‘তাঁর বয়েস হয়েছিল, তাঁর সাহিত্যজীবন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল অথচ সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর অভিমত ছিল আধুনিকতম এবং সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল। প্লটের প্যাঁচ আর থিয়েটারি কৌশলে ভর্তি উপন্যাস তিনি দু চোখে দেখতে পারতেন না, তিনি বলতেন, কিছু নয়, সুদ্ধমাত্র জীবন হবে উপন্যাসের উপাদান– তাতে প্লটের কলাকৌশল থাকবে না, থাকবে না অসম্ভব কীর্তিকাহিনী।
‘তাঁর মতে উপন্যাস আর্টের সর্বাধুনিক রূপ। গোড়ার দিকে রূপকথার ছলাকলা তাতে ব্যবহার করা হত এবং উপন্যাস এখনও তার থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পায়নি। নানারকম রোমান্টিক আর আকাশ-কুসুম কল্পনা উপন্যাসকে এতদিন ধর্মভ্রষ্ট করেছে। এখন আস্তে আস্তে মানুষের রসবোধ শুদ্ধ হতে চলেছে। এখন ওসব সস্তা ছলাকলা বর্জন করে উপন্যাসকে করতে হবে সরল, তাকে জীবনের আর্ট রূপে তুলে ধরতে হবে, যাতে করে একদিন সে জীবনের ইতিহাসরূপে গণ্য হতে পারে।
‘আজ তাঁর প্রতিভাপ্রসূত কাব্যসৃষ্টির বিশ্লেষণ করা যাবে না– যদিও জানি তাঁর সৃষ্টি রুশ-সাহিত্যের সর্বোচ্চ সৃষ্টির সমপর্যায়ে স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রিয়তম বন্ধু মহাকবি পুশকিন, লেরমন্তফ এবং ঔপন্যাসিক গগলের সৃষ্টির পাশাপাশিই তাঁর রচনার স্থান। রুশদেশ যাদের সৃষ্টি চিরকৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে ইনি তাদেরই একজন। ইনি রুশকে দিয়েছেন চিরঞ্জীব সম্পদ, অমূল্য নিধি। ইনি দিয়েছেন এমনই সম্পূর্ণ আর্ট, এমন সব সৃষ্টি যার বিস্মরণ অসম্ভব; তিনি দিয়েছেন এমন এক গৌরব যে গৌরবের মূল্যবিচার অসম্ভব, যার আয়ু অন্তহীন এবং রুশদেশের অন্য সর্বগৌরব সে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়। এর মতো লোকই দেশের জন্য এমন কিছু করে যান যার কাছে প্রিন্স্ বিসমার্ক তুচ্ছ; পৃথিবীর সর্বভূমির সর্বমহাজনের কাছে এরা নমস্য হন।
ক্রন্দসী
“শ্যামার নামের মন্ত্রগুণে
উতলা নগররক্ষী আমন্ত্রণ শুনে
রোমাঞ্চিত; সত্বর পশিল গৃহ মাঝে
পিছে বন্দী বজ্রসেন নতশির লাজে
আরক্ত কপোল। কহে রক্ষী হাস্য ভরে,
‘অতিশয় অসময়ে অভাজন পরে
অযাচিত অনুগ্রহ।”
ওহ্ ভাষার কী জেল্লা! ‘অতিশয় অসময়ে অভাজনে অযাচিত অনুগ্রহ–’
‘অ’য়ে ‘অ’য়ে ছয়লাপ! তা-ও ইন্সপেক্টর জেনরেল অব্ পুলিসের মুখে।
গল্পটি সকলেরই জানা। রবীন্দ্রনাথ এটি কণেবর জাতক থেকে নিয়েছেন। আজকের দিনের ভাষায় বলতে গেলে রাজ্যপালের মেয়ের আঙটি হারিয়েছে। তুমুল কাণ্ড। স্বয়ং আইজি যখন চোর ধরে গবর্নমেন্ট হৌসের দিকে যাচ্ছেন তখন মনে করুন মাতাহারি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি কি তখন ‘উতলা’ এবং ‘রোমাঞ্চিত’ হবেন না? তাঁর মুখে কি তখন থৈ ফুটবে না, চোখ দুটো পলকা নাচ নাচবে না! অবশ্য সামান্য ‘অ’ দিয়ে কবিত্বের প্রকাশ– রবীন্দ্রনাথ অতি মোলায়েম ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পুলিস এর বেশি আর কী কবিত্ব করবে? তবে কি না রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতাটি লিখেছিলেন সেদিনের তুলনায় আজকের পুলিস বড্ড বেশি লেখা-পড়া করে আপন সর্বনাশ টেনে আনছে।
