উপরের উদ্ধৃতি ১৯৩০-এর ৯ ডিসেম্বরের ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে। প্রসঙ্গ, ৮ ডিসেম্বরের রোমহর্ষক ‘অলিন্দ-যুদ্ধ’, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের দুঃসাহসিক অভিযান। সর্বজনবিদিত, সিম্পসনকে হত্যা করার পর বাদল আত্মহত্যা করেন পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। বিনয় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গুলি চালিয়ে এবং ১৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ত্রয়ীর মধ্যে দীনেশ গুপ্ত শুধু বেঁচে যান, বিষ খাওয়া এবং গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরেও।
ব্রিটিশ সরকার চিকিৎসাধীন দীনেশের পরিচর্যায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। বরং পরম যত্নে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, যাতে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচার-প্রহসনের সাতপাকে বেঁধে ফেলা যায় অকুতোভয় যুবককে, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় বিপ্লবীদের কাছে। ১৯৩১–এর ৭ জুলাইয়ের শেষ রাতে ফাঁসিকাঠের পাটাতন সরে গিয়েছিল দীনেশের পায়ের তলা থেকে।
সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, ‘Dauntless Dinesh Dies at Dawn.’। কলকাতা কর্পোরেশনের সভায় গৃহীত হয়েছিল প্রস্তাব, ‘This corporation records its sense of grief at the execution of Dinesh Chandra Gupta who sacrificed his life in the pursuit of his ideal.’
দীনেশের ফাঁসি বঙ্গজ বিপ্লবীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করল। দীনেশের নিজের হাতে গড়া মেদিনীপুর শাখার Bengal Volunteers (বিভি)-এর বিপ্লবীরা ফেটে পড়লেন ক্রোধে। যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত হল। যার পরিণতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্নেল জেমস পেডিকে হত্যা করলেন যতিজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত। বিমলকে চিহ্নিত করল পুলিশ, কিন্তু ধরতে পারল না। বিমল ফেরারি হলেন।
পেডি-হত্যা ছিল প্রতিশোধস্পৃহার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। আসল লক্ষ্য ছিলেন স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট Ralph Reynolds Garlick, যিনি দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। যিনি বিচারাধীন বিপ্লবীদের প্রতি বরাবরই ছিলেন খড়গহস্ত, রাজদ্রোহের যে-কোনও মামলায় অভিযুক্তের প্রতি ছিলেন মাত্রাছাড়া নির্মম।
এহেন গার্লিক সাহেবকে কৃতকর্মের ফল পেতেই হবে, সংকল্প করলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু করবে কে কাজটা?
.
কানাইলাল ভট্টাচার্য। উনিশ বছরের চনমনে যুবক, বাড়ি জয়নগর থানার মজিলপুর অঞ্চলে। যাকে জয়নগর ব্যায়াম সমিতির বার্ষিক সভায় চোখে পড়ল এলাকার নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী সুনীল চ্যাটার্জীর। নেতাজির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সোৎসাহে। কে ছেলেটা? খোঁজ নিতে হবে সভা মিটে গেলে, সাতদা-কেও বলতে হবে।
‘সাতদা’। সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার। চেম্বার বারুইপুরে। রোগীর আনাগোনা লেগেই আছে অবিশ্রান্ত। আর যাওয়া-আসা ছেলের দলের। চব্বিশ পরগনার বিপ্লবী দলগুলির সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিভাবক। সুনীল অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন সাতদা-র। জয়নগর-মজিলপুরে ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে সাতদা-রই আশীর্বাদ। স্বয়ং নেতাজি বিশেষ পছন্দ করেন সাতকড়ি ডাক্তারকে। সাতদা-রই অনুরোধে জয়নগরে সুভাষচন্দ্র বসুর পদার্পণ ব্যায়াম সমিতির বিপ্লবীদের উৎসাহ দিতে।
গার্লিক-নিধনের ছক কষা শুরু হল। সুনীল চ্যাটার্জীর উপর দায়িত্ব দিলেন সাতদা, উপযুক্ত ছেলে খুঁজে বার করার। নির্দেশ স্পষ্ট, অ্যাকশন করতে যাওয়ার সময় শুধু রিভলভার নয়, বিষও থাকবে সঙ্গে। কাজ হাসিলের পর পালাতে পারলে ভাল, না পারলে আত্মহত্যা। ধরা দেওয়া যাবে না, কোনও পরিস্থিতিতেই না।
‘ছেলে’ খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট করতে হল না সুনীলকে। ততদিনে কানাই যোগ দিয়েছে ব্যায়াম সমিতিতে, দীক্ষিত হয়েছে বিপ্লবের মন্ত্রে। সমিতির একঝাঁক তরুণ তুর্কি তখন অ্যাকশনের জন্য মরিয়া। তাত্ত্বিক আলোচনায় তেমন আগ্রহ নেই তাদের, উৎসাহ নেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়। মূলধন বলতে শুধু আবেগ আর সাহস। দেশের জন্য কিছু করতে হবে, তাতে মরতে হলে হবে। এই দলে সকলের মধ্যে সহজেই আলাদা করা যায় কানাইকে। পেটানো চেহারা তার, শরীরচর্চার জন্য ব্যায়াম সমিতিতে হাজিরার প্রয়োজন নেই এমনিতে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধের পর সুনীলদা’র কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, ‘কাজ দেবে না কিছু? কুস্তি-লাঠিখেলা ভাল লাগছে না আর। চান্স দিয়ে দেখোই না একবার অ্যাকশনের, রিভলভার চালানোটা রপ্ত করে ফেলেছি।’
‘চান্স’ এল ১৯৩১–এর জুলাইয়ে। হাজরা রোডে একটি মেসের তিনতলায় একটি ঘর ভাড়া করে রেখেছিলেন সুনীল। কলকাতায় এলে ওখানেই উঠতেন, চলত বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক। বাকি সময় ঘর থাকত তালাবন্ধ। সুনীলের নির্দেশে তাঁর দুই সহযোগী কানাইকে জয়নগর থেকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। সেদিন ২৫ জুলাই। হঠাৎ তলবে কানাই অবাক, কিছুটা উত্তেজিতও। ঘটনাচক্রে কানাইয়ের মা-ও তখন কলকাতায়, বড়ছেলের বাড়িতে উঠেছেন। সুনীলকে প্রশ্নে প্রশ্নে অতিষ্ঠ করে তুললেন কানাই, উত্তরে জুটল মৃদু হাসি আর পিঠ চাপড়ানি, ‘ঠিক সময়ে সব জানতে পারবি। কাল ভোরভোর উঠবি, একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’