—মিস্টার রায়, চেহারায় ‘গ্লেজ়’ ফিরিয়ে আনার ওই ইঞ্জেকশনটা দিলে হয় না?
—মন্দ বলেননি, কিন্তু ঘুম পাবে তো একটু। অবশ্য ঘণ্টাখানেক মাত্র। তারপর উঠে পড়বে, মুখে ‘গ্লেজ়’ ফিরে আসবে। ফ্রেশ লাগবে অনেক।
অনুরাগ লাফিয়ে উঠল।
—দিন আঙ্কল, দিন। ইঞ্জেকশনটা দিন প্লিজ়।
Pethidine ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। ডিসপোজ়েবল সিরিঞ্জ দেবাশিস কিনে রেখেছিলেন। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কাটল | কিন্তু যাকে বলে ‘Deep Sleep’, তাতে তলিয়ে গেল না অনুরাগ। ঘুমঘুম আচ্ছন্ন ভাব, কিন্তু জেগে। ঘণ্টাখানেক পর উঠেই বসল অনুরাগ।
—আঙ্কল, ছবি তুলে নিন এবার।
ছবি তোলা হল। ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে প্রায়। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের একজন পাড়ার কালীপুজোর ব্যাপারে কথাও বলতে এসেছেন। কাজ হাসিল সেদিনও হল না। অনুরাগকে মেট্রোতে ছেড়ে দিতে গেলেন দেবাশিস। রাসবিহারী মোড়ের PCO থেকে বাড়িতে মা-কে ফোন করল অনুরাগ, ‘একটু দেরি হচ্ছে। চিড়িয়াখানা গিয়েছিলাম। সমীরদের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছিল। চিন্তা কোরো না। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’
‘অপারেশন কিডন্যাপ’ বারবার তিনবার ফেল। সেই রাতে বিজন পরিষ্কার জানালেন দেবাশিসকে, তাঁর বাড়িতে আর সম্ভব নয়। ছেলেটাকে অনেকে দেখেছে, চিনে ফেলেছে। কৌতূহল বাড়ছে পাড়াপ্রতিবেশীর। কিডন্যাপের পর রাখার অন্য জায়গা খোঁজা দরকার।
হাওড়ার বালিতে দেবাশিসের এক পরিচিত ছিল। নাম পল্লব মুখার্জি ওরফে পলু। কাজকর্ম বলতে টুকটাক জমির দালালি, বাকি সময় এলাকায় দাদাগিরি। পরের দিনই বালি গিয়ে প্ল্যান খুলে বলা হল পলুকে। সব শুনেটুনে পলু বলল, ‘জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে পারে ঘাসবাগানের অশোক রাই ওরফে ভোদা | তোমরা ১১ তারিখ এসো একবার, তার মধ্যে আমি কথা বলে রাখছি। হাওড়া স্টেশনের কফি কর্নারে বেলা এগারোটা নাগাদ দেখা হবে।’
১১ অক্টোবর। পলুর সঙ্গে কফি কর্নারে অপেক্ষা করছিল আর একটি ছেলে। এর নাম গোপাল, গোপাল সরকার | একে সঙ্গে রাখলে কাজের সুবিধে হবে— আলাপ করিয়ে দিল পলু | চারজনে মিলে ঘাসবাগানে যাওয়া হল ভোদার সঙ্গে দেখা করতে। বহু গলিঘুঁজি পেরিয়ে ভোদার বাড়ি। কথা হল। দেবাশিস-বিজন অল্পক্ষণেই বুঝলেন, ভোদা অপরাধের দুনিয়ায় জলের মাছের মতোই স্বচ্ছন্দ। হাওড়ার নটরাজ হোটেলের কাছে গম বিক্রি করে। এহ বাহ্য | আসলে এলাকার নামকরা মস্তান, দুর্দান্ত দাপট আছে |
টাকাপয়সার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে কথা হল। কিডন্যাপের পর অপহৃতকে রাখার জায়গা দেখাতে নিয়ে চলল ভোদা। কাছেই একটি নুনের গোলা, বিশাল এলাকা জুড়ে | পরিত্যক্ত, নির্জন। অনেক ঘর, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য আঁকাবাঁকা গলিপথ | ভুলভুলাইয়ার সঙ্গে টক্করে জিততে না পারলেও লড়াই দেবে | ভোদা বিড়ি ধরিয়ে বলল, ‘এটাই ফিট জায়গা। কেউ টের পাবে না। রাতে কোনও পাহারা থাকে না। এখানে রাখতে গেলে তোমাদের দু’জনকেই পালা করে পাহারা দিতে হবে। আমার লোক পাহারা দেবে না।’
বিজন-দেবাশিস শত হলেও দাগি আসামি তো নন, একটু ঘাবড়ে গেলেন। বিজন বললেন, এই হানাবাড়িতে রাতভর একা পাহারা? অসম্ভব! দেবাশিস সায় দিলেন, অন্য জায়গা হলে ভাল হয়।
ভোদা ফ্রন্টফুটের প্লেয়ার। ব্যাকফুটের কোনও অস্তিত্বই নেই চিন্তাভাবনায় | হেসে আরেকটা বিড়ি ধরাল। বোঝা গেল, জায়গার অভাবটা কোনও সমস্যাই নয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সদলবলে পৌঁছল কাছেই Dikshit Transport Company-র গোডাউনে। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাসছয়েক আগে। একজন দারোয়ান আছে, নাম ভগবতী| ভরদুপুরেই যার মুখ থেকে মদের গন্ধ ছিটকে বেরচ্ছে ভকভক| পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি চোলাই মদ বেচা শুরু করেছে ইদানীং।
ভগবতী চাবি দিয়ে দিল এক কথায়। গুদামঘরটা বেশ বড়। নানা মাপের কাঠের প্যাকিং বক্স রাখা। বেশ পছন্দ হয়ে গেল দেবাশিস-বিজনের। হ্যাঁ, এটা চলবে।
এই সেই গুদামঘর
দু’জনে রওনা হয়ে গেলেন কলকাতায়। পরের দিন সকাল দশটায় অনুরাগের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বলা হল দুপুর দেড়টা নাগাদ কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে আসতে। দিনটা ১২ অক্টোবর। নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি থেকে কাউকে না জানিয়ে বেরল অনুরাগ| ‘হিরো’ হওয়ার স্বপ্নে মাতোয়ারা কিশোর, দূরতম কল্পনাতেও ভাবেনি, আর ফেরা হবে না।
অনুরাগকে নিয়ে দু’জনে প্রথমে গেলেন চাঁদপাল ঘাট, তারপর লঞ্চে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ায়। অনুরাগকে বললেন, হাওড়ায় একটা গোডাউনে শুটিং-এর লোকেশন। গোপাল ওপারের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। দূর থেকে দেখেই রওনা হয়ে গেল পলু আর ভোদাকে খবর দিতে। বেলা তখন সাড়ে তিনটের কাছাকাছি।
দেবাশিস-বিজন যখন অনুরাগকে নিয়ে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গুদামের রাস্তায়, গোপাল পথ আটকাল। দেবাশিসদের আলাদা ডেকে বলল, সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দিনের আলোয় গোডাউনে ঢোকা যাবে না। লঞ্চঘাটে ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলেন দেবাশিস-বিজন-গোপাল। এবং অনুরাগ। যে এতক্ষণে একটু অস্থির হয়ে পড়েছে, বলছে, বাড়িতে সন্ধের মধ্যে ফিরব বলে এসেছি। মা-বাবা খুব চিন্তা করবে। দেবাশিস আশ্বস্ত করলেন, টেকনিক্যাল সমস্যার জন্য দেরি হচ্ছে। কোনও চিন্তা নেই, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব আমরা। মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলব।