- বইয়ের নামঃ বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ আবুল মকসুদ
- প্রকাশনাঃ ডেইলি স্টার বুকস
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০. ভূমিকা : বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা
উত্সর্গ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
খাঁটি বাঙালি বুদ্ধিজীবীর প্রতিভূ
ভূমিকা
অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যায় বেশি। অখণ্ড পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে না। ভারতবর্ষে পার্শিরা সংখ্যায় অতি অল্প, কিন্তু তা তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা নয়। বাঙালি মুসলমান একই সঙ্গে আত্মঘাতী ও ভাগ্যহত। নিজেদের কৃতকর্মের কারণে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাকে বলা যায় আত্মঘাতী। অন্যের কারণে অথবা নিয়তির ফলে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে ভাগ্যহত। বাঙালি মুসলমান ভাগ্যবিড়ম্বিত তার নিজের স্বভাবদোষে, ভাগ্যচক্রে এবং অন্যের কারণেও। বারবার হয়েছে সে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার। প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যখন সে একটু দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে কোমর সোজা করে, তখনই তার ওপর এসেছে আঘাত, কোমর আর সোজা করতে পারেনি।
বাঙালি মুসলমান অগ্রসর ও দূরদর্শী নেতৃত্ব কোনোকালেই পায়নি। মুসলিম শাসক নবাবি আমলে নয়, ইংরেজ আমলে তো নয়ই, পাকিস্তানি আমলেও নয়। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ছিল বাঙালি মুসলমানের জীবনে একটি ক্রান্তিকাল অর্থাৎ একটি যুগ থেকে আর একটি যুগের মধ্যবর্তী সময়। যেকোনো পরাবৃত্তিকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি সঠিক ও বাস্তবসম্মত না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়টি অর্থবহ হয় না। সেই সময়টিতে যদি সে বিভ্রান্তিতে ভোগে এবং সে তার বিশ্বাসে অটল না হয় তা হলে পরবর্তীকালে গঠনমূলক ভালো কিছু করা সম্ভব হয় না। তার জীবনে আসে ব্যর্থতা এবং সে আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি শাসনামলের চব্বিশ বছরে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ বহু ভুল করেছে, কিন্তু সে ভুল তাঁরা স্বীকার করেন না, তাই সে ভুলের খেসরাত তাকে এখন যে দিতে হচ্ছে তাই নয়, ভবিষ্যতে আরও মারাত্মকভাবে দিতে হবে।
এই বইয়ের লেখাগুলো দৈনিক যুগান্তরের সাময়িকীতে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। সাময়িকী পাতার সম্পাদক জনপ্রিয় ছড়াকার জনাব রফিকুল হক দাদুভাই তাড়া দিয়ে লিখিয়েছেন। তিনি আমার অগ্রজপ্রতিম শ্রদ্ধাভাজন সুহৃদ, তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার অবকাশ নেই। পাঠকসমাজ থেকে অপ্রত্যাশিত অনুকূল সাড়া পাওয়া যায়। বই আকারে প্রকাশের জন্য তাগিদ দেন অনেকে। ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করে তখনই, কিন্তু আমার আলস্যে দেড় বছর দেরি হয়। রচনাগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে যে দুই তরুণ কবি আমাকে অবিরাম তাগিদের ওপর রেখেছিলেন তাঁরা হলেন জুননু রাইন এবং ইমরান মাহফুজ। তারা আমার অতি স্নেহভাজন, সুতরাং তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিব্রত করা যায় না।
এই জর্নালধর্মী লেখাগুলোকে কোনো বিশেষ শ্রেণিতে ফেলা যাবে না। ছোট প্রবন্ধবিশেষ, গবেষণামূলক রচনার উপাদান এতে যথেষ্টই আছে। একটি সময়ের চিত্র পাওয়া যাবে। উপনিবেশ পরবর্তী পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে যারা কাজ করবেন, তাঁরা এগুলো থেকে তাঁদের প্রয়োজনমতো তথ্য ও উপাদান পেতে পারেন।
প্রতিটি রচনাই যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ, তেমনি একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্কও রয়েছে। তবে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বলে প্রতিটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে দেখাই ভালো।
সৈয়দ আবুল মকসুদ
আজিজ এপার্টমেন্ট
ধানমন্ডি, ঢাকা। জানুয়ারি ২০১৯
০১. পূর্ব বাংলায় নবজীবনে যাত্রা শুরু
১৯৪৭-এর আগস্টে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯০ বছর পরে উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দু-তিন বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটি অংশের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। অতি অল্প সময়ে এত বেশি পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে ঘটেনি বলেই ধারণা করি। দীর্ঘকাল যাঁরা ছিলেন অনুদার ও রক্ষণশীল, তারা হয়ে গেলেন অনেকটা প্রগতিপন্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নিষ্প্রাণ ঢাকা নগরী হয়ে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার একটি নতুন কেন্দ্র।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি দীর্ঘ। তা কমবেশি সবাই জানে। এই এলাকার মানুষ বহুকাল ছিল অবহেলিত ও শোষিত-বঞ্চিত। দেশের অর্থনীতিও ছিল না তাদের হাতে, রাজনৈতিক ক্ষমতাও নয়। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি-অর্থনীতি সবই কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একটা পর্যায়ে পাকিস্তান-আন্দোলনে ঐকান্তিকভাবে অংশ নিয়েছিল মোটেই আবেগের বশে নয়– ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। কৃষিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসমাজ জাতীয় অর্থনীতিতে অতুলনীয় অবদান রাখছিল। পাট চাষে ও পাটশিল্পে, যদিও পাটকলগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি শিল্পপতিরা, পূর্ব বাংলার মানুষের অবদানই বেশি। চল্লিশের দশক নাগাদ এই অঞ্চলের সচ্ছল কৃষক ও একটি মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার শ্রেণির সন্তানদের অনেকে কিছুটা উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারি চাকরি-বাকরিতে ঢুকছিলেন। খুব উঁচু পদে না হোক, মোটামুটি সংখ্যার দিক থেকে বাঙালি মুসলমান সরকারি চাকরিতে যথেষ্টই ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে।