে সমালোচক হওয়ার পন্থা তো সবসময়েই ভোলা আছে। সেই যে পুরনো গল্প– শহর-পাগলা ভাবত, সে বিধবা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী। পাগল সেরে গেছে এই রিপোর্ট পাওয়ার পর পাগলাগারদের বড় ডাক্তার তাকে ডেকে পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে শুধালেন, ‘তা তুমি খালাস হওয়ার পর করবে কী?’ সুস্থ লোকের মতো বলল, ‘মামার বড় ব্যবসা আছে, সেখানে ঢুকে যাব।’ ‘সেটা যদি না হয়?’ চিন্তা করে বলল, ‘তা হলে আমার বিএ ডিগ্রি তো রয়েছেই– টুইশনি নেব।’ তার পর একগাল হেসে বলল, ‘অত ভাবছেন কেন, ডাক্তার? কিছু নাহলে যেকোনো সময়ই তো আবার মহারানির স্বামী হয়ে যেতে পারব।’ সমালোচক সবসময়ই হওয়া যায়।
তৃতীয় দল অন্য পন্থা নিল। ওস্তাদদের হুবহু নকল তারা করল না– তাতে বয়নাক্কা বিস্তর। আবার বিন-তালিমের ‘অরিজিনালিটি’ পাঠক-সাধারণ পছন্দ করে না। উপায় কী? তাই তারা ওস্তাদদের কতকগুলো বাছাই বাছাই জিনিস অনুকরণ করল এবং শুধু অনুকরণেই না, বাছাই বাছাই জিনিসগুলোর মাত্রা দিল বাড়িয়ে।
চার্লি চ্যাপলিন একবার নাম ভাঁড়িয়ে গোপনবাসের জন্য গেছেন চিলির এক অজানা শহরে। বেড়াতে বেড়াতে দেখেন, দেয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন ‘সোমবার রাত্রে শহরের কনসার্ট ঘরে চার্লি চ্যাপলিনের নকল করার প্রতিযোগিতা হবে। ভ্যাগাবন্ড চার্লির বেশভুষা পরিধান করে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজের ইসপার উসপার হতে হবে চার্লি ধরনে। সর্বোৎকৃষ্ট অনুকরণের পুরস্কার পাঁচ শ টাকা।
চার্লি ভাবলেন, এখানে তো কেউ তাকে চেনে না, দেখাই যাক না, প্রতিযোগিতায় ছদ্মনামে কী হয়।’
ছাব্বিশজন প্রতিযোগীর ভিতর চার্লি হলেন তেরো নম্বর।
তার সরল অর্থ, ওই ছোট শহর, ধেড়ধেড়ে ডিহি গোষ্ঠীপুরে বারোজন ওস্তাদ রয়েছেন যাঁরা চার্লিকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন চার্লির পার্ট কী করে প্লে করতে হয়।
চার্লি শিরে করাঘাত করে বলেছিলেন, ‘হে ভগবান, আমার অভিনয় যদি এই বারোজনের মতো হয় তবে আমি আত্মহত্যা করে মরব।’
ব্যাপারটা হয়েছে, চার্লি যেখানে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা দিয়ে হৃদয়ের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেন এঁরা সেটাকে দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মশকরাতে পরিণত করেছেন; চার্লি যেখানে চোখের জলের রেশ মাত্র দেখিয়েছেন, এঁরা সেখানে হাউমাউ করে আসমান-জমিন ফাটিয়ে আড়াই ঘটি চোখের জল ফেলেছেন; চারুকলার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে চার্লি যেখানে অখণ্ড সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রশান্ত শিব সৃষ্টি করেছেন সেখানে তারা প্রত্যেক অঙ্গে ফাইলেরিয়ার গোদ জুড়ে বানিয়ে তুলেছেন এক-একটি বিকট মর্কট।
ঘরোয়া উপমা দিতে হলে বলি, ভেজাল সরষের তেলেরই বড় বেশি সোনালি ঝাঁঝ– মারাত্মক তুখোড়।
রবীন্দ্রনাথের ‘দোদুল-দোলা’, ব্যা’কুল রেণু’, ‘উদাস হিয়াকে’ ‘দোলাতর’, ‘বেণুতর’ করে নিত্য নিত্য কত না নব নব মশকরা হচ্ছে। কিন্তু তবু চার্লি বেঁচে গেছেন। কারণ আর যা-ই হোক মার্কিন মুলুক পরশুদিনের গড়া নবীন দেশ। ভেজালে এদের অভিজ্ঞতা আর কতটুকু? প্রাচীন চীনের কাহিনী শ্রবণ করুন।