- বইয়ের নামঃ গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার
- লেখকের নামঃ সুপ্রতিম সরকার
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
১. গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার – ১ম খণ্ড
ভূমিকা
এই বইয়ের ভূমিকা লেখার অনুরোধটি যখন এল, অস্বীকার করব না, একটু চিন্তিতই হয়ে পড়েছিলাম।
বইটিতে সংকলিত সুপ্রতিম সরকারের লেখাগুলি সাইবার-দুনিয়ায় উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলায় এমন মনোগ্রাহী রহস্যকাহিনি লেখা হয়নি, মত পোষণ করেছেন বহু পাঠক-পাঠিকা। বইয়ের আকারে যখন প্রকাশিত হচ্ছে সেই লেখাগুলি, কীভাবে শুরু করব মুখবন্ধ, ধন্দে ছিলাম তা নিয়ে। ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হয়ে অস্বস্তি আরও বাড়ল, যখন দেখলাম বইয়ের ভূমিকা তাঁদেরই সচরাচর লিখতে বলা হয়, যাঁদের নিজেদের প্রকাশিত বই রয়েছে, বা যাঁরা বিরল কোনও কৃতিত্বের অধিকারী। আমার ক্ষেত্রে উপরোক্ত দুটি শর্তের কোনওটিই প্রযোজ্য নয়। ব্যক্তিপরিচয়ে নয়, ভারতের অন্যতম দক্ষ পুলিশবাহিনীর প্রধান হিসেবেই এই ভূমিকা লেখা।
একটু তলিয়ে ভেবে অবশ্য মনে হল, ভাল লেখকদের যা যা বই পড়েছি এ পর্যন্ত, সেগুলির ভূমিকা যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁদের একজনের নামও মনে করতে পারছি না। তাঁরা কী লিখেছিলেন ভূমিকাতে, মনে নেই তা-ও। এই ভাবনাটি মাথায় আসতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, চিন্তাও অদৃশ্য হয়ে গেল। বস্তুত, কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে এবং ওয়েবসাইটে ‘রহস্য রবিবার’ সিরিজের লেখাগুলি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকমহলে যে ‘ঝড়’ উঠেছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় সংকলনটি প্রকাশ করতে একরকম বাধ্যই হয়েছি আমরা। লিখনশৈলীর বিষয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব। এবং সত্যি বলতে, লেখাগুলি একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উপায় থাকে না। এটা কম কৃতিত্বের নয়, কারণ কাহিনিগুলি সত্য ঘটনানির্ভর, লেখকের বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা ছিল না তথ্য এবং তদন্তের দিশা থেকে বিচ্যুত হওয়ার। শুধু লিখনশৈলীই নয়, আলোচিত মামলাগুলি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের পরিশ্রম ও দক্ষতার এক প্রামাণ্য নিদর্শন। এঁরা কেউ কল্পনার Sherlock Holmes বা Hercule Poirot নন, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এঁদের রহস্যভেদের ক্ষমতা এবং তদন্তের দক্ষতা বিশ্বের সেরা পুলিশবাহিনীগুলির সঙ্গে তুলনীয়।
যে বাহিনীতে এমন দুঁদে গোয়েন্দারা রয়েছেন, রয়েছেন সুপ্রতিম সরকারের মতো ক্ষমতাধর লেখক, সেই বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া বিরল সম্মানের। কলকাতা পুলিশের অফিসারদের পেশাদারিত্ব নিয়ে আমার কখনই কোনও সংশয় ছিল না। তবে এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুপ্রতিমের লিখনশৈলী আমার কাছে ছিল সানন্দ বিস্ময়ের মতো। স্বাদু লেখনিতে গোয়েন্দাদের অনন্য দক্ষতার কাহিনি পাঠকমহলে বিপুল সমাদর পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
