—ওটা চলছে স্যার। ফ্ল্যাটের সমস্ত বাসিন্দাদের কল ডিটেল রেকর্ডস চেয়েছি। কে কার সঙ্গে কখন কথা বলেছে বা বলছে, আপডেট রাখছি।
.
পরের দিন বিকেল। হন্তদন্ত হয়ে মলয় ঘরে ঢুকলেন গোয়েন্দাপ্রধানের। হাতে ‘কল ডিটেলস’-এর শিট একটা।
—স্যার, এই দেখুন!
—কী হল মলয়?
মলয় ‘কল ডিটেলস’-এর একটা পাতা মেলে ধরেন।
—গত রাতে সুমিত রায় একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথা বলেছে। মোস্ট প্রবাবলি অ্যান্টিসিপেটরি বেল মুভ করবে কাল-পরশুর মধ্যে।
গোয়েন্দাপ্রধান নড়েচড়ে বসেন।
—কী করে বুঝছ, অ্যান্টিসিপেটরি বেল মুভ করবে?
—অ্যাডভোকেটের নম্বর তো কল রেকর্ডসেই আছে। একটু আগে ফোনে কথা বললাম ওঁর সঙ্গে। আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। উনিই বললেন।
—হুঁ, সুমিতকে নিয়ে এসো লালবাজারে। এখনই।
—রাইট স্যার।
‘ইন্টারোগেশন রুম’ বলতে সাধারণত যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একটা আধো-অন্ধকার ঘর। সিলিং থেকে অল্প পাওয়ারের একটা বালব ঝুলছে। গা-ছমছমে একটা পরিবেশে সন্দেহভাজনকে হাড়হিমকরা গলায় জেরা করছেন অফিসার।
লালবাজারের ‘ইন্টারোগেশন রুম’-এ ওই ‘সিনেমায় যেমন হয়’ জাতীয় ব্যাপারই নেই কোনও। সাদামাটা ঘর, খুব বেশি হলে আট ফুট বাই ছয়। একটা টেবিল, যার দু’দিকে দুটো চেয়ার পাতার মতোই জায়গা আছে শুধু। একটায় তদন্তকারী অফিসার বসেন। উলটোদিকে সন্দেহভাজন।
পরিবেশ আপাতদৃষ্টিতে নিরীহই। কিন্তু যত সময় যায়, সন্দেহভাজনের পক্ষে ‘নিরীহ’ থাকে না আর তেমন। লালবাজারের একটা স্থানমাহাত্ম্য আছে। গোয়েন্দাবিভাগের তো আরও। একতলার প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চোখে পড়ছে পোশাকে বা প্লেন ড্রেসে পুলিশকর্মীদের ওঠানামা। চোখে পড়ছে বিভিন্ন শাখার বোর্ড। গুন্ডাদমন শাখা, ব্যাংক ফ্রড সেকশন, ডাকাতি-ছিনতাই দমন শাখা, হোমিসাইড… একটার পর একটা। হয়তো কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটিয়ে কোনও আসামিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করিডর দিয়ে, কোনও নির্দিষ্ট ঘরে। যে আসামির চুপসে যাওয়া চোখমুখ দেখে মনে হবে, ঝড় নয়, শরীর-মনের উপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেছে। মায়া হবে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম লোকেরও।
আবহটাই এমন, কোনওরকম বলপ্রয়োগ বা ‘আদরযত্ন’ ছাড়াই অধিকাংশের স্নায়ু বিদ্রোহ করতে শুরু করে, চোখে চোখ রেখে ওই একচিলতে ঘরে যখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঠান্ডা গলায় ছুটে আসতে থাকে। কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়, ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরতে থাকা সত্ত্বেও। থানায় বা অন্যত্র জিজ্ঞাসাবাদে কিছুতেই চিড় ধরানো যায়নি রক্ষণে, অথচ লালবাজারে এসে পোড়খাওয়া অভিযুক্তের যাবতীয় প্রতিরোধ অদৃশ্য হয়ে গেছে একঘণ্টার জেরায়, এমন যে কত দেখেছি আমরা।
সুমিত রায়কে অবশ্য বিচলিত দেখাচ্ছিল না বিশেষ। মলয়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
—হ্যাঁ, কথা বলেছি অ্যাডভোকেটের সঙ্গে। গত সাতদিনে আপনারা পাঁচবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। বাড়িতে দু’বার, থানায় ডেকে তিনবার। আমার ধারণা হয়েছে, আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই উকিলের কাছে গিয়েছিলাম।
—আমরা তো অন্য অনেককেও একাধিকবার ডেকে কথা বলেছি। প্রয়োজনে আবার বলব। কারও মাথায় আগাম জামিনের কথা এল না, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন শুধু আপনারই হল? এর থেকে কী বোঝা যায় বলুন তো?
—কী?
—ঠাকুরঘরে কে জিজ্ঞেস করতে না করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রমাণ করতে, আপনি কলা খাননি।
সুমিতকে একটুও প্রভাবিত দেখায় না মলয়ের খোঁচায়। চুপ করে থাকেন, এবং মলয় বলে যান একটানা।
—মোটিভ ছিল আপনার। ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। ভেবেছিলেন মঞ্জুদেবীকে মেরে টাকাপয়সা পাবেন বিস্তর। কপাল মন্দ, অল্পই জুটল। বেলটা আপনিই বাজিয়েছিলেন, তারপর নেমে এসেছিলেন। ঘরে ঢুকে চা খেয়েছিলেন, তারপর বয়স্কা মহিলাকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। ঠিক বলছি? শুধু সঙ্গে কে ছিল সেটা জানি না এখনও। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। বলুন, অনেক সময় আছে।
সুমিত নির্বিকার। থেমে থেমে উত্তর দেন।
—দেখুন মি. দত্ত, আপনি যা শুনতে চাইছেন, সেটাই বলব বলে যদি ভাবেন, ভুল ভাবছেন। আপনি যা যা বললেন, সেটা আপনার থিয়োরি, আপনার কল্পনা। খুনটা আমি করিনি। আগেও বলেছি, এখনও বলছি। প্রমাণ আছে কোনও? সারাদিন ধরে এখানে বসিয়ে রাখলেও একই কথা বলব। খুনটা করিনি আমি।
পুলিশ প্রশিক্ষণের সময় জেরার যা যা পদ্ধতি শেখানো হয়, সবই প্রয়োগ করলেন মলয় কয়েক ঘণ্টা ধরে। সুমিত ভাঙলেন না, মচকালেনও না। স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে খুনের মামলায় গ্রেফতার করা যায় না। হয় এমন প্রমাণ লাগে যা সন্দেহভাজনের সামনে ফেললে স্বীকারোক্তি আসা অবধারিত, নয় সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি দরকার হয় জেরার মুখে। প্রমাণ সংগ্রহ পরে, বয়ান অনুযায়ী।
কোনওটাই হাতে নেই সুমিতের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করে আদালতে তুললে হাসির খোরাক হতে হবে। হতাশ লাগে মলয়ের। সুমিতকে অনুমতি দেন বাড়ি যাওয়ার।
—বেশ সুমিতবাবু, আজকের মতো এটুকুই। আবার ডাকতে হতে পারে আপনাকে। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম, এমন ভাবার কারণ নেই, এটুকু বলে রাখলাম।