কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তার ধারণা মিথ্যা নাও হতে পারে। হয়ত সত্যিই সেটার একটা ব্লু-প্রিন্ট করে নিয়ে দলিলটা আবার যথাস্থানে রেখে গিয়েছে—কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ যেন কিরীটী থেমে গেল।
মনে হলো তার মাথার মধ্যে হঠাৎ যেন কোন একটা চিন্তা এসে উঁকি দিয়েছে।
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
কিছু না—আচ্ছা মিঃ রামস্বামী—
বলুন।
দলিলটা যে চুরি গিয়েছিল, ব্যাপারটা কে কে জেনেছিল বলুন তো?
ব্যাপারটা প্রথম থেকেই, বুঝতেই তো পারছেন, সিক্রেট ও কনফিডেনশিয়াল রাখা হয়েছে–
তবু কে কে জানত?
প্রধানমন্ত্রী, আমি আর আমার চীফ সেক্রেটারী প্রতাপ সিং ছাড়া কেউ জানে না।
প্রতাপ সিংকে নিশ্চয়ই আপনি খুব বিশ্বাস করেন?
ওঃ, শিয়োর। হি ইজ অ্যাবভ অল সাসপিসান।
হুঁ। তা বলছিলাম—
বলুন।
দলিলটা যখন পেয়ে গিয়েছেন, তখন কি আর আমার কোন প্রয়োজন আছে?
কি বলছেন মিঃ রায়, দলিলের কপি যখন করে নিয়েছে—সেটা পাচার হবেই।
আর একটা কথা
বলুন!
আমি যাবো আপনার পার্টিতে কিন্তু আমার পরিচয়টা যেন যথাসাধ্য গোপন থাকে।
আপনি যেমন বলবেন মিঃ রায় তেমনিই হবে—তারপরেই একটু থেমে মন্ত্রী মশাই বললেন, আপনার ব্যক্তিগত সিকিউরিটির জন্য যদি কোন প্রহরার প্রয়োজন বোধ করেন তো আমাকে জানাতে কোনরকম দ্বিধাবোেধ করবেন না মিঃ রায়।
না, সেরকম কিছু আপাতত আমার প্রয়োজন নেই।
গাড়ি চাই না আপনার?
না।
কোথায় উঠেছেন।
রায়সিনহা রোডে।
আপনার থাকার তো আমি ভাল ব্যবস্থা করেছিলাম।
তার প্রয়োজন নেই।
ঠিক আছে, কিছু দরকার হলে সিংকে বলবেন।
জানাবো। এখন তাহলে আমি উঠবো—
কিরীটী মন্ত্রীমশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
বিকেলের দিকে সুব্রত এলো।
দেবেশ খনো অফিস থেকে ফেরেনি। শীতের বেলা ইতিমধ্যেই ম্লান হয়ে এসেছিল। দেবেশের বসবার ঘরে চা-পান করতে করতে দুজনার মধ্যে কথাবার্তা হয়।
তারপর তোর কি খবর বল্ সুব্রত?
খবর বিশেষ কিছু নেই—স্টেশন থেকে বেরুনো পর্যন্ত ওদের আমি ফলো করেছিলাম।
তারপর?
কিন্তু স্টেশনের বাইরে একটা গাড়ি ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল—সে গাড়িতে চেপে হাওয়া হয়ে গেল।
ওদের অনুসরণ করতে পারলি না?
বিরাট সুপার লাকসারী কার—গাড়িটার নম্বর ছিল দিল্লীর।
হুঁ। তাহলে তারা সোজা দিল্লীতেই এসেছে-কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা বললে কিরীটী।
ঐ সময় বেয়ারা রামলাল এসে বললে, সাহেব অফিস থেকে ফোন করছেন।
কাকে?
রায় সাহেবকে ডাকছেন।
কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল।
কে, কিরীটী?
হ্যাঁ, কি ব্যাপার?
গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, চলে আয়।
কোথায়?
আয় না। কিরীটীর মনে হলো দেবেশ যেন কোনমতে কথা কটা বলেই ফোনের কানেকশনটা কেটে দিল।
০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়
ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়, দেবেশবাবু ফোন করেছিলেন কেন?
বুঝলাম না ঠিক। বললে গাড়ি পাঠাচ্ছে, কোথায় যেন যেতে হবে।
কোথায়?
তা তো কিছু বললো না।
দেবেশবাবু জানেন কেন তুই এখানে এসেছিস?
হ্যাঁ, বলেছি।
কিরীটীর পরনে একটা গরম পায়জামা, পাঞ্জাবি ও গায়ে শাল ছিল; সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে প্রস্তুত হয়ে নিল।
একটু পরেই গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকছে হেড-লাইট জ্বালিয়ে দেখা গেল। গাড়ির আলোটা জানালার বদ্ধ কঁচের শার্সির উপর দিয়ে ঘুরে গেল।
ঐ, গাড়ি বোধ হয় এসে গেল। চলি।
একজন নেপালী ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। কালো রঙের ঝকঝকে একটা নিউ মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি।
কিরীটী গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়িটা দেবেশের নয়, একবার মনেও হয়েছিল কথাটা; দেবেশ তার নিজের গাড়ি না পাঠিয়ে অন্য গাড়ি পাঠাল কেন? এ কার গাড়ি?
কিরীটী তখন অপরিচিত বাঁধানো মেটাল পথ ধরে নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে।
কিরীটী মনে হয় একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় সে যাচ্ছে? কিন্তু কি ভেবে কোন প্রশ্নই করল না।
প্রায় মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে কুতুবের কাছাকাছি নতুন যে পল্লী গড়ে উঠেছে, এখানে ওখানে সব নতুন বাড়ি হচ্ছে, সেই পল্লীর মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াল।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দরজাটা খুলে দিল।
কিরীটী গাড়ি থেকে নামল।
নীচের তলায় আলো জ্বলছে।
এই কোঠি?
জী সাব—অন্দর যাইয়ে—
কিরীটী দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছাকাছি যেতেই দরজাটা খুলে গেল।
খোলা দরজার সামনে দামী সুট পরিহিত চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে। যুবক তাকে অভ্যর্থনা জানাল : মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
আসুন ভিতরে।
ঘরের মধ্যে পা দিল কিরীটী। আলোকিত কক্ষ—মূল্যবান রুচিসম্মত সোফা কাউচে ঘরটি চমৎকার করে সাজানো।
কেঝা যায় কোন ধনীর গৃহ।
মিঃ দাশ কোথায়?
উপরে চলুন।
কিরীটী যুবককে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে একটা ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল।
ভিতরে যান মিঃ রায়, মিঃ দাশ ভিতরেই আছেন।
একটু যেন কেমন ইতস্তত করে কিরীটী, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। কেন যেন মনে হয় কিরীটীর, হঠাৎ এভাবে দেবেশের একটা ফোন কল পেয়ে সোজা না এলেই ভাল হতো। কিন্তু চিন্তা করবারও আর তখন সময় নেই। কিরীটী দরজা ঠেলে ভিতরে পা দিল।
আলোকিত ঘরটা।
মাঝারি সাইজের এবং সে ঘরের মধ্যেও সব মূল্যবান আসবাবপত্র। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে কিরীটী কাউকে দেখতে পেল না।
ঘরটা খালি।
একটু যেন বিস্মিত হয়েই কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে।
আসুন মিঃ রায়–গুড ইভনিং।