শরীরে-মনে ততদিনে সম্পূর্ণতই রণধীরের উপর নির্ভরশীল হয়ে-পড়া সুদীপা হাত চেপে ধরল স্যারের, ‘না, তুমি যাবে না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও, আমি দেখছি। টাকার জোগাড় হয়ে গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’ রণধীর নিরুত্তর থাকলেন।
টাকার জোগাড় হল। পরের দিনই সুদীপা রণধীরের হাতে তুলে দিল একটা সোনার আংটি, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।’ বাড়ির সমস্ত আলমারি-সিন্দুকের চাবি ঘরের দেরাজেই পড়ে থাকে। ঠাকুমার ঘরের সিন্দুক থেকে একটা সোনার আংটি সরিয়ে ফেলা আর কী এমন কঠিন কাজ? আংটিটা হাতে নিয়ে সুদীপাকে একটা গভীর চুমু খেলেন রণধীর। স্যারের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দে ছাত্রী তখন আত্মহারা। রণধীর বুঝে গেলেন, সুদীপা ‘সোনার হাঁস’। যাকে একবারে মেরে ফেললে চলবে না।
অর্থকষ্টের অজুহাতে দেড়-দুই মাস অন্তর টিউশনটা ছেড়ে দেওয়ার কথা তুলতে শুরু করলেন রণধীর। যা শুনলেই অস্থির হয়ে পড়ত স্যারের হাতের পুতুলে পরিণত হওয়া সুদীপা। কখনও মায়ের সোনার চেন, কখনও ঠাকুমার রুপোর বালা, কখনও বাবার আলমারিতে পড়ে থাকা ‘ইন্দিরা বিকাশ পত্র’… সুদীপা জোগান দিয়ে যেত নিয়মিত। একবার একসঙ্গে প্রায় আট-দশ হাজার টাকার মতো দরকার পড়ল রণধীরের। লাইফ ইনশিয়োরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে হবে। বাবার কাছে আবদার জুড়ল সুদীপা, ‘স্যার লজ্জায় বলতে পারছেন না। ওঁর খুব দরকার টাকার। আমাকে বলেছেন, তোমার বাবাকে বোলো, মাইনে থেকে যেন মাসে মাসে কিছু কিছু করে কেটে নেন।’ মেয়ের আর্জি ফেলতে পারলেন না সুভাষ।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরল। ‘স্টার’ পেল সুদীপা, অঙ্ক সহ তিনটে সাবজেক্টে লেটার। পালবাড়িতে সেদিন খুশির হইহই। সুভাষ বেশ কয়েক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মা-ঠাকুমাও সারা সন্ধে ধরে রান্না করলেন সুদীপার পছন্দের খাবার। দাদু ভাবতে বসলেন, ঠিক কোন উপহারটা কিনে আনা যায় নাতনির জন্য।
সন্ধেবেলা রণধীর এলেন। সুদীপা বলল, ‘যা নম্বর পেয়েছি, সবটাই স্যারের জন্য।’ বলে নিজের হাতে মিষ্টি মুখে পুরে দিল রণধীরের। ছাত্রীর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন রণধীর। শুধু ছোঁয়ালেন নয়, হাত বুলোলেন প্রায় মিনিটখানেক ধরে। মধ্যপঞ্চাশের শিক্ষক মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছেন কিশোরী ছাত্রীকে। নেহাতই স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু স্বাভাবিক লাগল না সুলেখার। মিষ্টি তো প্লেটে দেওয়াই আছে। নিজে হাতে করে খাইয়ে দেওয়ার কী আছে? যত সব আদিখ্যেতা! মাস্টারেরও বলিহারি, আশীর্বাদ করার নামে অতক্ষণ মাথায় হাত বুলোনোরই বা কী আছে! আর মেয়েও কেমন বলল, যা নম্বর পেয়েছে, সবই নাকি এই গদু মাস্টারের জন্য! ওঁর কাছে পড়িস তো শুধু অঙ্ক! বাকি সাবজেক্টগুলোর নম্বরও কি এই মাস্টারের জন্য নাকি? বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে! গদু মাস্টার পড়াতে এলেই মেয়ে আজকাল যেন খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে, নজর এড়ায়নি সুলেখার। কথাটা বলা দরকার সুভাষকে।
সুভাষ পাত্তাই দিলেন না সুলেখাকে, ‘ধুর, কী যে বলো! ভদ্রলোকের লেট ম্যারেজ। সাত-আট বছরের মেয়ে আছে একটা। আমাদের বুড়ি ওঁর মেয়ের মতো। তা ছাড়া এত ভাল রেজাল্ট করেছে ওঁর কাছে পড়ে। সামনে ইলেভেন-টুয়েলভ। তারপর জয়েন্ট এন্ট্রান্স। ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট এই দুটো বছর। এসময় দুম করে ছাড়িয়ে দেব অঙ্কের মাস্টার? হয় কখনও? তুমি এসব উলটোপালটা ভেবো না তো!’ সুভাষ জানতেন না, ‘এসব উলটোপালটা’ তাঁকেও ভাবতে হবে কিছুদিনের মধ্যেই।
‘ব্যারাকপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ফর গার্লস’-এ সায়েন্স নিয়ে ভরতি হল সুদীপা। শিক্ষক-ছাত্রীর এমনিতে দেখা হত শুধু পড়ানোর সময়টায়। সে আর কতটুকু? দেড় থেকে দু’ঘণ্টা। কখনও কখনও আড়াই। তার মধ্যে সকলের নজর এড়িয়ে একটুকু ছোঁয়া লাগা, একটুকু কথা শোনা। একান্ত সান্নিধ্যের সিকিভাগও পূরণ হয় না বাড়িতে। রণধীর-সুদীপা দেখা করতে শুরু করলেন ব্যারাকপুরের চিড়িয়া মোড়ে বা রেল স্টেশনে। স্কুল কামাই করতে শুরু করল সুদীপা। রণধীরও সপ্তাহে অন্তত দু’দিন যেতেন না নবাবগঞ্জের স্কুলে। দু’জনে ট্রেনে করে চলে যেতেন কলকাতায়। ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা, ইডেন গার্ডেন্স…। সিনেমা হলের অন্ধকারে একে অন্যের আরও কাছাকাছি আসা।
মেলামেশা যে হারে বাড়ছিল, পরিচিত কারও না কারও নজরে আজ নয় কাল পড়তই। পড়লও। এক প্রতিবেশিনী সুলেখাকে বলে গেলেন, ‘জানো, গদু মাস্টারের সঙ্গে তোমার মেয়েকে কাল দেখলাম চিড়িয়া মোড়ে। রোল খাচ্ছিল দু’জনে।’
সুলেখা চেপে ধরলেন মেয়েকে। সুদীপা বলল, ‘স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখা হয়ে গিয়েছিল স্যারের সঙ্গে। স্যারই রোল খাওয়ালেন।’ দু’-চারটে চড়-থাপ্পড় পড়ল নিয়মমাফিক। কিন্তু সুদীপা নিজের বক্তব্য থেকে নড়ল না একচুলও। সুভাষও সব শুনলেন। খটকা একটা লাগল না, এমন নয়। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও ভাবলেন, হতেও তো পারে মেয়ে সত্যিই বলছে। সুলেখাকে বোঝালেন, ‘দেখা হয়েছে, রোল খাইয়েছেন। টিচার স্টুডেন্টকে খাওয়াতেই তো পারে। খারাপটাই ভেবে নিচ্ছ কেন?’ সুলেখা জোর করলেন, ‘ছাড়িয়ে দাও এই মাস্টারকে।’
সুভাষ মানলেন না। ছাড়িয়ে দেওয়াই যায় রণধীরকে । অন্য টিচার পাওয়া যাবে না, এমনও নয়। কিন্তু মেয়েটা হয়তো দুঃখ পেয়ে পড়াই বন্ধ করে দেবে। ভাববে, বাবাও মায়ের কথায় সন্দেহ করে টিউটর ছাড়িয়ে দিল। তা ছাড়া যে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন রণধীর, সেটা শোধ করছেন টিউশনের টাকা থেকে প্রতি মাসে কিছুটা করে কাটিয়ে। এখন অগস্ট, পুরোটা শোধ হতে হতে বছর ঘুরে যাবে। ততদিন অন্তত অপেক্ষা করা যাক চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। আর সুলেখা চিরদিনই মেয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত ‘পজ়েসিভ’। তিলকে তাল করছে হয়তো অকারণে, যেমন প্রায়ই করে থাকে।