- বইয়ের নামঃ সোমেন চন্দর গল্প
- লেখকের নামঃ সোমেন চন্দ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অকল্পিত
একটিমাত্র হলে এত পরিচ্ছদ, এত শাড়ীর বৈচিত্র্য, তবু গুঞ্জন কোলাহল হইয়া ওঠে নাই, আর হয় না। কারণ যে সমাবেশ, যে পরিবেশ—এখানকার বাতাসে যে সুরুচির সৌরভ, জীবনের বিশেষ অভিব্যক্তি।
মিসেস ঘোষ সমুদ্রপারের মেয়ে, আরও অনেক ইংরেজমেয়ের মতোই একটি বাঙালি ছেলেকে বিবাহ করিয়া আজ বছর দশেক হয় কলিকাতায়, অর্থাৎ ভারতবর্ষের আকাশের নীচে। বিদেশি এই বিহঙ্গীর বয়স হইয়াছে কিন্তু চেহারার জৌলুস এতটুকু কমে নাই। বিশেষ করয়ি হাসিটি—বরফের কুচির মতো দাঁতগুলি কী সুন্দর চকচক করিয়া ওঠে! যাই বলো, ঘোষ লোকটি ভাগ্যবান, পত্নী ভাগ্যে ভাগ্যবান। সেই মিসেস ঘোষ আজ এখানে আগত কয়েকটি স্বজাতির সঙ্গে একেবারে মিশিয়া গিয়াছেন। হয়তো মুখের দিকে চাহিয়া লণ্ডনের রাজপথের অনেক তুষারভেজা সকালের কথা, বা গ্রীষ্মকালের সমুদ্রস্নান, তীরবর্তী বালুর আঘ্রাণ, অথবা কলেজবিল্ডিং-এর করিডোরে একদিনের চপলতায় নিঃশঙ্ক আচরণ ও বিচরণের কথা মনে হইতেছে।
বাহিরে মোটরের ভিড় বাড়িয়া চলিয়াছে। শিল্পী জীবানন্দ সেন একা মানুষ, কারের হুশহুশ আর জুতার মচমচ আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এবং ব্যস্ত হইয়া আসেন অভ্যর্থনা করিতে। নিঃসঙ্গতাহেতু এই ভয়, তার চারদিকে দৃষ্টি না দেওয়ার ফলে যদি কোনো সম্ভান্ত অতিথি অভ্যর্থনার উষ্ণতা হইতে বাদ পড়িয়া যান।
এটর্নি অতুল চৌধুরী একটি বন্ধুর ছবি দেখিয়া আশ্চর্য হন, পাশে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, বাঃ চমৎকার। জীবানন্দবাবু শুধু এই ছবিখানা দিয়েই আপনাকে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে অভিহিত করা যায়; সত্যি, চমৎকার! জীবানন্দ মুচকিয়া হাসেন। এটর্নি সাহেবের সময় নাই, তাড়াতাড়ি সারিতে হইবে, চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া পাশে অগ্রসর হন।
আর একটি মেয়ে—যে মেয়েটির আঘ্রাণ পাইয়া নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েরও চোখে তাক লাগিবে, তির্যকদৃষ্টিতে একবার অন্তত সেদিকে চাহিবে সেই মেয়েটিকে অনেকেই জানে, ব্যারিস্টার প্রতুল চক্রবর্তীর কন্যা, অপরূপ রূপবতী (নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েও একথা বলিবে)।
গায়ের রঙ এত ফর্সা যে ঠোঁটের নকল রঙও সৌন্দর্যে তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। মাথার চুল কপালের পাশে ঈষৎ কোঁকড়ান, কালো কুচকুচ। মসৃণ নগ্ন দুই হাতে চুড়ির ভার অল্প, পরনের শাড়িতে আগুন জ্বলে, লাল।
প্রোফেসর সুব্রত রায়ের বয়েস অল্প, ছেলেরা তাহার সঙ্গে ইয়ার্কি দেয়, তাহার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে, এমনকি তাহার ব্যক্তিগত জীবনেও দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়াছে। অবশ্য সুব্রতর সেখানে অসম্মতি ছিল না, সে বলে: কেবল পড়ার সময় পড়া, অন্য সময় আমরা বন্ধুর মতো ব্যবহার যেন করি। কিন্তু ভাগ্যিস এখানে কোনো ছেলেই আসে নাই। তাহার পরনে ছাই রঙের সুট, চুলগুলি ব্যাক-ব্রাশ করা, কতকটা লালচে রং ধরিয়াছে।
তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া বলিল, মিস চক্রবর্তী? পাশে চাহিয়া শকুন্তলা হাসিয়া ফেলিল-আপনি? তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সুব্রত বলিল, ওই দিকটাতে একটা ছবি ছিল, সেটাকে আমার মতে শ্রেষ্ঠ বলা চলে—দেখেছেন? এ্যস্তভাবে কথা বলা শকুন্তলার অভ্যাস। বলিল, আমি তো সব ছবিই দেখেছি, কোনটা বলুন তো?
সে একখানা পোট্রেট। শকুন্তলার গা ঘেঁষিয়া সেই ছবিটার দিকে যাইতে যাইতে সুব্রত বলিল। প্রথমে চারদিকে একবার যথাসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে তাকাইয়া তারপর শকুন্তলা ছবির দিকে দৃষ্টি দিল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ দেখিয়া বলিয়া উঠিল, শ্রেষ্ঠ একে বলা চলে না, রয়, আপনার বিচারকে তারিফ করতে পারিনে।
সুব্রত হাসিয়া বলিল, তাই নাকি? তাহার চোখে চোখ চাহিয়া শকুন্তলা বলিল, ছবিটার দিকে একবার চেয়ে দেখুন, যে অঙ্কন পদ্ধতিতে এই ছবিটা এঁকেছেন, সেই ধরনের অনেকগুলো ছবি তাঁর আছে। এই দেখুন না এটাও। এগুলোই নাকি তাঁর আজকালকার আঁকা—আমার কিন্তু ভালো লাগে না। তবে এখানাকে কিছু সইতে পারি, বেশ ভালোই এটা, কিন্তু তাবলে শ্রেষ্ঠ নয়।
-সেই হিসেবে দেখতে গেলে অবিশ্যি আপনার কথাই ঠিক, হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন…। টানিয়া টানিয়া বলিতে লাগিল সুব্রত। কোন হিসেবে দেখিতে গেলে যে তাহার কথাটা ঠিক, সেটা সে নিজেও জানে না।
তাড়াতাড়ি আর এক পাশে গিয়া আঙুল বাড়াইয়া শকুন্তলা বলিল, দেখুন তো এটা কী, wonderful execution।
অতিরিক্ত হাসিয়া সুব্রত বলিল, wonderfull।
–মিস চক্রবর্তী।
পেছনে ফিরিয়া শকুন্তলা আশ্চর্য হইল, হাত বাড়াইয়া বলিল, good Heavens ! কখন এলেন? মৃদু হাসিয়া পল বলিল, এই তো এখন। আপনি?
—আমিও বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি।
–সব ছবি দেখা হল?
—হ্যাঁ। শকুন্তলা তাহার হাত ধরিয়া বলিল,-চলুন আপনাকে দেখাচ্ছি।
ভয়ানকভাবে সুব্রত ছবি দেখায় মন দিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখদুটি ছবি হইতে সরিয়া সেই ছোকরা সাহেবটি আর শকুন্তলার উপরে গিয়া পড়ে। পল বড়ো সোজাসুজি—দেরি সহিতে পারে না, সম্মুখের ছবির বিষয়ে শকুন্তলার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়াই বলিয়া ফেলিল: মিস চক্রবর্তী, আপানাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।
হাসিয়া শকুন্তলা বলিল, Thank you.
হলের মাঝখানে দাঁড়াইয়া একদল গল্প করিতেছে। অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট অবনী সিংহ এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের পরিচয় করাইয়া দিতেছিলেন, ছেলেটির গায়ে এখনও বিলাতের গন্ধ তীব্র। সিংহ-কন্যা সেই গন্ধই শুকিতে লাগিল। নিজেও তিনি কয়েক বছর আগে তাঁহার বাবার সঙ্গে বিলাতে গিয়াছিল। সে-কথাও জানাইতে ভুলিল না। অবনী সিংহ নিজে আর এক পাশে সরিয়া মিশনারি উইলিয়ামসনের সঙ্গে আলাপ আরম্ভ করিলেন। বাহিরে এখনও একটু আলো আছে বটে, ভিতরে অন্ধকার। তাই সবগুলি আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। সেই আলোতে মেয়েদের শাড়ী ঝলমল। মুখে স্নিগ্ধতা। মসৃণ মেঝেতে জুতার মৃদু আওয়াজ, কথার গুঞ্জনে কতকটা চাপা পড়িয়াছে।
জীবানন্দ জানিতেন, ইহাদের বেশিরভাগই ছবি কিনিবেন না, ইহাদের অনেকেই ঠিক সমঝদার নন, এবং-জীবানন্দ আরও কিছু হয়তো জানিতেন কিন্তু তবুও আশা! যাই বলল, এমন সমাবেশ আর কোনোবারই হয় নাই। না, না, তাঁহাদের সম্বন্ধে অভিযোগ করা মিথ্যা।
আবার কে আসিলেন?
সকলে বাহিরের দিকে তাকাইল। জীবানন্দ অগ্রসর হইলেন। বাইরে হাসি, কথা—আর জুতার শব্দ। ক্রমেই স্পষ্ট হইতেছে।
তাহারা কয়েকটি ছেলে ও মেয়ে-বাইশ তেইশ হইতে তিরিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পরনে কারোর সুট, কারুর সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। তাহাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটি কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। একেক জন উজ্জ্বল হাসিয়া, জোরে কথা বলিয়া স্বাস্থ্যের প্রসন্নতায় এখান হইতে সেখানে ঘুরিয়া ছবির পর ছবি দেখিয়া চলিল।
সকলে বিরক্ত হইল। মিসেস গুপ্ত আজকালকার ছেলেমেয়েদের—বিশেষত ওই নবাগত দলটির মধ্যে ফর্মালিটির নিতান্ত অভাব দেখিয়া নাক সিঁটকাইলেন। কী বিশ্রী। সাধারণ এটিকেটও কী ইহাদের জানা নাই?
এটর্নি অতুল সরকার নিজের মেয়ের দিকে হইতে এমন কোনো দোষ নাই ভাবিয়া মনে মনে আশ্বস্ত হইলেন। আর কী চেঁচামেচি? তাহাদের দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে চাহিয়া শকুন্তলা কথা বলিতে লাগিল। পেছনে চুলে হাত দিয়ে অবনী সিংহের মেয়ে ভাবিলেন : আহা মেয়েগুলির চেহারার যা ছিরি! তেমনি কাপড় আর জামা। যেন এইমাত্র কোথা হইতে যুদ্ধ করিয়া আসিল! বুকের উপরে আঁচল টানিবার সাধারণ স্টাইলটুকুও কী উহাদের জানা নাই? ওরকম পাড়ের আর রঙের কাপড় আর আজকাল চলে না, যাই বলো।
জীবানন্দও দারুণ বিরক্ত হইয়া এদিকে আসিয়া যোগ দিলেন।
বেগনী রঙের শাড়ি-পরিহিতা একজোড়া তীক্ষ্ণ ভ্র-বিশিষ্ট শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে প্রায় চীৎকার করিয়া উঠিয়াছেঃ আয়ার? আরার?
একপাশে দাঁড়াইয়া আরও কয়েকটির সঙ্গে মিলিয়া আরার একটা ছবি দেখিতেছিল, ডাক শুনিয়া ইংরাজিতে বলিল, কেন?
হাত দিয়া কাছে আসিতে ইঙ্গিত করিল মেয়েটি। কিন্তু উত্তর দিয়া আর আয়ার সেদিকে তাকায় নাই, নিজ মনে ছবি দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি তাহার কাছে আসিয়া বলিল
–Am I to shout your name this whole evening comrade ?,outs হাসিয়া ফেলিল, বলিল, এ-তো তোমাদেরই দেশ কমরেড। তোমরা তো ঘরের লোক, আমরা তোমাদের অতিথি।
মেয়েটি বলিল come, come, কিন্তু ওধারে তোমাকে একটি জিনিস দেখাবার আছে, চলো৷ ভাসা, ভাসা, সুন্দর চক্ষুবিশিষ্ট আরেকটি মেয়ে কাছে আসিয়া বলিল, লাবণ্য কেমন লাগছে?
লাবণ্য আর এক দিকে যাইতে যাইতে বলিল,-এখনও বলতে পারিনে।
-–তার মানে? কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ফর্সা মেয়েটি হাসিয়া ফেলিল।
নির্মল আসিয়া বলিল, মিস, সীতা, আপনার দেখা হয়েছে?
—মোটেই না।
–কমরেড আয়ার এসব দেখে খুশি হচ্ছে নিশ্চয়ই।
–তাই মনে হল।
—আর, দেশাই?
—ওই তো-সীতা আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল।
দেখা গেল, দেশাই ভয়ানক নত হইয়া গভীরভাবে কী একখানা ছবি দেখিতেছে।
নির্মল তাহার উপরে গিয়া পড়িল, হ্যালো, কমরেড দেশাই, Youve found something, I see?
মিসেস গুপ্তা যেন আর এখানে থাকিতে না পারিয়াই স্বামীকে লইয়া মোটরে উঠিলেন।
লাবণ্য আবার আর এক গোলমাল বাধাইয়াছে। জীবানন্দর কাছে গিয়া বলিল, আপনিই জীবানন্দবাবু?
বিরক্তি চাপিয়া তিনি বলিলেন, হ্যাঁ।
–একটু এদিকে আসুন। পরিত্যক্ত একখানা ছবির কাছে গিয়া লাবণ্য বলিল Loneliness বলে এই যে ছবিখানা, এতে ল্যাণ্ডসকেপ নেই কেন।
জীবানন্দর বলিতে ইচ্ছা হইল, ফুটপাথের ধারে ল্যাণ্ডসকেপের অনেক ছবিই পাওয়া যায়, সেগুলি কিনলেই তো হয়।
লাবণ্য বলিল, কিন্তু তার আগে বলে রাখি, আপনার ছবি সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান নেই, বুঝিনে। তবে আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন, আপনার আরও আঁকা ছবি সম্বন্ধেও বুঝিয়ে বলুন। আমি জানি, তাতে আমার মনে হয়তো একটা নূতন রুচি জন্মাবে, যাতে আপনার ছবি আমার খুব ভালো লাগবে। বিশ্বেস হচ্ছে না? নতুন একটা টেস্ট জন্মানো বুঝি অসম্ভব? কখনো নয়। তাহলে একটা ব্যাপার বলি শুনুন। ছেলেবেলা থেকেই আমি পুঁই চচ্চড়ি–
পুঁই চচ্চড়ি? এই আন্তর্জাতিক আবহাওয়ায় পুঁই চচ্চড়ির নাম শুনিয়া জীবানন্দ সভয়ে একবার চারিদিকে চাহিলেন।
লাবণ্য বলিল, হ্যাঁ। ওটা আমি কখনো দেখতে পারিনে, গন্ধ পর্যন্ত শুকতে পারিনে, অথচ সকলের মুখে তার কত নাম শুনেছি; শুনেছি, খেতে নাকি চমৎকার—এসব দেখে আশ্চর্য হয়েছি, ভেবেছি, তাহলে আমার কী হল। কিন্তু আপনিও আশ্চর্য হবেন, আজ আমি পুঁই চচ্চড়ি ভালোবাসি, ভালো জিনিসের প্রতি মানুষের রুচিও তেমনিভাবে জন্মায়, যদি দুর্ভাগ্যবশত তেমন জিনিস তার কোনোদিন ভালো না লাগে। পুঁই চচ্চড়ির ইতিহাস অবশেষে লাবণ্য শেষ, করিল, আপনার ছবিও আমার তেমনি ভালো লাগবে আপনি বুঝিয়ে বলুন। এই ছবিতে ওই লোকটির নিঃসঙ্গতাকে ফুটিয়ে তুলতে ল্যাণ্ডসকেপের দরকার ছিল বলে মনে হয় না? লাবণ্য আগ্রহভরা চোখে কতকটা বিজ্ঞের মতো শিল্পীর দিকে চাহিল।
অসহ্য! সহিতে না পারিয়াও অতিকষ্টে জীবানন্দ মনের বিরক্তি চাপিলেন। বলিলেন, ল্যাণ্ডসকেপ ছাড়াই কি ওতে একটা Loneliness ফুটে ওঠেনি!
—হ্যাঁ, তা ফুটে উঠেছে অবিশ্যি।
—তাহলে? যে জিনিসটির কথা আপনি বলেছেন, সেটা আপনার—শুধু আপনার কেন, সকলের কল্পনায় জন্ম নিক, আমার আঁকার বিষয় নয়, আমি ওই পর্যন্ত এঁকে বোঝাতে পেরেছি, ওখানেই শেষ করেছি, ওই ছবি উপলব্ধি করার পক্ষে আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।
আশ্চর্য হইয়া লাবণ্য একবার শিল্পীর দিকে, একবার ছবির দিকে চাহিল।
—যদি আপনার এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র জ্ঞান থেকে থাকে তবে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন প্রেজেন্টেশনের ওই টেকনিকই আমার আবিষ্কারের কৃতিত্ব।
ব্যাপার দেখিয়া পূর্বাগতদের যে নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাঁহারা যেন কোণঠাসা হইয়া পড়িয়াছেন। বয়স্করা যথাসম্ভব স্বাভাবিক ও সহজ হইয়া ছবি দেখিতে লাগিলেন। বয়স যাদের অল্প, শকুন্তলা ও অন্যান্য মেয়েরা, আড়চোখে চাহিয়া সব দেখিয়া দেখিয়া চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
পল চলিয়া গিয়াছে। সুব্রত হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল, সামনের ছবিটি তার চোখে অপূর্ব হইয়া উঠিল, নত হইয়া খুব ভালো করিয়া সেটা দেখিয়া সে আবার চারিদিকে চাহিল। একটু পরে স্বাভাবিকভাবে কতকটা অগ্রসর হইয়া দেখিল, ইতিমধ্যে আর একজন কার অত্যন্ত গা ঘেঁয়িয়া শকুন্তলা কথা বলিতেছে।
-Aweful, aweful! সেক্সপিরিয়ান নায়কের মতো আরও কাছে গিয়া বলা হইল না যে—অথবা কানের কাছে মুখ দিয়া বিনা আড়ম্বরে এবং স্বাভাবিকভাবে মিস চক্রবর্তী, ছবি দেখা হল?—ইহাও বলা হইল না। চুলোয় যাক! নিজের উপর অনেক অভিমান করিয়াই সুব্রত একথা বলিতে বাধ্য হইল এবং কাছেই একটি বয়স্কা, ছিপছিপে অত্যন্ত লম্বা, ছুঁচলো মুখের, শাড়ী-পরিহিতা শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখিয়া তাহার কানে কানে না হোক, সামনেই একটু ঝুঁকিয়া সুব্রত বলিল,
— Have you finished, Madam?
–No. Thank you.
অনেকক্ষণ পরে যখন প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছে, সেই দলটি কেবল তখন একটা মস্ত বড়ো ছবির সামনে জটলা করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
জীবানন্দ মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছেন, দুই একটি সস্তা ছবি ছাড়া আর বিক্রি হইল না। আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নাই। তার উপর এই মেয়ে আর ছেলেগুলির যন্ত্রণা। তাঁহার সব রাগ যেন উহাদের উপর গিয়া পড়িল।
বড়ো ছবিখানার নাম Mass.
সীতা বলিল, কী সুন্দর!
দেশাই অত্যন্ত খুশি হইয়া সায় দিল।
লাবণ্যের চোখেও বিস্ময়।
নির্মল বলিল, দেখেছেন, কমরেড ঘোষ, মাস-এর কী চমৎকার রূপ ফুটে উঠেছে এই একখানা ছবিতে। এরা পথ চলতে পারে না, এদের দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই, এদের দৃষ্টি নিষ্প্রভ, অথচ এরা জীবনের জীবন, মহাপ্রাণের মূল উৎস, মুষ্টিমেয় মানুষের অসম্ভব বিলাসের উপকরণ জোগায় এরাই! কী আশ্চর্য দেখুন, একখানা ছবিতেই আমাদের কত কথা মনে পড়ে গেল, আমরা অনুভব করলাম (এ কথায় সবচেয়ে আশ্চর্য হইল লাবণ্য, কারণ এই কথাটি জীবানন্দ তাহার কাছেই প্রথম বলিয়াছেন)। কমরেড সীতা, এই একটি ছবি দেখেই আপনার নিশ্চয় মনে হয় আমাদের চারিদিকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহরণ, খাদ্যের অভাবে, শিক্ষার অভাবে কুৎসিত ব্যায়রামের ছড়াছড়ি, মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস, কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ, তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ। কমরেড দেশাই, এত কথা যাঁর ছবি দেখে আমাদের মনে হয়, তাঁর উদ্দেশে নমস্কার জানাই।—তাহার কণ্ঠস্বর এক অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরিয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল।
সকলেই স্তব্ধ, ছবিতে নিবদ্ধ দৃষ্টি।
একটু পরে একজন বলিল, Let us buy this picture.
লাবণ্য তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত উৎসাহে বলিয়া উঠিল : আমি সায় দিচ্ছি। আরও সকলের সায় দেওয়ার উৎসাহে সারা হলটি আবার কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। জীবানন্দ মুখ তুলিয়া চাহিলেন, রাগে দৃষ্টি তাঁহার তীব্র হইয়া উঠিল।
দেশাই বলিল, ছবিটার দাম কত?
–তিনশো।
নির্মল মুখে মুখে হিসাব করিল আমরা পনেরো জন প্রত্যেকে কুড়ি টাকা করে দিলেই হবে। রাজি?
–রাজি।
লাবণ্য দৌড়াইয়া গেল জীবানন্দর কাছে, তাঁহার হাত ধরিয়া আদরের ভঙ্গিতে বলিল, আমরা অত কষ্ট করে একা একা সব দেখে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে চুপ করে বসে আছেন। জানেন আপনার অঙ্কন-পদ্ধতি আমি বুঝতে পেরেছি। তাই তো অত ভালো লাগল। না, না, এখানে বসে থাকলে চলবে না, আপনি চলুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। জানেন, আপনার মাস ছবিখানা আমরা কিনব! চলুন, লাবণ্যের দুই চোখে হাসি।
জীবানন্দ আশ্চর্য হইলেন, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অভিভূতের মতো সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, কাছে গেলে সকলে শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে তাঁহার দিকে চাহিল, দুই হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। লাবণ্য কিন্তু হাসিমুখে জীবানন্দর একটি ভারী হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যেন তাঁহার অতি আপনার কোনো আত্মীয়! তারপর যখন তাহারা সকলে শিশু-সুলভ হাস্য কোলাহলে চারিদিক ভরিয়া চলিয়া গেল, জীবানন্দ তখনও বিস্ময়ে তাহাদের দীপ্তি গতিপথের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কোনো এক সময় সেই বিস্ময়ের ভাব কাটিলে জীবানন্দ ফিরিয়া সেই ছবিখানার দিকে তাকাইলেন, আজ এই মুহূর্তেই নিজের সৃষ্টিরও অত বড়ো রহস্য তাঁহার কাছে দুৰ্ব্বোধ্য হইয়া উঠিল যেন!
অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন
সতীশ ওঠেনি, শিবু ওঠেনি, মনুর মা ওঠেনি, এমনকী সূর্যও আকাশে দেখা দেয়নি, তার শুধু আলো পৌঁছেছে পৃথিবীতে।
কিন্তু শ্রীবিলাস উঠেছে।
বিছানা থেকে উঠেই প্রথমে খুঁজল লাঠি,—এটা ছাড়া সে চলতে পারে না, তার অন্ধত্বকে সে কতকটা উপহাস করে ওই লাঠির সাহায্য নিয়ে। ওই লাঠি তার মস্ত বড়ো সাথি। খুঁজতে খুঁজতে সাথিকে সে খুঁজে পেলোও, তার ডগাটি একবার ডানপাশে, একবার বাঁ-পাশে ফেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল এবং আন্দাজে দিক ঠিক করে করযোড়ে সূর্যকে প্রণাম করল।
ঘরের ভিতর তার স্ত্রী বিন্দু দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, ভোরের বাতাসের ছোঁয়ায় বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।
লাঠিটা একপাশে রেখে শ্রীবিলাস দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে পড়ল। একটু বসে থেকে ডাকতে লাগল, ও বউ, বউ? ওরে কেলো, ওরে হেবো, ওঠ বাবা ওঠ, আর কত ঘুমুবি বল, রোদুর উঠে গেছে যে, ও মা সদু–
অনেক ডাকাডাকিতে বিন্দুর ঘুম ভাঙল, বললে, রাত না পোয়াতে কী আরম্ভ করেছ শুনি?
শ্রীবিলাস বললে, এখনও কি তোমার রাত রয়েছে? কত লোক উঠে গেছে। আমি কতক্ষণ ধরে উঠে বসে আছি।
ছেলেপিলেগুলো ওঠেনি, বিন্দু বাইরে এসে ধপ করে মেঝের উপর বসে চোখ রগড়াল, গা মোড়ামুড়ি দিল, হাই তুলল, তারপর স্থির হয়ে বলল, এই তো এখন উঠলে, আমি বুঝি দেখিনি? কত লোক উঠেছে। একটিকেও তো দেখছিনে বাপু!
—তাতে কী হয়েছে, সকলে পাগল হলে কি তুমিও পাগল হবে বউ?
বিন্দু কি একটা কাজে ভেতরে গেল, যেতে যেতে বললে, আমি বলছি, কেন মিথ্যে কথা? সারারাত যে গরম গেছে, ঘুম একরকম হতেই চায় না, তার ওপর–
—মিথ্যে কথা? শ্রীবিলাস জোরে বললে, আমি মিথুক আর তুমি খুব সত্যবতী না? দেখবে, সকলে উঠেছে কি না? দেখবে দেখবে?
—দেখব, বিন্দু নিঃশব্দে হাসল।
–ওরে সতে, ওগগা শিবনাথ, ও মনুর মা,—কিছুক্ষণ এমনি নিষ্ফল ডেকে হতাশ হয়ে শ্রীবিলাস বললে, আর মেয়েমানুষের অত ঘুমই বা কেন!
-মেয়েমানুষের ঘুমেই চোখ টাটায়, না! বুঝি ঘুম শুধু পুরুষের? শ্রীবিলাস রেগে কী বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ঘরের পাশে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।
—ও দাদা, কি করছ?
–কে, বীরু?
-হ্যাঁ।
-এই তো দাদা বসে আছি একা, যাব একা, শ্রীবিলাস যেন এক মুহূর্তে বদলে গেল, বললে, কিছু সঙ্গে যাবে না, কেউ সঙ্গে যাবে না, স্ত্রী নয়, পুত্র নয়, ভাই নয়, বোন নয়, ধন-দৌলত নয়—শ্রীবিলাস গুনগুন করে পরলোকতত্ত্ব বিষয়ক একটা গান ধরলে, তারপর থেমে বীরুর দিকে তাকিয়ে বললে—বাঁশি বেজেছে। কারখানায় চললে এত সকালে?
বীরু বললে, ঠিক এসময়ই তো রোজ আমি যাই দাদা।
—রোজই এসময় যাও? তা হবে, শ্রীবিলাস বললে, ঘড়ি তো নেই যে সময় ঠিক রাখব, কি বল বীরু?
এই একটু আগেই এই নিয়েই স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছিল।
—কিন্তু আছে মন, আছে তাতে কাঁটা, মিনিটের নয় কিন্তু ঘণ্টার কাঁটা। তাই ঠিক করে বলতে পারিনে ছ-টা বেজে ক-মিনিট হয়েছে, কিন্তু এটা বলতে পারি যে ছ-টা বেজেছে, কি বল?
শ্রীবিলাস হাসল, বললে, ওই যে কথায় বলে মন না গতি–
বিন্দু আবার বাইরেই এসে দাঁড়িয়েছিল, বললে, আমাদের বীরু এখন একটা বিয়ে থা করুক, ঘরদোর কে দেখে বল? তা ছাড়া, অসুখ-বিসুখও তো আছে? করো ভাই করো, আমরা একটা নেমন্তন্ন খাই।
বীরু যেন লজ্জা পেল।
শ্রীবিলাস হেসে বললে, ওই তো মেয়েমানুষের দোষ, কেবল বিয়ে থা করো! আরে, বিয়ে তো করবে, খেতে দেবে কী? তারপর ছেলেপিলে হলে!
তার কথা শুনে বিন্দুর খিলখিল করে হাসতে বা ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কে কাকে বলে ? কিন্তু সে তা করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রীবিলাস বললে, তাই অল্প মাইনে, দুজনের পেট কী করে চলবে এতে? হ্যাঁ বীরু, তোমার না মাইনে বাড়বার কথা ছিল?
—ছিল, কিন্তু বাড়াচ্ছে না তো?
–বাড়াচ্ছে না? কথা দিয়েও!
–তাইতো দেখা যাচ্ছে।
—কি বলো, এত অন্যায়? কথা দিয়ে কথা-না-রাখার মতো পাপ আর আছে? বাইবেরটা দেখে মনে হয় শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে উঠেছে, পরক্ষণেই বেড়ালের মতো ঠাণ্ডা হয়ে বললে, ভগবান করুন, দিনে দিনে যেন তোমার উন্নতি হয়।
—আমি যাই?
—এসো ভাই।
কাছেই বিন্দুর নিঃশব্দ উপস্থিতি টের না পেয়ে শ্রীবিলাস জোরে ডাকতে লাগল, বউ, ও বউ–
-কী?
এখনও দাঁড়িয়ে আছ? কাল যে বললে, আজ তোমাকে খুব সকালে যেতে হবে, বাবুদের বাড়ির ছেলের ভাত! যাও তাড়াতাড়ি। আবার যদি রেগে-টেগে যায় তাহলে কি করবে বল? যাও শিগগির।
-যাই।
—আর দ্যাখো, ঘরে কোনো খাবার নেই, কিন্তু ছেলেপিলেগুলো খাবে একটা কিছু, দুটো পয়সা যদি থাকে রেখে যেয়ো না হয়, দু-পয়সার মুড়ি কি চিড়ে কিনে এনে খাবেখন।
-হুকুম করবার বেলায় তো খুবই মজা, আর পয়সা নেবার বেলায় কেবল গৌরী সেন! আঁচলে বাঁধা ছিল পয়সা, বিন্দু তা বার করে মেঝের ওপর ঝনাৎ করে ফেলে চলে গেল। শ্রীবিলাস হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে আপন মনে বললে, আমার হাতের ওপর দিয়ে গেলে কি দোষটা হত শুনি? এখন পয়সা দুটো আমি কী করে পাই? কোথায় না কোথায় গড়িয়ে চলে গেছে কে জানে? লোকে বলে, টাকা-পয়সার হাত-পা আছে।
ছেলেপুলেদের মধ্যে কেলো সকলের বড়ো।
শ্রীবিলাস ডাকলো, ওরে কেলো—
কাছেই কোথায় সে খেলছিল, দৌড়ে এসে বললে, কী বাবা?
-তোদের খুব খিদে পেয়েছে না রে?
–পেয়েছে।
–খুব?
—হ্যাঁ বাবা, খুব।
—হেবো, সদু, ওরা কোথায়?
—ওই তো, আমি যেখানে খেলছিলাম সেখানেই তো খেলছে। সদুটা পিট পিট করে কাঁদছেই কেবল, বলে, খিদে পেয়েছে দাদা। কেলোটা অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলে ফেলল।
—আর হেবো, ওটাও কাঁদছে?
—হুঁ, কেলো বললে, ভয়ানক কাঁদছে।
–কই আমি তো শুনতে পাইনি?
–পাবে কি গো! কতক্ষণ আর কাঁদবে? দিলাম এক চড়, বললাম, মা এলে খাবি ছোঁড়া। তারপরই তো ফট করে চুপ করে গেল।
-চড় দিলি! শ্রীবিলাস তার লাঠিটা হাতে তুলে নিল, সেটা দিয়ে মেঝের ওপর এক শব্দ করে বললে, কেন চড় দিলি বল, নইলে আজ তোকে–
যে এত মিথ্যে কথা বলতে জানে, সে তার সাফাই গাইতেও জানে, বিশেষভাবে তার কাছে—যে ব্যক্তি চোখে কিছুই দেখতে পায় না।
কেলো বললে, খুব জোরে নয় বাবা। আমি কেন জোরে মারব ওকে বলো! এই এরকম আস্তে করে—সে শ্রীবিলাসের গায়ে আস্তে মৃদু একটা আঘাত করে বললে, হাতটা কেবল একটু লাগিয়েছিলাম, আর অমনি কেঁদে ফেলল ভ্যাঁ করে। এমন ছিচকাঁদুনে আর কখনও দেখিনি, বাপরে।
শ্রীবিলাস আবার শান্ত হল। মাটির ওপর একপাশে লাঠিটা রেখে, আঁচলের গিট খুলে পয়সা দুটো বার করল, বললে, শিরীষ দোকানির কাছে যা, মুড়ি নিয়ে আয়। দু-পয়সার, বুঝলি?
-আচ্ছা।
শ্রীবিলাস কেলোর হাতে পয়সা দিয়ে বললে, মুড়ির সাথে একটু তেল আর নুনও চেয়ে নিস বাবা, ভুলিসনি যেন, বুঝলি?
কেলো কি আর সেখানে রয়েছে, পয়সা পেয়ে তক্ষুনি দৌড়ে পালিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে–
আসতে দেরি দেখে শ্রীবিলাস ডাকল ছেলেটাকে, কেলো—
ঘরের পূর্বদিকের দরজার সামনেই একটা ভাঙা উঠোন ছিল, সেখানে বসে ওরা খাচ্ছিল। শ্রীবিলাস ছিল এপারের বারান্দায়, টের পায়নি।
—কেলো!
উত্তর এল, কী বাবা?
—খেলি?
–বাবা।
–হেবো আর সদু, ওরা?
—ওরাও তো খাচ্ছে, কিরে হেবো, খাচ্ছিস না তুই আমার সঙ্গে? কেলো ফিসফিস করে হেবোকে বললে, বলনা, চেঁচিয়ে বল।
হেবো চেঁচিয়ে বললে, হুঁ, আমি খাচ্ছি।
শ্রীবিলাস লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের দরজা পেরিয়ে বললে, সবই খেলি?
—সবই তো বাবা।
শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যেতে যেতে বললে, একটুও রাখিসনি?
—হুঁ, সে তো আছেই বাবা, এই একেবারে তলায়, এই আধমুঠোও হবে না। শ্রীবিলাস দাঁত-মুখ খিচিয়ে বললে, পাজি ছেলে, সবই খেয়ে ফেললি? বয়েস আমাদের বেশি হয়েছে বলে বুঝি খিদে পেতে নেই মোটেই? শয়তান ছেলে, হতচ্ছাড়া, তোর হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলব আমি–
কেলো ভয়ে দৌড়ে পালাল।
-বউ এলে পর বলব, এরকম ছেলে পিঠমোড়া করে বেঁধে চাবুক লাগানো। দরকার, শুধু নিজের খাওয়া, সাতদিন না খাইয়ে রাখলে তবে ঠিক হয়—হবে না এমন, কেবল ছোটোলোকদের সঙ্গে মিশলে এরকম হয়ই। বউকে কত বলেছি, না ওর কেবল টাকা আর টাকা! আরে বাপু, ইদিকে যে ছেলেপিলেগুলো অমানুষ হয়ে গেল তা চোখে পড়ছে? আবার কোথায় গেল ওটা?
শ্রীবিলাস দরজায়, চৌকাঠে, দেওয়ালে কয়েকবার খুব করে লাঠির আঘাত করে বললে, ছেলেটা কোথায় গেল?
হেবো আর সদু কাছেই ছিল, বাপের রাগ দেখে ভয়ে এতক্ষণ কিছু বলেনি, এখন কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললে, দাদা পালিয়েছে বাবা।
—পালিয়েছে বাবা! ন্যাকামি! যা আমার সুমুখ থেকে, যা বলছি, নইলে মার খেয়ে মরবি বলে দিলাম।
হেবোটা সত্যিই ছিচকাঁদুনে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে।
শ্রীবিলাস বললে, আবার কাঁদছিস কেন?
—দুমুঠো করে আমাদের দিয়ে দাদা আর সবই নিজে খেয়েছে বাবা।
নিজে খেয়েছে! রাগে শ্রীবিলাসের চোখ ফেটে জল আসে আর কি! সবই নিজে খেয়েছে, আর আমরা বুঝি ভেসে এসেছি। দাঁড়া তো আসুক!
শ্রীবিলাস গুম হয়ে বসে রইল।
প্রায় এগারোটা অবধি বসে বসেই কেটে গেল। কাজই বা কী? অন্ধের আবার কী কাজ?
কিন্তু শ্রীবিলাসের কাজ আছে, সে দিনরাত কেবল বকে, বারান্দায় আর ঘরে আসা-যাওয়া করে, ছেলেপিলেগুলোকে নিষ্ফল শাসন করে, আরও কত কী করে?
বিন্দুর আসতে দেরি হচ্ছিল, আজকে বেশি কাজ, উৎসব-আয়োজনে রোজকার চেয়ে একটু দেরি হবেই তো।
বেলা বারোটা বাজল।
ছোটোছেলেদের এমনি একটা স্বভাব, যেমন ভুলে থাকতে পারে খুব, তেমনি অনেক সময় যার জন্যে একবার ঝোঁক চাপল তার জন্যে একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠে।
কেলো ওরাও ক্ষিদে ভুলে তখনও কোথায় খেলছিল।
শ্রীবিলাস নিজেই অস্থির হয়ে উঠল।
চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দু-একটা কাকের ডাক।
পাশের ঘরে থাকে সতীশ। এক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে কাজ করে। বিয়ে করেছে। বেশিদিন হয়নি, এখনও সন্তান হয়নি।
শ্রীবিলাস বললে, ও সতীশ, গলার আওয়াজ যে পাচ্ছি, কাকে কী বলছ? কী হয়েছে?
ওপাশ থেকে জবাবা এল, এই তো দাদা, একটা কাচের গ্লাস গেল ভেঙে। গ্লাসটা ভালো দাম দিয়ে কিনেছিলাম এই ভেবে যে অতিথি মানুষ-টানুষ এলে পর জল দেওয়া যাবে—তাও আবার ভেঙে গেল। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের এমন হলে কি চলে, বলুন?
-কে ভাঙলে?
-ভাঙবে আবার কে? এই হল কি–
ওদিকে দেওয়ালের ওপাশে সতীশের বউ তাকে চুপিচুপি বলছে, বাইরে থেকে ভয়ানক তেষ্টা নিয়ে এসে আমায় বললে, বউ, দাও এক গ্লাস জল, সেই গ্লাসটি করে। দারুণ তেষ্টা পেয়েছে আমার। আনলুম জলের বদলে সরবৎ করে, এসে দেখি তুমি হাসছো, হাত থেকে সরবৎ তো নিলে না, নিলে আমাকে, গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল, আমি কী করব বল? আমার কী দোষ? আবার হাসছে, আরে, আরে, দ্যাখো, অত ফাজলামি কোরো না। দেবো মুখের ভিতর এই ভাঙা কাচ ফুটিয়ে–
এদিকে আবার শ্রীবিলাস সতীশের দিক থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে বললে, সতীশ, ও সতীশ–
—কী?
–ক-টা বাজল বলতে পার?
–একটা হবে আর কি! কেন জিজ্ঞেস করছেন?
শ্রী বিলাস বিনা আয়াসে বলে ফেলল, ওই দ্যাখো, আমিও কিন্তু ওইরকমই আন্দাজ করেছিলুম। ঠিক হল দেখছি। এখন আমি প্রায়ই পরীক্ষা করে দেখি, কি জানো, ঠিক হয়। কম আশ্চর্যের কথা নয়, কি বল?
-হ্যাঁ। আমি চান করতে চললুম দাদা।
—ওকি, এখনও খাওনি? হা ভগবান! এমন করলে কি শরীর থাকবে? এই অবেলায় খেয়ে জোয়ান বয়সেই না হয় কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে চলতে পারো, কিন্তু বুড়ো বয়সে এর জন্যে ভুগতে হবে বাপু। যাও তাড়াতাড়ি যাও–
অন্যের কাছে খুব ভালো মানুষ সেজে শ্রীবিলাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
একটু পরেই বিন্দু এল, সঙ্গে কেলো আর হেবো। সদু ঘরে ঘুমিয়েছিল।
হাত থেকে সব নামিয়ে বললে, ছেলেগুলো এমন দুষ্টু দ্যাখো, আবার বাবুদের বাসায় গেছে। কী সাহস! কতদিন মানা করলাম তবু—সেই ন্যাংটা দিগম্বর সেজে গিয়ে উপস্থিত।
শ্রীবিলাস বললে, কোনোদিন গাড়িঘোড়ার তলে পড়ে খুন হবে।
—হবেই তো।
শ্রীবিলাস বললে, আর যাসনে কিন্তু। তারপর, বউ, কেমন খাওয়া-দাওয়া হল?
–খুব ভালো। আমরা তিনজনেই পেট পুরে খেয়ে এসেছি।
–আর?
–আর এনিছিও তোমার জন্যে।
—তাহলে এবেলা আর রাঁধতে হবে না বল, শ্রীবিলাস কাছে এগিয়ে বললে, বসব?
–চান করেছ?
–সেই কখন।
–আচ্ছা দাঁড়াও, পিঁড়ি পেতে দিই।
শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি বললে, না থাক থাক, আমি মাটির ওপর বসতে পারব। বিন্দু তাকে খেতে দিতে দিতে বললে, আজ আর ভাত, ডাল, মাছ নয়, পুরনোয় মুখ বিষিয়ে উঠেছে। আজ পাকা লুচি, মাংস, দই, সন্দেশ।
শ্রীবিলাস হঠাৎ একমুখ হেসে উঠল।
–হাসছ যে?
–এমনি গো, এমনি।
–এমনি কেউ হাসে?
–বউ, আমি হাসি।
খেতে খেতে হঠাৎ একবার শ্রীবিলাসের গলায় ঠেকল।
বিন্দু তাড়াতাড়ি বললে, আহা, অত তাড়াতাড়ি খাচ্ছ কেন?
খাওয়া-দাওয়ার পর একটা পান চিবোতে চিবোতে শ্রীবিলাস বললে, সেই কড়িগুলো কোথায় গো বউ, সেই যে কিনেছিলে, না কোত্থেকে এনেছিলে?
—আছে বুঝি কোনোখানে, কেন?
–এসো না একটু খেলি?
বিন্দু বললে, না আমার ঘুম পেয়েছে। সারারাত একরকম ঘুমুইনি। আর তুমিই বা খেলবে কীগো, আমি যদি মিথ্যে চাল দিই?
-না, না, আমি খেলব, তুমি আনো।
বিন্দু একটা ছেড়া পাটি পেতে তার ওপর একটা বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল।
শ্রীবিলাস বললে, তাহলে আমি কী করব, ঠায় বসে থাকব?
—রোজ যা করো তাই করো। ঘুমোও, কিছু পেতে দেব?
–দাও।
শ্রীবিলাস যখন ঘুম থেকে উঠল, বিন্দু তখন অনেকক্ষণ কাজে চলে গেছে। সন্ধ্যার আর বেশি বাকি নেই।
শ্রীবিলাস সদুকে বললে তাকে কলতলায় নিয়ে যেতে।
সদু তিন বছরের মেয়ে, কিন্তু কথা বলে পাকা-পাকা। সে তার বাবার হাতের লাঠি ধরে তাকে কলের পারে দিয়ে এল।
অতগুলো গরিব পরিবারের জন্যে একটিমাত্র কল, তা-ও সারাদিন জল পড়ে যায়।
শ্রীবিলাস হাত-মুখ ধুতে এসেছিল। তাকে দেখে একজন কল ছেড়ে দিলে। সে হাত-মুখ ধুয়ে আবার ফিরে ঘরে এসে বসল।
সকলে যে যার কাজ থেকে ফিরছে।
আর শ্রীবিলাস তার ঘরের সামনেকার বারান্দায় বসে আছে চুপ করে। অনুভব করছে মানুষের পদচারণা, কথা বলা। এমনি সে রোজই বসে থাকে একা।
তার চোখের রং ধূসর, মাঝে মাঝে জল পড়ে, মাথার চুলগুলো খুব ছোটো করে ছাঁটা। পা-দুটো এক করে হাঁটুর ওপর এক হাত রেখে, তার ওপর মুখটি স্থাপন করে সে বসে থাকে। এই সময় কেউ সেধে কথা বললে উত্তর দেয় খুব। বিনীতভাবে কিন্তু অতি সংক্ষেপে।
রাত নটার সময় বিন্দু এল। আজ সে একটু সকালেই এসেছে। ছেলেরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু শ্ৰীবিলাস জেগে আছে। বিন্দু জিজ্ঞেস করলে, ওরা সব খেয়েছে?
হ্যাঁ। তুমি তো রেখে গেছলেই খাবার। কিন্তু বউ, আজ তুমি সকালে এসেছ বলে মনে হয়।
বিন্দু বললে, হুঁ। ছুটি দিয়ে দিলে। ওদের বাড়িতে আজ মেয়েরা নাচবে গাইবে। তারপর মেয়েপুরুষ মিলে থিয়েটার করবে গো—কিন্তু আমি তাতে কী কাজে লাগব বল? তাই চলে এলাম।
-তা নাচ-গান দেখে এলে না কেন?
বিন্দু মুচকি হেসে বললে, যাবে?
–কি বল? এখন? এত রাতে?
—এত রাতেই তো এলাম। তা ছাড়া আমার ওসব লোকের ভয় নেই।
খেয়ে-দেয়ে শ্রীবিলাস বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললে, নেই কেন?
বিন্দুর গরমটা সত্যি একটু বেশি, সে বাইরে গিয়ে বসেছিল।
একটু ঝিরঝিরে বাতাস বাইরে পাওয়া যায় বটে। কিছু দূরেই একটি মাধবীলতার গাছ আছে, তাতে অজস্র ফুল, সেই থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে, মাঝে মাঝে বাতাসের সঙ্গে ভেসে।
বিন্দু বললে, কারণ আমি জানি, আমি সত্যি, ওরা মিথ্যে। ওরা ভীতু।
–তবে কাকে ভয় করে শুনি?
বিন্দু বললে, তোমাকে।
শ্রীবিলাস শুয়েছিল, উঠে পড়ল, ধীরে ধীরে বাইরে এসে বললে, আমাকে কেন?
বিন্দু ফিক করে হেসে বললে, ভয় করব না তো কি? এই দ্যাখো, ছেঁড়া কাপড়, তালি দিয়ে সেলাই করে কোনোরকমে পরি। কিছুতেই আর সংসার চালাতে পারি না। এই তো আজ অর্ধেক মাস মাত্র গেছে, আমার কাছে মোটে একটা টাকা। ঘরে শুয়ে আছে তিন ছেলে-মেয়ে। ওরা বেঘোরে ঘুমুচ্চে। কিন্তু ওগো, তোমার চোখে কি ঘুম নেই? তোমার চোখের আগুন নেবাও, আমি তো আর পারিনে।
—আমি এখন শোবো না।
–শোবে না?
–না, আমার শুতে ইচ্ছে করছে না।
শ্রীবিলাস কাতরস্বরে বললে, দ্যাখো, আমি অন্ধ মানুষ, কত দুঃখ। তার ওপর আমাকে আরও কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বিন্দু, ও বিন্দু–
-না, না, আমাকে আর ডেকো না। এই বয়সে আর অত সোহাগের ডাক ভালো লাগে না। একটা রাতও……।
-অত অহংকার ভালো নয়।
–আরে, এতে অহংকারের কী হল?
শ্রীবিলাস শক্ত গলায় বললে, তুই কি সারারাত ওখানেই দাঁড়িয়ে কাটাবি?
তুই সম্বোধন আরম্ভ হল।
বিন্দু চুপ করে রইল।
-আমি চোখে দেখতে পাই না বলে মজা পেয়েছিস বুঝি? খুব মজা না, খুব মজা?
কাছেই ছিল লাঠি, শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে সেটা ছুঁড়ে মারল আন্দাজে।
বিন্দু এবার হেসে উঠল। লাঠিটা গায়ে লাগেনি। সে তা উঠিয়ে রেখে দিলে ঘরের এক কোণে।
শ্রীবিলাস উঠে দাঁড়াল, কাঁপতে কাঁপতে বিন্দুকে ধরবার জন্যে রুখে এল, কিন্তু বিন্দু নিঃশব্দে সরে এসেছে আর একদিকে।
একটা পুরনো বাক্সের সঙ্গে শ্রীবিলাস খেলো ধাক্কা, আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর, আশ্চর্য—কেঁদে উঠল ডাক ছেড়ে, আমাকে মেরে ফেললে রে, ওই রাক্ষুসি আমাকে মেরে ফেললে রে!
আশেপাশে অনেক লোকজন, তারা শুনতে পেলে কী মনে করবে, হয়তো ভিড় জমাবে এসে এই রাতে, বিন্দু ভয় পেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি শ্রীবিলাসের কাছে এল, হাঁটু গেড়ে বসল, তার হাত ধরে বললে, চুপ চুপ! কেন অমন করছ? এই দ্যাখো, আমি একটুও ভয় পাই না তোমাকে।
শ্রীবিলাসের চেঁচামেচি এক মুহূর্তে গেল থেমে, ব্যথা গেল উড়ে।
বিন্দু দরজা বন্ধ করল।
আবার ভোরও হল, কেউ না উঠতেই শ্রীবিলাসও উঠল, আকাশে না-দেখা সূর্যকে প্রণামও করল, পরলোক-বিষয়ক একটি গানও ধরল।
অমিল
অভিনয় শেষ। গ্রিনরুমে এসে সমবেত হয়েছে। স্থান অল্প, লোক বেশি। অভিনয় ব্যাপারে এত পরিশ্রমের পরেও অজস্র কথার গতিতে মুখের রঙ তোলার বা পোশাক পরিচ্ছদ বদলানোর তাড়া নেই।
স্থান সল্পতা স্বত্ত্বেও ঘরের এক কোণে একটু নিরিবিলি আছে। মেয়েদের সেখানে আনাগোনা কম, কিন্তু ভারতী এসেই সে স্থানটুকু বেছে নিয়েছে। অত গোলমাল আর তার ভালো লাগে না। ভারতী তাই একটা লোহার চেয়ারে চিবুকে হাত রেখে বসে মজলিশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চুপ করে আছে।
কিন্তু কোনোরকমেই রেহাই পাবার উপায় নেই। রেখা কোত্থেকে এসে ধরল।
–ইস, ভাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান! এমন করে একলাটি বসে। আছিস কেন বল তো?
ভারতী হেসে বললে, এমনি!
তোর সবই, তো এমনি, সে যাক, একটু বসতে দে আগে, আমি আর দাঁড়াতে পারছিনে।
—জায়গা কোথায়?
–একটু সরলেই হবে— কোনোরকমে জায়গা করে রেখা তার পাশে বসল। রানির ভূমিকাভিনয়ে ছিল ভারতী। তাই জমকালো হয়ে সাজতে হয়েছিল। রানির পরিধানযোগ্য অনেক ধরা-চূড়া। কিন্তু একটি জিনিসও ভারতীর নিজের নয়, সব এই রেখার দেয়া। সে কোথায় পাবে? মেয়েরা তাকে একদিনের জন্যও একটা ভালো কাপড় পরতে দেখেনি। তারা জানে এর মূলে কী!
ভারতী বললো, তোর জিনিসগুলো–
রেখা আর বলতে দিল না, তার মুখে হাত চেপে বাধা দিয়ে বলল, ওসব কে এখন শুনতে চাইছে? একসময় দিলেই হবে।
-না, দামি জিনিস তো!
ইস আমি পারিনে। এখানে কি এমন কেউ নাই যে আমাকে এই nonsense talk থেকে রেহাই দিতে পারে। রেখা অভিনয়ভঙ্গিতে বলল।
ভারতী নীরবে হাসল।
ভারতীকে জড়িয়ে রেখা বললে, তোর মতো রূপও যদি আমার থাকত তবে দেখতিস।
কথাবার্তায় রেখার প্রকৃতিই ওই রকম, সবসময় কেবল সৌন্দর্যচর্চা। একটু পরে বলল, থিয়েটার কেমন হল?
দু-চার বছরেও এমন হয়নি।
খানিকটা পরে : অঞ্জন আসবে লিখেছে।
ভারতী বললো, শুধু এই? আর কী লিখেছে বল? লিখেছেঃ পাইনের মর্মর ভুলতে পারো কি? আমাকে তো অনেকগুলো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাদের ভাষায় আমি এক অতিপরিচিত ভাষাই শুনতে পাই। আমার ভালো লাগে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তটিকে কী নামকরণ করব বলো, যখন মনে হয়, যা অতীত তা তো আর আলোক নয়, শুধু অন্ধকার? অন্যদিকে চেয়ে কতকটা স্বগতভাবে রেখা বলল,-এমন সরল স্বভাব, এমন হাসি!
ভারতী পরিহাসচ্ছলে বলল, কালো অঞ্জন মেখেছিস চোখে! কিন্তু আমার তো হিংসে হওয়ার কথা।
-তা হোক, তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমার ভয়ানক, খিদে পেয়েছে।
রেখা আশ্চর্য হয়ে বলল, কেন, তুই খাসনি? চা?
-ওসব আমার ভালো লাগে না।
–তুই একটা অদ্ভুত প্রাণী। চল, এলাদির কাছে গিয়ে বলি।
ভারতী তার হাত ধরে বলল, দোহাই তোর, তুই এখান থেকে যাসনে। অত গোলমালে আমার মাথা ধরে গেছে। এখানে বেশ ভালো আছি, তুই বরং গল্প কর।
ভারতী খানিক থেমে বললে, এলে কিন্তু আমায় দেখাবি।
-আচ্ছা।
–তখন আমার দুঃসময়। তুই তো আমাকে ভুলেই যাবি।
–তা তুই ভাবতে পারিস, তোর মতো নেমকহারাম দুটি আছে? ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, কী দোষটা করেছি শুনি?
-দোষ? কতদিন বললাম আমাদের বাসায় যেতে! বন্ধু বলে আমারই ঠেকা বেশি, না?
-না, কে বললে অমন কথা? কখনও নয়। ঠেকা আমারই বেশি। কিন্তু তোকে আমাদের বাসায় নিইনে কেন জানিস? সেখানে গেলে তুই শ্বাসরোধ যন্ত্রণায় মারা পড়বি।
রেখা গম্ভীর হয়ে বললে, তুই আমাকে ঠাট্টা করিস?
—মোটেই না। জ্বলন্ত সত্য কথা।
রেখা গম্ভীর হয়েই রইল। ভারতী তার হাতটি বুকের কাছে টেনে বলল, কাল এক মজার ব্যাপার ঘটেছিল। শেষরাতে হঠাৎ জেগে দেখি, ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ঝরঝর একটানা শব্দ। কী যে ভালো লাগলো বলতে পারি না–
রেখা আর চুপ করে থাকতে পারল না। তাড়াতাড়ি বলল, একেবারে মিলে গেছে। আমিও জেগে উঠেছিলাম কিন্তু। তোরই মতো ভালো লেগেছিল আর মনে হয়েছিল, ভারতী এখন কী করছে কে জানে? এখন যদিও থাকত আমার পাশে, শেষ রাতটুকু অনেক কথা বলে কাটিয়ে দিতাম।
ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, আমার ভাবনাও ছিল ঠিক তাই। আশ্চর্য তো!
রেখাদের বাসা আছে। তাই যাবার পথে নেমে পড়বার সময় তার টানাটানিতে ভারতী না গিয়ে থাকতে পারল না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রেখা বলল, এখন রাত আটটা বেজেছে আরও দু-ঘণ্টা দেরি করে গেলে বাসায় কিছু মনে করবে না, ভাববে ইসকুলের থিয়েটার শেষ হয়নি।
—তারপর যাবার উপায়?
–গাড়ি। আমিও যাব সঙ্গে।
তার শোবার ঘরে বসিয়ে রেখে সে বলল, বোস, একটু আসছি।
একটু পরে রেখা তার মাকে সাথে করে ফিরে এল। ভারতী উঠে দাঁড়াল। মা বললেন, চলো মা, কিছু খাবে।
-ওঃ, এই ষড়যন্ত্র করেছে রেখা! আমি খাব না।
রেখার মা হেসে বললেন, তাহলে ভুগতে হবে কিন্তু আমাকেই। ও তো কিছুতেই খাবে না। ভারতীকে খেতে হল।
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার দুজনে এসে বসল ঘরে।
–একটা রাত থেকে যা ভারতী। বাসায় খবর পাঠিয়ে দি।
-না না, আমার কাজ আছে।
ঘরে রেডিও ছিল।
-শুনবি?
ভারতী হেসে মাথা কাত করল।
কিছুক্ষণ কেটে গেছে।
-এক্কেবারে বাজে। রেখা বললো, তার চেয়ে গল্প করা ভালো।
ভারতীর কিন্তু বেশ ভালো লেগেছিল, একমনে শুনেছিল, কচিৎ শোনার দুর্বলতার মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।
রেখা বলল, খুব বেশি চালাক যারা, তাদের আমি দেখতে পারিনে। তারা মনে বাইরে এক নয়।
-মনে-বাইরে কেউ এক নয়। সে যাক, তোর কথা শুনে যাদের তুই দেখতে পারিস, সে বিষয়ে একটু আন্দাজ করতে পারছি বটে।
রেখা হেসে বলল, সত্যি, এমন সরল আমি আর কখনো দেখিনি।
–দু-একটা প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত শুনি আগে, তারপরে তো মতের মিল হবে।
–একদিন জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফিরে আসবার সময় অঞ্জন পরিষ্কার রুমাল বার করে আমার পা মুছিয়ে দিল, তারপর জুতো পরলাম।
—আরে বাপরে, এ যে দেখছি—
—চেঁচিয়ে ওঠার কোনোই কারণ নেই, তারপর যা আছে শোন। আবার এমনও হয়েছে তিন-চারদিন আমার সমুখ দিয়ে অঞ্জন ওর বুড়ো ঠাকুরদার সাথে চলে গেছে, আমাকে দেখেও দেখেনি!
–তোর তখন কী অবস্থা?
–কান্না পেয়েছে। রেখা হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে দশটা বাজল।
ভারতী বললো, আমি যাই।
—এখনই?
–বলেছি না, দরকার আছে?
তারপর নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে উঠতে ভারতী বলল, সঙ্গে এসে আর কী করবি? অনর্থক তোকে কষ্ট দেয়া।
পরের দিন স্কুলের দালানে। রানির উপযোগী যত কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার রেখা দিয়েছিল, আজ সব সে এনেছে। কাল যখন ওদের বাসায় গিয়েছিল তখনই দেয়া যেত এবং একবার বলেছিল কিন্তু রেখা মোটেই কান দেয়নি।
ভারতী বলল, এই নাও বাপু!
–এত তাড়া কীসের? রেখা যেন অবজ্ঞায় বান্ডিলটায় হাত দিল।
এ দেখে ভারতী ধরে নিল যে অনেক আছে বলেই এ ধরনের ভাবভঙ্গি। সেখানে আর কেউ ছিল না।
–গয়নাগুলো পরে ওদের তাক লাগিয়ে দিই, কি বলিস?
—আচ্ছা। কিন্তু আমি যাই, এখনই আসব আবার।
ভারতী চলে গেল। রেখা বান্ডিলটা খুলল। কিন্তু কতক্ষণ পরে এসে যা দেখল তাতে ভারতী রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। রেখা উদবিগ্ন হয়ে কী খুঁজছে।
—কী হয়েছে?
–একটা হার পাচ্ছিনে।
–একটা ছাড়া আরও ছিল নাকি!
রেখা আশ্চর্য হয়ে বললে, ছিল নাকি মানে? আমার স্পষ্ট মনে আছে।
ভারতী শুষ্ক স্বরে বলল, আমার মনে হচ্ছে—
—আরে, না না, আমি কি মিথ্যে বলছি তোর কাছে?
ভারতী কী করবে ভেবে পেল না, একটু দেখবার আশায় বাইরে গেল। একটু পরে কতকগুলো মেয়ে এসে জুটল।
—কী হয়েছে রে?
রেখা সব বললে।
একটা মেয়ে মুচকি হেসে আস্তে আস্তে বলল, আমার ঠাকুরমা একটা কথা প্রায়ই বলেন, অভাবে স্বভাব নষ্ট। যদিও সকলের বেলায় তা নয়।
রেখা বলল, অন্য কিছু হলে আমার আফসোস হতো না, কিন্তু জিনিসটা বিলেতের গোল্ড স্মিথ কোম্পানির, দাদা এনেছিলেন। তাই দুঃখ হয়। কী যে করি এখন!
-কী আর করবে? আরও ভাব করো গে!
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকতে ভারতী কিছুটা শুনে ভয়ে আর বিস্ময়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। এমন যে হবে সেটা কখনও ভাবতে পারেনি। তবু সে অনেকগুলো কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে গিয়ে বলল,
—বাসায় একবার খুঁজে দেখিস না ভাই
-এত ভুলো মন নয় আমার। আর এই তো প্রমীলাও তো দেখেছে। অন্য জিনিস হলে আমি কিছু বলতাম না, কিন্তু এ যে—আর এতই যদি টাকার দরকার ছিল, আমি কি চাইলে দিতে পারতাম না?
ভারতী একবার প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না।
কিন্তু পরের দিন এর চেয়েও বেশি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রেখা এসে হাত ধরে বলল, তোরই কথা সত্যি হল, বাসায় সেটা পেয়েছি। কিন্তু তোকে অনেক কষ্ট দেয়া হল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার মতো যেন ভারতী অনুভব করল। মুখে বলল, ব্যাপারটা খুব হাস্যকর বোধ হচ্ছে।
-হ্যাঁ, তুই আমাকে মাপ কর ভাই!
—ক্ষমা কাকে বলে তা আমাদের মতো লোকের জানবার কথা নয়, তার অর্থও ভালো করে বুঝিনে, আরও অনেক জিনিস না বোঝার মতো!
রেখা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
-কিন্তু এটা একাধিকবার প্রমাণিত হল যে, বড়োলোক এবং গরিবে এমনি খুব দরকারবোধে গম্ভীর আবহাওয়ার মধ্যে কথাবার্তা হয়তো চলতে পারে কিন্তু ভাব যাকে বলে, মানসিক ঘনিষ্ঠতা যার নাম, তা কখনও হতে পারে না।
-কেন?
—কেন, তার অনেক কারণ। প্রধান কারণ হল, একপক্ষ নিজের অবস্থা সম্বন্ধে একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সচেতন।
-কথাটা হয়তো সত্যি নয়।
—তুমি কিছুমাত্র দ্বিধা না করে আমাকে সকলের কাছে চোর বলে চালিয়ে দিলে কী মনে করে?
–ভুল হয়েছিল বলেই তো?
-এ একটা হাস্যকর কথা, ধনীদের সস্তা অজুহাত।
–বললামই তো, ভুল।
–আবার সেই কথা! ভারতী উষ্ণ হয়ে বলল, এই যে সকলে চোর বলেই জানল, আমার দারিদ্রের সুবিধা নিয়ে অনেক ধারণাই করল, তার কী হবে, কী কৈফিয়ৎ দেবে তুমি? আমাদের আত্মসম্মান নেই? না, সেটা তোমার ওই পেন্সিলকাটা জাপানি কলের চেয়ে সস্তা?
–এখন ব্যাপারটা যখন সত্যি নয়—
–সত্যি নয় কে বললে? এখন কারোর কাছে গিয়ে আমি যদি বলি, প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি মেয়ে আমার বন্ধু ছিল, এমন ভাব বোধহয় কোনোখানেই দেখা যায় না। কিন্তু একদিন একটা হার চুরি যাওয়ায় সেই মেয়েটিই আমাকে চোর বলতে একটু ভেবে দেখল না, অমনি আমার কথা বিশ্বাস করবে বল? আমাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে।
ভারতী রাগে লাল হয়ে বলল, আমার সাথে তুমি কথা বোলো না। ঘৃণা জিনিসটা আমি খুবই ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন একটু দরকার বোধ করছি।
সে আর কিছু না বলে জায়গা ছেড়ে চলে গেল।
ইঁদুর
আমাদের বাসায় ইঁদুর এত বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। তাদের সাহস দেখে অবাক হতে হয়। চোখের সামনেই, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলের সুচতুর পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়ার মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়, দেয়াল আর মেঝের কোণ বেয়ে-বেয়ে তরতর করে ছুটোছুটি করে। যখন সেই নির্দিষ্ট পথে আকস্মিক কোনো বিপদ এসে হাজির হয়, অর্থাৎ কোনো বাক্স বা কোনো ভারী জিনিসপত্র সেখানে পথ আগলে বসে, তখন সেটা অনায়াসে টুক করে বেয়ে তারা চলে যায়। কিন্তু রাত্রে আরও ভয়ংকর। এই বিশেষ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ আমাদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু হয়ে যায়। ঘরের যে কয়েকখানা ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স কেরোসিনের অনেক পুরোনো টিন, কয়েকটা ভাঙা সিঁড়ি আর কিছু মাটির জিনিসপত্র আছে, সেখান থেকে অনবরতই খুটখুট টুং টাং ইত্যাদি নানা রকমের শব্দ কানে আসতে থাকে। তখন এটা অনুমান করে নিতে আর বাকি থাকে না যে, এক ঝাঁক নজদেহ অপদার্থ জীব ওই কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর এখন রাতের আসর খুলে বসেছে।
যাই হোক, ওদের তাড়নায় আমি উত্যক্ত হয়েছি, আমার চোখ কপালে উঠেছে। ভাবছি ওদের আক্রমণ করবার এমন কিছু অস্ত্র থাকলেও সেটা এখনও কেন যথাস্থানে প্রয়োগ করা হচ্ছে না? একটা ইঁদুর মারা কলও কেনার পয়সা নেই। আমি আশ্চর্য হব না, নাও থাকতে পারে। আমার মা কিন্তু ইঁদুরকে বড়ো ভয় করেন। দেখেছি একটা ইঁদুরের বাচ্চাও তাঁর কাছে একটা ভালুকের সমান। পায়ের কাছ দিয়ে গেলে তিনি চার হাত দূর দিয়ে সরে যান। ইঁদুরের গন্ধ পেলে তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন, ওদের যেমনি ভয় করেন, তেমনি ঘৃণাও করেন। এমন অনেকের থাকে। আমি এমন একজনকে জানি যাঁর একটা মাকড়সা দেখলেই ভয়ের আর অন্ত থাকে না। আমি নিজেও জোঁক দেখলে দারুণ ভয় পাই। ছোটোবেলায় আমি যখন গোরুর মতো শান্ত এবং অবুঝ ছিলাম, তখন প্রায়ই মামা বাড়ি যেতুম বিশেষত গভীর বর্ষার দিকটায়। তখন সমুদ্রের মতো বিস্তৃত বিলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে বর্ষার জলের গন্ধে আমার বুক ভরে এসেছে, ছই-এর বাইরে এসে জলের সীমাহীন বিস্তার দেখে আমি অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছি, শাপলা ফুল হাতের কাছে পেলে নির্মমভাবে টেনে তুলেছি, কখনো উপুড় হয়ে হাত ডুবিয়ে দিয়েছি জলে, কিন্তু তখনি আবার কেবলি মনে হয়েছে, এই বুঝি কামড়ে দিল!—আর ভয়ে-ভয়ে অমনি হাত তুলে নিয়েছি। সেখানে গিয়ে যাদের সঙ্গে আমি মিশেছি, তারা আমার স্বশ্রেণির নয় বলে আপত্তি করবার কোনো কারণ ছিল না, অন্তত সেরকম আপত্তি, আশঙ্কা বা প্রশ্ন আমার মনে কখনো জাগেনি।
সেই ছেলেবেলার বন্ধুরা মাঠে গোরু চরাত। তাদের মাথার চুলগুলি জলজ ঘাসের মতো দীর্ঘ এবং লালচে, গায়ের রং বাদামি, চোখের রংও তাই, পাগুলি অস্বাভাবিক সরু-সরু, মাঝখান দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা, পরনে একখানা গামছা, হাতে একটা বাঁশের লাঠি, আঙুলগুলি লাঠির ঘর্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। তাদের মুখ এমন খারাপ, আর ব্যবহার এমন অশ্লীল ছিল যে আমার ভিতর যে সুপ্ত যৌনবোধ ছিল, তা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে উঠত, অথচ আমি আমার স্বশ্রেণির সংস্কারে তা মুখে প্রকাশ করতে পারতাম না। তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। আমার মুখ লাল হয়ে যেত। তাদের মধ্যে একজন ছিল যার নাম ভীম। সে একদিন খোলা মাঠের নতুন জল থেকে একটি প্রকান্ড জোঁক তুলে সেটা হাতে করে আমার দিকে চেয়ে হাসতে-হাসতে বললে, সুকু, তোমার গায়ে ছুঁড়ে মারব?
আমি ওর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম, ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল, আস্তে আস্তে বুদ্ধিমানের মতো দূরে সরে গিয়ে বললাম, দ্যাখ ভীম, ভালো হবে বলছি, ভালো হবে না। ইয়ার্কি, না?
ভীম হি-হি করে বোকার মতো হাসতে হাসতে বললে, এই দিলাম দিলাম—
সেদিনের কথা আজো মনে পড়ে, ভীমের সাহসের কথা ভাবতে আজও অবাক লাগে। অনেকের এমন স্বভাব তাকে—যেমন অনেকে কেঁচো দেখলেও ভয় পায়। আমি কেঁচো দেখলে ভয় পাইনে বটে, কিন্তু জোঁক দেখলে ভয়ে শিউরে উঠি। এসব ছোটোখাটো ভয়ের মূলে বুর্জোয়া রীতিনীতির কোনো প্রভাব আছে কি না বলতে পারিনে।
একথা আগেই বলেছি যে আমার মা-ও ইঁদুর দেখলে দারুণ ভীত হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে সামলানো দায় হয়ে ওঠে। ইঁদুর যে কাপড় কাটবে সেদিকে নজর না দিয়ে তখন তাঁর দিকেই নজর দিতে হয় বেশি। একবার তাঁর একটা কাপড়ের নীচে কেমন করে জানিনে একটা ইঁদুর আটকে গিয়েছিল। সে থেকে থেকে কেবল পালাবার চেষ্টা করছিল, ছড়ানো কাপড়ের ওপর দিয়ে সেই প্রয়াস স্পষ্ট চোখে পড়ে। মা পাঁচ হাত দূরে সরে গিয়ে ভাঙা গলায় চীৎকার করে বললেন,
—সুকু, সুকু।
প্রথম ডাকে উত্তর না দেওয়া আমার একটা অভ্যাস। তাই উত্তর দিয়েছি এই ভেবে চুপ করে রইলাম।
-সুকু? সুকু?
এবার উত্তর দিলাম, কেন?
মা তাঁর হলুদ-বাটায় রঙিন শীর্ণ হাতখানা ছড়ানো কাপড়ের দিকে ধরে চোখ বড়ো করে বললেন,
-ওই দ্যাখ!
আমি বিরক্ত হলাম। ইদুরের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে আর কী! এত উঁদুর কেন? পরম শত্ৰু কী কেবল আমরাই। আমি কাপড়টা সরাতে অমনি মা চেঁচিয়ে উঠলেন, আহা, ধরিসনে, ওটা ধরিসনে।
-খেয়ে ফেলবে না তো!
-আহা,বাহাদুরি দেখানো চাই-ই।
—মা, তুমি যা ভীতু।–ইঁদুরটা অনবরত পালাবার চেষ্টা করছিল, বললাম, আচ্ছা মা,বাবাকে একটা কল আনতে বলতে পারো না? কোনোদিন দেখবে আমাদের পর্যন্ত কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
—আহা, মেরে কী হবে? অবোধ প্রাণী কথা বলতে পারে না তো। আর কল আনতে পয়সাই বা পাবেন কোথায়? মা-র গলার স্বর এমনি অকাতর থাকে এবং অত্যন্ত সংক্ষেপে শেষ হয়ে যায়। শেষ হওয়ার পর আর এক মিনিটও তিনি সেখানে থাকেন না। তিনি অমনি চলে গেলেন।
একটা ইঁদুর মারা কল কিনতে পয়সা লাগবে, এটা আমার আগে মনে ছিল না। তাহলে আমি বলতাম না। কারণ এই ধরনের কথায় এমন একটা বিশেষ অবস্থার ছবি মনে জাগে যা কেবল একটা সীমাহীন মরুভূমির মতো। মরুভূমিতেও অনেক সময় জল মেলে, কিন্তু এ-মরুভূমিতে জল মিলবে, এমন আশাও করিনে। এই মরুভূমির ইতিহাস আমার অজানা নয়। আমার পায়ের নীচে যে বালি চাপা পড়েছে, যে বালুকণা আশে পাশে ছড়িয়ে আছে, তার ফিসফিস করে সেই ইতিহাস বলে। আমি মন দিয়ে শুনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আঠারো বছর বয়েস অবধি এগিয়ে আবোল-তাবোল অনেক ভেবেছি, কিন্তু আবোল-তাবোল ভাবনা মস্তিষ্কের হাটে কখনো বিক্রি হয় না। ঈশ্বরের প্রতি সন্দেহ এবং বিশ্বাস দুই-ই প্রচুর ছিল, তাই ঈশ্বরকে কৃষ্ণ বলে নামকরণ করে ডেকেছি, হে কৃষ্ণ, এ পৃথিবীর সবাইকে যাতে একেবারে বড়ো—লোক করে দিতে পারি তেমন বর আমাকে দাও। রবীন্দ্রনাথের পরশমণি কবিতা পড়ে ভেবেছি, ইস, একটা পরশমণি যদি পেতাম। সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোককে সত্যই জিজ্ঞেস করে বসেছি, আচ্ছা, পরশমণি পাথর আজকালও লোকে পায়? কোথায় পাওয়া যায় বলবে?
আমি যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বৃহৎ পরিবারের লোকগুলির নির্মল দেহে তখনও অর্থহীনতার ছায়াটুকু পড়েনি। বুর্জোয়ারাজের ভাঙনের দিন তখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়নি। শুরু না হওয়ার আমি এই মানে করেছি যে, তখনও অনেক জনকের প্রসারিত মনের আকাশে তার ছেলের ভবিষ্যৎ স্মরণ করে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। আমাকে আশ্রয় করেই কম আশা জন্ম নিয়েছিল। অথচ সে সব আশার শাখা-প্রশাখা এখন কোথায়। আমি বলতে দ্বিধা করব না, সে সব শাখা-প্রশাখা তো ছড়ায়ইনি, বরং মাটির গর্ভে স্থান নিয়েছে। একটা সুবিধা হয়েছে এই যে, পারিবারিক স্বেচ্ছাচারিতার অক্টোপাস থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পেরেছি।
কিন্তু নিরিবিলি থাকতে চাইলেই কী আর থাকা যায়। ইঁদুররা আমায় পাগল করে তুলবে না। আমি রোজ দেখতে পাই একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স বা ভাঙা টিনের ভিতর ঢুকে ওরা অনবরত টুং টাং শব্দ করতে থাকে, ক্ষীণ হলেও অবিরত এমন আওয়াজ করতে থাকে যে অনতিকাল পরেই সেটা একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে শুধু আমার কেন অনেকেরই বিষম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটা কুকুর যখন কঁকিয়ে কঁকিয়ে আস্তে আস্তে কাঁদতে থাকে, তখন সেটা কেউ সহ্য করতে পারে? আমি অন্তত করিনে। অমন হয়। যখন একটা বিশ্রী শব্দ ধীরে ধীরে একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে তখন সেটা অসহ্য না হয়ে যায় না। ইঁদুরগুলির কার্যকলাপও আমার কাছে সেরকম একটা বিরক্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আর একদিন মা চীৎকার করে ডেকে উঠলেন,–সুকু! সুকু!
বলেছি তো প্রথম ডাকেই উত্তর দেওয়ার মতো কঠিন তৎপরতা আমার নেই।
মা আবার আর্তস্বরে ডাকলেন, সুকু?
আর তৃতীয় ডাকের অপেক্ষা না করে নিজেকে মার কাছে যথারীতি স্থাপন করে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে যা দেখলুম তাতে যদিও চিন্তিত হবার কারণ থাকে তবু চিন্তিত হলাম না। দেখলাম, আমাদের কচিৎআনা দুধের ভাঁড়টি একপাশে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর তারই পাশ দিয়ে একটি সাদাপথ তৈরি করে এক প্রকান্ড ইঁদুর দ্রুত চলে গেল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কোনো বিশেষ খবর শুনে কোনো উত্তেজনা ভাবান্তর প্রকাশ করা আমার স্বভাবে নেই বলেই বার বার প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই এখানেও তার অন্যথা হবে না, একথা বলা বাহুল্য। দেখতে পেলাম, আমার মা-র পাতলা কোমল মুখখানি কেমন এক গভীর শোকে পার হয়ে গেছে, চোখ দুটি গোরুর চোখের মতো করুণ, আর যেন পদ্মপত্রে কয়েক ফোঁটা জল টল টল করছে, এখুনি কেঁদে ফেলবেন।
দুধ যদি বিশেষ একটা খাদ্য হয়ে থাকে এবং তা যদি নিজেদের আর্থিক কারণে কখনো দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায় এবং সেটা যদি অকস্মাৎ কোনো কারণে পাকস্থলীতে প্রেরণ করার অযোগ্য হয়, তবে অকস্মাৎ কেঁদে ফেলা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মা অমনি কেঁদে ফেললেন, আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম. এমন একটা অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। যার ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর বিনিয়ে বিনিয়ে কথা আমার চোখের দৃষ্টিপথকে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিল, আরও গভীর করে দিল, আরও গভীর করে তুলল। আমি দেখতে পেলাম আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য প্রচুর অগ্নিবর্ষণ করছে, নীচে পৃথিবীর ধূলিকণা আরও বেশি অগ্নিবর্ষী। আর হৃদয়ের খেতও পুড়ে পুড়ে থাক খাক হয়ে গেল। একটি নীল উপত্যকাও দেখা যায় না, দূরে জলের চিহ্ন মাত্র নেই, মরীচিকাও দিয়েছে ফাঁকি। ভাবলাম স্বামী বিবেকানন্দের অমূল্য গ্রন্থরাজি কোথায় পাওয়া যায়? শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি অমূল্য। সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণব্রতী শ্ৰীঅরবিন্দ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ (তখনও ভাবতাম না দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কখন শুরু হবে)! আমার মুখভঙ্গি চিন্তাকুল হয়ে এল, হাঁটু দুটি পেটের কাছ এনে কুকুরের মতো শুয়ে আমি ভাবতে লাগলাম—ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে নিয়েছি ভালো করে ভাবার জন্যে—ভাবতে লাগলাম, এমন কোনো উপায় নেই যাতে এই বিকৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
সন্ধ্যার পর বাবা এলেন, খবরটা শুনে এমন ভাব দেখালেন না যাতে মনে হয় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন অথবা কিছুমাত্র দুঃখিত হয়েছেন, বরং তাড়াতাড়ি বলতে আরম্ভ করলেন—যদিও তাড়াতাড়ি কথা বলাটা তাঁর অভ্যাস নয়, বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে। আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম এমন একটা কিছু হবে। আরে মানুষের জান নিয়েই টানাটানি দুধ খেয়ে আর কী হবে বলো!
দেখতে পেলাম বাবার মুখটি যদিও শুকনো তবু প্রচুর ঘামে তৈলাক্ত দেখাচ্ছে, গায়ের ভারী জামাটিও ঘামে ভিজে ঘরের ভিতর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন একটা বিপর্যয়ের পরেও তাঁর এই অবিকৃত ভাব দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। এই ভেবে যে, ক্ষতি যা হয়েছে, হয়েছেই তার আলোচনায় এমন একটা অবস্থা যার কোনো পরিবর্তন নেই বরং একটা মস্ত গোলযোগের সূত্রপাত হবে, তা থেকে রেহাই পাওয়া গেল, খুব শীগগির আর আমার মানসিক অবনতি ঘটবে না।
কিন্তু বাবা কিছুক্ষণ পরেই সুর বদলালেন : তোমরা পেলে কী? কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি! দয়া করে আমার দিকে একুট চাও। আমার শরীরটা কী আমি পাথর দিয়ে তৈরি করেছি। আমি কী মানুষ নই? আমি এত খেটে মরি আর তোমরা ওদিকে ফুর্তিতে মেতে আছ। সংসারের দিকে একবার চোখ খুলে চাও? নইলে টিকে থাকাই দায় হবে!
আমার কাছে বাবার এই ধরনের কথা মারাত্মক মনে হয়। তাঁর এই ধরনের কথার পেছনে অনেক রাগ ও অসহিষ্ণুতা সঞ্চিত হয়ে আছে বলে আমি মনে করি।
সময়ের পদক্ষেপের সঙ্গে স্বরের উত্তাপও বেড়ে যেতে লাগল। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই কঠিন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় যে অদ্ভূত নগ্নতা প্রকাশ পাবে, তাতে আমার লজ্জার আর সীমা পরিসীমা থাকবে না। এমন অবস্থার সঙ্গে আমার একাধিকার পরিচয় হলেও আমার গায়ের চামড়া তাতে পুরু হয়ে যায় নি, বরং আশঙ্কার কারণ আরও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। যে পৃথিবীর সঙ্গে আমার পরিচয় তার ব্যর্থতার মাঝখানে এই নগ্নতার দৃশ্য আরও একটি বেদনার কারণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবা বললেন, আর তর্ক কোরোনা বলছি। এখান থেকে যাও, আমার সুমুখ থেকে যাও, দূর হয়ে যাও বলছি।
মা বললেন, অত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। চেঁচামিচি করে পৃথিবী সুষ্ঠু লোককে নিজের গুণপনার কথা জানানো হচ্ছে, খুব সুখ্যাতি হবে।
শুনতে পেলাম, এরপরে বাবার গলার স্বর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে বোমার মতো ফেটে পড়ল!
-তুমি যাবে? এখান থেকে যাবে কি না বল? গেলি তুই আমার চোখের সামনে থেকে? শয়তান মাগী.বাবা বিড়বিড় করে আরও কত কী বললেন, আমি কানে আঙুল দিলাম, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম একটি অসাড় মৃতদেহ হয়ে, আমার চোখ ফেটে জল বেরোলো বিপর্যয়ের পথে বর্ধিত হলেও আমার মনের শিশুটি আজন্ম যে শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছে তাতে এমন কোনো কথা লেখা ছিল না। মনে হল যেন আজ এই প্রথম বিপর্যয়ের মুহূর্তগুলি চরম প্রহরী সেজে আমার দোর গোড়ায় কড়া নাড়ছে। আগে এমন দেখিনি বা শুনিনি তবু আমার এই অনুভূতির শিক্ষা কোথেকে এল? বলতে পারি আমার এই শিক্ষা অতি চুপি চুপি জন্মলাভ করেছে, মাটির পৃথিবী থেকে সে এমন ভাবে শ্বাস ও রস গ্রহণ করেছে যাতে টুঁ শব্দ হয়নি। ফুলের সুবাস যেমন নিঃশব্দে পাখা ছড়িয়ে থাকে তেমনি ওর চোখের পাখা দুটিও নিঃশব্দে এই অদ্ভুত খেলার আয়োজন করতে ছাড়েনি। আরও বলতে পারি আমার মনের শিশুর বাঁচবার বা বড়ো হবার ইতিহাস যদি জানতে হয় তবে ফুলের তুলনা করা চলে। কিন্তু সেই শিক্ষা আজ কাজ দিল কই? বরং আরও কর্মহীনতার নামান্তর হল, আমার কাঁচা শরীরের হাত দুটি কেটে ভাসিয়ে দিল জলে, দুই চোখকে বাষ্পকুল করে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দিল। আমি কী করব? আমার কিছু করবার আছে কী?
—শয়তান মাগি, বেরিয়ে যা!
আবার ভেসে এল অদ্ভুত কথাগুলি। এসব আমি শুনতে চাইনে তবু শুনতে হয়। বাতাসের সঙ্গে খাতির করে তা ভেসে আসবে, জোর করে কানের ভিতর ঢুকবে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার মনের মাটিতে সজোরে লাথি মারবে।
—যা বলছি!
গোলমাল আরও খানিকটা বেড়ে গেল।
কিছুপরে মা বাষ্পচ্ছন্ন স্বরে ডাকলেন, সুকু! সুকু!
ঠিক তখুনি উত্তর দিতে লজ্জা হল, ভয় করল, তবু আস্তে বললাম, বলো।
মা বললেন, দরজা খোল।
ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলাম, ভয় হল এই ভেবে যে, এবার অনেক বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, যা শুনতেও ভয় পাই ঠিক তারই সামনে এক বিচারপতি হয়ে সমস্ত উত্তেজনাকে শূন্যে বিসর্জন দিয়ে রায় দিতে হবে।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা আর হল না। মা ঘরের ভিতর ঢুকেই ঠাণ্ডা মেঝের ওপর আঁচলখানা পেতে শুয়ে পড়লেন। পাতলা পরিচ্ছন্ন শরীরখানি বেঁকে একখানা কাস্তের আকার ধারণ করল। কেমন অসহায় দেখাল ওঁকে, ছোটো বেলায় যাঁকে পৃথিবীর মতো বিশাল ভেবেছি, তাঁকে এমনভাবে দেখে এখন কত ক্ষীণজীবী ও অসহায় মনে হচ্ছে। যাকে বৃহত্তম ভেবেছি, সে এখন কত ক্ষুদ্র, সে এখনও শৈশব অতিক্রম করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। আর আমি কতো বৃহৎ, রক্তের চঞ্চলতায়, মাংসপেশির দৃঢ়তায়, বিশ্বস্ত পদক্ষেপ কত উজ্জ্বল ও মহৎ, ওই হরিণের মতো ভীরু ছোটো দেহের রক্তপান করে একদিন জীবন গ্রহণ করলেও আজ আমি কতো শক্তিমান! আমাকে কেউ জানে? এমনও তো হতে পারত, আজ লণ্ডনের কোনো ইতিহাস বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির করিডোরের বুকে বিশ বছরের যুবক সুকুমার গভীর চিন্তায় পায়চারি করছে, অথবা খেলার মাঠে প্রচুর নাম করে সকল সহপাঠিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, অথবা ত্রিশ বছরের নীলনয়না কোনো খাঁটি ইংরেজ মহিলার ধীর গভীর পদক্ষেপে ভীরুর মতো অনুসরণ করে একদিন তাঁর দেহের ছায়ায় বসে প্রেম যাঞ্চা করছে। এমন তো হতে পারত, তার সোনালি চুল, দীর্ঘ পক্ষ্মাবৃত চোখ দেহের সৌরভ—আহা, কে সেই ইংরেজ মহিলা? সে এখন কই..আর সেই স্বর্ণাভ রাজকুমার সুকুমারের মা ওই ঠাণ্ডা মেঝের ওপর কাপড় বিছিয়ে শুয়ে? এখান থেকে কতো ছোটো আর কতো অসহায় মনে হয়! এক অর্থহীন গর্বে বুকটা প্রশস্ততর করে আমি একবার মার দিকে তাকালাম।
ডাকলাম, মা? ও মা?
কোনো উত্তর নেই। গভীর নিস্তব্দতা ভঙ্গ করে কোনো ভগ্ন নারীকণ্ঠ আমার কানের দরজায় এসে আঘাত করল না। ঘুমিয়ে পড়েননি তো?
পরদিনও আবহাওয়ার গভীরতা কিছুমাত্র দূর হল না। মা-র এমন অস্বাভাবিক নীরবতা দেখে আমার ছোটো ভাই বোনেরা প্রচুর আস্কারা পেয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি। তারা নগ্ন গাত্র হয়ে যথেচ্ছ বিচরণ করতে লাগল। স্কুলহীন ছোটো বোনটি তার নিত্যকার অভ্যাসমত প্রেমকুসুমাস্তীর্ণ এক প্রকান্ড উপন্যাস নিয়ে বসেছে, অন্যদিকে চাইবারও সময় নেই।
সেদিন অনেক রাতে সারা বাড়ি গভীর ধোঁয়ায় ভেসে গেল, সকলের নাক-মুখ দিয়ে জল বেরুতে লাগলো, দম বন্ধ হয়ে এল। ছোটো ভাই বোনেদের খালি মাটিতে পড়ে ঘুমুতে দেখে রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখনও রান্না হয়নি, মা?
চোখের জলে ভিজে উনানের ভিতর প্রাণপণে ফু দিতে দিতে মা বললেন, না। এখন চড়াচ্ছি।
—এত দেরি হল কেন?
মা চুপ করে রইলেন।
বুঝতে পারলাম সেই পুরোনো কাসুন্দি। বুঝতে পারলাম এ জিনিস সহজে এড়াতে চাইলেও সহজে এড়াবার নয়, ঘুরে ফিরে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় পাশ কাটাতে চাইলে হাত চেপে ধরে, কোনো রকমে এড়িয়ে গেলেও হাত তুলে ডাকতে থাকে। এই ডাকাডাকির ইতিহাসকে যদি আগাগোড়া লিপিবদ্ধ করি তবে সারাজীবন লিখেও শেষ করতে পারব না, তাতে কতগুলি একই রকমের চিত্র গলাগলি করে পাশাপাশি এসে দাঁড়াবে, আর সৌখিন পাঠকের বিরক্তিভাজন হবে। আমি তো জানি পাঠকশ্রেণিকে? তাঁদের মনোরঞ্জন করতে হলে কান্নাকাটির ন্যাকামি চলবে না, কিংবা কিছু লিখলেও টাকার হিসাবটাকে সযত্নে এড়িয়ে দিতে হবে বা হাসিমুখে বরণ করতে হবে। যেমন আমার বাবা অনেক সময় করেন প্রচুর অভাবের চিত্রকেও এক দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে পরম আনন্দে ঘাড় বেঁকিয়ে হাসতে থাকেন। কিংবা যেমন আমাদের পাড়ার প্রকান্ড গোঁফওয়ালা রক্ষিত মশায় করেন—ঘরে অতি শুকনো স্ত্রী আর একপাল ছেলেমেয়েদের অভুক্ত রেখেও পথে ঘাটে রাজা-উজির মেরে আসেন। বা যেমন আমাদের প্রেস কর্মচারী মদন, শূন্যতার দিনটাকে উপবাসের তিথি বলে গণ্য করে, কখনো পদ্মাসন করে বসে নির্মীলিত চোখে দুই শক্ত দীর্ঘ বাহু দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ঈশ্বরকে সশরীরে ডেকে আনে। এমন নয়। এ ছাড়া আর উপায় কী? স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়াই, জীবন আমাদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করি, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম পাই, অথবা উধ্ববাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করি। এসব দেখে আমি একদিন সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের নাম করতে গিয়ে যাদের জিহ্বায় জল আসে সেদিন আমি তাদেরই একজন হয়েছিলাম। বন্ধুকে এক ধোঁয়াটে রহস্যময় ভাষায় চিঠি লিখলাম। এরা কে জানো? এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে, এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি! পেটের ভিতর উঁচ বিধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষা পাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার অজ্ঞতায় নিজের মনে যে কল্পনায় সৌধ গড়ে তুললাম তাতে নিজের মনে মনে প্রচুর পরিতৃপ্ত হলাম। যে উপবাসকৃশ বিধবারা তাদের সক্ষম মেয়েদের দৈহিক প্রতিষ্ঠায় সংসার যাত্রার পথ বেয়ে বেয়ে কোনোরকমে কালাতিপাত করছেন, তাদের জন্য করুণা যেমন হল, মনে মনে পুজো করতে লাগলাম আরও বেশি। কিন্তু সেসব ক্ষণিকের ব্যাপার! শরতের মেঘের মতো যেমনি এসেছিল তেমনি মিশে গেল। মগজের মধ্যে জায়গা যদিও একটু পেয়েছিল, বেশি দিন থাকবার ঠাঁই হল না। আজ ভাবছি আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। নইলে এক অসম্পূর্ণ সংকীর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হয়ে থাকত, সে ভাবনা নিয়ে মনে মনে পরিতৃপ্ত থাকতাম বটে, কিন্তু গতির বিরুদ্ধে চলতাম। এক ভীষণ প্রতিক্রিয়ার বিষে জর্জরিত হতাম।
এমন দিনে এক অলস মধ্যাহ্নের সঙ্গে আমি সাংঘাতিক প্রেমে পড়েছিলাম। সেই দুপুরটিকে যা ভালো লেগেছিল কেবল মুখে বললে তা যথেষ্ট বলা হবে না। সেদিন যতটুকু আকাশকে দেখতে পেলাম তার নীলকে এত গভীর মনে হল যে চোখের ওপর কে যেন কিছু শীতল জলের প্রলেপ দিয়ে দিল। ভাবনার রাজ্যে পায়চারি করে আমি আমার মীমাংসার সীমান্তে এসে পৌঁছোলাম সেই মধ্যাহ্নে, সেখানে রাখলাম দৃঢ় প্রত্যয়। আকাশের নীলিমায় দুই চোখকে সিক্ত করে আমি দেখতে পেলাম চওড়া রাস্তার পাশে সারি-সারি প্রকান্ড দালান, তার প্রতিকক্ষে সুস্থ সবল মানুষের পদক্ষেপ। সিঁড়িতে নানারকম জুতোর আওয়াজ, মেয়ে পুরুষের মিলিত চীৎকার ধ্বনি পৃথিবীর পথে পথে বলিষ্ঠ দুয়ারে হানা দেয়, বলিষ্ঠ মানুষ প্রসব করে আমি দেখতে পেলাম ইলেকট্রিক আর টেলিগ্রাফ তারের অরণ্য, ট্রাকটর চলেছে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে—অবাধ্য জমিকে ভেঙে চুরে দলে মুচড়ে, সোনার ফসল আনন্দের গান গায়, আর যন্ত্রের ঘর্ষণে ও মানুষের হর্ষধ্বনিতে এক অপূর্ব সংগীতের সৃষ্ট হল। একদা যে বাতাস মাটির মানুষের প্রতি উপহাস করে বিপুল অট্টহাসি হেসেছে, সেই বাতাসের হাত আজ করতালি দেয় গাছের পাতায় পাতায়। কেউ শুনতে পায় ?
যারা শোনে তাদের নমস্কার। তাই অলস মধ্যাহ্নকে মধুরতর মনে হল। দেখলাম এক নগ্নদেহ বালক রাস্তার মাঝখানে বসে একটা ইটের টুকরো নিয়ে গভীর মনোযোগে আঁক কষছে। কোন বাড়ি থেকে পচা মাছের রান্নার গন্ধ বেরিয়ছে বেশ, সঙ্গীত—পিপাসুর বেসুরো গলায় গান শোনা যাচ্ছে হারমোনিয়াম সহযোগে এই অসময়ে, রৌদ্র প্রচন্ড হলেও হাওয়া দিচ্ছে প্রচুর, ও বাড়ির এক বন্ধু রাস্তার কলে এইমাত্র স্নান করে নিজ বুকের তীক্ষ্ণতাকে প্রদর্শনের প্রচুর অবকাশ দিয়ে সংকুচিত দেহে বাড়ির ভিতর ঢুকল, দুটি মজুর কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সেরে কয়লামলিন বেশে আবার দৌড় দিচ্ছে। এ দৃশ্য বড়ো মধুর লেগেছে অবশ্য কোনো বুর্জোয়া চিত্রকল্পের চিরন্তনী চিত্র বলে নয়। এ চিত্র যেমন আরাম দেয়, তেমনি পীড়াও দেয়। আমার ভালো লেগেছে এই স্মরণীয় দিনটিতে এক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির রাজত্বে খানিকটা পায়চারি করতে পেরেছি বলে। চমৎকার। চমৎকার! চমৎকার!
অনেক রাত্রে ইঁদুরের উৎপাত আবার শুরু হল। ওরা টিন আর কাঠের বাক্সে দাপাদাপি শুরু করে দিল, বীরদর্পে চোখের সামনে দিয়ে ঘরের মেঝে অতিক্রম করে দারুণ উপহাস করতে লাগল।
রান্না শেষ করে এসে মা সকলকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, ওরে মন্টু ওরে ছবি, ওরে নারু, ওঠ বাবা ওঠ!
মন্টু উঠেই প্রাণপণে চীৎকার আরম্ভ করে দিল। ছবি যদিও এতক্ষণ তার উপন্যাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল, এখন বই টই ফেলে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। —ওরে ছবি, খেতে আয়, খাবি আয়!
বার বার ডাকেও ছবি টুঁ শব্দটি করে না।
মা ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, আমার কী দোষ হল? আমার ওপর রাগ করিস কেন? গরিব হয়ে জন্মালে…
মার চোখ ছল ছল করে উঠল, গলা কেঁপে গেল, আমি রাগ করে বললাম, আহা, ও না খেলে না খাবে, তুমি ওদের দাও না?
মধ্যরাত্রির ইতিহাস আরও বিস্ময়কর।
এক অনুচ্চ কণ্ঠের শব্দে হঠাৎ জেগে উঠলাম। শুনতে পেলাম বাবা অতি নিম্নস্বরে ডাকছেন, কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?
বাবা মাকে ডাকছেন নাম ধরে। ভারী চমৎকার মনে হল। মনে মনে বাবাকে আমার বয়েস ফিরিয়ে দিলাম; আর আমার প্রতি ভালোবাসা কামনা করতে লাগলাম তাঁর কাছ থেকে। যুবক সুকুমার একদিন তার বউকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চীৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে।
-কনক? ও কনক?
প্রৌঢ়া কনকলতা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো উত্তর দিলেন না, কঁকিয়ে উঠলেন, কোনবার উঃ আঃ করলেন। আমি এদিকে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে নিম্নগামী হলাম। বালিশের ভিতর মুখ গুঁজে হারিয়ে যাবার কামনা করতে লাগলাম। লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলাম। শরীর দিয়ে ঘামের বন্যা ছুটল।
ওদিকে মধ্যরাত্রির চাঁদ উঠেছে আকাশে, পৃথিবীর গায়ে কে এক সাদা মসলিনের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে এনেছে জলের স্রোতের মতো বাতাস, আমার ঘরের সামনে ভিখিরি কুকুরদের সাময়িক নিদ্ৰাময়তায় এক শীতল নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ও বাড়ির ছাদে নিদ্রাহীন বানরদের অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যায়। মধ্যরাত্রের প্রহরী আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেবে কখন?
অবশেষে প্রৌঢ়া কনকলতার নীরবতা, ভাঙল, তিনি আবার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন, অল্প একটু ঘোমটা টেনে কাপড়ের প্রচুর দৈর্ঘ্য দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করলেন। তারপর এক অশিক্ষিতা নববধুর মতো ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে লাগলেন। অঙ্গ-ভঙ্গির সঞ্চালনে যে সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়, সেই সঙ্গীতের আয়নায় আমার কাছে সমস্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি লক্ষ করলাম দুই জোড়া পায়ের ভীরু অথচ স্পষ্ট আওয়াজ আস্তে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
অনেক রাত্রে বাবা গুনগুন স্বরে গান গাইতে লাগলেন। চমৎকার মিষ্টি গলা বেহালার মতো শোনা যাচ্ছে। সেই গানের খেলায় আলোর কণাগুলি আরও সাদা হয়ে গেছে, মনে হয় এক বিশাল অট্টালিকার সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সেই গানের রেখা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ রাত্রির বাতাস অপূর্ব স্নেহে মন্থর হয়ে এসেছে। একটা কাক রোজকার মতো ডেকে উঠেছে। বাবাকে গান গাইতে আরও শুনেছি বটে, কিন্তু আজকের মতো এমন মধুর ও গভীর আর কখনো শুনিনি। তাঁর মৃদু গানে আজ রাত্রির পৃথিবী যেন আমার কাছে নত হয়ে গেল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন কার প্রাণ খোলা হাসিতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলাম। হাসির ঐশ্বর্যে বাড়ির ইটগুলি কাঁপছে।
বাবা বললেন, পন্ডিত মশাই, ও পন্ডিত মশাই, উঠুন? আর কত ঘুমুবেন সকালে না উঠলে বড়লোক হওয়া যায় কী? উঠুন?
আমি অনেক কষ্টে চোখমেলে চেয়ে দেখলাম কখন ভোর হয়ে গেছে! বাবার স্নেহময় কথায় আমি কখনো হাসিনে, কেমন, বাধে, যথেষ্ট বয়েস কি না, এককুড়ি বছর তো পেরিয়ে চললাম।
মশারির দড়ি খুলতে খুলতে বাবা বললেন, পৃথিবীতে যত গ্রেট মেন দেখতে পাচ্ছো, সকলের ভোরে ওঠবার অভ্যেস ছিল। আমার বাবা মানে তোমার ঠাকুরদারও এমনি অভ্যেস ছিল। আমরা যতো ভোরেই উঠি না কেন, উঠেই শুনতে পেতাম বাইরের ঘরে তামাক খাওয়ার শব্দ হচ্ছে। অমন অধ্যবসায়ী না হলে আর একটা জীবনে অত জমি-জমা অত টাকা পয়সা করে যেতে পারেন! তিনি তো সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমরা কিছুই রাখতে পারলাম না। কিন্তু উঠুন পন্ডিত মশাই, যারা ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে জীবনে তারা কখনো উন্নতি করতে পারে না।
অতটা মাতব্বরী সহ্য হয় না, জীবনে একদিন মাত্র সকালে উঠেই বাড়ি সুদ্ধ লোক মাথায় তুলছেন।
সমস্ত বাড়িটা খুসির বাজনায় মুখরিত হয়ে উঠল।
ওদিকে মন্টু সেলুনে চুল ছাঁটাবার জন্য পয়সা চাইতে শুরু করেছে, ঘণ্টাখানেক পরেও পয়সা না পেলে মেঝেতে আছাড় খেয়ে তারস্বরে কাঁদবে। নারু পৰু-পক্ক বাক্য বর্ষণ করে সকলের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টায় আছে। ছবি এই মাত্র তার উপন্যাসের পৃষ্ঠায় নায়িকার শয়নঘরে নায়কের অভিযান দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠেছে।
বাবা দারুণ কর্মব্যস্ত হয়ে উঠলেন, এঘর ওঘর পায়চারি করতে লাগলেন।
একসময় আমার কাছে এসে বললেন, তোমরা থিয়োরিটা বার করেছ ভালোই, কিন্তু কার্যকরী হবে না, আজকাল ওসব ভালোমানুষি আর চলবে না। এখন কাজ হল লাঠির। হিটলারের লাঠি, বুঝলে পন্ডিত মশাই?
আমি মনে মনে হাসলাম। বাবা যা বলেন তা এমনভাবে বলেন যে মন মনে বেশ আমোদ অনুভব করা যায়। তাঁর কী জানি কেন ধারণা হয়েছে, আমরা সব ভালোমানুষের দল। নিজের খেয়ে চিন্তা করি, শুষ্কমুখ হয়ে শীতল জল বিতরণ করতে চাই, নিজেরা স্বর্গচ্যুত, অথচ পরের স্বর্গলাভের পথ আবিষ্কারে মত্ত।
আবার বলেন : তোমাদের রাশিয়া কেবল সাধুরই জন্ম দিয়েছে, অসাধু দেয়নি! কেবল মার খেয়ে মরছে। লেনিন তো মস্ত বড়ো সাধু ছিলেন, যেমনি টলস্টয় ছিলেন। কিন্তু ওঁরা লাঠির সঙ্গে পারবেন কী? কখনো নয়।
বলতে ইচ্ছে হয় চমৎকার! এমন স্বকীয়তা, এমন নূতনত্ব আর কোথাও চোখে পড়েছে! এমন করে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না, এটা জোর করে বলতে পারি। তিনি একবার যা বললেন তা ভুল হলেও তা থেকে একচুল কেউ তাঁকে সরাবে, এমন বঙ্গ সন্তান ভূভারতে দেখিনে। এক হিটলারি দম্ভে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু একমাত্র আশার কথা এই যে, এসব ব্যাপারে তিনি মোটেই সিরিয়াস নন, একবার যা বলেন দ্বিতীয়বার তা বলতে অনেক দেরি করেন। নইলে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। পৈত্রিক অধিকারে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার অপব্যবহার করতেন সন্দেহ নেই।
ওদিকে কর্মব্যস্ত মাকে দেখতে পাচ্ছি। গভীর মনোযোগে তিনি তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন, কোথাও এতটুকু দৃষ্টিপাত করবার সময় নেই যেন। কাঁধের ওপর দুই গাছি খড়ের মতো চুল এলিয়ে পড়েছে, তার ওপর দিয়েই ঘন ঘন ঘোমটা টেনে দিচ্ছেন, পরনে একখানা জীর্ণ মলিন কাপড়, ফর্সা পা-দুটি জলের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত বিশীর্ণ হয়ে এসেছে। পেছনে পেছনে নারু ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছেড়ে বাবা এবার ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দিলেন। নারুকে ডেকে বললেন, নারু, বাবা তোমার কী চাই বল?
নারু তার ছোটো ছোটো ভাঙা দাঁতগুলি বের করে অনায়াসে বলে ফেলল, একটা মোটরবাইক। সার্জেন্টরা কেমন সুন্দর ভট ভট করে ঘুরে বেড়ায়, না বাবা?
কিন্তু মন্টুর বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছ। সে হঠাৎ পিছন ফিরে মুখটা নীচের দিকে নিয়ে কামানের মতো হয়ে বললে, বাবা, এই দ্যাখো?
দেখতে পাওয়া গেল, তার পেছনটা ছিড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, বাঃ বেশ তো হয়েছে, মন্টুবাবুর যা গরম, এবার থেকে দুটি জানালা হয়ে গেল বেশ তো হল। এবার থেকে হু হু করে বাতাস আসবে আর যাবে, চমৎকার, না।
মন্টু সকল ত্রুটিবিচ্যুতি ভুলে বুদ্ধিমানের মতো হেসে উঠল; নারু তার ভাঙা দাঁত বের করে আরও বেশি করে হাসতে লাগল, বাবাও সে হাসিতে যোগ দিলেন। আমাদের সামান্য বাসা এক অসামান্য হাসিতে নেচে উঠলে, গুম গুম করতে লাগল।
হাসলাম না কেবল আমি। শুধু মনে মনে উপভোগ করলাম। ভাবলাম আনন্দের এই নির্মল মুহূর্তগুলি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে খুশির আর অন্ত থাকে না। মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে।
বাবার পরবর্তী অভিযান হল রানাঘরে। একখানা সিঁড়ি পেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হাসিমুখে বাবা বললেন,—আজ কী রাঁধবে গো?
মুখ ফিরিয়ে অজস্র হেসে মা বললেন, তুমি যা বলবে? বাবাকে এবার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল—আমি যা বলব, ঠিক তো? বলি, রাঁধবে মাংস, পোলাও, দই সন্দেশ? রাঁধবে চাটনি, চচ্চড়ি, রুই মাছের মুড়ো? রাঁধবে? রাঁধবে আরও আমি যা বলব?
—ওমা গো, থাক থাক, আর বলতে হবে না। মা দুই হাত তুলে মাথা নাড়তে লাগলেন, খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ব্যাপার দেখে নারু দৌড়ে গেল, দুজনের দিকে দুইবার চেয়ে তারপর মাকে মুচকে হাসতে দেখে বললে, মাগো কী হয়েছে? অমন করে হাসছো কেন? বাবা তোমায় কাতুকুতু দিয়েছে?
-আরে, নারে না, অত পাকামি করতে হবে না। খেলগে যা—
বাঁ হাত তুলে মা বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলেন।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বাবা আবার বললেন, আচ্ছা তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা মনে পড়ে?
একটু চিন্তা না করে মা বললেন, আমার ওসব মনে-টনে নেই?
-আহা, বিলের ধারে মাঠে সেই যে গোরু চরাচ্ছিলে?
মার চোখ বড়ো হয়ে গেল—ওমা, আমি কী ভদ্দরলোক নই গো যে মেয়েলোক হয়েও মাঠে-মাঠে গোরু চরাব?
—গোরু চরানোটা কী অপরাধ? দরকার হলে এখানে সেখানে একটু নেড়েচেড়ে দিলে দোষ হয়? আসল কথা তোমার সবই মনে আছে, ইচ্ছা করেই কেবল যা-তা বলছ?
-হ্যাঁ গো হ্যাঁ, সব মনে আছে, সব মনে আছে।
মৃদু মৃদু হেসে বাবা বললেন, নৌকা থেকেই দেখতে পেলাম বিলের ধারে কে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার রাত্রে একটি মাত্র দীপশিখার মতো; নৌকো থেকে নেমেও দেখলাম, সেই মেয়ে তার জায়গা থেকে এতটুকুও সরে দাড়াচ্ছে না বা পাখির মতো বাড়ির দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে না, বরং আমাদের দিকে সোজাসুজি চেয়ে আছে, অপরিচতি বলে এতটুকু লজ্জা সেই, কাছে গিয়ে দেখলাম ঠিক যেন দেবী প্রতিমা, খোলা মাঠে জলের ধারে মানিয়েছে বেশ। গভীর বর্ষায় আরও মানাবে। তারপর এক ভাঙা চেয়ারে বসে ভাঙা পাখার বাতাস খেয়ে যাকে দেখলাম সে-ও সেই একই মেয়ে। কিন্তু এবার বোবা, লজ্জাবতী লতার মতো লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
বাবা হা-হা করে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন। কততক্ষণ পরে বললেন, তোমার কী চাই–বললে না?
আমার জন্য একখানা রান্নার কাপড় এনো।
–লাল রঙের?
–হ্যাঁ।
তারপর কার জন্যে কী এনেছিলেন খবর রাখিনি, কিন্তু নিজের জন্যে ছ-আনা দামের এক জোড়া চটি এনেছিলেন দেখেছি। মাত্র ছ-আনা দাম। বাবা এ নিয়ে অনেক গর্ব করেছেন, কিন্তু একেবারে কাঁচা চামড়া বলে কুকুরের আশঙ্কাও করছেন।
কুকুরের কথা জানিনে, তবে কয়েকদিন পরেই জুতো জোড়ার এক পাটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল কেউ বলতে পারে না। আশ্চর্য!
পরদিন দুপুরবেলা রেলওয়ে ইয়ার্ডের ওপর দিয়ে যেতে যেতে কার ডাকে মুখ। ফিরে তাকালাম। দেখি। শশধর ড্রাইভার, হাত তুলে আমার ডাকছে। এখানে ইউনিয়ন করতে এসে আমার একেবারে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই শশধর ড্রাইভারের সঙ্গে। সেদিন সঙ্গে কমরেড বিশ্বনাথ ছিল। তখন গভীরভাবে শশধর বলেছিল, দেখুন বিশ্ববাবু, সায়েব সেদিন আমায় ডেকেছিল।
-কেন?
-শালা বলে কি না, ড্রাইভার, ইউনিয়ন ছেড়ে দাও। নইলে মুস্কিল হবে। বলছি। শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মুখের ওপর বলে এলাম, সায়েব আমার ইচ্ছে আমি ইউনিয়ন করব। তুমি যা করতে পারো করো। এই বলে তখুনি ঠিক এইভাবে চলে এলাম। আসবার ভঙ্গিটা দেখবার জন্যে শশধর হেঁটে অনেকদূর পর্যন্ত গেল। তারপর আবার যথাস্থানে ফিরে এল।
আমার প্রথম অভিজ্ঞতায় সেদিনের দৃশ্যটি আমার চমৎকার লেগেছিল। আমার এই মধ্যাহ্নের ট্রাকটর-স্বপ্নের ভিত পাকা করতে আরম্ভ করলাম সেদিন থেকে। একদা বলাই বাহুল্য যে ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলাম। আমি হাত প্রসারিত করে দিলাম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলাম। তাদেরও ধন্যবাদ, যারা আমাকে আমার এই অসহায়তার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।
বিকেলের দিকে আমি শশধরের কাছে গেলাম। শশধর বললে, উঠুন।
সে আমাকে তার ইঞ্জিনে উঠিয়ে নিলে। তারপর একটা বিড়ি হাতে দিয়ে বললে, খান, সুকুমারবাবু।
বিকেলের দিকে একটা গ্যাঙের দিকে দেখা করতে গেলাম। একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করবার ছিল। ওরা আমার দিকে কেউ তাকাল কেউ তাকাল না। অদূরে ইঞ্জিনের ঝাঁ ঝাঁ সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে। পয়েন্টসম্যান—গানারদের চিৎকার আর হুইসিল শোনা যাচ্ছে।
ইয়াসিন এতদিন পরে ছুটি থেকে ফিরেছে দেখলাম। আমাকে দেখে কাজিয়া থামিয়ে বললে, ওরা কী বলছিল জানেন?
হেসে বললাম, কী?
-বলছিল আপনি একটা ব্যারিষ্টার হলেন না কেন?
সকলে হো হো করে হেসে উঠল, আমিও হাসতে লাগলাম। মেট সুরেন্দ্র গম্ভীরভাবে বললে, তোমার কাছে আমাদের আর একটা নিবেদন আছে, ইয়াসিন মিঞা! আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে তোমায় ইস্কুলে পড়াতে চাই!
এবারে হাসির পালা আরও জোরে। কাজ ফেলে সবাই বসে পড়ল।
ইয়াসিন রেগে গেল, বললে, বাঃ, বাঃ বাঃ খালি ঠাট্টা আর ঠাট্টা, না? চারটে পয়সা দিয়েই খালাস না? চারটে পয়সা দিলেই বিপ্লব হবে, না? বিপ্লব আকাশ থেকে পড়বে না?
-একটু শান্ত হয়ে ইয়াসিন শেষে একটা গল্প বলল।
গল্পটি হচ্ছে এই : সে এবার বাড়ি গিয়ে তার গাঁয়ের চাষিদের একটা বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। সেই বৈঠকে যে লোকটা বক্তৃতা করছিল সে হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বললে, ভাই ইয়াসিন, তোমাদের ওখানে ইউনিয়ন নেই? ইয়াসিন বুক ঠুকে বললে, আলবৎ আছে! এবং সঙ্গে সঙ্গে বুক পকেট থেকে একখানা রসিদ বের করে দিল লোকটি তখন ভয়ানক খুশি হয়ে বলেছিল, তুমি যে আমাদের কমরেড, ভাই ইয়াসিন! তুমি যে আমাদেরই, ইয়াসিন তখন বিচক্ষণের মতো হেসেছিল। —দুনিয়ার সবাই এরকম জোট হচ্ছে, আর আমরাই কেবল চুপ করে বসে থাকব না? চারটে পয়সা দিলেই খালাস, না? বলতে বলতে ইয়াসিনের ঘর্মাক্ত মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে কাজে লেগে গেল গম্ভীর মনোযোগের সঙ্গে ঠকঠক শব্দ করে তার কাজ করতে লাগল।
আমি ফিরে এলাম। সাম্যবাদের গর্ব, তার ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে ফিরে এলাম। এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ঝির ঝিরে বাতাসের সঙ্গে শেডঘর থেকে তেল আর কাঁচা কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ আসছে বেশ। আমি বাঁ-দিকে শেড-ঘর রেখে পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। একটু এগিয়ে দেখি লাইনের ওপর অনেকগুলি ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় গভীর ধ্যানে বসেছে যেন। আমার কাছে ওদের মানুষের মতো প্রাণময় মনে হল, এখন বিশ্রাম করতে বসেছে। ওদের গায়ের মধ্যে কত রকমের হাড়, কতো কলকবজা, মাথার ওপর ওই একটিমাত্র চোখ, কিন্তু কতো উজ্জ্বল। মানুষ ওদের সৃষ্টিকর্তা। হাসি নেই, কান্না নেই, কেবল কর্মীর মতো রাগ। এমন বিরাট কর্মী পুরুষ আর আছে। সত্য কথা বলতে কী, এত কলকবজার মাঝে, এতগুলি ইঞ্জিনের ভিতর দিয়ে পথ চলতে চলতে আমার শরীরে কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। আমি হতভম্ব হয়ে তাদের মাংসহীন শরীরের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
তারপর সন্ধ্যার অনুকূলে বাসায় ফিরলাম। কয়েকদিন পরে কোনো গভীর প্রত্যুষে একটি ইঁদুর মারা কল হাতে করে আমার বাবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে লাগলেন। দারুণ খুশিতে নারু আর মন্টুও দুই আঙুল ধরে বানরের মতো লাফাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পরেই আরও অনেক ছেলেপেলে এসে জুটল।
একটা কুকুর দাঁড়াল এসে পাশে। উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে যারা সাহসী তারা কেউ লাঠি, কেউ বড়ো-বড়ো ইট নিয়ে বসল রাস্তার ধারে।
ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।
একটি রাত
রাস্তায় লোকজন একটিও নেই। এখন আশ্বিনের শেষ, তাই একটু শীতের আমেজ লাগে। সুকুমার তার জামার কলারটি আরও টেনে ধরল। নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়েও সে শুনতে পেল, একটা বিড়াল মিউ মিউ করে কাতরস্বরে ডাকছে, হয়তো হঠাৎ কোনো খোলা ড্রেনে পড়ে স্নান করে উঠেছে। তা ছাড়া ড্রেনের গন্ধও নাকে আসে। রাত্রির নিস্তব্ধতা দিনের বেলার চেয়েও তীব্র। দূরে একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করে জ্বলছে। পাশেই একটা দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়া।
সে পুরোনো বাড়িটার একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে সুকুমার থাকে, সামনেই তার মস্ত বড়ো গেট, প্রায় অর্ধেকটা ভাঙা। সর্বাঙ্গ লোনায় ধরেছে। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে সুকুমার দেখল, লম্বা একটা লোক হঠাৎ কোথায় সাপের মতো সরে পড়ল। লোকটা কে সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এদের ছায়া দেখলেও চিনতে কষ্ট হয় না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সুকুমার বাড়ি ঢুকে পড়ল। ভিতরে মার কাশির শব্দ শোনা যায়, সেই কাশি। সুকুমার ডাকলো, মা? মার বদলে ভোলা এসে হাজির হল।
ভোলা সুকুমারের কুকুর।
কিন্তু একটা সামান্য কুকুরের আগেও ছেলের ডাক না শোনার এই অক্ষমতায় লজ্জিত হয়ে মা চেঁচিয়ে উঠল—যা এখান থেকে, কেবল পায়ে পায়ে হাটে। কতবার বলি, আমার বাপু এসব ঘেন্না করে, তবু। মা আর বলতে পারল না, দরজা খুলে দিয়ে যেন নিষ্কৃতি পেল। তার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কখুস্ক, মুখে একটা অসাধারণ কাঠিন্যের ছাপ, চোখে একটা অদ্ভুত কাতরতা। ভ্রূ কুঁচকে সে কুকুরটার কান্ড দেখল। সুকুমারের বুকে সে শিশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার সমস্ত শরীরটাকে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে শুকছে। সুকুমার বললে, আরে, দাঁড়া, দাঁড়া, আগে ঘরে ঢুকতে দে।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে মা আলো হাতে সটান ঘরের দিকে গেল। ভিতরে এই গলির ঠাণ্ডা আর ভারী, চারিদিকে কেমন একটা পচা আবর্জনার গন্ধ।
ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় ছেড়ে সুকুমার তক্তপোষের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ভোলাও তার বুকের ওপর মুখ রেখে গা চাটবার চেষ্টা করল। তার কান দুটি নিয়ে খেলা করতে করতে সুকুমার হঠাৎ বললে, এবেলা কী বেঁধেছো মা? কোনো উত্তর নেই। বোঝা যায়, বাইরে অন্ধকারে কোথাও সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।
সুকুমার আবার ডাকল, মা?
কিছুক্ষণ পরে ভারী অস্পষ্ট গলায় উত্তর এল, তুই এখন খাবিনে সুকু? দেখল, অন্ধকারে দেয়ালে হেলান দিয়ে নীরবে সে দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমার বললে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন মা? বাইরে যে হিম পড়ছে।
-কোথায় হিম! ব্যঙ্গের সুরে সে বললে, যা গরম পড়েছে!
এই বলে পরক্ষণেই আবার অন্ধকূপের মতো রান্নাঘরে ঢুকে ভাত বেড়ে ডাকল, খেতে আয়।
সুকুমারের পেছনে পেছনে ভোলাও ঢুকছিল। এবার চুপ করে থাকা যায় না। মা চীৎকার করে উঠল : ঢের হয়েছে বাপু, শোবার ঘর এমন কী বিছানা পর্যন্ত তো হয়েছে, এখন খাবার ঘরটা থাক!
সুকুমার হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে ভোলাকে লক্ষ করে বললে, যা, এখান থেকে, দুর হয়ে যা, পাজী কুকুর কোথাকার—আমাদের জাত ধর্ম খুইয়ে ছাড়বি দেখছি!
একটু একটু করে খানিকটা এগিয়ে পেছিয়ে গিয়ে ভোলা এখন অন্ধকারে শুয়ে পড়ল! অনেক আগেই তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। ওপরের ঘরের মাতাল দীননাথ চক্রবর্তীর মেয়ে বীণা কয়েকদিন ধরে তাকে রোজ খাইয়ে দেয়। কিন্তু এ ইতিহাসের বিন্দুবিসর্গও সুকুমার জানে না।
খাওয়া-দাওয়া পরে সুকুমার একটা বই খুলে বসল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সারাদিনের পরিশ্রমে চোখ তার জড়িয়ে এল। বইটা পাশে সরিয়ে রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
মা এবার ছেলের পাশে বসল। ছেলের নিদ্রিত মুখের দিকে চেয়ে চোখের দৃষ্টি তার অদ্ভুত নরম হয়ে এসেছে।
সে তার দেহে গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তার নিজের ফ্যাকাসে বর্ণহীন চোখেও একরাশ অশ্রু জমা হয়েছে, একটু পরেই বাঁধ ভেঙে হয়তো বইতে থাকবে।
ওদিকে ওপরের ঘরে বসেও দুই করুণ চোখে যে মেয়েটি রাত জাগছে সে। বীণা। কার জন্যে এই রাত জাগা? অন্তত তার বাবার জন্যে যে নয়, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে। দীননাথ ঘোর মাতাল, বুড়ো হবার আগেই গোরুর মতো শান্ত বউটাকে লাথি-গুঁতো মেরে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে। এখন বউর অভাবে বাইরে রাত কাটিয়ে আসে। সুতরাং, দীননাথ চক্রবর্তীর একমাত্র মেয়ে বীণা তার অপেক্ষায় যে রাত জাগে না, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে।
কিন্তু এতক্ষণে সে আলোটা নিভিয়ে দিল।
সুকুমারের ঘরের ওপর নিবদ্ধ দৃষ্টিকে এতক্ষণে সে অন্ধকারে ঠেলে দিল একটা কুকুরের মতো কুঁকড়ে শুয়ে অনেক আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।
এখন সমস্ত বাড়িটাই বিদেশে প্রথম আসা কোনো মূঢ় বালকের মতো স্তব্ধ। অন্যান্য ভাড়াটেদের তো অর্ধেক রাতের ঘুম হয়ে গিয়েছে। তারা সারাদিন একমুষ্ঠি অপ্রচুর অন্নের জন্যে দেহের রক্ত জল করে বাড়ি ফেরে, তারপর সন্ধ্যার পরেই খেয়ে দেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, সবগুলি ছেলেমেয়েকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয়ার অবসরও তাদের নেই, তার আগেই তাদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। তারপর সেদিন যা একটা কান্ড ঘটল, তা যেমন হাস্যকর, তেমনি করুণ। সকলের শেষে কলতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে থাকে নকুল, সে কোনো এক বইয়ের দোকানে কাজ করে। তার শরীরটা এত মোটা, ভারী আর লম্বা যে হঠাৎ দেখলে কোনো কাল্পনিক দৈত্যের কথা মনে হয়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু ঘরে একপাল ছেলেমেয়ে, তার বউ চিরটাকাল কেবল ছেলেমেয়ে প্রসব করে, তারপর একদিন হঠাৎ বলা-নেই-কওয়া-নেই মরে গেল। নকুল তখন আর কি করবে? সে তখন আর এক দরজা দিয়ে কোনো এক গাঁয়ে মেয়ে দেখতে চলে গেল। যখন ফিরে এল, তখন তার গায়ে সিল্কের জামা পরনে নকশি পাড়ের ধুতি, পয়ে চকচকে পাম্পসু, মুখে সিগারেট আর একরাশ পান, আর তার পেছনে দুই হাত লম্বা একটি বউ, তার আড়াই হাত ঘোমটা। কাপড়টুকু ভালো করে পরতে জানে না, কোমরের নীচে দেহের প্রস্থটুকু কাঠির মতো সরু। সেদিন রাত্রে এই বউটিই হঠাৎ ভীষণ চীৎকার করে কেঁদে উঠল, তারপর বাকি রাতটুকুও শূকরের মতো চি-চি করে কেঁদেছিল। বাস্তবিক এমন কান্ড কমই দেখা যায়। তখন এই গল্প নিয়ে বাড়ির অন্যান্য বন্ধু আর মেয়েদের ভিতরও একটা খোরাক জুটেছিল মন্দ নয়, তারা এই নিয়ে অনেক বলাবলি অনেক ফিসফাস করছে।
দূরে গির্জার দড়িতে একটা বেজে ফেল। দীননাথ এখনও ফেরেনি। বীণা আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে সুকুমারও গভীর ঘুমে অচেতন কিন্তু মা-র ঘুম কখনো গভীর হয় না। সে কেবল শুয়ে থাকে মাত্র। মাঝে মাঝে জেগে কাশতে থাকে। এই মাত্র সে কেঁদে একটু চোখ বুজেছে, এখনও কান্নার ছাপে অপরিচ্ছন্ন আর বিকৃত তার মুখ। সুকুমার তাকে আর কত কাঁদাবে?
সুকুমারের কাছে কত লোক যায় আসে তার ইয়ত্তা নেই। সারাদিন ডাকাডাকি লেগেই আছে। সর্বদা যারা আসে তাদের গ্লাস-ওয়ার্কসের সামসুর একজন। তার চোখ আর চুল—দুই-ই কটা, চোখে-মুখে সর্বদাই একটা খুশি ঝরে পড়ে। এই সামসুর ছাড়া আরও অনেকেই আসে। তাদের কারোর বয়স চোদ্দো, কারোর বয়স চল্লিশ; যার বয়স চোদ্দো, তার নাম অনিল। এদের নিয়ে মাঝে-মাঝেই জটলা করে সুকুমার, সকলে মিলে রুদ্ধ ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। রাশিয়া, লেলিন ইত্যাদি দুই-একটি পরিচিত কথা ছাড়া মা এদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না।
একদিন একটা ব্যাপার ঘটল চমৎকার। সুকুমার হঠাৎ সামসুরকে লক্ষ করে বললে, একা-একা বিড়ি খাচ্ছেন! দিন একটা? সামসুর অমনি মেঝের ওপর একটা বিড়ি ফেলে দিল। এবং সেই বিড়িটা জ্বালিয়ে সুকুমারের কী সহজ স্বচ্ছন্দ টান।
ব্যাপার দেখে মা-র দুই চক্ষু স্থির। আর কখনো সে তাকে বিড়ি বা সিগারেট টানতে দেখেনি। তার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে এল।
হা-হা করে হেসে সুকুমার বললে, দেখুন মা কেমন রেগেছে! …সুকুমার তার হলদে দাঁতগুলি বের করে হাসল।
সুরেন মুখ বাড়িয়ে বললে, আমাদের দোষ নেই, মা! মা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, উঁহুঁ তোমাদের কিছু দোষ নেই, তোমরা সব শান্ত সুবোধ বালক! তারপর সুকুমারের দিকে লক্ষ করে তোরা মনে করিস আমি কিছুই বুঝিনে। কিন্তু আমি সব বুঝি, সব বুঝি!
এই শুনে সকলেই হেসে উঠল। সুরেনের গলাটাই শোনা যায় সবচেয়ে বেশি। সে আস্তে কথা বলতে পারে না। যত বাজে বা হাস্যকর কথাই হোক সকলের
দৃষ্টি আকর্ষণ করে তবে সে কথা বলবে। জামার বোতাম তার কোনো কালেই থাকে না। তবু বোতাম লাগানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে সে বললে, কী বোঝেন, বলুন, আমরা সবাই শুনি।
মা তার দিকে একদৃষ্টে চাইল, এই মধুর স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় মুখের কাঠিন্য চেষ্টা করল দূর করতে, কিন্তু চেষ্টা করেও যেন পারল না।
সুকুমার বললে, বুঝবে না। আপনারা পাভেলকে জানেন?
–পাভেল?
—সে কী, গোর্কির মা পড়েননি?
—হুঁ, পড়েছি, পড়েছি।
–ইনিও সেই পাভেলের মা, সেই মা! সুকুমার মা-র দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। এর কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকদিন পরে মা একখানা বই খুলে বসল। বইটা পড়ে তার এত ভালো লেগে গেল যে ওদিকে যে নটা বেজে গেছে, সেদিকে তার এতটুকু খেয়াল নেই। এক সময় কুকুরটার কলরবে বই-এর প্রতি তার মনোযোগ কিছুক্ষণের জন্যে ভেঙে ছিল বটে, কিন্তু একটু পরেই আবার সে পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছিল। ভাবল, ছেলের আসতে এখনও দেরি, রাত এগারোটার আগে সে কখনো আসে না। কিন্তু সেদিন সুকুমার হঠাৎ এসে পড়ল। দরজা খোলা পেয়ে এত চুপি চুপি সে আসতে পেরেছিল যে, ভোলা একবার আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও বইটি তাড়াতাড়ি লুকোনোর অবসর মা পায়নি।
তার হাতে বই দেখে সুকুমার বিস্মিত। জামা-কাপড় খুলতে খুলতে সে বললে, ও কী বই পড়ছে, মা! ভ্রূ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে—কিন্তু বোকার মতো একবার হেসে মা বললে, কেন, তোরা পড়িস আমরা পড়তে পারিনে? আমাদের পড়ায় দোষ আছে নাকি?
বই-এর মলাট দেখেই সুকুমার চিনতে পেরেছে।
ভয়ানক খুশি হয়ে সে বললে, তুমিও এই বই পড়ছো, মা? দোষ আছে কে বললে? কিছু দোষ নেই। তুমি সত্যি সত্যি পাভেলের মা হতে পারবে। আমি অবশ্যি পাভেলের মতো হতে এখনও পারিনি। তবে হব।–
সুকুমার মাটির ওপর শুয়ে পড়ল, মার কোলে মাথা রেখে বললে, মাথায় একটু হাত দাও না, মা? পিঠেও একটু হাত বুলিয়ে দেবে?
—বারে আমি পড়ব না বুঝি?
সুকুমার আশ্চর্য হয়ে গেল, এমন সহজ চাপল্য-ভরা কথা সে অনেকদিন শোনেনি।
কিন্তু ছেলের মুখের দিকে চেয়ে পরক্ষণেই মা-র মুখ কঠিন হয়ে এসেছে, মনে হল যেন একটা ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছে সে, দোষের চারপাশের চামড় তার কুঞ্চিত হয়ে গেল, তীক্ষ্ণ নাক আরও তীক্ষ্ণ হয়ে এল, বইটে পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে সে ভারী গলায় বললে, দাঁড়া, দিচ্ছি।
মা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু গভীর নয়—গভীর ঘুম তার কখনো হয় না–তন্দ্রার মতো খানিকটা। তার গলার খর খর শব্দ বেশ শোনা যায়, হয়ত এখুনি উঠে কাশতে বসবে। চোখের জল এখনও শুকোয়নি।
ওদিকের বারান্দায় একটি কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপরে পড়ে ভোলা ঘুমুচ্ছে। কোথায় একটু খর খর শব্দ শুনে একবার চোখ মেলে চাইল।, বাক্স থেকে নেমে এদিক-ওদিক একটু হাঁটাহাঁটি করল, তারপর বাক্সের ওপর উঠে আবার শুয়ে পড়ল। বারান্দায় ওদিকটায় শুয়ে-শুয়ে সেখানে কেমন গন্ধের সৃষ্টি করেছে
তার এই বাসায় স্থানলাভের ইতিহাসটা কিছু বিচিত্র। তখন একদল বিদেশি সৈন্য শহরের প্রান্তে আস্তানা গাড়ছে। তাদের সঙ্গে জিনিসপত্রের অন্ত নেই। নদীর পার থেকে খচ্চরের গাড়িতে বোঝাই হয়ে সেগুলি যথাস্থানে যাচ্ছিল!—
সৈন্যগুলি খুব লম্বা আর খুবই জোয়ান, পায়ে লোহার মতো বুটের জুতো, গায়ে খাকি শার্ট, গলার আওয়াজ মরচে-পড়া লোহার মতো কর্কশ, তাদের কথাগুলিকে মনে হয় যেন ইস্পাতে ইস্পাতে ঠোকাঠুকি করে মরছে। তাদের দেখে রাস্তার পাশে লোক জমে গেল, মাথার ওপরে আগুনের মত রৌদ্রকেও উপেক্ষা করে তারা বিস্ময়ে তাদের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। কোনো একটা কাজে এসে রাস্তা বন্ধ দেখে সুকুমারও সেই জনতার ভিতর দাঁড়িয়েছিল। তখন খচ্চরের গাড়িগুলি বিপুল ঝন ঝন শব্দ করে রাস্তা দিয়ে চলছে, প্রত্যেকটি গাড়ির সামনে আর। পেছনে কিছু কিছু সৈন্য। এমন সময়ে হঠাৎ একাট কাতর কুঁই কুঁই শব্দে সকলে বিস্ময়ে চেয়ে দেখল, ছোট বাদামি রঙের একটা কুকুর-তার গলাটি গাড়ির ওপরে ভারী কলের সঙ্গে একটা সরু দড়ি দিয়ে বাঁধা—খচ্চরের পায়ের তলায় কয়েকবার এদিক-ওদিক হয়ে রাস্তার এই পাশে ঠিকরে পড়ে কাৎরাচ্ছে। ব্যাপার দেখে রাস্তার দুইপাশের লোকগুলির চোখ আতঙ্কে বড়ো হয়ে গেল, সকলেই একসঙ্গে ইস শব্দ করে দুঃখ প্রকাশ করল, তারা অনুমান করল যে, কুকুরটা নিশ্চয় গাড়ির নীচে চাপা পড়েছে। একটু পরেই কাতরাতে কাতরাতে মারা যাবে।
কিন্তু কুকুরটা নেহাতই নাছোড়বান্দা, তার মরবার সম্ভাবনা যদিও সম্পূর্ণই ছিল, তবু সে মরল না। গাড়িটা তখন চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও হেঁচড়াচ্ছে।
এমন সময় একটা সৈন্য এসে দড়িটা ছিড়ে তাকে পাশে ফেলে দিল। সুকুমার দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে করে নিয়ে এল। দুপুরের রৌদ্র আগুনের মতো গায়ে বিধছিল, জনতার চাপে গরম আরও বেশি, সৈন্যগুলির উৎকট ঘামের গন্ধে চারিদিকের বাতাস ভরপুর। সুকুমারের বুকের কাছে মুখ রেখে বাচ্চা কুকুরটা চিঁ চিঁ করে কাঁদতে লাগল। রাশি রাশি লোমের উষ্ণতা সুকুমারের গায়ে লাগছে।
তার নামকরণ করা হয়েছে ভোলা। ভোলা এমন অনেক বড়ো হয়েছে। একলাই নির্ভয়ে এদিক ওদিক বেড়িয়ে আসে, তার দাপটে এখন মানুষও ভয় পায়, অনেক কুকুরও লেজ তুলে দৌড় দেয়। কিন্তু সুকুমার তাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছেঃ দ্যাখ কুকুর পোষাটা নিতান্তই বড়লোকি ব্যাপার কিন্তু আমি গরিব। একবেলা ভাত জোটে তো আর একবেলা জোটে না। আমি যা খাই, তুইও তাই খাবি। তাতে বাঁচতে হয় বাঁচবি, না হয় মরবি। বুঝলি?
এই ভোলা একদিন এদিক-ওদিক ঘুরে অনেক চিন্তা করে আস্তে আস্তে ওপরের ঘরের কাছে বারান্দাটিতে গিয়ে হাজির হল। বীণা শুয়ে-শুয়ে একটা বই পড়েছিল। তাকে দেখে নেমে এসে নিতান্ত আপনার জনের মতো বললে এখানে কেন? নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলি, আমি আজ মাংস বেঁধেছি? (দীননাথ মদ যেমন নিত্যই খায়, মাংস তেমন প্রায়ই আনে) খাবি?
ভোলা এখানে ওখানে হুস হুস করে অনেক শুঁকলো;তারপর ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে লেজ নাড়তে লাগল।
বীণা একটা অদ্ভুত মমতা বোধ করল এই কুকুরটার ওপর। সুকুমার ঘরের দিকে একবার চেয়ে বললে, ভাল লোকের হাতেই পড়েছিস, নিজরে শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেই ওই পাশে গদাধরের স্ত্রীকে বীণা দেখে বীণা থেমে গেল, হঠাৎ রেগে বললে,–
—যা এখান থেকে, যা বলছি, একেবারে ওপরে এসে হাজির হয়েছেন, ভারী ইয়ে আমার! যা এখান থেকে, যা বলছি। ও মাসিমা আপনাদের কুকুরের কান্ড দেখেছেন? বীণা তাকে তাড়া দিতে দিতে একেবারে নীচে নিয়ে গেল, রান্নাঘর থেকে কিছু মাংস নিয়ে তার পায়ের কাছে ফেলে চুপি চুপি বললে, মা!– তাকে খেতে দিতে গিয়ে সুকুমারের কথা মনে করে বীণার মুখ লাল হয়ে গেল।
কয়েকদিন পরে। বীণা নাক সিঁটকিয়ে বললে, তোর গায়ে কী গন্ধ রে! একদিনও চান করিস না বুঝি? কেউ তোকে চান করিয়ে দেয় না, না? দেবে কী, নিজের শরীরের দিকেই নজর দেয়ার সময় যার নেই— তারপর বীণা চারদিকে চেয়ে নিজের কথাটাকে অর্ধ সমাপ্ত রেখেই একটা সাবান নিয়ে বসে গিয়েছে, তাড়াতাড়ির মধ্যে যতটা পারা যায় তাকে ধুইয়েছে, বোয়াবার সময় তার সেমিজ ঘামে ভিজে গেল।
বেলা তিনটের পরে সুকুমারের ঘরের কাছে গিয়ে ডাকল, মাসিমা?
মা চোখ বুজে শুয়ে ছিল, মেয়েটার ডাক শুনে চোখের পাতার নীচে তার চোখের মণিও কুটিল হয়ে উঠেছে, সে ইচ্ছা করেই কোনো সাড়া দিল না।
বীণা তবু ঘরে ঢুকে মাকে ঘুমুতে দেখে নিঃশব্দে জানালার তাকের কাছে গেল, একটা মোটা বই খুলে সেটা নাকের কাছে ধরে একটু এঁকে আবার বাইরে এসে ভোলাকে লেজ নাড়তে দেখে বললে, তা হলে আমিও শুয়ে থাকিগে কী বলিস? কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকা—কিন্তু মনে মনে বললে, সুকুমারের কাজের কি শেষ নেই?
অনেক রাতে ভোলার গায়ে সুগন্ধি সাবানের গন্ধ পেয়ে সুকুমার বলছিল, মা, তুমি কি আজ ওকে চান করিয়ে দিয়েছ?
মার চোখ তখন ছোটো হয়ে গেল; গলার ভিতর একটা খুশ খুশ বোধ করছিল, কাশতে কাশতে তারমুখ লাল হয়ে গেল, চোখ দুটি যেন ছুটে বের হয়ে আসতে চায়, তবু সে বলল, আমাকে একটা ওধুষ এনে দিবি, সুকু?
কেরোসিন কাঠের ওপর ভোলা তেমনি ঘুমুচ্ছে, এখন রাত দুটোর কম নয়। ভাঙা কলতলায় সঞ্চিত উচ্ছিষ্ট ভাত, পচা ডাল, তরকারি আর মাছের কাঁটার দুর্গন্ধকে ক্ষীণ বাতাসও বয়ে আনে। দেয়ালের কোণ ঘেঁসে মালপত্র ডিঙিয়ে ছোটো-বড়ো অনেক দুর এখানে সেখানে আসা যাওয়া করে, তাদের খুট খুট আওয়াজ শোনা যায়।
এমন সময় দীননাথ এসে জড়িতস্বরে ডাকল,-বীণা, ও বীণা? কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের মনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগল, বীণা? ও বীণাপাণি, একবারটি দরজা খোল মা? তোর বজ্জাত মা-মাগীর মতো তুইও আমায় সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি কী? দরজা খোল, মা?
বীণা নিঃশব্দে এসে দরজা খুলে দিল, মদের তীব্র গন্ধ সইতে না পেরে নাকে কাপড় চেপে একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
কিন্তু দীননাথকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানায় আশ্রয় দিতে রাত চারটের আর বাকি থাকে না। নাকে মুখে কাপড় দিয়ে বীণা শুয়ে পড়ল।
এদিকে কিছুক্ষণ পরেই আবার সুকুমার ঘুম থেকে উঠে বসল, কিছুক্ষণ অর্ধনিমীলিত চোখে চেয়ে বসে তারপর আলো জ্বালিয়ে একটি বই খুলে বসল। বইখানা রালফ ফক্স-এর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক নীতি। সুকুমার পড়তে লাগল—সাম্রাজ্যের রাজধানী আড়ম্বরপূর্ণ দিল্লি নগরী তার প্রয়োজনাতিরিক্ত জাঁকজমকময় প্রাসাদগুলি নিঃসম্বল কৃষকদের শোষিত অর্থে নির্মিত। দুইটি শাসন পরিষদ, রাজন্য পরিষদ মন্ত্রীবৃন্দ ও সেক্রেটারী গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও শাসন সংস্কার ও নিয়মতান্ত্রিক সুবিধা সত্ত্বেও ভারত সরকারের ভিত্তি ১৮৫৭ সনের মহাবিদ্রোহের পরে ১৮৫৮ সালে যাহা স্থাপন করা হইয়াছিল ঠিক সেই অবস্থায়ই আছে..সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে এই ছাপার অক্ষরগুলি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যায়, অথবা যেন খুব দীর্ঘ হয়ে তাড়া করে মারতে আসে; বা বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে এক ঝাঁক সৈন্য, চমৎকার এক-একটি বলির পাঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা এও মন হয়, এক বিশাল মরুভূমি, তার মাঝখানে পাঠশালার মতো সরু জোড়া জোড়া ঠ্যাং-এ ভর করে বড়ো মাথাওয়ালা একদল লোক, বালির ভিতর মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে।
এরা কে! সুকুমার একটু নড়ে চড়ে বসে চোখ ঘষতে লাগল। এখন শেষ রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, একটু পরেই ভোর হবে। দূরে হঠাৎ অনেকগুলি কুকুরের। মিলিত চিৎকারধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, শেষ রাতে পুলিশকে টহল দিতে দেখে তারা নিত্যকার মতোই বিদ্রোহ জানাচ্ছে। ভোলাও সেই শুনে বক্সে থেকে নেমে একবার বারান্দার এপাশে আর ওপাশে ঘুরে আবার স্বস্থানে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওদিকে কলের জল পড়তে শুরু করেছে। প্রকান্ড চৌবাচ্চায় গপ গপ শব্দ হচ্ছে। ওটা যেন পড়বার জন্যেই প্রস্তুত থাকে এবং চিরকালই পড়তে থাকবে এইভাবে।
বাইরে কিছু কিছু কুয়াশা পড়ছে, কোনো গাছের চারিদিকে একটা মোটা আংটির মতো মনে হয়, বাড়ির সামনের আঙিনায় যে শেফালি গাছটি একটা ছোলা মুরগির মতো আজও বেঁচে আছে, তার অবশিষ্ট কয়েকটি ডাল থেকে কিছু ফুল একটি করে আঙিনার কর্কশ শরীরে ঝরে পড়েছে। এমন সময় বাইরে হঠাৎ একটা গোলমাল, কতকগুলি ভারী পদশব্দ, হিন্দি বাংলায় মিশ্রিত বুলি, দরজার ধাক্কাধাক্কি। লাথির শব্দও শোনা যায়। তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে সুকুমার দ্রুত জানালার তাকের কাছে গেল। ওদিকে মা-ও জেগে উঠেছে। ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করে ভয়ে তার গলা যেন বুজে আসতে চায়। সে বললে, সুকু, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।
-বলো?
–তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।
সুকুমার কী একটা জিনিস তাড়াতাড়ি খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে বললে, বলো।
-ওরা আর একদিন এসে তোকে খুঁজেছিল।
সুকুমার কেবল বললে, ও– তারপর তাক থেকে একটা কাগজের বান্ডিল বার করে তার হাতে দিয়ে বললে, এটা কোথাও রেখে এসো গো।
কাঁপতে কাঁপতে মা অমনি বীণার কাছে গেল, তাকে এখন কত আপনার মনে হচ্ছে। বললে, বীণা, মা, তোর কাছে এটা রাখ।
খানাতল্লাশি হতে বেলা আটটা বেজে গেল।
দারোগা তাঁদের সঙ্গে সুকুমারকে নিয়ে যেতে ভুললেন না। সবই স্বপ্নের মতো মনে হয়। স্বপ্ন যখন ভেঙেছে তখন দেখা গেল, মা-র শুকনো দুইগাল বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। কিন্তু একসময় গলা তার খুশ খুশ করতে লাগল, এমন কাশি যে, চোখ দুটি ছুটে বের হয়ে আসতে চায় যেন, তার কাশি কী ইহজীবনেও আর যাবে না। ওদিকে ভোলাও চি চি করে গোঙাচ্ছে।
মার বীণার অবস্থা আরও মারাত্মক।
সে আজ বাড়ির সকলকে উপেক্ষা করে যেন প্রকাশ্য রাজপথে নেমে এল, সুকুমারের ঘরে ঢুকে দেখল ঘরময় ইতস্তত ছড়ানো নানা জিনিসপত্র, বই কাগজ, সেই রাশি রাশি বই আর কাগজের স্কুপে মুখ গুঁজে বীণার চোখে জল ভরে এল, চুলের খোঁপা তার খুলে গেল, পিঠ থেকে কাপড়ের আঁচল খসে পড়ল।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল পরদিন। সেদিন দুপুরবেলায় ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়ে
গিয়েছে। বিকেলবেলায় তা খানিকটা থামল বটে, কিন্তু বৃষ্টি টিপ টিপ করে পড়তেই লাগল। সেদিনের পাইকারী ধরপাকড়ে শহরে একটা বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে শত শত শোভাযাত্রাকারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখে প্রতিধ্বনি দিয়ে নগরের অনেক পথ অতিক্রম করল। মা বুঝতে পেরেছিল, এরা কারা এবং কেন?
সে ব্যস্ত হয়ে ডাকল, বীণা! ও বীণা!
–বলুন!
–শুনিস!—এই বলতেই সেই কাশি আবার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ওই বীণা এখন কত আপনার।
এক্স-সোলজার
ছোটো দোতালা বাড়ি, তবুও আমাদের পক্ষে বেশি হয়ে যায় বলে নীচের ঘরে। অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় একজন ভাড়াটে আনলাম।
লোকটির নাম শৈলেশ, সঙ্গে স্ত্রী আর চারটি ছেলে-মেয়ে।
যেদিন তারা প্রথম এল তখন রাত্রি, লোকটাকে সেদিন আর দেখিনি। কিন্তু পরদিন কলের পাড়ে মুখ ধুতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম তার চেহারা দেখে। মিশকালো তার গায়ের রঙ, চোখ দুটি বড়ো, লম্বা আর ভয়ানক জোয়ান, সমস্ত গা লোমে ভরতি, মাথায় চুল ওলটানো। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর যা তা হচ্ছে তার গোঁফজোড়া। স্যর আশুতোষেরও বোধ করি এমন গোঁফ ছিল না। নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম, এই ভেবে যে রাতে না দেখে ভালোই করেছি, দেখলে হয়তো মূচ্ছ যেতাম। এখানে বলে রাখা দরকার যে, তাকে যে আমার নীচের ভাড়াটে ঠিক করেছিলাম, আমি নিজে দেখে নয়, কথাবার্তা চলেছিল অন্যের মধ্যস্থতায়, আর সে বাসাও দেখে গিয়েছিল আমার অ-সাক্ষাতেই।
সে যাক।
আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। বাইরেটা দেখে প্রথম যা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই নয়। লোকটা গল্প করতে পারে খুব, যখন একবার আরম্ভ হয় কিছুতেই আর শেষ হয় না। কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে অবস্থা ভালোই মনে হয়।
একদিন রাত্রে নীচ থেকে একটি ছেলের ভয়ানক কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকক্ষণ অমন চিৎকার শুনে আর থাকতে না পেরে বারান্দায় এসে ডাকলাম,—শৈলেশবাবু, ও মশাই—
জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? ছেলেটাকে অত মারছেন কেন?
—আর মশাই! এমন দুষ্টু ছেলে কারোর ঘরে নেই। সন্ধ্যে থেকে বলছি পড়তে বসতে, না, ওর কানেই যায় না। আজ বাদে কাল পরীক্ষা, এখনও পর্যন্ত নাউন কাকে বলে জিজ্ঞেস করলে হাঁ করে বসে থাকে, আবার এদিকে পড়তেও বসে না। তাই এমন রাগ হল যে খুব মার দিলাম।
–তা বলে কি এমনভাবে মারতে আছে?
শৈলেশ চেঁচিয়ে বললেন, কি জানেন, আমরা ওর চেয়ে বড়ো হয়েও বাপের কাছ থেকে অনেক বেশি মার খেয়েছি। এমনকি, হাত-পা বেঁধে পর্যন্ত ঘরের ছাদে ঝুলিয়ে রেখেছে। এত শাসন ছিল। আর সেই শাসন পেয়েই না আজও সবকে ভয় না করে চলি! আমি চাই, আমার ছেলেও তেমনি হোক। লোকে বলুক, হ্যাঁ, এ ছেলে শৈলেশ চক্রবর্তীর নাম রেখেছে বটে।
ছেলেটার কান্নার শব্দ ক্রমে কমে আসছে।
নীচের থেকেই শৈলেশ বললেন, দেখুন, চক্রবর্তী পরিবারের আমরা তখন একটি দুটি নয়, পঞ্চাশটা ভাই ছিলাম। শুনে আশ্চর্য হবেন। আমার বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই, সব একসাথে। আজকালের মতো নাকি যে দুটি ভাইয়েতেও একান্নবর্তী সংসার চলে না? হাঁ, তখন আশেপাশের সমস্ত গাঁ আমাদের নামে ভয় পেত। এত নাম ছিল চারদিকে।
হাসি পেলো খুব, না হেসে বললাম, এখন আপনার আর ভাই সব কোথায় গেল?
এখন কি আর সব একখানে আছে। এই তো ধরুন, আমি এখানে, কেউ কলকাতায়, কেউ থাকে চাটগাঁ, কেউ জলপাইগুড়ি, কয়েক ভাই গাঁয়ের বাড়িতে থেকে জমি-জমা দেখছে, আর কয়েকজন মারা গেছে।
শৈলেশ অনায়াসে একটা হিসাব দিলেন, আমি হাসি চেপে চুপ করে গেলাম। সেদিন এই পর্যন্ত।
তারপর এক রবিবার দুপুরবেলা, আমি বসে একটা বই পড়ছি। সুরমা গেছে খেতে। বাইরে ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
-কী করছেন? শৈলেশ কিছু না বলেই একটু হেসে ঘরে এসে একটা চেয়ারে। বসে পড়লেন।
দুপুরবেলা সুরমার বদলে এই লোকটির নিমন্ত্রণহীন উপস্থিতিকে উৎপাত ভেবে বিরক্ত হলাম। এখন দুঘণ্টা বসে অনর্গল বকুনি শুনতে হবে আর কি! কিন্তু মুখে কিছু না বলে বললাম, এ কয়দিন আপনাকে দেখিনি যে?
-আর বলেন কেন মশাই! গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে, ধরে নিয়ে গেল, কি আর করি? মেয়ের বাড়ী গাঁ-দেশে। কিন্তু গিয়ে দেখি একেবারে অজ পাড়াগাঁ, যত ছোটোলোকের আড়া। এর চেয়ে খারাপ জায়গা আমি আর জীবনে দেখিনি। আরে। বাপরে, কী জঙ্গল! তার ওপর আবার ক-দিন সমানে বৃষ্টি, এখানেও হয়েছিল কিন্তু ক-দিন সমানে তো নয়? ওখানে হয়েছিল খুব। আর কেবল কাদা। আমি তো ঘরের বারই হইনি।
তার কথার দিকে বেশি মনোযোগ আমার নেই দেখে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, কী বই ওটা?
-এমনি একটা ইতিহাস। বইটা পাশে রেখে বললাম, বসে আছি তাই টেনে নিয়ে পাতা উলটোচ্ছিলাম।
—তাহলে এই দেখুন, শৈলেশ খুশি হয়ে বললেন, ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম। আপনি আমাকে ডাক দিলে তো পারতেন। লোকটার নির্বুদ্ধিতা ক্ষমার যোগ্য নয়।
গোঁফে কয়েকবার হাত বুলিয়ে শৈলেশ বললেন, মানুষের কান্ড দেখে অবাক হতে হয়।
—আবার কী হল?
-শুনুন একটা ব্যাপার। আশ্চর্য হয়ে যাবেন। কিছু খারাপ কথাও আপনাকে শুনতে হবে, কিছু মনে করবেন না যেন। সেদিন বিকেলে বাইরে বেরোচ্ছিলাম। গলির মাথায় যে বাসাটি আছে—এখনও তো ভালো করে এ পাড়ার সকলকে চিনি না—সেই বাসার দোতলার বারান্দায় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেতে যেতে আমি লক্ষ করলাম, তারা আমাকে দেখে হাসল। আমি ভাবলাম, আমাকে দেখে হাসবার কী আছে, না, অন্য কারোর দিকে চেয়ে হাসল? আশেপাশে চেয়ে দেখলাম কেউ নেই। তারপর চলেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ খিল-খিল হাসির শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওরা আমাকে ঠাট্টা করছে। একটা মেয়ে তার ঠোঁটের দুদিকে দুহাতে আঙুল দিয়ে টেনে আর একজনকে এমনি করে দেখাচ্ছে—শৈলেশ নিজের হাতে তা দেখিয়ে বললেন, মানে তোরা দ্যাখ, লোকটার কতো বড়ো গোঁফ! এ নিয়েই হাসাহাসি। আচ্ছা বলুন তো, এসব কী? এগুলো কি ভালো? বড়োলোক বলে মানুষকে এমন ঠাট্টা করে নাকি? অমন দু-চারটে বড়োলোক আমি এখনও কিনে রাখতে পারি।
এমন ব্যাপার শুনলে কার না হাসি পায়, হেসে বললাম, তারপর কী হল?
-আপনি হাসছেন, কিন্তু বলুন তো এরকম করা কি উচিত? তারপর কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছা হল একবার বলি, পুরুষের পরিচয় হল একজোড়া গোঁফে আর মেয়েদের সৌন্দর্য হচ্ছে–
পরের কথাটুকু আন্দাজ করে বিরক্ত হয়ে বললাম, থাক, থাক, ওসব কথায় কাজ নেই। কিন্তু শৈলেশ থামলে না। বললেন, তোমরা যদি তা কেটে ফেলতে পারো, আমি আমার এই গোঁফজোড়াটিও তাহলে মাত্র দু পয়সা খরচ করে কেটে ফেলব।
—আহা, শৈলেশবাবু আপনি এসব কী বলছেন?
—কী আর বলব বলুন? এতে কার না রাগ হয়? আমি পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি পুরুষ মানুষ, আমাকে নিয়ে ওরকম ঠাট্টা যারা করে তাদের ওপর আপনারও কি রাগ হয় না? আগে মানুষ আমার মুখের পানে চেয়ে কথা বলেনি, এত ভয় করত! শৈলেশ চক্রবর্তীর নাম কে না জানে?
শৈলেশ বলে গেলেন, যখন স্টিমার অফিসে চাকরি করি তখন আমাদের ওপরওয়ালা মরিসন সাহেবের সঙ্গে কি খাতিরই না ছিল! ক্যালকাটা ব্যাংকের এখানকার ম্যানেজারজানেন নিশ্চয়ই তাঁকে, সেই বীরেন মুখার্জী আমার আপন মাসতুতো ভাই, তারপর সেদিন অজিত বসাক বলে যে ছেলেটি বিলেতে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়তে গেল, সে তত আমাকে ভয়ানক সম্মান করত। এরকম কত লোক আমার ঘনিষ্ঠভাবে চেনা! আর তা ছাড়া-I am an Ex-soldier of the last Great war–
আশ্চর্য হয়ে বললাম, আপনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। শৈলেশ বললেন, জীবনে কী না করেছি! ভেবে দেখুন, না করলেও পারতাম। কেউ আমাকে তাড়িয়েও দেয়নি, অবস্থাও খারাপ নয়, তবুও তো জীবনের বেশিরভাগ সময় কেবল বাইরে ঘুরে কাটিয়েছি। আচ্ছা বলুন, কী দরকার ছিল আমার যুদ্ধে যাওয়ার, না গেলেও তো পরতাম।
আরও কতক্ষণ বকবকানির পর রেহাই পাওয়া গেল।
সুরমা এসে বললে, এমন কী কথা হল এতক্ষণ?
—আর বলো না, ক-দিনেরই বা চেনা, এর মধ্যেই কীরকম সব কথা বলে যায়! এতটুকু মুখে বাধে না!
-আর যাই বলো, আমি লক্ষ্য করেছি, ও বউটিকে ভয়ানক ভালোবাসে।
এটা ওর চেহারা আর কাজকর্ম দেখে দুর্লভ মনে করেছিলাম।
কয়েকদিন পরে এক অদ্ভুত খবর শুনতে পেলাম। শৈলেশ কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। খবর শুনে আশ্চর্য বেশি হইনি, হতুম এই ভেবে যে, এটাই শুধু এতদিন কেন হয়নি। বউদি কেবল কাঁদছে, এমন বিপদের সময় একটা লোক নেই যে তাকে একটু দেখে শশানে। অথচ নিজের যাবারও সাধ্যি নেই।
সুরমা সব বললে।
ভাড়াটে এনে মহা মুস্কিলে পড়া গেছে আর কি! কী আর করি, একদিন গেলাম। ফার্স্ট সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে চোদ্দো নম্বর বেড। শৈলেশ আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন; বললেন, আপনি এসেছেন!
বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু শৈলেশবাবু এসব কী?
—আর বলবেন না, ব্যাটারা ভয়ানক পাজি।
–সে কারা? কেমন করে এমন হল?
—সামান্য একটা কথা নিয়ে তর্ক হল, সেই তর্কেই শেষ পর্যন্ত মারামারি। ওরা ছিল পঁচিশ জনের ওপরে, আর আমি একেবারে একা। তবু শৈলেশ চক্রবর্তীর হাতে যা মার ওরা খেয়েছে সেটা ওরাই জানে। আর আমার এই যে দেখছেন, মাথা ফেটেছে, হাতে একটু ব্যথা পেয়েছি, জানেন তো, মার দিতে গেলে মার খেতেও হয়। দেখুন কী সাহস, আমাকে ওরা চেনে না, মনে করছে, ওদের মতো আমিও এক পথের ধুলোরই মানুষ। ওদের এও খেয়াল নেই যে আমি একজন Ex-soldier.
শৈলেশ উত্তেজনায় বসে পড়লেন, উত্তেজনায় তাঁর শরীর কাঁপছে।
বললাম, থাক থাক, আগে সেরে উঠুন, তারপর যা হয় করা যাবে। কিন্তু ওরা কে তাতো বুঝতে পারলাম না?
——চায়ের দোকানের মালিক।
শুনে সত্যি একটু রাগ হল। বললাম, তাহলে দেখছি, ভয়ানক পাজি তো! সামান্য তর্কের জন্যে এমন করল! ওদের পুলিশে দেওয়া হয়নি?
শৈলেশ হেসে বললেন, সে কখন।
-বেশ হয়েছে। আপনি এখানে আর ওদিকে সকলে আপনার জন্যে ভয়ানক চিন্তায় পড়েছে।
—সকলে কে কে?
—এই ধরুন, আপনার স্ত্রী, কেবলই কাঁদছেন।
শৈলেশ বাইরের আকাশের দিকে গম্ভীরভাবে তাকালেন, চোখের উপরে ম্লান ছায়া। সুরমার কথা বিশ্বাস করতে হল, তার প্রত্যক্ষ পরিচয় এখন পেলাম। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অত চিন্তার কী হল? একটা অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকবে, ওরকম জীবন শৈলেশ চক্রবর্তী রাখে না। আর এই তো প্রথম নয়, সারাজীবন তাই করে এলাম, মরণকে এতটুকু ভয় করিনি; এখনও করি না, সেইজন্যেই তো লোকে অত ভয় করে, সম্মান করে চলে। আর সে জায়গায় ব্যাটারা কি না সামান্য চায়ের দোকানের মালিক হয়ে—
বললাম, সে যাক, এখন ওসব বলে লাভ নেই। এখন যাই।
—এখনই যাবেন? আচ্ছা, যান। গিয়ে বলবেন, ভালোই আছি, ডিসচার্জড হবার আগেই ফিরে আসবো। এখানে থাকা আমাদের পোষায় না।
-আচ্ছা, বলব। চলে আসছিলাম, আবার পেছন থেকে ডাক এল, দেখুন—
কাছে গেলাম, বললাম, কী?
-নার্সগুলো বড়ো অযত্ন করে, মনে করেছে একটা সাধারণ লোকই আমি। আপনি একটু আর-এম-ও বা ছাত্রদের বলে যাবেন আমার কথা।
ভাবলাম, আমি কি লাটসাহেব নাকি যে ওরা আমার কথা শুনবে? তবু বললাম, আচ্ছা বলব।
প্রায় মাসখানেক পরে শৈলেশ এলেন।
এতদিন পরে নীচের ঘরের মেয়েতে ছেলেপিলেদের অশ্রান্ত দাপাদাপি আর হাসির শব্দ পেয়ে ভালো লাগল। আর একজনেরও ব্যাকুল প্রতীক্ষারও এতদিনে অবসান হয়েছে।
কিন্তু দুদিন পরে আবার সব ঠাণ্ডা।
সুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
সে কিছু বলতে পারল না।
বলার দরকারও হল না, একদিন ভোরবেলা সব পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাকে নিভৃতে ডেকে শৈলেশ বললেন, দেখুন, এতদিন পরে এসেছি, হাতে একটি টাকা নেই, একেবারে না খেয়ে থাকবার মতো অবস্থা। এই বিপদের সময় যদি কয়টা টাকা দেন তো বড়ো উপকার হয়। ইংরেজি মাস পড়লেই দিয়ে দেব।
চুপ করে রইলাম।
—দেখুন, আপনাকে মিথ্যা বলেছি। আসলে অবস্থা আমার একটুও ভালো নয়। আর সেই যে চায়ের দোকান, ওরা আমার কাছে অনেক টাকা পেত, তাইতো অত বচসা, মারামারি। ভিতরে আর কোনো কারণ নেই। আপনাকে সত্যি কথা বললাম। দিন না কয়েকটি টাকা, আমি ঠিক দিয়ে দেব।
তার গলা ভিজে এল। এযাবৎ ভাড়াও একটি পয়সা পাইনি। বললাম, টাকা আমি দিতে পারি কিন্তু আপনি এ বাসা ছেড়ে কালই চলে যাবেন। আমারও বা এমন অবস্থা কি যে আপনার জন্যে আমি অত ক্ষতি স্বীকার করব? টাকা আমি আর চাইনে, আপনি কেবল চলে যান।
শৈলেশকে টাকা দিলাম।
বাসা ছেড়ে শৈলেশ সত্যি চলে গেলেন, তবে রাত্রে নয়, দিনে। বাড়িওয়ালার ধরবার ভয় নেই। যাবার সময় দেখলাম, দুটো টাকা পেয়ে আগের মতো সেই খুশি এতটুকু অন্তর্হিত হয়নি, ঠিক সেইরকম লম্বা গোঁফে আঙ্গুল বুলিয়ে বললেন, Ex-soldier of the last Great War.
গান
শীলাবতী যেন অপূর্ব সুন্দরী হইয়া উঠিয়াছে—বিশেষত আজিকার দিনটিতে। এক বছর ধরিয়া অশোক তাহাকে দেখিয়াছে, আজও দেখিল।
দেখিল— শীলাবতী ঘামিয়া উঠিয়াছে, কপালে, সরু চিবুকে, গলার নীচে, বুকের মাঝটিতে ছোট ছোট ঘাম-বিন্দু। ডান হাতটি ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে লীলায়িত, গালের পাশে অবিন্যস্ত উড়ো চুল।
রান্নাঘর। একপাশে একটিমাত্র জানলা—অপরিসর; সারাটা ঘর একটু আগেও ধোঁয়ার আচ্ছন্ন ছিল, এখনও আছে, কিন্তু গভীরতায় অল্প।
অশোক দুই হাত তুলিয়া বলিয়া উঠিল :
-আহা দেখেছো, সব নষ্ট করে দিলে। অমন মাছটা আর খেতে পেলাম না।
খুন্তী নাড়িতে নাড়িতে, হাসিয়া শীলাবতী বলিল–আহা! নিজের চরকায় তেল দাওগে বাপু, রান্নাঘরে কেন পুরুষের ঝকমারি! টাকা যদি তোমরা আনতে পারো, রাখবার উপায়টা আমরা জানি, তোমরা নও। তোমরা যদি গাছ কাটতে পারো, আমরা জ্বালাতে পারি আগুন।
–এবং জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে দিব্বি আরামে, পায়ের পর পা তুলে ঘুমোও। ওদিকে তো পুরুষের দোকানে ঘিয়ের বাতি।
হাসি চাপিয়া শীলাবতী যেন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে— তাই নাকি? তাহলে উপায়? অশোকও গম্ভীর হইয়া বলে–এক কাজ করো। কিছুদিন তোমরাই এখন দোকান সাজাও; আমরা ঘরে এসে বসি।
খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠা শীলাবতীর অভ্যাস। হাসির বেগে চোখ দুইটি ছোটো হইয়া আসে, গাল ফুলিয়া ওঠে, চিবুকের ওপর কয়েকটি রেখার—দাগ পড়ে।
অশোক তাহার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। খুশির প্রাবল্যে শীলাবতীর মুখখানা কীরকম হইয়া আসে দেখিয়া তৃপ্তি অনুভব করে। তারপর অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া গেল, দারুণ গম্ভীর।
দুইজনেই চুপচাপ; কেবল খুন্তি নাড়ার ঠুংঠাং শব্দ, তার সঙ্গে হাতের চুড়িতে অনুচ্চ আওয়াজ।
ঘাড় কাত করিয়া গালটা একপাশে উচাইয়া ধরিয়া শীলাবতী ভুরু কুঁচকাইয়া বলে–কি হল?
—কেবলই মনে হচ্ছে, কালকেই যে চলে যাব।
—হ্যাঁ! শীলাবতী মুখ নীচু করিয়া নিল।
—হ্যাঁ মানে?
–একেবারেই সোজা কথাটি। মানে আবার আসবে।
—আসব। যেন অশোকের মতো জলমগ্ন প্রায় হতভাগ্য, একটা ভাসন্ত তৃণ দেখিতে পাইয়াছে।
শীলাবতী মাথা নাড়িয়া বলিলঃ–হ্যাঁ শীতের ছুটিতে।
-ও, এই কথা, সে তো আমিও জানি।–
অশোকের চোখে-মুখে যেন হতাশার চিহ্ন।
শীলাবতী এবার নিজের সঙ্গে কথা বলে তোমার কিন্তু মজা মন্দ নয়; শহরে থেকে গাড়ি-ঘোড়ায় দৌড়াও, কত কিছু দেখ, কত কিছু খাও, আবার মুখের চোখের স্বাদ বদলাতে চলে আসো গাঁয়ে! কী মজা!
অন্য সময়ে হয়তো অশোক হাসিমুখে অন্য কথাই বলিত, যোগ্য উত্তর ছিল। কিন্তু এখন তেমনই গম্ভীরভাবে, ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল— তুমি আমার সঙ্গে যাবে শীলা?
শীলাবতীর মুখ ঘুরিয়া গেল–কোথায়?
—যেখানে কত কিছু দেখি, কত কিছু খাই।
তৎক্ষণাৎ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়া গেল–ছিঃ!
তার কাঁধে হাত রাখিয়া অশোক বলিল, ছিঃ কেন?
–পাগলামি কোরো না। তোমার মা নেই? বোন নেই? তারা মানুষ নয়? তারা এখানে পড়ে থাকবে—আর আমাকে একলা নিয়ে যাবে তুমি?
অশোক হাত সরাইয়া নিল। চুপ করিয়া সামনের উঠানের দিকে তাকাইয়া থাকা। ছাড়া গত্যন্তর কোথায়? কিছুক্ষণ পরে আবার কি মনে করিয়া নিজেই বলিল :
আমার দোষ? তুমিই তো বললে!
—বললাম বলেই বুঝি যেতে চাইলাম? শীলাবতী সশব্দে হাসিয়া উঠিয়া বলিল–হা ঈশ্বর! সে কথা তুমিও জানতে, ওটা পাগলামি। তবু তো বললে, বলে আবার নিজেই দুঃখু পেলে! না বাপু, অমন হাঁড়িপানা মুখ আমি সইতে পারিনে, অত রাগ আমি ভালবাসিনো—এই বলিয়া সে একটু পিছন ঘুরিয়া অশোকের ডান হাতটি নিজের হাতে নিল। মুখ নীচু করিয়া নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল।
তারপেই খিলখিল করিয়া দুজনেরই উচ্ছ্বসিত হাসি। এমন সময় বাহিরে দ্রুত পদশব্দ এবং কাশি। সঙ্গে সঙ্গে ডাক ভূতো, ভূতো?
নিমেষমধ্যে হাত ছাড়িয়া দিয়া স্খলিত ঘোমটা মাথায় তুলিয়া শীলাবতী রান্নায় মন দিল। যেন ভালো মানুষটি। বিরক্তির সুরে অশোক বলিল— তোমায় তো কতবার বলেছি মা, ও নাম ধরে আমায় ডেকো না; তবু তোমার কি যেন খেয়াল, কিছুতেই ও নামটি ছাড়বে না। যেন জিদ করে বসে আছ। আড়ালে শুনে লোকে ভাববে, লোকটা বুঝি সত্যি ভূতের মতো দেখতে।
আঁচলটা খসিয়া গিয়াছিল। সেটা আবার কোমরে জড়াইতে জড়াইতে মাথায় শুকনো খড়ের মতো দুই গাছি চুলকে একটা গুটির মতো পাইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত এবং এস্ত নিরুপমা বলিলেন–ভূতো দেখ দিকিন। কাজের সময়েই যত ঝকমারি!
ঝকমারি!–অনিচ্ছা সত্ত্বেও অশোক বলে।
—তা নয় তো কী? যত বলি, ব্যাটা যেন আরও চেপে বসে। আমি বলি বাপু আমি তো আর কত্তা নই, যিনি কত্তা তাকে জিজ্ঞেস করে এসো। বলে, তাহলে ডেকে দিন। আমার দুহাত ভরা কাজ, আমি নাকি পারি অতদিকে নজর রাখতে? ঝকমারি! কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অশোক বলিল কিন্তু লোকটা কে?
-কি জানি? ও নাম বলতে আমার দাঁত ভাঙে, আমার মনে থাকে না বাপু। সেই যে পশ্চিম পাড়ার বুড়ো সর্দার।–
নিরুপমা নাম মনে করিতে চারিদিকে তাকাইলেন।
—কে? আস্রফ মিঞা?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই সর্দারই বলে কিনা, শুধু আপনি বললেই হয় ঠাকরুন, আমরা এবার ভাসান শোনাবই। আমি বলি বাপু আমাকে কেন? কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি-নীচু হইয়া গলার স্বর নামাইয়া নিরুপমা বলিলেন, চমৎকার গায় ওরা। লখিন্দর যে ছেলেটা সাজে, আহা কি সুন্দর চেহারা, কী গায়ের রং আর এই যে সর্দার, ওর যা গলা, শুনলে বাক্যিহারা হতে হয়। চমৎকার!-আবার গলার স্বর স্বাভাবিক করিয়া বলিলেন, বলি আমাকে ধরে কি হবে? টাকা-পয়সার মালিক তো আর আমি নই।
খুশি হইয়া অশোক বলিল, তা হলে বলে দাও গে মা।
-আজই তো? কালকে তো চলে যাবি। যাই তাহলে কথা দিয়ে দিইগে। বলিয়া নিরুপমা দ্রুতপদে তাঁহার চারিদিকের ঝামেলা পোহাইতে চলিলেন।
মুখ টিপিয়া শীলাবতী হাসিতেছিল। ঘোমটা তুলিয়া দরজার দিকে চাহিয়া বলিল :
—ভাগ্যিস নিজের চোখে দেখেছিলাম, তা নইলে ওই নাম শুনে কে আর বিয়ে করে!
পরম উৎসাহে অশোক সায় দিয়া কহিল,
–এই দেখো ওই জন্যে কতবড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। তুমি আজ অন্যের হয়ে যেতে পারতে; ইস, কত বড়ো একটা ফাঁড়ার হাত এড়ানো গিয়েছে।
–নাকি? খিলখিল করিয়া শীলাবতী আবার হাসে।
বিকালের খানিকটা আগে হইতে উদ্যোগপর্ব শুরু হইল। সর্দার নিজে তদারক করে। মাথার উপরে টাঙানোর জন্য নৌকার পাল, বসিবার জন্য একটা ছোটো সতরঞ্চি, দরকার হইলে তক্তা পাতিয়া দেওয়া যাইবে। এইভাবে সারাটা বিকাল কাটিল। অশোকের ছোটো বোন অরু ও পাড়ার ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে অসামান্য খুশি হইয়া দেখিতেছিল। সর্দারের মুখটি আজ কী পরিষ্কার, পালিশ, চকচকে। চুলে সাবান দেওয়া হইয়াছে; আজ আর তেল চপচপে নয়, আজ তার ঘাড় পর্যন্ত বড়ো বড়ো চুল রেশমের মতো নরম আর হালকা,বাতাসে ফর ফর করিয়া উড়িতেছে। যাই বল, সর্দার এককালে সুন্দরই ছিল। আজ নয় বুড়া হইয়াছে; কিন্তু যাই বল লখিন্দরের মতো অমন জোয়ান মদ্দর মা-র পার্টে তাহাকে মানাইবে ভালো; বেশ মানাইবে।
নিজেদের বসিবার জায়গা করিয়া লইতে আর কতটা সময়ই বা লাগে। কোনো এক মুহূর্তে নিরুপমা, অরু আর শীলাবতী বসিয়া পড়িয়াছে। সস্তা হারমোনিয়ামের রিডে অনভ্যস্ত আঙুলের চাপ পড়িয়াছে। অশোক তাহা ভালো করিয়া খেয়ালই করে নাই।
ভাসান গানে কথা কম, গান বেশি, মিনিটের কাঁটা লক্ষ করিয়া সর্দার ভাসান শোনায় না। তাই, সবেমাত্র সনকা লখিন্দরকে বিদেশ যাইতে বারণ করিয়াছে, তখনই রাত এগারোটা।
অশোক উঠিয়া দাঁড়াইল ও আড়চোখে চাহিয়া দেখিল,-একপাশে আরও কয়েকটি বউ এবং অরুর পাশে শীলাবতী গুটিসুটি বসিয়া আছে, তন্ময় হইয়া পালাগান শুনিতেছে, সকলের সামনে তাহার মা।
অশোক আপন মনেই যেন সরবে বলে ইস রাত হয়েছে অনেক, শুয়ে। থাকি গে।
কেউ সাড়া দিল না, এমন কি ফিরিয়াও তাকায় না। এমনই তন্ময়।
অশোক খানিক বসিল; একটু পরেই আবার উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, কাল ভোর না হতেই তো আবার দৌড়াতে হবে ইস্টিশান। নাঃ, শুইগে যাই।
এবার কেবল অরুই ফিরিয়া তাকায়। চোখে তাহার অশেষ করুণা। অন্য কাহারও কানে কথাটা কি যায় না? অশোক উচ্চারণ করে— ইস যে না গান, তা আবার এত মনোযোগ দিয়ে শোনা? আমার তো কেবল হাসিই পায়! হাসি পায় বলিয়াই বুঝি অশোক একবার হাসিবার চেষ্টা করে।
এবার লখিন্দর নিতান্তই অবাধ্য হইয়া বিদেশযাত্রা শুরু করিবে। রাত তখন বারোটা।
নাঃ, অসহ্য। অশোক আবার দাঁড়ায়। এই জিনিস দেখেই যদি সারাটি রাত জাগতে হয়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী আছে? শেষ কি আর এখন হবে, হবে সেই বেলা দশটায়—হু–, আমি জানি বলেই তো শুতে যাচ্ছি। ব্যাটাদের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। বেলা দশটা অবধি ভাসান-যাত্রা!
অরুর সত্যি অশেষ করুণা—এক মা-র পেটের বোন তো? সে তার দাদার দিকে মিটমিট করিয়া তাকায়। ওই তো অতটুক মেয়ে ঘুমে ঢুলছে, তবু ঠায় বসিয়া সমস্তটা দেখা চাই-ই! মেয়েদের তো ওই দোষ। চোখ কটমট করিয়া অশোক তার দিকে তাকাতেই ভয়ে ভয়ে অরু মুখ ফিরাইয়া লইল।
আর না দাঁড়াইয়া অশোক তাতাতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেল, দরজা আটকাইয়া কেহ বসিয়া নাই, তা না হইলে হয়তো পথ নাই বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিত। কিন্তু আলো? সবগুলি আলোই কি আত্মহত্যা করিয়াছে?
নাঃ, এমন সব মানুষের সঙ্গে ঘর করা মুশকিল। বিছানাও পাতা হইয়াছে কি না কে জানে। অথচ রাত একটা তত বাজে। অশোক ফিরিয়া আসিয়া দরজার কাছে
একটু দাঁড়াইয়া জোরে বলিল, আমার তো আর সারারাত জাগবার শখও নেই, সময়ও নেই, শোবার ব্যবস্থা কিছু হয়েছে কি না বলো? ওমা, বিছানা কি পাতা আছে?
–একটা মিনিটও নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকিবার যো নাই! নিরুপমা এতক্ষণে তাকাইলেন।
অশোক ততক্ষণ আবার ভিতরে চলিয়া গিয়াছে। পায়ের ধাক্কায় কি যেন একটা পড়িয়া গেল। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করিয়া চলা যায়? কিন্তু নিজের ঘরে আসিয়া দেখিল, মিটমিট করিয়া আলো এ ঘরে জ্বলিতেছে। ইস, কী বিকট গান! সারারাত কি ঘুম হইবে?
বাতিটা উস্কাইয়া বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল। সমস্ত বিছানা জুড়িয়া শুইয়া গভীর ঘুমের আশা করিতে লাগিল। কিন্তু যে বিকট গান! ও আলোটা আবার নেবানো হইল না; কী জ্বালা! কিন্তু না নিবানোই থাকুক না। জ্বলুক না জ্বলজ্বল করিয়া, তার কী?
গানের এখন নিশ্চয় অর্ধেকও হয় নাই, কখন শেষ হইবে কে জানে! না আছে একটা পরচুলা, না আছে একটা পোষাক—এই দেখিতে আবার সারারাত জাগা! সেই বেলা দশটা অবধি, ওরে বাপরে! চোখে এত ঘুম থাকিতে একটু ঘুমানোর উপায়ও নাই। সামনের জানালাটা অশোক ঠাস করিয়া বন্ধ করিয়া দিল। কাল ভোরেই তো আবার দৌড়াতে হবে ইষ্টিশনে, অথচ এখনও… নাঃ অসম্ভব?
-কেমন সুন্দর হচ্ছিল, তা-ও একটু দেখবার যো নেই! ও মাগো, আলোটা কী রকম জ্বলছে। আগুন লাগবে নাকি? জেগে থেকেও এটা চোখে পড়ছে
?-বাতিটা কমাইয়া দিয়া শীলাবতী বলিল, নিজের ঘুম পেয়েছে সোজা শুয়ে পড়লেই হয়, সঙ্গে অন্য কারোরও ভয়ানক ঘুম পাবে এমন কোনো কথা আছে। কী ভালো লাগছিল, তবু দেখতে পারলাম না!
-মেয়েদের তো ওই দোষ, রুচি কাকে বলে তা জানে না। অশোক বলিল।
থাক, থাক, বক্তৃতার আর দরকার নেই। শীলাবতী কি হাসি চাপিতেছে?
-আমি বুঝি সেদিক থেকেই বলছি? আমি বলেছি এক মহত্তর,–
–থাক, থাক, আর বলতে হবে না।
শীলাবতী বিছানার কাছে আসিল। আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া অশোক কিছু বলিতে গিয়া শীলাবতীকে দেখিতে পাইয়া চোখ বুজিল। বিড় বিড় করিয়া বলিতে লাগিল, যাও না, প্রাণ ভরে দ্যাখোগে, সারারাত জেগে দ্যাখো আমি তো আর অমন বাজে শখে সারারাত জেগে তারপর ভোরবেলা ট্রেনে চড়ে ঘুমে ঢুলতে পারিনে।
হাসিয়া শীলাবতী বলে, নাঃ, এ ঘুম আর কিছুতেই ভাঙবে না দেখছি।
আকাশ তাহার বুকে এক মৃদু উষ্ণতা অনুভব করিল। চোখ মেলিলে কথা বলিতে হয়, বোধকরি সেই ভয়েই সে চোখ বুজিয়াই পড়িয়া রহিল।
বাইরে ভাসান গান। মেয়ে সাজিলেও সর্দারের গলাটাই সবচেয়ে বেশি জোরে শোনা যায়।
দাঙ্গা
লোকটি খুব তাড়াতাড়ি পল্টনের মাঠ পার হচ্ছিল। বোধহয় ভেবেছিল লেভেল ক্রসিংয়ের কাছ দিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ডে পড়ে নিরাপদে নাজিয়াবাজার চলে যাবে। তাহার হাতের কাছে বা কিছু দূরে একটা লোকও দেখা যায় না—সব শূন্য, মরুভূমির মতো শূন্য। দূরে পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে দুই একটি সুদৃশ্য মোটরকার হুস করে চলে যায় বটে, কিন্তু এত তীব্র বেগে যায় যে মনে হয় যেন এইমাত্র কেউ তাকেও ছুরি মেরেছে, আর সেই ছোরার ক্ষত হাত দিয়ে চেপে বসে পাগলের মতো ছুটে চলেছে। নির্জন রাস্তার ওপর মোটর গাড়ির এমনি যাতায়াত আরও ভয়াবহ মনে হয়। দূরে গভর্নর হাউসের গর্বময় গাম্ভীর্য মানুষকে। উপহাস করে। পথের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। মাঠের ওপর কয়েকটা কাক কীসের আশায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেক দূরে একটা ইঁদুরের মতো ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে কে? একটি সৈন্য। ওই সৈন্যটি আজ তিনদিন ধরে এক জায়গায় ডিউটি দিয়ে আসছে।
লোকটা মাঠ ছেড়ে রাস্তায় পড়ল। তার পরনে ছেঁড়া ময়লা একখানা লুঙ্গি, কাঁধে ততোধিক ময়লা একটি গামছা, মাথার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কখুস্ক, মুখটি করুণ। তার পায়ে অনেক ধুলো জমেছে, কোনো গ্রামবাসী মনে হয়।
এমন সময় কথাবার্তা নেই দুটি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পেছনে একবার বসিয়ে দিল। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতটুকু বিচলিত হল না, লোকটার গায়ে যেখানে সেখানে আরও তিনবার ছোরা মেরে তারপর ছুটে পালাল, কুকুর যেমন লেজ তুলে পালায় তেমনি ছুটে পালাল। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে পড়ল, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাটকা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ওই কংকালসার দেহে আছে!
মিনিট দশেক পরে এক সৈন্য বোঝাই গাড়ি এল, সৈন্যরা বন্দুক হাতে করে গাড়ি থেকে পটাপট নেমে সার্জেন্টের আদেশে হাতের কাছে যাকে পেল তাকেই ধরল। হিন্দি বুলি ছেড়ে, সিগার খেয়ে এদি ওদিক ছুটোছুটি করে সার্জেন্টদের শ্বেতবর্ণ আরক্ত হয়ে এল। যারা এদিকে জেলের ভাত খেতে আসছিল তাদের থামিয়ে দিল। উধার মৎ যাইয়ে বাবু, মৎ যাইয়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় অর্ধেকটা ঘেরাও হয়ে গেল, ছোটো ছোটো গলি এবং সমস্ত রাস্তার মাথায় সশস্ত্র পুলিশ সঙ্গীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ ঢুকতে পারবে না, কেউ বেরোতেও পারবে না, শৃঙ্খলিত করে একটা সামরিক বন্দিশালা তৈরি হল।
কিন্তু শৃঙ্খলের ভিতরেও সংগ্রাম হয়। এক বিরাট সংগ্রাম শুরু হল। সকলেই এখানে সেখানে ছুটোছুটি করতে লাগল, চোদ্দো বছরের বালক থেকে আরম্ভ করে সত্তর বছরের বুড়ো পর্যন্ত। এমন দৃশ্য শহরে জীবনে অভিনব।
লাইনের পাশে যাদের বাসা তাদের পালাবার আর অবসর কোথায়? তাদের মুখ চুন হয়ে গেল, কেউ হিন্দুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বীরের মতো অগ্রসর হল। এক রিটায়ার্ড অফিসার ভদ্রলোক একটা ব্যাপার করলেন চমৎকার। বাক্স থেকে বহু পুরোনো একটি পাতলুন বের করে সেটা পরে এবং তার ওপর একটা পুরোনো কোট চাপিয়ে এক সুদর্শন যুবকের মতো ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন, তাঁর শরীরের ভিতর আগের সেই তেজ দেখা দিয়েছে, যখন ওপরওয়ালা অনেক সাহেব-সুবোকেও বকে ঝকে নিজের কাজ তিনি করে যেতেন। সেই দিন আর এখন কই, হায়, সেই দিনগুলি এখন কোথায়!
ভদ্রলোক নীচে নেমে এলেন, পাতলুনের দুই পকেটে কায়দা করে দুই হাত ঢুকিয়ে দুই পা ফাঁক করে গেটের ওপর দাঁড়ালেন। ওই যে, রক্তবর্ণ সার্জেন্টটি এদিকেই আসছে। ভদ্রলোক তার সঙ্গে বড়োবাবু সুলভ ইংরিজি আরম্ভ করে দিলেন।
শিক্ষয়িত্রী সুপ্রভা সেনের ব্যাপার আরও চমৎকার। সে তো মেয়েদের কোনো ইস্কুলে চাকরি করে। শহর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত বলে প্রচুর ছুটি উপভোগ করছিল, আজও এইমাত্র দুপুরের রেডিও খুলে বসেছে। ছুটির দিন বলে একটা পান চিবুচ্ছে। ভোরবেলা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছোটো ভাইকে গাধা বলে শাসিয়েছে, খানিকক্ষণ গম্ভীরভাবে কিছু ভেবেছে আর এখন বসেছে রেডিয়োর গান শুনবে বলে। তার চোখে চশমা, একগাছি খড়ের মতো চুল সযত্নে বাঁধা। আঙুলগুলি শুকনো হাড়ের মতো দেখতে, আর শরীরের গঠন এমন হয়ে এসেছে যে যত্নবতী না হলেও চলে। এমন সময় বাইরের রৌদ্রে গুর্খাদের বন্দুকের সঙীন ঝলমল করে উঠল, তাদরে শ্বেত অধিনায়কের গর্বোন্নত শির আরও চোখে পড়ে, এবং বুটের খটমট আওয়াজ শুনে সুপ্রভা সেন আর তিলমাত্র দ্বিধা না করে নীচে চলে গেল, বসনে এবং ব্যবহারে বিশেষ যত্নবতী হয়ে সাহেবের সম্মুখীন হল।
মুহূর্তে এই গল্প লাফিয়ে চলল এবং সুপ্রভা সেনের অনেক খ্যাতি ও অখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
লাইনের পাশে কোনো বাড়িই খানাতল্লাশির হাত থেকে রেহাই পেল না, রাজনৈতিক বন্দিদের বেলায় যেমন খানাতল্লাশি হয় তেমন অবশ্য নয়, তল্লাশি হয় শুধু মানুষের।
ভিতরের দিকে তেমনি ছুটোছুটি, একবার এদিকে একবার ওদিকে। কিন্তু সকলের মুখেই হাসি, বিরক্তি বা রাগের চিহ্নমাত্র নেই। অশোকের দেখে রাগ হল, এই ব্যাপক ধরপাকড় আর ব্যাপকতর ঘেরাও মানুষের কাছে একটা Sports হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধঃপতন বা পচন একেই বলে। অশোকের ইচ্ছে হয় চীকার করে বলে, আপনারা কেন হাসবেন? কেন হাসছ তোমরা?
একটা জায়গায় কিছু লোক জমা হয়ে গেল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভেঙে গেল। লোকগুলির মুখে হাসি আর ধরে না, তারা আর কিছুতেই সিরিয়াস হতে পারছে না। অশোকের মন হল, এরা একেবারে জর্জরিত হয়ে গেছে।
রাস্তা দিয়ে একটা ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল পুরোনো কাগজের বোঝা নিয়ে। তার পায়ে একটা ময়লা কাপড়ের প্রকান্ড ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। সে হঠাৎ থেমে বললে, বাবুরা হাসছেন। হাসুন, আপনাদেরই দিন পড়েছে, গভর্নমেন্টের যেমন পড়েছে। দিন পড়েনি শুধু আমাদের, আমরা মরব, মরব!
অশোক মন্থর পায়ে হেঁটে বাসায় গেল। এই মাত্র আর একটা ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। দোলাইগঞ্জ স্টেশনের ডিস্ট্যান্টসিগন্যাল পার হয়ে এক বৃদ্ধ যাচ্ছিল–একটা বিবরণ শুনতে আর ভালো লাগে না। কখনো নিজেকে এত অসহায় মনে হয়।
অশোকের মা খালি মাটিতে পড়ে ভয়ানক ঘুমুচ্ছিলেন, ছেলের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, যা শীগগির, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা বলছি। একশোবার বলেছি যে, যা বাপু মামাবাড়িতে কিছুদিন ঘুরে আয়, মারামারিটা কিছু থামলে পরে আসিস, না তবু এখানে পড়ে থাকা চাই, একটা ছেলেও যদি কথা শোনে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা চাই, শহরের মাটি এমন মিষ্টি, না? অশোক হেসে বললে, এত কাজ ফেলে কোথায় যাই বল?
-হুঁ কাজ না ছাই। কাজের আর অন্ত নেই কী না! তোদের কথা শুনবে কে রে? কেউ না। বুঝতে পেরেছি তোদের কতখানি জোর। কেবল মুখেই পটপটি, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা!
—জানো কংগ্রেস মিনিস্ট্রির সময় কানপুরে কী হয়েছিল? আমরা দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলুম।
মা দুই হাত তুলে বললেন, হয়েছে। অমন ঢের বড়ো বড়ো কথা শুনেছি। তোদের রাশিয়ার কী হল শুনি? পারবে জার্মানির সঙ্গে? পারবে?
অশোক বাইরের দিকে চেয়ে বললে, পারবে না কেন মা? বিপ্লবের কখনো মরণ হয়?
মা হাঁ করে চেয়ে রইলেন, একটু পরেই চুপি চুপি বললেন,
-হ্যাঁরে, একি সত্যি?
–কী মা?
—ওই যে উনি বললেন, জার্মানি রাশিয়ার সব নিয়ে গেছে, একেবারে আমাদের দেশের কাছে এসে পড়েছে?
অশোক হো হো করে হেসে উঠল, এঁরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন।
এমন সময় অজু মানে অজয় এসে হাজির। অজু অশোকের ছোটো ভাই। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, নবাব বাড়ি সার্চ হয়ে গেছে। অশোক চোখ পাকিয়ে বললে, এটি কোথেকে আমদানি, শুনি!
–বারে আমি এইমাত্র শুনলুম যে!
–তোমার দাদারা বলেছে নিশ্চয়?
অজু একজন হিন্দু সোসালিষ্ট। সম্প্রতি দাঙ্গার সময় জিনিসটির পত্তন হয়েছে। এই বিষয় শিক্ষা নিতেই সে পাগলের মতো ঘোরাফেরা করে। উচ্চস্বরে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে, হিটলারের জয়গান করে, হানাহানিতেও প্রচুর আনন্দিত হয়।
–বারে আমি নিজের কানে শুনেছি। একটা সোলজার আমায় বললে,–
–তোমায় কচু বলেছে।
অজু কর্কশ স্বরে বললে, তোমরা তো বলবেই— তারপর মৃদুস্বরে—তোমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও–
—আমরা ইহুদির বাচ্চা, নারে? অশোক হা হা করে হেসে উঠল, বললে, সার্চ হোক বা না হোক, তাতে Rejoice করবারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে? আসল ব্যাপার হল অন্যরকম। দেখতে হবে এতে কার কতোখানি স্বার্থ রয়েছে। অজয় চুপ করে ছিল, সে খুক খুক করে হেসে উঠল।
দুপুর আস্তে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেল।
অশোক রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পেল, এই মাত্র পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে। লোকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই অঞ্চলেরই অধিবাসী যারা বাইরে ছিল, আহারে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই মুখের হাসিটি শুকোয়নি। ভিতরে এবং বাইরে যারা ছিল তাদের সকলেরই অভিজ্ঞতার বর্ণনা চলতে লাগল। ওদিকে দুই গাড়ি বোঝাই ভদ্রলোকদের ধরে নিয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোক বাড়িতে বসে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।
–কার আবার স্বার্থ থাকবে। স্বার্থ রয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের।–এই বলে অজয় অন্যদিকে চেয়ে একটা গান গাইতে লাগল!
মা বলে উঠলেন, তোরা ভাইয়ে ভাইয়ে এমন ঝগড়া করিস কেন বলত? আমাদের সময় আমরা বড়ো ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে কথা কইতাম না, মুখে মুখে তর্ক করা দূরের কথা। কিন্তু দাদা আমায় যা ভালোবাসতেন। ছোটোবেলায় অনেক শীতের রাত্তিরে আমরা এক লেপের তলায় শুয়ে ঘুমিয়েছি।
অশোক গালে হাত দিয়ে বললে, হয়েছে। এবার ভাইয়ের গল্প আরম্ভ হয়ে গেছে, আমাদের তাহলে উঠতে হয়।
তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা এগিয়ে এল। এবার তবে বাসায় ফিরতে হয়। কিছু পরেই সান্ধ্য আইন শুরু হয়ে যাবে। রাস্তাঘাট নির্জন হবার আগে একটা মস্ত ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয়ে গেছে। পুলিশগুলো মানুষের শরীর সার্চ করে নিচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা একেবারে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়। এক ভদ্রলোক একটা পেন্সিল কাটা ছুরি নিয়ে ধরা পড়লেন। সকলে তাঁর নির্বুদ্ধিতার নিন্দা করতে ছাড়ল না। ওদিকে সমস্ত দোকানপত্র আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে রাস্তার পাশেও একটা মেলা বসেছিল যেন, এখন সকলেই শেষ ডাক দিয়ে চলে গেছে। রিটায়ার্ড অফিসাররা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরম স্নেহের দৃষ্টিতে সেই অস্থায়ী হিন্দু দোকানদারদের দিকে বার বার তাকাচ্ছেন, ওদের এখন পুত্রবৎ মনে হচ্ছে, অথবা যেন বোমা বিধ্বস্ত লণ্ডন নগরীর অংসখ্য রিফিউজি!
অশোক বাসার কাছে গিয়ে দেখে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই বললেন, বাবা আশু, তোর বাবা তো এখনও এল না। তারপর ফিসফিস করে—তা ছাড়া আজ আবার মাইনে পাবার দিন।
কিছুমাত্র চিন্তার চিহ্ন না দেখিয়ে অশোক তৎক্ষণাৎ বললে,
-আহা, অত ভাবনা কীসের? এখনও তো অনেক সময় আছে।
—অনেক নয় আশু, সাতটা বাজতে আর আধঘণ্টাও বাকি নেই।
অশোক আবার রাস্তায় নেমে এল, পেছনে ছোটো ভাই নীলু মা-র আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইল, বেলাও মা-র পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ক্রমেই লোক কমে আসছে। যারা কিছুদূরে আছে তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ছোটো ছোটো সৈন্যদল মার্চ করে গেল। আকাশের রঙ ক্রমেই ধূসর হয়ে আসছে। রাস্তা আর দালানের গায়ে ছায়া নেমেছে। বাদুড় উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এই সাতটা বাজল। অশোক ফিরে এল।
মা এখনও বাইরে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটি ভোরের তারার মতো করুণ। আশু এখন উপায়–? মা ভাঙা গলায় বললেন তাঁর চোখ জলে ভরে এসেছে।
অশোক কিছু বললে না। নিঃশ্বব্দে ঘরে ঢুকে খালি তক্তপোষের ওপর শুয়ে পড়ল তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে এসেছে, চোখের ওপর একটা বিষম দুর্ভাবনার চিহ্ন স্পষ্ট। হয়তো এক কঠিন কর্তব্যের সম্মুখীন হতে চলেছে সে। নীলু তার হাত ধরে ডাকল, বড়দা, বড়দা গো? বারে কথা বলে না। ও বড়দা? বারে! বারে!
নীলু কেঁদে ফেলল, বাবাগো বলে নাকিসুরে কাঁদতে লাগল।
ওদিকে মা-ও কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। বেলাও তাঁর পাশে বসে দুই হাঁটুর ভিতর মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এ ছাড়া সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা ভয়াবহ গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। অন্ধকার নেমেছে রাস্তায়। ঘরের অন্ধকার আরও সংঘাতিক। আলো জ্বালাবে কে? ঘরের আবহাওয়া ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘন ঘন বাসের হর্ন শোনা যায়। সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। যেন কোনো যুদ্ধের দেশ। অথবা কোনো সাম্রাজ্যবাদের শেষে শঙ্খধ্বনি, বার্ধক্যের বিলাপ।
পাশের বাড়িতে ভয়ানক তাসের আড্ডা জমেছে। বেশ গোলমাল শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে টর্চ হাতে করে বিমল এল। বিমল ছেলেটিকে ভালোই মনে হয়, কথাবার্তায় অনেক সময় ছেলেমানুষ। অনেক সময় পাকাও বটে। সে বললে, অশোকবাবু চলুন।
অশোক প্রস্তুত হয়েই ছিল। খালিপায়েই সে বিমলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিমল টর্চ জ্বালিয়ে এগুতে লাগল। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল, কোনো পুলিশ আসছে কি না! বাড়িটা বেশি দূরে নয়। অলিগলি দিয়ে নিরাপদেই যাওয়া যায়। বিমল যথাস্থানে গিয়ে ডাকল, সূর্যবাবু? সূর্যবাবু বাড়ি আছেন?
ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে?
-আমরা। দরজাটা খুলুন।
সূর্যবাবু নিজেই এসে দরজা খুললেন, হেসে বললেন,–কী ব্যাপার?
বিমল বললে, আমরা আপনার ফোনে একুট কথা বলতে পারি?
—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সুর্যবাবু সাদরে ফোন দেখিয়ে দিলেন। বিমল স্টিমার অফিসে ফোন করল, অনেকক্ষণ পরে কে একজন লোক এসে বলল, সুরেশবাবু কে? সুরেশবাবু টুরেশবাবু বলে এখানে কেউ নেই। ও দাঁড়ান দাঁড়ান। ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘণ্টাখানেক পরে আবার আসুন। আমি খুঁজে আসছি।বিমল অনেকবার ডেকেও আর কোনো উত্তর পেলো না। ফোন রেখে অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, আবার আসবখন।
অশোক ফিরে এল। দরজার কাছে মার জল ভরা চোখ ছল ছল করছে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। অশোক বললে, পরে যেতে বলছে? এই শুনে মা আবার ভেঙে পড়লেন, ভগ্নস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মন বললে, আগামী নতুন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ দুঃখ আমারও সুখ দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের আর সীমা নেই। আমি জানি, আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোনো ভয় নেই।
এমন সময় পাশের ঘরে আলো দেখা গেল—আলো নায় তো আগুন। কাগজ পোড়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। অশোক গিয়ে দেখল হিন্দু মুসলমান ঐক্যের আবেদনের ইস্তাহারগুলি স্তূপীকৃত করে অজয় তাতে আগুন দিয়েছে। অশোক তৎক্ষণাৎ আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে করতে বললে এসব কী করছিস?
-কী করব আবার? মড়া পোড়াচ্ছি।
–অজু, তুই ভুল বুঝেছিস। চোখ যখন অন্ধ হয়ে যায়নি, তখন আগে। পড়াশোনা কর। তারপর পলিটিক্স করিস।
—দাদা তোমার কমিউনিজম রাখো! আমরা ওসব জানি।
–কী জানিস বল অশোকের স্বরের উত্তাপ বাড়ল।
–সব জানি। আর এও জানি তোমরা দেশের শত্রু–
—অজু, চুপ করলে?
অজয় নিজের মনে গুম গুম করতে লাগল।
অশোক উত্তপ্ত স্বরে বললে, ফ্যাসিস্ট এজেন্ট। বড়োলোকের দালাল। আজ বাদে কালের কথা মনে পড়ে যখন হিন্দু মুসলমান ভাই বোনরা বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর দাদার ডাক শুনবে কে। পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস প্যালেস্টাইনের কথা? জানিস আয়ারল্যাণ্ডের কথা, মূর্খ।–কিন্তু একটা তীব্র আর্তনাদ শুনে হঠাৎ অশোক থেমে গেল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখলো, মা আরও অস্থির হয়ে পড়েছেন।
কয়েকদিন পরে। অশোক বাইকে চড়ে একাট সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মিটিং-এ যোগদান করতে যাচ্ছিল। এক জায়গায় নির্জন পথের মাঝখানে খানিকটা রক্ত দেখে সে বাইক থেকে নেমে পড়ল। সারাদিন আকাশ মেঘাবৃত ছিল বলে রক্তটা তত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়নি, এখনও খানিকটা লেগে রয়েছে। কার দেহ থেকে এই রক্তপাত হয়েছে কে জানে। অশোকের চোখে জল এল, সব কিছু মনে পড়ে গেল। সে চারিদিক ঝাপসা দেখতে লাগল, ভাবল এই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে কবে?
পথবর্তী
ঘরে আর কেউ নেই।
মালতী জিনিসটা এপিট-ওপিট করে বল্লে, আহা এটা কী দিয়ে তৈরি বলুন তো?
সুব্রত ঢালটি পরীক্ষা করে বললে, নিশ্চয় লোহা।
মালতী খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বল্লে, মোটেই নয়, তার ধার কাছ দিয়েও নয়। এটা গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি। দেখতে ঠিক লোহার মতো মনে হয়, না?
সুব্রত বিস্ময়ের স্বরে বললে, হ্যাঁ, কিন্তু এ দিয়ে গুলি ফেরানো যায়?
-হুঁ খুব যায়। গন্ডারের চামড়া যে খুব শক্ত এটা জানেন না?
-জানি।
—তার চেয়েও শক্ত এটা। জলে ভিজিয়ে রোদে শুকিয়েছে, একেবারে লোহার মতো হয়ে গেছে। এগুলো আগে আরও অনেক ছিল, হাতে হাতে কতকগুলি নিখোঁজ হয়ে গেছে, এখন এই কয়টি মাত্র আছে। মালতী ঢালটি আবার নেড়েচেড়ে বললে, মনে করুন এর মধ্যে কতগুলি এসে লেগেছে, কত লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছে এটা।
সুব্রত বললে, অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রাণ বাঁচানোর কোনো অর্থই হয়তো নেই মালতী। ধরো, এখন যারা আত্মরক্ষা করে এটা দিয়ে অথচ নীতি তাদের ভালো নয়, হয়তো পাজি, অত্যাচারী তখন সেই আত্মরক্ষার পক্ষে কী অর্থ হতে পারে?
-মানে তখন ওর কোনো মূল্যই নেই?
-একেবারে ভুল! মালতী হাত নেড়ে বললে, জীবন রক্ষা তা শত্রু-মিত্র যারই হোক, বা যে কোনো রকমের হোক—শেষ পর্যন্ত জীবনের রক্ষাই। সুকৃতি দুষ্কৃতির মূল্য, সেটা মানুষের দাবি, তারই নিজস্ব ব্যাপার, তাতে এই ঢালের কী এসে যাবে। এর যা মূল্য আছে, আছেই। তেমনি মানুষের বেলায়।
মালতী মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে কথা বলে বটে। সুব্রত এতে একটুও আশ্চর্য হল না এবং হেসে বললে, তুমি ভুল করছে। যে একটা খারাপ কাজ করছে তাকে জেনে-শুনে সহায়তা করলে প্রশ্রয় দেয়া হয় জানো?
-হুঁ। তাতে আমার কী এসে যাবে?
-এসে যাবে এই যে, তুমিও তার ফল ভোগ করবে। কারণ, একটা পাপকে প্রশ্রয় দিয়েছো।
মালতী হাঁ করে তার দিকে কতক্ষণ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু বলল না।
বেশি রাত না হলেও চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ।
এমন সময় ব্রজকিশোর বাবুর ডাক শোনা গেল। মালতী ব্যস্ত হয়ে বললে, আপনাকে বাবা ডাকছেন চলুন।
একটা বড়ো ঘর। পুরোনো আসবাবপত্রে ভরা। দেয়ালে বড়ো বড়ো ছবি, সোনালি কাজ করা ফ্রেম দিয়ে আটা। বেশির ভাগই রবি বর্মার—আর কয়েকটি বিদেশি চিত্রকরের আঁকা। ছাদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি অকর্মণ্য ঝাড়। ঘরের আলোটা-তেলের প্রদীপটাও দেয়ালের গায়ে। মেঝেটা আয়নার মতো চকচক করে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একপাশে প্রকান্ড পুরোনো দিনের খাট—তাতে খুব পুরু বিছানা—ধবধবে চাদর। সেখানে একটা মোটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে ব্রজকিশোরবাবু বসেছিলেন। তাঁর মাথায় চুল বেশি নেই, খুব ছোটো ছোটো করে কাটা, মুখটা বড়ো, বড়ো একজোড়া গোঁফ, শরীরের চামড়া ঢিলে হলেও খুব বলিষ্ঠ। গায়ের রঙ খুব ফর্সা।
তিনি চোখ বুজে বসেছিলেন। সুব্রত যে এসেছে টের পাননি।
সুব্রত বললে, আমাকে ডেকেছিলেন?
ব্রজকিশোর বাবু চোখ মেলে বললেন, হ্যাঁ। একা বসে আছি তাই মনে হল সুব্রতকে ডেকে না হয় কতোক্ষণ গল্প করি। কোনো কাজ ছিল?
–না কাজ আবার কি? এখানে এসেও যদি কাজ থাকে তাহলে তো মুস্কিল। ব্রজকিশোর বাবু হেসে বললেন, কেন ধরো চিঠিপত্র লেখা, পড়াশুনো করা। ও কী–বসো।
সুব্রত বিছানার একপাশে বসল।
ব্রজকিশোর বললেন, পুজো আসছে অথচ এখন মনে হচ্ছে না পুজো বলে কিছু আছে! এমনি দিনকাল। মানুষ কী করবে? আগে খাবার, তারপর তো কাজকর্ম!
সুব্রতও আশ্চর্য হল একথা শুনে। প্রাচীন—বিশেষত যাঁরা ধর্মপ্রাণ তাঁদের মুখে এমন কথা বড়ো শোনা যায় না।
ব্রজকিশোরবাবু বললেন, মানুষের এইসব হৃদয়বৃত্তির মূলে, এটা তো জানো, অনেক শ্রদ্ধা-ইচ্ছা থাকে, কাজেই যখন এগুলোও কোনো অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় তখন ওপর থেকে কোনো অভিশাপের ভয় নেই—কী বল? অথচ অনেকে এটা বোঝে না। আর এ তো সহজ কথা, যেখানে আমারই বিস্তর প্রয়োজন, অথচ সেই সব অনুষ্ঠান আমাকে বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হল সেখানে তো আমার নিজেরই ক্ষতি। এই বলেও একশ্রেণির লোকদের বোঝানো যায় না। ওরই তো এই দোষ। কত বলি…
সুব্রত বললে, প্রত্যেক মেয়েরই এই দোষ।
—ঠিক বলেছ। এটা যেন তাদের বদ্ধমূল সংস্কার। যদিও আমার কিছু আসে যায় না তাতে। তবে কালের প্রভাবে মানুষের জীবন পদ্ধতি অমনভাবে বদলে যাওয়ায় আমাদের অভ্যস্ত চোখেও ওসব ঠেকে। বিশেষত আমার স্বভাবটাই হচ্ছে তাই। যা নতুন কিছু মঙ্গল আসবে তাকে অবহেলা করি না, বরং প্রসন্ন মনে গ্রহণ করি। বিশ্বাস কর।
-হ্যাঁ। কিন্তু অনেক সময় তখনকার অবস্থানুসারে সব নতুনকেই মঙ্গল বলে মনে হয় না।
-তা ঠিক—ব্রজকিশোরবাবু বাইরের দিকে চাইলেন। এই দৃষ্টির ভিতর দিয়ে যেন কোনো দূরাতীতে তিনি চলে গেলেন। বললেন, তা ঠিক। নইলে মাইকেল যা লিখেছেন তা দিয়ে জীবিতকালে তিনি এতটুকু খ্যাতি বা প্রশংসা পাননি—এবং অনেক কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু পরে—মরবার পর মানুষ তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধায় স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। অথচ বেঁচে থাকতে খুব কম লোকই তাঁকে বুঝল। আমরা তাঁর কাব্য পড়েছি ছোটোবেলায়। ইস—সে কী ভালোই না লেগেছে। ওই যে কী বলে—
রুষিলা বাসবত্রাস! গম্ভীর যেমতি নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, কহিলা বীরন্দ্র বলী— চমৎকার না?
–হ্যাঁ।
ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, কাব্যের কথায় এসে পড়ল কবির কথা। আমার বাবা, জানো, তিনি কবি ছিলেন—অনেক কবিতা লিখেছিলেন। লোককে কত গান বেঁধে দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রায় সব লেখাই আমার কাছে আছে। একদিন দেখো তুমি। তোমাদের যারা লেখে টেখে তাদের অনেকেই এই গুণটি বংশানুক্রমিক পায় শুনি—কিন্তু আমার বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখলে, না?
তিনি সুব্রতর মুখের দিকে তাকালেন।
ব্রজকিশোর বাবুকে যারা ভালো জানে, তারা কখনই কথার শেষে তাঁর না-র প্রয়োগ দেখে বিস্মিত হয় না কারণ এটা জানা, তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে না উক্তি কোনো মতামতের অপেক্ষা না রাখলেও সর্বদা প্রযুক্ত হবে।
সুব্রত বললে, ওটা যে বংশানুক্রমিক সম্পত্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা সত্যি নয়। তাই আপনি যে ব্যতিক্রম হবেন, তাতে–
-তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, এই তো? ব্রজকিশোরবাবু হাসতে লাগলেন। বললেন, ঠিকই, ওটা কখনোই সত্যি নয়, নইলে রামের ছেলে রামই হত। আমার বাবা যা করেছেন তা তোমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হবে। সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। যুগ অনেক রকম হয়, আমাদের সময়ের সঙ্গে তোমাদের সময়ের মিল নেই। তোমরা যা পেয়েছে আবার আমরা তা পাইনি। এ যেন বিকেলের মেঘ, ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে রং। কিন্তু আমার–
সুব্রত সাগ্রহে বললে বলুন।
ব্রজকিশোরবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন রাতারাতি অনেক লোক মেরে আবার তা লুকিয়ে চাপা দেবার কাহিনি শুনেছ?
সুব্রত শিউরে উঠল।
—আজকাল একে বলে বর্বরতা, কিন্তু তখনকার দিনে কী বলতো জানো? আভিজাত্য সম্মান। ব্রজকিশোরবাবু এক বিকট হাসি হেসে বললেন, তোমাকে আগেই বলেছি সময়ের সঙ্গে সব কিছু বদলাচ্ছে। একদিন যা নিজের হাতে করতে পেরেছি আজ তা ভাবতেও পারিনে-না, না, পারব না কেন, খুব পারি। জানো, মানুষের দৈহিক আবরণের ভিতর একটা পশু লুকিয়ে আছে। হিংস্রতা আর কাকে বলে!
বিস্ময়ে তাঁর বলিষ্ঠ দেহের দিকে সুব্রত চেয়ে রইল।
-হিংস্র আর কাকে বলে! পদ্মাপারের মানুষ আমরা। সয়েছি ওর চিরক্ষুধার রাগকে। সব বুকে পেতে নিয়েছি। তারপর দিনের পর দিন ওর রাগকে হজম করে একদিন আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলাম, আমার চারদিকে কেবল রক্ত আর রক্ত। ওরে বাবা, সে কী লাল রক্ত! ব্রজকিশোর তাঁর চেহারার এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, তখনও বাবা ছিলেন বেঁচে। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী? উত্তর এল, কাশিমপুরের দাম্ভিক জমিদারের লাঠিয়ালদের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে—তাইতেই এত লাল—কিন্তু কিছু নয় ব্রজ। কালই এই রক্তরাঙা পথে উড়বে ধুলো, ধূসর বর্ণের রোজকার মতো বইবে মেঠো বাতাস—সেই সঙ্গে যদি চাও শুনতে পাবে বৈরাগীদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মেশানো গান। কিন্তু পদ্মার গর্জন নয়-কে আর কী করবে বল?
সুব্রত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেবল বললে, তারপর?
—তারপর যা কথা তাই! তোমাকে একদিন দেখাব একাটা জিনিস—
এমন সময় মালতী ঘরে ঢুকে সুব্রতর কাছে এসে বললে, আপনাকে মা ডাকছে।
ব্রজকিশোর বাবু একটু উষ্ণ হয়ে বললেন, একটা আলাপ করছি দেখতে পাচ্ছো-আবার ডাকাডাকি! কেন আর কি সময় নেই!
–খাবার যে তৈরি!
–ও, সুব্রত তুমি খাওনি?
সুব্রত নীরবে হাসল। ব্রজকিশোর বাবু মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, যাও একটু পরে আসবে। বলোগে।
মালতী চলে গেল।
—কত কাহিনি আছে। সে সব বলতে গেলে সময়কে পাওয়া যাবে না খুঁজে —নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে অতীতের কোঠায়। তুমি অনুভব করবে—তার চেয়ে অনেক বেশি অনুভব করব আমি। সুব্রত, আজ তোমার সাথে বসে আমি গল্প করছি, কিন্তু পনেরো বছর আগে কী এমনিই ছিলাম? আমি যদিও বদলে যাইনি কিন্তু আমার চার দিকে আবহাওয়া বদলেছে।
-আপনার পাওনা আমরা কী করে কেড়ে নিতে পারি?
ব্রজকিশোর হেসে বল্লেন, তা কেমন করে বিশ্বাস করি বল? আর আমাদের মনের কথা তোমরা কী বুঝতে পারবে? কখনো-না।
—আমাদের মনের কথাও আপনারা বুঝতে পারেন না।
-তা কেমন করে পারব হে? তোমাদের সঙ্গে আমরা দৌড়োতে কী পারি? ব্রজকিশোরবাবু আবার খুব হাসতে লাগলেন। হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, তারপর কী বলছিলাম? পনেরো বছর আগের ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর কথা না?
সুব্রত দেখতে পেল, অদূরে উপবিষ্ট ওই মানুষটির মনের দুঃখে চোখ এখন নিজের বিগত আত্ম-ইতিহাসের পাতায়—যেখানে মহিমা উজ্জ্বল পূর্বপুরুষের ছায়া; হয়তো নিষ্ঠুর বর্তমান তাঁকে দিচ্ছে ব্যথা, অপমান।
ব্রজকিশোরবাবু বললেন, সেই পদ্মার কথা না? কী জানো, শহরের এই ইটের স্কুপের আড়ালে বসেও আমি যেন পদ্মার ডাক মাঝে মাঝে শুনি, আমাকে সে ডাকে। তাই একসময় ইচ্ছে হয় সব ফেলে চলে যাই আবার সেখানে। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিই, সেখানে গিয়ে নিজেকে অনুভব করি। এখানে বিষাক্ত বাতাস, আমার শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। সব সময় মনে হয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে—এ যে একাট সাদা কঙ্কাল!
–তবে আবার সেখানে ফিরে যান না কেন? ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, সাতবার আমাদের বাড়ি পদ্মা নিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি চারবার। বাড়িতে সে কত মহল, কত ঘর-দুয়ার! শুনে আশ্চর্য হবে, এক ঘরে বন্দুকের আওয়াজ করলে অন্যদিকের আর একটি ঘরে কিছুই শোনা যেত না। এত ঘর যে অচেনা কাউকে সেখানে ছেড়ে দিলে বার হতে কষ্ট হত। কিন্তু তাতে পদ্মার কী আসে যায়? এবং বড়ড়ার উপর লোভ তার বেশি। অনেক দিনের পরিশ্রমে তৈরি ঐশ্বর্যকে তাই একরাতে টেনে নিলে। সেই রাতটি আমার এখনও মনে আছে।
—তবু তো পদ্মাকে ভালোবাসেন?
—নিশ্চয়। ধ্বংস করতে যার পরিতৃপ্তি—ধ্বংস হতেও যে তার এতটুকু ভয় নেই। জন্ম হতে যার সঙ্গে দিন কাটিয়েছি, যাকে ভেবেছি স্বভাবমিলের বন্ধু—তার দেওয়া ক্ষতি সহ্য করতে পারব না এমন অহংকার আমার নেই। কিন্তু এই দ্যাখো, তুমি যে খেতে যাবে এটা ভুলেই গেছি। যাও—এই বলে ব্রজকিশোর বাবু চুপ করলেন।
সুব্রত ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দায় এল। সেখানে গভীর অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। চৌধুরীদের সমস্ত প্রতাপ সমৃদ্ধি যেন ওই সীমাবদ্ধ! সুব্রতর হাসি পেল, কিন্তু হাসতে কষ্ট হল।
এই অন্ধকার হেঁটেই গেল। একটি ঘরে আলো জ্বলছে। সে সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, ঘরে কেউ নেই। গলা বেশি উঁচু না করেই সে ডাকল—
–মাসিমা–মাসিমা—
–এসো।
স্বর লক্ষ করে সুব্রত খাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। লীলাবতী তার অপেক্ষায় বসে আছেন। কাছেই মালতী।
-আপনি আমার জন্য অনেকক্ষণ বসে রয়েছেন!
লীলাবতী কোনো উত্তর না দিয়ে একটু হেসে বসতে বললেন।
পিড়িতে বসে সুব্রত বললে, অল্প দেবেন। আমার কিন্তু খিদে নেই।
রাত বেশি হচ্ছে বলে লীলাবতী পঞ্চুর মাকে বিদায় করে দিয়েছেন। বাড়ির মধ্যে ওই একটিমাত্র ঝি। তিনটি প্রাণীর সংসারে এর চেয়ে বেশি লীলাবতী চান না। তা ছাড়া রান্না করা আর খাওয়ানো তাঁর বিশেষ কাজ, নিষ্ঠার তৃপ্তি। সুব্রত তাঁর বাপের বাড়ির গাঁয়ের অতি দূর সম্পর্কের। হয়তো বা আত্মীয়তার চেয়ে অনিষ্টতাতেই সেখানে সম্পর্কের সৃষ্টি—এক বোনের ছেলে। এখন বিদেশে থাকে। অনেক বছর পর এসেছে। বড়ো হয়ে এই প্রথম তার লীলাবতীর সঙ্গে ভালো করে পরিচয়।
এখানে আসবার পর কয়েকটা দিন কেটেছে।
মালতী বললে, সে কী! খোট্টার দেশে ডালরুটি খেয়ে খেয়ে মুখ ফিরিয়ে এখন নিজের দেশে বসে খিদে বরং বাড়বে যে!
সুব্রত মুখ তুলে হেসে বললে, না মালতী। সেখানে বদহজম হয়ে গেছে। তাতে যে খিদে একেবারেই থাকে না।
-তাই হবে।
লীলাবতী এবার মালতীর দিকে চেয়ে বললেন, তুই আবার ওর কথায় সায় দিয়ে বসলি? ওর না-খাওয়ার অজুহাতকে প্রশ্রয় দেয়া হল না?
মালতী অপ্রতিভ হল।
সুব্রত বললে, অজুহাত মোটেই নয়। বিশ্বাস করুন মাসিমা আজ আমার সত্যি খিদে নেই।
–আচ্ছা সে কথা পরে হবে।
–পরে হবে মানে? ব্যাপারটা যে এখনেরই! সুব্রত হেসে উঠল।
লীলাবতীও হেসে বললেন, সুব্রত, ছোটোবেলায় তোমাকে দেখেছি যে উলটো?
–দেখুন মাসিমা ছোটোবেলা এমন একটি বয়েস যার গায়ের রঙ আর কোনো কালের রঙের সঙ্গে মেলে না। শুনেছি তখন কেবল নদীর দিকে ছুটে যেতাম। কিন্তু এখন জল দেখেই ভয় হয়, সাঁতার জানিনে! একেবারে উলটো।
-কি বল? তাহলে একেবারে খোট্টাই হয়ে গেছো দেখছি!
—কতকটা বটে। লীলাবতী একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, তাহলে জলপথে বেড়ানো তোমার পক্ষে ভালো নয়।
–তা বটে।
এরপর কতক্ষণ চুপচাপ। সুব্রত মুখ নীচু করে নিঃশব্দে খেতে লাগল।
মালতী হঠাৎ বললে, ও কথা সব সময় সত্যি নয় মা। আমি এমন অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারি যেখানে খুব ভালো সাঁতার জেনেও জলে পড়ে মরেছে। তোমার
কী মনে নেই মাসেই
-তা জানি। কিন্তু সেটা হল অদৃষ্টের কথা। সাঁতার জানলে একটা আশা অন্তত থাকে তো?
মালতী কোনো উত্তর না দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে চেয়ে রইল। তার এমন হয়, মাঝে মাঝেই হয়, পূর্ণ উদ্যমে একটা আলোচনায় যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারে না, ভেঙে পড়ে। কিন্তু সে নিজেও বুঝতে পারে তার এই স্বভাবের দুর্বলতা এবং এটা খুব বেশি দিনের অর্জিত নয়—সুব্রত আসার পর থেকেই। অথচ আলোচনার মাঝে ভেঙে পড়ায় সুব্রতর সঙ্গে যে কী সম্পর্ক সেটাও বিবেচ্য এবং এটা যেন একটা মিষ্টি স্বপ্ন। মালতী দেখে, এই স্বপ্নের রাত সবে শুরু হয়েছে। মালতী একটা কোমল প্রার্থনায় উল্লসিত হয়ে ওঠে : হে ঈশ্বর, এই রাতের উত্তরীয়কে মেলে দাও অশেষের দেহে।
তার আকস্মিক অন্যমনস্কতার কারণ যদি কেউ খোঁজে তবে এখানেই হয় তো একটু আলোর রেখা পাওয়া যেতে পারে, হয়তো পারে না, কারণ এখনও মালতী স্থির নিশ্চয় নয় সে কোনো ভিন্ন পথে চলেছে কি না, সে পথে তার একা চলায় সেই রাতটির সান্নিধ্য আছে তো!
কীসের সেই স্বপ্ন?
মালতীর অন্যমনস্কতা বেড়ে চলে। অথচ কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার স্থিরতা নেই। চাইবার নির্দিষ্ট স্থানে সেখানে দৃষ্টির ক্লান্তি আসবে তার অক্লান্ত অন্যমনস্কতায় চোখের কার্যক্ষমতা শতগুণ বেড়ে যাবার কথা, এ ব্যাপারটা ভাববার এবং কাজে লাগাবার অবসর তার আছে। তাই দুপক্ষের গাম্ভীর্যনিবিড় নিস্তব্ধতায় মালতী তার স্বপ্নের পথ দিয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছোল যা সুব্রতও গভীরভাবে চেয়েছে।
সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। খাওয়ার পর শোবার ঘরে ঢুকবার সময় সুব্রত দেখল অন্ধকার বারান্দায় যে মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে মালতী।
সুব্রত কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললে, তুমি?
-হ্যাঁ।
–আচ্ছা মালতী, একটা কাজ করবে?
–বলুন।
-আমার একটা অভ্যাস—ঘুমুবার আগে বই না পড়লে বা কাছে বসে কেউ গল্প না করলে ঘুম হয় না। আপাতত বই যখন নেই তখন তুমি একটু গল্প করবে?
এ ছাড়া আর উপায় নেই তবু নির্লিপ্তভাবে মালতী বললে, আচ্ছা।
সুব্রত তার হাত ধরল—যদিও হাত ধরার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এবং দুজনে একসঙ্গে ঘরে ঢুকল। সুব্রত ঘুমুবার চেষ্টা না করে বসল একটা চেয়ারে, মালতী তার বিছানায়।
আগের সহজতা যদি ফিরিয়ে আনা যেত তবে মালতী যে কাউকে মনেপ্রাণে আশীর্বাদ করত। সুব্রত বললে, ছুটি ফুরিয়ে এল। এখন না-যাওয়াকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না।
এইবার মালতীর চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয়, সে বললে, কী বললেন?
–বোধ হয় পরশু চলে যাব। এখানে অনেক দিন রইলাম। জীবনে একটা পরিবর্তন হল। কয়েকটি আপনার মানুষকে চিনতে পারলাম তাদের ভালো লাগল। এখন পশ্চিম মরুভূমিতে ফিরে গিয়ে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ত আর হবে না—ঠিক সেখানেই মুশকিল। উপায় যদি থাকত তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
হঠাৎ এ কথার কী মানে মালতী তা বোঝে। তাই অভ্যাসমতো অনির্দেশ তাকাতে লাগল–দেখল, ওপরের দিকে, ফটোতে, মেঝেতে, চারদিকে। তারপর যখন তার এই অভ্যাসের সাময়িক সমাপ্তি হল সুব্রতর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ে, তখন সে একপলক হেসে বললে, ঠিক নিয়ে যাবেন তো? তাহলে বাবাকে বলি?
-বলো।
—সেখানে কিছু দেখবার আছে?
—অনেক কিছু। কিন্তু তুমি কী সে সব দেখবে? যেন সেখানে তারা ইতিমধ্যে চলে গেছে এভাবে সুব্রত বললে।
—না।—স্পষ্ট এই বলে মালতী তার কাপড়ের আঁচল এমনি পাকাতে লাগল।
সুব্রত তার হাতের দিকে চেয়ে রইল। সুন্দর, নিটোল, ফর্সা, অনেকগুলি চুড়িতে ভরতি আঙুলগুলো সরু, শীর্ণ-কথার সঙ্গে এঁকে বেঁকে নড়ছে।
সে বললে, ভারী সুন্দর তো! দেখি তোমার হাতখানা। মালতীর চোখে বিস্ময় নেমে এল। ধীরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষণেক পরে সে অনুভব করল : একটি আলোর রেখা যেন তার হাতের লোমকূপ দিয়ে প্রবেশ করে শরীরের অণু-পরমাণুতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন বোধ হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রীকে আক্রমণ করেছে, নইলে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় কেন? সে স্তব্ধ হয়ে তার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সুব্রত বলেল, তুমি খেয়েছো? যাও—
বিছানার উপর হাত দুটো আরও ছড়িয়ে আরও চেপে বসে মালতী বললে, মার সঙ্গে খাব—আপনার এখন ঘুম আসবে না আমি জানি।
–সেটা তো তোমারই আগে জানবার কথা।
কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে মালতী হেসে বললে, বারে আপনি আবার তা জানলেন কেমন করে?
সুব্রত সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে বললে, মালতী, আমার সত্যি বড়ো ঘুম পাচ্ছে। তুমি এনে দেবে তাতে একটা স্বপ্ন?
হে মালতী!
স্বপ্নাঞ্চল মেলে ধরো আমার চোখেতে!
মালতীর দু-চোখ কী এক স্নিগ্ধতায় নিবিড় হয়ে উঠল। সে একুট ঝুঁকে পড়ল।
কোনো এক অলিখিত কাব্য টুকরো টুকরো হয়ে সেই ঘরের বাতাসে শূন্যতায় গভীরভাবে মিশে গেল।
আলোর রেখাগুলো যেন কাঁপতে লাগল।
–মালতী—ও মালতী–
লীলাবতী এসে ভয়ানক চমকে উঠলেন। মালতী তার রেশমের মতো হালকা, মসৃণ খোলা চুলগুলি খোঁপায় ঠিক করতে করতে মার কাছে এসে মুখ নীচু করে দাঁড়াল।
বাইরের দুরন্ত বাতাস ঘরে এসেও মাতামাতি করছে। সুব্রত একা নিদ্রাহীন বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। তার মনে হল : ব্রজকিশোর বাবুর মতো সেও যেন আজ কোন আর এক পদ্মার প্রবল কলোচ্ছ্বাস শুনতে পাচ্ছে।
যখন সে জাগল তখন একটু বেলা হয়ে গেছে। অনেকখানি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে বিছানার। সে ব্রজকিশোরবাবুর উঁচু গলায় স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ শুনতে পাচ্ছে।
লীলাবতী গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে। কিন্তু চিরকালই ঠিক এমনি ছিলেন কি না তা অজ্ঞাত। আজ কতোদিন হয় কে জানে—আশ্চর্য ব্যাপার-স্বামীর সঙ্গে তাঁর এতটুকু কথা পর্যন্ত হয় না। ছোটো চৌধুরী পরিবারে এ নিয়ে কোনো অসুবিধে বড়ো দেখা যায়নি। এবং এত সহজ যে, যে কেউ প্রথম এলে তার চোখে এটা ধরা পড়বে না, যে পর্যন্ত না কেউ বলে!
এমনিও দেখা যায়, লীলাবতীর আত্মমর্যাদাবোধ বড়ো প্রখর। বোধ হয় তাতে কোনোদিন কোনো আঘাত লেগেছিল এবং সেইজন্য তিনি তাঁর নিজের স্বামীকেও সইতে পারেননি।
কিন্তু এতদিন সাংসারিক সব কিছু অভাব-অভিযোগ, ত্রুটি একা নিজের মনেই বিচার করে সফল হয়েও আজ সত্যি জটিলতায় পড়ে পথ হারিয়ে ফেললেন, তারপর সারারাত ভেবে কোনো কুলকিনারাই পেলেন না।
এখন অনেক বেলা হয়েছে। লীলাবতী কাজের ফাঁকে কেবল ভাবতে লাগলেন। এরকম মানসিক দ্বন্দ্বে সারাজীবনে আর পড়েননি।
শেষে একটা উপায় স্থির হল।
তখন দুপুরবেলা। বাইরে রৌদ্র খাঁ-খাঁ করছে। চারিদিকে অখন্ড নিস্তব্ধতা।
লীলাবতী যেভাবে সাধারণত থাকেন সেভাবেই ঘোমটা দিয়েই ব্রজ কিশোরবাবুর ঘরে ঢুকলেন। কতোদিন পর এই প্রথম তাঁর এ ঘরে আসা এবং কথা বলা!
কিন্তু ব্রজকিশোর বাবু আশ্চর্য হলেন না। যেন সব সময়েই কথাবার্তা হয় এমন ভাবে অথচ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, কোনো কথা আছে?
–হ্যাঁ। লীলাবতীর কোনো ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না, তিনি সহজভাবেই বললেন, মালতীর বিয়ের তো কিছুই করা হচ্ছে না?
-পেলে তো হবে।
—আমি বলি সুব্রতর সঙ্গে—
ব্রজকিশোর বাবুর চোখদুটি বড়ো হয়ে উঠল।-কী বললে? নলহাটির চৌধুরীদের মেয়ের বিয়ে হবে একটা সামান্য…তোমার আত্মীয় বলে জাত খোয়াতে যাব? অর্থ-অসামর্থ্যের সুযোগ নিচ্ছ? মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিলেও তা হবে না, কক্ষনো না, মরে গেলেও না। অতিথিকে আদরযত্ন করা মানেই কী তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেয়া?
–দেয়ার কারণ ঘটেছে বলেই বলছি।
ব্রজকিশোরবাবু প্রথম একটু আহত হয়ে পরে আবার কঠিন স্বরে বললেন, যা ইচ্ছে ঘটুক, তুমিই একমাত্র সেটা জানো, লোকের মধ্যে রটে গেলে তুমিই সেজন্য দায়ী থাকবে। কিন্তু তাও যদি হয় তবু ওর সঙ্গে আমি মেয়ের বিয়ে দিতে পারব না, দেব না জেনো। রায়চৌধুরী বংশের এমন অপমান করলে পূর্বপুরুষেরা অভিশাপ দেবেন। আমি ঠিক জানি তাঁদের মৃত আত্মা শান্তি পাবে না।
লীলাবতী সেখানে আর এক মুহূর্ত না থেকে নিজের ঘরে এসে দরজা দিলেন। মেয়ের কথা মনে করে আজ অনেক দিন পরে এই প্রথম তাঁর দুচোখ ছাপিয়ে কান্না এল।
পরদিন।
সুব্রত ঠিকই চলে যাচ্ছিল। জিনিসপত্র সঙ্গে তেমন কিছু নেই। যা আছে, ঠিক করা হয়েছে।
বারোটায় গাড়ি।
লীলাবতীর কচিৎ সাক্ষাৎ মিলেছে। আর মালতীর তো একেবারেই নয়। খাওয়া দাওয়ার পর সে ব্রজকিশোর বাবুর ঘরে এল।
তিনি বললেন, এখনও তো সময় আছে। বসো।
সুব্রত বসল।
—আমার ইচ্ছে তুমি পুজো পর্যন্ত থাকো।
-সে তো অনেক দেরি?
-তা হোক না। বাঙালির ছেলে পুজো না দেখতে পারলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য কী আছে? তা ছাড়া আমরা তোমার পর নই। তুমি থাকলে কত আনন্দ হত। পূর্বপুরুষেরা যা রাজসিকভাবে করেছেন তাই কোনো রকমে চালিয়ে নিই আর কী! তখনকার দিনে যা হত তা শুনলে আশ্চর্য হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না, এখন তো তার শতাংশের একাংশও নয়। আর একটা ব্যাপার শুনলে অবাক হবে–আমার বাবা এবং তাঁর পূর্বপুরুষেরা সকলে নিজেরাই দুর্গাপুজো করেছেন, কোনো বামুন পুরুত লাগেনি, আর এমন মন্ত্র জানতেন যা অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরাও জানেন না। অথচ আমি তাঁরই ছেলে। বংশানুক্রমিক গৌরব অর্জন না করার ধৃষ্টতা আমার আছে!
আরও অনেক কিছু বললেন ব্রজকিশোরবাবু। কতোক্ষণ পরে সুব্রত প্রণাম করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।
লীলাবতীকে পাওয়া গেল। কিন্তু কোনো রকমেই মালতীর দেখা পাওয়া গেল না।
সুব্রত স্টেশনে এল। টিকেট করে একটা নির্জন কামরা বেছে নিল। তারপর হুইসল দিয়ে গাড়ি ছাড়ল, শহরের সীমা ক্রমে বিলীন হয়ে গেল।
সুব্রত জানালায় মুখ রেখে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। দু-পাশে তখন মাঝে মাঝে জলচিহ্নাঙ্কিত খোলা মাঠ, ধু ধু করে। আরও দূরে একটানা গাছের সারি, মধ্যে উঁচু তালগাছ।
মাঠ ভরা মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্র ঝিম ঝিম করে।
সে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখতে বসল। মালতীকে লিখতে লিখতে চোখে জল ভরে এল। সে কাগজটা তুলে জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে ছেড়ে দিল।
প্রবল বাতাসের বেগে সেই চিঠি পড়ল গিয়ে এক বাবলা গাছের ছায়ায়। প্রান্তর পার হয়ে সেখানে গভীর বনানী-অজস্র বুনো ফুলের গন্ধ, তার মাদকতা, বাঁশঝাড়ে কিচ কিচ আওয়াজ, পাখীর ডাকে মুখরিত আকাশ, হিংস্র প্রাণীদের নির্ভয় বিচরণ, আর নির্জনতার গন্ধে ভরপুর।
গাড়ি চলে গেল।
আর মালতীকে লেখা সেই চিঠি বাবলা গাছের ছায়ায় বসে বুনোফুলের গন্ধ শুকতে লাগল।
প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘ পঁচিশটা বছর পরে।
বিকালের রোদের নীচে সরু আলোর পথ দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে প্রশান্ত ভাবিল, দীর্ঘ পঁচিশটা বছর পরে আবার এই প্রথম সে গ্রামের দিকে পথ চলিতেছে। সেই পরিচিত পথ। সেই বুনোফুল-ঘাস-লতাপাতার গন্ধ, শুকনো পাতার স্কুপে, কোনো অদৃশ্য প্রাণীর খস খস শব্দ, হঠাৎ কখনো সারি সারি আকাশ-ছোঁয়া তালগাছের সামঞ্জস্যহীন অবস্থিতি, সেই খেয়াঘাটের নৌকা ও মাঝি। বছরের পর বছর, মুহূর্তের পর মুহূর্ত কত পরিবর্তন চলিতেছে, কত স্বেচ্ছাচারীর চোখেমুখে উল্লাস, কত ডাকাত পরের অন্নে মাথা ঠোকাঠুকি করে, অথচ এখানে তার ছোঁয়াটুকু নাই। পঁচিশ বছর আগের পুরুষরা একদিন আকাশের দিকে চাহিয়া নিরুপায়ে কাঁদিয়াছে, তার বংশধরেরা আজও কাঁদিতেছে, তাহাদের চোখমুখ ফুলিয়া গেল। আকাশে কি একটা পাখি চমৎকার ডাকিয়া গেল। কিন্তু সেদিকে চাহিতে প্রশান্তর ভয় হয়। যে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহারা কপালে হাত ঠুকিয়াছে, সেই আকাশের দিকে প্রশান্ত তাকাইতে পারে না।
পথের একপাশে পাটখেতের ভিতর বসিয়া কয়েকটা লোক নিঃশব্দে খেত নিড়াইতেছে। হঠাৎ কখনো কোনো শহুরে চেহারার লোক দেখিলে পঁচিশ বছর বা তারও আগে তাহারা যেভাবে তাকাইত, আজও সেইভাবে তাকায়। চোখ ছোট করিয়া একজন বলিল, বাড়ি?—বাড়ি! প্রশান্ত মনে মনে একবার হাসিল। বাড়ি তাহার কোথায়! ভারতবর্ষের কোন গ্রামে বা শহরে বাড়ি?
পৌঁছিতে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। প্রশান্ত দেখিল, একটি ঘর প্রায় ধসিয়াই গিয়াছে, আর একটা ঘরের চাল নাই, কেবল কয়েকটি খুঁটি—একটা বট গাছ। ঘরের উপর দিয়া একেবারে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে, উঠান-ভিটা সমস্ত জঙ্গলে ভরা।
এই বাড়ি! এই বাড়ির ঠিকানাই প্রশান্ত পথের পাশের লোকদের বলিয়াও বলে নাই। পঁচিশ বছরের দীর্ঘ অজ্ঞাতবাসে সে বাঁচিয়া আছে বটে কিন্তু তাহার ছোটবেলার ক্রীড়াভূমি আত্মহত্যা করিয়াছে। কৈশোরের এই প্রাঙ্গণ হইতেই সে তাড়িত, কি একটা কারণে সংসারে একটা ভীষণ অনর্থ সৃষ্টি করায় শান্তিপ্রিয় বাবার চক্ষুশূল হওয়া, আর আজ এতকাল পরে তাহাকে আমন্ত্রণ করিতে একটি প্রাণীও নাই। প্রশান্ত ভাবিল, এখনো কেউ তাহার দিকে সন্দেহের চোখে চাহিতেছে কেন? লোকগুলি কি রাতারাতি মানুষ হইয়া গেল? সন্ধ্যার ঝাপসা আলোয় দুই-একজন যদি-বা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার দিকে তাকাইয়াছে, প্রশান্ত তাহাদের কষ্ট করিয়াও চিনিতে পারে নাই। নিশ্চয় তাহারাও তাহাকে চেনে না।
কয়েকটা চামচিকা ঝটপট তাহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল। আশেপাশে নানা রকম কীটপতঙ্গের অবিশ্রান্ত চেঁচামেচি শশানা যায়, বন্য লতাপাতার একটা
অদ্ভুত গন্ধও নাকে আসে।
বাঁদিকের একটা রাস্তা হইতে, প্রশান্ত যে পথে চলিতেছিল, সেই পথে পড়িয়া কে একটা লোক নিজের মনে গান গাহিতে গাহিতে সামনের দিকে চলিতেছে, তাহার পরনে লুঙ্গি, কাঁধে একখানা গামছাই হইবে, হাতে একটা নিড়ানি।
প্রশান্ত একেবারেই সামনে গিয়া পড়িল, বলিল, কালু মিঞা না?
লোকটা থামিল, গানও থামিল, ভ্রূ কুঁচকাইয়া তাহার দিকে তাকাইল।
সে যে কালু মিঞা ছাড়া আর কেহই নয়, ইহাতে নিশ্চিত হইয়া প্রশান্ত একবার হাসিল।-চিনতে পারলে না?
কালুর চোখের দৃষ্টি এবার সহজ হইয়া আসিল, ঠোঁটের দুইপাশে আস্তে আস্তে হাসি ছড়াইয়া পড়িল, তাহার দিকে একবার হাত বাড়াইয়া আবার কি মনে করিয়া আস্তে গুটাইয়া তাড়াতাড়ি বলিল : বন্ধু না?
হাত ধরিতে তাহার সঙ্কোচ দেখিয়া প্রশান্ত নিজেই হাত বাড়াইয়া দিল, হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ।
কালু আবার বলিল, বন্ধু-মশয় না?
-হ্যাঁ কালু।
বিস্ময়ে আর আনন্দে এবার তাহার হাত জড়াইয়া ধরিয়া কালু বলিল : এতকাল কই আছিলা গো, বন্ধু-মশয়? সেই কোন কালে গেলা, আর এতদিন বাদে ফিরা আইলা, একটা দুইটা দিন নাকি? আহারে, যে বুড়া বইনা গেছে দেখছি!
-আর তুমি খুব জোয়ান না?
—আমরা গেরামে থাকি, রৈদে বিষ্টিতে, ভিজে খাটি-পিটি, আমাগোর কথা ছাড়ান দাও–
প্রশান্ত চারিদিকে একবার চাহিল। এ গাঁয়ের নবীন বা প্রাচীন আর কেউ এ পথে আসিয়া পড়িলে তাহাকে দেখিয়াও দেখিবে না, অথবা চাহিলেও একটা বিশেষ করুণার দৃষ্টিতে তাকাইবে, ইহা সে চায় না। বিশেষত তাহারা যখন দেখিবে এক ঝাঁক কঙ্কালসার মানুষের মধ্যে একটি মেদবহুল মাংসল পুরুষ।
প্রশান্ত বলিল: তোমার ঘরে চলো কালু।
ঘরের চালখানা প্রায় মাটিতে নামিয়া আসিয়াছে। উঠানে একটা ছোট নারকেল গাছ।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। একেবারে কাছে না গেলে কিছুই চোখে পড়ে না।
উপুড় হইয়া প্রশান্ত ঢুকিল দাওয়ায়। তাহাকে বসিতে একখানা সিঁড়ি দিয়া কালু আলো আনিতে চলিয়া গেল। একটু পরেই কুপি হাতে ফিরিয়া আসিল। অগ্নিশিখাকে মধ্যবর্তী করিয়া এখন সবই স্পষ্ট দেখা যাইবে। কালু প্রশান্তর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। অন্ধকারে অনর্গল বকিয়াছে সত্য, কিন্তু এখন বোবা হইয়া গেল।
প্রশান্ত বলিল: কালু, একী অবস্থা দেখছি।
-কী?
এদিক-ওদিক চাহিয়া প্রশান্ত বলিতে দ্বিধা বোধ করিল, বলিতে পারিল না।
কিন্তু কালু কিছুই বুঝিতে পারে নাই, এমন নয়। দুই হাঁটু একত্র করিয়া তার উপর হাত রাখিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল : বন্ধু, তোমার ঘর ভাঙা গেছে, ধন আছে কিনা জানি না, আমার জন আছে এই একরকম, ধনের খোঁজও রাখি না, সবই নসিব, এই নসিবের খেলা।
কপালে আঙুল ঠুকিতে লাগিল কালু।
প্রশান্ত হাসিল।–হাস কেন?
প্রশান্ত আবার হাসিল, কিন্তু এবারও নিরুত্তর।
বারে মুখ টিপা-টিপা খালি হাস কেন?
কালু অধীর হইয়া উঠিল।
হাসি থামাইয়া প্রশান্ত বলিল : কি বলছিলে? নসিব, সবই নসিবের খেলা না?
-হ।
–কালু অমন কথা আর বোল না। দশজনের ভেতর নয়জন আমরা ভাল খেতে পরতে পাচ্ছিনে—কেউ না কেউ শুধু একবেলা খাচ্ছি, কারুর কোনরকমে দিন যাচ্ছে, আমাদের সকলের নসিব তাহলে খারাপ, তুমি এই মনে করো?
কালু স্তব্ধ হইয়া গেল। বাহিরের দিকে চাহিয়া কী ভাবতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে আবার হঠাৎ ডাকিয়া উঠিল: বাবা অলি, ও বাবা অলি। ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই বাহিরের বিপুল অন্ধকার ঠেলিয়া একটি দশ-এগারো বছরের ছেলে আসিয়া হাজির হইল। খালি গা, পেট মোটা, হাত-পাগুলি সরু সরু পরনে শুধু একখানা গামছা; প্রশান্ত লক্ষ করিল, তাহার হাঁটায় কেমন একটা জড়তা; একদিকে নিবদ্ধ চোখের দৃষ্টি।
তাহার চোখে বিস্ময়ের চিহ্ন দেখিয়া কালু তাড়াতাড়ি বলিল : পোলা আমার অন্ধ, জনম হইতেই— তারপর ছেলের দিকে চাহিয়া—কিছু তামুক আইনা দে তো বাবা?ছেলে চলিয়া গেল।
প্রশান্ত বলিল, আর ছেলে নাই?
উত্তরে কালু জানাইল, আর দুই ছেলে ভিন্ন গ্রামের দুই বাবুদের বাড়িতে কাজ করে; বড়ো-ছোটো দুইজনে যথাক্রমে তিনটাকা আর আড়াই টাকা মাসে পায়।
কোনোরকমে উত্তরটা কালু মনে মনে ভাবিল, নসিব কিছুই নয়?
কিন্তু প্রশান্তর খাওয়ার ব্যবস্থা তো করিতে হইবে। ব্যবস্থা সহজেই হইল। মুড়ি চিড়া-গুড়, দুইটি পাকা আম, কিন্তু আশ্চর্য, খাওয়ার জল নাই। প্রশান্ত একরকম চেঁচাইয়া উঠিল, বারে জল কোথায়?
কালু এতটা ভাবিতে পারে নাই। তাহার কথা শুনিয়া এমনভাবে তাকাইল যেন—অর্থাৎ কুয়া সামনেই আছে, নিজ হাতে তুলিয়া খাও।
দারুণ প্রতিবাদ করিয়া প্রশান্ত বলিল : না না, ওসব না, তুমিই এনে দাও, আমার জাত মারা যাবে না, আমাদের কোনো জাত নেই।
কালু অবাক হইল। লোকটা চিরকালই এমনি, কৈশোরেও এমনি অল্পবিস্তর পাগলামি করিয়াছে, আজও সেই স্বভাব বদলায় নাই।
কিন্তু বিস্ময়ের ভাব অল্পক্ষণেই কাটিল। আবার মনে মনে সে ভাবিল, নসিব কিছুই নয়?
লোকটার কথামতো খড় দিয়া বিছানা পাতিয়া দেওয়া ছাড়া উপায় কী। কালু উপর হইতে বহু দিনের সঞ্চিত একটা নতুন কাঁথাও আনিয়া পাতিয়া দিল, বিচিত্র খড়ের বিছানায় পরম পরিতৃপ্তিতে শুইয়া প্রশান্ত ভাবিল, দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতায় মাটির শয্যাও তাহার কাছে মনোরম, সুখের সময়ে পরম অখাদ্যই শ্রেষ্ঠ খাদ্য—এখবর কালু রাখে কী!
খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া একটু রাত করিয়াই কালু আবার আসিল। দাওয়ায় অনেকক্ষণ বসিয়া তামাক টানিল। ভিতরে তখনও জাগিয়া ছিল প্রশান্ত, শুইয়া শুইয়া তামাক খাওয়ার শব্দ শুনিতেছিল।
শেষে ভিতরে আসিয়া কালু আস্তে আস্তে ডাকিল, বন্ধু।
-বলো।
অন্ধকারে বিছানার পাশে বসিয়া কালু কী যেন একটু ভাবিল : তুমি আজকালও স্বদেশি কর?
প্রশান্ত মনে মনে হাসিল।সেদিন বড়ো ভুল করিয়াছিলাম বন্ধু, একলা পথ চলিয়াছিলাম। তোমাদের কথা কখনো ভাবি নাই, আজ আর সেই ভুল হইবে না। স্বদেশি করা কাকে বলে তা কালুই জানে।
প্রশান্ত কিছু না বলিয়া তাহার হাতটি শুধু ধরিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। চারিদিকে নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে কেবল নারকেল গাছে শব্দ, হাওয়ার দোলায়। এ ছাড়া টুঁ শব্দ শোনা যায় না।
প্রশান্ত বলিল : তুমি তখন বলেছিলে, আমার ঘর নাকি ভেঙেছে— কালু, বাবা-মার মৃত্যুর খবর আমি জানি, না জানলেও পঁচিশ বছর পরে ফিরে এসে তাঁদের দেখা পাওয়ার আশা করা উচিত নয়। কিন্তু আর মানুষ কোথায়? আমার পিসিমা, তার ছেলেমেয়েরা, ঠাকুরমা?
—তাঁরা! পিসীমারা তো তোমার বাবা যেই মইরা গেল তার কয়দিন পরেই চম্পট, এই শূন্যপুরীতে কে আর পইড়া থাকতে চায় কও? কিন্তু পইড়া রইল তোমার ঠাকুরমা, শূন্যি ঘর আগলাতে একা পইড়া রইল। বুড়ির শকুনির পরমায়ু, তা না অইলে আর এখানে আসিয়া কালুর গলার স্বর হঠাৎ থামিয়া গেল, যেন অন্ধকারে আস্তে আস্তে মিশিয়া গেল।
–তা না হলে কী? বল?
কালু আর কিছুতেই বলিতে চায় না, কোন ভুলে একবার আরম্ভ করিয়া হঠাৎ তাহার জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে, প্রশান্ত অনেক পীড়াপীড়ি করিয়া তবে যা জানিতে পারিল তা সংক্ষেপে এই: বুড়ির শকুনির পরমায়ু, একথা কালু আগেই বলিয়াছে। তা না হইলে আর শূন্যগৃহে পাহারা দিতে অতগুলি বছর বাঁচিয়া থাকে! আহা মৃত্যুর সময় বুড়ি যা কষ্ট পাইয়াছে তা নাকি মর্মান্তিক। শেষের দিকে তো কেউ তাহার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যাইতে পারে নাই, কেউ ভুলেও তাহার কাছে গিয়া উপস্থিত হইলে সে যা-তা করিয়া গাল দিত, আর অভিশাপের তো অন্ত নাই। হয়তো মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল। তাই কালুও শেষ পর্যন্ত খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিয়াও আর পারে নাই। শেষে হঠাৎ একদিন শুনিল, বুড়ি মরিয়া গিয়াছে এবং বড়ো কষ্টেই নাকি মরিয়াছে। রান্নার কিছু নামাইতে গিয়া হয়তো পা-দুটি একেবারে পুড়িয়া গিয়াছিল। তাহাই পাকিয়া-ফুলিয়া একদিন জ্বর হইয়াছে এবং তারপরেই—
প্রশান্তর চোখে জল আসিল। মৃত্যুর কথা তো নয়, মানুষ মরিলেও অনেক সময় শান্তি পায় এবং অন্যকে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর বুক হইতে শেষ নিশ্বাস গ্রহণ করিতে মৃত্যুকে লইয়া জীবনের এমন বিশ্রী কাড়াকাড়ি, যার শেষ দৃশ্য আরও নিষ্ঠুর আরও বিকট। সেই দৃশ্যের এমন তীব্র হীনতা যে চোখে জল আনিবে, এটা বিচিত্র নয়। কিছুক্ষণ পরে কালু হঠাৎ বাহিরে চলিয়া গেল, বলিল–
-বন্ধু, তুফান আইল!
–তুফান?
-হ! কী বাতাস ছাড়ছে গো! দেইখা যাও, দক্ষিণের আকাশটা কেমন লাল! লাল না, যেন আগুন?
—আগুন?
–হ বন্ধু, আগুন? কালু চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল,—সামাল তরী, সামাল মাঝি ভাই, সামাল তরী, সামাল। গাছে-গাছে শোঁ শোঁ আওয়াজ করিয়া ভীষণ হাওয়া বহিতেছে, আকাশে চিড়-চিড়ে বিদ্যুৎ আর মেঘের ডাক, ঘরের খুঁটির সঙ্গে-সঙ্গে চালখানাও কাঁপিয়া উঠিল, পৃথিবীর কাতর প্রার্থনা যেন ঝড়ের পায়ে দারুণ কুটোপুটি খাইতেছে।
প্রশান্ত জড়োসড়ো হইয়া পড়িয়া রহিল।
ঘুম ভাঙিল আবার কালুর ডাকেই। বোধহয় সকাল হইতে আর বাকি নাই। মুরগির ডাক শোনা যায়। কী আশ্চর্য, এখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার। প্রথম রাতের ঝড়ের কথা এখন স্বপ্ন বলিয়াই মনে হয়। দূরের আকাশে মধ্য রাতের চাঁদ উঠিয়াছে। কালু বলিল, বন্ধু, মাছ ধরিতে যাই।
কেন?
–বারে, তোমারে খাওয়ামু না? তুমি আমার অতিথি।
–এমন সময়?
–বারে, এই তো সময়। রাইতে তুফানের কথা ভুইলা গেছ বুঝি?
কালু একটা গান ধরিয়া দ্রুত চলিয়া গেল।
প্রশান্ত বাহিরে আসিল। চারিদিকে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আর কেমন একটা ভিজা গন্ধ।
প্রশান্ত হাঁটিতে লাগিল। ঝিরঝিরে বাতাসে তাহার চোখমুখ ভিজিয়া আসিল। ভোর না হইতেই নানারকম পাখির কলরব শুরু হইয়াছে, দুইপাশে পাট খেতের সারি; পাশে ঝুঁকিয়া সরু আলের পথটিকে প্রায় ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু একী?
প্রশান্ত দেখিল, সেপাইর মতো খাড়া শুধু কয়েকখানা খুঁটি। মাটির স্তূপ, গভীর জঙ্গল, বট গাছের গাম্ভীর্য, ভয়াবহ নির্জনতা, অথচ সব জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল।
প্রশান্তর দুই চোখ যেন বুজিয়া আসে। এই কঙ্কালের দিকে সন্ধ্যাবেলা তাকাইতে পারিয়াছিল, অথচ এখন আর তাকাইতে পারে না। বুড়ির কাতর গোঙানি কি কেউ শোনে নাই? শেয়াল কুকুর আজও ঘুরিয়া বেড়ায়!
পূর্বদিকের আকাশ কি স্বচ্ছ হইয়া আসিতেছে?
প্রান্তর
রক্ষিতরা সম্পন্ন, অর্থে এবং পরিবার সভ্য সংখ্যাতেও।
রান্নাঘরে উনান রেহাই পায় না,—শিশুদের কলরবে দেয়াল রেহাই পায় না। প্রতিধ্বনি করিয়া ক্লান্তি আসে। যেন একটি ছোটো কারখানা। এ বাড়ির গুঞ্জনের সঙ্গে ভোরবেলা যেকোনো লোকের এমনি হঠাৎ পরিচয় হইলে মনে হয়, রাত থাকিতেই যেন এখানকার দিন-মানের কোলাহলের তোড়জোড় চলিতেছে। কোনো ছেলের ভোরে ইস্কুল, তাহার খাওয়ার ব্যবস্থা, বা কোনো শিশু রাত্রিশেষ কাঁদিয়া উঠিলে আর উপায় নাই। তারপর আস্তে আস্তে ভোর হয়, তাড়া খাইয়া চাকর বাকর ওঠে, সঙ্গে বাড়ির অন্যান্য ঘুমকাতর ছেলেমেয়েরাও। বাড়ির গৃহিণীকেই অতি সকালে উঠিতে দেখিয়া বধূরাও অতিকষ্টে আয়নার কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, অবিন্যস্ত চুল অথবা কপালের সিঁদুর ঠিক করিয়া লয়।
মনোরমার পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে। সবকটি ছেলেমেয়েরই বিবাহ হইয়াছে। মেয়েরা বেশির ভাগই থাকে দূর বিদেশে, কেবল ছোটো মেয়েটির এই শহরে বাস। ছেলেদের মধ্যে চারটি উপযুক্ত, অর্থাৎ যথেষ্ট অর্থ বহন করিয়া আনে। তারপর ছোটো ছেলেটির সম্বন্ধে বলিতে এইরূপ কোনো অশুভ প্রভাতে বাড়ি ঘিরিয়াছিল পুলিশ, তারপর কী হইয়াছিল মনোরমা জানেন না, জ্ঞান হইলে দেখেন, বাড়ি ঘিরিয়া পুলিশ নাই, ছোট ছেলে অজয়ও নাই। ছেলেটা মাত্র এম. এ. পাস করিয়াছিল,—নিজের ইচ্ছায় একটি গরিবের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে। এখানেই মনোরমার দুঃখ। ছেলেকে লইয়া অনেক আশা তিনি করিয়াছিলেন, বিলাত যাওয়ার খরচ সুন্ধু কত ডানাকাটা পরীর বাপও ঘোরাঘুরি করিতেছিল তাঁহার কাছে। তার উপর জেলে যাওয়া! দৈনিকপত্রের বহু বিজ্ঞাপিত ব্যাপার শেষে তাঁহারই ঘাড়ে আসিয়া চাপিল!
তারপর একটি বছর কাটিয়া গিয়াছে। এখন সবই আগের মতো সহজ। কক্ষের অভ্যন্তরে শিশুদের দাপাদাপি, কোলাহল, বধূদের চাপা হাসি, চুড়ির শব্দ চাকর বাকরের চেঁচামেচি, মনোরমার ব্যস্ততা—স্বামীর মৃত্যুতিথির উৎসব দিনেও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিবার সময় নাই।
তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। কিছুক্ষণ নীচতলার পেছন দিকের বারান্দার গলায় আঁচল জড়াইয়া সতী একাকী ঘুরিতেছিল। একপাশে একটি ছোটো ঘরের দরজার কাছে দেয়াল ঘেঁসিয়া বৃদ্ধা লাবণ্যলতা বসিয়াছিলেন। বংশের মধ্যে সকলের ঊর্ধ্বতন দৃষ্টান্ত তিনি, মনোরমার শাশুড়ি। কিন্তু সাংসারিক রীতি অনুযায়ী আপন নন, সৎ; মনোরমার মৃত স্বামী তাঁহার নিজের ছেলে নয়, আগের পক্ষের। কিন্তু শোনা যায়, সেই ছেলে অনেক বড়ো হইয়াও নাকি জানিতে পারে নাই, লাবণ্যলতা তাহার মা। নয়। যা-হোক, সেই ছেলে অবশেষে মানুষ হইয়াছে, শহরে বাসা বাঁধিয়াছে, অজস্র টাকা উপার্জন করিয়াছে, আবার নিজের সন্তানদের মানুষ করিয়াছে, তারপর হঠাৎ একদিন মারা গিয়াছে। সেও খুব অল্প দিনের কথা নয়, তবু আজও সেই লাবণ্যলতা বাঁচিয়া আছেন। চোখে কম দেখিতে পান, নিজে রাঁধিয়া খান।
কপালে কুঁচকানো চামড়া আরও কুঁচকাইয়া লাবণ্যলতা বলিলেন, তুই কে?
উত্তর আসিল, আমি।
–আমি? আমি কে?
সতী কাছে গেল, ইচ্ছা করিয়া কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, অজয় নামে একটা ছেলে আছে না? আমি তারই বন্ধু, নাম হল সতী।
লাবণ্যলতা নিজের মুখ সরাইয়া নিলেন, ঠোঁট উল্টাইয়া বলিলেন,
-ওমা—তোদের সব কান্ড! সোয়ামীর নাম মুখে আনা যেন হেলা খেলা, দিনে দিনে আরও কত দেখতে হবে। আবার বলা হচ্ছে বন্ধু, বন্ধুই যদি, তবে বন্ধুর বিহনে একবারও চোখের জল ফেলিসনে কেন শুনি? অমন তাজা সোয়ামিটাকেও ঘরে আটকে রাখতে পারলিনে কেন শুনি? তোদের ভালোবাসায় ছাই!
হাসিতে হাসিতে সতী বলিল, আমাদের তো কিছুই নয়, কিন্তু সেকালে আপনাদের ভালোবাসার নমুনা দু-একটি বলবেন শুনি?
-না, না, বাপু, অত বকবক করতে আমি পারিনে। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিলেন, হুঁ আবার নাম রাখা হয়েছে সতী!
দীর্ঘ বারান্দার ওই পাশে ইলেকট্রিক আলো জ্বলিতেছে। উপরে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার শব্দ শোনা যায়। নীচে মনোরমা অথবা মেজছেলের ডাকাডাকি, ঝি চাকরদের কলরব। এদিকে কোনো সাড়া না পাইয়া লাবণ্যলতা মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, সতী নীরবে কাঁদিতেছে। —ওকি, কাঁদছিস? ওতে কাঁদবার কী হল? আমি ঠাট্টা করেছি বৈ তো নয়! হতভাগী, কাঁদিসনে তোর কান্না দেখে আমারও যে কান্না পায়। মুখটি কোলের মধ্যে টানিয়া লাবণ্যলতা তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন, একি, কুঁচবরণ রাজকন্যের অমন মেঘবরণ চুল কোথায় গেল? এযে খড়ের আঁটি। আর কদিন পরেই একদম নেড়া হয়ে যাবি যে। আমাদের সময় কেমন ছিল জানিস? চুলের ভারে গড়াগড়ি যেতাম মাটিতে।
এবার সতী মুখ তুলিয়া চাহিল, কিছুক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া শেষে হাসিয়া ফেলিল, লাবণ্যলতা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন, অনেকক্ষণ পরে ঝি দামিনী আসিল, ভাঙা বাসনের মতো বাজিয়া উঠিয়া বলিল, খাওয়া দাওয়া আপনার হবে না গো বৌঠান? সবাই তো খেয়ে উঠল।
যাওয়ার সময় লাবণ্যলতা সতীকে বলিয়া দিলেন, এবার এলে আমার ওষুধ নিয়ে যাস, স্বামীকে বশ করবি।
পরদিন দুপুরবেলা। বারোটা বাজিতে না বাজিতেই সমস্ত বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ। মনোরমার চার ছেলে গিয়েছে কর্মস্থলে, বাড়ির ছেলেমেয়েরা যার যার ইস্কুলে অথবা কলেজে; আর মনোরমার মেজছেলের এক শালী লীলা, এখানে থাকিয়া কলেজে পড়ে। সেও কলেজে গিয়াছে।
সতী আস্তে আস্তে লাবণ্যলতার পেছনে গিয়া দাঁড়াইল, ডাকিল,-ঠাকুমা? তিনি ফিরিয়া চাহিলেন, তাহাকে দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছে সতী। ভ্র জোড়া, চোখের পল্লব আর পক্ষে এখনও যেন জল লাগিয়া রহিয়াছে। ভিজা চুলগুলি খোলা, মাথায় ঘোমটা নাই। সিঁথি আর কপালে সিঁদুর।
—আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে তোকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতাম , বউ!
সতী হাসিয়া উঠিল, হাসিতে হাসিতে লাবণ্যলতার গায়ে ঢলিয়া পড়িল; তিনি চেঁচাইয়া উঠিলেন, উঃ, মাগো। বউ, তোর মতো আর একটিও দেখিনি। তোর মতো দস্যি নাকি আমি! ব্যাথা পাইনে?
হঠাৎ তাঁহার মুখে দুই হাত চাপিয়া সতী বলিল, চুপ, বউ নয়, সতী।
লাবণ্যলতা দুই চোখ কপালে তুলিলেন-সে কী! তুই কী এ বাড়ির বউ নয়? তোর আমি দিদিশাশুড়ী নই?
—না, না আমি আপনার বোন, বুঝলেন?
লাবণ্যলতা হাসিয়া বলিলেন, বুড়ো বেঁচে থাকলে সে সর্বনাশটা আজ হত বটে। বোন না হয়ে তার কাছাকাছি তো হতিস।
আজ একাদশী। লাবণ্যলতা খাওয়ার আয়োজন করিতেছিলেন। কিন্তু আয়োজনটা ভাতের দেখিয়া সতী আশ্চর্য হইয়া বলিল,-ওকি, ভাত-তরকারি যে?
–এ ছাড়া আরও খাওয়ার আছে কিছু বলিস?
সতী বোকার মতো বলিয়া ফেলিল, আজ না একাদশী!
উপরে সে একাদশী উপবাস-ক্লিষ্টা মনোরমার জন্য খাওয়ার বিপুল আয়োজন। দেখিয়া আসিয়াছে।
লাবণ্যলতা ফিরিয়া চাহিলেন। তাহার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চাহিয়া হঠাৎ হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, না বাপু আর পারিনে, ওসব আর সয় না। আমি মনে মনে হিসেব করেছিলাম কাল, ওরা কেউ আমায় বলেনি—সে যাক, ভালোই হয়েছে ওসব কী আর এখন সয়? এবার সহজ হওয়ার চেষ্টায় সতী সামনের দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, দেখি কী রাঁধছেন?
সব আড়াল করিয়া লাবণ্যলতা বলিলেন, না না দেখে কাজ নেই। নিজের চরকায় তেল দাওগে বাপু।
—তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
—হ্যাঁ। সই, তুই আমার কাছ থেকে যা, তোকে দেখে আমার হিংসে হয়।
সতী তবু বলিল, আহা দেখিনা কোন রাজভোগ আপনি খাচ্ছেন?
—রাজভোগই বটে!
চমকিয়া সতী ফিরিয়া চাহিল, দেখিল তীব্র দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া মনোরমা বলিলেন, রাজভোগই বটে! কিন্তু তোমার না হয় খাওয়া দাওয়া সংসার ধর্মের ওপর বিতৃষ্ণা, সেজন্য তো আর কেউ না খেয়ে বসে থাকতে পারে না! রোজই এ কী ব্যাপার শুনি? আমরা এমন কী অপরাধ করেছি শুনি যে তোমার খেয়ালের বোঝা আমাদের বইতে হবে?
নিজের যা কিছু খাওয়ার আয়োজন, সেগুলি কোনরকমে ঢাকিতে ঢাকিতে লাবণ্যলতা বলিলেন, সেকী?
সতী বলিল, যাই। তারপর মনোরমার পেছনে পেছনে চলিল।
খাওয়া দাওয়ার পর বসিল মিটিং। চার বধূই বিনা উদ্দেশ্যে একত্রিত হইয়াছে। প্রধান বক্তা মনোরমা। শ্রোতার দল যার যার সন্তানরক্ষা কার্যে আর অধিক ব্যাপৃত থাকিয়া বক্তার প্রতি কান খাড়া করিল।
-বুঝলে সেজ বৌ? সেজ-বউর প্রতি মনোরমার টান একটু বেশি; তার বাপ মস্ত বড়োলোক। কনট্রাকটরি করিয়া পয়সা করিয়াছেন, মেয়ের খোঁজ বরাবর লইয়া থাকেন, ভারী অমায়িক লোক, তাহার তুলনায় তাহারা কী-ই বা। মনোরমা বলিলেন, বুঝলে সেজ-বউ, বলে কিনা কোন রাজভোগ খাওয়া হচ্ছে দেখি।
মেজ বউর উপর ঢলিয়া পড়িয়া, ঘোমটা ফেলিয়া সুলেখা ভয়ানক হাসিয়া উঠিল, বলিল, তাই নাকি?
মনোরমা ভ্রূ কুঁচকাইয়া বলিলেন, দ্যাখো কী সব বিশ্রী কথা। তাও কিনা আমার সামনে, যেন বুড়ি না খেয়ে থাকছে! আর উনি সেটা বরাবর লক্ষ করে আসছেন। ওঁর মতো হিতাকাক্ষী জগতের আর দুটি মেলে? কী দুর্বুদ্ধি পেটে দ্যাখো। আমি বলি কী—
সকলেই অবাক। সুলেখাই কেবল অনর্থক অতিরিক্ত হাসিতেছে।
—আমি বলি কী, রাজভোগ কাকে বলে সে তো আর জানা নেই, জানবার ভাগ্যিও কোনদিন হয়নি। এখানে এসে ধাঁধা লেগেছে।
সুলেখা তেমনি হাসিতে লাগিল : অর্থাৎ এ সম্বন্ধে আমি কোন মতামত প্রকাশ করিতে চাই না, আমার হাসি হইতে যা হয় বুজিয়া নাও। তাহার হাসি দেখিয়া চার বছরের শিশু মন্টুও ছোটো ছোট দাঁত বার করিয়া হাসে।
সন্ধ্যার পর সতী আবার গিয়া হাজির হইল।
লাবণ্যলতা তাহার খুপড়িতে তেলের প্রদীপটা জ্বালাইয়া এইমাত্র নিজের বিছানার উপর বসিয়াছেন। ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা থাকিলেও ব্যবহার করেন না, বলেন, বুড়ো চোখে অত আলো সয় না।
সতী বলিল, তখন খাওয়া হয়েছিল?
হঠাৎ একটা গলার স্বর শুনিয়া লাবণ্যলতা চমকাইয়া উঠিলেন, ভালো করিয়া দেখিয়া বলিলেন, তুই সতী?
ধপ করিয়া একপাশে বসিয়া সতী বলিল, হ্যাঁ, আমি! ঠাকুরমা, আপনি চোখে কম দেখতে পান বুঝি?-কত বয়েস হয়েছে আপনার?
—বয়েস? বয়েস, আমার..হ্যাঁ, কালো-গোরার যুদ্ধ কবে হয়েছিল জানিস? হিসাব করিয়া সতী আশ্চর্য হইল, সে তো আশি বছরের কাছাকাছি। আপনি তাহলে আজকের নন ঠাকুরমা?
লাবণ্যলতা হাসিলেন, কিছু পরে বলিলেন, আর একবার এমনি চোখ খারাপ হয়েছিল, সেবার ভীষণ খারাপ হয়েছিল, রাত্তিরে তো একেবারেই দেখতে পেতাম না, দিনে তবু কিছু পেতাম—কিন্তু সেই দুঃখের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি এক স্বপ্নের ছায়ায় ঘোর হইয়া আসিল। সতী তা লক্ষ করে নাই, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তখন খাওয়া হয়েছিল?
তেলের প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলে, বিকীর্ণ আলোতে ছায়ার ভাগই বেশি, দুজনের মুখেই আলোর চেয়ে ছায়ার প্রলেপ বেশি।–খেয়েছিলাম। কারোর ওপর রাগ করে না খেয়ে থাকব এমন বোকা আমি নই। যাই বলিস, ছোঁড়াটার ওপর রাগ করে কখনো না খেয়ে থাকিসনে, পেটের কষ্ট বড়ো কষ্ট! নিজের রসিকতায় নিজেই হাসিয়া উঠিয়া লাবণ্যলতা আসল কথা চাপিয়া গেলেন, আসলে তিনি খান নাই।
সতী মুচকি হাসিয়া বলিল, সেই দুষ্টু ছোঁড়াটার কথা আর বলবেন না ঠাকুরমা, সে তো এখন জেলে পচছে!
–ষাট ষাট, ষাট, কী যা মুখে আসে তাই বলিস, তোর কী এতটুকু মায়া-দয়া নেই বাছা?
সতী তবুও মুচকিয়া হাসিতে লাগিল। একটু পরে হঠাৎ তাঁহার কোলের কাছে শুইয়া পড়িয়া বলিল, একটা গল্প বলুন না, ঠাকুরমা!
—আহা, আবার এখানে কেন? এই ছেঁড়া, ময়লা বিছানায়–
-তা থাক, সতী অন্য কথা পাড়িল, আচ্ছা বুড়ো আপনাকে খুব জ্বালাতন করত, না?
লাবণ্যলত্য অন্যদিকে নিঃশব্দে চাহিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পরে শুধু বলিলেন, ছাই!
সতী তাঁহার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, একটু পরে শুনিতে পাইল লাবণ্যলতা বলিতেছেন: জ্বালাতন না ছাই! সময় কোথায়? রোজ রাত বারোটা একটার পর খেয়ে দেয়ে শুলেও রাত থাকতে উঠতে হবে, নইলে রক্ষে নেই। তারপর আবার আড়াইটে-তিনটে অবধি বাড়িশুদ্ধ সকলের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজেদের খাওয়া, চান করে খেতে-খেতে চারটে বাজত, আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই রান্না ঘরে ঢোকা। এক রাত্তির ছাড়া বুড়োর মুখ আর কখনো দেখিনি। এর মধ্যে আবার জ্বালাতন করা, মাঝে মাঝে কথা বলা গলায় দড়ি দিতে আর বাকি থাকবে। কোনোদিন অসুখ-বিসুখ হলে তোর ঠাকুরদা একটিবার কাছে এসে বসলে চারিদিক থেকে কতরকমের কথা এসে তীরের মতো বিধত-ওমা গো, এত করেও যশ নেই, নিজের চোখে না দেখলে বুঝি বিশ্বেস হয় না! অবিশ্যি অসুখ-বিসুখ হলে তোর ঠাকুরদা একবারের জন্যেও কাছে এসে বসেনি, জ্বর ছাড়তে না ছাড়তেই আবার ভোর থেকে মধ্যরাত সমানে হাঁড়ি ঠেলতে হয়েছে! অসুখ হওয়াটাই যেন অপরাধ! প্রায় চিরকাল এমনি কেটেছে, কাজ করেও একটু আনমনা হবার উপায় নেই, কারোর আশায় বাইরের দিকে তাকাবার সাহস নেই। কিন্তু দিদি, সারাজীবনে এমন কয়েকটা দিনের কথাও জানি—তাঁহার চোখের দৃষ্টি আবার আচ্ছন্ন হইয়া আসিল, গলার স্বর বদলাইয়া গেল—সেসব দিনের কথা ভেবে আর সব দুঃখকে ভুলেছি। সেসব দিনের কথা ভাবলে আমার নিজেরই একসময় আশ্চর্য মনে হয়। তাহলে শোনো বলি। চোখ যখন আমার খারাপ হল, তখন পঁয়ত্রিশ পার হয়ে আমি প্রায় বুড়ি হতে চলেছি। শরীর ভয়ানক ভেঙে পড়েছে, অত খাটনি আর সয়না। তবু মুখ ফুটে বলতে সাহস নেই। আর বললেই বা কী হত? তাহলেও কোন উপায় ছিল না। চোখ খারাপ হলে পর সেই ভাঙা শরীর আর খারাপ চোখ নিয়েই কিছুদিন সমস্ত কাজ করেছি, কিছুতেই কাউকে বোঝাতে পারিনি যে, আমার কখনো অসুখ হয়েছে। কোনো সময় হয়তো কথাচ্ছলে জানালে তাঁরা বলতেন, তোমার আবার অসুখ কী গো, বেশ তো আছ, খাওয়া-দাওয়া তো বেশ হচ্ছে!—তবু কিছু বলিনি, চোখে না দেখার ভান করছি, —এই অজুহাতে সকলের হাসির কারণ হয়েও চুপ করে থেকেছি।
লাবণ্যলতা বলিয়া চলিলেন, কিন্তু যে রাতে আলো হাতে রান্নাঘর থেকে বার হবার সময় দরজার চৌকাঠে ঠেকে উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়লাম, তখন ভারী কান্না পেল, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সই, যা পেয়ে তখনকার কান্না পেল, আমি ভুলেছি, সে-কথা ভাবলে আজও ভারী আশ্চর্য মনে হয়। কার হাতের স্পর্শ টের পেয়েই চমকে মুখ তুলে দেখি, তোর ঠাকুরদা! বড় আরামে তার হাতে ভর দিয়ে ঘরে এসে, অনেকক্ষণ কাঁদলাম। সেদিন মনে হল, এ সংসারে আমি আর একা নই, এমন একজন কেউ আছে যে আমাকে ভালোবাসে। শুনে তোর হাসি পাবে জানি, বিয়ের পর প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়েও যখন কারোর এই প্রথম ভালোবাসার কথা মনে হয়! কিন্তু বুড়ো বয়েসে এমন এক ভীমরতি হল। সমস্ত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আমি ভুলে গেলাম, বুড়ো বয়সে এমন এক রাজ্যের রানি আমি হলাম, যে রাজ্যে ঢোকবার অধিকার কারোর ছিল না। সে বলল, ওগো, তুমি আগে আমায় জানাওনি কেন? তোমার শরীর এমন খারাপ, এভাবে বিনে চিকিৎছেতে দিন কাটালে যে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে। আর কোন চিকিচ্ছের কথা তো জানিনে বউ, যাকে খুব বড়ো চিকিচ্ছে বলে তখন মনে ভেবেছিলাম, সেই কথা বলি। রাতে যখন কোনো কারণে বাইরে যাবার দরকার হয়েছে, তোর ঠাকুরদা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই হাতে ভর দিয়ে আমি কোথায় যে যেতে হবে সে-কথা ভুলেছি। শুনে হাসবি, শুধু বাইরে যাবার জন্যে সেই বুড়ো বয়সে মিথ্যে কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। রাত্তিরে জল তেষ্টা পেলে তার হাতে জল খেয়ে এমন স্বাদ পেয়েছি, রোজই জল তেষ্টা পেয়েছে। খাওয়ার সময় কাছে বসে থেকে খাওয়ানোর কী যে আনন্দ হয়েছে, তা বলতে পারিনে।
সতী চুপ করিয়া শুনিতেছিল। লাবণ্যলতা বলিতে লাগিলেন, এমনি করে অনেকদিন কাটল, তিন-চার মাসের কম নয়। সেদিন জ্যোৎস্না রাত। গভীর রাতে কী কারণে যেন বাইরে বার হলাম, তোর ঠাকুরদা কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী সুন্দর জ্যোৎস্না, তুমি দেখতে পাচ্ছ বউ? আমি সবই দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছু আবছা, কিছু অস্পষ্ট। হঠাৎ তোর ঠাকুরদা, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললে, তুমি আমায় দেখতে পাও বউ? বোন, শুধু সেই রাতটিতেই সবচেয়ে বেশি করে আমি আমার মহিমা টের পেয়েছিলাম। তারপর চোখও ভালো হল, শরীরও সারল, কিন্তু যা আবার হারালাম, তা আর কিছুতেই সারবার নয়? তার ভয়ানক জ্বর হল, মাত্র তিনদিনের জ্বরে তাকে আমার ঘোমটার আড়াল থেকে বিদায় দিলুম। তারপর কত বছর আজ হয়েছে, শকুনের আয়ু নিয়ে আজও বেঁচে আছি, কিন্তু সারা জীবনে—শুধু তোর কাছেই বলি বউ, সারাজীবনে সেই ক-টা দিনের কথা কখনো ভুলতে পারিনে।
গল্প শেষ করিয়া লাবণ্যলতা সতীর গায়ে হাত রাখিয়া ডাকিলেন, ওরে বউ ঘুমিয়ে পড়লি?
সতী নিরুত্তর, ঘুমাইয়াছে কিনা বোঝা গেল না।
সেদিন অবনী রক্ষিতের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে কিছু লোক খাওয়ানো হয়। সবাই অতি সম্রান্ত আত্মীয়স্বজন। এইদিনে মনোরমাকে কচিৎ ঘরের বার হইতে দেখা যায়। রুদ্ধ ঘরে মৃত স্বামীর কথা স্মরণ করিয়া অচিরে নিজের মৃত্যু কামনাই করেন তিনি। পুত্র সৌভাগ্যের গর্বটা সজোরে চাপা দিয়া কোনো অদৃশ্য দেবতার পায়ে মাথা ঠুকিতে থাকেন। বন্ধুদের ভিতর শুশ্রুষার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। সমস্ত কাজ ফেলিয়া সেদিন তাহারা তাঁহাকে ঘিরিয়া থাকে। কিন্তু চারদিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া মনোরমার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি আরও অর্থহীন হইয়া আসে। সেজোবউ নাই যে! ক্ষীণস্বরে বলেন, সুলেখা কোথায়?
সুলেখাকে তৎক্ষণাৎ খবর দেওয়া হয়। সে আসিলে মনোরমা আবার কাতরস্বরে বলেন, তোমাদের বাসার সবাই এসেছে তো? তোমার মা-বাবাকে অনেকদিন দেখিনি। ওঁদের ঠিকমতো আদর-যত্ন করা হচ্ছে তো।
লোকটা মস্ত বড়লোক। কন্ট্রাকটারি করিয়া বিস্তর পয়সা করিয়াছেন, অতি সজ্জন সুলেখা তাঁহারই মেয়ে তো! এতক্ষণ পরে সেই সুলেখাকে হাতের কাছে পাইয়া মনোরমার দুই চোখে বিপুল বন্যা ছুটিল।
সন্ধ্যার পরে স্বল্প অন্ধকারে এক নীরব ছায়ামূর্তির মতো সতী বারান্দার রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আকাশে অজস্র তারা। মাঝে মাঝে মিষ্টি বাতাসের ঝলক আসিয়া চোখেমুখে ছড়াইয়া পড়ে, দুই পাশের ভাঙা চুলগুলি গালের পাশে কাঁপিতে থাকে। রাস্তার ওই পাশের বাড়িটিতে ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি, মস্ত লম্বা—যেন আকাশ ছুঁইতে আর বাকি নাই। সেই গাছের চারিদিকে গাঢ়তর অন্ধকারের আবরণ। বাড়ির প্রতি জানালায় উজ্জ্বল আলো, কোথাও দীপ্তকক্ষের আভাস। এই দালানের অভ্যন্তরেও লোকজন আর ছোটো ছেলেমেয়েদের চেঁচামিচি। চারদিকে বিশৃঙ্খল দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া কোন সময় সতীর দুই চোখ জলে ভরিয়া আসিল। পাশের আনন্দ-কোলাহল হইতে বিচ্ছিন্ন সতীর এই ঘরের নিঃশব্দতাটুকু স্পষ্ট ধরা পড়ে। ঘরের আলো নিবাইয়া বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়া সতী দাঁড়াইয়া আছে। চারপাশ শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। নিস্তব্ধ এই অন্ধকারের পটভূমিকায় কাহারও মূর্তি আজ চোখে পড়ে না। এই অন্ধকারের প্রসন্নতায় কেউ আসিয়া মুখোমুখি দাঁড়ায় না। সতী আঁচল মুখে চাপিয়া ধরিল।
কতক্ষণ সেইভাবে সে দাঁড়াইয়াছিল, ঠিক খেয়াল নাই, চমক ভাঙিল নীলার ডাকে–এখানে দাঁড়িয়ে কেন ভাই বউদি?
গলারস্বর যথাসম্ভব অবিকৃত রাখিয়া সতী বলিল, এমনি।
এমনি? নীলা কাছে আসিয়া তাহার গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু এত ঘনিষ্ঠতায় ধরা পড়িবার ভয়ে সতী চকিতে পাশ কাটাইয়া সরিয়া আসিল। একটা কাজ সেরে আসি ভাই, এখুনি আসছি,—এই বলিয়া দীর্ঘ বারান্দা দ্রুত অতিক্রম করিতে লাগিল।
নীলা তো অবাক! সতীর স্বর-বিকৃতি তাহার কাছে ধরা পড়ে নাই এমন নয়।
সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় পেছন হইতে বড়-বউ বলিল, ছোটো বউ শোন
কিন্তু সতীর কোনদিকেই খেয়াল ছিল না, তরতর করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া সে তখন নীচে নামিয়া গিয়াছে।
ছেলে বুকে করিয়া বড়বউ নাক সিটকাইলেন।–আহা, দেমাক দ্যাখো মেয়ের!
লাবণ্যলতার ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীরে অগ্রসর হইয়া সতী ডাকিল, ঠাকুরমা?
কোনো উত্তর নাই। কেবল একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসিল।
সতী আবার ডাকিল, ঠাকুরমা?
তবুও উত্তর নাই।
ভয়ে-ভয়ে আরও কিছুটা অগ্রসর হইয়া বিছানার উপর হাত রাখিয়া সতী দেখিল, না, লাবণ্যলতা শুইয়াই আছেন। মুখের কাছে মুখ লইয়া আবার ডাকিল,—ঠাকুরমা কত ঘুমুচ্ছেন?
তবুও কোনো উত্তর নাই। সভয়ে লাবণ্যলতার চোখে-মুখে-বুকে দুটি শিথিল হাত বুলাইয়া সতীর সারাদেহ হিম হইয়া আসিল। চারপাশে জমাটবাঁধা সারি সারি অন্ধকারের ভয়গুলি যেন তাড়া করিয়া আসিল তাহাকে। চীৎকার করিয়া আবার ডাকিতে গেল—ঠাকুরমা, কিন্তু পারিল না, কে যেন খুব চাপিয়া ধরিয়াছে তাহার গলা। ভয় আর দুর্বোধ্য বিস্ময়ে তাহার দীর্ঘায়ত চোখ বেদনায় বুজিয়া আসিল। সতী বৃদ্ধ লাবণ্যলতার কুঞ্চিত হিমশীতল দেহের উপর পড়িল।
পরদিন অনেক চেঁচামিচি, নতুন বিষয়ে এক নতুন কোলাহল। কথায় কথায় উঠিল : বুড়ির জ্বর হইয়াছে, পরদিন নাকি ইহা কার মুখে শোনা গিয়াছিল। মনোরমা বলিলেন, আহা, এতখানি বয়সে বুড়ী কী সুখেই না মরল! এবং নিজের কপালে করাঘাত করিলেন, আর শুধু তাঁহার বেলায়ই কী মৃত্যুর দেবতা পথ ভুল করিয়াছেন।
সতী তাহার রুদ্ধ গৃহাভ্যন্তরে কতক্ষণ জাগিয়াছিল, আর কতক্ষণই বা শুইয়াছিল, সে নিজেও জানে না। তখন রাত বারোটার কম হইবে না। কাপড়টি সর্বাঙ্গে ভালো করিয়া জড়াইয়া (যেন শীতার্ত কোনো রাত্রি) সতী ঘরের বাহির হইয়া আসিল। চারদিকে থমথম করে, টুশব্দও শোনা যায় না। দীর্ঘ বারান্দা পার হইয়া সে সিঁড়ির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। উজ্জ্বল আলোকিত সিঁড়িপথ। সতী নামিতে লাগিল।
বউদি?
সতী ফিরিয়া তাকাইল : তাহার ঘরের কাছে বারান্দায় এই রাত্রে একাকী পায়চারি করিতেছে নীলা।
নীলা বলিল, কোথায় যাচ্ছ ভাই, বউদি?
–ঠাকুরমার জ্বর হয়েছে, সে কি জানো না? বোধহয় জ্বরে ছটফট করছে এখন, একটু দেখতে যাই।
নীলা তাড়াতাড়ি তাহার কাছে গিয়া দুই হাতে তাহাকে জড়াইয়া ধরিল, বলিল, চলো, আমার ঘরে শোবে চলো।
সতী তাহার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল।
নীলা দেখিল, তাহার দুই চোখে জল, ইলেকট্রিক আলোয় চিকচিক করিতেছে।
বনস্পতি
এত বড় বটগাছ সচরাচর দেখা যায় না। পীরপুরের হাটকে যদি চিনিতে হয়, তবে যেকোনো অশীতিপর ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলেও ইহার উত্তর মিলিবে। দূরে, সে যত দূরেই হোক না কেন, যেন আকাশেরও প্রায় অর্ধেক ছাইয়া আছে, এমন একটা দৈত্যের মতো প্রকান্ড গোলাকার গাছের দিকে দারুণ তৎপরতায় শীর্ণ হাতটি উঠাইয়া সে বলিবে, আরে তুমি কি কানা? ওই দৈত্যিটার বারাবর চলে যেতে পারো না? যাহাকে বলা হইবে, সে যেন কোনো ব্যবসায়ী, ওই হাটের দিকেই যাইতেছে, আর কোনো উদ্দেশ্য তাহার নাই! পীরপুর গ্রামটি গ্রামের মতো নয়, সেখানে কেউ ঘর বাঁধিয়া বাস করিতে পারে একথা কেউ ভুলেও কল্পনা করিতে পারে না। কেবল একটি হাট লইয়াই যেন সারাটি গ্রাম। কেবল সারি-সারি টিনে ছাওয়া ছোটো ছোটো ঘর, মাঝখানে সরু ক্ষতবিক্ষত পথ, বটগাছের আশ্রয়ে চারিদিক চমৎকার ছায়াচ্ছন্ন, হাটবার আসিলে রাত থাকিতেই নৌকার পর নৌকার ভিড়, তারপর সারাদিন আর সারারাত কেবল জনসমুদ্রের কলোচ্ছাস। সেই কলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কিছুমাত্র পরিচয় যাহাদের নাই, অথবা যেকোনো উপায়ে হোক সেই জনসমুদ্রের কিছুমাত্র আভাস যাহারা পায় নাই, তাহাদের পক্ষে তেমন দৃশ্যের কল্পনা করা সুকঠিন।
আশেপাশে দশ-বারোটা গ্রাম হইতে পীরপুরের এই হাট চোখে পড়ে। সেই গ্রামগুলি আর এই হাটের মাঝখানে প্রায় দুইমহলব্যাপী একখানা নদী আর সারি সারি অনেকগুলি বিল। বর্ষাকালে এই বিলগুলি আর নদীতে মিলিয়া, যে অবস্থা হয়, সেকথা মনে করিতে হইলে, কেবল কোনো সমুদ্রের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। ওপারকে মনে হয় কোনো রহস্যময়, কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবী, বিপুল রহস্যের ফেনা সারা গায়ে মাখিয়া এপারের পৃথিবীর সন্তানদের চোখে ধাঁধাঁ লাগাইতেছে। ইহাও মনে হয়, আকাশের সীমারেখায় তাহা কোনো ধূসর বর্ণের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের রাশি —অন্যান্য মেঘের মতো যাযাবর নয়। সেই দুই পারের মাঝখানে বিস্তীর্ণ জলরাশি আরও দুর্বোধ্য। সারাক্ষণ কেবল দুই পারের মানুষকে ভীষণ শাসাইতেছে। তারপর বাতাস বহিতে থাকে, বিশাল জলরাশিতে এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত নৌকাগুলি সাদা এবং আরও নানারকমের রঙিন পাল মেলিয়া যেন পাখায় ভর দিয়া উড়িয়া আসিতে থাকে, বটগাছের শত শত ডালের ভিতর রক্তের জোয়ার আসে, কোটি কোটি পাতা মৃদু কাঁপিতে থাকে। তারপর কোনো এক সময় হয়তো শীতের আবির্ভাব, মাথার উপরে কাঠফাটা রৌদ্র, সমুদ্রের বুক দেখা যায়, আর বটগাছের নীচে অজস্র শুকনো পাতার রাশি। একটা মুসলমান বুড়ি মাঝে মাঝে সেই পাতাগুলি ঝাঁট দিয়া নেয়।
প্রায় দুই-শ বছর আগে চলিয়া যাইতে হয়। তখন ১৭৫০ সাল। তখনও সমগ্র ভারতবর্ষের কেন, কেবলমাত্র বাংলাদেশের শাসনভারও জনকতক হিন্দু শ্ৰেষ্ঠীর চেষ্টায় ইংরেজ বণিকের হাতে চলিয়া আসে নাই, তাহাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তখনও প্রকৃত শাসনপ্রতিষ্ঠান হইয়া উঠিতে পারে নাই, এমন দিনে এক রাত্রে পীরপুরের বৃদ্ধ জমিদার নবকিশোর চৌধুরী তাঁহার শয্যা-সঙ্গিনী তৃতীয়পক্ষের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে লইয়া বড়ো বিব্রত বোধ করিলেন। একটা ভয়ানক উত্তাপে এক মুহূর্তে কী জানি কেন সমস্ত শরীরটা তাঁহার দারুণ অবশ হইয়া, আসিল, কেমন একটা অবসাদে ভরিয়া গেল, তিনি বড়ো অসহায় বোধ করিলেন, ইচ্ছা হইল দুই হাত দিয়া নিজের চুল ছিড়িতে থাকেন। অবশেষে গুটি শুটি মারিয়া তিনি পড়িয়া রহিলেন।
রাত তখন দুইটা। চারিদিক গভীর নিস্তব্ধ, কোথাও টুঁ শব্দ শোনা যায় না। সামনের জানালা দিয়া বাগান হইতে তীব্র ফুলের গন্ধ আসিতেছে। বিছানায় বালিশের পাশেও নানারকম ফুল, কিন্তু নবকিশোরের কাছে তাহা এখন বিষের মতো মনে হইল, তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো, অথবা ছুঁচের মতো তাঁহাকে বিধিতেছে। পাশেই অরুন্ধতী তাহার প্রখর যৌবন আর চেহারার দীপ্তি লইয়া মুখ ফিরাইয়া শুইয়া আছে। নবকিশোরের ইচ্ছা হইল ডাক ছাড়িয়া কাঁদেন। তাঁহার মাথা ঘুরিতে লাগিল, তিনি ঘামিতে লাগিলেন। আস্তে আস্তে তিনটা বাজিয়া গেল, হয়তো রাতকে দিন ভাবিয়া কয়েকটা কাক বাইরে কা-কা করিতেছে, কাঁটার বিছানায় শুইয়াও নবকিশোর একসময় ঘুমাইয়া পড়িলেন। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিলেন, তাঁহার আশে-পাশে একদল নগ্ন নরনারী, চমৎকার তাহাদের চেহারা, যেন শ্বেতপাথরে খোদা মূর্তি, চমৎকার চোখ-মুখের ভঙ্গি, যেন অজস্র মানিক ঝরিতেছে, নবকিশোর দেখিলেন, খিলখিল করিয়া হাসিয়া তাহারা একজন আর একজনের সঙ্গে কথা বলিতেছে, অজস্র চুমা খাইতেছে, কেহ হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া কোন মেয়ের হাঁটুতে মুখ রাখিয়া কী সব বলিতেছে, কেউ বুকের উপর মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া রহিয়াছে আর সেই একদল হাস্যমুখর, সৌন্দর্যদীপ্ত মানুষের মধ্যে তিনি যেন একটি ভেড়া! এমন সময় নবকিশোর হঠাৎ জাগিয়া উঠিলেন, অসহায়তার তুলনা তো নাই, শরীরটাকে আরও অবসাদগ্রস্ত বোধ করিলেন। ঘরের এককোণে বাতি জ্বলিতেছে, মিটমিট করিয়া চাহিয়া তিনি দেখিলেন, আশ্চর্য, বিছানা খালি, পাশে তাঁহার সুন্দরী স্ত্রী অরুন্ধতী নাই, ঘরের দরজা শাশা খোলা, হু হু করিয়া শেষরাত্রির ঠাণ্ডা বাতাস আসিতেছে। ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার চোখের পাতা আর জ কুঁচকাইয়া আসিল, তিনি খাট হইতে নামিয়া দরজার কাছে আসিলেন, আস্তে ডাকিলেন— বউ?
কিন্তু কোনো উত্তর নাই। শুধু তাঁহার গলাটাকেই এই নিস্তব্ধতায় ভীষণ বিকৃত শুনাইল। আবার আরও জোরে ডাকিলেন বউ বউ?
তবু কোনো উত্তর নাই। নবকিশোরের প্রশস্ত কপাল আরও কুঁচকাইয়া আসিল, ঘর হইতে বার হইয়া তিনি এখানে-সেখানে অরুন্ধতীকে খুঁজিতে লাগিলেন, বাগানেও অনেক খুঁজিলেন, পুকুরের ঘাটের কাছে গিয়া ডাকিলেন, বউ? ও বউ?—কিন্তু অন্ধকারে কেবল প্রতিধ্বনিই ফিরিয়া আসিল। নবকিশোর ভাবনায় পড়িলেন। হঠাৎ চোখে পড়িল, ছেলে সুরেন্দ্রকিশোরের ঘরে আলো জ্বলিতেছে, আর সেখানে কোনো মেয়েলি স্বরে কথাবার্তার আওয়াজও শোনা যায়। ধীরে ধীরে তিনি অগ্রসর হইলেন, বুক তাঁহার দুরুদুরু কাঁপিতেছে। ঘরের ভিতর কথাবার্তার শব্দ আরও স্পষ্ট হইয়া উঠিল, আর কোনো সন্দেহ রহিল না, একবার উঁকি মারিয়া যা দেখিলেন, তাতে রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল, হাত-পা কাঁপিতে লাগিল।
পীরপুরের চৌধুরী পরিবারের ভাগ্যে আজ এ কী অভিশাপ, হায়, আজ এ কী দুরপনেয় কলঙ্কের ইতিহাস তাহাকেই বিশেষ করিয়া দেখিতে হইল। তাহার তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী সুন্দরী অরুন্ধতীর সঙ্গে এক বিছানায় শুইয়া তাহার বুকে মুখ রাখিয়া প্রেমালাপ করিতেছে তাঁহারই একমাত্র ছেলে সুরেন্দ্রকিশোর!
পরদিন অরুন্ধতী বা সুরেন্দ্র আর কাহাকেও ত্রিসীমানায় দেখা গেল না এবং পরেও আর কোনদিন দেখা যায় নাই। কেন এমন হইল, কিছুটা অনুমান করা যায় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি এই যে, নবকিশোর নাকি অরুন্ধতীকে রূপকথার রাজাদের মতো একেবারে মাটি চাপা না দিলেও এমন কিছু একটা করিয়াছেন যাতে সেই দুর্ভাগ্য মেয়ের মৃত্যু ঘটিয়াছে। মৃত্যুটা কল্পনা করিতে পারি এইরূপ : মস্ত বড় দালানের যেদিকটা বেশ একটু নির্জন, আর গাছপালার ছায়ায় বেশ গম্ভীর, সেখানে একটা সুন্দর ঘর আছে। ঘরটি চমৎকার সাজানো। মেঝেতে দামি ফরাস আর বালিশের ছড়াছড়ি, বাতাসে সুগন্ধ। চারিদিকে কেমন একটা নির্জন ভয়াবহতা, মাটিতে উঁচটি পড়িলে শোনা যায়।
এই ঘরের এক বিপুল ইতিহাস আছে। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে হইতে সেই ইতিহাসের শুরু। নবকিশোর তাঁহার সারা রাজ্য জুড়িয়া একটি জাল তৈরি করিয়াছিলেন, সেই জালে যে মেয়েগুলি ধরা পড়িত, তাহাদের ধরিয়া আনা হইত এই ঘরে—সকলের চোখেই পাগলের মতো দৃষ্টি, নয়তো নিতান্ত ছেলেমানুষ হইলে সারামুখ চোখের জলে ভেজা, মাথার চুল আর পরনের কাপড় এলোমেলো, আত্মসমর্পণের ইচ্ছা মোটেই না থাকিলেও আত্মরক্ষায় নিশ্চেষ্ট। নবকিশোর তাহাদের কোনো কুলই রক্ষা করিতেন না, কেবল পথে বসাইতেন। সেই মেয়েগুলি তখন পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইত, না হয় গ্রামের হাটে-হাটে কোন বিশেষ পল্লিতে আশ্রয় লইয়া বাঁচিত। এভাবে অনেক মেয়ের কুমারী অথবা বধূজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে। কিন্তু তাহাদের মৃত্যু দেখিয়া নবকিশোর বিন্দুমাত্র বিব্রত হন নাই, তাহাদের অভিশাপ আর বেদনার রক্ত গায়ে মাখিয়া তিনি এতটুকু বিচলিত হন নাই, বরং তাহাদের দেহ লইয়া বারবার ছিনিমিনি খেলিয়াছেন, একদিকে সর্বনাশ করিয়া অন্যদিকে লাথি মারিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। নবকিশোরের সুদীর্ঘ জীবন, আর সেই জীবনের সঙ্গে জড়িত এই ঘরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এই। এখন সেই ঘর তত ব্যবহৃত হয় না, মেঝেতে ধূলি পড়ে। তার মূলে একমাত্র কারণ হয়তো বার্ধক্যের অক্ষমতা এবং সেই কারণে আগের মতো প্রচুর উৎসাহের অভাব। কিন্তু সেদিন যে কান্ড ঘটিল তাকে সত্যই অদ্ভুত বলা চলে। ঘটনাটি গতানুগতিক পথ ধরিয়া ঘটে নাই। নবকিশোর সেই ঘরের কথা মনে করিয়াই স্ত্রীর জন্য উপযুক্ত শাস্তি খুঁজিয়া পাইলেন। অরুন্ধতী পরম গাম্ভীর্যে ঘরে ঢুকিল, নবকিশোর বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত আর খুলিলেন না। অরুন্ধতী প্রথমে অনেক ধাক্কা দিয়াছিল, তারপর কাঁদিয়াছিল। বাগানের সেই নির্জন অংশ তাহার উচ্ছ্বসিত কান্নায় থমথম করিতে লাগিল। কিন্তু কাঁদিতে কাঁদিতেও ক্লান্তি আসে, তাহার গলার স্বর একদিন আর শোনা গেল না।
এবং ইহার কয়েকদিন পরেই দেখা গেল নদীর পারে একটা চমৎকার খোলা জায়গা বাছিয়া সেখানে নবকিশোর দুটি বট অশ্বথের চারা একসঙ্গে পুঁতিয়া দিলেন,
তারপর সেই গাছে অনেক সিঁদুর মাখাইয়া নূতন কাপড় পরাইয়া বিরাট সমারোহে পূজা করিলেন, আশেপাশের বিভিন্ন গাঁ হইতে হাজার হাজার প্রজা আসিয়া তাঁহার সেই পূজা দেখিল, অজ্ঞাত নিরুদ্দেশ দেবতার উদ্দেশে ভক্তিভরে প্রণাম করিল। ধূপের ধোঁয়ায় আর মানুষের কোলাহলে কত ছাগশিশুর চীৎকার আর কান্না শুনিয়াও শোনা গেল না, ধুসর মাটি রক্তে ভাসিয়া গেল, নবকিশোর মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া মা মা করিয়া অনেক ডাকিলেন… বটগাছের জন্মের ইতিবৃত্ত মোটামুটি এই। কিন্তু এটুকু জানিবার চেষ্টাও জনসাধারণের নাই, গাছের মধ্যে দেবতার অংশ আছে, ইহা জানিতে পারিয়াই তাহারা খালাস।…
তারপর বিখ্যাত ১৭৫৭ সাল। পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলা অথবা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নিরূপিত হইয়া গেল। বাংলার ধনীরা ইংরেজের জয়লাভের আনন্দে আত্মহারা হইয়া গেলেন।
অথচ পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে কত নিরীহ দরিদ্রের রক্তে ভাসিয়া গেল। পীরপুরের একটি ছেলেও যে হতভাগ্য সিরাজের পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াছিল অশেষ বীরত্ব দেখাইয়াছিল, ইহা ইতিহাসের পাতায় লেখা না তাকিলেও পীরপুরের ছেলে-বুড়ো কে না জানে?
তাহার নাম অজুন।
সেবার কোথা হইতে এক বাঘ আসিয়া সারাটা গ্রামে ভয়ানক উৎপাত শুরু করিয়া দিল, আজ এ বাড়ির ছাগলটা, কাল ও বাড়ির বাছুরটা প্রায়ই পাওয়া যাইতে লাগিল না। বৃদ্ধ এবং শিশুরা ভয়ে ভয়ে আর সন্ধার পর বাহির হইত না। গভীর রাত্রে কোনো গভীর সমস্যায় পড়িলেও কেহ ভুলেও দরজাটা একটু ফাঁক করিত না। হয়তো কখনো একটা বাছুর ভীষণ আর্তনাদ করিয়া উঠিত। গরুগুলি প্রত্যুত্তরে মা মা করিয়া চীৎকার করিতে থাকিত, তারপরেই সব শেষ, এমন দৃশ্যের অভাব রহিল না। গ্রামের ভিতর একটা আতঙ্কের ছায়া নামিয়া আসিল। যে পথে বাঘের পায়ের ছাপের মতো কিছু চোখে পড়িত, সে-পথ আর কেউ মাড়াইত না। কিন্তু এই দুঃসময়েও অর্জুনের সাহস দেখিয়া সকলে অবাক হইয়াছিল বাস্তবিক এমন অসীম সাহসের পরিচয় খুব কমই পাওয়া যায়। সে একদিন সেই দুর্ধর্ষ বাঘটাকে সকলের পায়ের সামনে আনিয়া হাজির করিল। ব্যাপার দেখিয়া বৃদ্ধরা ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন এবং এমন ভবিষ্যৎবাণীও করিলেন যে, সে কালে একটা কিছু হইবে।
মেয়েরা আড়ালে থাকিয়া তাহার চেহারার দিকে চাহিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইল। আশে-পাশের দু-চারখানা গ্রামেও এমন বীরত্বের কাহিনি মুহূর্তের মধ্যে প্রচার হইতে বাকি রহিল না। এমন কি স্বয়ং জমিদার মহাশয়ও দারুণ খুশি হইয়া কিছু পুরস্কার দিলেন তাহাকে। কিন্তু সকলের প্রশংসাবৃষ্টির আড়ালে অর্জুনের জীবনে আর একটি ব্যাপার যা ঘটিল, তার তুলনা নাই। অর্থাৎ অর্জুন প্রেমে পড়িল। তাহার অথবা সেই মেয়েটির প্রেমের আসরে নামিবার প্রথম দৃশ্যটি এই — রাজকুমার মন্ডলের বাড়ির সামনেই একটা পোড়োবাড়ির উঠানে মরা বাঘটাকে ফেলিয়া রাখা হইয়াছিল। রোজই সেখানে কিছু না কিছু লোক জমিয়াই থাকিত। রাজকুমারের বড় মেয়ে চম্পক একদিন সেখানে গিয়া হাজির হইল, বাঘটার চারদিকে চরকির মতো কয়েকবার পাক খাইয়া, নাকে কাপড় দিয়া এখানে-সেখানে থু-থু ফেলিয়া অত্যন্ত ঘৃণাভরে বলিল, বারে, বাঘের গায়ে অমন গন্ধ কেন?
কাছেই ছিল অর্জুন। ব্যাপার দেখিয়া সে কিছুতেই হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিল , ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল। হাসি থামিলে শেষে আবার দারুণ গম্ভীর হইয়া এমন একটা তুচ্ছ বিষয়ও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বুঝাইয়া দিল যে চম্পক তো অবাক ! এমন দরদভরা স্বরে কেউ অনেক কাল তাহার সঙ্গে কথা বলে নাই। সে আগেও তাহাকে দেখিয়াছে বটে কিন্তু ভালো করিয়া দেখে নাই, আজ নতুন করিয়া দেখিল, যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া বীর আসিয়াছে, তাহার চুল এলোমেলো মুখভরা হাসি, হাতে খোলা তরবারি আর ঢাল, এখন শুধু বরণ করিতেই বাকি। বীর যুবককে বরণ করিবার লোক এখন কেথায়? চম্পক হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, কোনো হরিণশিশুর মতো তাহার চোখের দৃষ্টি।
তারপর প্রেমের দ্বিতীয় দৃশ্যের কথাও বলিতে হয়। রাজকুমারের বাড়িতে একদিন কীর্তনের আয়োজন করা হইয়াছে, গ্রামের অনেকেই আসিয়া কীর্তনে যোগ দিয়াছে। অর্জুন আসিয়াছে। চম্পক আর স্থির থাকিতে পারিল না, চুপিচুপি কখন কীর্তন আসরের কাছে গিয়া হাত নাড়িয়া ইঙ্গিতে অর্জুনকে ডাকিল, অর্জুন আসিল—কিন্তু কাছে আসিলে পর চম্পক আর কিছু বলিতে পারে না, মাটির দিকে চাহিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকে। এখানে বলিয়া রাখা ভালো চম্পকের মাথায় কিছু ছিট আছে, সে হ্যাঁ বলিলে মাঝে-মাঝে তাহার অর্থ হয় না। না বলিলে অর্থ হয় হ্যাঁ। অনেকসময় ভুলেও সে চুল বাঁধিত না, আবার একসময় যখন-তখন চুল বাঁধিত। বছর চারেক আগে স্বামী তাহার জলে ডুবিয়া মারা গিয়াছে। স্বামী জলে ডুবিয়া মরিলে স্ত্রীকে কপালে সিঁদুর মাখিয়া বারো বছর অপেক্ষা করিতে হয়, চম্পকও অপেক্ষা করিতেছিল। এখন বয়স তাহার সতেরো। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া সে পাগলামি করিয়া এখানে-সেখানে আছাড় খাইয়া অনেক কাঁদিয়াছিল কিন্তু অর্জুনের ছায়ার আশ্রয়ে এই পাগলামি এখন অনেক কমিয়াছে। সে যেন নতুন পৃথিবীতে পা ফেলিল, জলের আয়নায় নিজের চেহারা দেখিয়া নিজেরই এখন আর বিশ্বাস হয় না, চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হইয়া আসে, গাছের নীচে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি সে প্রাণ ভরিয়া শোনে।
খুব দ্রুত পদক্ষেপের মতো অনেকগুলি দিন কাটিয়া গেল। কিন্তু একসময় বিদায়ের পালা আসে। একদিন চমৎকার সাজিয়া এক বিদেশগামী নৌকায় অর্জুন চড়িয়া বসিল। দূর হইতে দারুণ চোখের জলে ভিজিয়া চম্পক দেখিল, বীরকুমার আবার যুদ্ধে যাইতেছে, এবারও সে জয়লাভ করিবে নিশ্চয়।
নদীর মাঠ হইতে কিছুদূরেই সেই বটগাছ। এখন কিছুটা বড়ো হইয়াছে। পাতাগুলি কচি, চমৎকার, চকচক করে। রোদ খুব তীব্র হইয়া উঠিলে ভাঙা ভাঙা ছায়া মাটিতে পড়ে। দু-একটি ডালের ভিতর দিয়া সুতার মতো সরু শিকড় বাহির হইয়া গিয়াছে। গাছের গোড়ার দিকটা সিঁদুরে লাল, আর সেই গোড়ার মাটিও প্রচুর দুধ আর তেল খাইয়া কালো রঙ ধরিয়াছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, এই গাছের নীচে একটি মেয়ে আসিয়া দাঁড়ায়, তাহার চুল এলোমেলো-চোখ দুটি কাহার প্রতীক্ষায় আকুল। সে চম্পক। চম্পক মাটিতে কপাল ঠেকাইয়া সেই দেবাংশী গাছের উদ্দেশে অনেক প্রার্থনা জানায়, বিড়বিড় করিয়া বলে, জয়ের মালা পরিয়া তাহার অর্জুন যেন শীগগিরই ফিরিয়া আসে, সে আবার তাহাকে বরণ করিয়া লইবে, তাহার বুকের ছায়ায় সেই বীরকে আশ্রয় দিবে। চম্পকের বুকের ভিতরটা হঠাৎ কেমন করিয়া উঠিল, স্তনের ভিতরও কেমন একটা যন্ত্রণা, দুই হাতে সে তাহার স্তন চাপিয়া ধরিল।
চম্পক নদীর পারে আসিয়া দাঁড়ায়, চোখ ছোটো করিয়া বহুদূর পর্যন্ত চাহিয়া থাকে, চোখের দৃষ্টি কখনো ভাঙিয়া আসিলেও সে নিজে কখনও ভাঙে না, বর্ষায় ক্ষিপ্ত নদীর ঢেউ পায়ের উপর আসিয়া আছাড় খায়, বর্ষা যায় শীত আসে, শীত যায় আবার বর্ষা আসে,তবু অর্জুন আসে না, বছরের পর বছর ঘুরিয়া গেল, বটগাছ আরও বাড়িয়া ডাল-পালা মেলিয়া মাটিতে দীর্ঘতর ছায়া বিস্তার করিল, গ্রামের কোথাও দারুণ জঙ্গলে ভরিয়া গেল, কোথাও মানুষের পদক্ষেপে পরিষ্কার হইল, গ্রামে আবার বাঘ দেখা দিল, অনেক ছাগল-বাছুর খাইল তবুও অর্জুন আসে না। পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাধীনতার লড়াই করিয়া সে প্রাণ দিয়াছে।
নদীর পারে দাঁড়াইয়া থাকিতে থাকিতে চম্পকের শরীরও একদিন ভাঙিয়া আসে, সে আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে না। একদিন দেখা দিল, রাজকুমার মন্ডলের মেয়ে চম্পক নদীর বিক্ষুব্ধ জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে, প্রাণপণে সে সাঁতরাইতেছে। নদীর ঢেউ-এর আঘাতে খোঁপা তাহার খুলিয়া গেল, জলের তালে তালে নাচিতে লাগিল, চম্পক সেই যে জলে নামিয়াছিল, আর ফিরিয়া আসে নাই।
তারপর ১৭৬৯ সাল। সেবার বাংলার আকাশে এক গভীর দুঃস্বপ্ন দেখা দিয়াছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা আজও লোকে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে স্মরণ করে। এই সভ্যতার দিনে এক যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো উপায়ে এমন প্রাণহানি ঘটিয়াছে কি না সন্দেহ। না খাইতে পাইয়া সেবার বাংলার এক-তৃতীয়ংশ লোক মরিয়া গেল। শুধু মরিয়া গেল বলিলে মৃত্যুটা বড়ো সহজই শোনায়। সেই মৃত্যুর দৃশ্যগুলি এত করুণ আর এত ভয়াবহ যে শুনিলে শরীরে কাঁটা দিয়া ওঠে। তবু অত্যাচারের সীমা নাই। তখন রাজত্ব আদায়ের যাহারা মালিক, তাহারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে এবং পরিমাণে রাজস্ব আদায় করিতে লাগিল। তাহাদের অত্যাচারে লোকে ঘর ছাড়িয়া পালাইল, স্ত্রী-কন্যা বেচিয়া খাইল, অথবা আত্মহত্যা করিয়া বাঁচিল। সাধারণ কুকুরও সেদিন ক্ষুধায় কাতর হইয়া মানুষকে তাড়া করিতেছে। এমন দিনে পীরপুরের লোকগুলির অবস্থাও কম ভয়ানক নয়। সারা গাঁয়ে দিনের বেলায়ও টুশব্দটি শোনা যায় না। কারোর মুখে কোনো কথা নাই, সকলেই কেবল একে অন্যের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া থাকে, তাহারা আজ কাঁদিতেও ভয় পায়। মাঝে-মাঝে কেবল কুকুরের কাতর ডাক শোনা যায়। কুকুরের ডাক আজ মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। সেখানকার বৃদ্ধরা তখন কেবল তাহাদের দীর্ঘ, শীর্ণ আঙুল দিয়া মাটিতে আঁক করিতেছে, প্রৌঢ়রা আর কোনো উপায় না দেখিয়া স্ত্রীর মাংসপিন্ডকেই জীবনের সার বলিয়া জানিল, যুবকেরা মাঠে মাঠে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মেয়েদের বেণী রচনায় আর সাধ নাই, কপালে টিপ দিতে আর পায়ে আলতা পরিতেও ইচ্ছা জাগে না।
একদিন এই দুর্ভিক্ষপীড়িতের দল সেই বটগাছের নীচে আসিয়া সমবেত হইল, বড়ো বড়ো উস্কখুস্ক চুলেভরা অনেকগুলি মাথার সেই ভোলা জায়গাটি ভরিয়া গেল, সেই মাথাগুলি কোনো গভীর প্রার্থনায় নতমুখী। দেবাংশী গাছের দিকে চাহিয়া তাহারা অনেক প্রার্থনা করিতে লাগিল।
তারপর আরও অনেকগুলি বছর কাটিয়ে গিয়াছে, প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি, এতদিনে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে, পীরপুরেরও। আগে যাহারা ছিল, এখন তাহারা নাই। এখন যাহারা আছে তাহারা আর একদল লোক! কিন্তু তাহাদের রক্তে একই মানুষের রক্তের প্রবাহ বহিতেছে। সেই বট গাছকেও আর চিনিবার জো নাই। একদিন যা ছিল নিতান্ত শিশু, সে এখন বড়ো হইয়া প্রকান্ড ছায়া বিস্তার করিতেছে। পাতাগুলি এত ঘন যে আকাশও অনেকসময় দেখা যায় না। এখানে-সেখানে মোটা-মোটা শিকড়, মাটির রস পান করিতে অতৃপ্তি নাই। গাছের ছায়া এত নিবিড় যে গ্রামের ছেলেরা ইহার নীচে বসিয়া আড্ডা মারে, শীতকালে এখানে বসিয়াই আগুন পোহায়, ধোঁয়ায় তাদের মুখ ধূসর হইয়া আসে। এ ছাড়া গাছের নীচে দু-একটি ঘর উঠিয়াছে। তার মধ্যে একটি মুদি-দোকান।
এত দিন পীরপুরের এই বটগাছকে ঘিরিয়া কত ঘটনা ঘটিয়া গেল, আরও কত ঘটিবে কে জানে! এতকাল এই গাছ গ্রামের দুইপুরুষ দেখিয়াছে, আরও দেখিবে।
১৮৫৭ সালে কানপুরে সিপাহিবিদ্রোহের আগুন জ্বলিয়া উঠিল, ধীরেধীরে তাহা সারা ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িল, বাংলায়ও সে ঢেউ আসিয়াছিল। সেই বিপ্লবের আগুন এত তীব্র হইয়াছিল যে শাসনযন্ত্রের চাকাও নড়িয়া উঠিয়াছিল। ঐতিহাসিকগণ এমন কথাও বলেন, সেই বিপ্লবের যাঁরা পরিচালক ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক আর নাই থাকুক শৃঙ্খলার অভাব যথেষ্টই ছিল; তাই আজও আমরা ইংরেজের আমল দেখিতেছি। সেই বিদ্রোহের ইতিহাসকে আজও লোকে কালা-গোরার যুদ্ধ বলিয়া স্মরণ করে। বিদ্রোহ দমনের দৃশ্য তাহারা অনেক দেখিয়াছে বটে কিন্তু মুখ ফুটিয়া বলিতে সাহস করে না। তখন সিপাহিদের কুকুরের মতো তাড়া করা হইত। অনেক ভারতবাসী তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
একদিন একটা সিপাহি পীরপুরের বটগাছে আসিয়া আশ্রয় লইল। সে যেন কোনো পলায়নপর সিংহ, পলাইতেছে বটে, কিন্তু তবু তাহার চোখদুটি জ্বলজ্বল করে। মুখের রঙ গৌর, পেশিবহুল শরীর, হাত-পায়ে অপরিষ্কার কাদামাটির দাগ, পোষাক ক্ষতবিক্ষত, লোকটা একটা দিন সেই গাছের উপর লুকাইয়া রহিল। দুই একজন যাহারা তাহাকে দেখিয়াছে, অনেককাল তাহাকে ভুলিতে পারে নাই, সে ওইভাবে পলাইয়াও অত্যাচারীর হাত হইতে রেহাই পাইয়াছিল কি না জানা যায় নাই।
তারপর আরও কয়েকটা বছর কাটিয়াছে। চিরকাল একই রকম যায় না। গ্রামে একবার ভয়ানক বসন্ত দেখা দিল। এমন একটি ঘর রহিল না যেখানে অন্তত একটিও বসন্তের রোগী নাই। প্রায় কোনো রাত্রিশেষে বা সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘন-ঘন হরিধ্বনি শোনা যাইতে লাগিল। হঠাৎ শুনিলে গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে। নদীর পারের জল আর আকাশ শ্মশানের অগ্নিশিখায় লাল হইয়া গেল।
এমন চরম অসহায়তার দিনে গ্রামের অধিষ্ঠিত দেবতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। গ্রামের সকলে আবার হাঁটু গাড়িয়া বসিল গাছের নীচে, প্রাণপণে প্রার্থনা করিতে লাগিল। কী কারণে দেবতা রাগ করিয়াছেন কে জানে। সমস্ত গ্রামবাসী মিলিয়া দেবতার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিয়া বলিল, হে দেবতা ক্ষমা করো। কোনোদিন না বুঝিয়া কী ভুল করিয়া ফেলিয়াছি, তুমি পিতা হইয়া তাহা ক্ষমা করো।
দেবতার পায়ের কাছে শত শত পাঁঠা বলি দেওয়া হইল, মাটিতে রক্তের নদী বহিয়া গেল। দেবতাকে একবার রাগাইলে আর উপায় নাই, অনেক মূল্য দিয় তবে সেই রাগ থামাইতে হয়। এমন অনেক বিপদ-আপদে যিনি পাশে আসিয়া দাঁড়ান তাঁহাকে মাঝেমাঝে খুশি না করিলে চলে না।
এদিকে দিনের পর দিন কাটিতে থাকে। আজ যা অতি আড়ম্বরে ঘটে, কাল তা মনেও থাকে না। কিছুই ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই।
ধীরে ধীরে দেশে বণিকদের নিজেদেরই প্রয়োজনে রেলপথের বিস্তার হইতে লাগিল। তাতে সাধারণ লোকেরও কিছু উপকার হইলে বটে কিন্তু সেই কিঞ্চিৎ উপকারের বদলে যতখানি অপকারের অভিশাপ আসিয়া দেখা দিল, সেই কারণে শুধু মালিকদেরই দোষ দেওয়া চলে। একটা যন্ত্রের কাছে যখন একটা ভয়ানক সুখের আশা করা অন্যায় নয়, সেখানে এই অভিশাপের ইতিহাস বড়োই করুণ! দেখা গেল, প্রতি ঘরে ম্যালেরিয়া বিরাজ করিতেছে এবং তাহার প্রতাপে প্রত্যেক মানুষকে হাতের মুঠায় প্রাণ লইয়া ফিরিতে হয়। এমনকী ইহাতে শঙ্করও যে গ্রামের সকলকে ফাঁকি দিয়া চলিয়া যাইবে, ইহা অভাবনীয় হইলেও অস্বাভাবিক নয়।
সম্প্রতি চোরের মতো চুপি চুপি লক্ষ করিলে দেখা যায়, সাদা কাপড় পরণে কে একটি মেয়ে প্রায়ই কোনো নির্জন সন্ধ্যায় অথবা গভীর রাত্রে সেই বটগাছের নীচে
আসিয়া মাথা ঠুকিয়া কাঁদিতে থাকে। খোঁজ করিলে জানা যায়, সে শঙ্কর ভুই মালীর স্ত্রী সুকুমারী।
শঙ্কর তো এই সেদিনও সশরীরে বাঁচিয়া ছিল। তাহার মতো জোয়ান শরীর হাজারে একটা মেলে। সকলেই তাহাকে ভয় করিয়া চলিত। এ ছাড়া ঘর তৈয়ারি করিতে এমন ওস্তাদ এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয় নাই। সেদিন সে গিয়াছিল মাধবদি-র হাটে, সন্ধ্যার কিছু পরে হাট হইতে ফিরিয়া আসিয়াই সে লম্বা হইয়া পড়িল, বলিল বউ, একটা কাঁথা দে, জ্বর আইল বুঝি।
সুকুমারী ব্যস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আবার কী সর্বনাশ আইছে কে জানে। তোলা একখানা কাঁথা বাহির করিয়া সে শঙ্করের উত্তপ্ত শরীরে তাড়াতাড়ি বিছাইয়া দিল। হাত দিয়া কপাল পরীক্ষা করিয়া বলিল, ওগো মাগো গাও যে পুইড়া গেল।
জ্বরের ঘোরেও শঙ্করের দুষ্টামি বুদ্ধি যায় না। তাহার হাতখানা সরাইয়া সে বলিল, এমনে জ্বর দেখে না।
কেমনে? সুকমারী তাহার কপালে নিজের গাল রাখিয়া বলিল, এমনে?
শঙ্কর তাহার গরম ঠোট দুটি সুকুমারীর ঠাণ্ডা গালে ঘষিয়া জড়িতস্বরে বলিল
সুকুমারী হাসিয়া ফেলিল, তাহার গালে মৃদু একটা চড় মারিয়া বলিল, এই বুঝি জ্বরের রুগীর মতন কথা?
তারপর জ্বর আরও বাড়িয়া চলিল। সেদিনের রাত্রিটা মোটামুটি ভালোই গিয়াছিল। সুকুমারীকে বেশি জাগিতে হয় নাই। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনও ভালোই গেল। চারদিনের দিন বিছানা হইতে উঠিয়া শঙ্কর বলিল, বউ, তাড়াতাড়ি ভাত বসাইয়া দে, আমি আজই ভাত খামু। শঙ্কর সত্যই স্নান করিতে চলিল। ব্যাপার দেখিয়া সুকুমারীর দুই চক্ষু স্থির। সে তাহার হাত ধরিয়া বলিল, এমন করলে আমি গলায় দড়ি দিয়া মরুম। তাড়াতাড়ি যাও, শুইয়া থাক গিয়া, জ্বর অহনও ছাড়ে নাই।
শঙ্করের স্বভাবটা চিরকালই এমনি। কেবল সুকুমারীর আশ্রয়েই সে যেন মানুষের মতো চলিতে পারে, নইলে কোথায় ভাসিয়া যাইত কে জানে!
মারা যাওয়ার আগের দিন এক কান্ড ঘটিল। রাত্রি তখন অনেক। শঙ্কর হঠাৎ চোখ মেলিয়া ডাকিল, বউ?
সুকুমারী তাহার মুখের উপর ঝুকিয়া বলিল, কও?
শঙ্কর আবার ডাকিল, বউ?
সুকুমারী বলিল, কী? কও না গো?
শঙ্কর তাহার কোলে মুখ গুঁজিয়া বলিল, উঁ।
সুকুমারী তবু বুঝিতে পারে না, সস্নেহে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল, কী অইছে গো?
তবু তাহার কোলের ভিতর মুখ গুঁজিয়া শঙ্কর গোঁঙাইতে থাকে, বিড় বিড় করিয়া একমনে কী বলে।
কী একটা কথা মনে হওয়ায় সুকুমারী হঠাৎ ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, তাহার মুখটি বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া বলিল,-ছিঃ, এমুন পোলাপানের মতন করে না। তোমার যে জ্বর গো!
শঙ্কর বলিল, না, জ্বর না, আমার জ্বর না।
-তুমি একটা পাগল। গাও পুইড়া যায় জ্বরে, তবু,–
সুকুমারী কী করিবে ভাবিয়া পায় না, তাহাকে আরও জড়াইয়া ধরিয়া তাহার মুখের কাছে নিজের মুখটি লইয়া সে বলিল, এই লও, খালি চুমা দাও।
কিন্তু শঙ্কর তাহার মুখ ফিরাইয়া লইল, একেবারে পাশ ফিরিয়া শুইল। এবং পরদিনই সে মারা গেল।
সুকুমারী ইহার পর আর কী করিতে পারে? ঘরের এককোণে মুখ গুঁজিয়া সে পড়িয়া রহিল, কাঁদিতে কাঁদিতে চোখমুখ তাহার ফুলিয়া গেল, কেবলই মনে হইতে লাগিল, মৃত্যুর আগে শঙ্কর কী একটা জিনিস তাহার কাছে চাহিয়াছিল।
অথচ সে দেয় নাই, হায়, সে কেন রাজি হয় নাই? এমন কঠিন কিছু নয় তো যে কিছুতেই দেওয়া চলে না, হায়, কেন রাজি হয় নাই সে! কাঁদিতে কাঁদিতে সুকুমারীর যে দমবন্ধ হইয়া আসে, আর ভাবিতে পারে না সে।
ইহার পর হইতেই তাহাকে অনেক নির্জন সন্ধ্যায় অথবা গভীর রাত্রে সেই দেবাংশী বটগাছের নীচে মাথা কুটিয়া কাঁদিতে দেখিতে পায়। এমন সাদা কাপড় পরা একটা মূর্তিকে হঠাৎ দেখিলে মনে প্রথমে ভয়ই জাগে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে ভুল ভাঙে। একটা চাপা কান্নার শব্দ কানে আসিতে থাকে এবং তখন মনে হয়, ওই সাদা কাপড়-পরা মেয়েটি শঙ্করের সদ্যবিধবা স্ত্রী সুকুমারী ছাড়া আর কেহ নয়।
তারপর আরও অনেকগুলি বছর কাটে। অনেক পরিবর্তন এবং তার দ্বিগুণ সম্ভাবনা লইয়া বিংশ শতাব্দী দেখা দিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে চেতনা আসিল, সুরেন্দ্রনাথ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হইলেন, অনেক যুবক তাঁহার গাড়ি টানিয়া কৃতার্থ বোধ করিল। তারপর পৃথিবীতে মহাসমর বাধিতেও আর বাকি থাকে না। ভারতবর্ষে সেই যুদ্ধের যাহারা প্রতিবাদ করিল তাহারা জেলে গেল, আর যাহারা করিল না তাহারা এই বলিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিল যে যুদ্ধের পর কিছু পাওয়া যাইবে।
কিন্তু বাহিরে যাহাই ঘটুক, পীরপুরের তার ছোঁয়াচটুকুও লাগে না, সে তার বটগাছের মতোই নির্বিকার, নির্বিকল্প।
এমনসময় এক সুদর্শন সুবেশ ভদ্রলোককে পীরপুরের নদীর ঘাটে আসিয়া নৌকা হইতে নামিতে দেখা গেল। তিনি এ গাঁয়ের বিশিষ্ট জামাই; বছর বছর স্ত্রী বাপের বাড়ি আসিলে তিনিও বছর বছর আসিয়া দেখা দেন। তাঁহার হাতে কী একখানা কাগজ, অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তিনি তাহা পড়িতেছিলেন, নৌকা পারে লাগিতেই আবার গুটাইয়া লইলেন এবং লাফ দিয়া পারে নামিয়া পড়িলেন। কিছু দূরেই বটগাছের নীচে পনেরো ষোল বছরের এক বালক গভীর মনোযোগে ইহা লক্ষ করিতেছিল। সে এ গাঁয়েরই ছেলে। ভদ্রলোক কাছে আসিতে সে তাঁহার দিকে চাহিয়া মুচকিয়া একটু হাসিল, ভদ্রলোকও হাসিলেন, তারপর সে তাঁহার পিছু লইল।
ভদ্রলোক ডান হাতে ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে যে বাড়িতে গিয়া প্রথম ঢুকিলেন, সে বাড়ির অবস্থা মোটের উপর ভালোই। তাঁহাকে দেখিয়া কয়েকটি ছেলেমেয়ে জামাইবাবু, জামাইবাবু, বলিয়া কলরব করিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে এক প্রৌঢ়া মহিলা ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। এবং আরও লক্ষ করিলে দেখা যাইত, বাখারির বেড়ার ফাঁক দিয়া আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়েও চুপি চুপি চাহিয়া কী দেখিতেছিল।
সেই ছেলেটি হঠাৎ ঘরে ঢুকিয়া বলিল, মৃণালদি জামাইবাবু এসেছেন। আমি বলেছিলাম আজ আসবেন? মৃণাল হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ, সতু, বলেছিলি।
ওদিকে জামাই-বেচারীকে নানারকম আদর-যত্নে রীতিমতো ঘায়েল করা হইতেছে।
একসময় চুপি চুপি সেখানে গিয়া সতু কাগজখানা খুলিয়া বসিল। কাগজখানা একটি পত্রিকা। সতু প্রথমেই দেখিল, কোনো এক জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক জায়গায় এক ভীষণ হত্যাকান্ড হইয়াছে, বড়ো বড়ো অক্ষরে তারই বিশদ বিবরণ দেওয়া। কয়েক হাজার লোকের একটা মিটিং হইতেছিল, হঠাৎ দেখা গেল চারিদিকে সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈন্যে ভরিয়া গিয়াছে। তাহারা সেই বিপুল জনমন্ডলীর চারিদিকে ঘিরিয়া নির্মমভাবে গুলি চালাইল। চার-শ লোক সেখানেই মারা গেল, এ ছাড়া আরও কত লোক যে শুধুই আহত হইয়াছিল, তার ইয়ত্তা নাই।
ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। পড়িতে পড়িতে সতুর গা-জ্বালা করিল, কখনো মুষ্টি দৃঢ় হইল, এমনকি সে কাঁদিয়া ফেলিল।
এবং ইহার কয়েক বছর পরেই দেখা গেল, এক শুভ অপরাহ্নে গ্রামের একমাত্র এবং শ্রেষ্ঠ পত্রিকাপাঠক শ্রীযুক্ত মনোহর চক্রবর্তী সমস্ত গ্রামজুড়িয়া শুধু এই কথাই প্রচার করিয়া বেড়াইতেছেন যে তাঁহাদেরই পীরপুর গাঁয়ের রাজেন মিত্তিরের ছেলে সতীন মিত্র শহরের কোন এক সাহেবকে মারিতে গিয়া নাকি ধরা পড়িয়াছে।
ঘটনা সত্য সন্দেহ নাই।
—বটগাছের নীচে আশে-পাশে এমনি-আরও অনেক ঘটনা ঘটে। মানুষের মতো দুটি চোখ থাকিলে অনেক কিছু সে দেখিত। সে এখন বৃদ্ধ। তার গায়ে এখানে-ওখানে নানারকমের শিকড়, কোনো কোনো ডালে হয়তো পোকাও ধরিয়াছে। গাছের গুঁড়িটা এত মোটা যে কয়েকটি লোক মিলিয়াও নাগাল পাইবে না। গুঁড়ির কাছে চারিদিকে কে যেন বাঁধাইয়া দিয়াছে। গাছের নীচে প্রকান্ড বড়ো ছায়া এবং সেই ছায়াকে জড়াইয়া আরও বড়ো একটা হাট বসে। ছোটো ছোটো টিনের ঘরের সারি এত বেশি এবং ঘন যে হাঁটিবার পথও পাওয়া দুষ্কর।
এখন ১৯৩০ সাল। গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। সেই আগুনের ঢেউ পীরপুর গ্রামেও কিছুটা আসিয়া পৌঁছিল। একদিন কোথা হইতে একদল যুবক আসিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
তাহাদের সঙ্গে ছোটো একটা হারমোনিয়ম। তাহারা স্বদেশি গান গাহিয়া বিলাতি বর্জনের কথা বলিয়া কিছু টাকা-পয়সা সংগ্রহ করিল। লোকগুলি সকলের কাছেই এক অদ্ভুত রহস্যময় জীব; মেয়েরা চুপি চুপি বিস্ময়ভরা চোখে এই সুদর্শন যুবকদের দেখিল।
বিকালে বটগাছের নীচে এক সভা। অনেক লোক আসিল। দেখা গেল, কয়েকটি স্ত্রীলোকও সন্তান-সন্ততি-সহ বক্তৃতা শুনিতে আসিয়াছে। তাহারা এক হাতে ঘোমটা টানিয়া স্বদেশি বক্তৃতা শুনিল। সভায় সভাপতিত্ব করিলেন শ্রেষ্ঠ পত্রিকাপাঠক মনোহর চক্রবর্তী মহাশয়। তিনি গান্ধীর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যেসব অদ্ভুত গল্প শুনিয়াছেন তাহা সমবেত সকল লোককে শুনাইলেন। একজন শুধু বন্দেমাতরম শব্দেরই ব্যাখ্যা করিলেন। তিনি বলিলেন, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের এই অপূর্ব মন্ত্র আজ প্রত্যেক ভারতবাসীর মুখে মুখে ফিরিতেছে বটে কিন্তু ইহার অর্থ অনেকেই জানে না। ইহার অর্থ হইল হে মাতা, তোমাকে বন্দনা করি।
এ ছাড়া সেই যুবকদের মধ্যেও দুই একজন বক্তৃতা দিল।
তারপর একেবারে ১৯৩৯ সাল। বটগাছের মৃত্যু আরম্ভ হইয়াছে, এতদিন চোখে পড়ে নাই, কিন্তু আজ দেখিতে বড়ো ভয়ানক। কতকগুলি ডাল এখন একেবারে জীর্ণ, পত্রহীন, ছোটো-ছোটো ডাল আর শুকনো পাতা সর্বদা ঝরিয়া পড়ে, এক মুসলমান বুড়ি তা কুড়াইয়া লয়। গাছের গুঁড়ির দিকে একটা মস্তবড় গর্তের মতো, একটা লোক বেশ লুকাইয়া থাকিতে পারে। হাটবারে চারদিকে বাঁধানো জায়গাটিতে অনেকে দোকান সাজাইয়া বসে, অনেকে বেশ আড্ডা মারে, কেহ কাঁঠাল ভাঙিয়াও খায়। মাঝে মাঝে দুই একজন সাধুও বসে। সেদিন হাটবার, সেদিনের অবস্থা দেখিলে এতকালের ইতিহাসকে ভুলেও মনে করা যায় না, দেখিয়া আশ্চর্য হইতে হয়, একটা ভীষণ কোলাহল চাঁদোয়ার মতো সেই প্রকান্ড বটগাছের নীচে গুম-গুম করিতে থাকে।
সেদিনও হাটবার। রাত থাকিতেই নানারকমের নৌকা আসিতেছে। একটার পর একটা করিয়া প্রায় আধমাইলখানেক নদী সেই নৌকায় ভরিয়া গেল। বেলা বারোটার পর হাট বেশ জমিয়া ওঠে। চারিদিক লোকে গিজ গিজ করে। বাহির হইতে যাহারা আসে তাহাদের চেহারা দেখিলেই বোঝা যায়। তাহাদের গায়ে নানারকমের জামা তাকে। ভিড় কোথাও পাতলা বলিয়া মনে হয় না। সব জায়গাতেই সমান। পীরপুর অথবা অন্যান্য গ্রাম হইতে যাহারাই হাট করিতে আসিতেছে তাহাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে গামছা, আর একটি ঝাঁকা। সকলে আসিয়াই একেবারে হাট করিতে বসিয়া যায় এমন নয়, অনেকক্ষণ এখানে সেখানে গল্প করিয়া সকলের শেষে তবে হাট করে। এইদিনে কত পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ফুলুরি, বেগুনি, জিলিপি—এসব যাহারা ভাজে, তাহাদের কথা বলিবারও অবসর নাই, কারণ সকলেই একটি পয়সার অন্তত কিনিয়া খায়।
হাটের মধ্যে কেমন একটা গন্ধ, যা অন্যদিন পাওয়া যায় না।
ছোটো ছোটো রাখালছেলেরা সস্তা সিগারেট কিনিয়া নির্ভয়ে খাইয়া বেড়াইতেছে। নতুন বিবাহ করিয়াছে যাহারা, অথবা যাহাদের কাছে তাহাদের স্ত্রীর গায়ের স্বাদ আজও পুরোনো হয় নাই, তাহারা বেশিরভাগই যেখানে গোলাপী রঙের সাবান, চিরুণী ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে ভিড় করিয়া আছে। গ্রামের একমাত্র খলিফা রহমান তাহার বহু পুরানো সেলাই-এর কলখানা একেবারে হাটের মাঝখানে লইয়া বসিয়াছে। কত লোক তাহাদের লুঙ্গি সেলাই করাইয়া লইল, কেহ কেবল জামার ছেঁড়াটুকু তালি দিয়া লইল।
দেখিতে দেখিতে বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে। এমন সময় এক কান্ড ঘটিল। সকলে দেখিল বটগাছের নীচে বাঁধানো জায়গাটিতে দাঁড়াইয়া একটা লোক বক্তৃতা করিতেছে। লোকটা সেই সতীন মিত্র ছাড়া আর কেহ নয়। আজ নয় বছর পরে কী কারণে হঠাৎ মুক্তি পাইয়া কয়েকমাস হইল সে গ্রামে আসিয়াছে। আসিয়াই সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে দারুণ মিশিতে লাগিল তাহাদের লইয়া কী জটলা করিতে লাগিল। আর আজ হঠাৎ দেখা গেল, ওই বটগাছের নীচে দাঁড়াইয়া সে বক্তৃতা করিতেছে। তাহার পাশে আর নীচে অনেকগুলি কৃষক। আস্তে আস্তে অন্যান্য কৃষকরাও একটা কৌতূহলবশে সেখানে গিয়া ভিড়িল, একটা বিপুল জনতার সৃষ্টি হইল।
সতীন বলিতেছিল– আমার চাষি-ভাইরা চেয়ে দেখুন, সব জিনিসেরই দর বেড়েছে কিন্তু যা বিক্রি করে আমরা দুটি খেয়ে বাঁচাব, সেসব জিনিসের দর বাড়েনি! কেন এমন হল?
সকলে তন্ময় হইয়া শুনিতে লাগিল। হায়দরের ছেলে বসির সতীনের পাশেই দাঁড়াইয়া আছে।
সতীন আবার বলিতেছে, ভাইসব, সমাজের যারা পরগাছা-যারা আমাদের গায়ের রক্ত শুষে শুধু বসে খায় তাদের উপড়ে ফেলবার দিন এসেছে আজ। ভাইসব আমাদের জিনিস দিয়েই ওরা মোটর হাঁকায়। ব্যাঙ্কে লাখ লাখ টাকা জমা রাখে, কিন্তু আমরা না-খেয়ে মরি। এ অত্যাচার কেন আমরা না-খেয়ে সহ্য করব? কেন সহ্য করব? এমনসময় আর এক কান্ড ঘটিল। হঠাৎ একটা হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। লাঠি হাতে মস্ত জোয়ান একদল লোক বাঁধানো জায়গাটিতে উঠিয়া অনবরত লাঠি চালাইতে লাগিল।
দুই-এক ঘা খাইয়াও সতীন চীৎকার করিয়া বলিল, ভাইসব এদের চিনে রাখুন, এরা সেই জমিদারদেরই ভাড়াটে গুন্ডা, লাঠি চালিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে এসেছে!
সতীন আর বলিতে পারিল না, আরও কয়েকটা লাঠির ঘা খাইয়া বসিয়া পড়িল, রক্তে তাহার শরীর ভাসিয়া গেল, যে মাটি একদিন সিঁদুর আর শত শত পাঁঠার রক্তে লাল হইয়াছে, তা আজ মানুষের রক্তে লাল হইয়া গেল।
এক মুহূর্তে যা ঘটিয়া গেল, তা কল্পনাও করা যায় না। ব্যাপার দেখিয়া যে যার মতো পলাইল। আর যাহারা সেই প্রকান্ড, বৃদ্ধ এবং জীর্ণ বটগাছের অত বড়ো হাটের মাঝখানে মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া রহিল, তাহাদের দেখিবার কেহ নাই।
ইহার কয়েকদিন পরেই এক ভীষণ ঝড় আসিল, এমন ঝড় এ-অঞ্চলে ইদানীং আর হয় নাই। ঝড়ের ঝাপটা মৃতপ্রায় বটগাছের উপরেই লাগিয়াছিল বেশি। বটগাছ ভাঙিয়া পড়িল, যেন প্রকান্ড এক দৈত্য ধরাশায়ী হইল। আর যেটুকু বাকি ছিল, তাহাও কাটিয়া লওয়া হইল। দেবাংশী গাছের কাঠ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা ব্যবহার করে না বটে কিন্তু স্থানীয় জমিদার উহা বেচিয়া বেশ দু-পয়সা লাভ করিলেন।
দীর্ঘ দুইশ বছর পরে বটগাছ অবশেষে মারা গেল। ইহার নীচে অনেক ইতিহাস রচিত হইয়াছে, কত দীর্ঘশ্বাস চাপাকান্নার শব্দ ইহার প্রতিটি পাতার নিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত; ইহার নীচে কত লোক চাপা পড়িয়াছে, তারপর এক রক্তের গঙ্গা বহিয়া গেল, এখনও কত রক্তের বীজ ছড়াইয়া আছে, সেই বীজ হইতে একদিন অঙ্কুর দেখা দিবে, তারপর অনেক নতুন বৃক্ষ জন্ম লইবে, ইহাও আশা করা যায়।
ভালো-না-লাগার-শেষ
রমলা বিরক্ত হয়ে উঠল। যেন এত বিরক্তি তার কোনোদিন আসেনি। নইলে ইকনমিক্সের পপুলেশন চ্যাপ্টারটা তো জমে ওঠবার কথা, কিন্তু আজকার ক্লাসে কিছুতেই যেন তার লেকচার গভীর হয়ে উঠল না।
এমন এক একটা দিন আসে সত্যি যখন কিছুই ভালো লাগে না। আজ যেন তাই। সে যেন আজ প্রথম টের পেল, ইস্কুলের মেয়েদের চেয়ে কলেজের মেয়েরা গোলমাল করে বেশি। অথচ এখানে কিছুই বলা যায় না, ইস্কুলের মতো যায় না কান মলে দেওয়া। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে মনে করে কি-না-কি করে ফেললাম; দুর্ভাগা সব। তার মেয়ে যদি হয়, সে কোনোদিন তাকে কলেজে পড়াবে না। পড়িয়ে বা লাভ কী? কিছু বোঝে না, কিছু জানে না, কেবল চোখ বুঝে মুখস্থ; আর পরীক্ষা খারাপ দিলে হাউহাউ করে কান্না, ফিট—আরও কতো কী! কিন্তু কাজের বেলায় দ্যাখো সব পেছনে পড়ে আছে।
নাচের যত পারফর্ম্যান্সই দিক, একাই কলেজে আসুক, বেড়াক একা, এক মিনিটে হাজারো কথা বলুক, পাঁচ হাজার বলো তো দশ হাজার বছর আগেকার আদিম মনোবৃত্তি আছে বেঁচে।
অথচ পুরুষেরা এমনি বোকা যে এসব তারা মোটেই জানে না, ধরে নেয়। অন্যরকম। কত কবিতা লিখে ফেলে, দেহের রূপ সাধনায়, হয়ে ওঠে তৎপর। রমলা যদি পুরুষ হত তবে দিত সব প্রকাশ করে।
রমলা হাসল, তাহলে কী মজা হবে। দুর্মুল্যতা, অহঙ্কার, লজ্জা সব চুরমার হয়ে যাবে।
রমলার মন আজ ভালো নেই। বলেছি তো, এত বিরক্তি আর অবসাদ তার কোনোদিন আসেনি। দেড়টার পর এত ঘণ্টা লীজার। সে কলেজ বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে নির্জন জায়গা দোতলার ছাদে যাওয়া সিঁড়ির কাছে যে এক টুকরো বারান্দা আছে সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যদিন হয় তো লাইব্রেরিতে গিয়ে বসত; গল্প করত প্রভাদির সঙ্গে, ভারী মজার লোক তিনি, হাসাতে হাসাতে মারেন, কিন্তু আজ তার কি হল সে রেলিংয়ে ভর দিয়ে বুকের কাছে এক হাতে মার্শালের ইকনমিক্স চেপে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নীচে কিছুদূরে দেখা যায়, গেটের কাছে বেলগাছের ছায়ায় বসে কলেজের দরওয়ান কার সঙ্গে গল্প করছে। ঘণ্টা পড়বার পর মেয়েরা ক্লাস বদলিয়েছে, এখনও দু-একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দুপুরের দমকা বাতাস মাঝে মাঝে গায়ে এসে লাগছে; কপাল আর গালের কাছে দু-এক গোছা চুল উড়ছে বাতাসে। আকাশে ছেঁড়া সাদা মেঘ।
রমলা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার কি মনে করে প্রফেসরদের বিশ্রাম-কক্ষের দিকে গেল। কিন্তু সেখানে প্রভাদি নেই। তাহলে তিনি আসেননি, নাকি আবার প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে গল্প করছেন?
একপাশে বসে নতুন নিযুক্ত অরুন্ধতী বসু নিবিষ্ট মনে কী যেন পড়ছে। রমলা কোনো সাড়া না দিয়ে নিঃশব্দে প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে হাজির হল।
প্রভাদি সত্যি আসেননি।
প্রিন্সিপাল নির্মলা রায় গম্ভীরভাবে কাগজপত্র দেখছেন। পাশের চেয়ারে ইংরেজির অধ্যাপক সুধীরবাবু বসে আছেন, কোনো কাজ আছে বোধহয়।
রমলা চকিতে একবার সেদিকে চেয়ে বললে, শরীরটা ভারী খারাপ বোধ হচ্ছে নির্মলাদি। নির্মলা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে ভাই? তিনি রমলাকে তুমি বলেই সম্বোধন করেন, রমলার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার একটু সূত্র নাকি আছে, আর তা ছাড়া সে কলেজের সবচেয়ে অল্পবয়সি অধ্যাপিকা।
রমলা বললে, ভারী exhausted feel করছি।
বোর্ডিং-এ চলে যেতে চাও?
If you permit—
নির্মলা তাড়াতাড়ি বললেন, যাও।
একটু হেসে রমলা চলে এল।
কলেজের লাইব্রেরি। বুড়ো লাইব্রেরিয়ান টেবিলের ওপর ভর দিয়ে বই পড়ছেন। ঘরে আর কেউ নেই।
রমলা একটা বই নেবে। বই দিয়ে সে তার ভালো-না-লাগার সময়গুলো কাটাবে। সে বললে, শর কোন বই সবচেয়ে ভালো হবে আপনি জানেন বড়োবাবু?
বড়োবাবু বললেন, আমাদের এখানে তো সব বই নেই, Man and Superman ছিল, এখন লাইব্রেরিতে নেই—কে যে নিয়েছে! Doctors Dilemma নিতে পারেন।
দিন তো।
যদুবাবু বই এনে দিলেন।
রমলা বই হাতে করে বোর্ডিং-এ চলে এল। দুটো বেজে গেছে। সে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে দেখল।
সমুখের জানালা দিয়ে হু হু করে আসছে বাতাস। তারই প্রতাপে একটা পাতলা ক্যালেণ্ডার দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শব্দ করছে।
দুপুরের নিস্তব্ধতা চারিদিকে।
রমলা জুতো ছেড়ে আয়নার কাছে এসে দাঁড়াল। আয়নাটা ছটো। বোর্ডিংয়ে এরকমই থাকে। কিন্তু রোজই কারণে অকারণে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে রমলার একটা বড়ো আয়নার কথা মনে পড়ে যাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যথাযথ দেখা যায়। কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো ছোটো ওই জাপানি আয়নায় দেহের সবটুকু দেখা যায় না। রূপ কি শুধু মুখেই!
পোষাক-পরিচ্ছদ বদলাবার পর রমলা গামছা সাবান নিয়ে স্নানের ঘরে গেল। কিছু পরে হাতমুখ ধুয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে এল।
গত রাত্রির বিছানা এখনও পাতাই রয়ে গেছে। টেবিলের ওপর ক-টা বই ছড়ানো।
Writing pad-এর পাতা বাতাসে ফরফর করছে।
রমলা আবার আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে আংশিক প্রসাধন সেরে বইটা হাতে করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বই খুলতেই Preface–
এক—
দুই—
তিন পৃষ্ঠা—রমলার আবার বিরক্তি এসে গেল। ক্রমাগত আরও পাতা উলটিয়ে দেখল, প্রায় অর্ধেক বই-ই কেবল Preface! তারপরে আসল নাটক।
ওরে বাপরে!
আপনারা শুনে আরও আশ্চর্য হবেন রমলা গুপ্তা এম-এ বইটা পাশে রেখে দিল। অদ্ভুত বটে! এরকম মনের অবস্থায় আপনি আমি হয়তো ক্ষমা পেতে পারি কিন্তু কলেজের অধ্যাপিকা রমলা গুপ্তা কখনো পান না।
আমি জানি এ আপনাদের চোখে ঠেকবে। কিন্তু ঘটেছিল সত্যি। কেন যে ঘটেছিল তা এখন খুলে বলি।
দু-বছর আগেকার কথা।
প্যাক্ট হল। কেউ কারোর স্বাধীনতায় বাধা দিতে পারবে না। যদি কখনো প্রয়োজন হয় পরস্পরে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করবার তখন দুজনের সম্মতিতেই হবে, তার আগে নয়।
পূর্ববঙ্গের কোনো এক বেসরকারি কলেজের তরুণ অধ্যাপক অদিতি গুপ্ত চুক্তিপত্রে সায় দিলেন। রমলা তখন নতুন চাকরি পেয়েছে। তখন তার প্রাচুর্যের আনন্দ, নতুন জীবনের আনন্দ যেন খোলা মাঠের বাতাস, যেন বাধা না পাওয়া মধ্যরাত্রির জ্যোৎস্না।
অদিতি গুপ্তের মতো মানুষ দেখা যায় না। মনে হল, এই তার স্বামী হওয়ার উপযুক্ত। এতটুকু অভিযোগ নেই; জোর খাটাবার ইচ্ছে নেই।
কতকগুলো চিঠি আছে। বিয়ের পর এগুলোই সম্বল। রমলা আবার উঠে ডেস্ক থেকে চিঠিগুলো বার করল। একটি সে খুলে বসল।
চিঠির কাগজ প্যাড থেকে নেওয়া নয়, সামান্য ছেঁড়া কাগজ। অন্য কোনো বাহুল্য নেই; অদিতি গুপ্তের মনের একদিক এখান দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু লেখার বাহুল্য আছে; মানে পড়তে বেশ লাগে।
সেটিতে লেখা :–রমলা, কলেজের ছাত্রদের এক সভায় শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে, ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই আদেশ এসেছে। কারণ আমি পড়াই বাংলা। যাই বলো, তুমি আছ বেশ, তোমার জীবনে ওটা কখনোই লাগবে না কাজে, অন্তত বক্তৃতা দিতে বলবে না কেউ।
তারপর আগের দিন রাতে প্রবন্ধ লিখে পরের দিন বলেছি কিছু। শুনেছি খুব ভালো নাকি হয়েছে। আমার প্রবন্ধে এমন একটা দিক নাকি প্রকাশিত হয়েছে যা আগে কখনো দেখা যায় নি। সম্পূর্ণ অভিনব। অভিনবই বটে।
নারী-চরিত্রে সর্বজ্ঞ আমি। হয়তো আরও কিছু লিখলে একটি অথরিটি হয়ে যেতাম!–
কী যেন এক অস্পষ্ট ইঙ্গিত, মনে এক আভাস আছে এই চিঠিতে, রমলা যেন আজ এই প্রথম বুঝতে পারল।
কিন্তু এ চিঠি আজকের নয়, অনেক দিনের। তখনকার মনের অবস্থা যা ছিল, এখনও তাই আছে কি না, কে জানে?
রমলা বাইরের দিকে চাইল! বোর্ডিংয়ের মাঠের পামগাছের কতখানি দেখা যাচ্ছে আর লম্বা ইউক্যালিপটাসের ছোটো পাতা বাতাসে কাঁপছে।
ফাল্গুনের বাতাস, একটু শীত করে যেন। রমলা তার একহারা পরা চাদর আরও খুলে গায়ে চেপে ধরল। তা ছাড়া শরীরটাও ক্লান্ত বোধ হচ্ছে।
অদিতি বিস্ময়ে বলল, কোনো খবর না দিয়েই যে!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রমলা বলল, ও খবর দিইনি বুঝি?
সে তো তুমিই জানো।
সে কথা আগে ভাববার সময় পাইনি।
এত কাজ! একরকম নোটে ছাত্রীরা আর খুশি নয়, তাই অন্য অথরের বই পড়তে হয় বুঝি খুব?
না, ইকনমিক্স সম্বন্ধে কেউ বড়ো আগ্রহ প্রকাশ করে না। রমলা হাসল। ঘরে ঢুকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে বলল, ঘরটি বেশ পরিষ্কার সাজানো তো! আমার ঘরের তুলনায় এ স্বর্গ। ইস, তুমি যদি দেখতে–
থাক, দেখার আর দরকার নেই। মেয়েদের বোর্ডিংয়ে পুরুষের যাবার অধিকার তো নেই।
অদিতি রমলাকে হাত ধরে বসাল। তারপর বলল, সারারাত ট্রেনের জার্নি, খুব strain হয়েছে নিশ্চয়ই, ঘুমও হয়নি। তুমি বিশ্রাম করো।
না, এখন স্নান করব। রমলা উঠে জুতো খুলল।
অদিতি বলল, তা হলে তুমি কাপড় বদলাও, আমি যাই।
যাও। রমলা মিষ্টি হেসে বলল, আবার এখনই এসো কিন্তু। বাথরুমটা দেখিয়ে দেবে এসে।
স্নানের পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে হল, ভালো লাগল।
অদিতি বলল, বয়কে ডাকি। কী খাবার বল?
–সে সম্বন্ধে আমার কোনো প্রেজুডিস নেই; যা ভালো হয়।
-বেশ। অদিতি খাবার ব্যবস্থা করল। রমলা বলল, সাহেবের হোটেল। খরচ। দাও কত?
–তা কি তোমায় বলিনি রমলা? সে সংসারে অনেক ছেলেমেয়ে, এক স্বামী আর এক স্ত্রী, তাদের বুড়ি মা–বেশ চলে এ টাকায় যত আমি দিই এখানে খাওয়া আর থাকায়। অবিশ্যি এই আমার ভালো লাগে। কোনো ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয় না।
রমলা বলল, মাইনেয় কুলোয় তাহলে?
–কোনো মাসে কুলোয়, কোনো মাসে কুলোয় না। জানো তো, আমার এক বিধবা বোন আছে, তাকে সাহায্য করতে হয়।
—জানি, রমলা এমনি হাত দুটো এক করে বলল, কিন্তু একটা কথা বলব
-কী?
—বলো কিছু মনে করবে না—
অদিতি হেসে বললো, না বল। রমলা বলল, আমার তো মোটেই খরচ নেই। তোমার যখন দরকার, কেন নাও না–
–চেয়ে? অদিতি আবার হাসল।
রমলার একবার ইচ্ছে হল বলে, না, চেয়ে নয়, জোর করে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।
তাকে নীরব দেখে অদিতি বলল, কি, প্রস্তাব করে বুঝি ঠকে গেলে? এ তো জানোই মেয়েদের অর্জিত টাকা পুরুষে নেয় না।
—কিন্তু তা তো অনেকে নেয় দেখেছি।
–না, তা নয়। আমি বলছিলুম, তাহলে যে চুক্তি ভঙ্গ হবে।
—ও, বলে রমলা একটা নিশ্বাস ফেলল চেপে। অদিতি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তুমি একটু পাতলা হয়ে গেছ।
-খুব কি খাটুনি পড়েছে?
–না। বেশি পরিশ্রম আমার ধাতে কোনোদিনই সইল না, তুমি তো জানো, রমলা হেসে বলল, তবু কেমন করে যে রোগা হলুম বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু তুমি টের পেলে।
অদিতি বলল, না, রোগা নয়। তুমি যেন আরও slim, আরও graceful হয়েছ।
রমলা নীরবে হাসল।
বয়ের হাতে খাবার এল। টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি তারা বসল।
রমলা বললে, তুমি খাবে না?
–বেশিক্ষণ হয়নি যে খেয়েছি, অদিতি বলল, তুমি খাও, আমি গল্প করি।
রমলা হাত গুটিয়ে বসল।—এত খেতে আমি কিছুতেই পারব না। তুমি এসো সঙ্গে।
ভঙ্গিটা কতকটা ছোটো মেয়ের আবদারের মতে, এ পরিচয় যেন অদিতির চোখে নতুন ঠেকল। সে হেসে বলল, আচ্ছা এসো।
খাওয়া শেষ হলে পর, অদিতি কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বললে, তোমাদের নির্মলাদি কেমন, এখনও বিয়ে করেননি? এখনও কুমারী নির্মলা রায়?
-হ্যাঁ, এখনও কুমারী নির্মলা রায়। রমলা মুচকি হাসল।
সিগারেটে আগুন লাগানো হয়নি। অদিতি তা মুখে দিয়ে এমনি বসেছিল। রমলা, দেশলাই-এর কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল।
তাতে একটি টান দিয়ে কতকগুলো ধোঁয়া ছেড়ে অদিতি বলল, তুমি ঘুমোও, সারারাত জেগেছ।
রমলা সত্যি বড়ো ক্লান্তি বোধ করছিল। সে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অদিতি টেবিলের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে লাগল।…
রমলা চোখ রগড়িয়ে ভাবলো, সে কোথায় এসেছে! এই তো কাল ছিল একা, আর আজ? কে আছে পাশে? এ কোন জায়গা?
সমস্ত ঘরটিতে রমলা চাপা আনন্দে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কিন্তু অদিতি ঘরে নেই। সে হাতের কাছে ছোটো টেবিল থেকে ঘড়ি তুলে দেখলো। পাঁচটা বেজেছে।
বেশিক্ষণ ঘুমুইনি তো! তবে অদিতি গেল কোথায়? একটু ভয় হলে যেন। খাট থেকে নেমে সে বাইরে বারান্দায় গেল। সেখানে অদিতি নেই। তার ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে ডাকে।
নীচে গিয়ে হোটেলের মেমগুলোকে জিজ্ঞেস করলে হয়। কিন্তু ওরা কি জানে? বারান্দায় রেলিং ধরে সে ভাবতে লাগল।
-রমলা।
রমলা চমকে ফিরে তাকাল, অদিতি খালি গায়ে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধে টার্কিস টাওয়েল।
–এ কী?
অদিতি হেসে বলল, কাপড়-চোপড় নিতে মনে নেই।
বাথরুমে ঢুকেও মনে হল না?
হয়েছিল, কিন্তু তখন অর্ধেক স্নান করে ফেলেছি কি না!
রমলা খিলখিল করে হেসে উঠল। এই প্রথম সে এমনভাবে হাসল। তারপর ঘরে গিয়ে কাপড় এনে দিল।
একটু পর অদিতি ঠিক হয়ে বলল, বেড়িয়ে আসবে?
চলো।
ডাক-বাংলো, রেলওয়ে কর্মচারীদের কোয়ার্টার, পথের পাশে বড়ো লাল দালান, গাছের সারি, জনহীনপ্রায় পীচ-ঢালা মসৃণ রাস্তা।
শহরের বুকে নেমেছে ধূসর পাতলা অন্ধকার, সারি সারি বাড়ি আর গাছপালার মধ্যে ছায়া এসেছে ঘন হয়ে।
আঁকাবাঁকা রাস্তা সাপের মতো, কালো তার রং, বাতাসে আর দীর্ঘ সেগুন পাতার সঙ্গে শব্দ হচ্ছে মাঝে মাঝে।
পাশে লম্বা লেক। তারপরেই অনেক দূর পর্যন্ত মাঠ। জলের মাঝখানে ছোটো ঢেউ।
এখানে এই খোলা মাঠে, নরম ঘাসে, গাছের ছায়ায় আকাশের নীচে বসলে পর চোখে কেমন যেন নেশা লাগে, হাত দুটি কাকে যেন হাতড়ায়।
অদিতি সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলতে ফেলতে বলল, একটা কথা এখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুমি কেমন আছো?
রমলা হাত ধরে ছিল, একটু হাসল, বললে—ভালো। তুমি?
ছোটোবেলায় কোনো কিছু হলেই আগে থেকেই বলে রাখতুম, তোমরা যাই বলবে তার চেয়ে একবার বেশি আমার। এখনও তাই বলছি। তুমি যতটুকু ভালো, তা যদি ডিগ্রি দিয়ে মাপা যায়, তার চেয়ে এক ডিগ্রি সবসময়ে আমি বেশি।
হাসিমুখে রমলা বলল, জায়গাটা বেশ না?
-হুঁ, কিন্তু একা নয়। আমরা দুজনে আছি বলে।
—মানে?
–মানে, আমি আছি বলে তোমার ভালো লাগে, আর তুমি আছো। বলে আমার ভালো লাগে। অন্য সময়ে, অন্য কেউ হলে রমলা করত প্রতিবাদ, কিন্তু এখন করল না।
সে অনুভব করল, তার হাতের মধ্যে অদিতির হাতটি আরও চেপে এসেছে।
সন্ধ্যা গাঢ় হল।
জিমখানা ক্লাবের উৎসবের বাজনা শোনা যাচ্ছে; রাত নটা। রমলা আর অদিতি হোটেলে ফিরল। নীচের তলায় গ্রামাফোনে মার্লিনের গান হচ্ছে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির পাশে জানালা দিয়ে দেখা গেল, কর্মরত দু-তিনটে মেম আর টেবিল ঘিরে সাহেব।
ওপরে গিয়ে অদিতি চেয়ারে বসে পড়ল আর রমলা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে।
অদিতি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, কি, দাঁড়িয়ে যে!
–বিছানা করতে হবে না?
–কোথায় হবে? অদিতি ধোঁয়া ছেড়ে বলল, জায়গা নেই তো। ওটা তো একজনের খাট। তুমিই না হয় ঘুমাও, আমি এখানে বসে–।
রমলা একরকম চেঁচিয়ে উঠল—তবে আমি কী করব? এখন গাড়ি আছে?
-ভয় পাও কেন রমলা? এ পর্যন্ত আগাগোড়া আমার স্বভাবটায় কী দেখতে পেলে, একবারটি ভেবে দেখ না। আজ রাতেই তোমাকে যেতে হবে, অসম্ভব এ কথা। অনেকদিন পর স্বামী-স্ত্রীতে দেখা হলে পর তারা রাত জাগতেও তো পারে? কি বল? তারপর মেঝে আছে। সে কথা কি তুমি এত ভুলে গেলে যে, চেঁচিয়ে উঠলে ভয় পেয়ে?
অদিতি হাসতে হাসতে খুব কাছে এসে বলল, কী মজা, লক্ষ্য দুজনেরই আমাদের এক হলেও ভান করে তোমাকে একটু রাগিয়ে দিলাম, তোমাকে সুন্দর দেখাল, তুমি ধরা পড়লে—আর—এখন হাসছ? অদিতি রমলার মুখের ওপর নত হয়ে তার পাতলা ঠোঁটে একটি চুমো খেয়ে বলল,
খিদে পেয়েছে বড়ো। বয়কে খবর দিই।
-না আমার মোটেই ক্ষিদে নেই, তুমি খেলে খেতে পারো–
—তবে আমারও নেই।
—কি বল? আশ্চর্যের ভাবে রমলা তাকাল, এই যে বললে—
অদিতি হেসে বলল, মনে আছে, তোমার খাওয়ার সময়, হাত গুটিয়ে বসলে–
-তারই শোধ নেওয়া হচ্ছে বুঝি?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা বয়কে ডাকো। আমি হার মানছি।
খাওয়া, দাওয়ার পর।
রাত্রি গভীর হয়ে এসেছে, আর বেড়ে উঠছে তার রহস্যময়তা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে অজস্র তারা চোখ মেলে রাত জাগছে, আবার দিনের বেলা। ঘুমুবে। গির্জের ঘড়িতে বাজল বারোটা, বাজল একটা…
রাত্রির রহস্য গভীরতর হল। তারপর একটু একটু করে ভোরের আভাস।
বাজলো বেলা আটটা।
শহরের চোখে নেশা জমে রাতে, আর ভোর হতেই সে নেশা যায় টুটে, শুরু হয় কোলাহল, ব্যস্ততা, মোটরের হর্ণ। দিনের আলোয় মানুষগুলো মুখখাস পরে।
অদিতি চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
আর—রমলা শুয়ে আছে মেঝেতে পাতা বিছানায়।
রমলা—
কি?
বারোটায় ছাড়বে কলকাতার গাড়ি। এখন আটটা বেজে গেছে। আমার স্বভাবটা তো জানো, আপনভোলো নই কিন্তু নিজেকে ভুলতে পারি ইচ্ছে করলে। তুমি চলে যাও, এতটুকু জোর আমি করব না,—থাকো, তোমাকে ভয়ানক ভালোবাসব– ওঠো। না গেলে কলেজে যাওয়া হবে না, ছুটিও নাওনি। ওঠো। তোমার অনেক কাজ–
আমাকে ঠাট্টা কোরো না।
তুমি কি স্বপ্ন দেখছো।
হ্যাঁ, খুব ভালো একটা স্বপ্ন, আগে কখনও দেখিনি। খুব সুন্দর, আমার ভালো লাগছে। এত ভালো লাগছে যে তা তোমায় মুখে বোঝাতে পারব না। এত ভালো, গভীর…
রমলার ঠোঁট চেপে আসছে, চোখের পাতা অর্ধেক খোলা।
তুমি ঘুমোও আমি সব ব্যবস্থা করি গে।
না, রমলা এবার যেন জেগে উঠল, বললো, না, তুমি কোথায় যাচ্ছ আমায় একা ফেলে?
অদিতি হেসে বলল, কেন সম্মতির অপেক্ষা করতে হবে নাকি?
রমলাও হেসে বলল, আচ্ছা কাল বিকেল থেকে এ পর্যন্ত ভেবে দ্যাখো তো আমার সম্মতির দিকে কতদূর চাওয়া হয়েছে?
অদিতি বললে, বৃথাই এতদিন প্রফেসারি করলুম রমলা। অনেক আগেই এটা আমার জানা উচিত ছিল যে, মেয়েরা মুখে কিছু বলে না তাদের ডাকাতি করতে হয়, অর্জুনের মতো হরণ করতে হয়। ডাকাত জড়িমায় রমলা চোখ বুজল আবার, তার রাত্রি এখনও শেষ হয়নি।
মরুভূমিতে মুক্তি
আশ্চর্য, এমন একটা ছবি রানির ভালো লাগল না। অর্ধেকও হয়নি, তখনি সে অস্বস্তি বোধ করেছিল। আগে, পেছনে ও পাশের দর্শকগুলো তন্ময় হয়ে দেখছে, কিন্তু রাণি তার চোখ দুটি যদিও পর্দার দিকে রেখেছে, ভালো লাগছে না তার। অথচ এখানে আসতে তারই আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
সে বিমলকে চুপি চুপি বললে, চলো বাড়ি যাই।
–কেন, ভালো লাগছে না?
–না, তুমি চলো।
—বিমল বললে, দাঁড়াও ইন্টারভ্যালটা তো হোক।
হলের ভেতরের হাওয়া যেন ভারী হয়ে উঠেছে, রাণি নিশ্বাস ফেলতে পারছে না।
বিশ্রাম হল, কিন্তু বিমল যা মনে করেছিল তা হল না, রাণি আর থাকল না। সে আর কী করে, নীল আলোর নীচ দিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠল।
কনকনে শীত। চলতি গাড়িতে বাতাসও লাগছে। রাণি আরও ঘন হয়ে বসল।
বাসায় চাকর রামলোচন অপেক্ষা করছিল। রাণি গিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে দিলে। তারপর ওপরে গিয়ে একেবারেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। যেন এই শীতের রাতেও অনেক ক্লান্ত। ওর এই এক দোষ, একটা সামান্যতম কিছু অসঙ্গতি ঘটলে, সে তা চেপে রাখতে পারে না, প্রকাশ করে ফেলে। কিন্তু ওদিকে আবার কী যে অসঙ্গতি ঘটেছে তাও সহজে জানাবে না, এখন যদি কেউ তার অনুভবের তীক্ষ্ণতায় জানতে পারে।
বিমল একটা চেয়ারে বসেছিল। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ। টেবিলের ওপর আলো জ্বলছে। কিন্তু পরে রাণি জানালাগুলো খুলে দিয়ে খাটের ওপর বসল।
-বাইরে ভয়ানক হিম পড়ছে, জানলা খোলার কী দরকার ছিল?
–থাক না খোলা, পরে বন্ধ করে দেব।
বিমল একটা সিগারেট ধরাল। কথায় কথায় রাণি বললে, আচ্ছা মেয়েটি যে ওরকম অবৈধভাবে ভালোবেসে চলল, এর শেষ কোথায় জান?
—শেষ পর্যন্ত দেখলেই তো জানা যেত, বিমল বললে, কিন্তু আমি জানি, বই পড়েছি, Anna আত্মহত্যা করল।
—আমিও তাই ভাবছিলুম। ওরকম জীবন কখনো ভালো নয়। তার শেষ কখনো ভালো হতে পারে না।
—কিন্তু মানুষের ভুল বলে একটা জিনিষ আছে, এটা তো স্বীকার করো।
–করি, কিন্তু এও জানি, সে ভুল আমরা জেনেশুনেই করি। তাই তার ফল কখনো ভালো হয় না। কেবল দুঃখ আর দুঃখ। তার পরের জীবন একটা কান্নার সমুদ্র। ওর জন্যে দুঃখ হয়, কিন্তু সেজন্যে তুমি আর কী করতে পারো বল? যে মেয়ে স্বামী আর ছেলে থাকতে আর একজনকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসার, ধরো তোমার কাছেই যদি ওরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তার পক্ষে তুমি কি তাহলে সাক্ষী দিতে পারবে? পারবে না। কেবল দুঃখই হয়।
—তা ছাড়া আর উপায় কী বল? কিন্তু তুমি যা বললে তা না করতে পারলেও নিজের দিক থেকে প্রশান্ত মনে ক্ষমাও তো করতে পারি?
—তা পারো। রাণি আবার শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ কাটল চুপচাপ। বিমলের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। সে হাত-পা গুটিয়ে বসেই রইল। পাশের বাড়ির বাসন মাজার শব্দ কানে আসছে।
—ঘুমুলে?
—না।
—হঠাৎ অত মনমরা হয়ে গেলে কেন? বিমল যেন অনেক সাহসে বললে।
–কী হবে অত পরেরটা ভেবে? রাণির স্বর ভারী হয়ে এল।
বিমল লক্ষ করছে, তবু বললে, তা ঠিক। তবে শুধু নিজের ভাবনাই তো সার নয়।
—এও ঠিক, কিন্তু সার নয় কখন, যখন নিজের ভাবনা বলে একটা কিছু অন্তত থাকে।
বিমল আবার জিজ্ঞেস করলে, সে কি একেবারেই নেই?
—আছে কি নেই তা কি তুমি নিজেই জান না? রাণি উষ্ণ হয়ে উঠল, কেন আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছ? তুমি আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, এটুকু বোঝবার শক্তি আমার থাকলে তোমারও নিশ্চয়ই আছে। ভাবনা! সে কার থাকে? তুমি বলো। তুমিই খুঁজে বের করো।
-আমি তো অনেক দেখেছি, পাইনি। জানতাম, তোমারও নেই। এখন দেখছি কিছু আছে। বলো তাহলে। কিছু সময় কাটানো যাবে। যে দিনগুলো এত অবহেলায় আর আলস্যে সেগুলোর কিছু অন্তত কাজে লাগানো যাবে।
-ইস, আমি তো আর পারিনে। রাণি আর বলতে পারলে না, স্বর বাষ্পচ্ছন্ন, সে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।
বিমলও চুপ করে গেল। রাত বেড়ে চলেছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে হুইসিলের শব্দ। শহরের প্রান্তে গভীর রাতের ট্রেন যাচ্ছে।
বিমলের চোখে ঘুম নেই। সে নড়েচড়ে বসল। কী শীত! ঘরের আলোটাও দুরন্ত শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু একটা কিরকম যেন অলসতায় বিমল চেয়ার থেকে উঠল না।
গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজল।
এবার সে চমকে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে জানালাগুলো আগে বন্ধ করল, তারপর সেইখানেই কতক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে খাটের কাছে গেল। রাণি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘুমের চোখেই হয়তো আলোর দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে। বাইরের পোশাকই এখন গায়ে। সেই জরিপেড়ে নীল সিল্কের শাড়ি, গায়ের সবকিছু একেবারে একটা গরম জামায় গিয়ে শেষ, বুকের মাঝখানে সবগুলো জামা ঈষৎ ফাঁক হয়ে একটা কোণের মতো সৃষ্টি করেছে। শুভ্র কতটুকু বুক। একটা সরু হার। চারিদিকে একটি মিষ্টি গন্ধ।
বিমল ডাকল না।
নিঃশব্দে ভাঁজ করা লেপটি তার গায়ের ওপর টেনে দিয়ে এবার টেবিলের কাছে একটা বই খুলে পড়তে লাগল। সময়ের বিরাম নেই। একটা বিড়াল এসেছে ঘরে। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের নয়। কিন্তু আশ্চর্যের যা তা হচ্ছে ওর ভীষণ চেহারা–গায়ের রঙ মিশকালো, একটু সাদা ছিট নেই, আর চোখদুটো আলোর ভাঁটার মতো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ দেখলে ভয় করে।
বিড়াল। বিমল দেখতে পেয়েছিল। সে এটা আরও অনেকবার দেখেছে, কিন্তু অন্যবার আজ রাতের মতো হয়ে ওঠেনি। সে চেয়ে রইল তার দিকে একদৃষ্টে, বিড়ালটাও চেয়ে রয়েছে একইরকম ভাবে।
বিমলের হঠাৎ ভয়ানক হাসি পেল : মনে মনে বললে, ওরে তোরও কি নিদ্রাবিহীন রাত্রি?
কিন্তু এখন হাসবার কথা নয়। ভয় পাওয়ার, নইলে রাগবার কথা। বিমল এবার রেগে গেল, হাতের কাছে ছিল একটা খালি সিগারেটের কৌটো, খুব চুপিচুপি সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ ছুঁড়ে মারল বিড়ালটার দিকে। কিন্তু তার পায়ে সেটা লাগল না। বিড়ালটা যেখান দিয়ে এসেছিল সেখান দিয়েই দৌড়ে পালাল।
ইতিমধ্যে কৌটোর শব্দে রাণি জেগে উঠেছে। বিমল অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি আবার বইয়ে মন দিলে। রাণি আশ্চর্য হয়ে বললে, ওকি, তুমি এখনও বসে!
সে আস্তে উঠে তার কাছে এল, বললে, ক-টা বেজেছে?
–বোধহয় একটা।
–একটা! রাণির চোখ দুটি বড়ো হয়ে গেল, বলল, আর তুমি এখনও জেগে?
-তা এমনকী হয়েছে? রাত একটা, এমনকী! বেশি ঘুমোনো কি ভালো? জগতে যত বড়ো বড়ো লোক আছেন তাঁরা কখনও বেশি ঘুমোননি, বই খুলে দেখো গিয়ে।
এই কয়েক ঘণ্টা আগের কথা রাণির মনে পড়লো, হঠাৎ অনুতাপে, আর একটা দুঃখে তার চোখ দুটি সজল হয়ে এল। বলল, তুমি কি বড়োলোক?
-না, তা নই, কিন্তু মহাজনপন্থা অনুসরণ তো করতে হবে।
–দরকার নেই। রাণি যেন ভয়ানক অনুতপ্ত হয়ে বলল, আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। তুমি এখনও না খেয়ে আছ, আর আমি কি না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো।
মাথাটি নীচু করে সে দুহাত জোড় করল। বিমল তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে তার দুটি হাত নিজের হাতে নিয়ে বললে, আহা, একি করছ? তোমার কিছু অপরাধ হয়নি। আমি এতটুকু মনে করিনি।
কতক্ষণ এমনি কাটল। রাণি হঠাৎ বললে, চল খেতে।
বিমল খেতে গেল।
কয়েকদিন পর। একদিন সাইকেলে করে একটি চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সি ছেলে এল। দুপুরবেলা।
কী একটা পর্ব উপলক্ষে বিমলের অফিসে ছুটির দিন।
ছেলেটি রাণিকেই খুঁজছিল। রাণি তার কাছে গিয়ে বললে, কাকে ডাকছো?
—বিমলবাবুর বাসা না এটা?
-হ্যাঁ।
-মানে, তারই—মানে, আমার দিদির বন্ধু রাণি বলে কেউ আছে এখানে?
–আছে। রাণি মুচকি হেসে বলল।
—তাকে একটু ডেকে দিন না।–আমিই।
-ওঃ, আপনি। ছেলেটি তাড়াতাড়ি শার্টের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বললে, দিদি লিখেছে। কালকে আবার ঠিক দশটার সময় আসব।
ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, রাণি তাড়াতাড়ি বললে, আমাকে এখনই আবার উত্তর দিতে বলেনি তো?
-ওঃ, একেবারেই ভুলে গেছি। ছেলেটি সাইকেল রেখে আবার কাছে এসে বললে, আমার সঙ্গেই উত্তর দিয়ে দিতে বললে।
—এই দ্যাখো, আমি মনে করে দিয়েছি বলেই না! তুমি এই ঘরে একটু বোসো, আমি আসছি।
—আচ্ছা।
-রাণি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে গিয়ে খাম ছিড়ে চিঠিখানা খুলে পড়ল। লেখিকা তার স্কুলের সময়কার অন্তরঙ্গ বন্ধু ললিতা। তার ছেলের অন্নপ্রাশন কাল। তাকে আর বিমলকে যেতেই হবে, নইলে ভয়ানক রাগ করবে। আরও নানা কথা।
রাণী হাসল, এই না সেদিন বিয়ে হল! হ্যাঁ, সেদিন বলেই তো মনে হচ্ছে, আর আজই ছেলের অন্নপ্রাশন!
আর লিখেছে, রাগ করবে। কুমারী জীবনে যখন ও ছাড়া আপনার বলতে আর কেউ ছিল না, তখন একথা শুনলে কী ভয়ই না পেত, কিন্তু আজ আর ভয় হয় না, চোখেও জল আসে না, বরং—
এই তো সেদিন বিয়ে হল। আর আজই ললিতা ছেলের চিন্তায় মশগুল। সমস্ত চিঠিতে কেবল তারই কথা। বরং এখন রাণির যেরকম অবস্থা—তার বুক কোথাও যেন ব্যথায় কনকনিয়ে উঠল, কোথাও যেন একটু রাগও সঞ্চিত হয়েছে।
সে থমকে দাঁড়াল, না আমি যাব না। একদিন যখন ভাব ছিল তখনই এসব।
আবদার খাটত, আজ আবার তার পুনরালোচনা কেন?
—রাণি, ওখানে দাঁড়ালে কেন? চিঠি কার? বিমল এসে দাঁড়াল।
–কারোর নয়। সে তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে একখন্ড কাগজে তার কিছুতেই যাওয়া হবে না, এই লিখে ভাঁজ করে ছেলেটিকে দিয়ে এল। সে সাইকেল নিয়ে চলে গেল।
বিমল কিছুই বুঝতে পারেনি, ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, কী হল, ও কার চিঠি?
রাণী চিঠিটা হাতের মুঠো থেকে বিমলের কাছে ছুঁড়ে দিলে।
-আমি পরের চিঠি পড়ি না, তুমি যদি পার বলো।
—স্বামী যে কী মনে করে তার স্ত্রীর কাছে দেওয়া কারোর চিঠি পড়তে পারে , সে তো আমার জানা নেই।
সে তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে গেল। বিমল স্তব্ধ। বিকেলবেলা মনটা হয়তো একটু হালকা হল। রাণি ভাবল, সে কি পাগল হয়েছে? কী করতে কী করে ফেলছে। একসময় এসব কথা মনে হলে যে হাসি পায়।
বিমল তখন যাইরে বেড়াতে বের হচ্ছিল, সে এসে বললে, চিঠিটা লিখেছে আমার বন্ধু ললিতা, সেই যে যার কথা তোমাকে অনেক বলেছি। ওর ছেলের অন্নপ্রাশন।
-ছেলে! বিমল সমস্ত ব্যাপারটা এক মুহূর্তে মনে করে নিল, তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকাল।
—হ্যাঁ, রাণি বললে, তা আমাদের যেতে বলেছে, অনেক অনুরোধ করে চিঠি লিখেছে। কিন্তু কে যায়? আমি যেতে পারব না লিখে দিয়েছি। তুমি কি বল?
বিমল বললে, আমি কী বলব? তবে, একজনের দুঃখ যে তোমার চেয়ে বেশি হবে, এটা বেশ বুঝতে পারি।
—আমার চেয়ে! রাণি অতিকষ্টে বলল।
—হ্যাঁ। আমি কিন্তু যেতেই বলি।
বিমল আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।
পরের দিন ললিতা নিজেই এল। রাণি এতটা ভাবতে পারেনি। বড়োলোক, তাদের কতো আত্মীয়-স্বজন, জীবনের কতত প্রাচুর্য, সেসব চাকচিক্য ফেলে তার মতো নগণ্য একজন বান্ধবীকে নিজে নিয়ে যেতে আসবে, এটা কল্পনা করা যায় না।
ললিতা বললে, তুই তো জানিস, আমার এখানে কেউ নেই।
-কেউ নেই? আমি তো জানতুম অনেকে আছে।
-না, আত্মীয় বলতে কেউ নেই। বাবা তো কবেই এখান থেকে বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু রাণি তুই না লিখে দিলি কেন? হায়রে নিষ্ঠুর, ছোটোবেলার কথা আজ বেমালুম ভুলে গেছিস।
দুজনেই হেসে উঠল।
হাসি থামতে ললিতা বললে, তবে আমি যাই, এখনও অনেক কাজ ভাই, অনেক কাজ। ছেলেটাকে আবার ফেলে এসেছি। কী হল কে জানে! তোরা নিশ্চয় করে যাবি। নইলে দেখবি, আবার এসে উপস্থিত হয়েছি। আমার কি এখন আর মরবার সময় আছে? নানাদিকে নজর রাখতে হয়। যাই ভাই।
ললিতা একটা আলেয়ার মতো মিশে গেল। ইস, কী রূপ। একটা অগ্নিশিখার মতো দেখতে হয়েছে। আগে এত সুন্দরী ছিল না। ললিতা ছিল ছোটো, কিন্তু আজ যেন তাকেই বড়ো দেখা যায়।
যথাসময়ে রাণিরা ওদের বাড়ি গেল।
লোকজন সত্যি তেমন নেই। কিন্তু সেই কয়টিতেই সমস্ত বাড়িটা হাসি কোলাহলে মুখরিত করে রেখেছে। ছেলের জন্যে শোবার ঘরেই একটি দোলনা করে দেওয়া হয়েছে। নরম বিছানায় শোয়ানো। সুন্দর, ফুটফুটে, মার আদলই পেয়েছে বেশি। গলায় মালা, কপালে চন্দন, চোখে কাজল। ছোটো হাত-পাগুলো শূন্যের দিকে ছুঁড়ছে আর মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ করছে। রাণি দোলনাটা একটু দুলিয়ে দিল।
ললিতা বলল, অনেক নাম মজুত হয়েছে। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। তুইও একটা বল, রানু–
-বলে কী হবে, আমার দেওয়া নাম তো আর রাখবিনে!
–পছন্দ হলে রাখব, বল তুই।
–আমি কী নাম রাখব! রাণি হেসে ফেললে, বললে, যা, রাখলুম চয়ন।
-বাঃ, বেশ নাম তো। তোর ভাই পছন্দ আছে। এই নামই রাখব। একটু দাঁড়া, আমি আসিগে, এই নামই রাখা হল।
ললিতার খুশি আর ধরে না। বিকেলবেলা রাণিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সুমুখে বাগানের ধারে গিয়ে বসল।
রাণি বলল, আর কতক্ষণ থাকব বল, সেই কখন এসেছি।
ললিতা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে, আজ বৈ তো নয়। আর তুই যদি এমন কথা বলিস, তবে কে আর বলবে না? রানু, টের পাচ্ছিস, দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করেছে, আর ওই যে ঝাউ গাছ, দেখছিস তো?
রাণি কিছুদূরে একটা ঝাউগাছের দিকে স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, হুঁ দেখছি।
—ওগুলো দেখে কি মনে পড়ে?
–মনে পড়ে অনেককিছু। কিন্তু লতা, সে-সব কথা মনে করে কী লাভ?
—লাভ নেই, কি বলিস? আমার কী ইচ্ছে করছে জানিস? ললিতা রাণির মুখটি দুহাতে চেপে ধরে তার গালে একবার ঠোঁট দুটি স্পর্শ করে খিলখিল করে হেসে উঠল।
রাণি হাসল। কিন্তু ললিতার হাসি যেন তাকে বিধছে। ঝাউগাছের নীচে টুকরো ছায়া বাতাসে কাঁপছে। রাণি কাতরভাবে বললে, আজ আসি ভাই, সেই কখন এসেছি।
—না কিছুতেই যেতে পাবি না।
–আমাকে মাপ কর ভাই।
এ-কথায় যদিও ললিতা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, কিন্তু তবুও তার কাছে রেহাই পাওয়া শক্ত।
রাত নটা অবধি কিছুতেই বাড়ি যেতে পারল না। বিদায় দেওয়ার সময় গেটের কাছে ললিতা এল, আর তার স্বামী এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাণি তার নিজের মুখে একটা বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত জানাতে পারল না।
বাসায় এসে বিমল বলল, চমৎকার লোক। কি বল?
ছোট্ট একটা হুঁ বলে রাণি কাপড় বদলাতে চলে গেল।
বিমলের একটা নতুন উপসর্গ জুটেছে। তাদের অফিসের তার এক ফেলো অফিসার এসেছেন এ-পাড়ায়। বুড়োমানুষ, রিটায়ার্ড হবার সময় হয়ে এসেছে। অত্যন্ত রসিক, আর ভয়ানক গল্প বলতে পারেন, এঁকে ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিমলের তাসের আড্ডা চলে, অনেক রাত অবধি, সময়কে চোখ রাঙিয়ে।
রোজ রাতে নীচের ঘরে আলো জ্বলে নিষ্কম্প। জানালা দিয়ে সে-আলো গিয়ে অনেক দূরে পড়ে। ভেতরে চারটি প্রাণী খেলায় রত। হঠাৎ একদিন রাণি ডাকল, বললো, তোমার খাওয়া-দাওয়া নেই?
-ওঃ, ভুলেই গেছলাম। তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, না?
স্বামীর এই অপ্রতিভ ভাব দেখে রাণির একটু কষ্ট হয়, বলে, না, কষ্ট আর কি? আমার তো বেশ মজা! খালি ঘুমুই, আর জেগে থাকলে বই পড়ি।
কিন্তু ওঁরা কি গেছেন? আলোটা ধরে বিদেয় দিয়ে এসো, নইলে কে জানে কোথায় হোঁচট খেয়ে পড়বেন।
কথায় ইঙ্গিত ধরে বিমল লজ্জা পেল, নম্রভাবে বলল, না পথ তো খারাপ নয়। যে হোঁচট খেয়ে পড়বেন।
-এই রাতে তুমি হেঁটে দেখেছ?
শূন্যের বাতাস ভারী, আকাশ মেঘাবৃত, পৃথিবী প্রাণহীনতায় স্তব্ধ, শেষরাতে কুকুরের ডাক, নিশাচর মানুষের ক্লান্ত পদধ্বনি আর কঠিন শীত—আর পাষাণ শীতল দেহ।
রাণি কেবল বসে থাকে। বিষণ্ণ সন্ধ্যা, রাত্রি আসে চুপিচুপি, যায় নিঃশব্দে, সে তখন চমকে ওঠে।
বসন্তের হাওয়ার পরশ নেই!
রোজই রাত্রে বিমলকে ডেকে পাঠাতে হয়, নইলে তার হুঁশ হয় না, কিন্তু মাঝে-মাঝে ভুল হয়ে যায়। সেদিন হয়তো রাণি ঘুমিয়ে থাকল, আর রাত বারোটা-একটা অবধি তাস খেলে বিমল শোবার ঘরে সেই চেয়ারে বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল। রাণিকে জাগাতে তার ভয় হয়।
আর পান্ডুর আলোয়, তার হাতে যে ধরানো সিগরেটটা থাকে তার সাদা ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরের দিকে ওঠে।
ল্যাম্পের আলোর রঙ যেন ধূসর, শীত যেন সহ্য করা যায় না। সমস্ত খাট জুড়ে ঘুমিয়ে আছে রাণি।
বিমলের বন্ধু অশোক; শিলং-এ থাকে, তার আসার কথা ছিল। সে চিঠি লিখেছিল। একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল।
বিমল খুশি হয়ে বললে, এতদিন পরে যে? সেই কবে লিখেছো তো?
–সময় যে করে উঠতে পারিনে, কিন্তু আগে যদি জানতুম তোমার গৃহে আমার এমন বউদি আছেন তবে কি আর এত দেরি করি!
অশোকের কথাই এরকম, অথচ কেউ কাউকে দেখেনি। রাণির চমক লাগল।
অশোক বললে, আমি মনে করেছিলুম, ইস্কুলের সেই ফার্স্ট বয় বিমল আমাদের জন্যে আর এমন কী বউদি আনবে! ওঃ, এখনও বুঝি নমস্কারটা জানানো হয়নি? ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। নমস্কার বউদি।
নমস্কার। রাণি হেসে বললে।
চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অশোক বললে, বাঃ, বেশ সাজানো গোছানো তো! বউদি, আপনারই হাতের গৌরব।
সে হাসতে লাগল।
অনেকদিন এ ধরনের কথা শোনা হয়নি, সে আজ পাঁচ-ছ-বছর হয়ে গেল, বিমল উৎফুল্ল হয়ে বললে, নাঃ, তুই এখনও সেই চন্ড অশোকই রয়েছিস, কবে মানুষ হবি বলত?
—মানুষ আর হব না, অশোক বললে, আর কেমন করেই বা হই বল? বিয়ে তো আর করিনি–
—যাক, বিমল বললে, একটু বিশ্রাম করো বন্ধু, আমি আসছি।
দুপুরবেলা। বিমল অফিসে।
অশোক কয়েকটা চিঠি লেখা শেষ করে রাণিকে খুঁজতে গেল। রাণি এখনও ভালো করে কথা বলেনি, কিন্তু সে আর এরকমভাবে থাকতে পারে না, তার অভ্যাস নয়।
অশোক দোতালার সিঁড়ির ওপর থেকে, নীচে গিয়ে, আবার উপরে এসে বউদি বলে ডাকল অনেক, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারপর শোবার ঘরের কাছে পর্দার বাইরে থেকে ডাকল, বউদি, ও বউদি! বারে আমি বুঝি একা-একা কাটাব এমনি করে?
রাণির মাথার নীচে একটা হাত রেখে শুয়েছিল, তন্দ্রাও একটু এসেছিল। হঠাৎ জেগে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বললে, ওঃ, আপনি!
-আপনি ঘুমিয়েছিলেন আর আমি এদিকে ডেকে ডেকে হয়রান! অশোক বললে।
রাণি হেসে বললে, আমার তাহলে অন্যায় হয়েছে।
—কিছু নয়। আপনি আসুন। আহা, দাঁড়িয়ে রইলেন যে! তাড়াতাড়ি আসুন, দেখে যান একটা জিনিষ–
অশোকের যেখানে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে সেই ঘরে সে গেল, পেছনে রাণি, একটা কৌতূহল নিয়ে।
অশোক দেয়ালের গায়ে রাণি-বিমলের একসঙ্গে তোলা একখানা ফটোগ্রাফ দেখিয়ে বললে, এটা তো বিয়ের অল্পকাল পরেই তোলা, না?
রাণি অনেকদিন সেদিকে ভালো করে তাকায়নি, আজ দেখে মনে মনে শিউরে উঠল, ফটোটা যেন তাকে ব্যঙ্গ করছে, সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে কোনোরকমে বললে, হুঁ।
–তবে আমাকে এককপি পাঠাননি কেন?
–আমি কি জানতুম যে–রাণি জোর করে একটু হাসল।
অশোক এ প্রসঙ্গে আর অগ্রসর না হয়ে বললে, বারে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন। রাণি হাসলো।
অশোক বললে, গল্প বলুন বউদি, গল্প বলুন।
-কী বলব?
-বাঃ, এই পঞ্চম বৎসরে কোনো কাহিনিই কি রচিত হয়নি? হা ভগবান? অশোক যেন সত্যি বড়ো হতাশ হল।
রাণি জোর করে হেসে বললে, সে কাহিনি কি সকলের কাছেই বলা যায়?
—নিশ্চয়ই নয়। সে কাহিনি শোনবার অধিকার কারোর নেই। আমার ভুল হয়েছে।
অশোক সরলভাবে হাসতে লাগল।
রাণির এখন লজ্জায় লাল হবার কথা, কিন্তু হল নীল। কিছু বলতে পারল না।
চুপ করে বসে থাকা অশোকের স্বভাব নয়, বললে, না, এরকমভাবে তো চলতে পারে না। বউদি, তাস আছে?
-আছে, কেন?
–দুহাত ব্রিজ খেলব, নিয়ে আসুন তো। রাণি হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার দেখল, মশারির ওপরে বিছানার তলায়, দেয়ালের সবখানে খুঁজে দেখল, কিন্তু পেল না। কি মজা, এর আগে সে নিজে আরও কয়েক জোড়া তাস ছিড়ে ফেলেছে রাগে, আজ তাকেই আবার নিজের প্রয়োজনে খুঁজতে হল।
সব জায়গাই দেখা হয়েছে, এবার আলমারির ওপরটা বাকি। কোমরে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে, একটা চেয়ার আলমারির কাছে এনে, সে তার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, হ্যাঁ, সত্যিই আছে একজোড়া নতুন তাস।
এত দেরী দেখে এমন সময়ে অশোক এসে ঘরে ঢুকল, তাকে এমন অবস্থায় দেখে হেসে উঠল, বললে, উদ্যোগ-পর্ব এখনও শেষ হয়নি নাকি?
আস্তে আস্তে নামতে নামতে রাণি হেসে বললে, হয়নি। এখন ভেবে দেখুন, এর পরের পর্বটা কীরকম হতে পারে!
রাণি আলমারির কাছে চেয়ারটা সরাতে যেতেই অশোক বললে, আপনি যান, শাফল করুন গে, আমি সব ঠিক করছি।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে বিমল রাণিকে অত্যন্ত খুশি দেখতে পেল। এই দেখে তার পাঁচ বছর আগেকার কথা মনে পড়ে গেল। সেই আলোকিত দিনগুলোর কথা আজ এখন একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তখনকার দিন আর রাত্রিগুলো যেন হাতের মুঠোর মধ্যে আনন্দে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে থাকত, আর বলরুমের পিছল মেঝেতে পা চালানোর মতো নিঃশব্দে গড়িয়ে যেত। কিন্তু আজ?
বিমল বললে, আজ কোনো সুখবর আছে নাকি! খুশি দেখছি যে বড়ো?
—আছে, রাণি হেসে বললে, অশোকবাবু আজ সর্দারী করে নিজের হাতে চা বানাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন।
—এটা কি সুখবর হল?
—তা নয় তো কি? অত সর্দারী কেন? আমি কত বললাম—
–কই সে?
বিমল অশোকের ঘরে গিয়ে দেখল, সে একটা বই পড়ছে।
বললে, কীরে চন্ড, কোথায় দাহন হল?
-খুব বেশি নয়। অনামিকার এই অগ্রভাগ।
অশোক শান্ত ছেলে হয়ে শুদ্ধ বাংলার অবতারণা করে আঙ্গুলটিই দেখাল, বললে, আমার একটুও দোষ নেই। বউদির মতো এমন দুষ্টু আর দেখিনি
দুজনের মাঝে এইসব কথার পেছনে হাস্যমুখর দৃশ্যাভিনয়ের মতো কতকটা কল্পনা করে বিমলের চোখ দুটো করুণ হয়ে উঠল।
রাণি কাছেই ছিল, বললে, আবার বউদির নামে কী লাগানো হচ্ছে? দুদিনের চেনা দুদিন পরেই আবার চলে যাবেন, কেন অনর্থক একজন নিরীহ মানুষকে দোষ দেওয়া বাপু!
-ওঃ, সত্যি কথা বললেই বুঝি ভালো লাগে না?
অশোক মুচকি হাসল। বিমল চলে এল।
আবার সন্ধ্যার ছায়া। রাত্রি। জানালায় উজ্জ্বল আলো উঁকি মারে, পথের পাশে শ্রান্ত আলো; রাতের কুয়াশা, রুদ্ধ গৃহে গৃহে চুড়ির শব্দ, আর চাপা কথা, নিঃশ্বাস। আর বিমলের নীচের ঘরের চারটি প্রাণীর চোখে ঘুম নেই।
বিমলের এখন অফিসে যাওয়ার সময়। রাণি আজ তাকে বাইরের দরজা অবধি এগিয়ে দিলে। কিন্তু এ দেখে আর কারোর না হোক বিমলকে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হতে হবে। কিন্তু সে কিছু বললে না।
কিন্তু দুপুরের ঢিমে-তেতালা সময়ে যতই চেষ্টা করুক নিজেকে দরজা বন্ধ করে রাখতে; মনকে কোথায় যেন আকর্ষণ করছিল, যা কিছুতেই থামানো যায় না। পা এগিয়ে চলল। গন্তব্য স্থানেও পৌঁছল। অশোক বিস্ময়ে বললে, আপনি!
রাণির মাথাটি কতকটা নীচু হয়ে আসছে।
—কিন্তু দেখুন বউদি দোহাই আপনার, অমন আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ করে থাকবেন না, আমার ভয় করে, ভালো লাগে না।
রাণি অনেক কষ্টে মাথা তুলে একটু হাসল।
–বাঃ, আপনাকে আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে! অশোক বলেই ফেলল।
অতি আপনার জন ছাড়া আর এক পুরুষের সম্মুখে রূপ বর্ণনায় বোধহয় কেউ সপ্রতিভ থাকতে পারে না, রাণিও পারল না, অধোবদন হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইল।
একটু দুঃখ পেয়ে অশোক বললে, দেখুন বউদি, যদি আমার কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, ক্ষমা করবেন। বাপ মা বোন ভাই কেউ নেই, স্নেহের স্পর্শ কোনোকালে একদিন পেলেও আজ আর চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনে। তাই ভুলচুক হওয়া স্বাভাবিক।
রাণির এতক্ষণে চমক ভাঙলো, ব্যস্ত হয়ে বললে, ওকি! কেন আপনি ওসব কথা বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। আমি তো কিছুই মনে করিনি।
–করেননি, তাহলে বসুন। অশোক এবার হাসল।
বসলে পরে বললে, আচ্ছা, এত একা আপনার কেমন করে সময় কাটে? সারাটি দুপুর–
—সে চিন্তা করে কী লাভ, কিছুই যখন হবার নয়। তবে বর্তমানে তো আর কোনো আপশোসের দরকার নেই।
-আজ নয় আমি আছি, অন্য দিন?
—সেদিন আছে ঘুম, নইলে বই!
—এসব তো আর চিরকাল ভালো লাগতে পারে না, একদিন নিশ্চয়ই বিরক্তি ধরে যাবে।
—অশোকবাবু, সেদিন আমি আত্মহত্যা করব। হয়েছে তো?
আর না পেরে এই বলে কান্না চেপে রাণি দৌড়ে পালাল।
অশোক শুধু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, যে পথে রাণির পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল সেইদিকে চেয়ে রইল।
এরপরে, দুদিন আর দেখা হয়নি, কথাবার্তাও হয়নি, যদিও দেখা করবার অবসর দুজনেরই প্রচুর। সেদিনের কথা মনে করে রাণি যেন কিছুতেই আর নিজেকে অশোকের সামনে বার করতে পারছিল না। অবস্থা আবার আগের মতোই হয়েছে।
একবার সিঁড়ির পাশে দেখা হলে পর অশোক নিজেই জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কোনো অসুখ করেছে বউদি?
-না তো।
–তবে দেখিনে কেন? অশোকের চোখের ওপর ম্লান ছায়া।
—আমিও তো আপনাকে দেখিনে।
অশোক কোনো দ্বিধা না করে বললে, কেন এমন হল বলতে পারেন?
–জানি না।
—আমি কিন্তু জানি।
–তবে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
—আপনাকে ছাড়া আর কাকে করব? রাণি যেন সবে সহজ হয়ে দাঁড়ল। সেদিন দুপুরেই দেরাজ থেকে নতুন। একখানা টকটকে লাল সিল্কের শাড়ি পরে রাণি খুব ভালো করে প্রসাধন সেরে অশোকের ঘরে গেল।
লাল শাড়ি! যেন আগুনের মাঝে সীতা দেবী।
অত্যন্ত আনন্দে অশোক কেবল বললে, বউদি!
রাণি তার কাছে এসে একটু হেসে বললে, আপনার দেওয়া কাপড়, অশোকবাবু।
–নাকি? আমি তো ভুলেই গেছি। তাহলে আপনাকে কখনো না দেখেও একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলাম সত্যি, নইলে আর এত ভালো মানিয়েছে কী করে?
রাণির মুখে মধুর লজ্জার রঙ ফুটে উঠল।
অশোক বললে, এটা এতদিন পরেননি কেন?
রাণীর মুখে উত্তর নেই, তার নিঃশ্বাস চেপে আসছে। শাড়ির পাতলা আঁচল বাতাসে উড়ছে।
আবার সেই রাত হল। বিমলের তাস খেলা তখনও পুরোদমে চলে। ভয়ানক শীত, চারদিকে সাদা কুয়াশা, নিস্তব্ধ শহর। সমস্ত শরীরে গরম কাপড় জড়িয়ে পথে কদাচিৎ মানুষের যাতায়াত, তাদের চকিত পদধ্বনি, আর রাত্রির নিঃশব্দ গতি।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রাণি অগ্রসর হল।
অশোক এখনও ঘুমোয়নি। ভেজানো দরজা, একটু ফাঁকা রাণি চেয়ে দেখল, আলোর সামনে বসে অশোক কী ভাবছে।
তার পা দুটি অবশ, বুকে অসহ্য দাপাদাপি। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। তার চারদিকে কেবল অন্ধকার।
কিছু আগেই শোবার ঘর, কিন্তু এতটুকু পথ হাঁটতেই সে যেন ক্লান্ত, দাঁড়াতে পারছে না। রাণির চোখ ফেটে জল এল।
তারপর, হঠাৎ একটু অন্যমনস্কতায় ওদিকে সরতে গিয়ে একটা কী যেন লাগলো পায়ে, হল প্রবল শব্দ। অশোক বললে, কে? আর রাণি ভয়ানক ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে একেবারে দরজায় খিল দিল। বুক দারুণ কাঁপছে, যেন কিছু চুরি করেছে আর কি!
রাত যখন একটা তখন বিমলের তাসের আসর ভেঙেছে। বন্ধুরা চলে গেলেন, নীচের ঘরের আলোও নিভল।
বিমল আস্তে ঘরে ঢুকে আগের মতো সেই চেয়ারে বসল।
টেবিলের উপর আলোটা আজ ভয়ানকভাবে জ্বলছে, সে আবার উঠে বাতিটা একটু কমিয়ে দিলে, তারপর স্থির হয়ে বসল।
আর একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামে টানতে লাগল।
আজও জানালা খোলা, ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বিমল আর কী করে, উঠে জানালা বন্ধ করে আবার বসল। সিগারেটের অনেকখানি পুড়ে গেছে, ছাই কমেছে, আস্তে একটু ঝেড়ে ছাইগুলো ফেলে সে আবার খেতে লাগল।
দেয়ালে ঘড়ির টিক টিক শব্দ।
ঘরটি অন্যদিন বেশ পরিষ্কার থাকে, আজ একটু অগোছালো, আলনার কাপড়–জামায় শৃঙ্খলা নেই, মেঝেতে কাগজের টুকরো। টেবিলের ওপর দু-তিনটি বই ছড়ানো, খাটের নীচে রাণির দুটি স্লিপারের একটি ওই কোণে।
বিমলের সিগারেট শেষ। সেটা মেঝেতে পিযে আগুন নিভিয়ে সে বাইরে ফেলে দিলে। কী ভেবে একবার আলোটা বাড়িয়ে খাটের কাছে এল। রাণি ঘুমিয়ে রয়েছে। মুখে দেহে যেন অনেকদিন পরে সাজগোজের ছাপ। চুলগুলো ভালো করে বাঁধা, ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলকালার, মুখটা চকচক করছে, কানে নতুন পরা একজোড়া দুল, গলায়ও নতুন হার, হাতে অনেকগুলো চুড়ি।
বিমল আবার চেয়ারে গিয়ে বসল।
রাণির নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায়।
ঘড়িতে টিক টিক শব্দ।
হঠাৎ কান্নার শব্দে বিমল চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, রাণি ঘুমের ঘোরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সে তাড়াতাড়ি তার কাছে গেল,-রাণি, রাণি, ওকি? ওঠো। কাঁদছো কেন? ওঠো।
কয়েক ডাকেই সে উঠল। ঘুমজড়িত চোখে বলল, কী হয়েছে?
তুমি কাঁদছো?
রাণির হয়তো কিছু মনে হল, তাই যেন খুব ভীত হয়ে আবার বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল।
বিমল আর একটি কথাও বললে না, নিঃশব্দে নিজের জায়গায় ফিরে এল। ঘরের কোণে, আর নানা জিনিষপত্রের পেছনে ছোটো ছোটো অন্ধকার, টেবিলের উপর সবখানে পৌঁছোতে পারেনি। পেরেছে দেয়াল আর মেঝেতে, খাটে শায়িত রাণির গায়ে…।
বিমল এই আলোর সঙ্গে সমদৃষ্টিতে চেয়ে সবই দেখেছে, কিছুই তার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে কী যেন হয়, তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে, দেহ অবশ হয়ে আসে।
কপালের কুঞ্চন হয়তো বা কিছুক্ষণের জন্যে সরল হয়ে যায়। আলোর কাছে তারই নিকটতম অবস্থিতি; তাই মুখের কোনোখানে এতটুকু ছায়াপাত হয়নি, সব পরিষ্কার দেখা যায়। অথচ কিছুই বলতে পারে না।
রাত বেড়ে চলেছে।
পরদিন অফিসে যাবার ইচ্ছে বা সামর্থ্য কিছুই ছিল না। তবু বিমল গেল এই ভেবে যে বাসায় থাকলে সামর্থ্যহীনতা আরও বাড়বে। কারোর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সামান্য কাজ করেই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
রাণির ঘরের দরজা বন্ধ। বিমল সেখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে, অশোকের ঘরে এসে দেখল, সেখানে কেউ নেই। নীচে নেমে চাকরকে জিজ্ঞেস করলো, সে বললো, অশোকবাবু চলে গেছে, এই একটু আগে।
-মালপত্র নিয়ে?
–হ্যাঁ বাবু।
—কিন্তু আমাকে জানায়নি তো।
বিমল ব্যাকুল হয়ে ওপরে এল, রাণির বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়াল।
এই কি বন্ধুত্ব? যাবার সময় আমাকে একবার জানানোও দরকার বোধ করলে না?
জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে বিমল ডাকলো, রাণি, দরজা খোল।
দরজা খুলল। রাণির মুখ নীচু।
বিমল তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, অশোক কি চলে গেছে? কেন গেল? তুমিই বা ওকে বিদেয় দিলে কেন? কেন দিলে?
হঠাৎ রেগে গেল রাণি, বললে, কী বলছো তুমি? ইচ্ছে হয় মেরে ফেলল, তবু ওসব কথা বোলো না।
-বলব না? আমাকে সে না বলে কয়ে চলে গেল কেন? আমি একটা মানুষ নই? বিমল একটু নরম হয়ে বললে, কিন্তু তুমি অত রাগলে কেন? কাল সারারাত জেগে রয়েছি, মেজাজের কি ঠিক আছে? কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনে।
বিমল চলে এল নীচের ঘরে। চুপ করে বসে রইল।
এমনি কতক্ষণ কাটবার পর হঠাৎ বাইরে জুতোর আওয়াজ পেয়ে চমকে সে মুখ তুলে দেখল, অশোক আবার আসছে।
সে ভয়ানক খুশি হয়ে বললে, আমার ওপর রাগ কেন বলো তো বন্ধু? আমাকে বলা নেই, কওয়া নেই—সে যাক—কী হল, গাড়ি ফেল করলে?
-হ্যাঁ।
–বেশ হয়েছে। ওপরে চল।
সমস্ত বাড়িটির মধ্যে একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন কেউ মরেছে।
সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই, আকাশের পশ্চিমদিক লাল, কতকগুলি চিল এখনও উড়ছে আকাশে।
বিমল অনেকক্ষণ বেরিয়েছে, এখনও ফিরে আসেনি।
রাণি তার ঘরে বসে এমনি একটা বই-এর পাতা ওলটাচ্ছিলো। কিছুতেই মন বসে না, আর ক্ষণেক পরেই চোখ ছলছলিয়ে আসে।
হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বেরিয়ে পড়ল বই থেকে। রাণি খুলে দেখলো, তাতে লেখা : তোমার জীবনের পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালাম। অনেকদিন ধরেই একথাটা ভাবছি, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারিনি। আজ সুযোগ হল তাই করলাম। যেহেতু আমি জানি, সন্তান না হবার জন্য দায়ী আমি, আমারই দোষ, আমিই অনুপযুক্ত। নিজের জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই, কিন্তু দুঃখ হয় তোমার জন্যে। স্বামী হতে না পারলেও ভালোবেসেছিলাম সত্যি।
—তোমার আর অশোকের দীর্ঘ মাধুর্যময় জীবন কামনা করি। এ চিঠিখানা রেখে দিও, তোমার দরকার হতে পারে।
অকস্মাৎ একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতে দারুণ চমকে উঠল রাণি। তারপর সে দু হাতে নিজের মুখ ঢাকল।
মরূদ্যান
হাজরাদের বাড়ি বীণা বেড়াইতে গিয়াছে। পাড়ার অন্য দুই একটা বাসা খুঁজিয়া সেখানে রণু গিয়া তাহাকে পাইল। বীণা আরও কয়েকজন মেয়ে ও বধূর সঙ্গে বসিয়া গল্প করিতেছিল।
রণু ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়া ডাক দিল, বীণা দি, শুনে যান তো।
বীণা বলিল, ওখান থেকেই বলো।
হাজরাদের বন্ধু কনক হাসিয়া বলিল, ও, রণজিতের বীণাদি বুঝি এসেছে এখানে? নইলে কোনোদিন যে ভুলেও এ বাড়িতে পা দেয় না, সে আজ এল! বীণাদির সাথে কী কথা আছে আমরা শুনতে পারব রণু?
একটা মৃদু হাস্যতরঙ্গ খেলিয়া গেল।
রণু লজ্জায় মাথাটা ঈষৎ কাৎ করিয়া বলিল আপনি কি যে বলেন বউদি। হ্যাঁ বীণাদি, শিগগির, গোটাকতক কথা রণুর সকলের সঙ্গেই থাকে।
কনক বলল, তুমি তো এবার আই-এ দিচ্ছ, টেষ্ট কবে? এসে পড়েছে নিশ্চয়ই–
রণু মাথা নাড়িল।
-তাই তো শেষ রাতে অত পড়ার শব্দ শুনতে পাই। আহা, অত পড়লে শরীর যে খারাপ হয়ে যাবে। তোমার বীণাদি তোমাকে মানা করে না এজন্যে?
বীণা আর রণুর দিকে সকলে চাহিয়া আবার হাসিল। রণুর অবস্থা দেখিয়া বীণা তাড়াতাড়ি খাট হইতে নামিয়া আসিল। সিঁড়ি বাহিয়া নামিতে নামিতে সে জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে?
রণু বলিল, ওই যে কারা দেখতে আসবে বলেছিল ওরাই তো এসে বসে রয়েছে। বড়দা তো রাগে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন। সে ভীত দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল।
বীণা হঠাৎ একটু উষ্ণ হইয়া বলিল, রাগ করেছে বড়ো বয়ে গেছে আমার। বলতে পারো, রোজ রোজ আমাকে এরকম সং সাজাবার মানেটা কী? রণু যেন নিজেকেই অপরাধী মনে করিল।
বাসায় আসিয়া বীণা সরাসরি তাহার মা কাদম্বিনীর ঘরে চলিয়া গেল। কাদম্বিনী বলিলেন, কোথায় গিয়েছিলি বলতো? তোকে তো আগে বলা-ই হয়েছিল, আজ ওরা দেখতে আসবে। নে, আর দেরি নয়, কাপড় বদলিয়ে আয়। ওরা আবার বসে রয়েছে।
বীণা জানালার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। কাদম্বিনী আবার কী বলিতে যাইবেন এমন সময় বড়দা আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। বীণাকে তেমনভাবে দেখিয়া রাগিয়া বলিলেন, এই যে, কোত্থেকে বেড়িয়ে আসা হল, শুনি? গুণবতী বোন আমার, সারাদিন কেবল মানুষের বাসায় ঘুরে বেড়ানো। আমি ভাবি যাদের বাসায় ও যায়, তারা কী মনে করে।
বীণা তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।
বড়দা বলিলেন, যান এখন রুজ পাউডার কতগুলো ধ্বংস করে আসুন গে। আর এই যে—তিনি রণুকে সম্মুখে দেখিয়া আরও ক্ষেপিয়া গেলেন,—আর একজনকে পাঠিয়েছিডেকে আনতে, তারও কোনো খোঁজখবর নেই। বুঝলে মা, এমন মেয়ে-ঘেঁষা ছেলে আমি আর কখনো দেখিনি।
মাথা নত করিয়া রণু দাঁড়াইয়া রহিল। সে এ-বাড়ির ছেলে নয়, জ্ঞাতি সম্বন্ধে একটু আত্মীয়তা আছে। খুব গরিব, এখানে থাকিয়া পড়ে।
এ বাড়ির সকলেই বড়দাকে বাঘের মতো ভয় করে। তিনি যাহা একবার মুখ দিয়া বলেন তাহা করিয়া তবে ছাড়েন। তাহাতে যদি সংসারে কোনো ওলটপালট হইয়াও যায় কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।
বড়দা কাদম্বিনীকে বলিলেন, দ্যাখো মা, লেখাপড়া জানলে অন্য সব গুণও আপনি হয়ে যায়। এ এমনই জিনিস। ওই তো, সেবার শিলং-এ গিয়ে ওঁরই সম্পর্কে এক মাসতুতো বোনকে দেখলাম। কী সুন্দর, আর কত গুণ! নিজেদের কথা মনে হলে রীতিমতো লজ্জা করে।
বীণা এবার রাগিয়া গেল। কোনোদিন সে বড়দার মুখের উপর কথা বলে না। কিন্তু আজ বলিল, আচ্ছা আমি কি নিজে থেকেই পড়লাম না, না তোমরাই আমাকে পড়ালে না—কোনটা সত্যি? আমি বলে রাখছি আমাকে এরকম করে জ্বালালে আমি কিছুতেই এ বাড়িতে থাকব না। আজ বাবা থাকলে নিশ্চয়ই এরকম কথা তোমরা আমায় বলতে পারতে না। রূপ কি সকলের থাকে? তাই বলে— বীণা আর বলিতে পারিল না—কান্না চাপিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।
ছেলের উপর কথা বলিবার শক্তি কাদম্বিনীর ছিল না। তিনি হতভম্বের মতো বসিয়া রহিলেন। বড়দার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল রণুর উপরে। তিনি একরকম চেঁচাইয়া বলিলেন, এখানে হাঁ করে কী দেখছ? যে ভদ্রলোকগুলি আমাদের মতো লোকের বাড়িতে কৃতার্থ হয়ে এসেছেন তাদের বিদায় করগে যাও। যত সব— আমার এখানে কারোর জায়গা হবে না বলে দিলাম। আরে বাপু, গরিবের ছেলে লেখাপড়া ছাড়া অন্যদিকে মন গেলে যে বাপের রক্তজল করা পয়সার মর্যাদা থাকবে না।
সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। এইরকম ঝড়ঝঞা এ সংসারে প্রায়ই আসে, নতুন কিছু নয়।
রাত্রে বড়দা ঘুমাইলে পর কিছুটা শান্ত হইল। মোটা, ঘুমকাতুরে মানুষ, অল্প রাত্রেই গভীরভাবে ঘুমাইয়া পড়েন।
সেদিনের জন্য পড়া রাখিয়া রণু উপরে বড়দার নাক ডাকার বিকট শব্দ শুনিয়া নির্ভয়ে বীণাকে খুঁজিতে গেল। তাহার শুইবার ঘরে তাহাকে পাওয়া গেল না। রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া দেখিল, সেখানেও বীণাদি নাই। সে চুপি চুপি সিঁড়ি বাহিয়া ছাদের উপর গেল।
চিলেকোঠার পূর্বদিকে আলিসায় ভয় দিয়া বীণা দাঁড়াইয়াছিল। জ্যোৎস্নাময় রাত্রি, চাঁদের আলো তাহার কাপড়ে পড়িয়া ফুটফুট করিতেছিল। পাশেই ছাদ আর আলিসায় তাহারই ছায়া দীর্ঘতর হইয়া লাগালাগি দাঁড়াইয়া আছে।
রণু আস্তে ডাক দিল, বীণাদি!
বীণা প্রথমে চমকিয়া উঠিল, মুখ ফিরাইয়া তাহার দিকে চাহিয়া আবার আগের মতো দাঁড়াইয়া বলিল, কেন?
কাছে আসিয়া রণু কহিল, খেয়েছেন? বীণা চুপ করিয়া রহিল।
চলুন তাহলে, বড়দা ঘুমিয়েছে, আমিও খাইনি। জ্যাঠাইমা তো আপনাকে খুঁজছে।
বীণা এবার একটু হাসিল, বলিল, তুমি যাও রণু। পড়া হয়েছে? পরীক্ষা কবে না বলেছিলে?
খুশি হইয়া রণু বলিল, এই কালকে এক সোমবার, তার পরের সোমবার আমাদের পরীক্ষা আরম্ভ হবে। আমার কিছু পড়া তৈরি হয় নি, কী যে করব ভেবে পাইনে। তার ওপর প্রিন্সিপাল নাকি এবার বলেছেন, খুব কষে ছাত্র পাস করাবেন।
কারণ, গতবার অনেকে ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফেল করেছিল। বড়ো ভয় করছে তাই–
রণু মুখের এমন ভঙ্গি করিল, যেন এখনই সে ফেল করিয়াছে!
করুণ চোখে রণু বলিল, কী হবে? আর পড়া হবে না, বাবা কষ্ট পাবেন, আর বড়দার মনেও আঘাত লাগবে, তাঁর বাড়িতে থেকে পড়লুম, পাস করতে পারলুম না। তখন কী যে হবে আমার ভাবতে ভয় করে। বীণা হাসিয়া বলিল, ওরে বাবা, এতেই ভয় পেয়ে গেলে? সত্যিই কি তাই হয়ে গেল নাকি? তুমি কখনো ফেল করবে না; আমি বলছি। তা যাক। আচ্ছা রণু, তুমি পাস করে তারপর কী করবে, চাকরি? তা জানি না। তবে পাটনায় আমার এক কাকা থাকেন, ভালো অবস্থা, তার ওখানে যাব।
বীণা একটু অন্যমনস্কভাবে আকাশের জ্যোৎস্নাবর্ষী খন্ড চাঁদের দিকে চাহিল, তারপর রণুর পানে স্থিরভাবে তাকাইয়া বলিল, আমার টাকা থাকলে তোমাকে আমি পড়াতাম।
রণু চুপ করিয়া রহিল, কিছুক্ষণ পরে কহিল, আমার ভাই-বোন কেউ নেই বীণাদি। কাজেই তাদের স্নেহ থেকে আমি বঞ্চিত। কিন্তু আপনাকে আমার বড়ো মনে পড়বে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন—
হাসিয়া বীণা বলিল, কি বললে শুনি!
হঠাৎ ভয়ানক লজ্জা পাইয়া কী বলব আবার—আমি কিছুই বলিনি তো, বলিয়া তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেল।
রণুর পাশের ঘরেই বীণা তাহার ছোটো বোন লীলা আর বড়দার ছোটো মেয়ে গীতার সঙ্গে শশায়। খুব সকালে ওঠা তাহার চিরকালের অভ্যাস।
তা ছাড়া শীতকালের রাত্রি দীর্ঘ বলিয়া অনেক আগেই ঘুম ভাঙিয়া যায়। একবার ঘুম ভাঙিয়া গেলে আর সহজে সে ঘুমাইতে পারে না। তাই কখনও লীলা বা গীতাকে জাগাইয়া গল্প করে, নয়তো পাশের ঘরে তাহার মামাকে ডাকিয়া পদ্মানদীর কাহিনি শোনে।
রণুর পরীক্ষার আগের দিন শেষ রাত্রেও বীণা জাগিয়া শুনিতে পাইল, দেয়ালের বড়ো ঘড়িতে চারটা বাজিয়াছে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়িয়া রণু টেবিলের ছোটো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়া রাখিয়াছিল সাড়ে তিনটায়, কিন্তু তখনও সে ওঠে নাই, বোধহয় গভীর ঘুমে অ্যালার্মের শব্দ শুনিতে পায় নাই।
বীণা আস্তে আস্তে তাহার ঘরে গেল। টেবিলের উপর বাতিটার আলো বাড়াইয়া রণুর বিছানার কাছে গিয়া ডাক দিল, রণু, অ রণু–
কয়েক ডাকের পর সে চোখ বুজিয়াই সাড়া দিল, কেন?
–চারটে যে বেজে গেছে, পড়বে বলেছিলে না?
—হুঁ! কিন্তু উঠিবার কোনো লক্ষণই তাহার দেখা গেল না। বেশি রাত্রে ঘুমাইয়া চোখ হইতে ঘুম ছুটিতে চায় না সহজে।
–আমি তো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি।
—হুঁ, দেখবে চলো, গম্ভীরভাবে বীণা রণুকে উঠাইয়া ঘড়ির সামনে আলো ধরিয়া দেখাইল। আশ্চর্য হইয়া রণু তাহার দিকে চাহিল।
বীণা বলিল, আশ্চর্য হবার কছু নেই। ওটা বেজে গেছে, কিন্তু আমাদের ঘুমকাতুরে রণুর কানে সেটা যায়নি। ভাগ্যিস আমি উঠে ডাক দিয়েছিলাম, নইলে যে কী হত!
চেয়ারে বসিয়া রণু বলিল, খুব খারাপ হত। বলিল, জুলিয়াস সীজারের কতখানি এখনও না-পড়া রয়ে গেছে। সেগুলি সারতে হবে। আবার সমস্ত পড়া রিভাইস করতে হবে, সময়ের দরকার অনেক। আমি কখন ঘুম থেকে উঠতাম কে জানে; শুতে যে রাত হয়ে গিয়েছিল!
—আমি যাই, তুমি পড়ো। বীণা চলিয়া গেল। পড়িতে পড়িতে রণুর ভোর। হইল, তারপর বেলা আটটাও বাজিয়া গেল।
বড়দা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, একটা কাজ করবে? এই যে চিঠিটা, নরেন মজুমদারের বাসা চেনো তো, সেই যে ফর্সা লম্বা লোকটা, আমার এখানে প্রায়ই আসে, ওঁকে এই চিঠিটা দেবে। তিনি তখনই এর উত্তর দিয়ে দেবেন। তুমি সঙ্গে করে তা নিয়ে আসবে। খুব জরুরি কিন্তু, বুঝলে! আর তাঁর বাসাটা কোথায়; দাঁড়াও, দাঁড়াও বলে দি তোমাকে, ইয়ে—
রণু করুণভাবে বড়দার দিকে চাহিল, এখন সে যায় কেমন করিয়া! সামনে দাঁড়াইয়া বীণা সব দেখিতেছিল। সে বলিল,-ওর কি না গেলে চলে বড়দা? পড়ার ক্ষতি হবে যে! কেন, ছোড়দা যাক না। ডেকে দেব?
ছোড়দা কিছু করে না, বসিয়া থাকে। ভোরবেলা এক কাপ চা খাইয়া সে কোথায় বাহির হইয়া গিয়াছে।
বড়দা কহিলেন, অজিত তো নেই বাসায়। কেন, ওই যাক না, এখন আর পড়ে কী হবে?
বীণা কহিল, না ওর যেয়ে কাজ নেই। অন্য কেউ যাক। বড়দা মনে মনে রাগিতেছিলেন। এই বোনটিকে আসলে তিনি কিছু ভয় করিতেন। কিন্তু বাহিরে সহজে প্রকাশ করিতেন না। ইহা তাঁহার স্বভাব নয়। নিজের কতৃত্বের অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না।
তবে এ ব্যাপারে এবার তিনি আর বেশি কিছু বলিলেন না। গম্ভীরভাবে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেলেন।
বীণা বলিল, তুমি কি রণু ! মুখ ফুটে কিছু বলতে পারো না? পরের বাড়িতে থাকো বলে কি সব কাজই করতে হবে নাকি? বড়দাকে দোষ দেওয়া যায় না। ওঁর ওটা স্বভাব। কিন্তু তাই বলে তোমার নিজস্ব কিছু নেই নাকি? ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, এখন আটটা বেজে পনেরো মিনিট হয়েছে। ঠিক সাড়ে নয়টার সময় স্নান করতে যেয়ো, বুঝলে? আমি মাকে গিয়ে বলছি।
বীণা চলিয়া গেল।
রণুর টেস্ট শেষ হইয়া গেল। নতুন উদ্যমে আবার সে ফাইন্যালের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল। পড়া আর পড়া—রণুর যেন ইহা ছাড়া আর কিছুই করিবার নাই।
একদিন ঘরে ঢুকিয়া বীণা বলিল, মা, রণুর জ্বর হয়েছে। আশ্চর্য হইয়া কাদম্বিনী কহিলেন, জ্বর হয়েছে? এই পরীক্ষার সময় আবার জ্বর হল? ও কী করছে এখন?
–দিলীপের সাথে ব্যাগাঠেলী খেলছে।
–ওকে শুয়ে থাকতে বলগে, আমি আসছি।
পরের দিন রণুর জ্বর কমিল না। না কমিলেও তত কাতর হইল না। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্প করিয়া খেলিয়া সেদিন তাহার কাটিল। কিন্তু তৃতীয় দিন বৈকালে জ্বর অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। রণু মাথার বেদনায় কথা বলিতে না পারিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল।
বীণা আগে ইহা লক্ষ করে নাই। সন্ধ্যাবেলা তাহার কপালে হাত দিয়া দেখে যে, শরীরের উত্তাপ ভয়ানক বাড়িয়াছে। চোখ দুটি ঈষৎ লাল আর ফুলিয়া গিয়াছে। সে ভীতস্বরে ডাকিল, রণু?
—কী?
—মাথাটা ধুইয়ে দিই, কেমন?
রণু বীণার দিকে পাশ ফিরিয়া বলিল, বীণাদি, একটা কথা বলি। আমাকে হাসপাতালে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। বাসায় এত লোকজন, একজনকে দেখতে হলে আর একজনের পাশে তাকানো চলে না। কেন মিছিমিছি আপনারা কষ্ট করবেন? এখনও আমি উঠে যেতে পারি, পরে হয়তো পারব না। আপনি ব্যবস্থা করুন।
বীণা তাহার কপালে, চোখের পাতায়, মুখে হাত বুলাইয়া বলিল, কি বাজে বকছো রণু! আমি জল নিয়ে আসি, দাঁড়াও।
ডাক্তার আনানো হইল, তিনি ওষুধের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। অনেক রাত্রি অবধি তাহাকে বাতাস করিয়া বীণা গিয়া শুইল। পরের দিন একরকম রহিল। রণু ঠিকই বলিয়াছিল। এত লোকদের মধ্যে শুধু অসুবিধা সৃষ্টি করা।
কাদম্বিনী বীণাকে একান্তে কহিলেন, ওর বাবাকে খবর দেব? কী বলিস?
বীণা বলিল, না, না, দরকার নেই। অসুখ এমন বেশি কী হয়েছে যে কাকাকে খবর না দিলে চলবে না! আজ যদি আমাদের কারোর এরকম হত তবে কী করতে?
-না, তা বলছি না। এই পরীক্ষার সময়, যদি খারাপ কিছু হয়ে দাঁড়ায় দোষের ভাগী হব আমরা। খারাপ কিছুই হইল না। পরের দিনই জ্বর কমিয়া গেল। রণু হাসিয়া কথা কহিল। কাদম্বিনী যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। অসুখ সারিবার পরে একদিন রাত্রে বিছানায় শুইয়া হঠাৎ রণুর কী যেন মনে পড়িয়া গেল। সারা অসুখের সময় কাহার যেন স্নেহের পরশ, তাহার দুঃখ-কষ্টের জন্য সচেতন অভিব্যক্তি, কোনোদিন অনুভব করিয়াছিল, দেখিয়াছিল, নদীর পাশে শুষ্ক বালুচরে সপ্তমীর চাঁদের অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার মতো কায়া লইয়া সে দাঁড়াইয়া। রণু হঠাৎ বসিয়া কি জানি কাহার উদ্দেশ্যে জোড় করিয়া নমস্কার করিল। সে লক্ষ করে নাই। ঘরে আছেন সেই মামা, দেখিয়া ফেলিলেন সব। রণু লজ্জা পাইল। মামা হাসিয়া বলিলেন—পরীক্ষা কাছে এলেই বুঝি অদৃশ্য দেবতার উপর দৃষ্টি পড়ে। কী বল রণু?
এ প্রসঙ্গ চাপা দিবার জন্য রণু বলিল, আপনাদের কয়টি বাড়ি পদ্মা নিয়েছে মামা? কেউ মরেনি তাতে? মুচকি হাসিয়া তিনি বলিলেন, কেউ মরেনি।
এক একটা কাজ রণু করিয়া বসে, পরে ভাবিলে হাসি পায়। একবার তাহার দুঃখ আর দারিদ্র্যের কথা বীণাদিকে বলিতে যাইয়া তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া কান্না আসে আর কি!
তবে সেদিনের কথা সত্যিই বড় মনে পড়ে। রাত্রির পৃথিবীতে সকলের অলক্ষ্যে এক অবহেলিত আত্মার কাছে দুহাত পাতিয়া সে আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়াছে। সেদিন চারিদিকে নিস্তব্ধতায় আর দুঃখের কথায় চোখের জল আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহা সত্যি।
রণুর পরীক্ষা হইয়া গেল অর্থাৎ এদিকের সব মিটিয়া গেল।
ফল বাহির হইতে তখনও অনেক বাকি। রণু বাড়ি যাওয়া ঠিক করিয়া ফেলিল। ফেলই হউক আর পাশই হউক এরপরে আর পড়া তাহার কোনো রকমেই হইতে পারে না। তা ছাড়া, বড়দাও তাহার খরচ বাড়তির জন্য তাহাকে এখানে রাখিতে চাহিবেন না।
কাদম্বিনী সৌজন্যের খাতিরে বলিলেন, ফলটা বেরুলে পর গেলে হত না!
—দরকার নেই জ্যাঠাইমা, রণু হাসিয়া বলিল, আমি পাস করবো।
কাদম্বিনী খুশি হইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই করবি। তুই কি আমাদের অজিত, বাবা, যে বছর বছর শুধু টাকা খরচ করতে হবে?
রণু বলিল, আচ্ছা জ্যাঠাইমা, জিতু বলে একটি ছেলে যে এসেছিল এখানে ও ই যে আপনার মাসতুতো না পিসতুতো ভাই-এর ছেলে, ও বুঝি বিলেত যাবে?
—যাবে না তো কি? মস্ত বড়োলোক ওরা, তার ওপর ছেলেটাকে দেখেছিস। তো, কেমন মুখের ওপর একটা বুদ্ধির দীপ্তি। অনেকটা তোর মতো …তোরও ওরকম হতো কেবল পয়সার জোর নেই বলে।
আশ্চর্য হইয়া রণু বলিল, কী বলেন জ্যাঠাইমা? আমার হতো না, কখনো হতো না, বড়দাই বলেছে যে…
হাসিয়া কাদম্বিনী বলিলেন, কী বলেছে?
নিজেকে নিজে বকব? রণু হাসিয়া ফেলিল। কাদম্বিনীও হাসিলেন।
আশ্চর্য বটে। যাইবার সময় বীণাকে বাড়িশুদ্ধ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। বেলা তিনটায় ট্রেন। একবার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য।
রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বীণাদিকে খুঁজে পাচ্ছি না জ্যাঠাইমা। গাড়ির সময় হয়ে এসেছে যে!
দ্যাখ পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?
সেই হাজরাদের বাসায় বীণাকে পাওয়া গেল। সে কনকের সাথে বসিয়া গল্প করিতেছিল।
আগেই কনক হাসিয়া বলিলেন, রণু কেন আমাদের বাসায় এসেছে আমি তা জানি।
আপনার সব সময়ই ঠাট্টা বউদি, রণু বলিল।
আমার কী দোষ ভাই? বীণা তো এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল। তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে, ফল বেরোয়নি কিন্তু তার আগেই তুমি চলে যাবে, তোমার নাকি পড়বার ইচ্ছা ভয়ানক, তা হলে কী হবে? বীণা বলে যে চায় সে পায় না। তা ছাড়া আরও কত কী?…তোমার মতো ছেলে খুব কম দেখা যায় কনক হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িলেন। আর চোখে জল ভরিয়া আসিল রণুর। কোনোদিন তাহার এ দুর্বলতা দেখা দেয় নাই, আজ কি জানি কেন দিল। সে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, বীণাদি চলুন শীগগির।
বাসায় আসিয়া রণু কী যে বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। বীণা প্রথমে কহিল,
যেখানেই থাকি না কেন তোমাকে আমি মনে করবো ভাই।
তা জানি বীণাদি। আমিও আপনাকে কোনোদিন ভুলবো না। রণু আর বলিতে পারিল না।
তারপর গলি শেষ হইবার আগে রণু একবার পিছনপানে তাকাইয়া দেখিল সকলেই তাহার দিকে চাহিয়া আছে, নাই কেবল বীণা।
মহাপ্রয়াণ
ছয়টা বাজিয়া গেল তবু কেউ আসিতেছে না। অথচ সাড়ে ছয়টায় মিটিং। উদ্যোক্তারা অধীর হইয়া উঠিল, শেষে স্থির করিল, এমন কান্ড তাহারা জীবনেও দেখে নাই, শোকসভার অনুষ্ঠান করিতে গিয়া যে এমন বেকুব বনিয়া যাইবে, ইহা তাহারা স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। একজন একটা অত্যন্ত কঠিন মন্তব্য করিয়া ফেলিল, আজ যাহারা শোকসভার এই আড়ম্বরহীন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দ্বিধা করিতেছে, কাল যে তাহারাই আবার শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত হইতে কুকুরের মতো ঠেলাঠেলি করিয়া মরিবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই! সুবোধ ঘোর জাতীয়তাবাদী, এমনকি বাঙলাকেও ভারতবর্ষ হইতে পৃথক করিয়া দেখে, কিন্তু আধুনিক সব কান্ড-কারখানা দেখিয়া সে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভীষণ সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছিল, অত্যন্ত বিরক্তিভরা সুরে সে বলিল, বাঙালির আবার টাইম!
মৃত মধুসূদন দাস মহাশয়ের মোটরের ড্রাইভারটি খাটিতে খাটিতে হয়রান হইয়া গেল। তবুও সে তাহার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনিয়ন্তা চাকরিটাকে দাস মহাশয়ের অন্যান্য ছেলেদের মতোই উত্তরাধিকারসূত্রে অক্ষুন্ন রাখিতে পারিবে কিনা কে জানে! সভামন্ডপটাকে চমৎকার সাজানো হইয়াছে, আরামদায়ক চেয়ারে, ইলেকট্রিক লাইট ইত্যাদিতে চমৎকার। প্রেসিডেন্টের টেবিলের উপর রাশি রাশি ফুল, ফুলের মালা, মাথার উপর ঝালর দেওয়া দামি সামিয়ানা। সেই ঝালরগুলি বাতাসে মৃদু কাঁপিতেছে।
মধুসূদন এত টাকা রাখিয়া গিয়াছেন যে, তা রূপকথার মতোই শোনায়। অথচ তাঁহার জীবনের কোথাও আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নাই। এক পয়সা দিয়া একটা সিগারেটও কিনিয়া খান নাই কখনো। নিজের স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় স্ত্রীলোকের মুখ দেখেন নাই জীবনে। একটা মোটর কিনিয়াছিলেন তাও লোকের কথায় নিতান্ত ঠেকিয়া, কিন্তু সেই মোটরে একটি দিনের জন্যও কখনো চড়েন নাই। এমন সরল অনাড়ম্বর জীবন যাঁহার ছিল, প্রাচুর্যের ভিতর বাস করিয়াও যিনি অপ্রাচুর্যের রূপকে চিরকাল ভক্তিভরে প্রণাম করিয়াছেন, তাঁহার স্বৰ্গত আত্মার সদগতি কামনার উদ্দেশ্যেই আজ সকলে এখানে সমবেত হইবে।
উদ্যোক্তারা ভুল করিয়াছিল, যতটা হীন মন্তব্য তাহারা মানুষের সম্বন্ধে করিয়াছিল, ততটা হীন হইবার যোগ্য তাহারা নয়। সাতটা বাজিবার আগেই সকলে একে একে আসিয়া হাজির হইল। স্থানীয় ইস্পিরিয়েল ব্যাঙ্কের এজেন্ট নিজে আসিলেন না কিন্তু তাঁহার কর্মচারীদের পাঠাইয়া দিলেন। অন্যান্য ব্যাঙ্কের কর্মচারীরাও আসিল। প্রেসিডেন্ট যিনি নির্বাচিত হইয়াছিলেন তিনি মধুসূদনের মতো কোনো রূপকথারই নায়ক। সকলে তাঁহার জন্যই কাতর হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। সকলের শেষে যখন তাঁহার ভারী মোটরখানা সভামন্ডপের কাছে আসিয়া থামিল, উদ্যোক্তাদের পক্ষ হইতে উকিল অনাদিবাবু দৌড়াইয়া গেলেন তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে, প্রেসিডেন্টের হাতের লাঠিখানা তাড়াতাড়ি নিজের হাতে লইয়া বলিলেন, আসুন আসুন।
প্রেসিডেন্ট বুদ্ধিমান, অত্যন্ত সাবধানে একটু হাসিলেন এবং তাঁহার এই হাসির স্বপক্ষে মুখ জনতা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিত সন্দেহ নাই, কিন্তু এতদূর মূর্খ তাহারা এখনও অর্জন করে নাই যে শোকসভার কথা শুনিয়াও হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিবে।
প্রেসিডেন্ট সভামন্ডপে প্রবেশ করিলেন। একটা চমৎকার সেন্টের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া গেল। প্রেসিডেন্ট বুড়া হইয়াছেন সত্য কিন্তু প্রসাধনের শখ এখনও যায় নাই। এবং তাঁহার শাস্ত্রে টাকাকড়ি সদব্যবহারের কথাটা উল্লেখ যেখানে আছে সেখানকার কিছুটা যে একেবারেই পড়েন নাই, এমন নয়। তাঁহাকে দেখিয়া একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনে সভাস্থল ছাইয়া গেল। প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গলায় মাল্যদানের পর সভার কাজ আরম্ভ হইল। একটা ভীষণ স্তব্ধতায় সভা ভরিয়া গেল। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে অস্পষ্ট স্বরে প্রেসিডেন্ট কী বলিলেন তাহা মোটেই বোঝা গেল না। এ কথা কে না জানে, এই দরিদ্র দেশে টাকা-পয়সা সঞ্চয় করিবার প্রবল উৎসাহেই তিনি গা ভাসাইয়া দিয়াছিলেন, পড়াশুনা করিবার সময় পান নাই। তাঁহার বক্তৃতা শেষে এক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া পরলোকগত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবদেন করা হইল। ইহার পর ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার জীবানন্দ চক্রবর্তী স্বর্গীয় মধুসূদন দাস মহাশয় যে বিখ্যাত দানবীর ছিলেন, এ কথার উল্লেখ করিলেন। কংগ্রেসের অনেক নিরাপদ সভায় বক্তৃতা দিয়া তিনি হাত পাকাইয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার বক্তৃতায় সকলেই চমৎকৃত হইল।
এমন সময় ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ করিলেন শ্রীপতি। এত করিয়াও তিনি যে সকালে আসিতে পারিলেন না, তার জন্য আফশোষের অন্ত নাই। বাহিরের অফিসকে কোনরকমে কাটাইয়া আসিতে পারিলেও আবার যে ভিতরের একটা মস্ত বড় অফিসের সম্মুখীন হইতে হয়, এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা তাঁহার মতো অন্যান্য অনেক অফিসওয়ালাদের তহবিলেও আছে। বাড়ি ঢুকিয়াই শ্রীপতি দেখিয়াছিলেন, এক রক্তবর্ণ শাড়ি পরিয়া দুই মেয়ে তাঁহার দিকে রক্তনেত্রে চাহিয়া আছে, আরও শাড়ি চাই। যে পয়সা তিনি দিবেন বলিয়াছিলেন, সেই কবে, সেই পয়সার জন্য আর একবার শাসাইয়া গেল তাঁহার ছেলেমেয়েরা, আর এই গোলমালে গৃহকত্রীর কণ্ঠের স্বর তো শোনাই যায় না। কিন্তু আজ সকল চাওয়াকে উপেক্ষা করিবার সুযোগ পাইয়াছেন শ্রীপতি, তিনি ছুটিয়া চলিয়া আসিয়াছেন। তবু তো দেরি হইয়া গেল। এমনি সংসার যে এক মিনিট নিশ্বাস ফেলিবার সময় তো নাই-ই, দৈবাৎ এমন একটা সভাতেও যোগ দেওয়ার সময় তাঁহার নাই!
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাশে শ্রীপতি তাড়াতাড়ি একখানা আসনগ্রহণ করিলেন। উকিল অনাদিবাবু এখনও অভ্যর্থনায় ব্যস্ত, কিন্তু শ্রীপতির অভ্যর্থনায় তাঁহার ভুল হইয়া গেল। তিনি তাঁহাকে দেখিয়াও দেখিলেন না। শ্রীপতি গভীর মনোযোগে, অভিভূত হইয়া বক্তার বক্তৃতা শুনিতে লাগিলেন। বক্তৃতা করিতেছিলেন এক সুবিখ্যাত ব্যাঙ্কার এবং জমিদার। তিনি ব্যবসায়ে মারোয়াড়ীর সাফল্য আর বাঙালির অসাফল্যের কথা বিশ্লেষণ করিয়া এক নতুন তথ্য পরিবেশন করিলেন। এ ছাড়া মধুসূদনের মৃত্যুতে তাঁহাদের মহলে তথা সমগ্র ভারতের জনসাধারণের যে সমূহ ক্ষতি হইয়াছে, তার উল্লেখ করিলেন। শ্রীপতি বসিয়া বসিয়া সেই সমূহ ক্ষতির কথাই কেবল ভাবিতে লাগিলেন। ভাবিতে ভাবিতে একসময় চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হইয়া আসিল, তিনি দাঁড়াইয়া গেলেন, গভীরস্বরে বলিলেন, মাননীয় সভাপতি মহাশয় এবং সমবেত বন্ধুগণ! আজ যাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনের সব বেদনা জানাতে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি, তিনি তো দুদিন আগেও আমাদের মধ্যে ছিলেন। অথচ তিনি আজ নেই, আমাদের শোকসাগরে ফেলে চলে গেছেন, আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। এটা যে কতবড়ো ব্যথার, কত কষ্টের, আমাদের পক্ষে কত শোচনীয়, তা আশাকরি আপনাদের বলতে হবে না। তিনি যে নেই, একথা ভাবতেও আজ আমাদের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে।…
শ্রীপতির সত্যই কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল, তিনি ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
মূর্খ জনতা বিস্তর মূর্খতা অর্জন করিয়াছে সন্দেহ নাই; এটা যে শোকসভা, একথা আর কিছুতেই মনে রাখিতে পারিল না, দারুণ করতালি দিতে লাগিল।
মুহূর্ত
তাহাদের ঘরে ঢুকিয়া হঠাৎ দরজা দিতে দেখিয়া পদ্মা কাতর স্বরে বলিল, আমাকে একটু আসতে দে ভাই, আমি কিছু বলব না, কেবল চুপ করে বসে বসে শুনব, কিছু বলব না–
দরজা আগলাইয়া সুমতি বলিল, না না, তোমাকে আসতে দেওয়া হবে না।
পদ্মা তবু তাহার মুখটি আরও কাতর করিয়া বলিল,
—তোদের পায়ে পড়ি ভাই, আমায় একটু আসতে দে, বলছি তো একটি কথাও বলব না
তাহারা একবার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করিল, শোভা মুখ টিপিয়া হাসিল, তারপর রাণু গম্ভীরভাবে বলিল, একটি কথাও বলতে পারবে না, ঠিক তো?
—ঠিক বলছি, এই চোখ ছুঁয়ে বলছি। পদ্মা সত্যিই তাহার দুই চোখ ছুঁইয়া বলিল।
সুমতি এবার পথ ছাড়িয়া দিল, পদ্মাকে ঢুকিতে দিয়া তারপর দরজা বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া সকলে মিলিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিল। শোভা পাশের বাসায় থাকে, বয়স নিতান্ত অল্প—এখনও পনেরো পার হয় নাই, কিন্তু খুবই আশ্চর্যের কথা এই যে, এখুনি বিবাহের কথাবার্তা ঠিক হইয়া গিয়াছে। সুতরাং, গল্পটা হয় তাহাকে উপলক্ষ করিয়াই।
সুমতিদের উচ্ছাসটা শোভার চাইতেও বেশি, শোভা কেবল মাঝে মাঝে লাল হইয়া ওঠে, অথবা স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে বাইরের দিকে তাকায়। তাহারা তিনজনে মিলিয়া একটার পর একটা গল্প করিয়া চলিল, এক সময় শোভা তাহার বিবাহের জন্য নির্মিত নতুন চুড়ি দেখাইল, আর একসময় সুমতি তাহার কানে ফিস ফিস করিয়া কিছু বলিল। পদ্মা একবার কান পাতিয়া শোনার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সুমতি অমনি ঝংকার তুলিয়া বলিল, কী অসভ্য, আবার আড়ি পেতে শশানে!
কিছুক্ষণ পরে এদি-ওদিক চাহিয়া শোভা হঠাৎ চীৎকার করিয়া বলিল, আমার আর একটা চুড়ি কোথায়?
–চুড়ি! বিস্ময়ে সকলের চোখ বড়ো হইয়া গেল,–চুড়ি আবার কোথায়? এই না কোথায় রাখলি? ভোজবাজী নাকি যে চোখের সামনে জিনিস উড়ে যাবে?
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি হইল। রাণু হঠাৎ মুখ তুলিয়া বলিল, আমার মনে হয় কী জানিস?
সকলের চোখে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিয় হইয়া গেল। সুমতি গম্ভীরভাবে পদ্মার দিকে আগাইয়া আসিল, তাহার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া বলিল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল?
পদ্মা তো অবাক! এমনটা যে হইবে সে কল্পনাও করিতে পারে না। সবটাতেই কী তাহার দোষ! সে কাতরস্বরে বলিল, আমি তো নিইনি…
—আমি তো নিইনি। আহা, ন্যাকা আর কী। তোমাকে বাপু আমরা চিনি, এই সেদিন সুলতার ছোটো ভাইয়ের হাতের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলে; চুড়ি শীগগির বার করে দে বলছি?
পদ্মার চোখ দুটি ছোটো হইয়া আসিল, সে আরও করুণ হইয়া বলিল, বিশ্বেস কর ভাই, আমি চুড়ি নিইনি…
—তবে রে! তবু মিথ্যা বলা হচ্ছে! রাণু আরও কাছে আসিয়া বসিল, তাহলে দাঁড়াও, তোমার সমস্ত শরীর আমরা খুঁজে দেখব।
কিন্তু তাহার কাপড়-চোপড় খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
সুমতি হঠাৎ তাহার বুকের উপর ঝুঁকিয়া বলিল,
দেখি তোর—এই বলিয়া তাহার বুকের উপর সেমিজটা সরাইয়া দেখিল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।
পদ্মা ভাবিল, সে কী এতই বোকা যে চুরি করিয়াও এতক্ষণ এখানে বসিয়া থাকিবে, বা বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিবে? কিন্তু সকল সময়েই কী তাহার দোষ? যে কেউ চুরি করলেও তাহার নাম বলিবে? এই তো আজ-আজ তো সে চুরি করে নাই, তবুও তো সকলেই তাহাকে কেমন যা-তা বলিতে ছাড়িল না!
পদ্মা ধীরে ধীরে সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, দীর্ঘ বারান্দা ধরিয়া ধীরে ধীরে হাঁটিতে লাগিল। বারান্দায় প্রায় সবটাই দিনের বেশিরভাগ সময় জলে চ্যাক চ্যাক করে, দারুণ পিছল হইয়া থাকে, এখন দুপুর বলিয়া খানিকটা শুকনো। প্রদিনি ভোর হইতে না হইতেই পাশের ঘরগুলি হইতে ছোটো বড়ো নানা ধরনের ছেলেমেয়েদের দল পিঁপড়ার মতো বাহির হইয়া আসে। বারান্দার বাহির হইয়া আসিতে পারিলেই যেন তাহারা বাঁচে, তারপর সেখানে পড়িয়া হাত পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে থাকে—যতোক্ষণ না খাবার দেওয়া হয়। বেলা দশটা বাজিতেই, অর্থাৎ রৌদ্রের তেজ বাড়িলে বৃদ্ধ হরিমোহন গায়ের সমস্ত কাপড়-চোপড় ফেলিয়া বারান্দায় একপাশে তেল মালিশ করিতে বসিয়া যায়, তাহার কোমরে নাকি বাত—গায়ে একখানা যেমন তেমন ছেড়া গামছা থাকিলেই যথেষ্ট। দুপুরবেলায় খানিকটা সময়ের জন্য কিছুটা ফাঁকা যায় বটে, কিন্তু তখন ছোটো ছেলেময়ে এবং বড়োদের বিস্তর কাঁথা আর তালি দেওয়া বিছানা রৌদ্রে শুকাইতে দেওয়া হয়। এখনও স্তূপ পড়িয়া আছে। তাই চারিদিকে কেমন একটা ছাগলের গায়ের গন্ধের মতো। মাছিও ভনভন করিতেছে। পদ্মা খুব সাবধানে পা ফেলিয়া সিঁড়ির কাছে গেল—নইলে ওই রঙ বেরঙ বিছানাগুলি একটু মাড়ালেই হয়তো পাশের ঘর হইতে শশধরের কাঠির মতো সরু বউটা চীৎকার করিয়া সারা বাড়ির লোককে আনিয়া জড়ো করিবে।
বাড়িটা অত্যন্ত পুরোনো, এত যে একটু জোরে হাঁটিলেই যেন থর থর করিয়া কাঁপিয়া ওঠে।
দেওয়ালে দেওয়ালে অজস্র ফাটল, অনেক ঘরের ছাদও ভাঙা বর্ষায় রীতিমত জল পড়ে, তাই প্রায় সবগুলি ঘরের দেওয়ালেই কালো কালো স্যাঁতসেঁতে দাগ ধরিয়া আছে। পদ্মা সিঁড়ি দিয়া নামিতে গিয়া দেখিল কাঁপে কি না। হুঁ, কাঁপে, তবে সিঁড়ির মতো নয়। আচ্ছা, বাড়িটা যদি হঠাৎ একদিন ভাঙিয়া পড়ে? তাহা হইলে কিন্তু উপরের ঘরের কেউ বাঁচিতে পারিবে না। তাহারা কেমন করিয়া পালাইবে? পালাইবার সময়ই বা পাইবে কোথায়?
সিঁড়িটা ভয়ানক খরখরে, কোনো কাঁকর বিছানো পথের চাইতেও অনেক কর্কশ। আর সরু, এত সরু যে আর একজন কেউ নীচ হইতে আসিলে একেবারে দেয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে হয়। একদিন যা হইয়াছিল…সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে পদ্মা উপরের ঘরে সুমতিদের হাসির রোল শুনিতে পাইল। চুড়িটা পাওয়া গিয়াছে তাহা হইলে? হয়তো কোথাও চাপা পড়েছিল, এতক্ষণে তা পাওয়া গেল। তবুও তো না জানিয়া শুনিয়াই সুমতিরা তাহাকে যা-তা বলিতে ছাড়ে নাই! সে চুরি করে বলিয়াই কী যখন-তখন যে-কোনো জিনিস চুরি গেলেই তাহার নাম পড়িবে।? সে কী এতই বোকা চুরি করিয়াও সেখানে বসিয়া থাকিবে? পদ্ম মনে মনে একটু হাসিল। কিন্তু পরক্ষণেই শোভা এবং তাহার সঙ্গিনীদের ব্যবহারের কথা মনে করিয়া একটু দমিয়া গেল। মন তাহার সহজে বড়ো খারাপ হয় না। আজ একটু খারাপ হইয়া গেল।
পদ্মার মা-র আজ দুপুরবেলা ঘুম হয় নাই। মেয়ের চেহারাখানা দেখিতে না দেখিতেই সে খনখন করিয়া বাজিয়া উঠিল, এই যে রানি এসেছেন দেখছি। এতক্ষণ হৈ-রৈ করে কোথায় বেরোনো হয়েছিল শুনি? পাড়া বেড়িয়ে এলেন বুঝি? এ ছাড়া আর কী কাজ? কাজের ঠেলায় খাওয়া-দাওয়া সারবার সময়ই বা কোথায়? মা হঠাৎ ঝাঁটার দিকে হাত বাড়াইয়া সামনের দিকে অগ্রসর হইল, নিজের কুঞ্চিত মুখখানা কংকালের মুখের মতো বিকৃত করিয়া বলিল, যা এখান থেকে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা বলছি।
ঘরের একপাশে আলোর কাছে বসিয়া শিবনাথ পুরোনো একজোড়া জুতায় লোহা মারিতেছিল। একবার পেছন ফিরিয়া চাহিয়াই সে বলিতে আরম্ভ করিল, আমি কিন্তু তোমাদের ওসব ইসটাইল-ফাইল ভালো বুঝিনে। এই যে যার তার সঙ্গে কথা কওয়া, যেখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়া—এ যেন এক ইসটাইল হয়েছে আজকাল! যতো সব…। খবরের কাগজে রোজই তো পড়ি, পড়তে পড়তে কান ঝালা পালা হয়ে গেল। এই তো সেদিনও শুনলাম অমূল্য চৌধুরীর বড়ো মেয়েটা বাড়ির সামান্য একটা তাই নিয়ে কত কেলেঙ্কারি! শিবনাথ নিজের মনে বিড় বিড় করিয়া আরও অনেক কিছু বলিল, তারপর এই বলিয়া উপসংহার করিল
—আমার কথা হল মেয়ে মোলোয় পড়ল তো অমনি বিয়ে দাও, বাস! লেখাপড়া দিয়ে কী হবে? বিয়ের ঘরে কোথায় থাকে লেখাপড়া, আর কোথায় থাকে গান। এই গান হয়েছে আর এক ইসটাইল দেশে। আমাদের নির্মলের বউ সেদিনও বলছিল— শিবনাথ দুরাত্মীয় ধনী ভাগ্নে নির্মল এবং তাহার স্ত্রীর কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিল।
মা তাহার মেয়ের দিক এতক্ষণ কটমট করিয়া—চাহিয়াই ছিল, এবার ঠিক তাহার সামনে গিয়া থপ করিয়া এমনভাবে খানিকটা থুথু ফেলিল যে মনে হয় যেন। তাহার গায়ের উপরেই ফেলিতেছে, তারপর চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন করে দ্যাখো, যেন হুকুম আলী সরদার! দুনিয়ার কাউকে পরোয়া নেই! যা এখান থেকে, আমার সুমুখ থেকে চলে যা বলছি?
ব্যাপার দেখিয়া পদ্মার মুখের চেহারা এমন হইয়া গেল যে, মনে হয় যেন সে ভাবিতেছে, ইস, আজ তোমরা সবাই মিলে আমাকে এমন করে বকছো কেন?
ব্যাপারটা সে সহজেই বুঝিতে পারিল। হাতে পয়সা না থাকিলেই কী। তাহাকে সবাই মিলিয়া এমন বকাবকি করিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহার দোষ! সর্বদাই কী আর চুরি করা যায়? সেকালেই তো আর যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এমন বোকা নয় যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও ধরিতে পারিবে না। তবুও চুরি করিতে হইবে। আর না করিলে মাঝে মাঝেই বলা-নাই কওয়া-নাই এমনি বকাবকি শুনিতে হইবে। পদ্মার মনটা আজ সত্যই একটু খারাপ হইয়া গেল। আর কোনোদিন এরকম হয় না। সে নিঃশব্দে সেখান হইতে সরিয়া। পড়িল।
বাড়িটা এখন একটু নির্জন। ছেলেমেয়েগুলি একেবারে সারাদিনের মতো রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িয়াছে কখন। সর্বাঙ্গে এক গাদা ধুলাবালি লইয়া সেই সন্ধ্যার সময় ফিরিবে, তারপর যে যার মতো বসিয়া খাইয়া দাইয়া বিছানায় পড়িয়া যাইবে। দুপুরবেলায় তাই বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম নির্জন বোধ হয়। ভাঙা বারান্দায় এখানে-সেখানে জল জমিয়া রহিয়াছে, এখনও শুকায় নাই, এমন স্যাঁতসোঁতে যে আর শুকাইবে না।
পাশ দিয়া একজন প্রৌঢ়া বিধবা ত্রস্ত পায়ে হাঁটিয়া যাইতেছিল। তাহার হাঁটিবার ভঙ্গিই এ রকম। তাহাকে দেখিয়া পদ্মা ডাকিল,-মাসিমা? মাসিমা যেন তাহার ডাকের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তার দিকে না চাহিয়া ফরফর করিয়া বলিল,–এতক্ষণে ছেলে আমার এসেছেন। তার যাওয়ার আয়োজন করতে হবে তো! —ছেলে? মাসিমার ছেলের নাম শৈলেন। সে অমনি প্রায়ই ভোর না হইতেই কোথায় বাহির হইয়া যায়, তারপর বেলা দুইটায় তিনটায় আসে। তারপর আবার সেই বিকাল না হইতেই বাহির হইয়া যায়, আর কখন যে ফিরে তা একমাত্র তাহার মা ছাড়া আর কেউ জানে না। চুলগুলিতে তেল আর চিরুনি পড়িয়াছে বলিয়া কোনোদিন কেউ দেখে নাই, পড়িলেই বরং অস্বাভাবিক দেখায়। এই শৈলেন কথাবার্তায় চমৎকার—পদ্মার দাদা বাঁচিয়া থাকিলে আজ তাহারই সমান হইত বটে কিন্তু একসময় এমন গম্ভীর যে কথা বলিতেই ভয় হয়। যেন সারা পৃথিবীর ভাবনা তাহার মাথায় আসিয়া ঢুকিয়াছে। সে সময় সে দাঁত দিয়া ভয়ানক নখ কাটে।
এইমাত্র কাপড় কাঁধে করিয়া শৈলেন স্নান করিতে চলিয়া গেল। সমস্ত বাড়িটা যেন তাহার পদক্ষেপে কাঁপিতেছে।
এই শৈলেন একদিন তাহাকে বলিয়াছিল, পদ্মা, তোমার চোখদুটো ভারী সুন্দর। — সে কথা মনে করিয়া এই মুহূর্তেও পদ্মার মনের ভিতর যা ভালো লাগিল, তা মুখে বলিবার নয়, বুকের ভিতর কেমন করিয়া উঠিল, খানিকটা সময়ের জন্য অন্তত সে গর্বে উন্নত হইয়া চোখদুটি টান এবং আরও বড়ো করিয়া অত্যন্ত করুণায় চারিদিকে তাকাইতে লাগিল।
মাসিমার ঘরে পদ্মার সর্বদাই আসা-যাওয়া আছে। মাসিমা খুবই ভালো মানুষ, আর শৈলেনদা আরও ভালো মানুষ। পদ্মা আস্তে আস্তে সেই ঘরে ঢুকিয়া অনির্দিষ্টভাবে চারিদিকে তাকাইয়া দেখিতে লাগিল। শৈলেন যে এইমাত্র আসিয়া গিয়াছে, তা ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিলেই বোঝা যায়। স্যান্ডেল জোড়া বিক্ষিপ্ত হইয়া এখানে একটা ওখানে একটা হইয়া পড়িয়া আছে।
তক্তপোষের উপর একটা বই, আর ভাঁজ-করা একটা ইংরেজি পত্রিকা। আর ভাঙা চেয়ারের উপর গায়ের জামাটা।
শৈলেনের জামা? পদ্মা হাত দিয়া আস্তে একটু ধরিল, ধরিয়া দেখিল, কলারের নীচে বেশ ময়লা পড়িয়াছে, আর ঘামের গন্ধ। শৈলেন—দার জামা! নীচের পকেটে কতো কাগজপত্র, এত কাগজপত্র যে কীসের, তা কে জানে! বুক পকেটে একটা নোটবই, আর একটা ময়লা রুমাল, রুমালের মধ্যে একটা কিছু বাঁধা। পদ্মার বুকের ভিতর টিপটিপ করিতে লাগিল, কোনো রুমাল দেখিলেই তাহার বুকের ভিতর এমনি টিপটিপ করিতে থাকে, শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত দ্রুত বহিতে থাকে।
রুমালটার ভিতর কী আছে কে বলিতে পারে? পদ্মা বাহিরের দিকে একবার তাকাইয়া দেখিল। শৈলেন এখনো জল ঢালিতে আরম্ভ করে নাই, মাসিমার বাসন কোসন নাড়ার শব্দ শোনা যায়। রুমালটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিল পদ্মা, হাতটা কাঁপিতেছে! এ কী, নোট? পাঁচ টাকার নোট? পদ্মার বুকের ভিতর টিপ-টিপ আরও বাড়িয়া গেল, রক্তের চলাচল আরও দ্রুত হইল। মাসিমারা চমৎকার মানুষ, এমন ভালো মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। সমস্ত বাড়ির মধ্যে তাহারাই তাহাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।…কিন্তু পাঁচ টাকার নোট! পাঁচ পাঁচটা টাকা! এখন লইয়া গেলে কেই বা জানিতে পারিবে? সোজা কথা সে এখানে আসে নাই। তবু যদি সন্দেহ করে—তবে খুঁজে বার করো। খুঁজিয়া পাইলে তো চোর বলিবে? হাতে-হাতে ধরা না পড়িলে কেউ কখনো চোর হয় নাকি।… মাসিমা..সেদিনও গদাধরের বউর কাছে মাসিমাকে চাল ধার লইতে দেখিয়াছে সে, হয়তো এই পাঁচটি টাকাই প্রায় মাসখানেকের সম্বল। পদ্মার হাত কাঁপিতে লাগিল, সারা শরীরের ভিতর কেমন একটা ভ্যাপসা গরম লাগিতেছে। ইস, পাঁচ পাঁচটা টাকা এখুনি দিব্যি হাতের ভিতর গুজিয়া বা বুকে ফেলিয়া সোজা উপরে চলিয়া গেলে কে জানিতে পারে। কিন্তু শৈলেন…শৈলেনদা একদিন মাসিমাকে লক্ষ করিয়া বলিয়াছিল, সত্যি,পদ্মার চোখের মতো এমন দুটি চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি, মা? সেকথা মনে করিয়া একাট মধুর অস্থিরতায় পদ্মার সারা মুখ লাল হইয়া গেল, টানা চোখদুটি আরও টান হইয়া আসিল। নোটটা কোনো রকমে রুমালের ভিতর জড়াইয়া সেটা পকেটে পুঁজিয়া রাখিয়া পদ্মা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল, বারান্দা পার হইয়া নিজেদের ঘরে আসিয়া ধপাস করিয়া খালি তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িল।
তাহাকে এমনি শুইতে দেখিয়া তাহার মা অমনি খন খন করিয়া বাজিয়া উঠিল : দ্যাখো, হাত পা ছড়িয়ে দস্যির মতো কেমন শুয়ে পড়ল। বাঃ বাঃ লাজ বলে কোনো জিনিস যদি থাকে। কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকা আর সময় মতো এসে দুটি খাওয়া।
শিবনাথের জুতায় লোহা লাগানো তখনো শেষ হয় নাই, সে ঘাড় ফিরাইয়া একবার মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ওই তো এক ইসটাইল হয়েছে দেশে, ঘরের কাজ না শেখা, যেন ওসব কিছুই নয়! আরে বাপু দুদিন পরে যে এই ঘরের কাজই তোমায় করতে হবে।…
কিন্তু চুরি কী সর্বদাই করা যায়? পদ্মা শুইয়া শুইয়া পিট পিট করিয়া চাহিয়া দেখিল, শৈলেন এখনও স্নান করিতেছে। তাহার মুখের রঙের অনুপাতে গায়ের রঙ অনেক ফর্সা। সেই শরীরের খানিকটা এখান হইতেই দেখা যায়—চমৎকার পেশিবহুল, আর ফর্সা, চক চক করে, চুলগুলি জলে ভিজিয়া একেবারে মুখের উপর আসিয়া পড়িয়াছে, ফর্সা বলিষ্ঠ হাত দুটি যেন দুটি সাদা পাখির মতো অল্প একটু জায়গার মধ্যে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু চুরি কী আর, বলা নাই— কওয়া-নাই সকল সময়েই করা যায়? আর লোকেও কী যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এত বোকা যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহাদের দোষ! আর থাকিলেও সেটা যদি দু-একদিনের মধ্যেই ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলেও তাহার দোষ! পদ্মার মনটা আজ সত্যই খারাপ হইয়া গেল। অন্য কোনোদিন এরকম হয় না। মন যদি সত্যই খারাপ হইয়া থাকে, তখন তাহার ইচ্ছা হইল একটু কাঁদে। আর কাঁদিলে মনটা খুব খারাপ কি না, তা ঠিক বোঝা যাইত। কিন্তু কান্না তাহার কখনো পায় না, আজও চোখ দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। স্তূপীকৃত ছেঁড়া বিছানায় মুখ গুঁজিয়া সে পড়িয়া রহিল।
রাত্রিশেষ
লোকটিকে কী জানি কেন চিত্তর একটু ভালো লাগিয়াছে। রতন গোঁসাই-এর গায়ের বর্ণ শ্যাম, চামড়া মন হয় পালিশ করা সোনার চেয়েও মসৃণ, লম্বা, দেহ এবং ঈষৎ মোটা, মাথা ভরা একরাশ ঘাড় পর্যন্ত চুল, একটিও পাকা দেখা যায় না, বেশ করিয়া সযত্নে আঁচড়ানো, চোখ দুটি গোল হইলেও বেশ ভাসা ভাসা চকচক করে, মুখে সর্বদাই মিষ্টি হাসি। সেদিনও গল্প হইতেছিল।
রতন একটা আসনের উপর দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া, সামনেই চিত্ত ও আর একটি লোক।
চিত্ত জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে কখনও গান গাইতে শুনিনি তো?
রতন হাসিয়া বলিল, গান গাইলে তো শুনবে। কিন্তু এ গাঁয়ে যখন প্রথম আসি তখন এই গানের জন্যই আমাকে সবাই ভালবেসেছিল। এখন আর গাই না। আশ্চর্য বটে। যা এখন তুমি খুবই ভালবাসলে পরে হয়ত তাই কোনো কারণে ভুলে যেতে পার, এটা কী আশ্চর্য নয়?
কথার ভাবে মনে হয় তাহার মূলে কোনো ইতিহাস আছে।
চিত্ত বলিল, নিশ্চয়ই। কিন্তু তোমার এই গান না গাওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে বোধ হয়!
রতন কোনো উত্তর না দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। চোখের দৃষ্টি নিবিড় হইয়া আসিয়াছে। কখন বিকাল হইয়াছে। গাছপালার পাশে তির্যক ছায়া, তার ফাঁকে ভাঙা মিষ্টি রোদ।
রতন আগের কথা আর না তুলিয়া অন্য লোকটিকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, তারপর কালিচরণ, কেমন আছ?
-এই তুমি যেরকম রাখ। কালিচরণ হাসিল।
—আমি রাখব কী হে? রাখবে একমাত্র আকাশের ওই—
রতন উপরের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ আবার বলিল, তোমার ছেলেটির না অসুখ করেছিল বলেছিলে?
–সেরে গেছে।
রতন এবার হাসিয়া বলিল, কালিচরণ, এ তোমার ভারী অন্যায়-বিয়ে করেছ সেই কবে, খাওয়ালে না, থাক, সে কথা নয় জোর করে ভুলেই গেলাম। কিন্তু তারপর ছেলে হল, তাতেও খাওয়ানোর নামটি নেই, এ কেমন কথা বল? ভারী অন্যায় ভারী—
কালিচরণ মুখ নীচু করিয়া হাসিল।
ঘরের ভিতর ছিল বিনোদিনী। তাহার গলা শোনা গেল–
-আর সে কথা মানুষের কাছে বলতে উলটে আমাদেরই লজ্জা করে। ওর সঙ্গে আমাদের এত ঘনিষ্ঠতা, আর তার মধ্যে কিনা বিয়ে হল, এমনকি ছেলে হল, তাতেও খাওয়ালে না! বাস্তবিক এসব কথা মনে হলে সংসার আর ভালো লাগে না।
রতন হাসি মুখে বলিল, ওরে বাসরে এতই দুঃখ।
-হ্যাঁগো। বিনোদিনী হাসিয়া উঠিল।
কালিচরণ লজ্জা পাইয়া বলিল, আচ্ছা, সে হবে-খন। ঝুলন পুর্ণিমা কবে?
-এখনও দু-মাস বাকি।
—সেদিন এখানকার উৎসবে যা খরচ হবে সব আমার।
রতন খুশি হইয়া বলিল, শুনছ ঠাকুরন?
—হুঁ।
কিছুক্ষণ পরে কালিচরণ চলিয়া গেল।
চিত্ত বলিল, কেন গাও না বলবে?
রতন চারিদিকে চাহিয়া মুখ বাড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল—বলি শোন। সে অনেক দিনের কথা। তখন আমাদের এখানে রাধা বলে একটি মেয়ে ছিল ওর একবার অসুখ হল, সে ভয়ানক অসুখ, মেয়েদের যেসব কঠিন রোগ হয়। কবরেজ চিকিৎসা করত। এতে হল না দেখে দু-কোশ দূরের মাধবদি, সেই যে যেখানে খুব বড়ো রথের মেলা বসে, সেখান থেকে মহিম ডাক্তারকে আনানো হল, সে বুড়ো এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু যার আয়ু সত্যি ফুরিয়ে এসেছে তাকে কী আর বাঁচানো যায়? যায় না। অবস্থা খারাপ হয়ে এল। এমন সময় হল কী, আশ্চর্য রাধা আমার গান শুনতে চাইল। কিন্তু ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর নীতি মেলে না। তখন এমনি খারাপ অবস্থা যে একটু টুঁ শব্দ করাও ভালো নয়। তা ছাড়া রোগীর মনে মরবার ভাব জেগেছে, প্রশ্রয় দেয়াও ভালো নয়। ক্ষান্ত হলাম। কিন্তু সে সময় যে অবস্থা, যে কাতরতা দেখেছি, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত গান গাওয়া হয়নি, হবেও না।
শুনিয়া চিত্তর কষ্ট হইল, কিন্তু কথাগুলি আস্তে আস্তে বলার সপক্ষে সে কোনো কারণই খুঁজিয়া পাইল না।
রতন নীচের দিকে চাহিয়া কী ভাবিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে সন্ধ্যা নামিয়া আসিল। আকাশে ধূসরতা, ছায়ার সঙ্গে বাতাস মিলিয়া যেন ভারী হইয়া গেছে। বনপথ স্তব্ধ।
চিত্তর দুটি চোখ কাহাকে যেন এতক্ষণ খুঁজিয়া ফিরিতেছিল, পায় নাই। সে হঠাৎ উঠিয়া বলিল, যাই এখন।
–এখনই যাবে?
–হ্যাঁ একটু কাজ আছে।
–রাতে আসবে?
—আজ ঠিক বলতে পারিনে, দেখি যদি পারি–
চিত্ত চলিয়া আসিল। ধূলা উড়াইয়া রাখাল ছেলেগুলি গোরু লইয়া ফিরিতেছে। কুকুরগুলি পথে আসিয়া দাঁড়ায়, আর অনর্থক ঘেউ ঘেউ করে।
সে আনমনে ধীরে ধীরে হাঁটিতেছিল। পথের পাশে সরকার বাড়ির খোলা পুকুর, জলে ভরা।
হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল এক কলসি জল কাঁখে ললিতার মতোই কে যেন সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া উঠিতেছে। চিত্ত আর একটু কাছে গিয়া ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিল, হ্যাঁ, সেই। বুকটা তাহার কেমন যেন করিয়া উঠিল।
তাহাকেই সে খুঁজিয়াছিল। চিত্ত যে পথের উপর দাঁড়াইয়াছে, ললিতাকে সেখান দিয়াই যাইতে হইবে। সে ধীরে ধীরে আসিয়া কাছ দিয়াই যাইতেছিল, চিত্ত বলিল, এই সন্ধ্যে বেলায় জল নিচ্ছ যে?
ললিতা নীরবে একটু হাসল। ভারী সুন্দর, চোখ দুটি ছোটো হইয়া আসে, লালাভ গালে টোল পড়ে, চামড়ার টানে চিবুকটি সরল হইয়া যায়।
চিত্ত বলিল, বারে, যোবা নাকি?
–না গো না। বোবা কেন হতে যাব। ললিতা আবার হাসিয়া সামনে অগ্রসর হইল।
দেখা যায়, সচকিত কতটুকু ফর্সা নগ্ন-পা, মাথা-ভরা চুল, চলমান, জল ভারে বাঁকা দেহলতা। ছায়ার স্নিগ্ধতা ঘিরিয়া রহিয়াছে।
চিত্ত সেখানে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। পথের বাঁকে অদৃশ্য হইবার আগে ললিতা আর একবার ফিরিয়া চাহিয়াছে।
পরের দিন হাটবার। হাট আখড়ার পিছনেই। ভোর হইতে আরম্ভ করিয়া দুপুরবেলা দুইটার মধ্যে জমিয়া উঠিল। নানা গাঁয়ের লোকে গিজগিজ করে। আর ভয়ানক গোলমাল। বড়ো বড়ো কয়েকটি বটগাছ ডালপালা শিকড় গাড়িয়া সমস্ত জাগয়াটিকে ছায়াচ্ছন্ন করিয়াছে, বট গাছের গোড়ায় উঁচু করিয়া মাটি দিয়া বাঁধানো, সেখানে কেউ নামিতে পারে না। এখানকার লোকদের বিশ্বাস, উহার মধ্যে দেবতার অংশ আছে, তাই পূজা দেওয়া হয়। এই গাছের বয়স কেহ আন্দাজ করিতে পারে না, ছেলে বুড়ো সকলেই বলে যে, জন্মাবধি তাহারা ঠিক এমনই দেখিতেছে। চিত্ত অনেকক্ষণ অনির্দিষ্টভাবে ঘুরিয়া বেড়াইল, দেখিতে বেশ লাগে। গরিবরা, মজুররা আর অল্পবয়সি ছেলেগুলি সস্তা সিগারেট কিনিয়া খাইয়া বেড়াইতেছে। অলস জীবনের একটু উত্তেজনা যেন অনুভব করা যায়।
চিত্ত রতনের ওখানে গেল।
-কী করছ গোঁসাই?
—এই তো এইমাত্র চান করে দুটি খেয়ে নিলাম।
—এসো। ওগো ললিতে, সতরঞ্চি পেতে দাও তো।
ললিতা শতরঞ্চি হাতে আসিয়াছিল, কিন্তু চিত্ত তাহার হাত হইতে সেটা লইয়া বলিল, থাক থাক বোবা মেয়ে।
চিত্ত খুব আস্তেই বলিয়াছিল।
লজ্জায় রাঙা হইয়া ললিতা বলিল, বারে।
আনত মুখের চাপা হাসির ভঙ্গিটি বেশ সুন্দর।
রতনের চোখে কিছুই এড়ায় না, সে বলিল, কি বলে গো?
ললিতা ঘরে যাইতে যাইতে একবার চিত্তর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমি নাকি বোবা। এমন মিথ্যে বলতে যে পারে, সে কী না করতে পারে!
-–মানুষকে মেরে ফেলতে পারে?
–হ্যাঁ।
রতন একমুখ হাসিয়া উঠিল,—শুনছ চিত্ত, কী বলছে?
—শুনেছি। চিত্তও হাসিতে লাগিল। একটু পরে রতন বলিল, হাট জমেছে কেমন?
–ভালো।
—আগে দেখেছি, এত লোক হত না। এখন একটা বাজার চলতে পারে কী বল?
—না। চিত্ত অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল। তার এই অন্যমনস্কতার কারণ রতন বোঝে। সে ডাকিল,-ওলো ললিতে, কোথায় গেলে?
-বলুন। ললিতা আসিল।
রতন বলিল, আজ ললিতা যা বেঁধেছিল—বিনু ঠাকরুন কোথায়?
-ঘুমুচ্ছেন ও ঘরে।
–কী বলছিলাম, হ্যাঁ যা বেঁধেছিল, এক কথায় চমৎকার। অনেকদিন এমন রান্না খাইনি।
চিত্ত ললিতার দিকে চাহিয়া বলিল, তা এমন রাঁধলে কার লাভ? ভাগ তো পাইনি। এখন শুনেই পেট ভরাই আর কী!
ললিতা একপাশে গুটিসুটি হইয়া বসিল।
রতন বলিল, অবিশ্যি একদিন যা হয়েছিল সে কথা মনে হলে এখনও হাসি পায়। আমরা না হয় ঘরের মানুষ, কিছু মনে করব না, কিন্তু সেদিন দু-চারজন অতিথি খাওয়াতে হলে কী ব্যাপারটা হত বল দেখি?
—সে তো আর ইচ্ছে করে করিনি, ভুল হয়ে গিয়েছিল।
—তা বটে, কিন্তু বিনু ঠাকরুণ সেদিন থেকে সত্যি তোমার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন। আজ আবার কী মতিগতি হল, রাঁধতে দিলেন। সৌভাগ্য তোমার, তুমি সে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে না, পাস হলে, আরে বৈকুণ্ঠ যে!
একটি মাঝবয়সি লোক পথ দিয়া যাইতেছিল। গোঁসাই-এর ডাকে থামিল।
—তোমরা একটু বসো, আমি আসছি! রতন লোকটির কাছে গিয়া কী কথা বলিতে বলিতে পথের বাঁকে অদৃশ্য হইল।
ললিতা চুপ করিয়া বসিয়াছিল। এবার চিত্তর দিকে মুখ তুলিয়া হাসিল। চিত্তও হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি বাইরে গেলে অতবড় ঘোমটা দাও কেন?
-এমনি!
–পাছে আমরা দেখে ফেলি, না!
–দূৎ, তার জন্য নয়। সে বালাই কার থাকে? যার— ললিতা মাঝখানে থামিয়া গেল। চোখের দৃষ্টি করুণ।
চিত্ত সেদিকে কান না দিয়া বলিল, হ্যাঁ খুব বুঝি রূপ না? খুব সুন্দরী?
ললিতা মুচকি হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ খুব সুন্দরী। পুকুরে জল আনতে গিয়ে জলে যখন ছায়া পড়ে, প্রথমে ভয়ানক কাঁপতে থাকে, ছায়াগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তারপরে একটু পরে ভাঙা ছায়া জোড়া লাগে, আশ্চর্য হয়ে দেখি, সে কী অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে কলসি কাঁখে করে দাঁড়িয়ে আছে, আমার দিকে চেয়ে হাসছে। জলকে নেড়ে দিতে ভয় করে, তাহলে ঢেউ হবে, আর মেয়েটি হারিয়ে যাবে। আমার জল ভরা আর হয় না। শেওলাভরা সিঁড়ির উপর বসে পড়ি। আর চেয়ে থাকি–ললিতা আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
-ইস, এত অহঙ্কার। তারপর আর আছে?
ললিতা বলিল, নিশ্চয়ই আছে। সে আর একদিন বলব। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া চিত্ত বলিল, সেদিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে গান গাইলে, চমৎকার গান, সেই থেকে তোমায় আমি চিনি। কতো বছর এখানে এসেছ?
-কতো বছর আবার? বারোটা মাসও তো হয়নি গো। যেদিন প্রথম এলাম, তখন খুব ছোটো ছিলাম।
–নাকি?
—আর এখন কতো বড়ো হয়ে গেছি, অনেক বড়ো।
—এক বছর না যেতেই?
—হ্যাঁ। ললিতা নীরবে হাসিল।
চিত্ত বলিল, আচ্ছা, এমন চমৎকার গলা পেলে কোথায়
–তার এক কাহিনি আছে।
—সবটার পেছনেই ইতিহাস? কী সে ইতিহাস শুনি?
ললিতা বলিল, সকলেই অনুযোগ করত, সবই যখন আছে, গলার সুর নেই কেন? আমিও ভাবলাম সত্যি তো, কিছুরই তো অভাব নেই, তবে গলায় গান নেই কেন? ঠিক এই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াতে লাগল আমার মনে, বোধ হয় দিনরাত। ইচ্ছে যদি তেমন হয়, উপায় একটা তার হয়ই। আমারও হল। রাতের স্বপ্ন বন্দিনী হল হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেই গানের সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্নও এল, যার জন্যে সারা জীবন চোখের জল ফেলেও সান্ত্বনা মেলা ভার।
—সেটা কী?
–তা অন্যদিন বলব।
চিত্ত হাসিয়া ফেলিল, তোমার কোনো শেষই কী আজকে শেষ হবে না? ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছ কেন?
—তাতো আমি নিজেই কিছুই জানিনে।
বোধহয় তোমার ওটা স্বভাব।
–স্বভাব?
–হ্যাঁ। এক একজনের এক একটি স্বভাব থাকে, যা নিতান্ত নিজের, যা অন্য কারুর সঙ্গে মেলে না। যেমন ধরো আমার স্বভাব, রোজ এখানে আসা—
-কেন? ললিতা মুচকি হাসিয়া বলিল।
চিত্ত কী যেন বলিতে যাইতেছিল এমন সময় রতন দেখা দিল, নিজের পরিত্যক্ত আসনে আবার বসিয়া বলিল, এক কান্ড ঘটেছে।
ললিতা উৎসুক চোখে তাহার দিকে চাহিল। চিত্ত জিজ্ঞাসা করিল, কী?
কোনো ভালো খবরেই রতন বশীভূত নয়, অন্তত বর্ণনার দিক দিয়া। বেশি হৈ চৈ করা তাহার স্বভাব বিরুদ্ধ।
রতন বলিল, নদীর ঘাটে একটা মড়া এসে লেগেছে।
–মড়া!
–হ্যাঁ! মড়া একটি মেয়ে, জলে থেকে ফুলে নাকি ভয়ানক দেখতে হয়েছে। তার ওপর পেটে আবার নাকি একটা সন্তান। আত্মহত্যা না সাপের কামড়ে মরেছে। কে জানে?
চিত্ত বিস্ময়ে বলিল, তুমি দ্যাখোনি?
-না, শুনলাম। খুব ভিড় হয়ে গেছে সেখানে।
—আমি যাই, চিত্ত উঠিয়া বলিল, কোনখানে, খেয়াঘাটে তো?
—হ্যাঁ। চিত্ত চলিয়া গেল।
ললিতা এতক্ষণ একটি কথাও বলে নাই, আশ্চর্য হইয়া সব শুনিতেছিল, এখন। মুখ নীচু করিয়া কী যেন ভাবিতে লাগিল।
রতন বলিল, তোমার কী মনে হয় ললিতে, আত্মহত্যা?
—হ্যাঁ।
হাটের একটানা সোরগোল। বেলা গড়াইয়া যাইতেছে, বিকাল হইতে বেলা বাকি নাই।
সকলেই মড়াটি দেখিয়া আসিয়াছে, আবরণহীন বিপুল দেহ, ফুলিয়া পচিয়া একটি বিশ্রী গন্ধে সেখানের বাতাস ভরপুর।
ললিতা ঠিকই বলিয়াছে, জানা গেছে, মেয়েটি আত্মহত্যাই করিয়াছিল। গাঁয়ের মধ্যে এমন একটা ঘটনা অভিনব বটে। আলোচনার আর শেষ নাই। রতনের ওখানেও জমিয়া উঠিয়াছে।
রাত্রি দশটা হইবে। সকলেই কিছু না কিছু বলিয়াছিল। চুপ করিয়াছিল কেবল ললিতা। সে ঘরের ভিতর বসিয়াছিল। বৈঠক হইতে নিঃশব্দে চিত্ত উঠিয়া গেল। আজ এতক্ষণে মাত্র চাঁদ উঠিয়াছে। বনানী কথা বলিতে শুরু করিয়াছে। পায়ে হাঁটা সাদা পথ টুকরা জ্যোৎস্নায় মনোরম। সৌন্দর্য আহরণের নেশায় চোখ বুজিয়া আসে, পা ফেলা মন্থর, দেহ শিথিল। কিন্তু বুকে হাত রাখিয়া সে হাঁটিতে লাগিল। পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্রের উৎস উপভোগে বঞ্চিত এক অনাগত আত্মা জ্যোৎস্নালোকিত শুকনো বালুচরে নিঃশ্বাস না ফেলিয়া ঘুমাইতেছে।
বহিরাবরণ তাহার মা, নিজের মূঢ়তায় অন্যকে মারিবার বেদনায় এখনও বোধকরি তাহার চোখের জল শুকায় নাই।
সেখানে মড়াকে ঘিরিয়া লোক জমিয়াছিল অনেক, নানা জনে নানা কুৎসিত মন্তব্য করিয়াছিল, ওদিকে ললিতাও ঠিক এই কথাই ভাবিতেছিল। কিন্তু আর একটা জিনিস যাহা তাহার মনের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল তাহা হইল ভয়।
ইস, কী ফুলিয়াছে রে বাপু। কী বিকৃত মুখের ভঙ্গি, কেমন বিশ্রী গন্ধ। ললিতা শিহরিয়া উঠিল।
আচ্ছা এইমাত্র ভাঙিয়াছে। রতন একা কতক্ষণ বসিয়া, উঠিয়া ঘরে গেল। একপাশে কাঁপিয়া কাঁপিয়া তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছে। সেই আলোয় দেখা গেল, ঘরের এককোণে মাটির উপরেই ললিতা পড়িয়া ঘুমাইতেছেঃ শরীর কুঁচকানো, মাথায় একটি, আর এক হাত বুকের উপর ন্যস্ত।
রতন কিছুক্ষণ তেমনি নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর কাছে গিয়া ডাকিল, ললিতে। কোনো উত্তর আসিল না।
-ওগো ললিতে, ললিতে।
—কে? ললিতা জাগিয়া উঠিল।
—এই তো আমি! হঠাৎ সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়িয়া যাওয়ায় সে ভয়ে সংকুচিত হইয়া বসিয়া রহিল। মুখে কোনো শব্দ নাই, আলোর দিকে স্থির দৃষ্টি। রতন বলিল, একেবারে খালি যে, ওরা সব কোথায় গো?
-দক্ষিণের ঘরে বোধ হয়।
–কিন্তু তুমি এখানে একা কেন? রতনের চোখ নিবিড় হইয়া উঠিল, বলিল, না খেয়ে দেয়ে এখনই ঘুমুচ্ছো!
—টেরও পাইনি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ললিতা দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল, ওদের ডাক দেব?
—না।
—তবে কি? ললিতা তাহার দিকে কতোক্ষণ চাহিয়া কী মনে করিয়া আঙিনায় গেল, কাহাকে যেন খুঁজিল, তারপর বাঁশের খুঁটি চাপিয়া নিঃশব্দে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। এখন মাথার উপরে চাঁদ, জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করে উঠানটি, গাছের নীচে সেই ভাঙা নরম আলো। পৃথিবী ভরিয়া রূপের প্রবাহ বহিয়া গেছে, সে দিকে চাহিয়া চক্ষু বুজিয়া আসে, বুকে নিঃশ্বাস ভরিয়া ওঠে।
কিন্তু বাহিরের পৃথিবীর তুলনায় মনের কোণ শূন্য, কেবল শূন্য। সেই মরুভূমিতে কাহার হাতের স্পর্শ, ওই জ্যোৎস্নার মতো নরম, বুলাইয়া গেছে। কিন্তু কী জানি কেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। যেন বিশুর সেই আগ্রহের মূলে শ্মশানবাসী খেয়ালই বেশি।
পিছনে দরজার চৌকাঠ ধরিয়া রতন চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ললিতা দেখে নাই, টের পাইলে সে হয়তো ভীষণ চমকিয়া উঠিত।
পর দিন ভরা দুপুর মাথায় করিয়া চিত্ত আসিল জল খাইতে। অন্তত তাহার কথায় এই বোঝা যায়। ললিতা তখন রাঁধিতেছিল, হাসিয়া বলিল, কেন গো এমন অসময়ে?
খুঁটি ধরিয়া চিত্ত বলিল, তেষ্টা পেয়েছে।
বিস্ময়ে ললিতার চোখ বড়ো হইল : তা বলে অতদূর থেকে এলে? বাড়িতে জল নেই? আচ্ছা এ কী রকম তেষ্টা?
-আরে বাপরে; সে ভয়ানক তেষ্টা, ছাতি ফেটে যাচ্ছে, পেট চোঁ চোঁ করছে, বুক শুকিয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না, এ কী, দাঁড়াতেও তো পারছি না গো। চিত্ত বসিয়া পড়িল।
তাহার ভঙ্গি দেখিয়া রুদ্ধ হাসিতে ললিতার ফর্সা মুখ যেন ফাটিয়া পড়িতেছিল। চিত্তর জলের তৃষ্ণা সত্যি পাইয়াছিল কি না জানা যায় নাই কিন্তু সে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল; কপালে আর তীক্ষ্ণ চিবুকে অল্প ঘাম, ঠোঁটে হাসি, কপালে আর গালের পাশে কিছু শুকনো বিপর্যস্ত চুল।
ললিতা হাত ধুইয়া জল আনিয়া দিল। চিত্ত অল্প একটু খাইয়া গ্লাসটি এক পাশে রাখিয়া বলিল, আজ প্রসাদ দেবে? তোমার রান্নার নাকি তুলনা নেই?
-কে বলে?
—সকলের মুখে তাই শুনি, বিশেষ গোঁসাই তো প্রায়ই বলেন।
—গোসাইজি? ললিতা মুচকি হাসিল।
–হাসলে কেন?
–এমনি।
কোনো কারণ না থাকলে এমনি কেউ হাসে?
ললিতা চুপ করিয়া রহিল।
চিত্ত বলিল, বললে না?
—এমনি গো এমনি, ললিতা হাসিয়া অন্য কথা পাড়িল; —খাওয়া হয়েছে?
-তা তো মনে নেই।
–খেলে কী না খেলে তাও মনে নেই, হা ভগবান! খিদের ব্যাপারে মানুষ কী করে ভুলে যায়? তুমি কী করে ভুললে?
চিত্ত বলিল, কে বলে আমি খিদের জ্বালা ভুলেছি? তার জ্বালায় একেবারে জর্জরিত। তাই তো বলছিলাম প্রসাদ দিতে। দাও, দাও, ওগো ললিতে
ললিতা হাসিয়া ফেলিল, মাছরাঙা দেখেছো?
—দেখেছি।
–সেগুলোকে আমার ভালো লাগে না।
—কেন?
–তা ঠিক বলতে পারব না, কী জানি কেন!
–ও, চিত্ত বলিল, আচ্ছা চাতক দেখেছো?
–দেখেছি।
—ওই পাখিটা আমার দু-চোখের বিষ।
–কেন?
চিত্ত বলিল, কেমন হাঁ করে বৃষ্টির আশায় চেয়ে থাকে ভিক্ষুকের মতো, ভয়ানক অলস, সবই আরামে পেতে চায়। আর পেটভরা অহংকার।
ললিতা আবার হাসিয়া উঠিল, দুষ্ট!
চিত্ত বলিল, কেমন, হয়েছে তো? আমারও মুখ আছে।
-আরও বলবে?
–বলব না? বলবই তো!
চিত্ত চুপ করিয়া রহিল।
কতক্ষণ ব্যস্তভাবে এটা ওটা নাড়িয়া আড়চোখে ললিতা চাহিয়া দেখিল, একটু পরে মুখ ফিরাইয়া বলিল, রাগ করেছ?
–না, চিত্ত হাসিয়া ফেলিল।
ললিতা সহজ হইয়া বলিল, আমি তো কোনো কাজই করতে পারছিনে। তোমার সঙ্গে কেবল গল্প করছি। কখন একটা অঘটন ঘটে, হাত পুড়ে যায়, কে জানে?
চিত্ত বলিল, তা কখনো পুড়বে না, আর যদি পোড়েই তখন কি করব জানো?
জানি?
—কি জানো বলো।
ললিতা তবু চুপ।
–বলো।
—তোমার ওই কালো চোখ চেপে ধরবে আমার ব্যথায়।
–তারপর?
—তারপর চোখ থেকে বেরিয়ে আসবে জল, মুছে দেবে আমার ব্যথা, আমার মন তখন খুশিতে ভরে উঠবে।
আনন্দে চিত্ত তাহার হাত বাড়াইয়া দিল।
কিন্তু ললিতা চকিতে আর একপাশে সরিয়া হাসিমুখে অর্ধেক সুর মিশাইয়া গাহিল : বঁধু ছুঁতে করেছি মানা–
-ওগো ললিতে, ডালনা হয়েছে? বিনোদিনী আসিয়া উপস্থিত হইল।
চিত্ত একটু দাঁড়াইয়া চলিয়া আসিল। আর একদিন দুপুরবেলা আঙিনায় বসিয়া ললিতা একটা আসন তৈরি করিতেছিল। আখড়ার প্রায় সবাই ঘুমাইয়াছে, কাহাকেও দেখা যায় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। অলস, মন্থর গতিতে সময় চলে।
বাতাস একটুও নাই।
ললিতা একমনে রঙিন সুতায় ফুল তুলিতেছিল; গলায় গানের একটা কলি। কাছেই অপ্রশস্ত পথে শুকনো পাতায় মর্মর উঠিল, কে যেন যাইতেছে। সে মুখ তুলিয়া দেখিল, চিত্ত। সে খুশি হইয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িল। চিত্তর একবার এদিকে চোখ পড়িয়াছিল। সে কাছে আসিয়া বলিল, একা কী করছ? গোঁসাই কোথায়?
–ঘুমুচ্ছেন।
চিত্ত বলিল, এক গ্লাস জল খাওয়াবে?
–আবার সেই জল, ললিতা হাসিয়া কোল হইতে আসন রাখিয়া উঠিল। জল খাইয়া চিত্ত বলিল, একটা পান? ললিতা পান আনিয়া দিল। চিত্ত সেটা মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে বলিল, কী সেই গানটা সেই যে ভজহরি গাইত।—অর্থটা বেশ মনে আছে।
কী অর্থ, গানটা কে যে গাহিত তাহা হঠাৎ ঠিক করতে না পারিয়া ললিতা জিজ্ঞাসা করিল।
অর্থটা হচ্ছে, তোমারই দেওয়া পানে রাঙিয়া ঠোঁট ছাপ এঁকে দেব তোমার সাদা ঠোঁটে। চিত্ত তাহার পানে চাহিয়া নীরবে হাসিতে লাগিল।
ললিতার মুখ রাঙা হইয়া উঠিল, সে তাড়াতাড়ি আসনটা হাতে লইয়া বলিল, একটা কাজ করবে?
বল?
–এখানে আমার নামটা লিখে দাও না, আমি তুলব।
চিত্ত হাসিয়া বলিল, কী দিয়ে লিখব?
—দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।
চিত্ত সযত্নে নাম লিখিয়া দিল।
কতোক্ষণ চুপচাপ।
সে বলল, তোমার সেই গল্পটা তারপর কী হল!
–সেই যে ছায়া দেখে জলভরা আর হচ্ছে না?
–হ্যাঁ।
—তারপর কততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম হুঁশ নেই, একটা ডাকে হঠাৎ চমকে উঠে দেখি সন্ধ্যার বাকি নেই, পুকুরে ছায়া নেমেছে, জলের রঙ হয়ে গেছে কালো, বাতাস হয়েছে স্থির। কী আর করি, কলসিতে জল ভরে ছায়া ভেঙে রাগ করে চলে এলাম। রাগ আর কারুর ওপর নয়, নিজের ওপর! আমি কী পাগল হয়েছি! কিন্তু কে জানত তখন, একরকম মানুষ আছে, নিজের থেকে পরের ওপর মায়া তাদের বেশি, নিজের চেয়ে পরের সম্বন্ধে তারা বেশি সচেতন? লম্বাপানা লোকটা, চমৎকার চেহারা। এত কথা বলতে পারি কিন্তু সেদিন কী হল মুখে কিছুই এল না। এমন নাকি হয়। এর মূলে নাকি আর কিছুই নয়, শুধু ভালো লাগা! যাই হোক তাড়াতাড়ি চলে এলাম এই ভেবে, লোকটি হারিয়ে যাবার নয়। আমার অতি কাছেই সে সারাক্ষণ থাকে।—পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চিত্তর দিকে একবার চাহিয়া ললিতা হাসিয়া ফেলিল। চিত্ত তাহার একটি হাত ধরিয়া বলিল, আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে, আমাকে পেছনে রেখে মেয়েটি চলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে আমার দৃষ্টিপথ থেকে, কিন্তু মনের পর্দায় আরও উঠছে জেগে, আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।-ওগো ললিতে।
-কী গো!
চিত্ত তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া চুপ করিয়া রহিল, অনুভব করিল তাহার হাতের উষ্ণতা। একটু হাসিয়া ললিতা তাহার হাত ছাড়াইয়া লইল। একটু পরে আবার ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
—হাসছ যে?
—ভাবছি আজ কতো কথাই না বললাম। এক একটা দিন এমনি হয়, না?
—হ্যাঁ।
-নইলে কে জানতো, তুমি আসবে এখন? ললিতা আবার হাসিল। তাহাকে যেন একটা রোগে পাইয়া বসিয়াছে। কিন্তু চিত্ত ইহাই চায়। হাসিলে এত সুন্দর দেখা যায়, সে আগে কখনো এরকম দেখে নাই। সে বলিল, আসনটা কার জন্যে করছ?
-যে বসবে তারই জন্যে।–গোঁসাই?
-আজ তবু একটু ঘুমিয়ে নিলুম, দুজনকেই ভয়ানক আশ্চর্য করিয়া রতন দেখা দিল, বলিল, দুপুরবেলা কখনো আমার ঘুমের অভ্যাস নেই, আজ কী জানি কেন হল! চিত্ত কখন এলে, আরও আগে?
চিত্ত কিছু বলিল না।
রতন দুজনের দিকেই একবার করিয়া চাহিয়া বলিল, ললিতা ভারী কাজের মেয়ে, এদিক দিয়ে অমন যে বিনু ঠাকুরণ তাকেও হার মানায়। কী ললিতে, বসবার একটা কিছু দাও?
ললিতা উঠিয়া আসন আনিয়া দিল।
বসিয়া রতন বলিল, কালিচরণ আসবে বলেছিল, ওর জন্যেই কতক্ষণ বসে, কী আর করি, শুয়ে পড়লাম। ব্যাটার কী কথার ঠিক আছে, বলছে না ঝুলন পূর্ণিমার সময় খরচ করবে, দেখো সব মিছে কথা। তারপর তুমি যখন এসেছিলে কাউকে দিয়ে ডেকে আনলেই তো পারতে। দিনে ঘুম সইতে পারি না, পরে আর কিছুই ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ নিশ্চয়ই এসেছো? রতন টের পাইয়াছিল আগেই। চিত্ত সংক্ষেপে বলিল, হ্যাঁ।
রতন বলিল, ললিতাও আমারই মত। কুঁড়েমি কাকে বলে জানে না।
—তবে একবার গল্প পেলে-চিত্ত উঠিয়া পড়িল।
–যাচ্ছ?
–হ্যাঁ।
–আবার কখন আসবে?
–সন্ধ্যাবেলা।
চিত্ত চলিয়া গেল। রতন কতোক্ষণ তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিল, ললিতাও কখন সরিয়া গিয়াছে।
আজ অনেকদিন পরে আবার বিকেলবেলা চিত্ত পুকুর পারে ছিপ লইয়া বসিল। কাছে একটি লোকও নাই, কেবল পার ঘেঁসিয়া কয়েকটা গোরু ঘাস খাইতেছে।
বড়শি ফেলিয়া সে নিস্তরঙ্গ জলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।
আকাশে একটুকরো মেঘ নাই। বাতাসও নাই। পুকুরের চারদিকের গাছের পাতা নড়ে না। ওদিকের তালগাছটায় বসিয়া কয়েকটা শকুন বোধ হয় ডানা নাড়িতেছে, তাহারই শব্দ মাঝে মাঝে কানে আসে। দিকচক্ররেখা, চিত্ত যে জায়গায় বসিয়াছে, সেখান হইতে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যায়, পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশ, দীর্ঘ, সোজা উজ্জ্বল আলোর রেখার সমষ্টি।
চিত্ত যেন অতি সন্তর্পণে কী লক্ষ করিতেছেঃ তাহার মনে হাস্যমুখী এক মেয়ে ছায়া ফেলিয়াছে। সিঁথি বিহীন চুল টান করিয়া বাঁধা, চোখ দুটিতে হাসি ঝরিয়া পড়ে, ঈষদুন্মুক্ত ঠোঁটে কত কথা যেন থামিয়া আছে।
ললিতা যেন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহার চোখের সামনে। হাত বাড়াইয়া চিত্ত তাহাকে ধরিতে গেল কিন্তু সে তাহার হাত সরাইয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে ঘরে দৌড় দিল। যেন বিদ্যুৎ।
চিত্ত তাহার পিছনে পিছনে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়া দেখিল, ললিতা মুখে হাত চাপিয়া ঘরের এককোণে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
সে কাছে গিয়া তাহার কাঁধে দুই হাত রাখিল।
বলিল, হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছো যে!
হাত দুইটি সরাইয়া দিতেই ললিতা আবার ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
চিত্ত নত হইয়া বলিল, ঠোঁট ছুয়ে থামাব নাকি হাসি?
ললিতা যেন একটা অবলম্বনের মতো তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল।
একটু পরে চিত্ত বলিল, ওগো ললিতে আজও তোমার কাছে একটা পান চাইছি!
—এই ভর সন্ধ্যেবেলা, এখন কতো কাজ! ললিতা বলিল,-আলো জ্বালাতে হবে না?
তাহার হাত ধরিয়া সে বাহিরে আসিল।
এখনও একটু আলো আছে, সব অস্পষ্ট দেখা যায়। এমন সময় তাহারা দেখিল, ঠকঠক শব্দ করিয়া খড়ম পায়ে রতন এদিকে আসিতেছে।
চিত্ত চলিয়া যাইতেছিল কিন্তু সে ডাক দিয়া বলিল,-কোথায় যাচ্ছ গো, আমি যে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সঙ্গে কদিন ধরে ভালো করে কথা বলতেই পারছি না। এসো, বসো।
রতনও বসিল। বলিল, ললিতে এখনও আলো জ্বালাওনি, কখন জ্বালাবে বল? তোমাদের কী সে দিকে হুশ আছে।
সে চিত্তর দিকে একবার চাহিল।
চিত্ত অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রাখিল।
তালপাতায় ডানার ঝাপট। চিত্ত স্বপ্ন হইতে চমকিয়া উঠিল, দেখিল : অন্তদৃষ্টির সীমানায় ললিতা অদৃশ্য হইয়া গেছে, আর কিছুই নাই, ধু ধু করে শূন্য মরুভূমি।
সূর্য অস্ত গেছে। সে বঁড়শি গুটাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। পথে আসিয়া পাশের ঝোপে ছিপটা রাখিয়া সে রতনের ওখানে চলিল।
ঘরের বাহিরে কেহ নাই। চিত্ত চারিদিকে চাহিল, কাহাকেও দেখা যায় না। আখড়ার পূর্বদিকে মেহেদি গাছের বেড়া ঘেরা একটি ছোটো বাগান আছে। চিত্ত সেখানে গিয়া দেখিল, সাজি হাতে ললিতা ফুল তুলিতেছে। সে তাহাকে লক্ষ করে নাই।
কাছে গিয়া চিত্ত ডাকিল, ললিতে। ললিতা চকিতে তাহার পানে চাহিয়া হাসিল।
-ফুল তুলছ?
–হুঁ। দাঁড়াও, হয়ে গেছে প্রায়।
চিত্ত বলিল, ইস, এত ফুল দিয়ে কী করবে? আমাকে একটা দাও না, ওই যে গোলাপ ফুলটা—
তুমি নেবে? ললিতা খুশি হইয়া ফুলটি ছিঁড়িয়া আনিয়া দিল।
চিত্ত বলিল, আর সব কোথায়?
–মাধবদির মেলায় গেছে।
–গোঁসাইও?
–না। তিনি ওদিকে এইমাত্র কোথায় যেন গেলেন।
ললিতা বাগান হইতে বাহির হইয়া ঘরে ফুল রাখিয়া আসিল। চিত্ত আঙিনায় একটা সিঁড়ির উপর বসিয়া পড়িয়াছে।
ললিতা কতটুকু পুরোনো কাপড় আনিয়া সলিতা পাকাইতে বসিল।
চিত্ত বসিল, তোমার কথা মনে হতেই চলে এলাম। ভেবেছিলাম আসব না।
ললিতা হাসিয়া বলিল, আমি তাহলে ভাগ্যবতী।
চিত্ত বলিল, গোঁসাইর মনে আমার উপর রাগ জমে উঠেছে। আমি লক্ষ করেছি। তোমার কী কোনো অসুবিধে হচ্ছে সে জন্যে?
-একটুও না।
-তাই! সে তোক ভালো আমি জানি, কিন্তু পৃথিবীতে এমন কতগুলো ব্যাপার আছে যাতে ভালো থাকা যায় না। ওকে আমার ভালো লাগে, বিশ্বাস করো ওর ওপর আমার এতটুকু রাগ নেই! যদি উপায় থাকত তবে ঠিক আগে যেমনটি ছিল তেমনটি হওয়া যেত।
নতমুখী ললিতা সলিতা পাকাইতেছিল।
চিত্ত বলিল, কিন্তু উপায় যে নেই। সেই কবে ছিল যাওয়ার কথা, এখনও যাইনি কেন জানো?
-জানি গো জানি।
—কী জানো?
ললিতা হাসিয়া বলিল, বলতে পারব না!
চিত্ত বলিল, প্রথম যে দিন তোমাকে দেখি, সে দিনে তুমি যে গানটি গেয়েছিলে তার রেশ এখনও আমার মনের অনেক উঁচু পর্দায় উঠে বাজছে, আমার খুব ভাল লাগছে। ললিতে—
ললিতা খিল খিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, ও মা বলে কী গো। এত আমি সইব কী করে?
ললিতা হাসি চাপিয়া সুর ধরিল—
ওগো সুখের জোয়ারে ভাসিছে আমার মন ভাবি নাই কভু, লুকায়ে কোথা ছিল। এমন ক্ষণ।
ললিতা আলো জ্বালাইয়া দিল। এমন সময় রতন আসিয়া উপস্থিত।
রতন বলিল, চিত্ত এমন চুপ করে বসে থাকায় কী লাভ? গল্প করো। আমি বাপু মুখ বুজে থাকতে পারিনে, তোমরা একে দোষই বলো আর যাই বলো।
চিত্ত এতক্ষণে একটু হাসিল, বলিল, তুমিই বলো, আমার পুঁজিতে আর গল্প নেই।
–তা আমার বেলায় থাকবে কেন? রতন চকিতে একবার ললিতার দিকে চাহিয়া বলিল, সে থাক, আমিই বলি শোনো। আমি তখন আমাদের বাড়ি শান্তিপুরে থাকি, অনেকদিন আগের কথা, আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল, দিশি কুকুর, গায়ের রঙ সবখানেই কালো কেবল পা আর মুখ ছাড়া, সেখানে সাদা রঙ। মাঝারি গোছের দেহের আয়তন, পা দুটি খাটো, লেজটিও কে যেন কেটে দিয়েছিল। সে যাই হোক আমরা কুকুরটাকে খুব ভালোবাসতাম। ওটাও আমাদের খুব পোষ মেনেছিল, আমরা যা খেতাম সব ওকে দিতাম, দরকার হলে ভালো জিনিস আমিও ওকে খাওয়াতাম। ওর শোবার জায়গা পর্যন্ত করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য, একদিন হল কী, আমারই ছোটো বোনকে সে অনর্থক কামড়ে দিল। আমরা তো সকলেই অবাক, এ কেমন করে হয়!
ভিতরের ইঙ্গিত ধরিয়া কোনোরকমে বিরক্তি চাপিয়া চিত্ত উঠিয়া পড়িল, রতন ইহা দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত ধরিয়া বলিল,-যাচ্ছো কেন, শেষটুকু শুনে যাও!
-না, আমি যাই, আমার কাজ আছে!
—শুধু আমার বেলাতেই কাজ না? দাঁড়াও শেষটুকু তোমায় শুনতেই হবে। রতন হাত ছাড়িল না। মুখটি অস্বাভাবিক কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
-কী আরম্ভ করেছে গোঁসাই? ছেড়ে দাও আমি যাই। ললিতা স্তব্ধ হইয়া দেখিতেছিল। হাত না ছাড়িয়া রতন উষ্ণ স্বরে বলিল, তারপর আমরা ভাবলাম এ কেমন করে হয়। এতকাল যাকে বাড়ির লোকের মতই আদর করেছি, খাবার দিয়েছি, ভালবেসেছি, সে কেন এরকম করলে? কৃতজ্ঞতা বলে কোনো জিনিসই কী নেই? এ ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে? তাই যদি না থাকে তাহলে তো আমি তোমাকে মেরে ফেলতে পারি, তুমিও আমাকে মেরে ফেলতে পার, ললিতাও পারে। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, পৃথিবীতে এমন একশ্রেণির জীব আছে যারা খুব প্রিয়জনের বুকেও ছুরি বসাতে পারে, এতটুকু দ্বিধা করে না, যাদের শিরা উপশিরায় বিভীষণের রক্ত, চোখে কংসের দৃষ্টি, ওই তাদের মতো, যারা তলে তলে ভয়ানক খেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওপর দেখে কিছুই বোঝা যায় না। এ ছাড়া অন্য কিছুই না! চিত্ত আর পারিল না, জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।
ললিতা দ্রুত ঘরে গিয়া দু-হাতে চোখের জল চাপিল।
রতন ঘরের দিকে একবার চাহিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া স্তন্ধের মতো বসিয়া রহিল। এত রাগ তাহার কোনোদিনও হয় নাই।
বাহিরের অন্ধকার আরও গাঢ়তায় চাপিয়া আসিয়াছে। একটানা ঝি ঝি পোকার শব্দ। কিছুদূরে কামার বাড়ির লোহা ঠুকিবার আওয়াজ।
রতন দুই হাঁটুর উপর হাত রাখিয়া, তার উপরে মুখটি স্থাপন করিয়া বসিয়া রহিল। চোখ দুইটি তাহার অকারণ জ্বালা করিয়া উঠিতেছে।
একটু পরেই বিনোদিনীরা আসিল। রতন তখনও বসিয়া আছে। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া ঘরে গিয়া দেখিল, ললিতাও ওপাশের দরজায় চৌকাঠ ঘেসিয়া বসিয়া আছে, মুখ হাঁটুর ভিতরে। সে আন্দাজে কিছু একটা কল্পনা করিয়া মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, কী গো ঠাকরুণ, রাত বারোটা না একটা বেজেছে যে ঘুমে মুখ তুলতে পারছ না? আমরাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ গো! নিজের রূপের জ্বালায় দেখি চোখে-মুখে পথ দেখতে পাও না। অত অহংকার ভালো নয় বলে দিচ্ছি।
ললিতা তবু মুখ তুলিল না।
আঙিনা হইতে রতন বলিল, ঘুমুচ্ছে নাকি?
—হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমি কী মিথ্যে বলছি? বিনোদিনী বাহিরে আসিয়া বলিল, বয়স তো আমাদেরও একদিন ছিল কিন্তু ভর সন্ধ্যায় ঘুম কাকে বলে সে তো কখনো জানিনি!
রতন সায় দিয়া বলিল, ওকথা আর বলো না বিনুঠাকরুণ, তোমার পায়ের ধুলোর যোগ্য তো ও নয়।
বিনোদিনী খুব খুশি হইয়া কাছে আসিয়া বলিল, এ বেলা শুধু দুধ খাবেন বলেছিলেন, এখন আনব?
-না থাক।—রতন তাহার হাত ধরিল। বিনোদিনী চারিদিকে একবার চাহিয়া নিজেকে ছাড়িয়া দিল।
কালীচরণ কথা রাখিল ঠিকই।
ঝুলন পূর্ণিমার রাত্রি। অনেক লোক জমা হইয়াছে। একটু বেশি রাতে কীর্তন আরম্ভ হইবে, এখন গল্প চলিতেছে, রতন রোজ যেখানে বসে সেইখানেই বসিয়া, আর চারিদিকে অন্যান্য সব লোক। সকলের শেষে গাওয়া হইবে। কালীচরণ এখন গাঁজার সরবরাহে ব্যস্ত।
সমস্ত লোকগুলির মাথার উপরে রাশি রাশি ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। মাঝে মাঝে মৃদু গুঞ্জন। রতনের আস্তে মিষ্টি কথা।
রাত্রি একটু বাড়িলে পর কীর্তন আরম্ভ হইল। রতন গান গায় না ঠিকই সে চুপ করিয়া বসিয়াছিল, ইতিমধ্যে চিত্তও কখন আসিয়া এককোণে নীরবে বসিয়াছে। রাগ করিতে সে পারে না। রতন তাহাকে লক্ষ করিল কিন্তু ডাকিয়া কিছু বলিতে পারিল না। সেদিনের ব্যাপারটা মনে করিয়া আজ তাহার সত্যি দুঃখ হইতেছে।
সময়ের কাঁটার চলার বিরাম নাই। উৎসবরত মানুষেরও সেদিকে খেয়াল নাই।
বাহিরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আলোর স্পর্শে বিবশ পৃথিবী। গাছপালা সব যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে রাত্রি বাড়িয়া চলে। কাহারও চোখে ঘুম নাই আজ। রতন তেমনি বসিয়া আছে, চোখ দুটি যেন কী এক নেশায় নিবিড়!
তখন রাত্রির শেষ প্রহর। লোক এখন আগের মতো নাই। রতনের চোখের নিবিড়তা আরও গভীর হইয়াছে, বুক ভরিয়া নিঃশ্বাস উঠিতেছে। সে উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু এ ঘর-সে ঘর ঘুরিয়াও যাহাকে খুঁজিতেছিল তাহাকে পাইল না। ললিতা নাই। রতন তাড়াতাড়ি আঙিনায় আসিয়া দেখিল চিত্তও নাই।
সে রাগে ঠোঁট কামড়াইতে লাগিল ভাঙা জ্যোৎস্লাঙ্কিত পথের উপর দিয়া তাড়াতাড়ি নদীর খেয়াঘাটে গেল। বর্ষার বিল, নদীর সঙ্গে এক হইয়া ধু-ধু করে।
শূন্যতায় বাতাস হা হা করে।
এই শেষ রাতের পৃথিবীতে রতন অনেকক্ষণ স্তন্ধের মতো দাঁড়াইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। দু-একটা জেলেনৌকা এদিক সেদিকে ঘুরিতেছে। তা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
রতন ফিরিয়া আসিল। আখড়া কিছু দূরে আছে। তাহার পিছনে একটা কুকুর আসিয়া জুটিল, সেটা হয়ত প্রথম হইতেই সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। রতন এই মুহূর্তে হঠাৎ উহাকে দেখিয়া ভয়ানক রাগিয়া গেল, পথ হইতে একটা ঢিল কুড়াইয়া চুড়িয়া মারিল কুকুরটার দিকে, কিন্তু লাগিল না। কুকুর পিছন দিকে দৌড় দিল।
তাহার এবার ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। সে আর একটা ঢিল লইয়া এবার এমন জোরে আর লক্ষ্যহীন ভাবে ছুঁড়িয়া মারিল যে কুকুরটা একবার ব্যথায় আর্তনাদ করিয়া সত্যি দৌড়াইয়া পালাইয়া গেল।
রতন তবু নিঃসন্দেহ হইবার জন্য কতোক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া লক্ষ করিল, কুকুরটা আবার আসে কি না। আসিল না। সে কতকটা নিশ্চিত হইয়া আগের জায়গায় গিয়া বসিল। এবং তখনও যে বাকি লোক অবশিষ্ট ছিল, তাহারা, বিনোদিনী ও আরও কয়েকটা মেয়ে অত্যন্ত বিস্ময়ে দেখিল : সুরে সুর মিলাইয়া রতন আজ গান গাহিতেছে।
ব্যাপারটা আশাতীত। আর সকলে গান থামাইয়া দিল। বিনোদিনী ঘর হইতে তাড়াতাড়ি একতারাটি আনিয়া রতনের হাতে দিল। সে সত্যই ভারী সুন্দর গান আরম্ভ করিল। বিনোদিনীর আজ খুশির অন্ত নাই; কারণ সে জানে, ললিতা চলিয়া গিয়াছে।
রানু ও স্যর বিজয়শঙ্কর
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু সান্ধ্যভ্রমণ শেষ হয়নি। পার্কের যেদিকটা জনবিরল সেখানে কখনো লাল কাঁকরের পথে, কখনো নরম ঘাসের উপরে স্যর বিজয়শঙ্কর নীরবে পায়চারি করছিলেন। অদূরে মানুষের ভীড় থেকে, যানবাহন পীড়িত পথের চলায়মান জনতা থেকে, একটানা কোলাহল শোনা যায়। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল আলো এসে পার্কের দেহাবরণ খুলে সমস্ত প্রকাশ করে দিয়েছে।
স্যর বিজয়শঙ্কর নিজের মন এদিক-সেদিক হাঁটছিলেন।
-বাবা, ও বাবা!
কান্নায় বিকৃত একটি ছোট্ট মেয়েলি স্বর যেন কাছে কোথাও শোনা গেল! স্যর বিজয় থমকে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হলেন।
-আপনি আমার বাবাকে দেখেছেন?
মেয়েটি তাঁর কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে—ফ্রকপরা, স্যর বিজয়শঙ্কর চশমা-চোখে সেই স্বল্পালোকেই তাকে দেখলেন। ঘাড় পর্যন্ত চুল, দু-হাত আর পা নিরাভরণ, মুখ চোখের জলে ভেজা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদছে।
-বলুন না, আমার বাবাকে দেখেছেন?
স্যর বিজয় তার ছোটো একটি সরু হাত ধরে বললেন, তোমার বাবা বুঝি হারিয়ে গেছেন?
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললে,—বাবা আমায় খুব ভালবাসে কি না, আমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে এমনি বেড়াতে আসি, আজও এলাম, কিন্তু বাবাটা কি দুষ্টু, আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেল, আমায় একবার ডাকলও না, আমি কত খুঁজলাম, এমন দুষ্টুমিতো বাবা কখনো করে না। আমি তো আর সব পথ চিনি না, কেমন করে বাবাকে খুঁজে বের করি! আপনি দেখেছেন আমার বাবাকে?
স্যর বিজয়শঙ্কর তার মাথায় হাত রেখে বললেন, দেখিনি, কিন্তু খুঁজে বার করে দেব, তুমি কেঁদো না খুকি। আচ্ছা, তোমার বাবার কেমন চেহারা বলো তো?
–আপনি যেমন লম্বা না, ঠিক এমনি লম্বা। কিন্তু আপনার মতো দাড়ি-গোঁফ নেই, আর থাকবেই বা কেন, আপনার মতো বুড়ো তো নয়—কিন্তু আমি একদিন দুপুরবেলা দেখেছি, মাথায় ছোটো একটা টাক, চুল পেকেছে খুব, আমি কত ফেলে দিই তবু পাকে!
কথার বেগে মেয়েটির কান্না কমে আসছিল। স্যর বিজয় পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে সস্নেহে মেয়েটির চোখের জল মুছে দিলেন। বললেন, খুকি, তুমি কেঁদো না। কোনো ভয় নেই, আমি তো আছি, তুমি কেঁদো না। আমি তোমার বাবাকে খুঁজে বার করে দেব।
মেয়েটি তাঁর মিষ্টি কথা শুনে, আর চেহারার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য দেখে কতকটা আশ্বস্ত হয়েছিল। ঘাড় কাত করে বললে, কলকাতার সব রাস্তা আপনি চেনেন?
কী একটু ভেবে স্যর বিজয় হেসে বললেন, তা নাহলে আর এত বুড়ো হলাম। কেমন করে বল? সব রাস্তা চিনি।
মেয়েটি মনে মনে তাঁর যুক্তি স্বীকার করল।
—রূপসিং?
–হুজুর?
স্যর বিজয়শঙ্কর মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, এসো।
প্রকান্ড গাড়ি। আর কেমন চকচক করে! মেয়েটি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। মাডগার্ডের ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, এটা আপনার গাড়ি! আমিও উঠব না?
—হ্যাঁ! স্যর বিজয় হাসলেন।
—কত দাম? তেমনি হাত বুলোতে বুলোতে সে জিজ্ঞাসা করলে।
স্যর বিজয় আবার হেসে বললেন, কুড়ি হাজার।
মেয়েটি আশ্চর্য হল না; কারণ কুড়ি হাজার কাকে বলে তা সে জানে না। কেবল চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগল।
–এসো। স্যার বিজয় ভিতরে গিয়ে বসে তাকে পাশে বসালেন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে বললেন, রূপসিং?
—হুজুর?
টাকা বার করে তিনি বললেন, কুছ টফি ঔর লজেন্স—
একটু পরে রূপসিং কতগুলো টফি আর লজেন্স এনে হাজির করল। সেগুলো সীটের একপাশে রেখে স্যর বিজয়শঙ্কর বললেন, তোমার ক্ষিদে পেয়েছে, না? খাও!
কিন্তু সেগুলো কয়েকটা হাতে নিয়ে মেয়েটি বসে রইল, আর তাঁর দিকে। তাকাতে লাগল—কেমন করে খাব?
স্যর বিজয় ওপরের কাগজ ছিড়ে তার মুখের কাছে ধরে হেসে বললেন, আচ্ছা, তোমার নাম তো বললে না?
—রাণু। মেয়েটি চিবুতে চিবুতে বললে।
রাজপ্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কক্ষসারির প্রতি জানালায় দেখা যায়। উজ্জ্বল আলো। কোলাহল নেই, স্তব্ধ পাষাণপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দু ধারে প্রকান্ড বাগান, চারিদিকে ঘিরে নীচু মেহেদির বেড়া, মধ্যে লাল পথ। বাতাসে নানা ফুলের সৌরভ। বিস্ময়ে অভিভূত রাণু প্রাণভরে সেই সৌরভ শুকতে লাগল। সে কী বলবে?
স্যর বিজয়শঙ্কর তার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। পায়ের নীচে রঙিন পুরু কার্পেট। রাণু নীচের দিকে চেয়ে-চেয়ে উঠতে হোঁচট খেল। আর, চারদিকে, কী আলো! মুক্তার মতো ঝরে পড়ে। জায়গায়-জায়গায় মানানসইভাবে ভাস্কর মূর্তি সাজানো। আর ঘরগুলো, যেন একেকটি মাঠ; কৌচ, আলমারি, নানা দামি আসবাবপত্রে ভরা, কেবল কার্পেটে মোড়া–কোথায় মেঝে? রাণু অবাক হয়ে ভাবে।
—এইখানটায় বসো। স্যর বিজয় একটা কৌচ দেখিয়ে দিলেন।
না ডাকতেই বয় এসে হাজির। স্যর বিজয়ের সিল্কের চাদর, জামা, লাঠি, জুতো ইত্যাদি খুলে রাখল।
দেখবার জিনিষের ভিড়ে রাণুর মনে সব জিজ্ঞাসা এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর দিকে গভীর দৃষ্টিতে কতোক্ষণ চেয়ে তারপর বললে, আচ্ছা আপনার দাড়ি এখান দিয়ে অমনি ছুঁচোলো হয়ে এসেছে কেন? রাণু নিজের ছোট্ট চিবুকটিতে হাত দিলে।
এরও আবার কারোর কাছে জবাবদিবি করতে হয়। স্যর বিজয়শঙ্কর হেসে বললেন, অমনি আমি ইচ্ছে করেই করি রাণু। একে ফ্রেঞ্চ-কাট বলে। তোমার ভালো লাগে না?
-না, একটুও না, কাউকে তো অমনি দেখিনি-রাণু হঠাৎ কিছুক্ষণ তাঁর মুখ আর মাথায় দিকে চেয়ে বললে, আচ্ছা আপনি তো বুড়ো ঠাকুদ্দা, আপনার চুল এত কালো কেন?
স্যর বিজয়শঙ্কর হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, আমি বুড়ো ঠাকুদ্দা নাকি? কিন্তু আমার যে ইচ্ছা করে না বুড়ো হতে, একটুও ইচ্ছা করে না। একটা ওষুধ বলে দিতে পার রাণু—যাতে বুড়ো না হয়ে এমনি জোয়ান হওয়া যায়? তিনি হাতদুটো পাশে ছড়িয়ে জোয়ানের ভঙ্গি করে দেখালেন। বয় এসে ডাকল, হুজুর?
-কীরে?
—ডাগদারবাবু।
—পাঠিয়ে দে।
ডাক্তার এলেন; পিছনে ইঞ্জেকশনের সরঞ্জাম হাতে একটি পরিচারক।
-হ্যাল্লো ডক্টর, আজ একটু দেরি বলে মনে হচ্ছে?
–না, স্যর বিজয়শঙ্কর, আমি ঠিক সময়েই এসেছি। ডাক্তার হাসলেন।
—ঠিক সময়? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্যর বিজয় বললেন, তাই বটে।
ডাক্তার মর্ফিয়া ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে গেলেন। রাণু সমস্ত ইন্দ্রিয় উন্মুখ করে এতক্ষণ দেখছিল, ডাক্তার চলে যাবার পর বললে, লোকটা অমনি ছুঁচ ফুড়ে দিলে, আপনি ব্যথা পেলেন না?
-না, রোজই দেয় কিনা, অভ্যাস হয়ে গেছে, আমি ব্যথা পাইনে।
-ওরে বাবারে, আমি হলে খুব ব্যথা পেতাম-রাণু যেন ভয় পেয়ে বললে, আচ্ছা, চামড়ার ভেতরে ভরে দিলে কী ওগুলো?
—মর্ফিয়া! স্যর বিজয়শঙ্কর হেসে বললেন, তুমি ওসব বুঝবে না রাণু। এখন তোমায় সব দেখাই এসো, ওদিকে বেড়াই গিয়ে চলো।
রাণু তার ছোটো সরু হাত দিয়ে তাঁর লম্বা ভারী হাতটি ধরল।
—এই দ্যাখো, এই যে আলমারি, টেবিল, চেয়ার, এই যে বড়ো আয়না, ছবি —সব আমার। আর এই যে আমার ছবিটা, অনেক খরচ করে তৈরি করিয়েছি, দ্যাখো আমার চেয়ে কতো বড়ো? এই ঘর-বাড়ি-দোর, সব আমার। আমার বড়ো ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ভিন্ন থাকে, কী আশ্চর্য দ্যাখো, আমার চেয়ে বড়োলোক হয়ে উঠেছে। এতে আমার হিংসা হয় না, বলো? আর তিন ছেলের একজন থাকে নরওয়েতে, আর একজন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে, আর একটি শ্রীনগর কাশ্মীরে। আর এই হলটার মেঝেটা দ্যাখো, এখানে কার্পেট নেই, সাহেবদের নাচের ঘর এমনি থাকে, তার চেয়ে ভালো করতে শখ হল একটা করেছি, কী চকচেকে দ্যাখো, চেহারা পর্যন্ত দেখা যায়। থাক, ওখানে গিয়ে কাজ নেই পিছলে যাবে এদিকে এসো।
-আপনি তাহলে মস্ত বড়লোক! আপনি একটা রাজা! বাবা কী বলে। জানেন? বলে, বড়লোকেরা দস্যি, ডাকাত, পরের লুঠ করে নেয়–
স্যর বিজয়শঙ্কর থমকে দাঁড়ালেন, রাণুর মুখের কাছে নীচু হয়ে অনাবশ্যক। উচ্চস্বরেই বললেন, তোমার বাবা আর কী বলেন?
-বলে, আমাদেরটা চুরি করে নিয়ে তারা বড়োলোক। তাই বুঝি আমরা খুব গরিব, না? বলে, আমাদের বড়োলোকরা মদ খাইয়েছে—আচ্ছা, মদ খেলে কী হয়? বাবাও মদ খেয়েছে নাকি? বাবা আরও কত সব বলে। সবাই বলে, আমার ভুলো মন, সব ভুলে গিয়েছি।
-তোমার বাবা। স্যর বিজয়শঙ্করের গলায় স্বর আরও উঁচু হয়ে উঠল, কাছেই একটা কোচে বসে পড়ে বললেন, মিথ্যে কথা। তোমার বাবা মিথ্যুক!
—আমার বাবা মিথুক? সব বাবাকে বলে দেব কিন্তু। আপনি নিজে মিথুক! চোপ! স্যর বিজয় ভয়ানক চিৎকার করে উঠলেন, তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল, তারপর মুখ নীচু করে কপালে হাত রেখে বসে রইলেন।
-আপনি মিথুক। আমার বাবাকে খুঁজে বার করে দিলেন কই? আমি সব বলে দেব, সব বাবাকে বলে দেব। বাবা, ও বাবা, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গেলে? আমি তো কোনো দুষ্টুমি করিনি, তুমি তো জানো না, কী কান্না পাচ্ছে! বাবা, ও বাবা, বাবা—রাণু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাড়াতাড়ি বারান্দা ধরে নামবার সিঁড়ি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে স্যর বিজয়শঙ্কর মুখ তুলে দেখলেন, রাণু সেখানে নেই। তিনি তাড়াতাড়ি উপরের সকলকে জিজ্ঞেস করে নীচে গেলেন। সেখানে একজন কেবল বললে, কে একটি ছোট্ট মেয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে।
বেরিয়ে গেছে। এখনও তো তেমন রাত হয়নি, রাস্তায় লোকজন মোটর ইত্যাদিতে ভরা! অতটুকু মেয়ে, রাস্তাও চেনে না।
রূপসিং? রূপসিং?
কণ্ঠস্বরে গুরুত্ব বুঝে রূপসিং এস্তে এল।–হুজুর?
—সেই মেয়েটা এইমাত্র রাস্তায় বের হয়ে গেছে, কখন কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে বসে কে জানে—তুমি শিগগির গাড়ি নিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি খুঁজে দেখো, রাস্তায় পেলে উঠিয়ে নেবে, হয়তো কাঁদবে আর জেদ করবে, তবু উঠিয়ে নেবে। নইলে এমনি বেঘোরে মারা যাবে নাকি? যাও শিগগির–
হুশ–রূপসিং গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়াল।
–পেলে না?
–নেহি, হুজুর।
স্যর বিজয়শঙ্করের আর ভালো লাগলো নাঃ হয়তো মেয়েটা এতক্ষণে কোনো প্রকান্ড মোটর গাড়ি বা বাসের নীচে—উঃ, সে তো তাঁরই জন্যে, তাঁর দোষেই যে সে চলে গেছে!
বহুমূল্য খাট আর তার ওপর পুষ্পকোমল শয্যায় স্যর বিজয়শঙ্কর না খেয়েই শুয়ে পড়লেন। পরিচারকরা ডাকতে এসে তিরস্কার শুনে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখলেন: রাজপথ—তিনি মিটিং-এ যাচ্ছেন, হঠাৎ একটি ছোটো মেয়েও চীৎকার জনতার গোলমালে মিশে গেল; তিনি নেমে দেখলেন তারই বিপুল মোটরের তলায় রাণু চাপা পড়েছে—তার ছোটো ফর্সা মুখ কেমন চ্যাপ্টা, আর কী রক্ত! কিন্তু কী আশ্চর্য, এই অবস্থাতেও রাণু কথা বলছে-বাবা, ও বাবা, তুমি কোথায় গেলে? রাজার মতো বড়োলোক, আর ছুঁচোলো দাড়িওলা একটা বুড়ো তোমাকে গাল দিলে, মিথুক বললে! বাবা, ও বাবা, আমায় একা ফেলে তুমি কোথায় গেলে?
স্যর বিজয়শঙ্করের বিলাসী ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। বাকি রাতটুকুও আর ভালো ঘুম হল না।
শিশু তপন
ছোটোবেলায় শুনিয়াছি—রূপকথার রাজপুত্র সোনার কাঠি স্পর্শ করাইয়া রাজকন্যার নিদ্রা ভাঙিয়া দেয়। বুড়া ঠাকুরমার মুখে ইহা শুনিয়া মনে হইত, নিছক একটি কাহিনি। কিন্তু বয়স হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশাল জনহীন পুরীর মাঝে অনুপম সৌন্দর্যলক্ষ্মী রাজকন্যা ও তেজস্বী এক রাজপুত্রের সাক্ষাৎকার ক্রমশই অপরূপ হইয়া উঠে।
সেইরকম একটি জীবন্ত কাহিনি ছোটোবেলায় দেখিয়াছিলাম। তখন ভাবিয়াছিলাম— মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে সত্য কতটুকু! কেবল প্রয়োজনবোধে বলিয়া ও করিয়া চলিয়াছে। কিন্তু এখন মনে হয়, কথার পিছনে যে অনুপ্রেরণাটুকু থাকে, অন্তরের ভিতরকার সেই বস্তুটির দাম অনেক।
অভ্রভেদী অচলায়তন, অস্ত সূর্যের রাঙা রশ্মি, লাল ও দেবদারু গাছ : ইহাদিগের মাঝে দুইটি একান্ত অজ্ঞাত বালক-বালিকার ইতিহাসই আমি বলিব। ঢাকা শহরে বাড়ি। বাড়ির মালিক যিনি তিনি কায়স্থ, নাম অবিনাশ রায়। বয়সে প্রৌঢ়, দোহারা ছিপছিপে গঠন, শ্যামবর্ণ, চোখে সোনার চশমা, চুল দুই-এক গাছি পাকিয়াছে। একটি ছেলে আছে, বছর এগারো। নাম তপন। স্ত্রী নাই, অনেকদিন মারা গিয়াছে। এক বিধবা বোন আছে, আর ঝি।
একটা অয়েলক্লথের কারবার আছে, বেশ চলে। সচ্ছল, কিন্তু খাইবার লোক নাই। চারিটি মাত্র প্রাণী। কনিষ্ঠা বিধবা বোনটি ভাইয়ের পানে চাহিয়া থাকে আর ভাবে, বয়স আর এমন কী হইয়াছে যে আবার বিবাহ করিলে সংসার ওলট-পালট হইয়া যাইবে। মৃত এক প্রাণীর স্মৃতি লইয়া বাঁচিয়া থাকা মরারই শামিল। একটি ডাগর দেখিয়া বউ আনিবে, নিজে তাহাকে সাজাইয়া দিবে, না একি অনাসৃষ্টি কান্ড! বউ যদি খারাপই হয়, তাহা হইলে সে আছে কী করিতে? কিন্তু বলিয়াই বা লাভ কী? আট বছর ধরিয়া তো বলা হইতেছে, কই কিছুই তো হয় না! তবুও একবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরযু কথাটি ঘুরাইয়া বলে, এই-তো আমাদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকটি আবার বিয়ে করেছেন, একপাল ছেলেমেয়েও রয়েছে। কই কেউ বলুক দেখি, কতটুকু অশান্তি ওদের বাড়িতে আছে? ভগ্নীর কথায় অবিনাশ মুখ তুলিয়া নীরবে হাসেন, বাহিরের পানে একবার তাকাইয়া বলেন, তা আমি অস্বীকার করছিনে সরো, আমার ওরকম নাও ঘটতে পারে, এইটুকুই শুধু বলি। আর বিয়ে করলে আমাকেই বা বিশ্বাস কী? আমিও বদলে যেতে পারি। তখন তপুকে দেখবে কে? শেষ সময় অবিশ্যি সে আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে গেছে। তোমরা বলতে পার, সে যখন বলেছে তখন তার কথাটা রাখা দরকার। কিন্তু আমি যে তার মনের কথাটি পড়েছিলাম তার মুখের উপর। আর বুঝেছিলাম এই যে, তপুর উপর কোনো খারাপ ব্যবহার হলে সারাক্ষণ তার মুখ আমার মনে পড়বে। আচ্ছা, এখন তুমিই বল বোন, আমি যদি আবার সুখের সংসার পেতে পুণ্যি সঞ্চয় করি, তাহলে কি তার স্বর্গগত আত্মা তৃপ্তি পাবে? অবিনাশের চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। সরযু ইহার পর আর বলিবে কি?
পিছনে একটা শব্দ হইল, হুম—অবিনাশ চকিত দৃষ্টিতে ফিরিয়া চাহিলেন, দেখিলেন, তপন দাঁড়াইয়া ঘাড় কাৎ করিয়া মুচকি হাসিতেছে। তিনিও হাসিয়া ফেলিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, এত সকালে যে ইস্কুল থেকে এলি তপু? তপন থপ, করিয়া বইগুলা টেবিলের উপর ফেলিয়া বলিল, আজ আমাদের ইস্কুলের ফাইন্যাল ম্যাচ কি না, তাই ছুটি হল। আমি কিন্তু দেখতে যাব। তারপর পিতার গলা জড়াইয়া বলিল, আচ্ছা, তোমাদের সময় তোমরা ক্রিকেট খেলতে বাবা, এই আমরা যেমন খেলি!
অবিনাশ তপনের মুখটি দুহাত দিয়া ধরিয়া বলিলেন, খেলতুম, কিন্তু তোদের মতো নয় রে। তখন এসব কেনার পয়সা জুটত না, কাজেই বানিয়ে নিতুম।
–দুত্তোর, বানিয়ে আবার খেলা যায় নাকি?
সরযুর ডাক আসিল, ওরে তপু, খাবি আয়।
তপু জুতা পায়েই মসমস করিয়া খাবার ঘরের কাছে গিয়া বলিল, যা দেবে দাও, আমার হাতেই দাও পিসিমা, বাইরে থেকেই খেয়ে যাই। সরযু ব্যস্ত হইয়া বলিল, না, ওসব হবে না বাপু, এ আমি বলে রাখছি। জুতো ছেড়ে ভিতরে বসে খেয়ে যাও। তপু বিরক্ত হইয়া বলিল, আজ যে আমাদের ক্রিকেট ম্যাচ, তা জান না বুঝি?
-আচ্ছা তা পরে হবেখন, আগে খেয়ে নে বলছি? অগত্যা তপু জুতা ছাড়িয়া খাইতে বসিয়া গেল। একটু পরেই তাহাকে উঠিয়া যাইতে দেখিয়া সরযু বলিয়া উঠিলেন, ওকি রে, উঠছিস যে, সবটুকু খেয়ে যা। আমি আর পারিনে, কী দস্যি ছেলে বাবা! কালই আমি তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তপু যাইতে যাইতে বলিল, তাহলে বেশ হবেখন, মজা করে খাব আর ঘুরে বেড়াব।
পরের বৎসর। বর্ষাকাল। বিদ্যুৎ চমকাইয়া মেঘ ডাকে। ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি আসে। বিশ্বপ্রকৃতি মুখর হয় ঘন কালো আকাশের অবিশ্রান্ত বারিপতনের অপরূপ শব্দে। এমন দিনে অতর্কিতে অবিনাশের এক বন্ধু আসিলেন। বলিলেন, চল অবিনাশ, আসামের হিল সেকশনটা দেখে আসি। যাবে? সে এক মজার জিনিস দেখতে পাবে। বৃষ্টিতে একটু কষ্ট হবে বটে।
তপনের তখন গ্রীষ্মের ছুটি। অবিনাশ যাইতে স্বীকৃত হইলেন। তপনও সঙ্গে গেল। তাহার মুখে খুশি আর ধরে না—নতুন দেশ দেখিতে পাইবে বলিয়া!
গৌহাটিতে গাড়ি পৌঁছিলে পর তপন বলিয়া উঠিল, এখানে সব টিনের ঘর কেন, বাবা? খুব গরিব বুঝি ওরা? ইট দিয়ে দালান বানাতে পারে না? অবিনাশ হাসিয়া বলিলেন, এখানে সবাই টিনের ঘরে থাকে। আমাদের চেয়ে বড়োলোকও, গরিবও।
বন্ধুর এক আত্মীয়ের বাসায় তাহারা উঠিল। আত্মীয়টি খুব আদর-যত্ন করিলেন, এই দূর দেশে নতুন একটি বাঙালির মুখ দেখিয়া। ভদ্রলোকের নম সতীশ। এক স্ত্রী, ছেলেমেয়ে হয় নাই, তিনি সকলের খাওয়ার আয়োজন করিতে লাগিলেন। সতীশ অভ্যগতদের স্নানের আয়োজন করিয়া দিয়া এক ফাঁকে রান্নাঘরে আসিয়া হাসিয়া বলিলেন, অতিথি খাওয়াতে তুমি খুব আমোদ পাও বীণা, এটা আমি জানি। কেমন, আজ পেলে তো? দূরে আছ বলেই ওদের খাওয়ানোর এত শখ। বাংলাদেশে থাকলে অতিথিসেবা কোথায় উঠে যেত! সতীশ মৃদু হাসিতে লাগিল।
বীণা মুখটি তুলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, হুঁ, চল না দেশে। দেখিয়ে দিই কাকে বলে খাওয়ানো। পুরুষ তোমরা, তোমরা কি বুঝবে একটি মানুষ খাইয়ে আমাদের কত সুখ!
সতীশ দুই হাত তুলিয়া বলিল, থাক, আর বলতে হবে না। কিন্তু মানুষ খাওয়ানোর অজুহাতে যেন এই অসহায় ক্ষীণ দেহটার উপর অবিচার করে বস না, এইটুকুই আমার অনুরোধ। তাহার কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া বীণা হাসিয়া ফেলিল। সতীশ তাহার মুগ্ধ আঁখি দুটি কর্মরত নারীটির উপর স্থাপন করিয়া বলিল, বাঃ, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে তোমাকে! দেখাবে না, সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা কি না—বিশেষত আজকের এমন একটা দিনে। তাই ভাবি, ভগবান যে আমায় এত সুখ দিলেন, এত সুখ আমি রাখব কোথায়? আচ্ছা তুমিই বল বীণা, এত ঐশ্বর্যের মাঝে দাঁড়িয়েও কীসের অভাবে মনটা আরও নিবিড় হতে পারে না?
অভ্যগতদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সতীশ আর দেরি না করিয়া চলিয়া গেলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর বীণা তপনকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার নাম কী খোকা?
—তপন।
–তোমার মা নেই বুঝি?
নরম জায়গায় আঘাত পড়িল। তপনের মুখ করুণ হইয়া গেল। সে বলিল, আমার মা-র কথা বলছেন? যখন আমার বয়স তিন বছর তখন তিনি মারা যান। আমাদের বাসায় গেলে দেখবেন মা-র মস্ত বড়ো একটা ফটো। এতবড়ো ফটো আপনি দেখেননি কখনও। বাবা রোজ ভোরবেলায় মার দিকে চেয়ে কি যেন বলেন। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও একটা ছোটো ফটো সব সময়েই ওঁর কাছে থাকে। আনব বাবার কাছে বলে? এই সরল ছেলেটির কথায় বীণার মুখ অবিনাশের প্রতি প্রশংসায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। সে সস্নেহে তপনকে বুকের কাছে টানিয়া বলিল, ফটো অন্য সময় দেখিও তপু, কিন্তু তোমার বাবা যেন না জানেন। এমন সময়ে অবিনাশ ছেলেকে খুঁজিতে খুঁজিতে শেষে তাহাকে এই অবস্থায় দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। নিরুদবেগ প্রশান্ত মুখ সরল হাসিতে ভরিয়া গেল।
কয়েকদিন পরে একদিন ভোরবেলায় অবিনাশ সতীশকে ডাকিয়া বলিলেন, আজ কামাখ্যায় যাওয়া যাক, কী বলেন? সতীশ হাতজোড় করিয়া মাপ চাহিবার ভঙ্গিতে বলিল, ঐটিই আমাকে মাপ করবেন অবিনাশবাবু, কাছ থেকে এত দেখেও যার ঘেন্না না ধরে সে তাহলে মানুষ নয়। আপনি একলা গিয়েই না হয় উপলব্ধি করে আসুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিই।
যাইবার সময় বীণা তপনকে ডাকিয়া বলিল, আবার আজকেই ফিরে এস কিন্তু তপু। তপন হাসিয়া বলিল, আর যদি আজকেই না ফিরি?
-তাহলে তোমার সঙ্গে আড়ি। একটি দিনের তরেও কথা কইব না-বীণা বলিল।
একেবারেই যদি না ফিরি বেশ মজা হবে তাহলে না? দেখাও হবে না, আড়িও চলবে না কেমন? দুজনেই হাসিয়া ফেলিল।
তাহারা রওনা হইল।
দুই পাশে পাহাড়, বড়ো বড়ো গাছ। মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়ি এবং তাহাদের মধ্যে আঁকা-বাঁকা পথের উপর দিয়া অবিনাশও তখন মন্থর গতিতে হাঁটিতেছিল। কামাখ্যার মন্দিরে পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। পাহাড়ের উপর মন্দির, সেখানেই পান্ডাদের বাড়ি, তাহাদের অবস্থা ভালো। তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়া কুমারী পূজা করে। কুমারী হয় পান্ডাদের মেয়েরাই।
টিলার উপরে উঠিবার সময় তপন ক্লান্ত হইয়া পড়িল। ঘর্মাক্ত মুখে লাল আভা পড়িয়া তাহাকে ভারী সুন্দর দেখাইল। কিন্তু ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে ক্লান্তিকে স্বীকার করিতে চায় না। কী যেন একটা ইংরেজি ছবিতে সে দেখিয়াছিল কতকগুলা লোককে সাদা বরফের পাহাড়ে উঠিতে। তাহার মধ্যে একটা বালক একজনের কোমর ধরিয়া কেমন সুন্দর মার্চ করিবার ভঙ্গিতে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া উপরে উঠিতেছিল। এক নিবিড়ো সুখের অনুভূতিতে তপনের মনের শিশু আনন্দে নাচিয়া উঠিল। সে ছবির খোকাটির মতো বাবার কোমরের জামাটা হিচড়াইয়া টান দিল। অবিনাশ মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন ও কী হচ্ছে রে? আমার হাত ধরে আয়। কষ্ট হচ্ছে বুঝি উঠতে?
তপন তাচ্ছিল্যের সহিত ঠোঁট উলটাইয়া তেমনিভাবে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া বলিল, এরকম করে পা ফেলতে পারবে তুমি? কোথেকে পারবে, জানলে তো পারা যায়?
উপরে উঠিলে পর পান্ডারা ঘিরিয়া ধরিল। থাকিতে হইবে কিন্তু একজনের বাড়িতেই। কাছে একজন নিরীহ গোছের পান্ডা দাঁড়াইয়া ছিল। চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে আর সকলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত গরিব। অবিনাশের চোখ পড়িল তাহারই উপরে। সেই পান্ডাটা তাহার দৃষ্টিপথে পড়িয়া বলিল, বাবু আমার কাছে আসুন। অবিনাশ খুশি হইয়া বলিল, চল। আয়রে তপু।
বাড়ির উঠানে পা দিতেই নবাগতদের চোখ পড়িল একটি মেয়ের উপর। দশ বছর বয়স। উপুড় হইয়া কতকগুলা মটির পাত্রে কী যেন রাঁধিতেছিল। ছোটো ছোটো কোঁকড়ানো চুলওলা ছড়ানোকপালে, কানে, পিঠে।
পায়ের শব্দে চাহিয়া মেয়েটি গম্ভীরভাবে কহিল, এসেছ? আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম বাবা, কবে রান্না হয়ে গেছে। এখনও তোমাদের জন্য আমি বসে আছি। আমার দিকেও তো চাইতে হয় বাপু। খেটে খেটে হয়রান হলুম।
পান্ডাটি মেয়ের কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া উঠিল। অবিনাশের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দেখেছেন বাবু? মেয়ে আমার কেমন পাকা গিন্নী, অবসর পাচ্ছে না এখনও, কী উপায় করি বলুন তো?
পিতার গলার অনুকরণ করিয়া মেয়ে বলিল, কী উপায় করি বলুন তো! না আমার আর সয় না বাপু! খাবে তো এস, না হয় আমি সব ফেলে দিই। অবিনাশের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবু, আপনারাও আসুন। অবিনাশ স্মিতমুখে বলিলেন, আসব, মা আসব। তপন মুগ্ধ চোখে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, কী সুন্দর! মনে মনে ভাবিতে লাগিল : সে তো তাহাদের পাড়ার কত মেয়েকেই দেখিয়াছে, কিন্তু এই মেয়েটির মতো সুন্দর কেহই নয়। তপন ফিরিয়া আস্তে আস্তে তাহার কাছে গিয়া বলিল, কেন ডাকছ আমায়?
–বস, বলিয়া সে হাত টানিয়া বসাইয়া দিল।
–তোমার নাম কী?
—তপন!
–বেশ নাম তো! তুমি কি বোকা! আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন করলে না? আমার নাম বাসন্তী। কেমন, আমার নাম ভালো কি না বল? না, তোমায় বলতে হবে, আমি যে বললাম।
তপবন হাসিয়া বলিল, বেশ ভালো নাম।
বাসন্তী বলিল, খাবে কিছু? দাঁড়াও আমি বেড়ে দিচ্ছি। মাটির পাত্রে ভাত, আগাছার ঝোল, চচ্চড়ি দেওয়া হইল। তপন হাত দিয়া মাখিয়া মুখের কাছে নিয়া ফেলিয়া দিল।
বাসন্তী হাসিয়া বলিল, দূর! অমন করে বুঝি খেতে হয়? তুমি একটা বোকা! মুখ সত্যি সত্যি খাওয়ার মতো করে নাড়তে হয় না? তা না করলে খাওয়া হল কী করে? খাওয়া শেষ হইলে তপন বাসন্তীর দিকে চাহিলে বাসন্তী বলিল, পেট ভরেনি বুঝি? তা না ভরলে আমি আর কী করব বল।
তপন হাসিয়া বলিল, তা হলে উঠি।
–আঃ দুধ যে রয়েছে, তা একেবারেই ভুলে গেছি। এই বলিয়া বাসন্তী একটু চুনমেশানো জল পাতের উপর ঢালিয়া দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খেয়ে লও, মা দেখলে বকবে। চুন যে চুরি করে এনেছি। খেয়ে আবার হাত ধোবে চল। এঁটো তো! জল আমাদের কোথেকে আনতে হয় জান? অনেক দূরে একটা ঝরনা আছে, ওখান থেকে আনতে হয়। যাবে দেখতে, কী সুন্দর দেখবে!
তপন ঝরনার প্রসঙ্গে খাওয়ার কথা ভুলিয়া গেল। বলিল, চল, এক্ষুনি চল। বাসন্তী ও তপন চলিল। চলিল দুটি স্বল্প-পরিচিত বালক-বালিকা, ছোটো নরম পা ফেলিয়া, শিশুসুলভ কথাবার্তা কহিয়া, কলহাস্যে হাসিয়া। কেহই জানিল না, কোন কাহিনি তাহাদের মধ্যে গড়িয়া উঠিতেছে, কেহই ভাবিল না, এতটুকু সময়ের পরিচয়ের মাঝে তাহারা কেমন করিয়া পরস্পরকে এত আপনার বলিয়া গ্রহণ করিল। কেমনে বলিব, এই দুটি বালক-বালিকার মনের ভাষায় কত যুগের ইতিহাস। তাহাদের বাক্যতরঙ্গে ফুটিয়া উঠে পৃথিবীর সকল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না–চাঁদের আলোর মতো নরম, নীল আকাশের মতো সুন্দর।
যাইতে যাইতে বাসন্তী একটা বুনো গাছের দিকে আঙুল বাড়াইয়া বলিল, এ রকম গাছ দেখেছ কখনো?
তপন বলিল, না। সব গাছই কি আর শহরে দেখা যায়! তুমি বুঝি শহরে কোনোদিন যাওনি?
—কে বললে তোমায়, আমি যাইনি? গৌহাটী গিয়েছি না!
তপন জোরে হাসিয়া উঠিল, বলিল, ছেঃ, গৌহাটী আবার একটা শহর! গোরা সৈন্য দেখেছ কখনো?
–না।
—ব্যস। কেমন ঠকিয়ে দিলাম।
বাসন্তী অপ্রতিভ হইয়া গেল। কতক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি। তোমাদের বাড়িতে কার সঙ্গে খেল?
—কত ছেলে আছে আমাদের ইস্কুলে। তাদেরি সঙ্গে খেলি।
–ইস্কুল! ইস্কুলে কী পড় তোমরা? তপনের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলিয়া গেল, একটু চিন্তা করিয়া বলিল, পড়ি কী জান? পড়ি, পৃথিবীটা গোল।
এইবার হাসিবার পালা বাসন্তীর। সে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে লাল হইয়া গেল।
–বারে! তুমি হাসছ যে?
—তুমি একটা আস্ত গাধা। পৃথিবী আবার কোনোদিন গোল হয় নাকি? চোখ দুটো ছোটো করিয়া, একটা পা উঠাইয়া একটু কাত হইয়া বাসন্তী বলিল, তাহলে এই যে দাঁড়িয়ে আছি, পড়ে যাব না?
তপন রাগিয়া বলিল, চল বাবার কাছে যাই। কী বলেন। কিছু জানলে তো বুঝবে? আবার হাসা হচ্ছে! অত হেসো না কিন্তু, তা হলে আমি কথা বলব না। আবার হাসছ যে! বেশ, এখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার আড়ি।
তপন নীরবে চলিতে লাগিল।
বাসন্তী হঠাৎ পিছন ফিরিয়া বাড়ির পানে দৌড়াইতে লাগিল। তপন ভয় পাইয়া গেল। পিছনের দিকে দৌড়াইতে দৌড়াইতে বলিল, বা, তুমি দৌড়াচ্ছ যে? যাবে না ঝরনা দেখতে? বাসন্তী মুখ ফিরাইয়া বলিল, থাক এখানে পড়ে।
কতদূরে গিয়ে বাসন্তী বসিয়া পড়িল। মুখ লাল হইয়া গিয়াছে রোদে-আমার সঙ্গে পারবে দৌড়াতে? তোমার মত মানুষে না, হাঁপাইতে হাঁপাইতে সে বলিল।
তপন তাহার পায়ের কাছে ঘাসের উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বাসন্তীর পানে চাহিয়া বলিল, হুঁ, পারব না আবার! জান আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম ভালো দৌড়বার জন্যে।
বাসন্তী নতুন একটা কথা শুনিল, সব ভুলিয়া আগ্রহের সহিত তপনের গলা দুই হাত দিয়া জড়াইয়া বলিল, পাইজ! কী তপু!
তপন বিজ্ঞের হাসি হাসিল, প্রাইজ! পাইজ আবার কাকে বলে? আচ্ছা বোকা তুমি! কিচ্ছু জান না। বললাম, প্রাইজ, না পাইজ! কতকগুলো বই বা অন্য জিনিস এমনি দিয়ে দেয়, ওকেই বলে প্রাইজ। কত ছবি কত গল্প থাকে ওর মধ্যে। আনলে তোমাকে দেখাতাম! বাসন্তী উপরের দিকে একবার চাহিয়া বলিল, ইস, কত বেলা হয়েছে! সূর্যি একেবারে মাথার উপরে উঠেছে। বাবা দেবেখন আজকে আমায়। চল, শীগগির চল।
বাড়ির কাছে আসিতেই চোখে পড়িল, এক মহা হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছে। বাসন্তীর বাবা তাহাকে দেখিয়া রাগতস্বরে বলিল, এই যে, এতক্ষণে আসা হয়েছে! পরের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হয়েছিল, শুনি? দাঁড়াও, আজ তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। পান্ডাটি একটা কঞ্চি লইয়া অগ্রসর হইল। বাসন্তী ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল! শব্দ হইল, সপাং, সপাং–
—আমি আর যাব না বাবা। আমায় এরকম করে মেরো না। বলছিই তো আর যাব না—না—
তপনের দুটি ভয়ব্যাকুল চোখ ছলছল করিতে লাগিল। এমন সময় অবিনাশ ফিরিয়া আসিলেন। একবার তপনের দিকে চাহিয়া পান্ডাটির কাছে গিয়া বলিলেন, ওকি করছ? আহা ও রকম করে মারতে আছে! এই তোমাদের দোষ, মারতেই শুধু জান।—শব্দ থামিল। বাসন্তী ফুপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। সেদিনই অবিনাশ চলিয়া গেলেন। পথে তপন জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, ওরা এরকম করে মারে কেন বাবা? তুমি তো আমাকে মারোনি কোনোদিন।
–খুব মেরেছে নারে? অবিনাশ কহিলেন। পরের দিন আবার তাহারা আসিল, কুমারী পূজা দিতে। বাসন্তী দূর হইতেই তিনজনকে দেখিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া গেল। কাছে আসিলে সে তপনের হাত ধরিয়া টান দিল। অবিনাশ পিছন ফিরিয়া একটু হাসিলেন, তারপর চলিয়া গেলেন।
বাসন্তী বলিল, ঝরনা দেখতে যাবে তপন! কালকে যে তুমি দেখতে চেয়েছিলে!
তপন ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, কাজ নেই, আবার তোমায় মারবে যে!
থামিয়া পুনরায় কহিল, জান, আমরা কুমারী পুজো দিতে এসেছি, কে কুমারী হবে বল তো?
—জানিনে।
–দূর বোকা, তুমি কিছুই বলতে পার না। বাবা বলেছে কুমারী হবে তুমি। বাবা তোমার জন্য নূতন কাপড় এনেছে।
বাসন্তীর মুখ খুশিতে ভরিয়া গেল।
পূজা হইতেছে। তপন মুগ্ধ চোখে দেখিতেছিল। এমন আর সে কখনও দেখে নাই। নূতন কাপড় পরিলে বাসন্তীকে কি সুন্দরই না দেখায়। রৌদ্রে ঝলমল। করিতেছে কাপড়, বিচিত্র গৌরবর্ণ মুখ লাল হইয়া গিয়াছে।
পূজা শেষ হইলে তপন হাত নাড়িয়া তাহাকে ডাক দিল। বাসন্তী মুক্তি পাইয়া। যেন দৌড়িয়া আসিল।
-কেন ডাকছ?
তপন হাসিয়া বলিল, তুমি কী সুন্দর, না? নূতন কাপড় পরে থাকবে কিন্তু।
–দুর, সবসময় বুঝি নূতন কাপড় পরে থাকে? তপন তাহার কথায় কান দিল না, কী যেন চিন্তা করিয়া বলিল, চল, ওদিকটায় যাই।
বাসন্তী তৎক্ষণাৎ রাজী হইয়া বলিল, চল।
কিছুদূর গিয়া তাহারা থামিল। সম্মুখে একটা গাছ ডালপাতা লইয়া অনেকটা জায়গা জুড়িয়া দাঁড়াইয়া আছে।
তপন বলিল, দাঁড়াও এখানে। পাতা দিয়ে মুকুট বানাতে পার তুমি?
–না।
তপন কতকগুলা সরু সরু লতা ছিড়িল আর ছিড়িল অজস্র বুনোপাতা। তারপর পাতার উপর পাতা গাঁথিতে লাগিল। এবং শিশু কারিগরের হাতে নির্মিত হইল একটা মুকুট। সে একবার মুখের কাছে মুকুটটা ধরিয়া হাসিয়া উঠিল। শিশু বৈজ্ঞানিক নিজের কৃতকার্যতায় বেজায় খুশি।
মুকুটপরিহিত বাসন্তীকে চমৎকার দেখাইল। দুই-একগোছা নরম চুল বাহির হইয়া রহিল। বাসন্তী ঋজু হইয়া দাঁড়াইল ও তপন তাহার পায়ের কাছে বসিল। পকেট হইতে সে একটা ছোট্ট ক্যামেরা বাহির করিল। বিস্মিত হইয়া বাসন্তী জিজ্ঞাসা করিল, এটা কী তপু?
তপন ক্যামেরাটা খুলিতে খুলিতে বিজ্ঞের মতো বলিল, দেখেছ কখনও? ছবি তোলা যায় এটা দিয়ে। আমি তোমার ছবি তুলব, খুব মজা হবে, না!
—হুঁ। একটা ছবি দেবে আমায়!
তপন হাসিয়া বলিল, আর কাকে দেব, বল? ঢাকায় গিয়ে প্রিন্ট করে পাঠিয়ে দেবখন।
বাসন্তী কিছুই বুঝিল না। শুধু তপনের ঘাড় ধরিয়া মুখের কাছে মুখ নিয়া উৎসুক নেত্রে এই অভিনব জিনিসটি দেখিতে লাগিল। কিছু পরে তপন বলিল, পেছনে যাও তো এখন তোমার ফটো তুলব। ওই গাছটার তলে যাও।
বাসন্তী পিছু হাটিয়াই যাইতে লাগিল। তপন ক্যামেরাটার দিকে চোখ রাখিয়া মনোযোগের সহিত উহা ঠিকমত ধরিতেছিল। হঠাৎ একটা কাজে চকিত হইয়া সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, বাসন্তী নাই। শব্দের মধ্যে একটা চীৎকারের রেশ ছিল। তপন উদভ্রান্তের মতো গাছটার কাছে আসিয়া দেখিল, গাছটার ঠিক পরেই একটা গভীর খাদ। কিছু দেখা যায় না। সে ক্যামেরাটা দূরে ফেলিয়া পাগলের মতো ডাকিল, বাসন্তী, বাসন্তী? আমি যে তোমার জন্যে বসে আছি, ফটো তুলবে না! শিগগির এসো, লক্ষ্মীটি, আমি তোমার সঙ্গে আর কখনও ঝগড়া করব না। এসো বাসন্তী, বা-স-ন-তী–
কেহই উত্তর দিল না। কতকগুলি প্রতিধ্বনি তাহাকে ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল।
তপনের মুখ বিবর্ণ। সে কাঁদিয়া উঠিল, মাটি আঁচড়াইতে লাগিল।
অচলায়তন ও নির্জনতার মাঝে একটা প্রাণের বিসর্জন, কতটুকু তাহার মূল্য জানি না। জানি পৃথিবী টলিবে না এই ঘটনায়। পৃথিবীর বুকে ইহা নূতন নয়, জানি মানবজীবন কেমন দ্রুতগতিতে চলিয়াছে, তেমনই চলিবে, কিন্তু অকালে যে ফুলটি ঝরিয়া পড়িল তাহারই কাহিনি লিখিতে কেন আমার এত আগ্রহ! চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হইয়াই আসে যদি, তবু কলম কেন থামে না! কেমনে বলিব, ইহা যে আজও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।
উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রলয় নৃত্য আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। নীচে মাটির বুকে বিয়োগ-বিধুর এক শিশুচিত্তের বেদনা, মনে করিতে কষ্ট হয়।
সংকেত
তখনও আকাশ ভালো করিয়া পরিষ্কার হয় নাই, নানারকমের পাখি আগামী দিনের ঘোষণায় প্রাণপণে ডাকাডাকি করিতেছে, বনগ্রামের মরা নদীর কঠিন বুকেও ভয়ানক ঝড় তুলিয়া কাহাদের এক লঞ্চ তীরে আসিয়া ভিড়িল।
প্রথমে দেখিয়াছিল অন্ধ দশরথ। তাহার দুই ছেলে—এক ছেলে গিয়াছে বাহিরে আর এক ছেলে যার বয়স অল্প, হাতের বৈঠাটি এক পাশে রাখিয়া সে তখন অন্ধ পিতার জন্য এক ছিলিম তামাক ভরিতেছিল, আর দশরথও তখন তাহার হাতের জালটি গুটাইয়া গলাটি একটু ভিজাইবার আশায় পশ্চিমের প্রায়ান্ধকার আকাশের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চাহিয়া ছেলের তামাকের প্রতীক্ষা করিতেছিল, হঠাৎ কেমন একটা গুম গুম আওয়াজ তাহার কানে বাজিতে লাগিল, কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগে কান পাতিয়া শুনিয়া সে ডাকিল, রাম?
দশরথ-পুত্র রাম তখন তামাক ভরিতে ব্যস্ত, তাহার কিছুই ভালো লাগিতেছে , রাগিয়া বলিল, ক্যান?
দশরথ বলিল, কিছু হুনসনি?
রাম মুখ না তুলিয়াই বলিল, না।
দশরথ আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, দ্যাখ তো চাহিয়া ইস্টীমার তো না?
—তা অইলে তুমি কিছু দেখতে পাও, না বাবা?
রামচন্দ্রের বিশ্বাস, তাহার বাবা তেমন করিয়া না দেখিলেও কিছুটা নিশ্চয় দেখিতে পায়, কিন্তু দশরথ ইহা শুনিলে আর রাগ সামলাইতে পারে না। এবার হয়তো শুনিতে পায় নাই, তাই রক্ষা। কোনো উত্তর না পাইয়া আবার সে ডাকিল, রাম।
-কী। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাম একবার সেদিকে তাকাইল : দশরথের কথা মিথ্যা নয়, সত্যই একটা ছোটো জাহাজের মতো চোখে পড়ে, এখন আওয়াজ আরও স্পষ্ট–
দারুণ খুশি হইয়া সে বলিল, হ, বাবা।
—দ্যাখ আমার কথা হাছা কি না। দশরথ হাসিয়া ফেলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিল : সে অনেকদিন আগেকার কথা, বেলতলীর জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে সদ্য বিলাত হইতে ফিরিয়া সেই প্রথম যখন নিজ গ্রামে প্রবেশ করিলেন, তখন আসিবার পথে বিস্তর দুর্ভোগ ভুগিয়া এত বিরক্ত হইয়াছিলেন যে তার কিছুদিন পরেই দেখা গেল, মস্ত এক স্টিমার ভীষণ হাঁকডাকের সঙ্গে আশপাশের গ্রামের সমস্ত লোককে আনিয়া হাজির করিয়াছে নদীর পারে। স্টিমার কোম্পানি নতুন লাইন খুলিয়াছে, তখনকার নদী কী আর এখন আছে। দশরথ সেই দৃশ্য দেখিয়াছে তাহার জীবনে। আজকাল কী আর সেরকম ঘটনা ঘটে। সেসব দিনের মানুষও আজ আর নাই, তাহাদের কীর্তিও নাই। এবং পরক্ষণেই এই অদ্ভুত খবরটি শ্রীরামচন্দ্রের মুখে সারা গ্রামে রটিয়া গেল।
অনেকক্ষণ পরে লঞ্চের সিঁড়ি বাহিয়া যে লোকটি সদলবলে নামিয়া আসিল, তাহার গায়ে চমৎকার পাঞ্জাবি আর সিল্কের চাদর, পায়ে চকচকে পাম্পশু মুখে একটি সিগারেট আর মৃদু হাসি।
যাহারা ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল তাহাদের কেহ দূরে সরিয়া দাঁড়াইল, কেহ সেখানে থাকিয়াই বুকের ওপর দুই হাত রাখিয়া এমনভাবে চাহিল, তাহাদের মতো তাহারাও চলিয়া বাইবে না, মারিয়া ফেলিবে না তো আর! ইহারা নবীন। যাহারা প্রৌঢ়া অথবা বৃদ্ধ তাহারা দূরে দাঁড়াইয়া হাসিল। ইহাদের স্পর্ধা তো কম নয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন সবটাতেই একটা বাহাদুরি দেখানো চাই। বাবু সেলাম। ইয়াসিন একটা সেলাম দিয়া বলিল, আজ জীবনের শেষ ঘন্টাগুলি ঢং ঢং করিয়া বাজিতেছে, এতকাল যে সেলামের জোরেই সে সকলের প্রিয় হইয়া আসিয়াছে আজও তাহার অন্যথা হইবে না।
বাবু সেলাম গ্রহণ করিলেন এবং মৃদু মৃদু হাসিলেন।
২.
খবরে যদিও জানা গেল লোকটি কোনো এক কাপড়ের কলের ম্যানেজার—অর্থাৎ একেবারে বড়ো কর্তা, মিলের জন্য এখানে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছে তবু তাহার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মতভেদের অন্ত রহিল না।
শীতের সকাল। রহমানের বাড়ি পার হইয়া দূরে কাহাকে যেন দেখিয়া বলরাম পাশে সরিয়া দাঁড়াইল, লোকটা একটু কাছে আসিলে পর হাসিয়া বলিল, কাকা না গো? ইয়াসিন বলিল, হুঁ।
-কী যে অইছে, দূরের থনে তোমারে চিনতেই পারি নাই। হ্যাশে— হুনছোনি? তোমরা যতই কও, আমার কিন্তু মনডা খালি কয় এখবর মিছা।
–দুরো! তোমার তো হগলটাতেই খালি সন্দ। ইয়াসিন পরম নিঃসন্দেহে অন্যদিকে চাহিয়া রহিল—এমনভাবে চাহিল যেন ইহার পরে আর দ্বিতীয় কথা নাই। সে সকলের আগে নিজের কানে যাহা শোনে, তাহাকে মিথ্যা বলিয়া প্রমাণ করিবে, এমন হতভাগ্য এ অঞ্চলে কেহ নাই। ধীরে ধীরে সে বলিল, বাবুটি যেকোনো মিলেরই বড়বাবু, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই এবং তিনি যে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছেন, একথাও মিথ্যা নহে-বলরাম তাহার কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে। তাহার ছোটো বেলায়ও যে এমনি আর একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে তখন ছোটো, হঠাৎ এমনি একদিন কোথা হইতে এক বাবু আসিয়া সারাটা গাঁ তোলপাড় করিয়া তুলিল!–
ইতিমধ্যে আকবার আলি আসিয়া তাহার কথা মনোযোগ দিয়া শুনিতে ছিল। তাহার হাতে একটি আমের কচি ডাল, সেটা দাঁত দিয়া চিবাইতে চিবাইতে সে মাথা নাড়িতে লাগিল। ফিক করিয়া কিছু থুথু ফেলিয়া বলিল, লড়াইয়ের খবর রাখনি, ইয়াসিন মিঞা? হেইর লেইগা ফাঁকি দিয়া লোক লিবার আইছে, জান?
আরও দুই একজন আসিয়া জুটিয়াছিল। এমন একটি কথা শুনিয়া তাহারা সকলে বিস্ময়ে আর ভয়ে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু সকলে আকবরের দিকে আকৃষ্ট হইতেছে দেখিয়া ইয়াসিন রাগিয়া উঠিল, হঠাৎ নিজের বুড়া আঙুলটি তাহার চোখের সামনে ধরিয়া বলিল, তুমি এইটা জান? আকবর আলী গম্ভীর ভাবে বলিল, তোমার কুন ডর নাই, হ্যারা বুড়া মানুষ গো নিব না।
ঝগড়া ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। আরও বাড়িত। কিন্তু কে একজন বলিল, বাচ্চা মৌলবি।
সকলের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হইল, ঝগড়া কিছুক্ষণের জন্য থামিল—এই আশায় যে বাচ্চা মৌলবিই ইহার মীমাংসা করিতে পারিবে।
বাচ্চা মৌলবি বলিয়া তাহাকে সবাই ডাকে, তার একমাত্র কারণ এই যে তাহার বয়স অত্যন্ত অল্প এবং এই বয়সেই সে মৌলবি হইয়াছে। সে পাশের গ্রামেই থাকে এবং মাঝে মাঝে কোনো পত্রিকা হাতে করিয়া আসিয়া বেলা দুইটা আড়াইটা অবধি এ অঞ্চলের সকলকে যুদ্ধের খবর শুনাইয়া যায়। শহরের খবর তাহার কাছে অবিদিত নাই, মাসের মধ্যে পনেরো দিনই তো সে সেখানে কাটায়। এ কথা সবাই জানে, নবাবের সঙ্গে বসিয়া সে খানা খাইয়াছে এবং নবাব সাহেব তাহার হাতে চুমা খাইয়াছেন।
বাচ্চা মৌলবির পরণে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি, গোঁফ এখনও ভালো করিয়া উঠে নাই, হাতে একটা ঘড়ি। কিন্তু ঘড়িটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন থামে এ খবর কেউ রাখে না। ঘড়িটা একবার চোখের সামনে ধরিয়া এই শীতের সকালেও পত্রিকা দিয়া বাতাস খাইতে খাইতে মৌলবি শুদ্ধ ভাষায় বলিল, ওনারে আমি চিনি। এই বলিয়া ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে তাহার এক সুদীর্ঘ পরিচয়ের ইতিহাস বিবৃত করিয়া অবশেষে বলিল, তাইন লোক নিতে আইছে ঠিকই। রহমান তোমার ঘরে তা তো তাঁত আছে তোমারে নিবে আগে।
রহমান এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিল, মৌলবির কথা শুনিয় হাসিয়া ফেলিল। নতুন বিবাহ করিয়াছে সে, তেলে আর জলে চুলগুলি চমৎকার পরিপাটি চোখে সুরমা, পরনের জামা আর লুঙ্গি রঙিন।
বেলা হইয়া যাইতেছিল। মৌলবির সময় নাই, একবার সূর্যের দিকে এবং আর একবার ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, দশটা বাইজা গেছে, আমি যাই, কাজ আছে, আমার একটু চৌধুরী বাড়ি যাইতে অইব।
আকবর আলী তবু কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। কিন্তু মৌলবিকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি তাহার পাশে গিয়া ফিক করিয়া থুথু ফেলিয়া বলিল, মৌলবি।
মৌলবি পাশে তাকাইল।
আকবর আলী বলিল, আমার একটা কথা রাখবা তুমি? কও?
—আমার ভাই-এর লেইগা একটু কইয়া দিবা তুমি–
মৌলবি পরিষ্কার ভাষায় বলিল, দিব, দিব। বলিয়া তর তর করিয়া চলিয়া গেল।
শত আনন্দ হইলেও হাসিয়া কখনো আনন্দ প্রকাশ করে না ইয়াসিন। সকলের দিকে একবার তাকাইয়া সে বলিল, অহনও বিশ্বাস অয় না?
বলরাম আগে সন্দেহ প্রকাশ করিলেও ইতিমধ্যে আবার বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছে। ইয়াসিনের কাছে ঘেঁসিয়া বলিল, কাকাগো, তোমার কাছেই আইছিলাম, একটা আলাপ করুম। মন্ডল-পুত্র কীসের পরামর্শ চাহিতে আসিয়াছে কে জানে। ইয়াসিন হাসিল।
৩.
বিকালের রৌদ্রে চারদিক ঝলমল করিতেছে। গাছের ছায়ার নীচে একটা চেয়ারে বসিয়া ম্যানেজারবাবু মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ তোমাদের গাঁ-টি বেশ ভালো লেগেছে। তোমরাই দেশের গৌরব। ফেমিন হবার আগে সারা ভারতের কাপড় জোগাতে তোমরাই। এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে দিতে, অথচ আজ শুকিয়ে মরছো। তোমাদের কদর কজনা বোঝে? নদীর দিকে আঙুল দেখাইয়া তিনি বলিলেন, সেখানেও এমনি নদীর হাওয়া, নদীর একেবারে পার ঘেঁষেই চমৎকার ব্যারাক সেখানে, তোমরা থাকবে। হাতের কাছ হাসপাতাল, খেলার মাঠ, সিনেমা , যখন যা খুশি!–ম্যানেজারবাবু মৃদু হাসিলেন।
রহমান নাম লিখাইয়া ফেলিল। আজ রাত বারোটার সময় লঞ্চে উঠিতে হইবে।
বাড়ি ফিরিলে তাহার বুড়া বাপ কাটি ছেলের হাতে দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খাওন দাওন সাইরা শুইয়া পড়, বারোটা বাজলে পর আমি ডাইকা দিমুনে, যাও শুইয়া পড় গিয়া।
রহমান পিতৃআজ্ঞা যথারীতি পালন করিল।
তাড়াতাড়ি খাইয়া দাইয়া শুইতে আর দেরি করিল না।
কিন্তু রাত বারোটা বাজিতে আর কতোক্ষণ লাগে? বুড়া রহমানের ঘরের দরজার কাছে গিয়া ডাকিল, বাপ, সময় অইয়া গেছে, অ্যালা ওঠ।
কোনো উত্তর আসিল না, বা কেউ বাহির হইয়া আসিল না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অপেক্ষা করিয়া বুড়া মনে মনে হাসিল, নিজের মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়িল।
অথচ এদিকে বারোটা বাজিয়া যাইতেছে। বুড়া আবার ডাকিল, রহমান ওঠ ইষ্টিমার ছাইড়া দিতে আর কতোক্ষণ! এই বলিয়া নিজের ঘরের দাওয়ায় আসিয়া আবার তামাক সাজিতে বসিল। কিছুক্ষুণ এমনি কাটিবার পরও রহমানকে আসিতে না দেখিয়া হুঁকা হাতে বুড়া আবার বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখিল, দাওয়ার খুঁটি চাপিয়া ধরিয়া অন্ধকারে নিঃশব্দে রহমান বসিয়া আছে।
হুঁকাটি তাহার হাতে দিয়া বুড়া বলিল, তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইয়া লও, বাপ, আর দেরি কইরো না।
রহমান তেমনি খুঁটি ধরিয়া বসিয়া রহিল।
এক হাতে একটি বহু পুরোনো লণ্ঠন, আর এক হাতে একটি প্রকান্ড চকচকে লাঠি লইয়া পথ দেখাইয়া চলিল বুড়া। রাস্তায় সাপ বা মানুষের ভয় থাক বা নাই থাক, এ দুটিকে ছাড়া সে কখনো পথ চলিতে পারে না। ধীরে ধীরে চলিতে চলিতে সে বলিল, হেইখান গিয়া চিঠি দিও, তা না অইলে চিন্তায় থাকুম।
রহমান আস্তে বলিল, আইচ্ছা। গোলাম আলীর বাড়ি পার হইলেই একটা মস্ত বকুল গাছের নীচ দিয়া হাঁটিতে হয়। সেখানে বকুল ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া থাকে। সেই গাছের নীচ দিয়া চলিতে চলিতে রহমানের শরীর অবশ হইয়া আসিল, ঘুমে ভরা চোখ বুজিয়া আসিল, সে অনুভব করিল এখনও যেন সে কারও ফুলের মতো বুকে মুখ রাখিয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলিতেছে।
ঠক ঠক করিয়া এখানে লাঠি ফেলিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বুড়া আবার ডাকিল, বাপ।
—কও? কিন্তু কিছুক্ষণ কান পাতিয়া থাকিয়াও রহমান আর কোনো কথাই শুনিতে পাইল না। বোধ হয় যা বলিতে হইবে সব ভুলিয়া গিয়াছে বুড়া।
একুট পরেই লঞ্চের আলো দেখা গেল। আশে পাশে অনেক লোক ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকলেই উচ্চস্বরে গল্প করিতেছে। কেহ সিঁড়ি বাহিয়া লঞ্চে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। সব মিলিয়া একটা মস্ত হল্লা।
একটু নির্জনতায় ছেলেকে টানিয়া বুড়া আবার বলিল, বাপ?
-কও?
একটা কথা কমু। এত বুড়া হইয়া গেলাম, তুমি আমারে ছাইড়া কোনো কালে কোনো খানে যাও নাই, কিন্তু আইজ ছাইড়া গেলা, আমার মনটারে কী দিয়া বান্ধুম, তুমিই কও? বুড়া অনেক কষ্টে তাহার সবগুলি কথা এতক্ষণে বলিয়া ফেলিল এবং ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। এমন দৃশ্যের সঙ্গে রহমানের এই প্রথম পরিচয়, সে কী যে করিবে ভাবিয়া পাইল না।
নদীর উপরের ঠাণ্ডা বাতাসে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো কাঁপিতেছে। চারিদিকে জলের গন্ধ। আকাশে অজস্র তারা। পাশেই আগামী কোনো সুখের সৌরভে বিহ্বল লোকজনের হল্লা। বুড়ার শীর্ণ হাতের লাঠিখানাও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে।
অনেকক্ষণ পরে রহমান উপরে উঠিয়া দেখিল, সেই বাচ্চা মৌলবি সারা লঞ্চময় চরকিবাজীর মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। লোকটা এমনি পাতলা ছোটোখাটো মানুষ যেন হাওয়ার সঙ্গে উড়িয়া চলে, এক মিনিটে হাজার মাইল অতিক্রম করে।
রহমানকে দেখিয়া সে ঘড়ি দেখিয়া এদিক সেদিক তাহার চঞ্চল দৃষ্টি বুলাইয়া তর তর করিয়া বলিল, এতক্ষণে আইছ! টাইম আইয়া গেছে।
মৌলবি টাইম ধরিয়া চলে। আবার ঘড়ি দেখিয়া সে সামনের দিকে অগ্রসর হইল।
রেলিং ধরিয়া রহমান একা দাঁড়াইয়া রহিল।
কয়েক হাত নীচেই তাহাদের গ্রামের নদী, আজ ছাড়িয়া যাইতেছে বলিয়া অত্যন্ত আপনার বলিয়া মনে হয়। নদীর জলে লঞ্চের আলো পড়িয়া চিকমিক করিতেছে, লঞ্চের ভিতরের মানুষগুলির আবক্ষ ছায়াও সেখানে দেখা যায়, অন্ধকারের বুকে কেবল আরও কতকগুলি গভীর অন্ধকারের মতো মনে হয়। আর তাহাদের আত্মীয়-স্বজনরা—তাহারাও লণ্ঠন হাতে বিদায়ের প্রার্থনায় কাতর।
রহমানের চোখের পাতা বুজিয়া আসিল, সে দেখিল, নদীর জলে কে এক নারীমূর্তি, নাকের চোখের জলে এক হইয়া তাহাকে ডাকিতেছে। তাহার নাকের ডগায় ঘাম, ঘর্মাক্ত সমস্ত শরীরটিকে রহমান ঝুঁকিয়া দেখিল। তাহার গায়ে এখনও সেই মেয়েটির ঘামের গন্ধ। আরও নিবিড় হইয়া সে সেই গন্ধ শুকিতে লাগিল।
ঘুমে তাহার চোখ জড়াইয়া আসিল।
কোনোরকমে একটা জায়গা করিয়া ছটো পুটুলিখানা মাথার নীচে রাখিয়া সে শুইয়া পড়িল। একটু পরেই সে স্বপ্ন দেখিল। আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাষ, এখন ভয়ানক বাতাস ছাড়িয়াছে দীর্ঘ সুপারি আর নারিকেল গাছের মাথায় ভীষণ মাতামাতিতে নদীর জলে দুরন্ত ঢেউ, বড়ো বড়ো ধান গাছের শিষগুলি যন্ত্রণায় কাঁপিতেছে, আকাশে পাখির কলরব, রহমান যেন শুনিতে পাইল, তাহাদের গোয়াল ঘরের গোরুগুলি মা মা করিয়া কাতরস্বরে ডাকিতেছে। মনে হয় এমন করিয়া যেন তাহারা আর কোনোদিনও ডাকে নাই। তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া গিয়া সে দেখিল, তাহার গোরু নয় তো, তাহার বউ, আর গোয়াল ঘরটা আসলে গোয়াল ঘর নয় তো, তাহার শোবার ঘর। বউ তাহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, গলা জড়াইয়া ধরিল, বুকের মাঝখানে তাহার হাতকে রাখিয়া বলিল, এই দ্যাখো, এহান কেমুন ব্যথা। তোমারে ছাইড়া আমি থাকতে পারুম না বন্ধু মইরা যামু। একটু পরে রহমান টের পাইল, তাহার দুইটি পা আরও দুইটি পায়ের সঙ্গে সুতার মতো হইয়া গিয়াছে।
–রহমান? ও রহমান?
রহমান ধড়মড় করিয়া জাগিয়া উঠিল, ভালো করিয়া চাহিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, কে? আজু?
মৌলবি তাহার বউয়ের নাম জানিত হাসিয়া বলিল, না আমি তোমার বউ না, আমি মৌলবি।
রহমান চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে বলিল, ও!
কিন্তু মৌলবি কাজের লোক, তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখিয়া বলিল,
–ভোর অইয়া আইছে, আর কত ঘুমাইবা?
রহমান বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল, সেখানে অনেক অন্ধকারের সারি এখনও ঠেলাঠেলি করিয়া মরিতেছে।
ম্যানেজারবাবুর কামরায় আলো দেখা যায়।
মৌলবি গল্প করিতে লাগিল, তাহার অভিজ্ঞতার ইতিহাস বলিয়া যাইতে লাগিল, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, রহমান কেবল হাঁ করিয়া শুনিল।
মৌলবি অনেক গল্প করিল।
কিন্তু ভোর আর হয় না, তাহারা উঠিয়া এবার ওধার অনেক ঘুরিল। দুই একজনকে জাগাইয়া গল্প করিল ঘণ্টা দুই চলিয়া গেল। তবু ভোর আর হয় না, বাহিরে তেমনি অন্ধকার, গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা কেবল জলের শব্দ।
মৌলবির ঘড়ির কাঁটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন গিয়া থামে, সে তথা রহমান আজও জানিতে পারিল না, কেবল হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল।
আবার সে একা একা কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল, লঞ্চের এটা-ওটা উঁকি ঝুঁকি মারিয়া কতক্ষণ দেখিল, শেষে হাত পা গুটাইয়া বউ-র কথা ভাবিতে লাগিল।
অনেকক্ষণ পরে ভোর হইল। এখন মস্তবড়ো নদী, ওপারের সীমানা কুয়াশায় ভরা, সূর্যের আলোয় জলের উপর কেহ কতকগুলি চকচকে নতুন টাকা ছড়াইয়া রাখিয়াছে মনে হয়। নদীর দুইপাশে মাঝে-মাঝে ইটের খোলা, পাটের গুদাম।
দূরে মিলের চিমনি দেখা গেল। কিন্তু ধোঁয়ার চিহ্ন নাই। কোথা হইতে আসিয়া আবার মৌলবি দেখা দিল। কোনো নতুন খবর সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে নিশ্চয়। বলিল, আমরা আইসা পড়ছি।
৪.
সকলের মধ্যে একটা সাড়া পড়িয়া গেল। তাহারা তাহাদের কর্মস্থলে আসিয়া পড়িয়াছে। সকলে সামনের দিকে ছুটিয়া আসিল। ওই যে কী একটা গম্বুজের মতে, এটাই কী তাদের মিল? মৌলবি তাদের বুঝাইয়া দিতে লাগিল। সে সবই জানে। সকলে বিস্ময়ে আর আনন্দে এমন একটা জিনিসের প্রতি চাহিয়া রহিল।
পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। ধীরে ধীরে লঞ্চের গতি মন্থর হইয়া আসিল, এখন পাড়ে ভিড়িবে। ম্যানেজারবাবু আসিয়া দেখা দিলেন। কেমন একটা সফলতার আনন্দে তাঁহার সারামুখ উজ্জ্বল। সকলে তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। দুই হাত ছাড়িলে যদি চলে সেখানে পাঁচ হাত সরিয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু তখনও লঞ্চটা পারে একেবারে ভিড়ে নাই, ধীরে ধীরে যেন একটা ভীষণ কলরব, সহস্র কণ্ঠের মিলিত চীৎকার ধ্বনি সকলের কানে আসিয়া বাজিল। সকলে উৎকর্ষ হইয়া উঠিল, মিল দেখার আনন্দে একেবারে ভাঙিয়া না পড়িয়া রহমান আগেই কিছুটা লক্ষ করিয়াছিল, এখন সকলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হইয়া শব্দটা আরও লক্ষ করিতে চেষ্টা করিল। মৌলবির মুখে বিস্ময়ের চিহ্নমাত্র নাই, সে নিতান্তই নির্বিকারভাবে ম্যানেজারবাবুর পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, ব্যাপারটা সকলের আগে বুঝিবার আশায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। কিন্তু ম্যানেজারবাবুর মুখ হঠাৎ ম্লান হইয়া গিয়াছে, মুখের সেই মৃদুমন্দ হাসি আর নাই। লঞ্চ চালকদের কী একটা নির্দেশ দিতে তিনি তাড়াতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেলেন।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার সন্দেহ নাই। নদীর পারেই প্রকান্ড চর, ধু-ধু করে বালু। তার পরে মিলের সীমানা। সেই ভীষণ গোলমাল আরও ভীষণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকান্ড চরটা মুহূর্তে হাজার হাজার লোকে ভরিয়া গেল; সেই লোক-গুলি প্রাণপণে দৌড়িয়া আসিতেছে, প্রাণ যায় কী বাঁচে। ব্যাপার দেখিয়া রহমানের চোখে বিস্ময়ের অন্ত নাই—যেন একটা প্রকান্ড নদীর মুখ হঠাৎ খুলিয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত জল বিপুল বেগে সারাটা পৃথিবী ভাসাইয়া লইল। রহমানের বুক কাঁপিতে লাগিল, নিঃশ্বাস দ্রুত হইয়া আসিয়াছে।
লোকগুলির কতক হুড়মুড় করিয়া জলে নামিয়া পড়িল, লঞ্চটাকে একেবারে ঘিরিয়া ফেলিল। আর বেশিরভাগই দাঁড়াইয়া রহিল পাড়ে কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা ভয়ানক চঞ্চলতা,কেহ হাত নাড়িয়া কিছু বলিতেছে, কেহ কেবলই চীৎকার করিতেছে, সকলের মুখে চোখে কার্যকলাপে এমন একটা ভাব যেন এখনই পারিলে লঞ্চটাকে ডুবাইয়া দেয়। আর কী গোলমাল! আকাশকেও ফাটাইয়া চৌচির করিয়া দিবে মনে হয়। অমন দৃপ্ত রাগান্বিত পদক্ষেপে তাহাদের পায়ের নীচের ভূমিখন্ড মুহূর্তে ধসিয়া বাইবে যেন, তাহাদের চীৎকার ধ্বনিতে নদীর জলও উত্তাল হইয়া উঠিল।
কিন্তু রহমান লক্ষ করিয়া দেখিল, একেবারে সামনে একটা লোকের মধ্যে পেছনের সকলের শক্তি যেন একত্রিত হইয়াছে। লোকটার বয়স অল্প, চেহারায় এই হাজার হাজার লোকের মধ্যে একটা পার্থক্য ধরা পড়ে। সে হাত নাড়িয়া ভয়ানক চীৎকার করিয়া কী যেন বলিতেছিল, প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই শোনা যায় নাই, কিন্তু শেষে গোলমাল আপনিই কমিয়া আসিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া শুনিল, লোকটা দৃপ্তস্বরে বলিতেছেঃ বন্ধুগণ, আমাদের দেখে আশ্চর্য হবেন না। আমরা এই মিলেরই শ্রমিক, আপনারা যেখানে কাজ করতে এসেছেন আমরা সেখানেই প্রথম কাজ করতে আসি। আমরা জানি আপনাদের শুধু চাকরির কথা বলেই আনা হয়েছে, আসল কথা বলা হয়নি। এই চাকরির ভেতর কী রহস্য তা আপনাদের কাছে গোপন করা হয়েছে। বন্ধুগণ, আমাদের কথা আপনারা একটিবার শুনুন, আমাদের বিশ্বাস করুন। যারা আপনাদের চাকরি দেবে বলে নিয়ে এসেছে তাদের আপনারা চেনেন না, কিন্তু আমরা চিনি। আমরা তাদের কাছে শুধু আমাদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতে গিয়েছিলাম, আমাদের সামান্য কয়েকটা মাত্র দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম কিন্তু তারা গ্রাহ্যই করেনি। তারা আমাদের মুখের ওপর লাথি মেরেছে! কিন্তু আমরা কেন তা সহ্য করব? আমরা স্ট্রাইক করেছি, মিলের কাজ বন্ধ। আমরা তার প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের এই শক্তিকে পিযে ফেলবার জন্যে, আমাদের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়ার জন্যে তারা মিথ্যে কথা বলে আপনাদের এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আপনারা তাদের বিশ্বাস করবেন না। ভাই সব। আপনাদের চোখে পৃথিবী যেমন, আমাদের কাছেও তাই, আপনাদের যতখানি শোষণ দুঃখ দুর্দশার কষ্ট সহ্য করে চলতে হয়, আমাদেরও তাই। আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই। আজ এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কাল কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই—আমার চাষি ভাইরা, দোহাই আপনাদের, ভাই হয়ে ভাই-এর মুখের ভাত এমন করে কেড়ে নেবেন না। একথা মনে রাখবেন, আজ যারা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারা আপনাদেরও সেই লাথি থেকে রেহাই দেবে না। বন্ধুগণ আমরা আপনাদের ভাই, ভাই-এর কথা একটিবার মন দিয়ে শুনুন, ভাই-এর কথা বিশ্বাস করুন—আপনারা এ কাজে যোগ দেবেন না, দোহাই আপনাদের, যে লোক আজ আপনাদের ভাই-এর ভাত কেড়ে নিচ্ছে, তার উল্লাসকে আর বাড়াবেন না।
রমহান স্তব্ধ হইয়া গেল, তাহার মনের ভিতর সব গোলমাল হইয়া গেল, সে আর কিছুই ভাবিতে পারে না।
ম্যানেজারবাবুর মুখে সেই হাসি আর নাই। রাগে অগ্নিমূর্তি হইয়া তিনি বলিলেন, সিঁড়ি ফ্যালো, সিঁড়ি ফ্যালো।
মৌলবি হাসিমুখে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, হাসিয়া হাসিয়া সকলকে বুঝাইল, ও কিছু নয়, একটা চাকরি খালি হইলে পঞ্চাশটা লোক আসিয়া যেমন দাঁড়ায়, ইহারাও তেমনি, পঞ্চাশটা চাকরি খালি হইয়াছে তো পঞ্চাশ হাজার লোক আসিয়া হাজির হইয়াছে। জোর করিয়াই হইবে আর কী। যেন মগের মুল্লুক। যেন মামার বাড়ির আব্দার। —প্রিয়নাথ, শ্রীপতি, বাদশা মিঞা, চাঁদ-মিঞা এবং আরও অনেকে মৌলবির কথায় সায় দিল, চরের উপর বিপুল জনতার দিকে আঙুল দেখাইয়া বোকার মতো তাহারা হাসিতে লাগিল।
ওদিকে সিঁড়ি পড়িয়াছে। একজন দুইজন করিয়া সকলে নামিতেছে সকলের শেষে নামিল রহমান। নামিয়াই সে আশে পাশে চাহিয়া দেখিল, তাহাদের গ্রামের কেহ তাহার পাশে নাই, সকলে জনতার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। সে একা একা ঘুরিতে লাগিল, একবার গেল উপরের দিকে। এখন জনতা আর সেই রকম জমাট বাঁধিয়া নাই, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।
একজন তাহার জামা ধরিয়া টানিল-বলিল,–শুনুন?
রহমান দেখিল তাহাকে যে জামা ধরিয়া টানিতেছে সে নিতান্ত অল্প বয়সের একটি ছেলে। বয়েস ষোল সতেরোর বেশি হইবে না।
মুখের রঙ বেশ ফর্সা কিন্তু রোদে লাল ঘর্মাক্ত—মাথায় বড়ো বড়ো চুল, অবিন্যস্ত, সার্টের বুকের বোম খোলা, ফর্সা বুক আর গলা বেশ চোখে পড়ে। ছেলেটি চমৎকার মিষ্টি গলায় বলিল, আপনাদের বাড়ি কোথায় ভাই?
রহমান বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। ছেলেটি আবার বলিল, বলুন না, আপনার বাড়ি কোথায়? রহমান এবার বলিল, বনগাঁ।
—বনগাঁ। বাঃ চমৎকার নামটি তো। আচ্ছা, সেটা এখান থেকে কতদূর হবে? রহমান হিসাব করিয়া বলিল কতদূর হইবে।
ছেলেটি বলিল, এখানে এই এলেন, না? এখানে কেন এসেছেন? এমনি, বেড়াতে না?
তাহার এই অনুসন্ধিৎসায় রহমান প্রথমে একটু বিরক্তি বোধ করিল, কিন্তু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আর মিষ্টি কথা শুনিয়া তাহা ভুলিয়া গেল। বলিল, এহান কাজ করতে আইছি।
–ও। ছেলেটি চারিদিকে চাহিয়া একটু পরে বলিল,-কিন্তু কাজ যারা এখন করছে তাদের উপায় হবে কী। ব্যাপার কী হয়েছে জানেন? এদের কোনো দোষ নেই তবু এদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাদের সে জায়গায় বসানো হবে। যার আর কোনো উপায় নেই এমন একজনের ভাত মারতে আপনার ইচ্ছে হয়।
রহমান কিছু বলিল না।
-বলুন না ইচ্ছে হয় কি না?
রহমান তবু কিছু বলিল না। ছেলেটি বলিল, মনে করবেন না, আপনিও চিরকালই ওদের সুনজরে থাকতে পারবেন, আপনাকেও এমনি একদিন তাড়িয়ে দেবে।–এই বলিয়া একটু হাসিয়া ছেলেটি চলিয়া গেল।
রহমানের ইচ্ছা হইল তাহাকে একটি বিড়ি খাওয়াইয়া দেয়, কিন্তু ছেলেটি তখন চলিয়া গিয়াছে।
রৌদ্রের তেজ ক্রমেই বাড়িতেছে। বালুর চর চিক চিক করে। নদীর হাওয়া রৌদ্রের মতোই তীব্র।
রহমান এদিক সেদিক ঘুরিয়া একবার উপরের দিকে গেল, দেখিল গেটের কাছে কয়েকটি লোক হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে অর্থাৎ কাহাকেও যাইতে দিবে না, এই মতলব। একটু দূরে তাহাদের গ্রামের কয়েকজন হাত গুটাইয়া জটলা করিতেছে। রহমান তাহাদের সঙ্গে জুটিল। সেই জটলায় বাদশা মিঞাই প্রধান বক্তা। তাহাকে দেখিয়া সে এক পলক হাসিয়া বলিল, রহমানরে হ্যারা তো যাইতেই দিব না, মনডা কয়।।
রহমান হাসিল, একটু পরে কী মনে করিয়া হঠাৎ বলিল, আইচ্ছা, বাদশা মিঞা—
-কও?
—হ্যাঁরা জোর কইরা গেলে কী করতো?
বাদশা মিঞা সমস্যায় পড়িল। সে এমন ব্যাপারের কথা আরও শুনিয়াছে বটে কিন্তু ইহার পরের ঘটনা আর জানে না। আমতা আমতা করিয়া বলিল, কী করতো আবার। ধইরা, মাইর দিত!
বাদশা মিঞা অকূলে কূল পাইয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, হ, মাইর দিত। ঠিক, ঠিক, ঠিক।
সুতরাং স্থির হইল, ওখানে জোর করিয়া ঢুকিলে উহারা খুব কষিয়া মার দিবে।
কিছু পরে মৌলবি আসিয়া বলিল, সামনের আর একটা গেটে তাহাদের যাইতে হইবে। সেখানে সকলেই আছে, শুধু তাহারাই কেন এখানে দাঁড়াইয়া আছে?
সকলে তাড়াতাড়ি মৌলবিকে অনুসরণ করিল।
সেই গেটের কাছে গিয়া দেখিল সেখানেও কয়েকটি লোক তেমনি হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
বাদশা মিঞার মেজাজটা খারাপ হইয়া গেল।
—যেখানেই যাই সেখানেই ইহারা জোঁকের মতো লাগিয়া থাকে কেন? মৌলবি তুড়ি মারিয়া বলিল, ভাই তোমরা হগলে আস।
এই বিপদের সময় ভাগ্যিস মৌলবির মতো মানুষ সঙ্গে ছিল। তা না হইলে কী উপায় হইত কে জানে। সকলে দল বাঁধিয়া সামনের দিকে গেল কিন্তু ততোক্ষণে সেই লোকগুলি সারা গেট জুড়িয়া শুইয়া পড়িয়াছে।
এ আবার কোন কায়দা? বাদশা মিঞা আশ্চর্য হইল। মার দিবে না তো! ব্যাপার দেখিয়া রহমান দূরে সরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে আরও কয়েকজন। আসিল। মৌলবি আর শেষ পর্যন্ত যাইতে পারিল না।
এইভাবে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। সূর্য এখন মাথার উপর উঠিয়াছে। চারিদিকে তেমনি গোলমাল। এই সমস্যার কখন যে শেষ হইবে, রহমান ভাবিয়া কুল পায় না।
এদিক-ওদিক দৌড়াইয়া, এ গেট—ও গেট করিয়া তাহার ক্ষুধা পাইয়া গিয়াছিল। একটা ছোটো পুটলিতে বউ কিছু মুড়ি চিড়া আর গুড় বাঁধিয়া দিয়াছিল। রহমান আর একজনকে লইয়া একটু নির্জনে গিয়া পুটলি খুলিয়া বসিল। খাওয়া শেষ হইলে নদীতে গিয়া হাত ধুইয়া আসিল। এখন একটা বিড়ি না খাইলে চলে না। কিছু দূরে একটা দোকানে গিয়া এক পয়সার বিড়ি সে কিনিল। কিন্তু একটা মুখে দিতেই আর একজন সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। এক মুহূর্তে এক পয়সার বিড়ি শেষ হইয়া গেল। রহমান নূতন বিবাহ করিয়াছে, সে এমনি দিয়া থুইয়া খাইবে না তো কে খাইবে!
হাজার হাজার লোকের এমন বিপুল সমাবেশ, মুহূর্তের পর মুহূর্ত এমন বিস্ময়কর ঘটনাবলির সঙ্গে সাক্ষাৎ, একটা গাছের নীচে দাঁড়াইয়া বিড়ি খাইতে খাইতে রহমান যতই ভাবিতে লাগিল ততই আশ্চর্য হইতে লাগিল।
ক্রমে বিকাল হইতে লাগিল। রৌদ্রে, অনাহারে, দৌড়াদৌড়িতে, চিন্তায় প্রত্যেককেই যেন এখন এক একটি ভূতের মতো দেখিতে। এমন সময় আবার মৌলবির ডাক আসিল। সে তাড়াতাড়ি আসিয়া জানাইয়া গেল যে তাহাদের এখন ঢুকিতে হইবে। আর দেরি করিলে চলিবে না, অনেক সময় পার হইয়া গিয়াছে।
সকলে দৌড়াইয়া গিয়া আর একটা গেটের কাছে গিয়া জড়ো হইল। গোলমাল আরও বাড়িয়া গেল। আকাশ বিদীর্ণ করিয়া নানারকম ধ্বনি উঠিল। কান ফাটাইয়া ফেলিবে আর কী। রহমান সকলের পিছনে ছিল, একেবারে সামনের দৃশ্য দেখিতে পায় না। পরে টের পাইল। তাহার সামনের লোকগুলি অনেকখানি অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। সে এখন একা পাশে চাহিয়া দেখিল, আরে সেই ছেলেটি, কী একটা উত্তেজনার লাল তাহার মুখ, চুলগুলি এলোমেলো, প্রাণপণে সে চীৎকার করিতেছে। রহমান বুঝিতে পারিল না সেই ভাষার অর্থ। সামনের দিকে চাহিয়া দেখিল, আশ্চর্য, এবার গেট জুড়িয়া শুইয়া কয়েকটি লোক। আর তাহাদের পা দিয়া মাড়াইয়া ভিতরে চলিয়া গেল মৌলবী,আর তাহার পেছনে আরও কয়েকজন। রহমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারল না, লোকগুলির দিকে কিছুক্ষণ। একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল সে।
এমন হল্লা সে জীবনেও শোনে নাই। কান ফাটিয়া গেলেও কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল। দেখিল, এখান হইতে সেখানে লোক ছুটাছুটি করিতেছে, কেহ ঘুসি দেখাইতেছে, কেহ দৌড়াইতেছে, হঠাৎ একটা লোক উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিতে শুরু করিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া দেখিল, সে লোকটি আর কেহ নয়, তাহাদের লঞ্চ পারে ভিড়িবার সময় যে লোকটি প্রথম জলের কাছে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিয়াছিল সে-ই। তাহার তখনকার কথাগুলি রহমান এখনও ভুলে নাই। তাড়াতাড়ি সে আরও কাছে গিয়া দাঁড়াইল তাহার সঙ্গে বিক্ষিপ্ত জনতা আরও ঘন হইয়া আসিল। লোকটি দৃঢ়কণ্ঠে বলিতে লাগিল :
বন্ধুগণ, আমার চাষিভাইরা…।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে। এখন প্রায় সারাটা আকাশ লাল। নীচে ধ্বংসের উৎসব দেখিয়া রক্তবর্ণ আকাশ যেন রক্তনেত্রে তাহার প্রতি চাহিয়া বিস্তর অশুভ কামনা করিতেছে। মানুষের পায়ের চাপে মাটির পৃথিবী বিদীর্ণ হইতে আর বাকি নাই। এখানকার এই কলরবের আগুনের মতো যদি কোনো শিখা থাকিত তবে সারাটা পৃথিবী নিশ্চয় পুড়াইয়া ফেলিত। বক্তা মাটিতে লাথি মারিয়া, বলিষ্ঠ ডানহাতে শূন্যে ঘুষি দেখাইয়া দৃপ্ত-স্বরে বলিল, বন্ধুগণ, আমার চাষি ভাইরা…।
কিন্তু এমন সময় হঠাৎ গুলির ভীষণ আওয়াজ, আশে পাশের সব লোক পাগলের মতো ছুটোছুটি করিতেছে, কারোর কোনো দিকে কোনো খেয়াল নাই, কে ধাক্কা খাইয়া পড়িয়া গেল, কে পায়ের তলায় পিষিয়া গেল, কারোর কোনো দিকে লক্ষ নাই, সকলেই যার যার প্রাণ হাতের মুঠায় লইয়া দৌড়াইতেছে। এক মুহূর্তে সারাটি মাঠ সশস্ত্র সৈন্যে ভরিয়া গেল।
রহমান প্রথমে লক্ষ করে নাই, যখন খেয়াল হইল তখন তাহার মাথা ঘুরিতেছে, হাত-পা কাঁপিতেছে, কানের ভিতর ভীষণ ঝাঁঝাঁ করিতে লাগিল, সে কোনো রকমে দৌড় দিল, দৌড়াইতে দৌড়াইতে শুনিতে পাইল—পেছনে কত লোকের তীব্র আর্তনাদ, কত লোকের কাতর গোঙানি। মুখ ফিরাইলে দেখিতে পাইত, কেহ রক্তাক্ত দেহে মাটিতে গড়াগড়ি দিতেছে, কেহ পড়িতে পড়িতে হাঁটিতেছে; আবার হঠাৎ বসিয়া পড়িল। শীতের দিনের গৈরিক ধুলি রক্তবর্ণ হইয়া গেল।
অনেকদূর গিয়া আর দৌড়াইতে পারিয়া রহমান তবে থামল, একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সে বসিয়া পড়িল। হাত-পা তাহার এখনও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে, বুকের ভিতর কালবৈশাখীর ঝড়। পেছনে যাদের ফেলিয়া আসিয়াছে, রহমান সেদিকে আবার চাহিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না চক্ষু তাহার বুজিয়া আসিল। সেখানকার কথা স্মরণ করিয়া চোখে তাহার জল ভরিয়া আসিল। রহমান নির্জীবের মতো পড়িয়া রহিল।
যখন উঠিল তখন অনেক রাত। কোথাও টুঁ শব্দটি নাই। রহমান ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল, শরীরের সবগুলি গ্রন্থি তাহার বেদনায় টনটন করিতেছে। তবু কোনো রকমে সে হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক পরে নদীর পারে আসিয়া দাঁড়াইল, চমৎকার ঠাণ্ডা বাতাস বহিতেছে এখানে, নদীতে নৌকা আর জাহাজের শব্দও শোনা যায়। রহমানের মনে পড়িল সেই লোকটির কথা : বন্ধুগণ, একথা আপনারা মনে রাখবেন, আজ আমাদের যারা শুধু লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারাই আপনাকেও লাথি থেকে রেহাই দেবে না।
নদীর জলের দিকে চাহিয়া রহমানের চোখ আবার ছল ছল করিয়া উঠিল।
সত্যবতীর বিদায়
শীতের এক সুগভীর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরবেলায় অত্যন্ত ময়লা কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা পুঁটুলি হাতে করে এক বৃদ্ধা, রাজকুমার রায়ের প্রকান্ড ফটকওয়ালা বাড়ির ভিতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমে ঢুকতে একটু দ্বিধা করেছিল। কারণ এই বাড়িতে সে এই প্রথম পদার্পণ করছে, কিন্তু মুহূর্ত পরেই সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে এক নিঃসঙ্কোচ কলেজ-বালিকার মতোই চাকর-বাকরের ছুটোছুটি আর কোলাহলে কাতর উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধার চেহারা এমন কদাকার যে হঠাৎ দেখলে ভয় হয়। উঁচু কপাল, তোবড়োনো নাক, মাংসল মুখ অথচ চোখদুটি অত্যন্ত ছোটো এবং গর্তে বসানো। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। বয়স পঞ্চাশের বেশি হলেও গায়ের চামড়া এখনও যথেষ্ট ঢিলে হয়ে আসেনি।
বৃদ্ধা কারোর আশায় এদিক-ওদিক চেয়ে শেষে একটা চাকরকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি না?
রাজু! রাজু কে! এই বলে চাকরটা আবার নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেল।
রাজু কে! তবে কি এটা রাজুর বাড়ি নয়? বৃদ্ধা মনে মনে খানিকটা অসহায় বোধ করল। কিন্তু বাইরে সে ভাব সম্পূর্ণ ঢেকে রেখে আর একজনকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি নয়?
ঝি মতির মা খনখন করে বলল, রাজু-টাজু কেউ এখানে নেই গো।
কিন্তু এমন সময় ভেতর থেকে মনোরমা বললো, কে রে মতির মা? এই বলে আর মতির মার উত্তরের অপেক্ষা না করে ধীরে ধীরে ভারী শরীরখানা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। তার চোখে চশমা, হাতে অনেকগুলি চুড়ি, গায়ে আঁটো সাটো সেমিজ, চওড়া নকশি পেড়ে শাড়ি, বুড়িকে দেখে মনোরমা আশ্চর্য হল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে বিস্ময়ের ভাব দমন করে ফেললে, বরং চোখের ওপর ভ্রূ কুঁচকে এসেছে।
একগাল হেসে সত্যবতী বলল, বউ, কেমন আছো? আচ্ছা তোমাদের কতকল দেখিনে, তোমাদের কথা ভেবে হয়রান হয়ে গেলুম, ঈশ্বরকে কত বলি, ঠাকুর আমার এমন ছেলে, ছেলের বউ, সব থাকতে আমি ষাটের বুড়ি কেন এত কষ্ট করে মরি? ছেলে তো আমার এমন নয় যে কক্ষনো ডাক-খোঁজ করে না, আমার রাজুর মতো ছেলে কারোর হয়? কক্ষনো হয় না, এই আমি বলে দিচ্ছি। এই তো সেবার এক দুই তিন চার, সত্যবতী হাতের কর গুণে বলল, পাঁচটা টাকার জন্যে দু-অক্ষর লিখে পাঠিয়ে দিলুম, আর অমনি তোমায় কী বলব বউ—আর অমনি যেন হাওয়ার গাড়িতে চড়ে টাকা এসে হাজির! বলতে বলতে সত্যবতীর দম বন্ধ হয়ে এল।
ইতিমধ্যেই প্রায় সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল; বাড়ির সমস্ত ছেলেমেয়েরা মন্টু-ঘেন্টু-জিতু-বেলা-হেলা ইত্যাদি সবাই এসে বুড়িকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলের ছোটো জিতু এই কুৎসিত বুড়িকে আর কখনো দেখেনি, সে মনোরমার আঁচল ধরে নাকি সুরে বলল, কে ঠাকুরমা?
সত্যবতী হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে বলল, আই ভাই আয়, তোদের নাম কী রে ভাই? আরে, আয় না? এই রাজকন্যার মতো সুন্দরী বউকে দেখে পছন্দ হচ্ছে না? সত্যবতী একটু পরিহাস করল। ওদিকে মনোরমার শীতলতাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তাকে খুশি করবার জন্যে বলল, তোমাকে ভারী শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে বউ। কোনো অসুখ করেছে বুঝি?
মনোরমা সংক্ষেপে গম্ভীর স্বরে বলল, না, কোনো অসুখ করেনি।
ওপরে পড়ার ঘরে বসে ইন্দু প্রাণপণে কলেজের পড়া মুখস্থ করছিল। নতুন মানুষের সাড়া পেয়ে বারান্দার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, মা, কে এসেছে?
মা একবার ওপর দিকে চাইলো মাত্র, কিছু বলল না। সত্যবতী চোখ বড়ো করে বলল, বউ, আমি বলে দিচ্ছি, তোমার কোনো অসুখ করেছে, তুমি না বললে আমি শুনব কেন? দাঁড়াও আমি ওষুধ দিয়ে দেব। সত্যবতী বছর দুই আগে নাকি কালী পেয়েছিল, তাঁর আশীর্বাদে একটা মূল্যবান ওষুধও পেয়েছিল এবং সত্যবতী মনোরমাকে অভয় দিল।
মন্টুরা একেবারে হাঁ করে তার দিকে চেয়েছিল, এমন কদাকার চেহারা তারা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখেনি। ছবিতেও এরকম চেহারা খুব কম দেখা যায়। দাঁত যা-ও আছে তাও এমন কালো যে দেখলে ঘেন্না করে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে কী যেন পড়ছে।
–কিন্তু ছাইপোড়া কপাল আমার,—সত্যবতী বলা-নেই-কওয়া-নেই হঠাৎ কপালে করাঘাত করে বলল, হা-ঈশ্বর! যার জন্য এতদূর এলাম তাকেই ভুলে গিয়েছি। রাজু কোথায় বউ, আমার রাজু?
মনোরমা বসবার ঘর দেখিয়ে দিল।
সত্যবতী তরতর করে অমনি সেই ঘরের দিকে ছুটল, পুঁটুলিটা কোথাও রাখবার জায়গা এখনো হয়নি, আর রাখবেই বা কোথায়? কোথাও এতটুকু পরিষ্কার জায়গা আছে কি? সেটা কাঁধে করেই সত্যবতী বসবার ঘরে ঢুকল, কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে তার চক্ষু স্থির, আহা কী চেহারা কী হয়েছে গো! ননীর শরীর যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই তকতকে সোনার বরণ রংই বা কোথায়, মাথায় সেই গভীর কালো চুলই বা কোথায়? রাজকুমার চেয়ারে বসে অনেক খাতাপত্র দেখছেন, সামনেই দুটি চেয়ারে বসে আরও দুটি লোক। সেই লোকগুলির সামনেই সত্যবতী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বললে, রাজু, তোর এ কী চেহার, হয়েছে বাবা? তোর এমন অসুখ আমায় আগে জানাসনি কেন? কেন জানাসনি বল? আমি কি তোর কেউ নই? ঈশ্বরকে কত বলি, হে ঠাকুর সবই তা দিয়েছে, তবে আর একটি মনোবাঞ্ছা যদি পূর্ণ করতে! আজ উনি বেঁচে থাকলে।
ব্যাপারটা প্রথমে রাজকুমার ভালো করে বুঝতেই পারেনি। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। একটু পরে লজ্জায় আর রাগে মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সত্যবতীকে দুহাত দিয়ে ধরে সে বলল, আহা, এখানে কেন মা? এখানে কেন মা? এখানে থেকে যাও, অন্যসময় হবে। সে সত্যবতীকে ঘরের বার করে দিল। সত্যবতী তখনো শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, একহাতে পুটুলিটা ধরে আর এক হাতে কাপড়ের আঁচল দিয়ে নাক-চোখ মুছতে লাগল।
দুর্ধর্ষ শক্তিমান কোনো লোককে কাঁদতে দেখলে যেমন হাসি পায়, এই কুৎসিত বুড়িকে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মন্টুদের হাসি পেল, তারা খিল খিল করে হাসতে লাগল।
এই দেখে সত্যবতীর রাগের সীমা নেই!
-আহা, হাসছিস কেন? আমরা গরিব বলে মানুষ নই বুঝি?
মনোরমা আর সহ্য করতে পারল না। বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন, কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন ওঘরে, তবু ওখানে গিয়ে ওদের সামনে ওরকম করছেন কেন? মনোরমার রাগ হলো, সারা জীবনে যিনি একটি দিনের জন্যও খোঁজ করেন না, তাঁর হঠাৎ এমন উৎসাহ দেখলে সত্যি হাসি পায়।
সত্যবতী রাজকুমারের পিতা নবকুমারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, তার বিবাহের ইতিহাস বড়াই বিচিত্র। রাজকুমারের মা মারা যাওয়ার বছর পাঁচেক পরে হঠাৎ একদিন ভয়নাক বাবু সেজে নবকুমার কোথায় উধাও হয়ে গেল, সাত-আটদিন পরে সঙ্গে করে নিয়ে এল এই দুর্ধর্ষ সত্যবতীকে। সত্যবতী তখনও এমনি কালো বটে, কিন্তু কিছুটা মার্জিত, চকচকে, হঠাৎ দেখলে চোখ ঝলসে যায়। তার প্রকান্ড শরীর তখন দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, ধূ-ধূ করে। নবকুমার তখন সেই রসসিক্ত শরীরটাকে পেয়ে চুলে প্রচুর কলপ মেখে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিল।
কিছুকাল পরে আবিষ্কার করা গেল, সত্যবতী কেবল সত্যবাদীই নয়, কিঞ্চিৎ মুখরাও বটে। গ্রামের ভিতর তার শক্ৰসংখ্যা হু-হু করে বেড়ে যেতে লাগল, সত্যবতী নিঃসংশয়ে একটা সিদ্ধান্ত করল যে, সমস্ত পৃথিবী তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারপর অনেকগুলি বছর কেটে গেছে এবং সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একলা সংগ্রাম করে এতকাল বেঁচে থাকা যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় বটে। নবকুমার এই স্ত্রীলোকটিকে বিয়ে করবার পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একদিন ভুলেও ছেলের খোঁজ করেনি—লোকে শুনে অবাক হয়ে যায়, বাস্তবিক মানুষ এমন পাগল হয় কী করে? শত হলেও নিজের ছেলে তো? মনোরমার অভিযোগ এইখানেই, তার জ্ব কুঁচকে এসেছে এই কারণেই। সে তার বড়ো মেয়ে জয়ন্তী এবং পুত্রবধু সুনন্দার কাছেই প্রথম ব্যাপারখানা সবিস্তারে খুলে বলল। শেষে এই বলে উপসংহার করল যে, এমন দরদ দেখলে হাসির বদলে কান্নাই পায়।
কিছুক্ষণ পরে ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে এক নতুন বিভ্রাট এসে হাজির। কেমন একটা পচা গন্ধ পেয়ে সত্যবতী নাকে কাপড় দিল, দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল, ঘরের অন্ধকার কোণের দিকটিতে একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে। আ রামো! এমন কান্ড তো জীবনেও দেখিনি। সত্যবতী অমনি দৌড়ে মনোরমার কাছে গেলো, গিয়েই একদমে বললো, বউ, তুমি জেনেশুনে যে এমন একটা কান্ড করবে তা আগে জানিনি।
মনোরমা সেদিনের বাজারের হিসেব লিখছিল। চাকর সামনে দাঁড়িয়ে, চশমাসুন্ধু ভারী মুখখানা তুলে চোখদুটি বরাবর সত্যবতীর চোখের ওপর স্থাপন করে সে বলল, কী হয়েছে?
সত্যবতী হাত-পা চোখ-মুখ সব একসঙ্গে নেড়ে হতাশার সুরে বলল, হবে আর কি! যা হবার তাই হয়েছে। একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে ঘরে। বউ, তুমি বেছে-বেছে এমন একটা ঘর কেন আমায় দিলে বলো তো? আমার রাজুর তো। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আর ঘরের অভাব নেই।
মনোরমা বিরক্ত হয়ে বলল কে বললে, আমি আপনাকে ওরকম একটা ঘরে ইচ্ছে করে থাকতে দিয়েছি! এই বলে একজন চাকরকে ডেকে চড়াইটা বাইরে ফেলে দিতে নির্দেশ দিল।
তখনও ভালো করে সন্ধ্যা হয়নি। এই সময়টা সমস্ত বাড়িটা ভোরবেলার গোলমালে ভরে যায়। ঝি উনান ধরাতে যায়, ঠাকুর মনোরমার কাছে এ বেলা কী কী রাঁধবে সে বিষয়ে পরামর্শ করতে আসে, আর বৈকালিক চা-পান এখনও যাদের হয়নি তাদের শিশুসুলভ চীকার বাড়ির ওদিকে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
এমন সময় বারান্দার আবছা অন্ধকারে কয়েকটি ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যবতী উৎসাহিত হয়ে ডাকলো, কে রে! বেলা? শোন।
বেলার দল খিলখিল করে হেসে উঠল, একটা দৌড় দিয়ে খানিকটা পালাবার চেষ্টা করে আবার যথাস্থানে ফিরে এল, বুড়ির দিকে পিটপিট করে তাকাতে লাগল।
—শুনে যা বলছি? আহা, ছেলে-বুড়ো সবাই এরকম! শুনে যা? ছোটো ছেলেমেয়ের দল এবার সাহস করে সত্যবতীর ঘরের ভিতর ঢুকল, দম বন্ধ করে বলল, কেন ডাকছ বুড়ি?
বুড়ি! সত্যবতী এক মুহূর্তে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, তাদের তেড়ে বলল, আমি বুড়ি নাকি? বজ্জাত ছেলে ধরে কান মলে দেব? যার তার সঙ্গে ইয়ার্কি, না?
বোরা আবার দমে গেল, এখন কী করবে ভেবে না পেয়ে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অন্ধকারে ঘুরঘুর করতে লাগল। এ দেখে সত্যবতীর মায়া হল। তাদের ডেকে বলল, ফের ওরকম করিসনি বুঝলি? বুঝলি তো? হ্যাঁ, তোর নাম কী রে? কী বললি? হেলা? সত্যবতী হেলা নামের ছোটো মেয়েটিকে কোলের কাছে টেনে বলল, আচ্ছা হেলা, তোরা কখনো ভূত দেখেচিস?
–ভূত, না।
–আমি দেখেছি! সত্যবতী এমনভাবে হাসল যেন কোনো ভূতের মতোই দেখায়, বলল—শোন তাহলে বলি। সেদিন শনিবার পশ্চিমপাড়ার ঘোষবাড়িতে শনিপুজোর নেমন্তন্ন ছিল, তাই সকাল-সকাল যাচ্ছিলুম। মাত্র সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পথে লোকজন নেই। গাঁ-দেশের পথ-ঘাটের কথা তো জানিস, ক-টা লোকই বা হাঁটে। সে রাস্তা দিয়ে যেতে একটা জায়গা ছিল যেখানে গাছপালা ঝোপ-জঙ্গল এত বেশি যে দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে আসে। বাঁদিকে একটা তেঁতুলগাছ আছে, কবে কোন ঝড়ে উপড়ে পড়ে রয়েছে। তবু আজও মরেনি, বছর বছর দিব্বি পাতা গজায়, তেঁতুল গজায়। এই তেঁতুলগাছের কাছে গিয়েই গা আমার ছমছম করতে লাগল, আমি জোরে হাঁটতে লাগলুম, কিন্তু ভাই পথ আর ফুরোয় না, যতোই হাঁটি না কেন পেছনদিকে চেয়ে দেখি সেই তেঁতুল গাছ। ভাবতে লাগলুম এবার কী করা যায়? ঠিক এখুনি তো মন্তরটা আওড়ানো আর ঠিক হবে না, একবার হারালে ও মন্তর আর ফিরে পাওয়া যায় না, এমন সময় দেখি আমার পথ আগলে সেই–! সত্যবতী মুখে উচ্চারণ না। করে আকারে ইঙ্গিতে বলল, বুকের ওপর থুথু ফেলল-এই প্রকান্ড…তালগাছের মতো তার দুটি ঠ্যাং, মিশমিশে কালো শরীর, ওপরের দিকে ভয়ে চেয়ে দেখলুম, তার গায়ে নেই আমাদের মতো কোনো মাথা, নেই গলা, কেবল বুকের ওপর বড়ো বড়ো দুটি চোখ, আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে! আমি তো ভয়ে হিমসিম খেয়ে গেলুম, শরীরের ভেতর ঘাম দিয়ে জ্বর এল, হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল, …সত্যবতীর ছাইরঙা দুটি চোখ বড়ো হয়ে এল, সে সকলের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সেদিনের ভয়ের ছায়াগুলি আজও তার চোখের সম্মুখে ভূতের মতো ঘুরে বেড়োচ্ছে। আর মন্টুরা? তাদের চোখও বিস্ফারিত, তারা ভয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে সত্যবতীর হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসে রইল। গল্প যখন শেষ হল তখন রাত নটা বাজতে আর বাকি নেই। সত্যবতী অনেক গল্প করল, মুখের জল ফেনা হয়ে গেছে, তার কুঞ্চিত পেটের ঘরখানায় আরও গল্প আনাগোনা করে। সত্যবতী আশ্বাস দিল, সেসব কাহিনি সে আরেক দিন বলবে—আজ আর নয় বাপু, আজ আর নয়!
-ঠাকুরমা ভয় করছে যে।
–ভয় কীসের? ভারী তত ভয়! কয়লার টুকরোর মতো কয়েকটি দাঁত বের করে সত্যবতী হাসে।
মন্টু বয়োজ্যেষ্ঠ। সকলের বড়ো হয়ে পাছে নিজের দুর্বলতা অতর্কিতে প্রকাশ পায় এই ভয়ে সে নিজের চঞ্চল দৃষ্টি যথাসম্ভব গুটিয়ে ওপরে যেতে যেতে বিজ্ঞের মতো বলল,-ভয় কীসের? আমার হাত ধরে চলে আয় হেলা।
বেশি রাত হয়নি। রান্নাঘরে এখনও রান্নার আয়োজন চলছে। বাসন আর খুন্তি নাড়ার টুং-টাং শব্দ, ঝি-চাকরের চেঁচামিচি, ওপরে ইন্দুর পড়া মুখস্থ করা, মনোরমার ছেলের ঘরে প্রথমে যে ছেলেটি রয়েছে তার অবিশ্রান্ত চীৎকার। মেয়েটা বড়ো কা