- বইয়ের নামঃ স্বাধীনতা যুদ্ধে অচেনা লালবাজার
- লেখকের নামঃ সুপ্রতিম সরকার
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০. অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের রোমহর্ষক বীরগাথা
ভূমিকা
. . .
যে লেখকের প্রথম বই ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ প্রকাশমাত্রই বিপুল সমাদর পেয়েছে পাঠকমহলে, তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের মুখবন্ধ লেখা বড় একটা সহজ কাজ নয়। ‘অচেনা লালবাজার’-এর কাহিনিগুলি শুধু অগ্নিযুগের তরুণ-তরুণীদের অসমসাহসের আখ্যানই নয়, এই বইয়ের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে নিজেরাই নিজেদের দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হওয়ার প্রবল আকুতিও, যা প্রবাহিত হত সে যুগের বিপ্লবীদের শিরায়-উপশিরায়। সেই প্রেক্ষিতেই আমার ধারণা, এই বইটি সর্বস্তরের পুস্তকপ্রেমীর কাছে সংগ্রহযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হতে চলেছে। এবং সেই কারণেই এই বইয়ের মুখবন্ধের রচয়িতা হওয়ার সুযোগও সহজে উপেক্ষা করা যায় না। অতএব, এই কয়েক লাইন।
বইটিতে দশটি কাহিনি রয়েছে, যার মধ্যে নয়টি অগ্নিযুগের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের সংগ্রামের প্রামাণ্য দলিল। একটি কাহিনির কেন্দ্রে বিরাজ করছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
‘অচেনা লালবাজার’-এ লিপিবদ্ধ কাহিনিগুলি পড়তে পড়তে অশ্রু সংবরণ করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। কী অনায়াসেই না অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন সে যুগের তরুণ-তরুণীরা! অর্থ নয়, প্রচার নয়, যাঁদের একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল দেশপ্রেমের মহতী আদর্শ। এই বইটিতে ধরা রয়েছে নাম-না-জানা বিপ্লবীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের খতিয়ান, যার সিংহভাগই দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্থান পায়নি ইতিহাস বইয়ের পাতায়।
এই বই কিন্তু ইতিহাসের পুনর্লিখনের প্রয়াস নয়। প্রয়াস বরং অজানা-অচেনা বিপ্লবীদের অপঠিত-অকথিত বীরগাথাকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার। কলকাতা পুলিশের মহাফেজখানা থেকে লেখক তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন কাহিনিগুলি। বিজয়ী বা বিজিতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসযাপন নয়, এই বই বস্তুত পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের শ্রদ্ধানিবেদন।
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘প্রকৃত নেতা তাঁরাই, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন।’ এই বইটি সেই প্রকৃত নেতাদেরই ত্যাগের উদযাপন। আশা করি, শুধু বর্তমানই নয়, আগামী প্রজন্মকেও প্রেরণা জোগাবে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাহিনিগুলি।
আজ থেকে ঠিক বিয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো-অভ্যুত্থানের সময় তোলা একটি ছবির কথা মনে করিয়ে দিই, যে ছবিতে হেক্টর পিটারসন নামের বারো বছরের এক মৃত্যুপথযাত্রী বালককে কোলে নিয়ে ছুটতে দেখা গিয়েছিল এক ক্রন্দনরত যুবককে, যে ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বকে। প্রভাবের অভিঘাতে এই ছবিটি তুলনীয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তোলা সেই পুলিৎজ়ার পুরস্কারবিজয়ী ছবিটির সঙ্গে। যে ছবিতে নাপাম বোমা নিক্ষেপের মারণ-প্রতিক্রিয়ায় এক বিবস্ত্রা বালিকাকে অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল। যে ছবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যুদ্ধের অবসানে।
আমাদের দেশের হেক্টর পিটারসনদের কাহিনিও জানা প্রয়োজন সবার। কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালা এবং সুপ্রতিমের লেখনীর মধ্যস্থতায় সেই প্রয়োজনের কিয়দংশ মিটবে বলেই আমার বিশ্বাস। ছবিটি (সৌজন্য: উইকিপিডিয়া) ভাগ করে নিচ্ছি আপনাদের সঙ্গে।
এই বইয়ের একটি কাহিনিও যদি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে, এ প্রকাশনা সার্থক। কলকাতা পুলিশ-পরিবারের পক্ষ থেকে অগ্নিযুগের নাম-না-জানা বিপ্লবীদের জানাই সশ্রদ্ধ স্যালুট।
রাজীব কুমার আই.পি.এস.
নগরপাল, কলকাতা
১৬ জুন, ২০১৮
.
লেখকের কথা
. . .
এ বই অন্য লালবাজার নিয়ে, অচেনা লালবাজার নিয়ে। এ বই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নিয়ে, অচেনা বিপ্লবীদের নিয়ে।
সূত্রপাত কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকে। যেখানে ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ শীর্ষকে গত বছরের শেষ দিকে পোস্ট করা হত অগ্নিযুগের বঙ্গজ বিপ্লবীদের বীরগাথা। কীভাবে সহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে যেনতেনপ্রকারেণ দমনের চেষ্টা করত প্রাক-স্বাধীনতা আমলের লালবাজার, থাকত তার অনুপুঙ্খ বিবরণও। কলকাতা পুলিশের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত বিস্তর নথিপত্র ঘেঁটে লেখা সেই পোস্টগুলি পাঠকদের আগ্রহ জাগিয়েছিল। বইয়ের আকারে প্রকাশিত হোক,অনুরোধ জানিয়েছিলেন অনেকে। এ বই সেই দাবিপূরণ। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকে যে কয়েক দশকের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ইতিহাসবিদরা ‘অগ্নিযুগ’ বলে অভিহিত করেন, তা নিয়ে বই রয়েছে প্রচুর। গবেষণাও বিস্তর। ইতিহাসচর্চার সেই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে এই বই মৌলিক স্তরে সমৃদ্ধ করবে, এমন দাবি করার অবকাশ নেই। ‘অচেনা লালবাজার’-এ শুধু ফিরে দেখা তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের কর্মপদ্ধতি-রণনীতি-কলাকৌশল, ফিরে দেখা সে সময়ের অসমসাহসী বিপ্লবীদের শৌর্য-বীর্য-ত্যাগ।
‘বিপ্লবী’ বলতে তাঁদের কথাই মুখ্যত, যাঁরা কাব্যে উপেক্ষিত। ইতিহাসেও। যাঁদের জন্য বরাদ্দ থেকেছে বিস্মৃতি, যাঁদের অচিন্তনীয় সাহস এবং দেশের জন্য নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের কাহিনি ঠাঁই পায়নি পাঠ্য ইতিহাসের পাতায়। গবেষকরা নিশ্চিত জানবেন কানাইলাল ভট্টাচার্য বা বীরেন দত্তগুপ্তের নাম, ইতিহাসবিদদের স্মরণে থাকবে হাবু মিত্র বা সুশীল সেনকে। কিন্তু আমার-আপনার মতো গড়পড়তা সাধারণরা?