আমার অবস্থা হয়েছিল বজ্রসেনের। সে চোর।
আমি তখন বোম্বায়ে। আমার এক বন্ধু ব্যাঙ্কার। নাম জভেরি– অর্থাৎ জহুরির গুজরাটি সংস্করণ। এক বাঙালি ‘ফিলিম-এস্টারে’র শাদি। তিনি তাঁর ব্যাঙ্কার জভেরিকে নেমন্তন্ন করেছেন। জভেরি ব্যাচেলর; আমার সঙ্গে চম্ করে। স্টার সেটি জানতেন। লক্ষৌয়ে প্রতিপালিত বঙ্গরমণী এটিকেট-দুরুস্ত হয়, যত না প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। বিবেচনা করি আমারও নিমন্ত্রণ ছিল– কিন্তু কসম খেতে পারব না।
রোশনাই বাদ্যি-বাজনা যা ছিল তা এমন কিছু মারাত্মক খুনিয়া ধরনের নয়। কন্যা কুরূপা হলে এসবের প্রয়োজন। ইংরেজিতে বলে লিলি ফুলকে তুলি দিয়ে রঙ মাখাতে হয় না! আজকের দিনের ভাষায় লিপস্টিক্-রু মাখাতে হয় না। যাঁরা আছেন এবং যাঁরা আসছেন তাঁদের এক-একজনই একধামা লিলি–না, দুইধামা।
দরিদ্র আবুহোসেন ঘুম ভাঙতে দেখে, সে সুন্দরীদের হাটে। কূজনে গুঞ্জনে গন্ধে অনুমান করল সে খলিফা হারুন-অর-রশিদের হারেমের ভিতর। সাক্ষাৎ পরীস্তান।
আর আমি? অধুনা মৃত ভাস্কর এপস্টাইন আমাকে ‘বৃদ্ধ নিগ্রো’র মডেল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুন্দরীরা আমাকে অবহেলা করেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, আমিও বুঝি ফিলিম স্টার ‘স্যুটিঙে’র (‘শুটিঙ’ সাদামাটা সিনেমা বাবদে অজ্ঞজনের শুদ্ধ উচ্চারণঃ) ড্রেস না ছেড়েই দাওয়াতে এসেছি।
আমি ভালো করেই জানি, আপনারা সব স্টারদেরই চেনেন, কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে দেখেছেন কি না সে-বিষয়ে সন্দেহ। তদুপরি আরেকটি ছোট কথা আছে। তারকার তুলনা দিয়েই নিবেদন করি। অরুন্ধতী আকাশের ক্ষুদ্রতম তারকা। কিন্তু তিনি বশিষ্ঠের পাশে বসে যখন সপ্তর্ষির সাতটি তারকার একজন হয়ে দেখা দেন তখন মনে হয় ইনি না থাকলে সপ্তর্ষির সাতটি তারকাই মিথ্যা হতেন।
শাদি মজলিসে তাই ক্ষুদ্রতম তারকাটিও চিত্তহারিণী হয়ে দেখা দিয়েছিলেন।
এলেন, মনে করুন– নামগুলো একটু উল্টেপাল্টে দিচ্ছি- শমশাদ বানু লায়লা। পরনে সাটিনের পাজামা। পায়ের এক-একটি ঘের অন্তত দু হাত। স্বচ্ছন্দে যে কোনও বঙ্গসন্তানের তিনটি পাজামা বা পাঁচটি পাতলুন হতে পারে। শমশাদ বানুর কোমরটি বঙ্গরমণীর কাঁকনের সাইজ। তাই কোমর থেকে পর্দার মতো ফোল্ডে ফোন্ডে সে পাজামা নেমে আসাতে বোঝা গেল না তিনি মাডাম পম্পাডুয়ের ফ্রক পরেছেন, না ভাওয়ালের জমিদারবাড়ির লুঙ্গি পরেছেন, না ইরানি বেদেনীদের তাম্বু-পানা ঘাঘরা পরেছেন। আসলে নাকি একে লক্ষৌঈ বড়া মুরি পাজামা বলে। তা সে যে নামই হোক, আমার মনে হল আমি যেন খাসিয়া পাহাড়ে মুশমই জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে। বিজলির আলো প্রতি ফোন্ড বেয়ে যেন গলা রুপোর মতো ঝরনাধারায় পায়ের কাছে নেমে এসে শততরঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে শমশাদ বানু লায়লা যেন আস্বচ্ছ দুগ্ধকুণ্ডে কটিতটটি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।