ভিনরাজ্যের কোনও গ্যাংয়ের পক্ষে একটা সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা জায়গায় এই মাপের ‘অপারেশন’ করা তো সোজা নয়। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। শ্রীকান্ত ভেবে রেখেছিল আগাম করণীয়। সূর্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সূর্য গোলদার। চাকদায় বাড়ি। কল্যাণী আর হরিণঘাটায় দুটো ডাকাতির মাল বেচেছিল শ্রীকান্তের কাছে বছরখানেক আগেই। শিশুপালের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল শ্রীকান্ত জানুয়ারির মাঝামাঝি, ‘বড়া কাম হ্যায়, টিম লে কে আ যাও তুরন্ত।’
চলে এসেছিল আটজনের গ্যাং। ধনেখালিতে বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল শ্রীকান্তই। সূর্যের গ্যাংয়ের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল বাবুলালদের। নিজে এঁকে দিয়েছিল বিমলের বাড়ির ঘরগুলোর ছবি। গভীর রাতে সবাই মিলে গিয়ে জরিপ করেও এসেছিল বাড়িটা। কীভাবে উপরে ওঠা হবে বাঁশের ভারা দিয়ে, ‘অপারেশন’-এর সময় কে কোথায় থাকবে, ছকের খুঁটিনাটি ঠিক হয়েছিল শ্রীকান্তের হরিপালের বাড়িতে।
এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি, নৃশংসতার ভোর। আগের রাতে আড়াইটে নাগাদ সবাই জড়ো হওয়া কাঁচড়াপাড়া স্টেশনে। আড়াই-তিন ঘণ্টার ডাকাতি, চন্দনাদেবীকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া চারতলা থেকে। শ্রীকান্ত নিজে উপরে ওঠেনি। একতলার ওয়ার্কশপের কাছে দাঁড়িয়ে উপর-নীচের অপারেশনের সমন্বয় করেছিল। মুখে কাপড় বাঁধা ছিল। না হলে বিমল চিনে ফেলতেন অবধারিত।
বাবুলালরা বুদ্ধি দিয়েছিল সূর্যদের, কাজের সময় ফোন সঙ্গে না রাখতে। যদি কোনওভাবে তাড়াহুড়োয় পড়েটড়ে যায়, পুলিশ খুঁজে পেয়ে যায়, ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সূর্যের টিম ফোন রেখে এসেছিল তালবান্দার ডেরায়।
কিন্তু উদ্দেশ্য তো ছিল ডাকাতি, খুন করতে হল কেন? ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যেত না? চারতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে হল এক নির্দোষ মহিলাকে, যিনি ডাকাতদের অকস্মাৎ হানায় আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়েছিলেন শুধু? ধাক্কাটা কে দিয়েছিল? পাতলা চুল আর ভারী চেহারার বাবুলাল নির্বিকারভাবে বলেছিল, ‘হাম নে ফেকা… শালি বহুৎ চিল্লা রহি থি, ইসি লিয়ে ফেক দিয়া।’ চিৎকার করছিলেন বলে ‘ফেক দিয়া’? বলছে এমন ভাবে, যেন একটা দেশলাই বাক্স বা জলের বোতল ছুড়ে ফেলার কথা হচ্ছে।
শুনে প্রবীরের মনে পড়ছিল বাদাউনের সেই ডিএসপি-র কথা, ধানুপুরার রেইডের আগে যিনি বলেছিলেন, ‘এক্সট্রিমলি ফেরোশাস এরা। সামান্যতম রেজিস্ট্যান্সেও এরা গুলি চালিয়ে দেয়। বর্ন ক্রিমিনালস… অ্যান্ড ভেরি ডেসপারেট… অল অফ দেম।’
চন্দনার মৃত্যুটা অবশ্য একেবারেই শ্রীকান্তদের হিসেবের মধ্যে ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ডাকাতিই। মৃত্যুটা ঘটে যায় স্রেফ বাবুলালদের গ্যাংয়ের বেপরোয়া স্বভাবের জন্য। শুধু ডাকাতি হলে যা হইচই হত, চন্দনার মৃত্যুতে তার একশোগুণ বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায় ঘটনাটা। আর এখানেই ডাকাতি-পরবর্তী ভাগবাঁটোয়ারার ছকটা ওলটপালট হয়ে যায় শ্রীকান্তদের।
কথা ছিল, ডাকাতির পরের দিন শ্রীকান্তের বাড়িতে লুঠের মাল নিয়ে বসা হবে। তারপর কেনাবেচার হিসেবনিকেশ। কিন্তু পরের দিনই এমন তোলপাড় শুরু হয় রাজ্যজুড়ে, এমন ‘রেইড’ শুরু করে পুলিশ, শ্রীকান্তই পরামর্শ দেয়, এখন কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকাই ভাল। হাওয়া ঠান্ডা হোক একটু, তারপর দেখা যাবে। সেইমতোই ধনেখালিতে বাবুলাল-বনওয়ারিদের ভাড়াবাড়িতে লুঠের মালপত্রের সিংহভাগ রাখা ছিল। অল্প কিছু সোনাদানা ছিল শ্রীকান্তের কাছে। সূর্যদের বলা হয়েছিল, টাকাপয়সার ভাগ পরে হবে। একটু থিতিয়ে যাক সব।
নামী ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের শখ ছিল শিশুপালের। চন্দনার ফোনটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহে কিছুদিনের জন্য ধানুপুরায় ফিরে গিয়েছিল এক আত্মীয়ের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পেয়ে। দেড় মাসেরও বেশি ফোনটা বন্ধ রাখার পর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আর লোভ সামলাতে পারেনি। নিজে যে ফোনটা ব্যবহার করত, তার সিমটা ভরে নিয়েছিল চন্দনার ফোনে। চালু করেছিল ফোন। ভাগ্যিস সেই ফোনটায় ছিল সবে গত বছর চালু হওয়া ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’!
.
চার্জশিট তৈরির সময় নিজের দীর্ঘদিনের তদন্ত-অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণটা উজাড় করে দিয়েছিলেন প্রবীর। প্রমাণ একত্রিত করেছিলেন অখণ্ড মনোযোগে। শিশুপালের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চন্দনার মোবাইল তো ছিলই। লুঠ হওয়া গয়নার প্রায় সবটাই উদ্ধার হয়েছিল বাবুলাল-বনওয়ারিদের দশঘরার ডেরা থেকে। বাকিটা শ্রীকান্তের বাড়ি থেকে। উদ্ধার হওয়া গয়নাগাটি যে বিমলের দোকানেরই, তা প্রমাণিত হয়েছিল তর্কাতীত। দোকানের সমস্ত গয়নাতে নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদায় করে দিতেন বিমল, ‘B.D’। উদ্ধার হওয়া সব গয়নাতেই ছিল ওই আদ্যক্ষর।
রাহুল আদালতে চিহ্নিত করেছিলেন বনওয়ারি আর সতীশকে, যাদের সিম বেচেছিলেন অনিন্দ্য-সুকান্তের নথিপত্র ব্যবহার করে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ফুটপ্রিন্ট যা পাওয়া গিয়েছিল, তার একাধিক মিলে গিয়েছিল অভিযুক্তদের কারও না কারও সঙ্গে। ‘টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড’-এ বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎ শনাক্ত করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের আট ডাকাতকে। সূর্য গোলদার, রতন তরাই আর বাবর আলি মণ্ডলকেও চিহ্নিত করেছিলেন ওঁরা। বিমল আদালতে শনাক্ত করেছিলেন সূর্যের সেই চামড়ার বেল্ট।