রহস্যভেদের কাহিনির সমাবেশ যে বইয়ে, তার ভূমিকা শেষ করা যাক রহস্য দিয়েই। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি আজ থেকে ঠিক ৬৯ বছর আগের একটি খুনের মামলার প্রতি, যার কিনারা আজ পর্যন্ত হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিল অন্য মহাদেশে, অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৪৮ সালের ১ ডিসেম্বর এক অজ্ঞাতপরিচয় ‘Caucasian’ পুরুষের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। শনাক্তকরণের মতো কোনও চিহ্ন ছিল না দেহে। ট্রাউজারের পকেটে শুধু পাওয়া গিয়েছিল ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত বই ‘রুবাইয়াৎ’–এর একটি ছেঁড়া পাতা। যাতে লেখা ছিল ‘তামাম শুদ’ (এটি একটি পারস্যদেশীয় শব্দ, যার মানে ‘শেষ হওয়া’)। পাঠকরা নিশ্চয়ই পরিচিত ‘কাম তামাম’ শব্দ দুটির সঙ্গে, যা হিন্দিতে বহুলব্যবহৃত, এবং যা ‘খুন’-এর ইঙ্গিতবাহী।
খুিন এক্ষেত্রে পেশাদারি দক্ষতায় মৃতদেহের পরিধান থেকে মুছে দিয়েছিল শনাক্তকরণের সমস্ত সম্ভাব্য চিহ্ন। এই মামলাটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জটিল হত্যারহস্য হিসাবে খ্যাত। প্রচলিত ধারণা, খুনটি হয়েছিল কোনও অজানা বিষের প্রয়োগে। ‘রুবাইয়াৎ’-এর যে সংস্করণটির ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল মৃতের ট্রাউজারের পকেটে, সেটি তদন্তকারীরা খুঁজে বের করেছিলেন। বইটিতে একটি সংকেত লেখা ছিল, যার মর্মোদ্ধার আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ তো বটেই, শিক্ষাজগতের গুণীজনের বহু বছরের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। সংকেতটির অর্থ উদ্ধার করলে তবেই খুনির পরিচয় জানা সম্ভব, সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল পুলিশ।
সংকেতটি তুলে দিলাম নীচে। রহস্যরসিক পাঠক চেষ্টা করে দেখতে পারেন মর্মার্থ উদ্ধারের।
‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ আপনাদের ভাল লাগবে, আশা রাখি।
রাজীব কুমার আই.পি.এস.
নগরপাল, কলকাতা
১ ডিসেম্বর, ২০১৭
.
লেখকের কথা
শুরুতেই বলে নিই, এ বই কোনও নির্দিষ্ট পূর্বপরিকল্পনার পরিণতি নয়। কলকাতা পুলিশের জনপ্রিয় ফেসবুক পেজে পাঠক-পাঠিকাদের অনেকে অনুরোধ করেছিলেন, পুরনো কিছু মামলা নিয়ে লিখতে, যার কিনারায় সাফল্য পেয়েছিল পুলিশ।
নগরপাল শ্রীরাজীব কুমারকে জানালাম একদিন, গত বছরের জুলাইয়ের শেষাশেষি। শুনেই এক কথায় রাজি, ‘গুড আইডিয়া, লেখো, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ঐতিহ্যের কথা লিপিবদ্ধ থাকা তো উচিতই। লেখো।’
এ বইয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নগরপালের উৎসাহবাক্যেই, তাঁরই প্রেরণায়। প্রতি রবিবার আমাদের ফেসবুকের পাতায় ‘রহস্য রবিবার’ শীর্ষকে পোস্ট হতে থাকল সাড়া-জাগানো কিছু পুরনো খুনের মামলার ইতিবৃত্ত। সাইবার-দুনিয়ার পাঠক-পাঠিকাদের প্রশ্রয় এবং সমর্থনে একের পর দুই, চারের পর পাঁচ, নয়ের পর দশ। লেখাগুলি বাঁধা পড়ুক দুই মলাটে, বই হোক, অনুরোধ এল অনেক। সেই অনুরোধকে শিরোধার্য করেই তড়িঘড়ি এই বইয়ের প্রস্তুতি এবং প্রকাশ।