আর অরবিন্দ ঘোষ? মামলার সওয়াল-জবাব কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ অবতীর্ণ হয়েছিলেন অভিযুক্তদের প্রধান আইনজীবী হিসাবে। বিচারের অন্তিম পর্বে অরবিন্দ প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন পেশ করেছিলেন আবেগমথিত বক্তব্য। সাধ্যমতো বঙ্গানুবাদ রইল।
‘ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের।
আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারি হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।
অতএব আমার আবেদন ধর্মাবতার, মানুষটি আপনার এজলাসে দাঁড়িয়ে নেই শুধু, দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের ন্যায়ালয়ে।’
বিচারকের আসনে ছিলেন Charles Porten Beachcroft, যিনি অরবিন্দের সঙ্গে একই বছরে বিলেতে Indian Civil Service পরীক্ষায় বসেছিলেন। উভয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, মেধাতালিকায় অরবিন্দের স্থান ছিল বিচক্রফ্টের আগে। বিচক্রফ্ট সাহেব সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনার পর লিখেছিলেন—
I now come to the case of Arabinda Ghose, the most important accused in the case. He is the accused, whom more than any other the prosecution are anxious to have convicted and but for his presence in the dock there is no doubt that the case would have been finished long ago. It is partly for that reason that I have left his case till last of all and partly because the case against him depends to a very great extent, in fact almost entirely, upon association with other accused persons…
The point is whether his writings & speeches, which in themselves seem to advocate nothing more than the regeneration of his country, taken with the facts proved against him in this case are sufficient to show that he was a member of the conspiracy. And taking all the evidence together I am of opinion that it falls short of such proof as would justify me in finding him guilty of so serious a charge.
বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন অরবিন্দ। মুক্তিপ্রাপ্তির নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গিয়েছিল নরেন গোস্বামীর ঘাতক-যুগলের। কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বোস, যাঁরা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছিলেন দশদিনের ব্যবধানে।
সে অবশ্য শারীরিক মৃত্যু মাত্র। আসলে তো ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’।
০৩. কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!
সিনেমায় যেমন হয়, যেভাবে হয়!
রাজপথ দিয়ে আঠারো-উনিশের যুবক দৌড়চ্ছে মরিয়া। ধাওয়া করছে পুলিশ। যুবকের হাতে উদ্যত রিভলভার। মাঝেমাঝেই পিছন ফিরে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছে, ‘খবরদার!’
হুমকিতে অবশ্য কাজ হচ্ছে না বিশেষ। পুলিশ পিছু হঠার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। উর্দিধারীদের নেতৃত্বে থাকা অফিসার বুঝতে পারছেন বিলক্ষণ, যুবককে ধরে ফেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কতক্ষণ দৌড়বে এভাবে? আর দৌড়ে পালাবেই বা কোথায়? দেখাই তো যাচ্ছে, হাঁফাচ্ছে।
জানুয়ারির কলকাতায় সন্ধে জাঁকিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছাড়িয়ে সাড়ে পাঁচের দোরগোড়ায়। অফিসফেরতা মানুষের ভিড় থমকে গেছে আচমকাই, স্তব্ধ হয়ে দেখছে রিভলভার হাতে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় যুবকের। যার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে তাড়া করে আসা পুলিশবাহিনীর।
দম তো ফুরিয়ে আসছেই। মাথাও আর কাজ করছে না যুবকের। পুলিশ ধরে ফেলল বলে! কী করবে এখন? কী করা উচিত? আরে, উলটোদিক থেকেও তো দু’জন ছুটে আসছে। গায়ে উর্দি, মানে পুলিশ! এবার?
‘দাদা’-র কথা মনে পড়ে যুবকের। ‘ইংরেজদের হাতে ধরা দেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল,’ প্রায়ই বলে থাকেন ‘দাদা’। ঠিকই! ধরে ফেললে পুলিশ দগ্ধে দগ্ধে মারবে। তার চেয়ে ঢের ভাল, নিজেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া। রিভলভার তো আছেই সঙ্গে। একটা বুলেট নিজের মাথায়, ব্যস, খেল খতম!
.
বলে কী ছোকরা!
স্তম্ভিত বললে কমই বলা হয়, একেবারে বাক্রুদ্ধ হয়ে যান আলিপুর আদালতের দীর্ঘদিনের কর্মী। এইসব বিপ্লবী ছেলেপুলের কাজকারবার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তাঁর। প্রায়ই পুলিশ এদের কাঠগড়ায় তোলে রাষ্ট্রদ্রোহের নানান মামলায়। ভয়ডর এদের বিশেষ নেই, জেনে গিয়েছেন এতদিনে। কিন্তু তা বলে এই! ঘণ্টাখানেক পরে বিচারক রায় শোনাবেন। ফাঁসির হুকুম হতে যাচ্ছে নিশ্চিত। সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র হেলদোল তো নেই-ই, উলটে আবদার করছে একগাল হেসে!
—স্যার, খুব খিদে পেয়ে গেছে। জেলের একঘেয়ে খাবার তো রোজই খাই, ফিরে গিয়ে সেটাই জুটবে। আজ কচুরি-শিঙাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে…