- বইয়ের নামঃ মন পবন
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও
মন পবন – কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
সেই মুখখানা যেন আজও ভুলতে পারিনি।
সত্যি, এমন এক একটি মুখ এক এক সময় আমাদের চোখে পড়ে যা কখনও বুঝি মনের পাতা থেকে মুছে যায় না।
সে মুখের কোথায় যেন এক বিশেষত্ব মনের পাতায় গভীর আঁচড় কেটে যায়।
এবং সেই মুখখানা যখনই মনের পাতায় ভেসে উঠেছে, তখনই মনে হয়েছে কেন এমন হল? শেষের সেই বিয়োগান্ত দৃশ্যের জন্য দায়ী কে?
কিরীটীর মতে অবিশ্যি সেই বিচিত্র শক্তি, যে শক্তি অদৃশ্য, অমোঘ সেই নিয়তি, নিষ্ঠুর নিয়তিই দায়ী।
কিন্তু তবু আমার এক এক সময় মনে হয়েছে সত্যি কি তাই, পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে তাই যদি না হবে তো এমনটাই বা ঘটে কেন?
ঘটেছে কেন?
থাক, যার কথা আজ বলতে বসেছি তার কথাই বলি।
.
কিস্তি।
কথাটা বলে কিরীটী হাত তুলে নিল।
দেখলাম শুধু কিস্তিই নয়, মাত।
পর পর তিনবার মাত হলাম এইবার নিয়ে এবং ব্যাপারটা যে সুখপ্রদ হয়নি সেটা বোধ হয় আমার মুখের চেহারাতেই প্রকাশ পেয়েছিল।
এবং কিরীটীর নজরেও সেটা এড়ায়নি, প্রকাশ পেল তার কথায় পরক্ষণেই।
বলল, কি রে, একেবারে যে চুপশে গেলি! মাত হয়েছিস তো আমার হাতে–
অদূরে সোফায় বসে কৃষ্ণা একটা নভেল পড়ছিল। এবং এতক্ষণ আমাদের খেলার মধ্যে একটি কথা বলেনি বা কোন মন্তব্য প্রকাশ করেনি।
কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণে সে কথা বললে, হ্যাঁ, কিরীটী রায় যখন তখন মাত হওয়াটাও তো তোমার গৌরবেরই সামিল হল ঠাকুরপো তার হাতে।
কিরীটী দেখলাম তার স্ত্রীর দিকে একবার আড়চোখে তাকাল মাত্র কিন্তু কথা বলল।
কৃষ্ণা স্বামীর আড়চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করেও যেন লক্ষ্য করেনি এমনি ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললে, তবে তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়া কর্তব্য বলে বোধ করছি, ভদ্রলোক নিজেও এবারে মাত হয়েছেন।
কিরীটী তার ওষ্ঠধৃত পাইপটায় একটা কাঠি জ্বেলে পুনরায় অগ্নিসংযোগে উদ্যত হয়েছিল, হঠাৎ তার উদ্যত হাতটা থেমে গেল এবং স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে, কি বললে?
বললাম আপনিও এবারে মাত হয়েছেন!
কথাটা বলে যেন একান্ত নির্বিকার ভাবেই কৃষ্ণা নভেলের পাতায় আবার মনঃসংযোগ করল।
মাত হয়েছি?
হুঁ।
পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।
মানেটা যদি বুঝিয়ে বলতে সখি!
মানে?
হুঁ।
সে তো অতিশয় প্রাঞ্জল, বেচারী নির্মলশিব সাহেব না বুঝতে পারলেও আমার কিন্তু বুঝতে দেরি হয়নি।
কি, ব্যাপার কি বৌদি? আমি এবার প্রশ্নটা না করে আর পারলাম না। কিরীটী মাত হয়েছে, বেচারী নির্মলশিব সাহেব
এতক্ষণে কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।
এবার আমি কিরীটীকেই প্রশ্ন করি, ব্যাপার কি রে?
জ্বলন্ত পাইপটায় একটা সুখটান দিয়ে কিরীটী বললে, তোকে বলা হয়নি সুব্রত, গত এক মাস ধরে নির্মলশিব সাহেব আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু নির্মলশিব সাহেবটি কে?
মনে নেই তোর, সেই যে কি আশ্চর্য নির্মলশিব সাহেব! একদা ব্যারাকপুর থানার ও. সি. ছিল, বছর দুই হল হেড কোয়ার্টারে বদলি হয়ে এসেছে।
এতক্ষণে আমার মনে পড়ে।
এবং সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারাটিও মনের পাতায় ভেসে ওঠে।
.
মোটাসোটা নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের হুড়িয়াল সেই ভদ্রলোক।
এবং দেহের অনুপাতে পদযুগল যার কিঞ্চিৎ ছোট এবং চৈনিক প্যাটার্নের বলে বাজারের যাবতীয় জুতোই যার পায়ে কিছুটা সর্বদাই বড় হত!
যার প্রতিটি কথার মধ্যে বিশেষ মুদ্রাদোষ ছিল, কি আশ্চর্য!
বললাম, হঠাৎ সেই নির্মলশিব সাহেব তোকে গত এক মাস ধরে অতিষ্ঠ করে তুলেছে মানে?
বলিস না আর তার কথা। আমিও শুনব না, সেও শোনাবেই।
কৃষ্ণা ঐসময় টিপ্পনী কেটে বলে ওঠে, অত ভণিতার প্রয়োজন কি? কেউ কোন কথা দশ হাত দূরে বসে বললেও যার ঠিক ঠিক কানে যায়, সে ঐ ভদ্রলোকের কথা শোনেনি এ কথাটা আর যেই বিশ্বাস করুক ঠাকুরপোও বিশ্বাস করে না—আমিও করি না। কিন্তু সত্যি কথাটা বলতেই বা অত লজ্জা কিসের! কেন বলতে পারছ না, শুনে বুঝতে পেরেছ, রীতিমত জটিল ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত মাত হবে তাই শুনেও না শোনার ভান! এড়িয়ে যাবার অছিলা করছ একমাস ধরে!
তাই, সখি, তাই। পরাজয় স্বীকার করছি, হার মানছি। কিরীটী বলে ওঠে।
হ্যাঁ, তাই স্বীকার কর, তাই মান।
বললাম তো, তোমার কাছে হার মানি সেই তো মোর জয়। কিরীটী হাসতে হাসতে আবার বলে।
কথা বললাম এবার আমি।
কিন্তু কি ব্যাপারটা রে?
কে জানে কি ব্যাপার! বলছিল—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, সে বলে, ঐ যে এসে গিয়েছেন জুতো!
হ্যাঁ রে, মনে নেই তোর, নির্মলশিব সাহেবের জুতো সম্পর্কে তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সেই বিখ্যাত রসিকতাটা? কে যায়। জুতো, কার? না ভুড়ির। ভুড়ি কার? নির্মলশিব সাহেবের। সাহেব কোথায়? আর একটু উপরে
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সত্যি সত্যি নির্মলশিব সাহেবই ঘরে এসে প্রবেশ করল।
এবং ঘরে ঢুকেই আমার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল।
তারপরই হঠাৎ জ্ব সোজা হয়ে এল এবং সহাস্যমুখে বলে ওঠে, কি আশ্চর্য! আরে সুব্রতবাবু না?
হ্যাঁ। নমস্কার। চিনতে পেরেছেন তাহলে!
চিনব না মানে? কি আশ্চর্য! বলেই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নির্মলশিব সাহেব।
বসুন নির্মলশিববাবু। কিরীটী এবার বলে।
কি আশ্চর্য! বসব না? আরে বসবার জন্যেই তো আসা। আর আজ যতক্ষণ না হ্যাঁ বলবেন উঠব না—একেবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই এসেছি।
কথাগুলো বলতে বলতে জাঁকিয়ে বসে নির্মলশিব এবং কথা শেষ করে বলে, এই বসলাম।
কি ব্যাপার বলুন তো নির্মলশিববাবু? এবার আমিই প্রশ্ন করি।
কি আশ্চর্য! কিছুই জানেন না সত্যি বলছেন আপনি?
সত্যিই জানি না।
কি আশ্চর্য! আরে মশাই সে এক বিশ্রী নাজেহালের ব্যাপার! বুঝলেন সুব্রতবাবু, গোল্ড একেবারে যাকে বলে সত্যি সত্যি pure gold মশাই!
গোল্ড?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—সোনা, খাঁটি সোনা এন্তার স্মাগল করছে।
.
০২.
নির্মলশিববাবুর মুখে গোল্ড এবং সেই গোল্ড স্মাগল-কথা দুটি শুনেই বুঝেছিলাম তার বক্তব্যটা কোন পথে এগুচ্ছে।
এখন আরও স্পষ্ট হল। নির্মলশিববাবু আবার বলতে শুরু করে, কিছুই খবর রাখেন না দেখছি!
মৃদু হেসে বললাম, আদার ব্যাপারী আমি। ওসব সোনাদানার ব্যাপার—কিন্তু কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছেন যখন–
সাধে কি আর হয়েছি মশাই! আমি তো ছাড়, সরকারের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, কাস্টমস এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ সকলের চোখে ধুলো দিয়ে স্রেফ যাকে বলে সকলকে একেবারে গত কয়েক মাস ধরে বুদু বানিয়ে ছেড়ে দিল।
বুদ্ধু?
তা না হলে আর বলছি কি। স্রেফ বুদ্ধু!
তা কোন হদিসই করতে পারলেন না এখনও?
কি আশ্চর্য! কি বললাম তবে?
তা যেন হল, কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎ কেমন করে আপনাদের নজরে এসে পড়ল। —অর্থাৎ বলছিলাম, ব্যাপারটা টের পেলেন কি করে? শুধালাম।
কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার ভাবে তখন পাইপ টেনেই চলেছে সোফায় হেলান দিয়ে দুটি চক্ষু বুজে।
কিন্তু যতই সে চক্ষু দুটি মুদ্রিত করে থাকুক না কেন, স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম তার ঐ নিষ্ক্রিয়তা আদৌ নিষ্ক্রিয়তা নয়, রীতিমতই যাকে বলে তার শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি জাগ্রত হয়ে রয়েছে।
অনাগ্রহের ভাবটা তার ভান মাত্রই।
কি আশ্চর্য! সেও এক অদ্ভুত ব্যাপার! আবার কথা বলে নির্মলশিব।
কি রকম? শুধালাম।
একটা চিঠি—
চিঠি?
হ্যাঁ। একটা বেনামা চিঠি পেয়ে কর্তাদের সব টনক নড়ে উঠেছে। তাঁদের টনক নড়েছে—আর প্রাণান্ত হচ্ছে আমাদের।
তা সে বেনাম চিঠিটা আপনি দেখেছেন?
তা আর দেখিনি! কি আশ্চর্য! কি যে বলেন?
কি লেখা ছিল চিঠিতে?
কি আশ্চর্য! মুখস্থ করে নিয়েছি চিঠিটা, আর কি লেখা ছিল তা মনে থাকবে না? শুনুন, লিখেছে, মাননীয় কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু—ভেবে দেখুন একবার সুব্রতবাবু, ইয়ার্কির মাত্রাটা। কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু, কেন রে বাপু, পাকামি করতে কে বলেছিল, জানাতে যদি হয় তো আগে আমাদের জানালেই হত!
তা তো নিশ্চয়ই।
তবেই বুঝুন! পাকামি ছাড়া কি আর বলুন তো!
কিন্তু চিঠিতে কি লেখা ছিল যেন বলছিলেন—
হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি, লিখেছে, আপনি কি খবর রাখেন, স্বাধীন ভারত থেকে একদল চোরাকারবারী কত সোনা গত এক বছর ধরে পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে আমেরিকায় চালান করে দিয়েছে আর আজও দিচ্ছে? এখনও যদি ঐভাবে সোনার চোরাই রপ্তানিতে বাধা না দিতে পারেন তো জানবেন, আর দুএক বছরের মধ্যে এক তোলা বাড়তি সোনাও এ দেশে আর থাকবে না।
বলেন কি, সত্যি?
কি আশ্চর্য! সত্যি মানে, চিঠিতে তো তাই লিখেছে—
লিখেছে বটে, তবে–
তবে কি?
মানে উড়ো চিঠি তো!
মানে?
মানে বলছিলাম, এমনও তো হওয়া অসম্ভব নয় যে আপনাদের খানিকটা নাজেহাল করার জন্যই কোন দুষ্ট প্রকৃতির লোক ঐ উড়ো চিঠিটা দিয়েছে।
হুঁ, আপনি বুঝি তাই ভাবছেন সুব্রতবাবু?
মানে বলছিলাম, ব্যাপারটা খুব একটা অসম্ভব কি?
আরে মশাই, না না—সোনাদানার ব্যাপার, ও ঠিকই—তাছাড়া—
তাছাড়া?
গত বছর-দুই ধরে কতকগুলো খবরও যে আমরা পেয়েছি সোনা স্মাগলিংয়ের ব্যাপারে! তারপর ঐ চিঠি
কিরীটী এতক্ষণ চুপচাপই ছিল।
আমাদের কথার মধ্যে কোন মন্তব্য করেনি।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী কথা বললে। প্রশ্ন করল, নির্মলশিববাবু!
আজ্ঞে?
বলছিলাম, কিরীটী বললে, চিঠিটা আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? হাতে, না ডাক মারফত?
কি আশ্চর্য! ওসব চিঠি বেনামা—উড়ো ব্যাপার, ডাক মারফতই চলে জানবেন চিরদিন।
চিঠিটা হাতে লেখা, না টাইপ করা? পুনরায় প্রশ্ন করে কিরীটী।
টাইপ করা।
খামে, না পোস্টকার্ডে?
খামে।
খামের ওপর ডাকঘরের ছাপটা দেখেছিলেন?
কি আশ্চর্য! বিলক্ষণ, তা আর দেখিনি? ভবানীপুরের পোস্ট অফিসের ছাপ মারা ছিল খামটার গায়ে।
ভবানীপুর ডাকঘরের?
হুঁ।
কিরীটী তারপর চোখ বুজে যেন কি ভাবে।
তারপর একসময় চোখ খুলে বলল, চিঠিটা আপনারা যা ভাবছেন, সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে তো–
কি?
তাহলে তো এক দিক দিয়ে আপনারা নিশ্চিন্তই হতে পারেন!
নিশ্চিন্ত হতে পারি?
হুঁ।
কি রকম?
হ্যাঁ, ধরে নিই যদি ব্যাপারটা সত্যিই, তাতে করে আপনাদের চিন্তার কি আছে এত?
কি আশ্চর্য! চিন্তার ব্যাপার নেই মানে?
নিশ্চয়ই। ভাঙনের মুখে আর কতদিন বাঁধ দিয়ে রোধ করবেন।
কি বলছেন?
ঠিক বলছি। বুঝতে পারছেন না, দলে ভাঙন ধরেছে! দলের কেউ মীরজাফরের রোল নিয়েছে এ নাটকে। অতএব নিশ্চিন্ত থাকুন, পলাশীর যুদ্ধ একটা শীঘ্রই হবে এবং হতভাগ্য সিরাজের পতন অবশ্যম্ভাবী!
কি আশ্চর্য!
আশ্চর্যের আর কি আছে? প্রবাদই তো আছে–History always repeats itself! ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি-এ যে সর্বকাল ও সর্ববদিসম্মত। আপনার কর্তাদের শুধিয়ে দেখবেন, তারা কথাটা স্বীকার করবেন।
দোহাই আপনার মিঃ রায়, নির্মলশিববাবু বলে ওঠে, আর কি আশ্চর্য! আর আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াবেন না, একটা বুদ্ধি বাতলান।
কিরীটী আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন সাড়াই দেয় না।
মিঃ রায়? করুণ কণ্ঠে আবার ডাকে নির্মলশিববাবু! কি আশ্চর্য! বুঝতে পারছেন না কি বিপদেই পড়েছি! এযাত্রা আমাকে সাহায্য না করলে এই পেনসনের কাছাকাছি এসে সত্যি বলছি যাকে বলে ভরাড়ুবি হয়ে যাব, বিশ্রী কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
অবশ্যই নির্মলশিব সাহেবকে সেবার কিরীটী শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছিল। এবং কিরীটী সাহায্য না করলে সেবারে সোনা পাচারের ব্যাপারটা আরও কতদিন ধরে যে চলত তার ঠিক নেই।
.
০৩.
এবং সে কাহিনীও বিচিত্র।
তবে এও ঠিক, কৃষ্ণা সেবারে অমনভাবে হঠাৎ সেদিন খোঁচা দিয়ে সুপ্ত সিংহকে জাগালে নির্মলশিববাবুর শিবত্বপ্রাপ্তি তো হতই তার এক চাকুরে ভাই মোহিনীমোহনের মত এবং চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের দর্শন আমরা পেতাম না হয়ত।
শুধু কি চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল।
সেই তিলোত্তমাসম্ভব-কাব্য।
চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল!
তিলোত্তমা!
সত্যি বার বার কত ভাবেই না অনুভব করছি, কি বিচিত্র এই দুনিয়া!
কিন্তু যাক, যা বলছিলাম।
কিরীটীর ঐ ধরনের নিরাসক্তির কারণটা নির্মলশিববাবুর জানা ছিল না, কিন্তু আমাদের—মানে আমার ও কৃষ্ণার জানা ছিল খুব ভালই।
সে কিরীটীর এক ব্যাধি।
মধ্যে মধ্যে সে এমনভাবে শামুকের মত নিজেকে খোলের মধ্যে গুটিয়ে নিত যে কিছুতেই তখন যেন তার সেই নিরাসক্তির জাগ্রত তন্দ্রা ভাঙানো যেত না।
সত্যিই বিচিত্র তার সেই আত্মসমাহিতের পর্ব।
বলাই বাহুল্য, আত্মসমাহিতের সেই পর্ব তখন কিরীটীর চলেছিল বলেই নির্মলশিববাবু প্রত্যহ এসে এসে ফিরে যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত একদিন, বিধি যদি হন বাম তো ভাগ্যর হাতেই আত্মসমর্পণ ব্যতীত আর উপায় কি ভেবে সে কৃষ্ণার কাছেই আত্মসমর্পণ করল, আমাকে এবারটা বাঁচান মিসেস রায়।
তাই তো নির্মলশিববাবু, মহাদেবটির আমার এখন জেগে ঘুমোবার পালা চলেছে। নিজের নেশায় নিজে এখন উর্ধ্বনেত্র। ওর কানে তো এখন কোন কথাই যাবে না। কৃষ্ণা বলে।
কিন্তু আমি যে অনন্যোপায় মিসেস রায়!
আচ্ছা দেখি।
কিন্তু নানাভাবে অনেক চেষ্টা করেও কৃষ্ণা কিরীটীর সাড়া জাগাতে পারে না।
তবু নির্মলশিবও আশা ছাড়ে না, সে-ও আশা ছাড়ে না।
অবশেষে সেদিন কিস্তিমাতের ব্যাপারের মোক্ষম মুহূর্তে ছোট্ট একটি মোক্ষম বাণে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ হল।
.
কিন্তু পরের কথাপ্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম, সেবারকার কিরীটীর নিরাসক্তির ব্যাপারটা সত্যি-সত্যিই নিরাসক্তির তন্দ্রা ছিল না।
সোনা স্মাগলের ব্যাপারটা ইতিপূর্বেই তার মনকে নাড়া দিয়েছিল। এবং কিছুদিন যাবৎ ঐ ব্যাপারের প্রস্তুতির মধ্যেই ড়ুবেছিল সে।
কাজেই কৃষ্ণার কিরীটীর তন্দ্রা ভাঙানোর ব্যাপারটা বাইরে আকস্মিক হলেও ভিতরে ভিতরে সত্যিই আকস্মিক ছিল না।
কিন্তু যা বলছিলাম, সেদিনকার কথা—
কিরীটীর সহসা আবার সাড়া পাওয়া গেল।
নির্মলশিববাবু!
আজ্ঞে?
মোহিনীমোহন চৌধুরীর কথা মনে আছে আপনার?
মোহিনীমাহন-মানে আমাদের সেই ব্রাদার অফিসার মোহিনীমোহন?
হ্যাঁ, যিনি অকস্মাৎ মাস ছয়েক আগে এক রাত্রে এই কলকাতা শহর থেকে, সুব্রতর ভাষায়, যাকে বলে যে একেবারে কপূরের মত উবে গেলেন! এবং যার কোন পাত্তাই এখনও পর্যন্ত আপনাদের বড়কর্তারাও করতে পারেননি, মনে আছে তার কথা?
আহা, মনে থাকবে না—মনে আছে বৈকি। মোহিনীর বেচারী বুড়ী মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সে কি কান্না
কিন্তু আপনার তো শুধু মাতৃদেবীই নন, ঐ সঙ্গে স্ত্রী ও আপনার পঞ্চকন্যা আছে –একসঙ্গে বারো জোড়া চক্ষু যদি কাদতে শুরু করে!
মানে—মানে—
মানে অতীব প্রাঞ্জল। সোনার কারবার যাদের, তাদের হৃদয়টা ঐ সোনার মতই নিরেট হয়ে থাকে বলেই আমার ধারণা।
সত্যি কথা বলতে কি, ঐসময় আমারও কিরীটীর কথাটা কেমন যে হেঁয়ালির মতই বোধ হচ্ছিল। কারণ তখনও আমি বুঝতে পারিনি, অতঃপর কোন্ দিকে কিরীটী মোড় নিচ্ছে।
নির্মলশিববাবু! আবার কিরীটী ডাকল।
বলুন?
এবং প্রায় ঐ সময়েই এই কলকাতা শহরে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল–মনে আছে বোধ হয় সেই ঘটনাটাও সকলেরই আপনাদের?
কোন্–কোন্ হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছেন, বলুন তো মিঃ রায়?
বলছি, তবে একটা ব্যাপার সে-সময় অনেকেই লক্ষ্য করেননি যে-নৃশংস দ্বিতীয় সেই হত্যাকাণ্ডটা ঘটে ঠিক মোহিনীমোহনের নিরুদ্দেশ হবার সাতদিন পরে
তার মানে?
এতক্ষণে দেখলাম সত্যি-সত্যিই যেন নির্মলশিববাবু সচকিত হয়ে ওঠে।
মানে আর কি–খুব সম্ভবত অর্থাৎ মোহিনীমোহনের নিরুদ্দেশ ও ঐ হত্যাকাণ্ড ব্যাপার দুটো যোগ দিলে দুয়ে দুয়ে চারের মতই তাদের যোগফল দাঁড়াবে।
কিন্তু-কিন্তু–
তাই বলেছিলাম, এ সোনা নয়—মায়ামৃগ! মৃত্যুবাণ যে কখন কোন্ পথে কার বুক এসে বিঁধবে!
মনে হল কিরীটীর এই কথায় যেন নির্মলশিব সত্যিসত্যিই একেবারে হাওয়া-বেরহয়ে-যাওয়া বেলুনের মতই চুপসে গেল মুহূর্তে।
এবং হঠাৎ যেন একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল।
কিরীটীর সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথায় আমার তখন মনে পড়ে যায়, ছমাস আগেকার সত্যি-সত্যিই সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথাটা।
.
নৃশংসতারও বুঝি একটা সীমা আছে। কিন্তু সেই বিশেষ হত্যাকাণ্ডটা যেন সে সীমাকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল।
সংবাদপত্রে সেদিন প্রথম ব্যাপারটা জানতে পেরে সত্যিই যেন মূক হয়ে গিয়েছিলাম।
আজকের দিনের সভ্য মানুষের মনের কি নির্মম বিকৃতি!
অবশ্যই আজকের দিনে শিক্ষা কৃষ্টি ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে মানুষ যত এগিয়ে চলেছে, তাদের চরিত্রও যেন ততই বিচিত্র সব বিকৃতির মধ্যে দিয়ে বীভৎস হয়ে উঠছে।
তবু কিন্তু সেদিনকার সেই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডটা মনকে আমার বিমূঢ় বিকল করে দিয়েছিল।
কোন একটি মানুষের দেহকে সম্ভবত কোন অতীব ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে টুকরো টুকরো করে দেহের সেই টুকরোগুলো বালিগঞ্জ স্টেশনের ধার থেকে কালীঘাট ব্রীজের ওপারে বেলভেডিয়ার পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
শহরের এক বিখ্যাত সার্জেনের সাহায্যে পুলিসের কর্তৃপক্ষ পরে সেই দেহখণ্ডগুলিকে একত্রিত করে সেলাই করে জোড়া দেয়।
কিন্তু তথাপি সে দেহ কোনমতে আইডেনটিফাই করতে পারে না।
কারণ সেই খণ্ডগুলিতে কোন চামড়া নখ বা কেশর কোন অস্তিত্ব না থাকায় দেহটি পুরুষ না নারীর সেটুকুও তখন বোঝাবার উপায় ছিল না।
কিরীটীর সাহায্য নেবার জন্য কর্তৃপক্ষ সেসময় তাকেও ডেকে নিয়ে মর্গে সেই সেলাই করা দেহটি দেখিয়েছিল।
কিরীটী সে-সময় কর্তৃপক্ষকে কেবল বলে এসেছিল—ঐ সেলাই করা বস্তুটির একটা ফটো তুলে রাখুন আর এই তল্লাট ও এর আশপাশের এলাকাগুলো ভাল করে একবার খোঁজখবর করে দেখুন।
বলাই বাহুল্য, সেই সময়ের কিছু আগে থাকতেই কিরীটীর নিষ্ক্রিয় জাগরণ-নিদ্রা চলেছে।
অতএব সুপ্ত সিংহকে জাগানো যায় নি ঐ সময়।
অবশ্যই ব্যাপারটা ঐখানেই সে-সময় চাপা পড়ে গিয়েছিল।
তবে কিরীটী কর্তৃপক্ষকে ঐ সময় আরও একটা কথা বলেছিল, যার মধ্যে মোহিনীমোহন চৌধুরীর নিরুদ্দেশের ব্যাপারের একটা যোগাযোগের ইঙ্গিতও ছিল।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেদিকে তখন দৃষ্টি দেওয়াই প্রয়োজন বোধ করেননি।
তাদের তখন স্থির বিশ্বাস, মোহিনীমোহন চৌধুরী সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়েছেন, কারণ তার চরিত্রের মধ্যে সর্বস্বত্যাগের নাকি একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তো ছিলই–তার কোষ্ঠীতেও নাকি সন্ন্যাস যোগ ছিল।
আরও একটা বিচিত্র ব্যাপার সে-সময় ঘটেছিল।
মোহিনীমোহনের মা মোহিনীর নিরুদ্দিষ্ট হবার ঠিক পাঁচদিন পরে হরিদ্বার থেকে ডাকযোগে পুত্রের হস্তলিখিত একটা চিঠি পান।
তাতে লেখা ছিল—আমি চললাম, আমার খোঁজ করো না।–ইতি মোহিনী।
কর্তৃপক্ষ ঐ চিঠিটা পেয়ে সে-সময় দুর্নাম ও অকৃতকার্যতার লজ্জার হাত থেকে বুঝি নিষ্কৃতিও পেয়েছিল।
.
০৪.
নির্মলশিব আবার প্রশ্ন করল, কিন্তু কোন হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছিলেন, মিঃ রায়?
কিরীটী তখন সংক্ষেপে সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কথাটা বিবৃত করে গেল।
I see! আপনি সেই হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু—
কি?
কিন্তু মোহিনীমোহন তো সন্ন্যাস নিয়েছেন এবং তার প্রমাণও আছে–তার সেই চিঠি–
হ্যাঁ সেই চিঠি, কিন্তু সে চিঠি যে তারই লেখা—তার তো অবিসংবাদী প্রমাণ সেদিন আমরা পাইনি নির্মলশিববাবু!
সে কি! পেয়েছি বইকি। তার মা-ই তো ছেলের হাতের লেখা দেখে চিনেছিলেন!
না।
মানে?
মানে হচ্ছে, মোহিনীমোহনের মা তখন চোখে ছানি পড়ায় কিছুই একপ্রকার দেখতে পান না।
ছানি পড়েছিল তার চোখে?
হ্যাঁ।
কিন্তু সেকথা আপনি জানলেন কি করে, মিঃ রায়?
কারণ মোহিনীমোহনের একজন ছোট ভাই আছে, জানেন?
হ্যাঁ, রমণীমোহন।
সেই রমণীমোহন সে-সময় এসেছিল আমার কাছে ঐ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করবার জন্য। এবং তার মুখেই সেদিন সেকথা আমি শুনেছিলাম।
কিন্তু–
যাক সেকথা নির্মলশিববাবু, বলছিলাম সেদিনও যা বলেছিলাম আপনার কর্তৃপক্ষকে–আজ আপনাকও তাই বলব, সে চিঠি মোহিনীমোহন চৌধুরীরই যে হাতের লেখা তার কোন সত্য বা নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ছিল না।
তবে কি আপনি মনে করেন, মিঃ রায়, সত্যিসত্যিই–
হ্যাঁ, সেই সোনার হরিণের পশ্চাদ্ধাবনের জন্যই তার মৃত্যু—অর্থাৎ তার অকালমৃত্যু হয়েছিল দানবীয় নৃশংস ভাবে।
ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করছিলাম ধীরে ধীরে নির্মলশিব সাহেবের সমস্ত উৎসাহই যেন নির্বাপিত হয়ে এসেছে।
তাহলে দেহটা তার কোথায় গেল? শুধাল এবার একটা ঢোক গিলে নির্মলশিব।
দেহ?
হ্যাঁ।
খোঁজেননি ভাল করে চোখ মেলে তাই পাননি, নচেৎ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই পেতেন।
কিন্তু–
তবে মনে হচ্ছে এবারে সন্ধান পাবেন।
পাব?
পাবেন।
কৃষ্ণা কখন একফাকে ইতিমধ্যে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্য করিনি।
এমন সময় জংলীর হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে সে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করল।
আমি ও কিরীটী একটা করে ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিলাম, কিন্তু নির্মলশিববাবু জংলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চা নয়—আমাকে এক গ্লাস জল দাও।
নির্মলশিবের শুষ্ক কণ্ঠে সেই এক গ্লাস জল কথাটি যেন অতিকষ্টে উচ্চারিত হল।
কৃষ্ণা হেসে বলে, নিন নিন, চা খান!
করুণ দৃষ্টিতে তাকাল নির্মলশিব কৃষ্ণার মুখের দিকে এবং পূর্ববৎ শুষ্ক কণ্ঠেই বললে, চা খাব?
হ্যাঁ, নিন।
কিরীটী টিপ্পনী কাটল, আরে মশাই, মৃত্যুকে ভয় করলে কি আপনাদের চলে? আপনাদের তো জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য।
অতঃপর চা নয়, যেন চিরতার জল—এইভাবে অতিকষ্টে একটু একটু করে গলাধঃকরণ করলে নির্মলশিব সাহেব।
তারপর নিঃশেষিত চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, কি আশ্চর্য! এ। যে দেখছি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুল বলে মনে হচ্ছে!
কিরীটী মৃদু হেসে আবার টিপ্পনী কাটল, হ্যাঁ, ঢোঁড়া নয়, জাতসাপ একবারে। তা যাক গে সেকথা, আপনাকে আমি সাহায্য করব নির্মলশিববাবু, তবে এক শর্তে–
শর্তে!
হ্যাঁ আপাতত আপনি ঐ ব্যাপারে আমাকে যে সঙ্গে নিয়েছেন, সেকথা কাউকেই জানাতে পারবেন না।
বেশ।
আপনার কর্তৃপক্ষকেও নয় কিন্তু—
তাই হবে।
সেদিনকার মত নির্মলশিব গাত্রোখান করল।
.
নির্মলশিবের প্রস্থানের পর আধ ঘণ্টা কিরীটী যেন কেমন ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল।
দুটি চক্ষু বোজা।
বুঝলাম কিরীটী নির্মলশিবের ব্যাপারটাই চিন্তা করছে।
অগত্যা আজ আর এসময় এখানে বসে থাকা বৃথা। উঠব উঠব ভাবছি, এমন সময় কিরীটী সহসা চক্ষু মেলে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, চল্ সুব্রত, একটু সন্ধ্যার হাওয়া খেয়ে আসা যাক পদব্রজে।
জুন মাস। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময় সেটা।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলেও বাইরের প্রচণ্ড তাপ যে এখনও অগ্নিবর্ষণ করছে সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ আমি।
কিরীটীর এয়ারকন্ডিশন ঘর বরং আরামেই বসে আছি; তাই বললাম, বাইরে এখনও গরম–
চল্ চল, বেশ ফুরফুরে দখিনা হাওয়া বাইরে দেখবি!
সত্যিই-সত্যিই অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
কৃষ্ণাও এবারে স্বামীর মুখের দিকে একটু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে শুধাল, সত্যিই বেরুচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ, যাই, অনেকদিন ঘরের বাইরে পা দিইনি—ভবানীপুর অঞ্চলটার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বলতে বলতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী ঘর থেকে বের হতেই সহাস্যে কৃষ্ণা বললে, ভাগ্যে তুমি দাবা খেলায় আজ ওর কাছে মাত হয়েছিলে ভাই, নচেৎ সত্যি বলছি, গত ছ-সাত মাস ও ঘরের বাইরেই পা দেয়নি–
কিন্তু তাতে করে তো তোমার দুঃখ হওয়া উচিত নয় বৌদি। বরং–
না ভাই, ওকে নিষ্ক্রিয় দেখলে কেমন যেন আমার ভয়-ভয় করে!
ভয় করে নাকি?
হ্যাঁ, সে সময়টা ও যেন কেমন আলাদা মানুষ হয়ে যায়। কেমন অন্যমনস্ক।
হবেই তো, ও হচ্ছে প্রতিভার আত্মকণ্ডুয়ন। প্রতিভা জেনো চিরদিনই এককনিঃসঙ্গ।
আমাদের কথার মধ্যেই কিরীটী প্রস্তুত হয়ে পুনরায় ঘরে এসে ঢুকল। বলল, চল্।
.
০৫.
দুজনে রাস্তায় বের হয়ে হেঁটে চললাম।
সন্ধ্যার অন্ধকার সবে ঘন হয়ে এসেছে, চারিদিকে রাস্তায় ও দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।
কিরীটী কিন্তু মিথ্যা বলেনি।
বাইরে সত্যিই যেন ভারি একটা মিষ্টি হাওয়া ঝিরঝির করে বইছিল।
সারাটা দিনের প্রচণ্ড তাপের দহনের পর ঐ ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়াটুকু সত্যিই উপভোগ্য।
কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে যায়।
নিঃশব্দে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
অফিসের ছুটির পর ঘরমুখো হাজার হাজার চাকুরেদের রাস্তায় ও ট্রামে-বাসে বাদুড় ঝোলা ভিড় চোখে পড়ে।
হঠাৎ কিরীটী একসময় বলে, শেষ কবে আদমসুমারী হয়েছে রে সুব্রত?
কেন?
না, তাই বলছি। অনেকদিন বোধ হয় জনসংখ্যা গোনা হয় নি!
বুঝলাম মানুষের ভিড়কে লক্ষ্য করেই কিরীটীর ঈদৃশ বক্রোক্তি।
হেসে বললাম, জনসংখ্যা তো বাড়ছেই।
বাড়ছে বলেই তো এত খাদ্যাভাব, এত বাসস্থানের অভাব, আর তাই ক্রাইমও বেড়ে চলছে। তবে লোকগুলোকে বাহবা না দিয়ে পারছি না!
কাদের কথা বলছিস?
কেন? যারা স্বর্ণর ব্যবসায়ে নেমেছে! যারা নির্মলশিবের মাথার চুলগুলো প্রায় পাকিয়ে তুলল!
হাসলাম আমি সশব্দে।
না রে না, হাসি নয়। কথায়ই তো আছে—অভাবে স্বভাব নষ্ট, কিন্তু আমি ভাবছি–
কি?
ভেক না নিলে তো ভিক্ষার্জন হয় না! তা কিসের ভেক নিয়েছে তারা ঐ স্বর্ণমৃগয়ায়? বলত বলতে চড়কভাঙার কাছাকাছি এসে থেমে পড়ল ও।
কি রে, থামলি কেন?
বিরাট ঐ নিয়ন-বোর্ডটা লক্ষ্য করেছিস? লাল সবুজের ঝিলিক হেনে জ্বলছে। নিভছে! মাসছয়েক আগেও তো ওটা দেখেছি বলে কই মনে পড়ছে না।
কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল, বিরাট একটি নিয়নবোর্ড চারতলা একটা নতুন বাড়ির একতলার মাথায় জ্বলছে নিভছে।
ওভারসিজ লিঙ্ক।
বিচিত্র নামটা।
নিচে লেখা গভর্মেন্ট কনট্রাকটার অ্যান্ড জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার।
বাড়িটা তো দেখছি নতুন! কিরীটী পুনরায় মৃদুকণ্ঠে বললে।
হ্যাঁ, তবে একেবারে নতুন নয়, বছরখানেক হল বাড়িটা তৈরি হয়েছে।
ওভারসিজ লিঙ্ক কারবারটিও তাহলে নতুনই বল!
ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়েই দেখলাম সে সেই নতুন চারতলা বাড়িটাই লক্ষ্য করছে।
লক্ষ্য করতে করতেই আবার একসময় বললে, দোতলা তিনতলা আর চারতলা–দেখছি ফ্ল্যাট সিস্টেমে ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
ব্যবসার আড্ডা ছেড়ে এখানে এসে অমন জাঁকজমক করে অফিস খুলেছে–
সে অঞ্চলে হয়ত তেমন মনোমত বাড়ি পায়নি।
তা বটে। বলতে বলতে লক্ষ্য করি, সেই অফিসের দিকেই এগুচ্ছে কিরীটী।
একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করি, কোথায় চললি?
চল একবার অফিসটায় ফুঁ দিয়ে আসা যাক। খোলাই যখন আছে, এখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে!
তা যেন হল, কিন্তু হঠাৎ অর্ডার সাপ্লাই অফিসে তোর কি প্রয়োজন পড়ল?
আমার যে এখন সেই অবস্থা। খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর! চল–চল।
আমাকে আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন বা বাদ-প্রতিবাদের অবকাশমাত্রও না দিয়ে সহসা লম্বা লম্বা পা ফেলে, সত্যি সত্যি দেখি, ও ওভারসিজ লিঙ্কের খোলা দ্বারপথের দিকেই এগিয়ে চলেছে।
অগত্যা অনুসরণ করতেই হল ওকে।
দরজার গোড়াতেই চাপদাড়ি শিখ দারোয়ান রাইফেল হাতে একটা টুলের উপর বসে প্রহরায় নিযুক্ত ছিল।
আমাদের দেখে সেলাম জানিয়ে কাচের স্প্রিংডোর ঠেলে রাস্তা করে দিল।
ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা একটা হাওয়ার ঝাপটা যেন সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিল।
এয়ার-কনডিশন করা ঘর বুঝলাম। ঘর বলব না, বিরাট একটা হলঘরই বলা উচিত। একধারে কাউন্টার, অন্যদিকে পর পর তিনটি কাঠের পার্টিশন দেওয়া কিউবিকল। দেওয়ালে দেওয়ালে ফ্লরেসেন্ট টিউবের সাদা ধবধবে আলো জ্বলছে।
ঝকঝকে তকতকে পালিশ করা সব চেয়ার টেবিল।
এক কোণে সুসজ্জিত সোফা ইত্যাদি-ভিজিটারদের বসবার স্থান।
মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিস্তৃত, কিন্তু সমস্ত কক্ষটিতে তখন নজরে পড়ল গুটি দু-তিন লোক মাত্র কাউন্টারের অপরদিকে টেবিলের সামনে বসে কি সব কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে।
একজন উর্দিপরা বেয়ারা এগিয়ে এল, কি চাই?
বড় সাহেব আছেন তোমাদের?
সাহেব তো নেই। সেক্রেটারি দিদিমণি আছেন।
সেক্রেটারি দিদিমণি?
আজ্ঞে।
বেশ, তাকেই বল গিয়ে একজন বাবু জরুরি কাজের জন্য দেখা করতে চান।
বসুন, খবর দিচ্ছি। বেয়ারা চলে গেল।
লক্ষ্য করলাম বেয়ারা অদূরবর্তী একটা কিউবিকলের সুইংডোর ঠেলে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।
আমরা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বসে বসে আমি ভাবছি কিরীটীর মতলবখানা কি!
দুম করে এই অফিসে এসে ঢুকল কেন ও, তবে কি ওর ধারণা এই অফিসটাই চোরাই সোনার কারবারের কেন্দ্রস্থল?
কিন্তু যদি ব্যাপারটা সত্যিই হয় তো স্বীকার করতেই হবে, অমন একটা চোরাই কারবার এমন প্রকাশ্য একটা স্থানে বসে জাকজমকসহ করার মধ্যে দুঃসাহসিকতা আছে সন্দেহ নেই।
এবং যারাই ঐ কারবার করুক না কেন তাদের সে দুঃসাহসটা রীতিমতই বুঝি আছে।
যাই হোক একটু পরেই কিন্তু বেয়ারা ফিরে এল।
বললে, চলুন–
বেয়ারার নির্দেশমত আমরা সেক্রেটারি দিদিমণির কিউবিকলের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
এবং প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সুমিষ্ট নারীকণ্ঠে আহ্বান এল, বসুন!
কণ্ঠস্বর নয়, যেন সুরলহরী।
আর শুধু কি সুরলহরীই, ঐ সঙ্গে রূপ এবং সাজসজ্জায়ও যেন অসামান্যা। এক কথায় সত্যিই অতুলনীয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য পড়ল সম্মুখে উপবিষ্টা সেই অসামান্যা নারীর চক্ষুর প্রতি।
তীক্ষ্ণ ধারাল ছুরির ফলার মত সে দুটি চক্ষুর দৃষ্টি। যে দৃষ্টি কিরীটীর প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপরই প্রসন্ন একটুকরো হাসিতে তরুণীর মুখখানা যেন ভরে গেল।
সে বললে, বসুন।
০৬-১০. বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে
বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে।
আজও মনে আছে, রূপ অনেক এ পোড়া চোখে পড়ছে কিন্তু রূপের সঙ্গে বুদ্ধির ওরকম খর্য সত্যিই বুঝি আর চোখে পড়েনি।
কিরীটী ফেরার পথে আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন বলেছিল, তিলোত্তমা!
সত্যিই তিলোত্তমা।
আপনাদের কি করতে পারি বলুন? পুনরায় তরুণী প্রশ্ন করল।
আপনাদের ম্যানেজারের সঙ্গেই আমার দরকার ছিল।
মিঃ মল্লিক তো এখন নেই, আপনি তা হলে কাল দুপুরের দিকে আসুন। তবে কোন অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপার হলে আমাকে বলতে পারেন।
অবশ্য অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপারই। তবে—
কি সাপ্লাই করতে হবে?
আমার নিজস্ব একটা ছোটখাটো কেমিকেলের কারখানা আছে। তাই কিছু অর্ডার আমি ফরেন থেকে পেয়েছি। আপনাদের থু দিয়ে সেটা আমি সাপ্লাই করতে চাই।
ও! তা সেরকম কোন সাপ্লাই তো আমরা করি না।
অবশ্যই আপনাদের আমি একটা ওভার-রাইডিং কমিশন দেব।
আপনি বরং কাল এসে ম্যানেজার মিঃ মল্লিকের সঙ্গেই দেখা করবেন।
বেশ, তাই করব। আমাদের কথাটা তাহলে তাকে বলে রাখবেন।
কি নাম বলব। তরুণী প্রশ্ন করে।
কিরীটী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, বাইরে পুরুষকণ্ঠে একটা বচসা শোনা গেল।
আরে রেখে দে তোর সেক্রেটারি দিদিমণি! ঘরে লোক আছে, দেখা করবে না! তার বাপ দেখা করবে, চোদ্দ পুরুষ করবে—হামভি আর্থার হ্যামিলটন হ্যায়!
সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমাদের সামনে উপবিষ্টা তরুণীর মুখ থেকে অমায়িক ভাবটা যেন মুহূর্তে নির্বাপিত হয়ে গেল।
.
সমস্ত মুখখানা তো বটেই এবং দেহটাও সেই সঙ্গে যে কঠিন ঋজু হয়ে উঠল।
পাশ থেক একটা প্যাড ও পেনসিল তুলে নিয়েছিল। তরুণী ইতিমধ্যে, বোধ করি কিরীটীর নামটাই টুকে নেবার জন্য, হাতের পেন্সিল হাতেই থেকে গেল।
পরমুহূর্তেই একটা দমকা হাওয়ার বেগে ঘরের সুইংডোর ঠেলে খুলে যে লোকটি ঠিক ভগ্নদূতের মতই ভিতরে এসে প্রবেশ করল সে দর্শনীয় নিঃসন্দেহে।
আমরা যে ঘরের মধ্যে বসে আছি তা যেন ভ্রক্ষেপ করল না।
তীক্ষ্ণকণ্ঠে সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, আমি জানতে চাই সীতা, তুমি আমার ওখানে ফিরে যাবে কিনা? Say–yes or no?
আগন্তুককে দেখছিলাম আমি তখন।
ঢ্যাঙা লম্বা চেহারা।
একমুখ দাড়ি, ঝোড়ো কাকের মত একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, তৈলহীন রুক্ষ।
ডান কপালে দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন।
নাকটা তরোয়ালের মত যেন ধারাল, তীক্ষ্ণ।
পরিধানে একটা জীর্ণ মলিন ক্রি-ভাঙা কালো গরম কোট ও অনুরূপ সাদা ময়লা জিনের প্যান্ট। গলায় লাল বুটি-দেওয়া পুরাতন একটা টাই।
আরও চেয়ে দেখলাম, তরুণীর মুখখানা অসহ্য ক্রোধে আর আক্রোশে যেন সিঁদুরবর্ণ ধারণ করেছে।
আগন্তুক আবার বললে, say–yes or no!
বেয়ারাটাও ইতিমধ্যে আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গেই তার পিছনে ঘরে এসে ঢুকেছিল।
বেচারী মনে হল যেন আকস্মিক ঘটনায় একটু হতভম্ব হয়েই নির্বাক হয়ে গিয়েছে।
সহসা তরুণী সেই হতভম্ব নির্বাক বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললে, এই, হাঁ করে চেয়ে দেখছিস কি? দারোয়ানকে ডাক?
সঙ্গে সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল আগন্তুক যেন, কি, দারোয়ান দেখাচ্ছ! আর্থার হ্যামিলটনকে আজও চেনোনি সুন্দরী। সব ফাঁস করে দেব। সব একেবারে চিচিং ফাঁক করে দেব।
সহসা ঐ সময় পিছনের সুইংডোরটা আবার খুলে গেল এবং স্ল্যাক ও হাফশার্ট পরিহিত বিরাট দৈত্যাকৃতি একজন লোক এসে যেন অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকল ও বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ডাকল, আর্থার।
সঙ্গে সঙ্গে জোকের মুখ যেন নুন পড়ল।
.
হ্যামিলটন সাহেব সেই ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ষণপূৰ্ব্বের এত হম্বিতম্বি যেন দপ্ করে নিভে গেল।
মুহূর্তে যাকে বলে একেবারে যেন চুপসে গেল মানুষটা।
ইয়ে–স স্যার–র–
কথাটা বলতে গিয়ে তোতলায় হ্যামিলটন।
কাম অ্যালং! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর ডাকে তাকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি করেই যেন মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সেই দৈত্যাকৃতি আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয় গেল হ্যামিলটন।
দেখলাম সেক্রেটারি দিদিমণি যেন কেমন বিব্রত ও থতমত খেয়ে বসে আছে।
আকস্মিক যে এমনি একটা ব্যাপার ঘটে যাবে, বেচারীর যেন ক্ষণপুর্বে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তাহলে আমরা আজকের মত আসি!
তরুণী যেন চমকে ওঠে। বলে, অ্যাঁ, যাবেন?
হ্যাঁ! আমরা চলি।
বেশ।
অতঃপর কিরীটীর নিঃশব্দ ইঙ্গিতে কিরীটীর পিছনে পিছনে আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
কিউবিকলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকালাম, কিন্তু সেই হলঘরের মধ্যে কোথায়ও ক্ষণপূর্বের দৃষ্ট সেই বিচিত্র বেশভূষা পরিহিত আর্থার হ্যামিলটন বা দৈত্যাকৃতি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম না।
শুধু তাই নয়, হলঘরে আগে যাদের কাজ করতে দেখেছিলাম তাদেরও কাউকে। আর দেখতে পেলাম না ঐ সময়।
হলঘরটা তখন শূন্য।
দুজনে বাইরে বের হয়ে এলাম।
.
০৭.
রাস্তায় পড়ে কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তখনও ভাবছি, ব্যাপারটা কি হল?
কিরীটীও স্তব্ধ হয়ে হেঁটে চলেছে।
কিন্তু কিরীটী খুব বেশি দূর অগ্রসর হল না।
পনেরো বিশ গজ হেঁটে গিয়ে ঐ ফুটপাতেই একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানী পানওয়ালাকে বলে, বেশ ভাল করে জর্দা কিমাম দিয়ে দুটো পান তৈরি করতে।
পানওয়ালা পান তৈরি করে দিল।
পান নিয়ে দাম মিটিয়ে দিয়ে, পান মুখে পুরে দিয়ে বেশ আরাম করে কিরীটী চিবুতে লাগল সেই দোকানের সামনেই ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে।
নড়বার নামগন্ধও নেই যেন।
বুঝতে পারি, ঐ সময় পান কেনা ও পান খাওয়া কিরীটীর একটা ছল মাত্র।
কিছু সময় হরণ করতে চায় সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যেই।
ইতিমধ্যে দেখি দিব্যি পানওয়ালার সঙ্গে এটা-ওটা আলাপ শুরু করে দিয়েছে কিরীটী।
চার প্যাকেট কি এক নতুন ব্র্যাণ্ডের উর্বশী-মার্কা সিগারেটও কিনল, যে সিগারেট কস্মিনকালেও খায় না। এবং সর্বক্ষণ ওর মধ্যেই যে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এদিক-ওদিকে, বিশেষ করে অদূরবর্তী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকে নিবন্ধ হচ্ছিল সেটা অবশ্য
আমার নজর এড়ায় না।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিরীটী হাত ধরে আকর্ষণ করে নিম্নকণ্ঠে বললে, আয় সুব্রত!
কোথায়?
আয় না! বলে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল।
বাধ্য হয়েই যেন কিরীটীকে আমি অনুসরণ করি।
কোথায় যাচ্ছি, কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারি না।
রাস্তার ধারে ট্যাকশি পার্কে একটা ট্যাকশি দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণে নজরে পড়ল কিরীটী সেই দিকেই হনহন করে হেঁটে চলেছে।
সোজা গিয়ে কিরীটী খালি ট্যাকশিটায় উঠে বসল আমাকে নিয়ে।
তারপরেই ট্যাকশি-চালককে চাপাকণ্ঠে বললে, সামনের ঐ ট্যাকশিটাকে ফলো করে চল সর্দারজী।
নজর করে দেখলাম সামনেই অল্পদূরে তখন একটা বেবী ট্যাকশি চৌরঙ্গীর দিকে ছুটে চলেছে।
হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত নটা বাজে প্রায়।
রাস্তায় তখন নানাবিধ যানবাহনের রীতিমত ভিড়। এবং থিয়েটার রোড পর্যন্ত বেশ সমগতিতে এসে ট্রাফিকের জন্য আগের গাড়ির গতি ও সেই সঙ্গে আমাদের গাড়ির গতিও হ্রাস হয়।
কিরীটী ইতিমধ্যে ট্যাকশির ব্যাকে বেশ আরাম করেই বসেছিল, যদিও তার তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি বরাবরই নিবদ্ধ ছিল সামনের চলন্ত ট্যাকশির উপরেই।
গাড়ির গতি আর হ্রাস হতে এতক্ষণে কিরীটী মুখ খুলল, সত্যি কথা বলতে কি সুব্রত, একান্ত ঝোঁকের মাথায়ই বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরোবার মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারিনি এমন একটা সরস রোমাঞ্চকর রাত্রি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বলা বাহুল্য, কারণ ইতিমধ্যে কিরীটীর মনোগত ইচ্ছাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
তা যা বলেছিস। যোগাযোগটা অপূর্ব বলতেই হবে। মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।
কিরীটী আমার জবাবে সোৎসাহে বলল, অপূর্ব কিনা জানি না এখনও, তবে অভূতপূর্ব নিশ্চয়ই।
তুই যে সত্যি-সত্যিই নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থলের সন্ধানেই আজ বেরিয়েছিস, সত্যিই কিন্তু আমি প্রথমটায় কল্পনাও করতে পারিনি কিরীটী।
তবে তুই কি ভেবেছিলি, সত্যি-সত্যিই আমি হাওয়া খেতে বের হয়েছি?
না—তা নয়—
তবে?
আচ্ছা তোর কি মনে হয় কিরীটী, ঐ ওভারসিজ লিঙ্কই সত্যি সত্যি নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থল?
ততখানি এত তাড়াতাড়ি ভেবে নেওয়াটা কি একটু কল্পনাধিক্যই মনে হচ্ছে না? না ব্রাদার—no so fast! বঙ্কিমী ভাষায় বলব, ধীরে রজনী, ধীরে।
তা অবশ্যি ঠিক। তবে ঘটনাচক্রে অনেক সময় অনেক অভূতপূর্ব ব্যাপারও ঘটে তো!
তা যে ঘটে না তা আমি অবশ্যি বলছি না, তবে—
তবে?
তবে সীতা মেয়েটি সত্যিই অনিন্দনীয়া। কি বলিস?
হুঁ।
হুঁ কি রে? ভাল লাগল না দেখে তোর মেয়েটিকে? আমার তো মনপ্রাণ এখনও একেবারে ভরে রয়েছে।
সত্যি নাকি?
হুঁ।
আর আর্থার হ্যামিলটন? তার সম্পর্কে তোকই কিছু বললি না!
লোকটা রসিক নিঃসন্দেহে, এইটুকুই বলতে পারি।
কি বললি, রসিক?
নয়? অমন একটি মেয়ের চিত্তহরণ যে একদা করে থাকতে পারে, সে রসিকজন বৈকি। সত্যিই কবি যে বলে গিয়েছেন একদা প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কথাটা খুব খাঁটি কিন্তু তুই যা বলিস।
তা তোর কিসে মনে হল যে ঐ আর্থার হ্যামিলটন একদা সীতার মনপ্রাণ সত্যি সত্যিই হরণ করেছিল?
কেন, সোজাসুজি এসে একেবারে বললে শুনলি না, ফিরে যাবে কিনা বল?
তার মানে বুঝি—
অতশত জানি না তবে আমার যেন মনে হল ক্ষণপূর্বে সেক্রেটারি সীতার ঘরে বৃত্ররূপী যে দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল, সেই বৃত্রই ঐ শচীদেবীকে কোন এক সময় বেচারী ইন্দ্ররূপী দুর্বল আর্থার হ্যামিলটনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে।
তুই বুঝি ঐ কাব্য মনে মনে এতক্ষণ ধরে রচনা করছিলি কিরীটী?
হ্যাঁ, ভাবছিলাম—
কী?
দধীচীর মত নিজ অস্থি দিয়ে ঐ দুর্বল ইন্দ্রকে যদি গিয়ে বলি, লহ অস্থি, কর নির্মাণ বজ্র-সংহার ঐ দৈত্যাসুর বৃত্রকে!
হো হো করে হেসে উঠি আমি।
হাসছিস কিন্তু বেচারীর সে-সময়কার করুণ মুখখানার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলে তোরও ঐ কথাই মনে হত।
ইতিমধ্যে মেট্রোর কাছ বরাবর আমরা এসে গিয়েছিলাম।
আগের ট্যাকশিটা সোজা এগিয়ে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিল। তারপর কিছু দূরে এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে পড়ল।
আমাদের ট্যাকশিচালক সর্দারজী ঠিক তাকে অনুসরণ করে যায়।
শেষ পর্যন্ত আগের ট্যাক্সিটা কুখ্যাত চীনাপাড়ার এক অখ্যাত চীনা হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বাবুজী, উও আগারি ট্যাকশি তো রুখ গিয়া!
হিঁয়াই রোখো সর্দারজী।
লক্ষ্য করলাম, আগের ট্যাকশি থেকে নেমে আথার হ্যামিলটন সাহেব ট্যাকশির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে।
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে হ্যামিলটন হোটেলের ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল।
বলা বাহুল্য আমরাও একটু পরে সেই হোটেলেই গিয়ে প্রবেশ করলাম দুজনে।
.
০৮.
ভিতরে প্রবেশ করে যেন একটু বিস্মিতই হই।
এমন পাড়ায় অখ্যাতনামা একটি চীনা হোটেলে বেশ কসমোপলিটন ভিড়।
হোটেলটায় প্রবেশ করবার মুখে হোটেলের নামটা লক্ষ্য করেছিলাম। বিচিত্র নামটিও।
চায়না টাউন।
বেশি রাত নয়—মাত্র সাড়ে নয়টা তখন।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখি, কসমোপলিটন খরিদ্দারের ভিড়ে তখন গমগম করছে হোটেলের হলঘরটি।
এক পাশে ড্রিঙ্কের কাউন্টার। তারই গা ঘেঁষে বাঁয়ে প্যানট্রির দরজা এবং ডাইনে ছোট একটি ডায়াস।
ইংরাজী অর্কেস্ট্রা সহযোগে একটি ক্ষীণাঙ্গী, মনে হল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েই হবে, নানাবিধ যৌনাত্মক অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাকিসুরে কি একটা দুর্বোধ্য ইংরাজী গান গেয়ে চলেছে।
চারপাশে টেবিল চেয়ারে জোড়ায় জোড়ায় নানাবয়সী পুরুষ ও নারী, কেউ খেতে খেতে, কেউ কেউ আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে সেই যৌনরসাশ্রিত সঙ্গীত উপভোগ করছে।
একটা বিশেষ ব্যাপার ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজর করছিলাম—উজ্জ্বল আলো নয়-ঈষৎ নীলাভ স্রিয়মাণ আলোয় সমস্ত হলঘরটি স্বল্পালোকিত বলা চলে।
রীতিমত যেন একটা রহস্যনিবিড় পরিবেশ হোটেলটির মধ্যে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে হলঘরের নিরিবিলিতে হ্যামিলটন সাহেব জায়গা করে বসে গিয়েছে লক্ষ্য করলাম। ..
তারই পাশে আর একটা খালি টেবিল তখনও ছিল, কিরীটী আমাকে নিয়ে সেই দিকেই এগিয়ে চলল।
নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে আমরা টেবিলটার দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম মুখোমুখি।
হ্যামিলটনের অত কাছাকাছি গিয়ে বসতে আমার যেন ঠিক মন সরছিল না, কিন্তু দেখলাম হ্যামিলটন আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।
সে অন্যদিকে অন্যমনস্ক ভাবে তখন চেয়ে আছে।
কিন্তু হ্যামিলটনের সঙ্গের সেই দৈত্যাকৃতি লোকটাকে আশেপাশে কোথাও নজরে পড়ল না।
ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার দেখলাম একটা পুরো বোতল, একটা গ্লাস ও একটা কাচের জাগভর্তি জল এনে হ্যামিলটন সাহেবের সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।
বোয়।
কিরীটীর আহ্বানে সেই লোকটাই আমাদের সামনে এগিয়ে এল।
দুটো কোল্ড বিয়ার।
তাড়াতাড়ি বললাম, আমি তো বিয়ার খাই না!
কিরীটী নির্বিকার ভাবে জবাব দিল, খাস গ্লাসে নিয়ে বসে থাকবি।
কি আর করা যায়, চুপ করেই থাকতে হল অগত্যা।
ওয়েটার কিরীটীর নির্দেশমত দুবোতল ঠাণ্ডা বিয়ার ও দুটো গ্লাস এবং একটা প্লেটে কিছু কাজুবাদাম আমাদের টেবিলে রেখে গেল।
ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম হ্যামিলটন সাহেব গ্লাসের আধাআধি রাম ঢেলে তাতে জল মিশিয়ে বার দুই চুমুক দিয়েই গ্লাসটা প্রায় অর্ধেক করে এনেছে।
কিরীটী দু গ্লাস বিয়ার ঢালল।
নে-না খাস অন্তত মুখের কাছে তোল!
কিরীটীর নির্দেশমত তাই করি।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। অর্কেস্ট্রা সহযোগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুন্দরী তখন দ্বিতীয় সংগীত শুরু করেছে। হ্যামিলটন ড্রিঙ্ক করে চলেছে। লোকটা যে সুরারসিক বুঝতে দেরি হয় না।
.
ঘড়ির দিকে তাকালাম একসময়, রাত সাড়ে এগারোটা।
হলঘরের ভিড়টা তখন অনেকটা পাতলা হয়ে গিয়েছে বটে, তবু মধুলোভীদের ভিড় একেবারে কমেনি।
সকলের চোখেই নেশার আমেজ। ঘরের মধ্যে তখনও যারা উপস্থিত তাদের তখন যেন নেশা জমাট বেঁধে উঠেছে।
ইতিমধ্যে হ্যামিলটন সাহেব রামের বড় বোতলটি প্রায় নিঃশেষিত করে এনেছে।
এবং সাহেবের যে রীতিমত নেশা ধরেছে সেটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
কিরীটী ফিসফিস করে আমাকে বললে, চল সাহেবের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।
এতক্ষণ যে এত কষ্ট করে কিরীটী হোটেলে বসে আছে সেও ঐ কারণেই সেটা পুর্বেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কিন্তু তবু ইতস্তত করি।
কি হল, ওঠ?
কিন্তু যদি চিনে ফেলে আমাদের!
নেশার ঘোরে আছে, চল্।
চল।
কিরীটীর সঙ্গে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম।
হ্যামিলটন সাহেবের টেবিলে আরও দুটি চেয়ার ছিল। তারই একটা টেনে নিয়ে আমি বসলাম এবং কিরীটী অন্যটায় বসতে বসতে বললে, গুড ইভনিং মিঃ হ্যামিলটন!
নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ দুটি খুলে তাকাল আমাদের দিকে হ্যামিলটন সাহেব।
কে? জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে হ্যামিলটন।
তুমি আমাকে চিনবে না হ্যামিলটন-আমার নাম রথীন বোস।
আঃ-বোস! বলে নিঃশেষিত গ্লাসটার পাশ থেকে বোতলটা তুলে উপুড় করে ধরল কিন্তু বোতলটায় তখন একবিন্দুও তরল পদার্থ অবশিষ্ট ছিল না।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ওর মধ্যে তো একবিন্দুও নেই, ঢালছ কি?
নেই! বলে বোতলটা কম্পিত হাতে সামনে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, নেই-ইয়েস, সত্যিই নেই—অল ফিনিশড!
ড়ু ইউ লাইক টু হ্যাভ মোর, মিঃ হ্যামিলটন?
গড ব্লেস ইউ মাই বয়। আই হ্যাভ নট এ ফারদিং লেফট ইন মাই পকেট।
কিরীটী ততক্ষণে ওয়েটারকে ডেকে হ্যামিলটনের শূন্য গ্লাসটার জায়গায় অন্য একটা ভর্তি গ্লাস এনে দিতে বললে।
ওয়েটার এনে দিল নির্দেশমত একটা গ্লাস।
সানন্দে নতুন গ্লাসটা তুলে নিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে জড়িত স্বরে হ্যামিলটন বললে, গড উইল ব্লেস ইউ মাই বয়, গড উইল ব্লেস ইউ। দ্যাট ডার্টি স্নেক, দ্যাট ফিলাদি স্নেক গেভ মি ওনলি ফিফটিন রুপিজ। তাতে কি কিছু হয় মিঃ বোস, তুমিই বল? একজন ভদ্রলোকের এক রাত্রের ড্রিঙ্কের খরচাও হয় না!
তা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তুমি তো ইচ্ছা করলে সীতার কাছ থেকে নিতে পার!
সীতা! ডোন্ট টক অ্যাবাউট হার। জুয়েল, হার্টলেস উয়োম্যান। জান, সে চলে যাবার পর থেকেই তো আমার এই অবস্থা। শি হ্যাজ ফিনিশড মি, শি হ্যাজ ফিনিশড মি। আই অ্যাম গন-গন ফর এভার। কিন্তু তবু-তবু আমি তাকে ভালবাসি।
তুমি তাকে সত্যিই ভালবাস হ্যামিলটন?
সহসা হাত বাড়িয়ে কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল হ্যামিলটন, হা হা-বাসি—বিশ্বাস কর বোস—দো শি হ্যাজ ডেজার্টেড মি—তবু, তবু তাকে আমি ভালবাসি। আই লাভ হার, আই লাভ হার, আই লাভ হার লাইক এনিথিং। শি ইজ মাই ম্যারেড ওয়াইফ–শি ইজ-কথাটা শেষ হল না হ্যামিলটনের।
অকস্মাৎ আমাদের পিছন থেকে সরু মিহি গলায় কে যেন ডাকল, হ্যামিলটন!
কে? ও চিরঞ্জীব।
আগন্তুক ততক্ষণে বগলের ক্রাচের সাহায্যে আমাদের সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে।
বেঁটেখাটো মানুষটা, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুটের বেশি হবে না।
রোগা লিকলিকে চেহারা।
পরিধানে একটা ঝলঝলে কালো রঙের পুরাতন জীর্ণ স্ল্যাক ও গায়ে অনুরূপ একটা ওপন-ব্রেস্ট কোট।
ভিতরে ময়লা একটা ছিটের শার্ট, তাও গলার বোতামটা খোলা।
মাথায় নিগ্রোদের মত ছোট ছোট চুল–ঘন কুঞ্চিত।
ছড়ানো কপাল, চাপা নাক, দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ।
ছোট ছোট কুতকুতে দুটি চক্ষু যেন সতর্ক শিকারী বিড়ালের মত।
ডান পা-টা বোধ হয় পঙ্গু-অসহায়ভাবে ঝুলছে।
এস চিরঞ্জীব, তোমাকে এদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড ওনলি অ্যাডমায়ারার চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ডস বোস–
কিন্তু হ্যামিলটনের আগ্রহে এতটুকু সাড়াও যেন দিল না চিরঞ্জীব।
সে বললে, তুমি এখানে বসে আছ আর তোমার জন্য পকের্টে টাকা নিয়ে আমি তোমাকে সারা দুনিয়ায় খুঁজে বেড়াচ্ছি!
টাকা! আর ইউ রিয়েলি সেয়িং মানি।
ইয়েস–
ও গড ব্লেস ইউ মাই বয়। ইউ ডোন্ট নো হাউ আই অ্যাম ব্যাডলি ইন নিড অফ মানি! দাও দাও-হাত বাড়াল হ্যামিলটন।
সে কি, পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি নাকি? চল, আমার বাড়ি চল।
চল, চল-টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় হ্যামিলটন।
আর একটু হলেই পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল হ্যামিলটন, কিন্তু পলকে হাত বাড়িয়ে পতনোদ্যত হ্যামিলটনকে ধরে চিরঞ্জীব হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।
কেমন বিহ্বল হয়েই যেন ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি।
হঠাৎ কিরীটীর মৃদু কণ্ঠস্বরে ওর দিকে মুখ ফেরালাম।
বন থেকে বেরুল টিয়ে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে! টিয়া পাখি উড়ে গেলসুব্রতচন্দ্র এবারে গৃহে চল!
তারপরই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, উঃ, রাত বারোটা বাজতে মাত্র চোদ্দ মিনিট। গৃহিণী নিরতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই।
তা হবারই তো কথা, সান্ধ্যভ্রমণ যদি মধ্যরাত্রি পর্যন্ত গড়ায়-মৃদু হেসে বললাম আমি, ব্যাকুলা তো হবেনই।
তাড়াতাড়ি বিল চুকিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলের বাইরে চলে এলাম।
হোটেলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম।
একটু আগে হ্যামিলটনকে নিয়ে এই পথেই চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল হোটেল থেকে বের হয়ে এসেছে।
কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
কিরীটী আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, নেই হে বন্ধু সে টিয়া পাখি অনেক আগেই উড়ে গিয়েছে। এবারে একটু পা চালিয়েই চল, কারণ পাড়াটা বিশেষ করে এই মধ্যরাত্রে তেমন সুবিধার নয়।
ট্রামরাস্তায় এসেও অনেক অপেক্ষার পর ট্যাকশি মিলেছিল সেরাত্রে এবং কিরীটীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে বাসায় পৌঁছতে রাত সোয়া একটা বেজে গিয়েছিল।
.
০৯.
সেই রাত্রের পর পুরো দুটো দিন কিরীটী আর বাড়ি থেকে কোথাও এক পাও বেরুল না।
কেবল নিজের বসবার ঘরে বসে বসে দুটো দিন সর্বক্ষণ পেসেন্স খেলা নিয়েই মেতে হইল।
তৃতীয় দিনও দ্বিপ্রহরে গিয়ে দেখি বসবার ঘরে চারিদিকে লাল পর্দা টেনে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চালিয়ে ঠাণ্ডায় বসে পেসেন্স খেলছে সে।
আজ কিন্তু সত্যিই আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার উপক্রম হয়।
কারণ গত দুটো দিন আমার মনের মধ্যে সর্বক্ষণ সেরাত্রের ঘটনাগুলি ও কতকগুলো নরনারীর মুখ ভেসে ভেসে উঠছিল।
মনে মনে একটা আঁচও করে নিয়েছিলাম যে, অতঃপর নিশ্চয়ই তোড়জোড় করে কিরীটী গিয়ে ওভারসিজ লিঙ্কে হানা দেবে।
কিন্তু কিরীটী যেন সেরাত্রের ব্যাপার সম্পর্কে একেবারে বোবা।
ধৈর্যচ্যুতি ঘটতও হয়ত আর একটু পরেই, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পেয়ে উৎকর্ণ হই।
জুতোর শব্দটা ঠাণ্ডা ঘরের দরজা বরাবর যখন প্রায় এসেছে, কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই আমাকে বললে, দরজাটা খুলে দে সুব্রত, নির্মলশিব এলেন!
সত্যি দরজা খুলে দিতে নির্মলশিবই এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে পা দিয়েই নির্মলশিব বলে, আঃ, প্রাণটা বাঁচল! কি আশ্চর্য! কি ঠাণ্ডা।
কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই বলল, মল্লিক সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল নির্মলশিববাবু?
কি আশ্চর্য! তা আর করিনি! খাসা লোক—তবে—
তবে আবার কি?
প্রচণ্ড সাহেব।
তা বাঙালীরা ধুতি ছেড়ে কোট পাতলুন পরিধান করলে একটু সাহেব হয়ে পড়েন বৈকি। কিন্তু যেজন্য আপনাকে সেখানে যেতে বলেছিলাম তার কোন সংবাদ পেলেন কিনা?
কি আশ্চর্য! তা পেয়েছি বৈকি।
পেয়েছেন তাহলে!
হ্যাঁ।
বিদেশে কোন মালটা বেশি রপ্তানি হয় ওদের, জানতে পারলেন কিছু?
হ্যাঁ। চা, চাটনি আর ছাতি।
ছাতি?
হ্যাঁ,–আমব্রেলা। আমেরিকায় নাকি প্রচুর চা আর ছাতি চালান যাচ্ছে আর বোয়ামে বোয়ামে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে আমের আচার।
আমের আচার আর ছাতার স্যাম্পল দিলে বুঝি আপনাকে?
স্যাম্পল মানে?
না, বলছিলাম, শুধু ছাতি আর আমের আচার-সিঙ্গাপুরী কলা নয়!
বেচারী নির্মলশিব, কিরীটীর সূক্ষ্ম পরিহাস উপলব্ধি করবে কি করে? আমি কিন্তু ততক্ষণে রুদ্ধ হাসির বেগটা আর না সামলাতে পেরে হো-হো করে হেসে উঠলাম।–
কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, আপনি হাসছেন?
নির্মলশিববাবুর কথায় কিরীটীও এবারে হেসে ওঠে।
.
যাক, সীতা আর আর্থার হ্যামিলটনের খোঁজ নিয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
কি আশ্চর্য! নিয়েছিলাম বৈকি। হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। তবে বর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওদের সেপারেশন হয়ে গিয়েছে।
ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?
না, তা হয়নি বটে, তবে—
তবে কি?
ওরা বছরখানেক হল আলাদা ভাবে বসবাস করছে।
হুঁ। আর চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল? তার কোন সংবাদ পেলেন?
আপনার অনুমানই ঠিক। চায়না টাউন হোটেলের মালিক লোকটা।
তাহলে লোকটার দুপয়সা আছে বলুন?
কি আশ্চর্য! তা আর নেই? হোটেলটা খুব ভালই চলে। লোকটি সজ্জন সন্দেহ নেই। আর মুরগীর রোস্ট যা করে না, আশ্চর্য, একেবারে যাকে বলে ফার্স্ট ক্লাস, অতি উপাদেয়!
মুরগীর রোস্ট বুঝি খাইয়েছিল আপনাকে?
নিশ্চয়ই। দু-প্লেট ভর্তি।
আমি এবার প্রশ্ন করলাম, দু-প্লেটই খেলেন?
কি আশ্চর্য! দিলে আর খাব না? না মশাই, আমার অত প্রেজুডিস নেই।
তা তো সত্যিই, আগ্রহভরে যখন বিশেষ করে সে দিয়েছে। কিন্তু নির্মলশিববাবু শত্রুশিবিরে গিয়ে ঐ ধরনের প্রেজুডিসটা বর্জন করাই ভাল জানবেন।
কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো বললে।
কথাটা বলেই কিরীটী আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে এল, আচ্ছা নির্মলশিববাবু, ওভারসিজ লিঙ্কের ম্যানেজার ভদ্রলোকটির চেহারাটা কেমন? মানে বলছিলাম কি, দেখতে শুনতে কেমন? খুব লম্বাচওড়া দৈত্যের মত কি?
কি আশ্চর্য! কই না তো!
তবে কি রকম দেখতে?
রোগা লিকলিকে, একটু আবার খখানা। নাকিসুরে কথা বলে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, একটা চোখও আবার বিশ্রীরকম ট্যারা।
একটা পা খোঁড়া নয়?
খোড়া! কই না তো?
হুঁ। বলুন তো কিরকম চেহারাটা তার ঠিক ঠিক?
নির্মলশিব বর্ণনা করে গেল মল্লিক সাহেবের চেহারাটা।
ওভারসিজ লিঙ্কের ম্যানেজারের চেহারার বর্ণনাটা মনে হল নির্মলশিবের মুখে শুনে ঠিক যেন মনঃপূত হল না কিরীটীর।
ব্যাপারটা যেন কিছুটা তার প্রত্যাশার বাইরেই মনে হল।
বুঝতে পারি লোকটার চেহারার একটা বর্ণনা কিরীটীর মনের মধ্যে ছিল। সেই বর্ণনার সঙ্গে না মেলায় সে যেন একটু চিন্তিতই হয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণ অতঃপর কিরীটীর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না।
ভ্রূ দুটো কুঞ্চিতই হয়ে থাকে। তারপর এক সময় ভ্র দুটো সরল হয়ে আসে। চাপা খুশির একটা ঢেউ যেন কিরীটীর মুখের উপর দিয়ে খেলে যায়।
মৃদু কণ্ঠে সে বলে, সত্যি, আমারই ভুল হয়েছিল, ঘটোৎকচের মাথায় বা সেই ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে তো অতখানি বুদ্ধি থাকতে পারে না!
কিরীটীর উচ্চারিত ঘটোৎকচ কথাটা নির্মলশিবের কানে গিয়েছিল, সে বলে, কি আশ্চর্য! ঘটোৎকচ আবার কে মিঃ রায়?
একটা দৈত্য। ওভারসিজ লিঙ্কে আমরা সেরাত্রে একটা দৈত্যাকৃতি লোক দেখেছিলাম, কিরীটী তার কথাই বলছে নির্মলশিববাবু। জবাব দিলাম আমি।
কি আশ্চর্য! তাই বলুন। আপনারা মিঃ গড়াই! গজানন্দ গড়াইয়ের কথা বলছেন। তা সত্যি—আমি মশাই একটু লেটে বুঝি। বলেই প্রাণ খুলে হো হো করে হেসে উঠল নির্মলশিব।
.
১০.
নির্মলশিবের কাছ থেকে আরও সংবাদ পাওয়া গেল ওভারসিজ লিঙ্ক সম্পর্কে।
ম্যানেজার লোকটা অফিসে বড় একটা থাকেই না। ঐ গজানন্দ গড়াই-ই সব একপ্রকার দেখাশোনা করে বলতে গেলে। আর অফিসে সর্বদা থাকে সেক্রেটারি দিদিমণি সীতা মৈত্র। আর একটা প্রশ্ন করেছিল কিরীটী নির্মলশিবকে।
যে সমস্ত মাল ওরা এদেশ থেকে অন্যান্য দেশে পাঠায়, সে সমস্ত মাল সাধারণত কিসে যায়?
বলাই বাহুল্য, সে সংবাদটা দিতে পারেনি নির্মলশিব সাহেব কিরীটীকে।
অবশেষে নির্মলশিব গাত্রোত্থান করেছিল। এবং বিদায় নেবার পূর্বে যখন সে কিরীটীকে শুধাল, এবার আমাকে কি করতে হবে বলুন মিঃ রায়!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, একটা বা দুটো বিশেষ নম্বরের ট্যাকশি কিংবা কোন ভ্যান নিশ্চয়ই ওভারসিজ লিঙ্ক অফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করে আমার ধারণা। ধারণাটা আমার সত্য কিনা, একটু লক্ষ্য রাখবেন তো নির্মলশিববাবু!
কি আশ্চর্য! এ আর এমন শক্ত কথা কি, আজই এখুনি গিয়ে একজন প্লেন ড্রেসকে ওখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পোস্ট করে রাখছি।
হ্যাঁ, তাই করুন। আপাতত ওইটুকুই করুন।
নির্মলশিব বিদায় নেওয়ার পর আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর কি তাহলে সত্যি সত্যি ধারণা ঐ ওভারসিজ লিঙ্কটাই হচ্ছে স্বর্ণমৃগয়ার ঘাঁটি?
তাই আমার এখন মনে হচ্ছে সুব্রত।
কিন্তু কেন, সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি! কারণ সেরাত্রে ওভারসিজ লিঙ্ককে কেন্দ্র করে পর পর যে ব্যাপারগুলো ঘটেছিল সেগুলোকে স্রেফ ঘটনাচক্র ছাড়া আর কি বলা যায়।
জানবি, ঘটনাচক্রই বহু ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর সত্যেরও ইঙ্গিত দেয়। আমি অবিশ্যি ব্যাপারটা নিছক একটা ঘটনাচক্রই বলি না, বলি, সাম্ আনসিন্ ফোর্স, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের সত্যপথে চালিত করে, যেটা বহু ক্ষেত্রেই আমরা জীবনে অনুভব করি। কিন্তু এক্ষেত্রে কেবল ঐ ঘটনাচক্র ও আনসিন ফোর্সেরই ইঙ্গিত ছিল না। দেয়ার ওয়্যার সামথিং মোর!
কি?
প্রথমত স্বর্ণমৃগয়ার ব্যাপারটা যে সত্য, সেটা পূর্বেই আমার মন বলেছিল একটি কারণে!
কি, শুনি?
সংবাদপত্র লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতিস, গত বছর-তিন সময়ের মধ্যে জাহাজঘাটায় এবং প্লেনের ঘাঁটিতে পাঁচ-পাঁচটা বিরাট গোল্ড বা সোনার স্মাগলিংয়ের ব্যাপার ধরা পড়েছে। এবং সেইসুত্রে এক বা ততোধিক লোক স্মাগলার হিসেবে ধরা পড়লেও আসলে তারা চুনোপুঁটি মাত্র। এই ব্যাপারের আসল রুইকাতলার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিস কোনদিন। তবে ঐ সঙ্গে আরও একটা সংবাদে প্রকাশ, পাঁচবারের মধ্যে বারতিনেক বিরাটকায় দৈত্যাকৃতি একটা লোককে বিভিন্ন অকুস্থানের আশেপাশে নাকি দেখা গিয়েছে; অবশ্য ঐ ব্যাপারের সঙ্গে তাকে কোনরকম সন্দেহই পুলিস করতে পারে নি। মাস আষ্টেক পূর্বে আমাদের সাউথের ডি. সি.-র সঙ্গে তাঁর জীপে চেপে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। পথের মাঝে ট্রাফিকের জন্য ডি. সি.-র জীপটাও দাঁড়ায়। পাশেই এমন সময় একটা নতুন ঝকঝকে ডজ কিংসওয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ায় ব্রেক কষে। সেই গাড়ির মধ্যেই একটা দৈত্যাকৃতি লোক অর্থাৎ আমাদের ঐ ঘটোৎকচ বা গজানন্দ গড়াইকে আমি চাক্ষুষ প্রথম দেখি এবং বলাই বাহুল্য মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হই।
তারপর? শুধালাম আমি।
সেই সময়ই ডি. সি. লোকটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হঠাৎ বলেছিলেন, মিঃ রায়, ঐ যে গাড়িটার মধ্যে দৈত্যের মত একটা লোক দেখছেন, বিখ্যাত তিনটে গোল্ড স্মাগলিংয়ের কেস যখন ধরা পড়ে, দুবার এরোড্রোম ও একবার জাহাজঘাটায়, ঐ লোকটাকে নাকি আশেপাশে দেখা গিয়েছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ওকে সন্দেহ করলেও আজ পর্যন্ত লোকটার একটি কেশও স্পর্শ করা যায়নি।
কিরীটী বলতে লাগল, যাই হোক, সেই যে ঘটোৎকচকে আমি গাড়ির মধ্যে দেখেছিলাম, ভদ্রমহোদয়কে কেন যেন আর ভুলিনি। এবং সেদিন নির্মলশিবের সমস্ত ব্যাপার মনোযোগ দিয়ে শুনে আমার মনে হল, স্বর্ণমৃগয়ার ব্যাপারটার দক্ষিণ কলকাতার মধ্যেই কোথাও ঘাঁটি আছে। অবিশ্যি সেখানেও আমি কিছুটা যোগবিয়োগ করে আমার অনুমানকেই প্রাধান্য দিয়েছি বরাবরের মত।
যথা?
আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। তবে যা মনে হয়েছিল—
কি?
যোগ-বিয়োগটা করেছিলাম আমি দক্ষিণ কলকাতা অঞ্চলেই সংঘটিত দুটি বীভৎস ও রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড থেকে। সে হত্যাকাণ্ড দুটো তোমাদের সকলেরই জানা।
কোন্ দুটি হত্যাকাণ্ড?
যে হত্যাকাণ্ড দুটোর কথা সেদিন নির্মলশিবের কাছে আমি উল্লেখ করেছিলাম।
মানে সেই পুলিস অফিসার মোহিনীমোহন–
হ্যাঁ, এবং দ্বিতীয়ত সে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ের কোন হদিস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সে যাই হোক আমার বক্তব্য হচ্ছে প্রথমত, আবার কিরীটী বলতে লাগল, সেই দ্বিতীয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিদর্শন অর্থাৎ তার টুকরো টুকরো দেহখণ্ডগুলো এই দক্ষিণ কলকাতাতেই পাওয়া গিয়েছিল এবং দ্বিতীয়ত সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাত্র সাত দিন পূর্বে এই এলাকারই অন্যতম পুলিস অফিসার মোহিনীমোহনের রহস্যময় নিরুদ্দেশের ব্যাপার ঘটে। যাই হোক আপাতত ঐ দুটি কারণই সেদিন যেন অলক্ষ্যে আমার মনকে দক্ষিণ কলকাতার প্রতিই আকৃষ্ট করে। একটা ব্যাপার কি জানিস সুব্রত, বহুবার আমার জীবনে আমি দেখেছি, ঐ ধরনের ইঙ্গিত মনকে আমার কখনও প্রতারিত করেনি।
শুধু কি সেই কারণেই সেদিন সন্ধ্যায় তুই অকস্মাৎ বের হয়েছিলি সন্ধ্যাভ্রমণের নাম করে?
না। আর একটা কারণ ছিল অবিশ্যি সেদিনকার সান্ধ্যভ্রমণের পশ্চাতে।
কী?
ঐ ভাবে সোনা স্মাগল করা যে এক-আধজনের কর্ম নয়, সুনিশ্চিতভাবে তাদের যে একটা গ্যাং বা দল আছে এবং নির্দিষ্ট সুচিন্তিত একটি কর্মপদ্ধতি আছে, কথাটা কেন যেন আমার মনে হয়েছিল এবং ঐ সঙ্গে এও মনে হয়েছিল ঐ সব কিছুর জন্য চাই একটি মিলনকেন্দ্র, যে মিলনকেন্দ্রটির বাইরে থেকে একটা সকলের চোখে ধূলো দেওয়ার মত, শো থাকবে।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ একটা অফিস।
অফিস?
হ্যাঁ, অফিস। কিন্তু অফিস-সংক্রান্ত ব্যাপার সাধারণত ক্লাইভ স্ট্রীট বা ডালহাউসি অঞ্চলেই হয় অথচ সেখানে আবার পুলিশেরও আনাগোনা বেশি। সেক্ষেত্রে স্বর্ণমৃগয়া করছে যারা তাদের পক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় অফিস করাটাই হয়ত নিরাপদ হবে। বিশেষ করে সেই জন্যেই একবার যতটা সম্ভব আশপাশটা ঘুরেফিরে দেখবার জন্য বের হয়েছিলাম সেই সন্ধ্যায় যদি ঐ ধরনের কোন কর্মস্থল মানে অফিস ইত্যাদি চোখে পড়ে। কিন্তু ভাগ্যদেবী বরাবরই দেখেছি আমার প্রতি প্রসন্ন। সেদিনও তাই ঘটল। ঘুরতে ঘুরতে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ একটা ব্যাপারে আমি সচকিত হয়ে উঠলাম।
কি ব্যাপার?
ঘটোৎকচ
ঘটোৎকচ?
হ্যাঁ, তাকে দেখলাম একটা ট্যাকশি থেকে নেমে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসবাড়িতে ঢুকতে। সঙ্গে সঙ্গেই ওভারসিজ লিঙ্ক আমার মনকে আকর্ষণ করে। তারপর যখন শুনলাম তোর মুখে বাড়িটা নতুন, বুঝলাম অফিসটাও নতুন, নামটাও দেখলাম বিচিত্র এবং সাইনবোর্ডে বোল্ড লেটার্সে তাদের বিজ্ঞাপিত কাজকারবারটার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে মনকে আমার সন্দিগ্ধ করে তুলল যেন সঙ্গে সঙ্গেই। সর্বোপরি সেখানে ক্ষণপূর্বে ঘটোৎকচের যখন প্রবেশ ঘটেছে-যাকে ইতিপূর্বে সোনার স্মাগল কেসে অকুস্থলের আশেপাশে দেখা গিয়েছিল বারতিনেক। অতএব কালবিলম্ব না করে আমি অন্দরে পা বাড়ালাম। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করে ঘটোৎকচকে প্রথমটায় না দেখে হতাশ হয়েছিলাম, তবে হতাশা আর রইল না। তিলোত্তমা সন্দর্শনের পর।
অর্থাৎ?
দেহ ও মন পুলকিত ও চমৎকৃত হল। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
তাহলে তোর ধারণা কিরীটী, নির্মলশিবের রহস্যের মূলটা ঐ ওভারসিজ লিঙ্কের সঙ্গে জড়িত?
সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে সেরাত্রে সেখানকার আবহাওয়া ও তিনটি প্রাণীকে দেখবার পর থেকে।
তিনটি প্রাণী?
হ্যাঁ। ঘটোৎকচ, তিলোত্তমা ও আর্থার হ্যামিলটন।
কিন্তু–
I have not yet finished। অমন একটা কাজের জায়গায় তিলোত্তমা কাব্যও যেমন বেখাপ্পা তেমনি ঘটোৎকচ পর্বের জুলুম ও হ্যামিলটনের নিরুপায়তা সব কিছুই যেন কেমন একটা এলোমেলো—জট পাকানো। জট পাকানো মানেই গোলযোগ, অতএব যোগ-বিয়োগ করে নিতে আমার অসুবিধা হয়নি। তাই
তাই কি?
তাই সেদিন তার কেসের আলোচনা প্রসঙ্গে নির্মলশিবকে যে আশ্বাস দিয়েছিলাম সেটাও যে মিথ্যে নয় সেটাও সেরাত্রে ওখানে হানা দেবার পর সুস্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম।
মানে দলে ভাঙন ধরেছে?
হ্যাঁ, এসব কারবারে সাধারণত যা হয়ে থাকে। মারাত্মক লোভের আগুনে সব ধ্বংস হয়ে যায়—মানে নিজেরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের ধ্বংসের বীজ বপন করে। কথাটা নির্মলশিবকেও বলেছিলাম। কিন্তু সে গা দিল না কথাটায়। অবিশ্যি নিজে থেকে তারা ধ্বংস না হলেও এটা বুঝতে পারছি যে তাদের দিন সত্যিই সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে।
যেহেতু কিরীটী-শনির দৃষ্টি তাদের ভাগ্যের উপর পড়েছে।
হাসতে হাসতেই এবার আমি কথাটা বললাম।
১১-১৫. তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ
তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ বাড়ি থেকে বের হল না।
একান্ত উদাসীন ও নিষ্ক্রিয়ভাবে সে তার সময় কাটাতে লাগল তাস নিয়ে পেসেন্স খেলে খেলেই।
কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম, তাশ নিয়ে সর্বক্ষণ উদাসীন থাকলেও কিছু একটার প্রত্যাশায় যেন তার দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয় উন্মুখ হয়ে রয়েছে।
সমস্ত অনুভূতি তার যেন যাকে বলে সেতারের তারের মত চড়া সুরেই বাঁধা হয়ে আছে।
ঠিক এমনি সময় একদিন বেলা এগারোটা নাগাদ রীতিমত যেন হন্তদন্ত হয়ে নির্মলশিব এসে ঘরে প্রবেশ করল কিরীটীর।
কি আশ্চর্য! মিঃ রায়–
কিরীটী পূর্বের মতই তাস নিয়ে খেলছিল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে হাতের তাসগুলো একান্ত অবহেলায় টেবিলের উপরে একপাশে ঠেলে দিয়ে, যেন আপাতত তার প্রয়োজন। ফুরিয়েছে, নিশ্চিন্ত দৃষ্টিতে নির্মলশিবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কি, ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে-এই তো নির্মলশিব বাবু?
কি আশ্চর্য! ইতিহাস—
হ্যাঁ,–নির্বিকার ভাবেই পুনরাবৃত্তি করে কথাটা কিরীটী।
কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, এক গ্লাস জল!
আমি দরজার কাছে উঠে গিয়ে জংলীকে এক গ্লাস জল দিতে বললাম।
জংলী জল আনার পর চো চো করে এক গ্লাস জল প্রায় এক টানেই নিঃশেষ করে নির্মলশিব বলে, আর এক গ্লাস।
জংলী শূন্য গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল।
কিন্তু ততক্ষণে এক গ্লাস জল পান করে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে নির্মলশিব।
সে বললে, আবার খুন হয়েছে আমার এলাকায় মিঃ রায়!
জানতাম হবে। নির্বিকার ভাবেই কিরীটী কথাটা বলে।
জানতেন?
হ্যাঁ, এবং আপনার কাছে সংবাদটা পেয়ে দুটো ব্যাপার অন্তত প্রমাণিত হল।
দুটো ব্যাপার?
হ্যাঁ।
মানে?
প্রথমত আপনার ঐ এলাকার সঙ্গেই যে স্বর্ণমৃগয়ার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আমার সেই অনুমানটা, এবং দ্বিতীয়ত খুব শীঘ্রই পূর্বের সেই হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটবে সেটা। বিশেষ করে যে সংবাদটার জন্য এই কয়দিন সত্যিই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যাক সেকথা। নিহত ব্যক্তিটি কে—তার কোন পরিচয় পেলেন বা তাকে আইডেনটিফাই করতে পারা গিয়েছে?
না, তবে—
তবে কি?
লোকটার বাঁ হাতে হিন্দীতে উল্কি করে করে নাম লেখা আছে—
কি নাম লেখা আছে?
ভিখন—
কি, কি বললেন? কি নামটা বললেন? উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করল।
ভিখন।
ভিখন?
হ্যাঁ।
লোকটার গায়ের রঙ কালো? আবার প্রশ্ন করল কিরীটী।
হ্যাঁ।
কপালে ডানদিকে একটা কাটা দাগ আছে?
আছে-কি আশ্চর্য!
নাকের উপর একটা আঁচুলি আছে?
আছে। কিন্তু কি আশ্চর্য। এসব কথা, মৃতদেহ সম্পর্কে এত ডিটেলস্ আপনি জানলেন কি করে? আপনি কি মর্গে গিয়ে ইতিমধ্যে মৃতদেহটা দেখে এসেছেন নাকি মিঃ রায়?
না, আপনিই তো দেখেছেন!
কি আশ্চর্য! তা তত দেখেছিই, কিন্তু আপনি এত সব জানলেন কি করে?
বাঃ, আপনিই তো বললেন সব! যাক সেকথা, কি ভাবে লোকটাকে হত্যা করা হয়েছে?
শ্বাসরুদ্ধ করেই অর্থাৎ স্ট্রাগল করেই অবিশ্যি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে কি বলব মিঃ রায়, কি আশ্চর্য, কোন রকম ভাবে কোন স্লাঙ্গল করার কোন চিহ্নই গলায় নেই মৃতের।
পোস্টমর্টেমে বুঝি প্রমাণিত হয়েছে?
কি আশ্চর্য! পোস্টমর্টেম এখনও তো হয়ইনি। পুলিশ সার্জেনের তাই মত।
অভিমত! ও, তা মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হল ঠিক কোথায়?
কালীঘাট ব্রিজের তলায়।
হত্যাকারীর তাহলে বলুন এখনও কিছুটা ধর্মভীতি রয়েছে।
কি আশ্চর্য। তার মানে?
এটা বুঝলেন না—সম্মুখেই পতিতোদ্ধারিণী মা গঙ্গা, আর হাত বাড়ালেই সর্বপাপহারিণী সর্বমঙ্গলা মা কালী। হত্যার পাপ যদি হয়েই থাকে, তাতেই স্থলন হয়ে গিয়েছে।
কথাগুলো বলে কিরীটী মৃদু হাসতে লাগল।
.
১২.
আমি কিন্তু তখনও রীতিমত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি।
মৃতের অনুরূপ কোন ব্যক্তিবিশেষকে স্মৃতির সাহায্যে মনের মধ্যে তোলপাড় করে খুঁজছি।
কিরীটী এমন সময় আবার কথা বললে, আপনার অনুসন্ধানের কাজটা তো এবার অনেক সহজ হয়ে এল নির্মলশিববাবু!
কি আশ্চর্য! সত্যি বলছি, দয়া করে আপনার হেঁয়ালি ছেড়ে সহজ করে যা বলবার বলুন।
সহজ করেই বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার উপরে যে কাজের ভার দিয়েছিলাম, তার কি করলেন বলুন তো?
কোন কাজ?
বিশেষ কোন নম্বরের ট্যাকশির বা ভ্যানের ওভারসিজ লিঙ্কে যাতায়াত আছে কিনা সংবাদটা পেলেন কিছু?
না। গত কদিন ভিন্ন ভিন্ন নম্বরের অন্তত গোটা পঁচিশেক ট্যাকশি ও ভ্যান ঐ অফিসে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে।
হুঁ। সোনার কারবারীরা খুবই সতর্ক আছে দেখছি। তবে টোপ যখন গিলেছে একবার, ফসকে যেতে নিশ্চয়ই পারবে না।
কি আশ্চর্য! টোপ গিলেছে!
হ্যাঁ। ভিখনের মৃত্যুটা সেই টোপ গেলবারই আকাট্য নিদর্শন।
নির্মলশিব তারপর আরও কিছুক্ষণ ধরে নানা ভাবে নানা প্রশ্ন করে কিরীটীর কাছ থেকে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করে জানবার—যাকে বলে আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না আর।
নির্মলশিব যেন একটা বিষণ্ণই হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।
অবশেষে একসময় বলে, আমি কিন্তু একজনকে অ্যারেস্ট করব বলে একপ্রকার স্থিরই করে ফেলেছি ইতিমধ্যে মিঃ রায়।
অ্যারেস্ট করবেন? কাকে? এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল কিরীটী, একটু যেন কৌতুকের সঙ্গেই।
আর্থার হ্যামিলটনকে। নির্মলশিব বললে।
সে কি! কেন?
আমার স্থির বিশ্বাস ওকে অ্যারেস্ট করলেই ঐ দলটার অনেক গোপন কথা পাওয়া যাবে।
সত্যিই পাওয়া যাবে মনে করেন?
নির্ধাৎ পাওয়া যাবে।
এ ধারণা আপনার কেন হল বলুন তো?
কেন?
হুঁ।
ও একটি বাস্তুঘুঘু।
বাস্তঘুঘু।
হ্যাঁ। ওকে চাপ দিলেই অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। নির্ঘাত ও অনেক কিছু জানে।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে এবারে হাসল।
কি আশ্চর্য। হাসছেন যে?
কারণ তাতে করে আপনি, যেটুকু এ কদিন এগিয়েছেন তার দশগুণ আপনাকে পিছিয়ে আসতে হবে।
কি আশ্চর্য! তাহলে আমি কি করব বলতে পারেন?
আজ নয়, তিনদিন বাদে আসুন এই সময়, বলব।
কি আশ্চর্য! কিন্তু
কিন্তু নয়। জানেন না, সবুরে মেওয়া ফলে। শনৈঃ শনৈঃ পর্বত লম্বন করতে হয়—শাস্ত্রের বচন।
অতঃপর কতকটা ক্ষুন্ন মনেই বেচারী নির্মলশিবকে সেদিনের মত বিদায় নিতে হল।
.
আরও আধ ঘণ্টা পরে।
সহসা কিরীটী গাত্রোখান করে বলল, চল্ সুব্রত, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
বেলা তখন প্রায় বারোটা।
গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রের তাপে বাইরেটা তখন যে ঝলসে যাচ্ছে অনায়াসেই সেটা বোঝা যায় ঘরের মধ্যে বসেও।
বললাম, এই অসময়ে?
বেরুবার আবার সময় অসময় আছে নাকি? চল–ওঠ!
অগত্যা উঠতেই হল।
এবং ঐ প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে বাইরে বের হয়ে পদব্রজেই কিরীটী নির্বিকারচিত্তে পথ অতিক্রম করে চলল এবং বলাই বাহুল্য আমাকেও তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলতে হল।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম কিরীটী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকেই চলেছে।
তবু জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছিস?
পান খাব। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে হাঁটতে হাঁটতে বলে।
কিন্তু চলেছিস কোথায়?
বললাম তো পান খেতে।
পান?
হ্যাঁ, লোকটা–-মনে নেই পানওয়ালাটা চমৎকার পান সাজে রে, সেদিন চমৎকার লেগেছিল! বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে যায়।
দাঁড়ালি কেন?
না, কিছু না চল—চলতে শুরু করে আবার।
কয়েক পা চলে আবার কিন্তু দাঁড়ায়।
এবার মিনিট দুই-তিন দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে শুরু করে।
ব্যাপারটা কিন্তু এবার কিছুটা অনুমান করেই পিছনে তাকালাম।
হাত দশ-পনেরো দুরে দেখি, একটি জীর্ণ বেশ পরিহিত পথের ভিক্ষুক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃদুকণ্ঠে এবারে কিরীটী বলল, ঐ ভিখিরীটা বোধহয় ভিক্ষে চায় না সুব্রত।
পুনরায় হাঁটতে শুরু করে এবং হাঁটতে হাঁটতেই কথাটা বলে কিরীটী।
তাই মনে হচ্ছে নাকি?
হুঁ, সেই দোরগোড়া থেকেই একেবারে দেখছি অনুগত দেবর লক্ষ্মণের মতই আমাদের অনুগমন করে আসছে।
কথাটা কিরীটী বললে বটে, তবে মনে হল কিরীটী অতঃপর যেন আর পিছনের ভিখারীটার দিকে কোন মনোযাগই দিল না।
হাঁটতে লাগল।
ততক্ষণ আমরা পানের দোকানের কাছাকাছি এসে গিয়েছি।
কিন্তু আজ দেখলাম, পানের দোকানে অন্য একটি লোক বসে।
কিরীটী ক্ষণকাল লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, চার আনার ভাল পান সেজে দাও তো।
মিঠা না সাদা পান বাবু?
মিঠা নয়, সাদা। জর্দা কিমাম দিয়ে দাও।
লোকটি পান সাজতে লাগল।
আড়চোখে লক্ষ্য করে দেখলাম সেই ভিখারীটা অল্পদূরে একটা লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে পথচারীদের কাছে ভিক্ষা চাইছে।
.
১৩.
কিরীটী অদূরবর্তী সেই ভিখারীর কথা উল্লেখ করার পর থেকেই আমার নজরটা সেই ভিখারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
কিরীটী যখন পানওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, আমার নজর তখন ভিখারীর প্রতিই নিবদ্ধ।
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।
হঠাৎ সেই সময় কিরীটীর চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি।
সুব্রত!
কি?
ঐ ভিখারী সাহেবকে চিনতে পারছিস?
অ্যাঁ! কি বললি?
বলছি ঐ ভিখারী সাহেবটিকে চিনতে পারছিস?
সত্যি কথা বলতে কি, তখনই লোকটা ভিখারীর ছদ্মবেশে যে আসলে কে বুঝে উঠতে পরিনি বলেই সেই দিকেই তখনও তাকিয়ে ছিলাম।
এবার কিরীটীর কথায় অদূরে দণ্ডায়মান ভিখারীর দিকে ভাল করে তাকালাম আর একবার।
চেহারা দেখে লোকটার বয়স ঠিক ঠিক বোঝবার উপায় নেই।
তবে মোটামুটি মধ্যবয়সী বলেই লোকটিকে মনে হয় ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও। পরিধানে একটা জীর্ণ সেলাই-করা মলিন ঝলমলে গরম প্যান্ট।
গায়ে অনুরূপ একটা টুইডের ওপন-ব্রেস কোট।
মাথায় একটা বহু পুরাতন জীর্ণ ফেল্ট ক্যাপ!
মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। হাতে একটা মোটা লাঠি।
ভিক্ষার জন্য পথচারীদের কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটা যে একটা ভেক মাত্র সেটা এবারে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবার পরই বুঝতে পারলাম।
এবং ভিক্ষাটা যখন একটা ভেক মাত্র, লোকটার পোশাক ও বাইরের চেহারাটার মধ্যেও যে ছল রয়েছে, সেটাও তো সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু তবু যেন চিনতে পারলাম না লোকটাকে।
এমন সময় কিরীটীর মৃদু আকর্ষণে ওর মুখের দিকে তাকাতেই নিম্নকণ্ঠে সে বললে, চ-গলাটা বড় শুকিয়ে গিয়েছে, সামনে ঐ পান্থ পিয়াবাস থেকে চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেওয়া যাক।
আমি এবারে কিরীটীর প্রস্তাবে দ্বিরুক্তি মাত্রও না করে রাস্তা অতিক্রম করে অপর দিককার ফুটপাতের সামনের দোকানটার মুখোমুখি প্রায় চায়ের রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে চললাম।
এবং ঠিক যেন ঐ সময়েই একটা চকচকে ভ্যান আমাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে পাশের দোকানটার সামনে রাস্তার উপরে ব্রেক কষে দাঁড়াল।
ভ্যানটার গায়ে একটি নর্তকীর ছবি আঁকা ও তার মাথায় লেখা উর্বশী সিগারেট!
ভ্যানটা প্রায় আর একটু হলেই আমাদের চাপা দিয়ে যাচ্ছিল—এমন ভাবে গা ঘেঁষে গিয়েছিল।
যাই হোক, দুজনে এসে অপর ফুটপাতে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ছোট রেস্টুরেন্ট, ঐ সময়টা প্রায় নির্জনই ছিল।
মাত্র একটি চা-পিয়াসী লোক বসে বসে চা পান করছিল।
ঘর বলা যায় না—একটা চিলতে-মত জায়গায় রেস্টুরেন্টটি।
সিলিং থেকে দুটি ঘূর্ণমান পাখা এবং দুটি পাখাই যে কতকালের পুরানো তার ঠিক নেই। ঘড়ং ঘড়ং একটানা শব্দ তুলে যেভাবে ঘুরছে তার তুলনায় হাওয়া কিছুই দিচ্ছে না।
ছোট ঐ একচিলতে জায়গার মধ্যেই কাঠ ও চট সহযোগে একটা পার্টিশন দিয়ে চা ও অন্যান্য সব কিছু তৈরির ব্যবস্থা।
অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের রন্ধনশালা বা প্যান।
আর বাকি অংশে মালিকের ছোট টেবিল ও টুলটি ছাড়া ছটি টেবিল ও প্রত্যেক টেবিলের সঙ্গে চারটি করে চেয়ার পাতা।
হোটেলের মালিকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে বলেই যেন মনে হল।
রীতিমত কৃষ্ণবর্ণ ও গোলালো মাংসল চেহারা লোকটার। গায়ে বোধ হয় একটা মার্কিনের পাঞ্জাবি।
ঘরে ঘূর্ণমান ইলেকট্রিক পাখা থাকা সত্ত্বেও হাতে একটি তালপাতার পাখা সবেগে চালনা করছিল লোকটা থেকে থেকে, কারণ লোকটা ঘেমে একেবারে স্নান করে যাচ্ছিল।
আমাদের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেখেই সবেধন নীলমণি ছোকরা চাকরটি এগিয়ে আসে।
কি দেব বাবু?
দু কাপ চা দে। কিরীটী বললে।
রাস্তার দিকে মুখ করে দরজা ঘেঁষে একেবারে দুজনে বসলাম দুটো চেয়ার টেনে।
কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি সে যেন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাইরের দিকে।
এবং চেয়ে আছে—যেন মনে হল, রাস্তার অপর ফুটপাতের ধারে সামনের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটার দিকেই।
আর ঐ সঙ্গে নজরে পড়ল, খাকী বুশ-কোট ও প্যান্ট পরিহিত—বোধ করি ঐ ভ্যানেরই ড্রাইভারটা, পাশের দোকানটার সমানে দাঁড়িয়ে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছে।
ছোকরা চাকরটা এসে দুকাপ চা আমাদের দুজনের সামনে টেবিলটার উপরে নামিয়ে দিয়ে গেল।
কিরীটীর কিন্তু যেন সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই।
থেকে থেকে ওষ্ঠধৃত সিগারটায় টান দিতে দিতে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরের দিকে দেখলাম তখনও।
বললাম, কি দেখছিস?
উর্বশী সিগারেট খেয়েছিস কখনও সুব্রত? পালটা প্রশ্ন করে আমার প্রশ্নের জবাবে কিরীটী।
না। বললাম।
খেয়ে দেখ—এই নে, বলে পকেট থেকে সত্যি সত্যিই একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেদিন যে ঐ দোকান থেকে দু-তিন প্যাকেট সিগারেট ও কিনেছিল তারই একটা।
কি বলব ভাবছি
এমন সময় কিরীটী আবার বললে, তা যা-ই বলিস, সিগারেটের ব্যবসা কিন্তু লাভজনক।
বললাম, জানি।
লেকের ধারে একটা বিরাট নতুন বাড়ি হয়েছে দেখেছিলাম—
নজর করিনি, কোন বাড়িটার কথা বলছিস?
বিরাট চারতলা গেট ও লনওয়ালা বাড়িটার কথা বলছি। বাড়িটা শুনেছি এক বিড়ির ব্যবসায়ীর-হনুমানজী বিড়ি। কিন্তু–
কি?
মোহিনী বিড়ি, মহালক্ষ্মী বিড়ি, হনুমানজী বিড়ি, হাউইজাহাজ বিড়ি, রেলমার্কা বিড়ি নানা-ধরনের জিজ্ঞাপন দেখেছি, কিন্তু সিগারেট বলতে তো সবেধন নীলমণি ন্যাশন্যাল টোবাকো কোম্পানি। হঠাৎ উর্বশী সিগারেট যে কোথা থেকে এলেন বুঝতে তো পারছি না! তাছাড়া এর আগে ঐ নামটা চোখে পড়েছে বলেও তো মনে পড়ছে না।
তুই তো আর সিগারেট খাস না, খেলে হয়ত নজরে পড়ত।
তা বটে! অনেকগুলো প্যাকেট ভ্যান থেকে নামাচ্ছে দেখছি!
হুঁ। ব্যবসাটা বেশ জমে উঠেছে মনে হচ্ছে। তাই ভাবছি উর্বশীর আবির্ভাব কবে থেকে হল এ শহরে?
আমি ব্যাপারটায় আদৌ মনোযোগ দিইনি গোড়া থেকেই। তাই একটু হালকাভাবেই কথাগুলো বলছিলাম।
কিন্তু কিরীটীর পরবর্তী কথায় হঠাৎ যেন এতক্ষণে মনে হল আমার, কিরীটীর আজকের দ্বিপ্রহরের অভিযানটা ঐ পানের দোকানটিকে কেন্দ্র করেই।
এবং এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, এই খর রৌদ্রতাপেও কিরীটীকে ঐ পানের দোকানটিই ঘরের বাইরে টেনে এনেছে।
কিন্তু নিশ্চয়ই তোর সীতা মৈত্র—আমাদের সেক্রেটারি দিদিমণি সিগারেট খায় না সুব্রত!
বলাই বাহুল্য, কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দৃষ্টি পানের দোকানটার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
দেখলাম, আশ্চর্য, সত্যিই সীতা মৈত্রই তো!!
কাঁধে একটা র্যাশন ব্যাগের মত ব্যাগ ঝুলিয়ে পানের দোকানটার দিকে চলেছে ছাতা মাথায় দিয়ে।
সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
সীতা মৈত্র সোজা উর্বশী সিগারেট ভ্যানটার মধ্যে উঠে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যানটা ছেড়ে দিল।
ব্যাপারটা যেমনি বিস্ময়কর তেমনি আকস্মিক।
অতঃপর কিংকর্তব্য! মনে মনে বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই তাই ভাবছিলাম।
হঠাৎ ঐ সময় আবার কিরীটীর কথায় চমকে উঠলাম, তোর নাম কি রে?
চেয়ে দেখি কিরীটীর সামনে দাঁড়িয়ে তখন রেস্টুরেন্টের সবেধন নীলমণি ছোকরাটি।
এজ্ঞে গদাই।
গদাই কি?
এজ্ঞে ঢোল।
কত মাইনে পাস এখানে?
এজ্ঞে কিছুই না।
হঠাৎ সেইসময় হোটেলের মালিকের গর্জন শোনা গেল, এই গদাই, এদিকে আয়!
গদাই তাড়াতাড়ি মনিবের ডাকে এগিয়ে গেল।
ওঠ সুব্রত। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
কোথায় যাবি?
কোথায় আবার যাব–বাড়ি যেতে হবে না?
রেস্টুরেন্টের দাম মিটিয়ে দিয়ে দুজনে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই একটা খালি ট্যাকশি পাওয়া গেল।
হাত-ইশারায় ট্যাকশিটা থামিয়ে কিরীটী আমাকে নিয়ে ট্যাকশিতে উঠে বসল।
পথে কিরীটী একেবারে চুপ করে বসে রইল চলন্ত ট্যাকশির মধ্যে।
বুঝলাম গভীরভাবে কিছু একটা ও চিন্তা করছে।
এসময় কোন প্রশ্ন করলেও জবাব মিলবে না।
.
১৪.
দিন দুই পরে একদিন দ্বিপ্রহরে।
কিরীটীর বাড়িতেই তার ঠাণ্ডাঘরে বসে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করছিলাম।
গত পরশু সকালে কিরীটী কৃষ্ণাকে বলে গিয়েছে বর্ধমানে সে যাচ্ছে একদিনের জন্য। কিন্তু দুইদিন হতে চলল প্রায় তার এখনও দেখা নেই।
কৃষ্ণার সঙ্গে সেই আলোচনাই হচ্ছিল।
হঠাৎ তার বর্ধমানে কি দরকার পড়ল? শুধালাম আমি।
তা তো কিছু বলে যায়নি। কৃষ্ণা জবাব দেয়।
নির্মলশিববাবুর ব্যাপারেই গেল নাকি?
কে জানে!
ঐ দিনই বেলা তিনটে নাগাদ কিরীটী ফিরে এল।
শুধালাম, হঠাৎ বর্ধমান গিয়েছিলি যে?
এই ঘুরে এলাম। একটা সোফার উপরে বসতে বসতে কিরীটী জবাব দেয়।
তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, হঠাৎ সেখানে কি কাজ পড়ল?
কাজ তেমন কিছু নয়, শ্বশুরবাড়ির দেশটা দেখে এলাম।
কার–-কার শ্বশুরবাড়ির দেশ?
তিলোত্তমার। কিন্তু সখি—এবারে কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললে, রন্ধনশালায় কিছু কি অবশিষ্ট আছে?
আছে।
তাহলে স্নানটা সেরে নিই।
কিরীটী উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।
কিরীটী মুখ খুলল আহারাদির পর। আমি, কৃষ্ণা ও কিরীটী তিনজনে তখন ঠাণ্ডাঘরে এসে বসেছি।
গভীর জলের মাছ-এইটুকু বোঝা গেল আজ। হঠাৎ কিরীটী একসময় বললে।
কিরীটীর খাপছাড়া কথায় ওর মুখের দিকে তাকালাম।
কিরীটী ওষ্টধৃত পাইপটায় একটা টান দিয়ে, পাইপটা হাতে নিয়ে এবার বললে, বেচারী নির্মলশিব তাই কোন হদিস করতে পারেনি!
তুই আহলে হদিস করতে পেরেছিস, বল? প্রশ্ন করলাম আমি।
পুরোপুরি হদিস করতে পারিনি বটে তবে মোটামুটি রাস্তাটা—মনে হচ্ছে বোধ হয় খুঁজে পেয়েছি।
রাস্তা।
হ্যাঁ, চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছি কিন্তু শেষ অর্থাৎ পঞ্চম ঘাঁটিটা কোথায় সেটা জানতে পারলেই কিভাবে কোথা দিয়ে চোরাই সোনার লেন-দেনটা হয় জানতে পারতাম।
চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছ! কৃষ্ণা প্রশ্ন করে এবার।
হ্যাঁ, এক নম্বর ঘাঁটি হচ্ছে ওভারসিজ লিঙ্ক, দু নম্বর চায়না টাউন, আর তৃতীয় ঘাঁটি পানের দোকানটি এবং অনুমান যদি আমার ভুল না হয় তো চতুর্থ ঘাঁটি হচ্ছে পান্থ পিয়াবাস। অবিশ্যি স্বীকার করতেই হবে, খুব planned way-তে কারবারটা চলছে যাতে করে কোনক্রমে কোন দিক থেকে তাদের উপরে সন্দেহ না জাগে কারও বিন্দুমাত্রও।
কিরীটীর কথার মধ্যে ঐ সময় ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কিরীটীই তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল, হ্যালো! কে, বাজোরিয়া? হ্যাঁ,–রায় কথা বলছি। পাওয়া গিয়েছে। Good-সুসংবাদ। আজ থেকেই তাহলে ফ্ল্যাটটা পাওয়া যাবে বলছ! তবে আজই যাব! হা হা-আজই। সব ব্যবস্থা করে ফেল। ঠিক আছে।
কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রেখে এসে পুনরায় সোফায় বসল।
কি ব্যাপার, কে ফোন করেছিল? কি ফ্ল্যাটের কথা বলছিলে ফোনে? কৃষ্ণা শুধায়।
ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে একটা খালি ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।
ওভারসিজ লিঙ্কের উপর খালি ফ্ল্যাট!
হ্যাঁ।
তা হঠাৎ ফ্ল্যাটের তোমার কি প্রয়োজন হল?
এক বাড়িতে বেশি দিন থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। তাই একটু বাসা বদল আর কি।
মানে সেখানে তুমি যাচ্ছ?
হ্যাঁ, একটা সুটকেসে কিছু জমা-কাপড় আর বেডিং তৈরি করে রাখ।
কি হেঁয়ালি শুরু করলে বল তো! বলে কৃষ্ণা।
বাঃ, ঐ দেখ! হেঁয়ালি এর মধ্যে কি দেখলে? দিনকতক গিয়ে এই ফ্ল্যাটটায় থাকব একটু নিরিবিলিতে ভাবছি।
ফ্ল্যাটটায় থাকবে!
হ্যাঁ, অবিশ্যি একা নয়,–সহ সুব্রত।
আমি? প্রশ্নটা করে আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
কি আশ্চর্য, নিশ্চয়ই তুই! কি আশ্চর্য! নির্মলশিবকেও অবশ্যি নেওয়া যেত কিন্তু ভিখারী সাহেবের চক্ষুকে কি ফাঁকি দিতে পারবে নির্মলশিববের ঐ বিশেষ প্যাটার্নের চেহারাটা?
কোন আর প্রতিবাদ করলাম না। কারণ বুঝতে পেরেছি তখন, সবটাই কিরীটীর পূর্বপরিকল্পিত।
এবং এও বুঝতে পেরেছি, ওর সঙ্গে গিয়ে আমাকে সেই ফ্ল্যাটে আপাতত কিছু দিন থাকতে হবে। কেন যে তার মাথায় হঠাৎ ঐ পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে তারও কোন উত্তর যে আপাতত ওর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না তাও জানি।
তাই বললাম, তাহলে আমি উঠি!
উঠবি? ব্যস্ত কেন, বোস্।
বাঃ, তোর সঙ্গে যেতে হবে বললি!
হ্যাঁ, সে তো রাত এগারোটায়। এখন বোস, সন্ধ্যানাগাদ বের হয়ে যাবি, তারপর রাত ঠিক এগারোটায় গিয়ে হাজির হবি ৫নং ফ্ল্যাটে।
কিন্তু–
আমি থাকব। অতএব কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই।
তুই কখন যাবি?
যথাসময়ে।
.
বলাই বাহুল্য ওভারসিজ লিঙ্কের ফ্ল্যাটে গিয়ে না উঠলে এই ব্যাপারের গুরুত্বটা সত্যিই বোধ হয় অত শীঘ্র উপলব্ধি করতে পারতাম না।
আর সেখানে না গেলে অত তাড়াতাড়ি সীতা মৈত্রর পরিচয়টাও পেতাম না।
অথচ সীতা মৈত্রের পরিচয়টা জানা যে আমাদের কতখানি প্রয়োজন ছিল সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
আর এও বুঝেছিলাম, সেবারে কিরীটীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি কতদূর পর্যন্ত দেখতে পায়।
যাক যা বলছিলাম—
রাত এগারোটা বেজে ঠিক সাত মিনিটে গিয়ে ৫নং ফ্ল্যাটে পৌঁছাতেই দরজা খুলে গেল।
কিরীটী পূর্ব হতেই তার কথামত ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিল। সে আহ্বান জানাল, আয়।
ভিতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় যথাসম্ভব বাড়িটার গঠনকৌশল ও প্ল্যান দেখে নিয়েছিলাম।
প্রায় সাত কাঠা জায়গার উপরে বাড়িটা।
ভিতরে একটা চতুষ্কোণ বাঁধানো আঙিনা।
সেই আঙিনার দক্ষিণদিকে সোজা খাড়া প্রাচীর দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে।
সেই প্রাচীরের ওপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা টিনের শেড দেওয়া মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা।
তারপরেই তিনতলা দুটো বাড়ি পাশাপাশি।
ঐ দুটো বাড়ির মধ্য দিয়ে অপ্রশস্ত কাঁচারাস্তা কারখানায় প্রবেশের। সেই বাড়ি দুটো রাস্তার উপর।
রাস্তা থেকে বুঝবারও উপায় নেই যে বাড়িটার দক্ষিণদিকে অতখানি জায়গা নিয়ে একটা অমন বিরাট গাড়ি মেরামতের কারখানা রয়েছে।
পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকে পর পর সব ফ্ল্যাট।
এক এক তলায় ছটি করে ফ্ল্যাট।
এক-একটি ফ্ল্যাটে তিনখানি করে ঘর—পরে জেনেছিলাম, বাথ ও কিচেন ছাড়া।
তিনদিকেই অর্থাৎ পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমে বারান্দা এবং বারান্দার গায়ে গায়ে ফ্ল্যাটগুলো।
সিঁড়িটা বরাবর পূর্ব-উত্তর কোণ দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের বাঁধানো আঙিনাটা দেখা যায়।
আঙিনার অর্ধেকটায় মোটা ও ভারী ত্রিপল খাটানো। দোতলা ও তিনতলার মত আঙিনার তিনদিকে নিচেও বারান্দা আছে।
নিচের তলায় উত্তর ও পশ্চিম দিকে গোটাচারেক যে ঘর ছিল সে ঘরগুলোও ওভারসিজ লিঙ্কের ভাড়া নেওয়া।
পরে অবিশ্যি জেনেছিলাম সে কথাটা।
অর্থাৎ বাইরে রাস্তা থেকে যে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিস দেখা যায় সেটাই সবটা নয়, ভিতরেও অনেকটা অংশ জুড়ে তাদের কারবার।
.
৫ নং ফ্ল্যাটের ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, আকারে ঘরটা বেশ বড়ই।
একদিকে দুটো খাট পাতা, খাটের উপরে সজ্জা বিছানো।
একধারে একটি টেবিল ও দেওয়াল-আলমারি।
ঘরের মাঝখানে একটা ক্যামবিসের আরামচেয়ারে বসে, সামনে ছোট একটা চতুষ্কোণ টুলের উপরে তাস বিছিয়ে কিরীটী বোধ হয় পেসেন্স খেলছিল।
আমাকে দরজা খুলে দিয়ে পুনরায় গিয়ে বসে পেসেন্স খেলার দিকে মন দিল।
দরজা বন্ধ কর দে সুব্রত। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে।
দরজাটা খোলাই ছিল, এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিলাম।
ঘরের সামনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই সামনের বড় ট্রামরাস্তাটা এদিক থেকে ওদিক বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।
বারান্দাটা একবার ঘুরে অন্য ঘর দুটোও একবার দেখে নিলাম।
বাকি দুটো ঘর খালি।
ফিরে এলাম আবার কিরীটী যে ঘরে বসে বসে তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল সেই ঘরে।
.
১৫.
আরও কিছুক্ষণ পরে ঐ রাত্রেই।
কিরীটী কিন্তু তখনও দেখি বসে বসে একমনে পেসেন্স খেলছে। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।
কি রে, তোর ব্যাপার কি বল তো? জিজ্ঞাসা করি কিরীটীকে।
কেন? মাথা না তুলেই জবাব দেয় কিরীটী।
না, তাই জিজ্ঞাসা করছি। এখানে এলি কি পেসেন্স খেলবার জন্যে।
তাস সাজাতে সাজাতে কিরীটী বললে, একেবারে মিথ্যে বলি কি করে, কতকটা তাই বটে।
মানে?
বেশ নিরিবিলি, বসে বসে রাত কাবার করে দিলেও কারও আপত্তির কিছু থাকবে না। তুই যদি দেখতিস-ইদানীং কৃষ্ণা কি রকম খিটখিট করে তাস হাতে দেখলেই! সে যাক গে, তোর আপত্তি থাকলে—ঘণ্টাখানেক তুই ঘুমিয়ে নিতে পারিস!
ঘুমিয়ে নেব–মানে?
ঘুমোবি! ঘুমের ঘুম ছাড়া অন্য কোন মানে আছে নাকি?
হ্যাঁ, শুয়ে পড়।
আর তুই বুঝি বসে বসে পেসেন্স খেলবি?
কি করি ব! পেসেন্স খেললে তবু জেগে থাকতে পারব।
বুঝলাম কিরীটী আপাতত জেগে থাকতেই চায়—তা সে যে কারণেই হোক না কেন।
আমি আর কোন কথা না বলে রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় রাস্তাও নির্জন হয়ে আসছে।
রাস্তায় পথিকের চলাচল কমে এসেছে।
গ্রীষ্মের রাত, নচেৎ এতক্ষণে রাস্তা হয়ত একেবারে নির্জন হয়ে যেত।
হঠাৎ ঐ সময় নজরে পড়ল, রাস্তার ওদিকে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টটা তখনও খোলা আছে।
ভিতরে এখনও আলো জ্বলছে এবং দরজা এখনও খোলা।
এত রাত্রেও পাপিয়াবাসের অর্গল খোলা! এখনও কি খরিদ্দারের আশা করে নাকি!
পানের দোকানটা এই ফুটপাতে হওয়ায় বোঝা যায় না ওখান থেকে যে, ওটা খোলা। কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মধ্যে মধ্যে ট্যাকশি ও প্রাইভেট গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, তবে সংখ্যাটা অনেক কম।
রিকশারও টুং-টুং শব্দ শোনা যায়।
রাস্তার দুধারের সমস্ত দোকানই বন্ধ।
গ্রীষ্মের রাত-রাস্তায় খাটিয়া পেতে সব শোবার ব্যবস্থা করছে।
ঝিরঝির করে বেশ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল।
তাছাড়া দিনের বেলায় ও রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত মানুষের চলাচলে, যানবাহনের ভিড়ে, নানাবিধ শব্দে গমগম-করা সেই রাস্তা যখন নির্জন হয়ে যায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন যেন একটা নেশা ধরে।
তাই বোধ হয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
একসময় খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকলাম, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
টেবিলটার তাস সাজানো রয়েছে কিন্তু কিরীটী ঘরে নেই।
কোথায় গেল কিরীটী?
পাশের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই ছিল। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা অন্ধকার।
সদর দরজার দিকে তাকালাম, সেটা কিন্তু বন্ধ।
বাথরুমেই হয়ত গিয়েছে—মনে করে শয্যায় এসে বসলাম।
কিন্তু পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে আধ ঘণ্টা কেটে গেল, কিরীটীর দেখা নেই।
এতক্ষণ কারও বাথরুমে লাগে নাকি!
শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় পাশের অন্ধকার ঘরটা থেকে কিরীটী বের হয়ে এল।
কোথায় ছিলি রে?
ছাদে গিয়েছিলাম।
ছাদে।
হ্যাঁ, দেখছিলাম বাথরুমে যাতায়াত করবার জন্য সুইপারদের যে ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা আছে সেই সিঁড়িটা দিয়ে সোজা ছাতে চলে যাওয়া যায়। রাত নটার সময় এসে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতেই অবশ্য সব জানা হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এত রাত্রে ছাতে গিয়েছিলি হঠাৎ?
উর্বশীর খোঁজে।
উর্বশী?
হ্যাঁ রে—সেদিনকার সেই সিগারেট উর্বশীর খোঁজে!
ছাতে উর্বশীর খোঁজে গিয়েছিলি মানে?
বোস, তোকে তাহলে সব বলি।
সাগ্রহে শয্যাটার উপর আবার বসলাম।
.
কিরীটী বলতে লাগল, ছাতে গেলেই তোর চোখে পড়বে এই বাড়ির পিছনে একটা গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা আছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওটার নাম হচ্ছে। লাটুবাবুর গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিং শপ। অবিশ্যি খোঁজটা দিয়েছিল নির্মলশিবের লোকই।
নির্মলশিবের লোক! মানে তুই তাহলে তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলি?
অবশ্যই। যাক শোন, কিছু দূরপাল্লার মালবাহী লরির গ্যারাজও ঐ লাটুবাবুর গ্যারাজটা। কলকাতা টু পুরুলিয়া, কলকাতা টু হাজারীবাগ ইত্যাদি প্লাই করে। নির্মলশিবের সেই নিযুক্ত লোকটি বেশ বুদ্ধিমান। চোখ খুলেই সে সব দেখেছিল। এবং সে-ই আমাকে খবর দেয় উর্বশী সিগারেটের একটা ভ্যানও নাকি ঐ গ্যারাজেই থাকে।
উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটার কথা তাহলে তুই আগে থাকতেই জানতিস?
না।
তবে?
তুই আসার ঘণ্টাখানেক আগে এখানে এসে সে আমাকে ঐ খবরটা দিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও একটা খবর সে দিয়ে গিয়েছে।
কি?
ঐ ভ্যানটি ছাড়া উর্বশী সিগারেটের অন্য কোন ভ্যানের নাকি অস্তিত্বই নেই। যাই হোক, তাই দেখতে গিয়েছিলাম ছাত থেকে উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা গ্যারাজে ফিরে এসেছে কিনা।
দেখতে পেলি?
পেয়েছি। কিন্তু আজ রাত অনেক হল, আর না। এবারে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করা যাক।
সে রাত্রের মত আবার কিরীটী মুখ বন্ধ করল।
১৬-২০. তারপরের দিন ও রাত
তারপরের দিন ও রাত কিরীটী ঐ ঘরের মধ্যে স্রেফ চেয়ারে বসে পেসেন্স খেলেই কাটিয়ে দিল।
নির্বিকার নিশ্চিন্ত।
ভাবটা যেন—বিশেষ বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল তাই বিশ্রাম নিচ্ছে।
সঙ্গে গোটাকয়েক নভেল এনেছিলাম, আমারও সেগুলো পড়ে সময় কাটতে লাগল।
তার পরের দিনটাও ঐ ভাবেই অতিবাহিত হল।
ক্রমে রাত্রি হল।
কোথায় কিরীটী খাবারের ব্যবস্থা করেছিল জানি না, একটা লোক নিয়মিত চা ও আহার্য সরবরাহ করে যাচ্ছিল।
সে রাতটাও ঐ ভাবেই কাটাতে হবে তখনও তাই মনে করেই শয্যায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
এবং বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একসময়।
হঠাৎ কিরীটীর হাতের স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেল।
কি রে! ধড়ফড় করে উঠে বসি।
আয় আমার সঙ্গে। চাপা সতর্ক কণ্ঠে কিরীটী বলে।
কোথায়?
ওদিককার ঘরে।
কৌতূহলে কিরীটীর সঙ্গে গিয়ে সর্বশেষ ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করলাম। ঘরটা অন্ধকার।
দেওয়ালে, দক্ষিণের দেওয়ালে কান পেতে শোন ত কিছু শুনতে পাস কিনা?
কান পাততেই স্পষ্ট নারীকণ্ঠ কানে এল দেওয়ালের ওপাশের ঘর থেকে।
পারব না, পারব না—আমি কিছুতেই পারব না।
পুরুষকণ্ঠে জবাব এল, পারতে হবেই তোমাকে।
না।
পারতে হবেই।
না, না–কি তোমার সে করেছে যে তাকে এইভাবে শেষ করতে চাও তুমি?
শেষ আমি করতাম না সীতা—
চমকে উঠলাম সীতা নামটা শুনে।
পুরুষকণ্ঠ তখনও বলছে, কিন্তু ঐ ইডিয়টটা যখন সব জেনে ফেলেছে একবার তখন ওকে সরে যেতেই হবে। পরশু এই সময় সে আসবে, তুমি তাকে শুধু গাড়িতে তুলে দেবে। তারপর যা করবার আমিই করব।
সত্যিই তাহলে তাকে তুমি প্রাণেই মারা স্থির করেছ?
একটু আগেই তো যা বলবার আমি বলেছি।
কিন্তু আমি সত্যিই বলছি, ওর দ্বারা তোমার কোন অনিষ্টই হবে না।
কিন্তু তোমারই বা তার জন্য এত মাথাব্যথা কেন?
মাথাব্যথা! না, না—
তাই তো দেখছি। না পুরনো প্রেমের ঘা-টা বুক থেকে তোমার এখনও শুকোয় নি?
পুরোনো প্রেম?
তাই তো মনে হচ্ছে, সম্পর্কচ্ছেদ করেও যেন তাকে ভুলতে পারনি আজও!
নারীকণ্ঠের কোনরূপ প্রতিবাদ আর শোনা গেল না।
যাক, আমি চললাম। যা বলে গেলাম ঠিক সেইভাবে যেন পরশু রাত্রে তুমি প্রস্তুত থাক।
.
একটু পরেই বারান্দায় পদশব্দ শোনা গেল। ঘরের বাইরের ঠিক সামনের বারান্দা দিয়ে কে যেন চলে গেল। আমরা দুজনে তখনও অন্ধকারে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
নারীকণ্ঠস্বরটি চিনতে না পারলেও নাম শুনেছি-সে সীতা মৈত্র! ওভারসিজ লিঙ্কের সেক্রেটারি দিদিমণি। কিন্তু পুরুষটি কে? কণ্ঠস্বরে চিনতে পারলাম না তাকে।
দুজনে আমাদের পূর্বের ঘরে আবার ফিরে এলাম।
ঘরে ফিরে এসে কিরীটী কিছুক্ষণ পায়চারিই করতে লাগল।
বুঝলাম পায়চারি করতে শুরু করেছে যখন-এখন ঘুমোবে না।
আমারও ঘুম চোখ থেকে পালিয়েছিল ইতিমধ্যে।
কিরীটী পায়চারি করতে লাগল আর আমি চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম।
একসময় সহসা পায়চারি থামিয়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকাল, সুব্রত!
কি?
বর্ধমান গিয়েছিলাম কেন জানিস?
কেন?
একসময় মানে চাকরির শেষদিকে বছর দুই আগে আর্থার হ্যামিলটন বর্ধমান স্টেশনের এ. এস. এম. ছিল।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। ওর অতীত সম্পর্কে খোঁজ করতে বলেছিলাম পুলিসকে। তারাই আমাকে সংবাদটা দিয়েছিল। দু বছর আগের ওর সার্ভিস রেকর্ড থেকে জানা যায় হ্যামিলটন কাজে ইস্তফা দেয়।
কেন?
কারণটা অবিশ্যি জানা যায়নি।কিন্তু সীতার সঙ্গে তখন ওররীতিমত নাকি সখ্যতাই ছিল।
তবে হঠাৎ গোলমালটা বাধল কেন?
সম্ভবত অতি লোভে।
অতি লোভে!
হ্যাঁ। তাঁতী নষ্ট হয়েছে অতি লোভেই। কিন্তু থাক সে কথা, আপাতত কাল সকালে তোকে একটা কাজ করতে হবে।
কি কাজ?
লাটুবাবুর গ্যারাজে!
তোকে একবার যেতে হবে।
লাটুবাবার গ্যারাজে!
হ্যাঁ।
কেন?
একটা সংবাদ তোকে যেমন করেই হোক যোগাড় করে আনতে হবে। লাটুবাবুর কারখানা ও গ্যারেজের বর্তমান মালিক কে?
বেশ। কিন্তু একটা কথা তোকে জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম কিরীটী!
কি?
এটা অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে সীতা মৈত্র আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে, কিন্তু সেজন্যই কি–
কি?
তুই এখানে এসে উঠেছিস?
হ্যাঁ, এবং সেই সংবাদটা পেয়েই বাজোরিয়াকে যখন সেদিন ফোনে বলেছিলাম এই বাড়িতে আমাকে একটা ফ্ল্যাট যোগাড় করে দিতে তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি ঘটনাচক্রে ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তার পাশের এই ফ্ল্যাটটাই খালি হয়ে যাবে। অনেক সময় পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র যোগাযোগ ঘটে, এ ব্যাপারেও ঠিক তাই হয়েছে।
তোর কি ধারণা সোনার চোরাকারবারীদের সঙ্গে ঐ সীতা মৈত্র ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত?
জড়িত কিনা এখনও সঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, তবে—
কি?
সীতা মৈত্রের যৌবন ও রূপ কোনটাই তো অস্বীকার করবার নয়!
অর্থাৎ–
অর্থাৎ এমনও হতে পারে, সীতা মৈত্রের রূপ ও যৌবন দুটোই শাণিত দুটি তরবারির মত মোক্ষম অস্ত্র হয়েছে ওদের হাতে।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল কদিন থেকে। তবে একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কি? কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাল।
আর্থার হ্যামিলটনের সঙ্গে সীতা মৈত্রের বর্তমান সম্পর্কটা কি?
কি আবার, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একদা স্ত্রী ও স্বামী ছিল। কোন কারণে বিচ্ছেদ ঘটেছে।
কারণটা কি আমাদের ঘটোৎকচ?
কিরীটী হেসে ওঠে।
বললাম, হাসলি যে?
কারণ তোর অনুমান যদি সত্যিই হয় তো বলব সীতা মৈত্রের রুচি নেই। কিন্তু মা ভৈষী! তা নয় বন্ধু, তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। কিন্তু রাত অনেক হল, একবার একটু নিদ্রাদেবীর আরাধনা করলে মন্দ হত না।
কথাটা বলে সত্যি সত্যিই দেখলাম কিরীটী শয়নের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
কিরীটী!
কি?
পাশের ঘরে একটু আগে যারা কথা বলছিল তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম-সীতা মৈত্র, কিন্তু পুরুষের কণ্ঠস্বরটা কার বুঝতে পারলাম না তো!
কিরীটী ততক্ষণে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।
একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, পিয়ারীলাল।
পিয়ারীলাল! সে আবার কে?
লাটুবাবুর গ্যারাজের একজন মোটর মেকানিক। কিন্তু তোর ব্যাপার কি বল্ তো? তোর চোখে কি ঘুম নেই? আমার কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে!
কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী পাশ ফিরে শুল।
কিন্তু আমার চোখে সত্যিই তখন ঘুম ছিল না।
কয়েকটা মুখ আমার মনের পাতায় পর পর ভেসে উঠতে লাগল একের পর এক।
ঘটোৎকচ, সীতা মৈত্র, চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল, ভিখারী সাহেব এবং আর্থার হ্যামিলটন। ঐ মুখগুলোর সঙ্গে নিজের অজ্ঞাতে যেন আর একখানি মুখ ভাববার চেষ্টা করতে লাগলাম, যাকে ইতিপূর্বে আমি না দেখলেও কিরীটী নিশ্চয়ই দেখেছে, নচেৎ ও জানল কি করে যে নাম তার পিয়ারীলাল?
লাটুবাবার কারখানার একজন মোটর মেকানিক পিয়ারীলাল। তা হোক, কিন্তু তার সঙ্গে সীতা মৈত্রের কি সম্পর্ক? আর ঘনিষ্ঠতাই বা লোকটার সঙ্গে তার কোন সূত্রে?
এবং কে-ই বা সেই নিরীহ ইডিয়ট প্রকৃতির লোকটা যার প্রতি এখনও সীতা মৈত্রের পুরনো প্রেম বুকের মধ্যে জমানো রয়েছে, যে প্রেমের জন্য মোটর মেকানিক পিয়ারীলালের বুকে ঈর্ষাটা টনটনিয়ে উঠে রক্তনখর বিস্তার করেছে?
অন্ধকার ঘরে শুয়ে পিয়ারীলাল আর সীতা মৈত্রের কথাই ভাবছিলাম।
পিয়ারীলালের কণ্ঠস্বরে সেই ঈর্ষার সুরটুকু আমার কানকে এড়িয়ে যায়নি। কেবলমাত্র ইডিয়েট ওসব জেনে ফেলছে বলেই নয়, সীতা মৈত্রের বুকের মধ্যে আজও তার জন্য ভালবাসা রয়েছে বলেই এ দুনিয়া থেকে সরে যেতে হবে আজ তাকে— পিয়ারীলাল তাই চায়।
আর যেতে তো হবেই-এই যে চিরাচরিত নীতি!
এক আয়েষার ভাগ্যাকাশে তো দুটি চন্দ্র থাকতে পারে না-ওসমান ও বীরেন্দ্র সিংহ!
ইডিয়ট ও মোটর মেকানিক পিয়ারীলাল!
কিন্তু কে ঐ ইডিয়ট?
আর সত্যিই যদি সে ইডিয়ট হত, সীতা মৈত্রের মত মেয়ের সেই ইডিয়টটার উপর দুর্বলতা থাকে কি করে?
পিয়ারীলাল এক কথার মানুষ, সে তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গিয়েছে।
ইডিয়টটার আজ প্রাণসংশয় হয়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে। তাকে আজ এ দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবেই।
শুধু স্বর্ণসন্ধানীদের রহস্য কিছুটা জেনে ফেলেছে বলেই নয়, পিয়ারীলালের প্রতিদ্বন্দ্বী আজ সে।
হায় রে বিচিত্র মানুষের মন, ভালবেসেও মুক্তি নেই, ভালবাসা পেয়েও মুক্তি নেই।
পঞ্চশরের দুমুখো শর।
কিন্তু ইডিয়ট–ইডিয়টটা কে? তবে কি–
হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতই যেন নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখখানাও মনের পাতায় ভেসে উঠল—আর্থার হ্যামিলটন।
আর্থার হ্যামিলটনেকে সীতা মৈত্র তাহলে আজও ভুলতে পারেনি!
.
১৭.
পরেরদিন সকাল আটটা নাগাদ কিরীটীর পূর্বরাত্রের নির্দেশমত ঘর থেকে বের হলাম লাটুবাবুর গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপের বর্তমান মালিকের অনুসন্ধানে।
আর মনের পাতায় যে অদেখা মানুষটার মুখটাকে তখনও কোন একটা পরিচিতের আকার দেবার চেষ্টা করছিলাম, সেই মোটর মেকানিক পিয়ারীলালের যদি সন্ধান পাই, দেখা পাই—সেই কথাটা ভাবতে ভাবতেই গেলাম।
তিনতলা ও চারতলা দুটো বাড়ির মাঝখান দিয়েই বলতে গেলে প্রায় গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপে প্রবেশের কাচা অপ্রশস্ত রাস্তাটা।
বড় লরি বা বাস সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে বটে, তবে একটু অসাবধান হলেই দেওয়ালে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা।
ঢোকার মুখেই একটা হিন্দুস্থানীদের মিঠাইয়ের দোকান-লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
একটা ভুষো কালির মত কালো কুচকুচে রঙ বিরাট ভুড়িওয়ালা লোক খালি গায়ে হাঁটুর উপরে কাপড় তুলে বিরাট উনুনের ধারে বসে বিরাট একটা কড়াইয়ে গরম জিলাপি ভাঁজছে।
সদ্যভাজা জিলাপির গন্ধটা কিন্তু বেশ লাগে।
এগিয়ে চললাম ভিতরের দিকে।
অনেকটা জায়গা নিয়ে বিরাট টিনের শেডের তলায় গ্যারাজ ও ওয়ার্কশপ। সবটা জায়গাই অবিশ্যি টিনের শেড দেওয়া নয়, উন্মুক্ত জায়গা অনেকটা রয়েছে।
বিশেষ কোন লোকজন সামনাসামনি চোখে পড়ল না।
কেবল দেখলাম একটা রোগা ডিগড়িগে লম্বা শিখ দাঁতনের একটা কাঠি দিয়ে দাঁতন করছে আর অদূরের কলতলায় কে একটা লোক সাবান দিয়ে মাথা ঘষছে।
এদিক ওদিক আট-দশটা ট্রাক, বাস ও ট্যাকশি দাঁড়িয়ে রয়েছে উন্মুক্ত জায়গাটায়।
টিনের শেডটার মধ্যে উঁকি দিলাম। সেখানেও বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার অনেকগুলোই আছে।
বাতাসে একটা মোবিল ও পেট্রোলের গন্ধ।
এ গেঁড়াইয়া, গাল শুন!
কে যে কাকে সম্বোধন করল।
কে কাকে সম্বোধন করল জানবার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ গ্যারাজের মধ্যে একটা পার্টিশনের ভিতর থেকে বের হয়ে এল ঘটোৎকচ, পরিধানে স্ট্রাইপ দেওয়া ময়লা পায়জামা, গায়ে একটা গেঞ্জি, সদ্য সদ্য বোধ হয় ঘুম ভেঙেছে।
একেই প্রথম দিন ওভারসিজ লিঙ্কের সেক্রেটারি দিদিমণির অফিস-ঘরে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম।
ঘটোৎকচও পার্টিশান থেকে বের হয়েই আমাকে সামনে দেখে বুঝি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়।
রোমশ জোড়া ভ্র-দুটো যেন একটু কুঞ্চিত হয়েই পরক্ষণে আবার সরল হয়ে আসে।
কাকে চান? ঘটোৎকচ প্রশ্ন করে আমাকে।
মুহূর্ত না ভেবেই জবাব দিলাম, মিঃ পিয়ারীলালের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভ্রূ-যুগল আবার মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হল এবং আবার সরল হল।
ধূর্ত শিয়ালের মত চোখের দৃষ্টিটা এক লহমার জন্য বোধ হয় আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিল একবার।
কেন, পিয়ারীলালকে দিয়ে কি হবে?
দরকার ছিল আমার একটু–
আমিই পিয়ারীলাল।
আপনি পিয়ারীলাল? নমস্কার। আপনিই মোটর মেকানিক পিয়ারীরাল?
হ্যাঁ।
ঠিক ঐ সময়ে টিনের শেডের মধ্যে পুর্ব কোণে নজর পড়ল, উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু বাঁদিকে যেন নজরই পড়েনি এমনিভাবে ঘটোৎকচের মুখের দিকে আবার তাকিয়ে বললাম, আপনি কি এই গ্যারাজ-ওয়ার্কশপের মালিক?
ঐ সময় একটা ছোকরা এসে পিয়ারীলালের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, চা দেব?
হুঁ, ঘরে দে।
ছোকরাটা চলে গেল।
অ্যাঁ, কি বলছিলেন, মালিক? তা বলতে পারেন বৈকি, আমি-আমি ছাড়া আর মালিক কে? কিন্তু কি দরকার আপনার এই গ্যারাজের মালিক কে জেনে?
কথাটা তাহলে আপনাকে খুলেই বলি মিঃ পিয়ারীলাল। আমার একটা বড় করে বেশ গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিং শপ খুলবার ইচ্ছা আছে। উল্টোডাঙ্গার ওদিকে একটা জায়গাও লিজ নিয়েছি।
কথাটা বলায় দেখলাম কাজ হল।
পিয়ারীলালের ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত হয়ে আবার সরল হল।
আবার একবার যেন নতুন করে পিয়ারীলাল আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল।
আবার বললাম, তাই বড় বড় মোটর রিপেয়ারিং শপগুলো আমি ঘুরে ঘুরে যথাসম্ভব দশ দিক জানবার চেষ্টা করছি। আপনারা তো অভিজ্ঞ লোক, আপনাদের পরামর্শ মূল্যবান।
তা কি রকম ক্যাপিটাল নিয়ে নামছেন?
খুব বেশি নয়, হাজার পঞ্চাশ-ষাট। রিপেয়ারিং তো হবেই আমার কারখানায়, সঙ্গে বড়ি-বিলডিং, ছোটখাটো একটা লেদ মেশিন আর স্প্রে পেনটিংয়ের ব্যবস্থাও থাকবে। আপনি কি বলেন, সেটাই বিবেচনার কাজ হবে না কি? তবে যাই করি, ভাল একআধজন মেকানিক না হলে তো আর কারখানা চালানো যাবে না। আচ্ছা সেরকম ভাল কোন মেকানিক আপনার খোঁজে আছে মিঃ পিয়ারীলাল?
না।
হঠাৎ পিয়ারীলালের কণ্ঠস্বরে যেন আমার কেমন খটকা লাগল।
নিজের অজ্ঞাতেই চমকে ওর মুখের দিকে তাকাই।
এখানে কোন্ সুবিধা হবে না। আপনি রাস্তা দেখুন!
কথাটা বলে পিয়ারীলাল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, সটান পার্টিশনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
.
১৮.
বলাই বাহুল্য আমিও আর অতঃপর সেখানে দাঁড়াই না।
অবিলম্বে স্থানত্যাগ করাই সমীচীন মনে হওয়ায় আমি গ্যারাজ থেকে সোজা বের হয়ে এলাম।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটে গেলাম না।
বড় রাস্তা পার হয়ে সোজা দক্ষিণমুখে হাঁটতে শুরু করলাম।
কিন্তু কিছুদূর হাঁটবার পরই মনটা কেমন সন্দিগ্ধ হওয়ায় পিছন ফিরে তাকালাম, কেউ অনুসরণ করছে না তো!
পশ্চাতে যারা ছিল তাদের মধ্যে তেলকালি-মাখা একটা নীলরঙের হাফপ্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট পরিধানে রোগা লোককে দেখতে পেলাম।
সেই লোকটার সঙ্গে আমার ব্যবধান মাত্র হাত দশেক। কেন যেন মনে হল, লোকটা আমারই পিছু পিছু আসছে! যাই হোক, আবার সামনের দিকেই চলতে শুরু করলাম। কিন্তু মনের মধ্যে সন্দেহ জেগেছে, আবার কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকালাম। ঠিক সেই ব্যবধানেই পূর্বের লোকটিকে পশ্চাতে দেখতে পেলাম।
অতঃপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলাম। লক্ষ্য করলাম, লোকটিও দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার চলা শুরু করতেই সেও দেখি চলতে শুরু করেছে।
আর কোন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম লোকটা সত্যিই আমাকে অনুসরণ করছে।
মনে মনে হেসে একটা ট্যাকশির সন্ধানে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা খালি ট্যাকশি পাওয়া গেল।
অতঃপর প্রায় ঘণ্টা দুই এদিক ওদিক ঘুরে পূর্বোক্ত ফ্ল্যাটে যখন ফিরে এলাম বেলা তখন প্রায় সোয়া এগারোটা।
এসে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ।
সঙ্গে ড়ুপলিকেট ইয়েল লকের চাবি ছিল, চাবি দিয়ে ঘর খুলে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
কিরীটী তখন ঘরে নেই, কোথাও বের হয়েছে নিশ্চয়ই। ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে চেয়ারটার উপর গা ঢেলে দিলাম।
এবং এতক্ষণে যেন নিরিবিলিতে একাকী সকালবেলাকার ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত মনেমনে ভাববার অবকাশ পেলাম।
কিরীটী কেন আমাকে পাঠিয়েছিল লাটুবাবুর গ্যারেজের আসল মালিকের অনুসন্ধান করতে?
আসল মালিকের নামটার কি সত্যিই কোন প্রয়োজন ছিল কিরীটীর? তবে কি কিরীটীর সেই শেষ ও আসল ঘাঁটিটিই ঐ লাটুবাবুর গ্যারাজটা? কিন্তু কথাটা যেন মন কিছুতেই মেনে নেয় না। তাছাড়া ঐ ঘটোৎকচ?
সেরাত্রে সীতা মৈত্রের ঘরে যে পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম সে ঘটোৎকচের গলা নয়।
অথচ ঘটোৎকচ বললে তারই নাম পিয়ারীলাল। মিথ্যা বলেছে বলে মনে হয় না।
লোকটাকে আর একটু বাজিয়ে দেখতে পারলে হত।
আরও একটা কথা—কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঘটোৎকচের গলার স্বর যখন বদলে গেল তখন বোঝাই যাচ্ছে আমাকে সে সন্দেহ করছে বা সন্দেহের চোখে দেখেছে।
কিন্তু হঠাৎ আমার প্রতি তার মনে সন্দেহই বা জাগল কেন? আর কি করেই বা জাগল?
একদিন মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য ওভারসিজ লিঙ্কের সেক্রেটারি দিদিমণি সীতা মৈত্রের ঘরে সে আমাকে দেখেছে।
তাও ঐ সময় সে আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আমার দিকে নিশ্চয়ই ভাল করে নজর দেবারও তার অবকাশ হয়নি।
ঐটুকু সময়ের জন্য দেখেই সে আমাকে চিনে রেখেছে, নিশ্চয়ই তা সম্ভব নয়।
আর চিনেই যদি থাকে তো প্রথম থেকেই বা সেটা প্রকাশ করেনি কেন তার কথায়বার্তায় ও ব্যবহারে?
কিরীটীর ধারণা, গতরাত্রে সীতা মৈত্রের ঘরে ঐ ঘটোৎকচ বা পিয়ারীলালই এসেছিল। সীতা মৈত্রের সঙ্গে ঘটোৎকচের একটা সম্পর্ক আছে।
কিন্তু সে সম্পর্কটা কতখানি?
ঘটোৎকচের সঙ্গে সীতা মৈত্রের সম্পর্কের কথাটা চিন্তা করতে গিয়ে কখন যে সীতা মৈত্ৰই মনটা জুড়ে বসেছে, বুঝতে পারিনি।
কিরীটী মিথ্যা বলেনি, সত্যিই মেয়েটির অদ্ভুত যেন একটা আকর্ষণ আছে।
এমন এক-একখানি মুখ আছে যা একবার চোখে পড়লে মনের মধ্যে এমন ভাবে একটা দাগ কেটে বসে যা কখনও বুঝি মুছে যায় না।
সীতা মৈত্রের মুখখানি তেমনি করেই যেন মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে গিয়েছিল।
বার বার কেবলই একটা কথা ঘুরেফিরে মনে হচ্ছিল, সীতা মৈত্র যেন ওদের দলের নয়।
ওদের দলে সীতা মৈত্র একান্তভাবেই বেমানান যেন।
সত্যি দুর্ভাগ্য আর্থার হ্যামিলটনের, সীতা মৈত্রের মত স্ত্রী পেয়েও আজ সে ছন্নছাড়া, এক পাপচক্রের মধ্যে হাবুড়ুবু খাচ্ছে!
সীতা মৈত্রের মত স্ত্রী পেয়েও আজ তার ঘরে নেই কেন? জীবনে কেন শান্তি নেই? কেন তাকে মদ খেয়ে নিজেকে ভোলবার চেষ্টা করতে হয়?
তার কেনই বা তাকে সেই নেশার খরচ যোগবার জন্য আজ অন্যের কাছে ভিক্ষুকের মত হাত পাততে হয়?
রাজার ঐশ্বর্য পেয়েও আজ কেন সে ভিক্ষুকেরও অধম?
যে ভালবাসা দিয়ে একদিন সে সমস্ত পৃথিবীকে অধিকার করতে পারত, আজ সেই ভালবাসা পেয়েও কেন তাকে অমন করে হারাতে হল?
আর কেনই বা সে অমন ভাল চাকরিটা ছেড়ে দিল?
সীতা মৈত্রের কথা ভাবতে ভাবতে কখন একসময় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিরীটীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
কি রে সুব্রত, ঘুমে যে একেবারে কুম্ভকর্ণকেও হার মানালি!
কখন এলি?
এই তো ফিরছি। কিন্তু ব্যাপার কি বল তো? কাল রাত্রে ঘুম হয়নি নাকি?
সে কথার জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, কোথায় গিয়েছিলি?
বিশেষ কোথাও না। তারপর-পিয়ারীলালের সঙ্গে আলাপ হল?
হল আর কই!
কেন?
তাড়িয়ে দিল যে আলাপটা ঠিক জমে ওঠবার মুখেই।
কি রকম?
সংক্ষেপে সকালবেলার ঘটনাটা খুলে বললাম।
সব শুনে কিরীটী শুধু বলল, হুঁ।
কিন্তু আমাকে সন্দেহ করল কি করে তাই ভাবছি!
কিরীটী কিন্তু আমার কথার ধার দিয়েও গেল না।
সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সে। বললে, একটা জরুরি কাজ একদম ভুলে এসেছি সুব্রত। সে কাজটা এখুনি একবার বের হয়ে গিয়ে তোকে সেরে আসতে হবে।
কি কাজ?
রমেশ মিত্র রোডে আমার বন্ধু সন্তোষ রায় থাকে, সেখানে গিয়ে ফোন করে কৃষ্ণাকে একটা কথা বলবি–
বল।
কাল রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে হীরা সিং যেন আমার পাশের বাড়িতেই যে অ্যাডভোকেট সুহাস চৌধুরী থাকেন তার গাড়িটা নিয়ে যোধপুর ক্লাবের মাঠের কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। কৃষ্ণা গিয়ে যেন সুহাসবাবুকে আমার কথা বলে গাড়িটা তার চেয়ে নেয়। হ্যাঁ, আর দেরি করিস না। আজ শনিবার, হাইকোর্ট বন্ধ বটে, তবে বেলা একটার মধ্যেই সুহাবাবু মাছ ধরতে একবার বের হয়ে গেলে আর তার গাড়িটা পাওয়া যাবে না। গাড়িটা ভাল, rough রাস্তায় dependable।
আমি আর দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়লাম।
.
১৯.
ফিরে এসে ঘরে ঢুকে দেখি চেয়ারটার উপরে নিশ্চিন্ত আরামের গা ঢেলে দিয়ে কিরীটী ঘুমোচ্ছে।
ইতিমধ্যে ভৃত্য টিফিন-ক্যারিয়ার করে টেবিলের উপরে আহার্য রেখে গিয়েছিল।
হাতঘড়িতে দেখলাম বেলা তখন সাড়ে বারোটো বেজে গিয়েছে। ক্ষুধায় পেটে যেন পাক দিচ্ছিল।
বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে কিরীটীকে ডেকে তুললাম।
খাবি না?
কিরীটী উঠে বসে আলস্যের একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, আচ্ছা সুব্রত, বেদব্যাস-রচিত মহাভারত তো পড়েছিস তুই নিশ্চয়ই?
প্লেটে খাবার সাজাত সাজাতে বললাম, একদা বাল্যকালে।
সে যুগের অর্জুনের মত এ যুগের সুভদ্রাটিকে নিয়ে পালা না কেন তুই।
বলতে বলতে উঠে এসে খাবারের প্লেটটা টেনে নিয়ে বসল কিরীটী।
হাসতে হাসতে বললাম, তা মন্দ বলিসনি, কিন্তু মুশকিল আছে যে একটা।
একটা মাছের ফ্রাই প্লেট থেকে তুলে নিয়ে বড় রকমের একটা কামড় দিয়ে আয়েস করে চিবুতে চিবুতে কিরীটী ভ্ৰ কুঁচকে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, কেন?
বললাম, সে যুগের হলধারী বলরাম যে এ যুগে রেঞ্চ হাতে ঘটোৎকচ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন!
দূর, দূর-ওটা একটা একের নম্বরের গবেট। ওকে তো কাবু করতে দু মিনিট সময়ও লাগে না। ওসব নিয়ে মনখারাপ করিস না, বুঝলি? বলে আর একটা ফ্রাই তুলে নিয়ে আরাম করে তার স্বাদগ্রহণ করতে করতে বললে, বুঝলি, বাবা বিশ্বনাথ বলে ঝুলে পড়।
ঝুলে পড়ব?
হুঁ। দিবারাত্রি ঐ শ্রীমুখপঙ্কজখানি চিন্তা করার চাইতে ঝুলে পড়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
দরজার গায়ে ঐ সময় মৃদু তিনটি নক পড়ল।
দরজাটা খুলে দে, আমাদের কি আশ্চর্য নির্মলশিব এলেন!
সত্যি, নির্মলশিববাবুই।
কি আশ্চর্য! আপনার কথা শেষ পর্যন্ত একেবারে সেন্ট পারসেন্ট মিলে গেল মিঃ রায়!
একটা মাঝারি সাইজের প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নির্মলশিব বললে।
আসুন নির্মলবাবু, বেশ গরম ফ্রাই আছে, খাবেন নাকি? কিরীটী ফ্রাই-সমেত টিফিনক্যারিয়ারের বাটিটা নির্মলশিবের দিকে এগিয়ে দিল।
হঠাৎ তার অত্যধিক উৎসাহ ও উত্তেজনার মুখে কিরীটীর ঐ রকম নিরাসক্তভাবে ফ্রাইয়ের বাটি এগিয়ে দেওয়ায় ভদ্রলোক যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়।
হাতের প্যাকেটটা হাতেই থাকে, কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্ন করে। বলে, ফ্রাই।
হ্যাঁ, অতি উপাদেয় ভেটকি মাছের ফ্রাই। খেয়েই দেখুন না!
বলতে বলতে কিরীটী নিজেই আর একটা ফ্রাই বাটি থেকে তুলে নিল।
কিন্তু মিঃ রায়–
কি, বলুন? বামাল তো পেয়েছেন আর কেমন করে পাচার হয় তারও হদিস পেয়েছেন!
তা—তা পেয়েছি বটে, তবে–
কারবারীদের সন্ধান পাননি, এই তো? মা ভৈষী—যজ্ঞের যখন পেয়েছেন, হোতার সন্ধান পাবেন বৈকি!
কিন্তু বামালেরই বা সন্ধান পেলাম কোথায়?
পাননি?
কই, সবই তো উর্বশী সিগারেটের প্যাকেট! বলতে বলতে হাতের প্যাকেটটা সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে নির্মলশিব হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ল সত্যি সত্যিই, দেখুন না উর্বশী সিগারেট।
প্যাকেকটা সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় টেবিল থেকে তুলে নিয়েছিলাম।
সত্যিই উর্বশী সিগারটের লেবেল আঁটা একটা মাঝারি আকারের সাধারণ প্যাকিং পেপারে প্যাক-করা প্যাকেট।
আমি প্যাকেটটা খুলতে শুরু করেছি ততক্ষণে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলল, আপনি মশাই অত্যন্ত অবিশ্বাসী। বিশ্বাস না থাকলে কি কৃষ্ণ মেলে? ঐ দেখুন সুব্রতকে, জহুরী ঠিক জহর চিনেছে, ইতিমধ্যেই প্যাকেটটা খুলতে শুরু করেছে।
উপর থেকে সাধারণ সিগারেটের প্যাকেট মনে হলেও—যত্ন নিয়ে প্যাকেটটা বাঁধা হয়েছে।
এবং প্যাকেটটা খুলতেই চোখের সামনে বের হল আমাদের পর পর সাজানো যত্ন করে সব ছোট ছোট সিগারটের প্যাকেট।
আমি প্যাকেটগুলো সব এক এক করে টেবিলের উপরে নামালাম। সবই সিগারেটের প্যাকেট-মধ্যে তার অন্য কিছু নেই।
সিগারেটের প্যাকেটগুলো দেখে নির্মলশিবের মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠেছিলই, আমারও মুখে বোধ হয় কিছুটা প্রকাশ পেয়েছিল।
কিরীটী কিন্তু নির্বিকার।
মৃদু হেসে বললে, কি, পরশপাথর মিলল না?
এবং কথাটা বলতে বলতেই সহসা হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে সেটা খুলে ফেলল।
খোলা প্যাকেটের সমস্ত সিগারেট চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কিরীটী পরমুহূর্তেই আর একটা প্যাকেট তুলে নিল। সেটা খুলতেও সিগারেট দেখা গেল সবই।
তবু কিন্তু নিরতিশয় উৎসাহের সঙ্গে একটার পর একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে কিরীটী খুলে যেতে লাগল।
কিন্তু সিগারেট–শুধু সিগারেট।
ততক্ষণে কিরীটীরও মুখের হাসি বুঝি মুছে গিয়েছিল।
সে যেন পাগলের মতই সিগারেটের প্যাকেটগুলো একটার পর একটা খুলতে থাকে।
সিগারেটগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আমি আর নির্মলশিব নির্বাক।
কিরীটীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে একটা চাপা উত্তেজনায়।
কঠিন ঋজু চাপাকণ্ঠে যেন কতকটা আত্মগতভাবেই বললে, না, ভুল হতে পারে। কিছুতেই না-বলতে বলতে হাতে যে প্যাকেকটা তখন তার ছিল সেটা খুলতেই চকচকে একটা লম্বা চাবির মত কি বের হয়ে পড়ল। সাইজে সেটা দু ইঞ্চি প্রায় লম্বা হবে।
পেয়েছি, এই যে পেয়েছি! ভুল হতে পারে? ভুল হয়নি আমার—এই যে দেখুন!
উত্তেজনায় ততক্ষণে আমি ও নির্মলশিববাবু কিরীটীর হাতের দিকে ঝুঁকে পড়েছি।
কি আশ্চর্য! এ যে সত্যি সত্যিই–
নির্মলশিবের অর্ধসমাপ্ত কথাটা কিরীটীই শেষ করল, হ্যাঁ, সোনার চাবি। ওজন অন্তত তিন থেকে চার ভরি তো হবেই।
কি আশ্চর্য! দেখি, দেখি, মিঃ রায়, দেখি–সোনার চাবিটা সাগ্রহে কৌতূহলে হাতে তুলে নিল নির্মলশিববাবু?
কিরীটী কথা বললে আবার, আজকের প্লেনে কতগুলো বাক্স যাচ্ছিল নির্মলশিববাবু?
দশটা বাক্স।
দশটা বাক্স! এক-একটা বাক্স কতকগুলো করে প্যাকেট রয়েছে নিশ্চয়ই গুনে দেখেছেন?
দেখেছি বইকি, কুড়িটা করে প্যাকেট।
কুড়িটা। তাহলে কুড়ি ইনটু দশ—দুশো প্যাকেট, অর্থাৎ তাহলে হল দুশো ইনটু চার অর্থাৎ আটশো ভরি সোনা আজ পাচার হচ্ছিল এ দেশ থেকে!
কি আশ্চর্য! বলেন কি? তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!
সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মানে? বাক্সগুলো ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? কিরীটী শুধাল।
তা—তা দিয়েছি,-কেমন করে জানব বলুন মশাই যে সিগারেট চালান যাচ্ছেতার মধ্যে সত্যি সত্যিই সোনা রয়েছে!
কিন্তু আমি তো আপনাকে সেই জন্যই-অর্থাৎ মালগুলো আটক করবার জন্যেই পাঠিয়েছিলাম!
কি আশ্চর্য! তা তো পাঠিয়েছিলেন—কিন্তু–
ঠিক আছে। আপনি এখুনি গিয়ে কাবুল কাস্টমসে একটাওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়ে দিন মালগুলো সেখানে আটক করবার জন্যে।
কি আশ্চর্য! তা আর বলতে? এখুনি আমি যাচ্ছি!
একপ্রকার যেন ছুটেই নির্মলশিব ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী আর একটা ফ্রাই বাটি থেকে তুলে কামড় দিতে দিতে বললে, নাঃ, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে!
.
২০.
ঘণ্টা দেড়েক বাদেই আবার নির্মলশিব হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল আমাদের ফ্ল্যাটে।
কি হল, দিয়েছেন মেসেজ পাঠিয়ে?
হ্যাঁ, প্লেন এতক্ষণে বোধ হয় পোঁছল কাবুল পোর্টে। কিন্তু কি আশ্চর্য সত্যি সত্যিই সুব্রতবাবু, যাকে বলে তাজ্জব বনে গিয়েছি। অ্যাঁ, সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যে সোনা! এ যে রূপকথাকেও হার মানাল!
সত্যি, রূপকথার চাইতেও যে সময় সময় বিস্ময়কর কিছু ঘটে নির্মলশিববাবু!
কিন্তু তা যেন হল, এই উর্বশী সিগারেটের ব্যাপারটা আপনাকে সন্ধান দিল কে মিঃ রায়?
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, কে আবার দেবে। ভগবান যে দুজোড়া চক্ষু কপালের ওপর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন সেই চক্ষুজোড়াই সন্ধান দিয়েছে। তা যেন হল,-আমাকে আর একটা যে কাজের ভার দিয়েছিলাম সেটার কতদূর করলেন?
কিসের? সেই হরগোবিন্দবাবুর কুকুর দুটোর কথা তো?
হ্যাঁ।
বললেন, তিনি কুকুর নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন ঠিক সময়—কথা দিয়েছেন।
ঠিক আছে, তাহলে আপনাকে ঠিক যে জায়গায় থাকতে বলেছি সেইখানে সশস্ত্র একেবারে হাজির থাকবেন কাল রাত্রে যথাসময়ে।
কি আশ্চর্য! থাকব বৈকি!
তাহলে এবারে আসতে আজ্ঞা হোক।
কি আশ্চর্য! উঠতে বলছেন তাহলে? হ্যাঁ।
বেশ, বেশ। কি আশ্চর্য। তাহলে আমি চলি, কি বলেন?
হ্যাঁ।
নির্মলশিববাবু বিদায় নেবার পর কিরীটী বললে, সুব্রত, ঘরটা একটু পরিষ্কার করে রাখ।
কেন, কি ব্যাপার?
বলা তো যায় না, হঠাৎ ধর তোরই খোঁজে কোন ভদ্রমহিলার যদি এ ঘরে এই সময়ে আবির্ভাব ঘটে তিনি কি ভাববেন বল্ তো! ভাববেন হয়ত আমরা বুঝি কেবল দক্ষিণ হস্তে একটি ব্যাপারের সঙ্গেই পরিচিত। সেটা কি খুব শোভন হবে।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু আসছেন কে?
কে বলতে পারে-হয়ত চিত্রাঙ্গদা, নয়ত রাজনটী বসন্তসেনা, কিংবা স্বয়ং উর্বশীই এই ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটে আবির্ভূতা হতে পারেন।
হেঁয়ালি রাখ। কথাটা খুলে বল্।
আমিই কি সঠিক জানি নাকি যে হেঁয়ালি ছেড়ে সঠিক বলব! সবটাই তো আমার অনুমান।
কিন্তু কিরীটীর অনুমান সেরাত্রে মিথ্যেই হল।
অথচ সেরাত্রে প্রতিটি মুহূর্ত যে কার অপেক্ষাতে কিরীটী অসীম আগ্রহে কাটিয়েছে, একমাত্র তা আমিই জানি।
এবং শেষ পর্যন্ত যতক্ষণ না রাত্রি প্রভাত হল কিরীটী শয্যায় গেল না।
জেগেই কাটিয়ে দিল রাতটা।
পরের দিনও সারাটা দিন কিরীটী ঘরে বসেই কাটিয়ে দিল।
কোথাও বের হল না।
কেবল চেয়ারটার উপরে চোখ বুজে বসে রইল।
কিন্তু বুঝতে পারছিলাম তার কান দুটো খাড়া হয়ে আছে।
এবং সে কারও আসারই প্রতীক্ষ্ণ করছে।
অবশেষে একসময় ক্রমশ বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা এল।
এবং ক্রমশ যতই সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হতে চলল কিরীটী একটা চাপা উত্তেজনায় যেন অস্থির হয়ে উঠতে লাগল।
এবং ব্যাপারটা যে আদৌ হেঁয়ালি নয় সেটাই যেন ক্রমশ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
কিরীটী সত্যি সত্যিই কারও আগমন প্রতীক্ষ্ণয় ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অস্থির, অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে গতকালের মতই।
কিন্তু কে?
কার আগমন প্রতীক্ষ্ণ করছে কিরীটী?
কার আগমন প্রতীক্ষ্ণয় কিরীটী এমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে?
এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে?
ইতিমধ্যে কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি শুরু করেছিল।
আমি নির্বাক চেয়ারে বসে আর কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।
পায়চারি করছে দেখছি সে সমানে সেই বেলা তিনটে থেকে।
মধ্যে মধ্যে অস্থির ভাবে নিজের মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ একটানা কয়েক ঘণ্টার প্রতীক্ষ্ণর বুঝি অবসান হল রাত্রি সাড়ে নটায়।
ঘরের বন্ধ দরজায় অত্যন্ত মৃদু নক পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু কিরীটী গিয়ে দরজা খুলে দিল।
আসুন—আপনার জন্যেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম আসবেন। ও কি, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ঘরের ভিতরে আসুন।
ঘরে এসে ঢুকল সীতা মৈত্র।
আমিও দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটী দরজাটা বন্ধ করে দিল।
বসুন।
সীতা মৈত্র কিন্তু বসল না।
হাতের হ্যান্ডব্যাগ থেকে একখানা চিঠি বের করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনিই তাহলে এই চিঠি আমাকে পাঠিয়েছেন?
চিঠির নিচে তো আমার নামস্বাক্ষরই তার প্রমাণ দিচ্ছে সীতা দেবী!
কিন্তু আমি আপনার চিঠির কোন অর্থই তো বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়!
মৃদু হেসে কিরীটী বললে, পেরেছেন বৈকি!
পেরেছি?
হ্যাঁ, পেরেছেন। নচেৎ আমার কাছে চিঠি পড়েই ছুটে আসতেন না।
কিন্তু—
বসুন ঐ চেয়ারটায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো কথা হয় না।
বিশ্বাস করুন আপনি, আপনার এই চিঠির অর্থটা জানবার জন্যেই আমি এসেছি।
সত্যিই কি এখনও আপনি বলতে চান সীতা দেবী, চিঠির অর্থ আপনি বোঝেননি? সত্যিই কি আপনি বলতে চান আপনার নিজের বর্তমান অবস্থার গুরুত্বটা আপনি এখনও বুঝতে পারেননি?
আমার বর্তমান অবস্থার গুরুত্ব!
হ্যাঁ, মৃত্যু আপনার সামনে আজ এসে ওৎ পেতে দাঁড়িয়েছে।
মৃত্যু কথাটার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চমকে তাকায় সীতা কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী নির্মম কণ্ঠে বলতে লাগল, আপনি জানেন না এখনও কিন্তু আমি জানি সীতা দেবী, যে দলের সঙ্গে আজ আপনি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক ভিড়েছেন তাদের আসল ব্যাপারটা কি! ওভারসিজ লিঙ্কের আসল ও সত্যিকার ব্যাবসাটা জানেন কি?
জানি বৈকি, কেমিক্যালস, চা, সিগারেট।
জোর গলাতেই কথাগুলো সীতা মৈত্র বলবার চেষ্টা করলেও যেন মনে হল গলাটা তার শুকিয়ে উঠেছে।
দু চোখে শঙ্কাব্যাকুল দৃষ্টি।
কিন্তু ওগুলো তো বাহ্য। আসলে যে মৃগয়া ওদের চলেছে সেটা কি জানেন?
কী?
চোরাই সোনা চালান দেওয়া।
সোনা?
ছোট একটা টোক গিলে যেন প্রশ্নটা করল সীতা।
হ্যাঁ, চোরাই সোনা। যে সোনা এদেশ থেকে নানাভাবে চুরি করে, গালিয়ে, ছোট ছোট চাবির আকারে উর্বশী সিগারেটের প্যাকেটে ভরে বিদেশে চালান দিচ্ছে আপনাদের ওভারসিজ লিঙ্কের কর্তারা!
না, না—কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি।
কিরীটীবাবু, আমি সত্যিই একেবারে কিছুই জানি না।
এতক্ষণে সত্যি সত্যিই সীতা যেন ভেঙে পড়ল।
২১-২৬. আপনি জানেন না
আপনি জানেন না যে তা আমি জানি, কিরীটী বলে, কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন জানে।
আর্থার। না না—সে অত্যন্ত নিরীহ গোবেচারি লোক। তাকে আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি জানি। সে এসবের মধ্যে সত্যিই নেই, বিশ্বাস করুন।
আপনার সঙ্গে তো তার গত দেড় বছর ধরে কোন সম্পর্ক নেই। আপনাদের স্বামীস্ত্রীর মধ্যে তো সেপারেশন হয়ে গিয়েছে!
হয়েছে, তবু তাকে আমি জানি। সে এসবের কিছু জানে না। He is so innocent! এত নিরীহ-বলতে বলতে সীতা মৈত্রের দু চোখের কোল ছলছল করে ওঠে।
পটপট করে তার দু চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সীতা দেবী, পিয়ারীলাল সে কথা বিশ্বাস করে না। কিরীটী এবারে বলল।
পিয়ারীলাল! চমকে তাকায় সীতা মৈত্র কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, পরশু রাত্রে সে কথা কি সে আপনাকে এসে বলে যায়নি?
ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে সীতার সমস্ত মুখখানা যেন একেবারে মড়ার মতই ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আর্থার হ্যামিলটনকে সে শেষ করে দিতে চায় সেই কথাই কি গতরাত্রে পিয়ারীলাল এসে আপনাকে জানিয়ে যায়নি?
সীতা একেবারে বোবা হয়ে যায় যেন।
কয়েক মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হয় না।
কি, চুপ করে রইলেন কেন? কোথায় গাড়িতে করে যাবার কথা আছে আজ রাত্রে আপনাদের? বলুন, এখনও আর্থারকে যদি বাঁচাতে চান তো বলুন।
সীতা নির্বাক পাথর।
আর্থারকে তো আজও আপনি ভালবাসেন। কেন তবে চুপ করে থেকে তার সর্বনাশ ডেকে আনবেন মিস্ মৈত্র?
জানি না, আমি কিছু জানি না।
দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল সীতা মৈত্র।
কোন ভয় নেই আপনার সীতা দেবী, নির্ভয়ে আপনি বলুন, আমি কথা দিচ্ছি আপনার নিরাপত্তার জন্য দায়ী আমি থাকব। বলুন, চুপ করে থাকবেন না!
কোথায় তাকে নিয়ে যাবে আমি জানি না, তবে—
তবে?
আজ অফিসে পিয়ারীলালকে বলতে শুনেছিলাম, আমাদের উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা নাকি বারুইপুরে যাবে।
বারুইপুরে?
হ্যাঁ, সিগারেটের কারখানাটা শুনেছিলাম একসময় বারুইপুরে না কি কোথায়।
হুঁ। তাহলে আমার অনুমান মিথ্যে নয়!
কিরীটী যেন অতঃপর চিন্তিতভাবে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করল।
তারপর একসময় পায়চারি থামিয়ে বললে, ঠিক আছে, আপনি আপনার ঘরে যান।
এখন তো আমি ঘরে যাব না—
তবে?
চায়না টাউন হোটেলে একবার যেতে হবে।
কেন, সেখানে কি?
সেখানেই আর্থার থাকে—সেখান থেকে তাকে নাকি ওরা গাড়িতে তুলে নেবে সেই। রকম কথা হয়েছে।
আপনার সঙ্গে কি সেই রকম কথা ছিল?
না। আমার এখানেই থাকবার কথা। কিন্তু—
ঠিক আছে, আপনি যান চায়না হোটেলে, আপনার কোন ভয় নেই।
যাবো?
হ্যাঁ, যান।
সীতা মৈত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
২২.
সেই রাত্রেই।
ভবানীপুর থানায় আমি, কিরীটী ও নির্মলশিববাবু অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় ফোনে সংবাদ এল, সীতা মৈত্র তখনও নাকি চায়না টাউনে যায়নি।
একটু অবাকই হলাম আমরা সংবাদটা পেয়ে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের ফ্ল্যাট থেকে সীতা মৈত্র বের হয়ে গিয়েছে।
এখন রাত সাড়ে এগারোটা এখনও চায়না টাউনে সে পৌঁছায়নি মানে কি?
সংবাদটা পেয়ে কিরীটী যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।
বলে, তবে কি সে সেখানে আদৌ পৌঁছাতেই পারল না?
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি চিন্তা করে।
তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে। সুব্রত।
কি?
ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না। এদিকে হরিপদও তো এখনও পর্যন্ত কোন ফোন। করল না। উর্বশী সিগারেটের ভ্যানের সংবাদটা তার দেওয়ার কথা ছিল–
কিরীটীর কথা শেষ হল না।
ফোন বেজে উঠল।
নির্মলশিবই ফোন ধরেছিল।
কি আশ্চর্য! কে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ও. সি. কথা বলছি। সন্ধ্যার সময় যে সেই ভ্যান গ্যারাজ থেকে বের হয়ে গেছে আর ফেরেনি!
ফোন রেখে দিয়ে নির্মলশিব কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, কি আশ্চর্য। শুনলেন তো মিঃ রায়, ভ্যান এখনও ফেরেনি!
হুঁ শুনলাম, আর দেরি নয়—চলুন—
সকলে আমরা এসে জীপে উঠে বসলাম।
কিরীটী নিজেই ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে স্টীয়ারিং ধরল।
রাত পৌনে বারোটা প্রায়।
কলকাতা শহর প্রায় নিশুতি হয়ে এসেছে।
নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দেখা গেল এক ভদ্রলোক বিরাটাকার দুই অ্যালসেসিয়ান কুকুর নিয়ে তার গাড়ির মধ্যে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
কিরীটী শুধালে, হরগোবিন্দ, এসেছ কতক্ষণ?
তা বোধ হয় ঘণ্টাখানেক হবে।
ঠিক আছে, আমাদের গাড়ির পিছনে পিছনে তুমি তোমার গাড়িটা নিয়ে এস।
.
আগে আমাদের জীপ, পিছনে হরগোবিন্দর গাড়ি।
বারুইপুরে এসে আমরা পৌঁছলাম রাত একটা নাগাদ।
পথের ধারে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করানো হল।
নির্মলশিববাবু প্রশ্ন করে, এবারে?
কিরীটী এবার তার পকেট থেকে একটা ব্যবহৃত, ঘামের গন্ধওলা পুরানো গেঞ্জি কাগজের মোড়ক থেকে বের করে হরগোবিন্দকে বললে, তোমার জ্যাকি আর জুনোকে নিয়ে এস তো গাড়ি থেকে নামিয়ে!
হরগেবিন্দ নিয়ে এল গলায় চেন বাঁধা কুকুর দুটো গাড়ি থেকে নামিয়ে।
সেই গেঞ্জিটা কুকুর দুটোকে শুঁকতে দেওয়া হল কিছুক্ষণ।
কুকুর-দুটো আকাশের দিকে অন্ধকারে মুখ তুলে বার-দুই ঘেউ ঘেউ শব্দ করে এগুতে শুরু করল। আগে আগে কুকুর দুটো, আমরা তাদের পিছু পিছু চলতে লাগলাম। কখনও রাস্তা, কখনও মাঠ, কখনও পুকুরের ধার দিয়ে কুকুর দুটো যেতে লাগল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে নির্জন একটা পড়ো বাড়ির কাছাকাছি আসতে আমাদের নজরে পড়ল, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে উর্বশী সিগারেটের সেই কালো রঙের চচকে ভ্যানটা।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী হরগোবিন্দকে চাপাকণ্ঠে যেন একেবারে ফি ফি শব্দে নির্দেশ করে, থামো।
হরগোবিন্দ কিরীটীর নির্দেশমত কুকুর-দুটোর গলায় বাঁধা চেনে টান দিতেই শিক্ষিত। কুকুর দুটো থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
এক পাও তারা আর নড়ল না।
পূর্ববৎ চাপাকণ্ঠে কিরীটী ডাকে, সুব্রত।
কি?
দেখেছিস?
হুঁ।
নির্মলশিববাবু?
বলুন!
পিস্তল আছে তো সঙ্গে?
হ্যাঁ।
লোডেড?
হ্যাঁ।
O. K.
বাড়িটার মধ্যে আমাদের প্রবেশ করতে বিশেষ কোন বেগ পেতে হল না।
পরে জেনেছিলাম, সেটা এককালে নাকি নীলকুঠী ছিল।
বিরাট বিরাট ঘর, বিরাট আঙিনা—কিন্তু সব যেন অন্ধকারে খাঁ-খাঁ করছে।
পাখি কি তবে পালাল? নিজেকেই নিজে যেন মনেমনে প্রশ্নটা করি।
এমন সময় হঠাৎ নজরে পড়ল অন্ধকারে একটা ক্ষীণ আলোর আভাস। আলোর আভাসটা আসছিল সামনে একটা ঘরের ঈষৎ উন্মুক্ত দ্বারপথে।
সর্বাগ্রে ছিল কিরীটী। তার পশ্চাতে আমি ও আমার পাশে নির্মলশিববাবু।
কিরীটী দরজার কাছ-বরাবর গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে।
এবং পূর্ববৎ ফিফিস করে আমাকে বলে, শুনছিস্?
হুঁ।
অত্যন্ত ক্ষীণ একটা গ্লোনিংয়ের শব্দ যেন কানে আসছিল সামনের ঘরের ভিতর থেকে।
নির্মলশিববাবু, গেট রেডি।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন একপ্রকার ছুটে গিয়েই দড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই।
ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের দেওয়ালে একটা দেওয়ালগিরি টিমটিম করে জ্বলছে।
আর একটা শয্যার ওপরে অসহায়ের মত চিৎ হয়ে পড়ে আছে কে একজন।
আচমকা এসময় দরজার ওপাশ থেকে একটা ছায়ামূর্তি যেন ঝাঁপিয়ে এসে কিরীটীর উপর পড়ল।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে এবং চোখের পলকে তাকে যুযুৎসুর এক মোক্ষম পাঁচে কায়দা করে ধরাশায়ী করে ফেলে।
আমি ততক্ষণে ছুটে শয্যার উপর সয়িত মানুষটার দিকে এগিয়ে গিয়েছি এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি।
একি! এ যে সীতা।
কিরীটী ঐসময় আমাকে ডেকে বলে, সুব্রত, শয়তানটাকে কায়দা করেছি, তুই আগে দেখ সীতা দেবীকে।
সীতাকে তখন আর দেখব কি!
প্রাণ আছে কিনা সন্দেহ।
নিশ্চল রক্তাক্ত দেহটা শয্যার উপর পড়ে রয়েছে।
সমস্ত পরিধেয় বস্ত্র রক্তে, একেবারে লাল।
ডানদিককার বুকেই রক্তাক্ত ক্ষতস্থানটা নজরে পড়ল। শয্যার একপাশেই নজরে পড়ল পড়ে আছে রক্তমাখা একখানা ছোরা।
বুঝলাম ঐ ছোরাটাই সীতার বুকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় নির্মলশিববাবু প্রথমটায় বোধ হয় একটু হতভম্বই হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে তখনও এক পাশে বোকার মত দাঁড়িয়েছিল।
আমি ঝুঁকে পড়লাম নিঃসাড় সীতার মুখের কাছে, প্রাণ আছে কিনা দেখবার জন্য।
কিরীটী ইতিমধ্যে তার আক্রমণকারীকে যুযুৎসুর প্যাচে ধরাশায়ী করে বুকের উপর চেপে বসেছিল।
নির্মলশিববাবুকে লক্ষ্য করে সে এবারে বলে, নির্মলশিবাবু, আমার পকেটে সিল্ককর্ড আছে একটা বের করুন তো, এটাকে বেঁধে ফেলা যাক।
নির্মলশিব তাড়াতাড়ি এবার এগিয়ে গেল কিরীটীর কাছে। এবং তার পকেট থেকে সিল্ককর্ডটা টেনে বের করল। এবং ক্ষিপ্রহস্তে কিছুটা কিরীটীর সাহায্যেই শেষ পর্যন্ত নির্মলশিব আততায়ীকে বেঁধে ফেললে।
এতক্ষণ আততায়ীকে কিরীটী মাটিতে উবুড় করে রেখেছিল। পিছন দিক থেকে তাকে শক্ত করে সিল্ককর্ডের সাহায্যে বাঁধবার পর চিৎ করেই আমার লোকটার মুখের প্রতি প্রথম নজর পড়ল।
আমি চমকে উঠি নোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে।
শেষ পর্যন্ত আততায়ী আর্থার হ্যামিলটন। সত্যিই বিস্ময়ের যেন আমার অবধি থাকে না!
সীতার আততায়ী আর্থার হ্যামিলটন।
.
ইতিমধ্যে আততায়ী হ্যামিলটনকে বন্দী করে কিরীটী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এবং কোন কথা না বলে প্রথমেই সীতার নাকের কাছে মুখ নিয়ে পরীক্ষা করল, তারপর তার হাতটা তুলে নিয়ে নাড়ির গতি পরীক্ষা করল। এখনও প্রাণ আছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে বাঁচবে না। তার পরেই পার্শ্বে দণ্ডায়মান নির্মলশিবের দিকে তাকিয়ে বললে, নির্মলশিববাবু, একে এখুনি হাসপাতালে রিমুভ করা দরকার।
আমার জীপে করেই তাহলে নিয়ে যাই?
হ্যাঁ, সেই ব্যবস্থাই ভাল হবে। চলুন—আর দেরি নয়।
বলতে বলতে কিরীটী নিজেই নিচু হয়ে রক্তাক্ত সংজ্ঞাহীন সীতার দেহটা দুহাতে বুকের উপরে তুলে নিল।
নির্মলশিব বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে অগ্রসর হল।
আর্থার হ্যামিলটন যেন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিনা প্রতিবাদে সে চলতে লাগল।
.
শেষ পর্যন্ত কিন্তু জীপে তোলা গেল না সীতার দেহটা।
কাজেই হরগোবিন্দের গাড়িতেই দেহটা ভোলা হল।
সেই গাড়িতেই আমি ও কিরীটী উঠলাম।
কিরীটীর নির্দেশে বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে জীপে উঠে বসল নির্মলশিববাবু।
স্থির হল হাসপাতালে সীতাকে পৌঁছে দিয়ে আমরা থানায় যাব।
.
২৩.
পরদিন বেলা সাতটা নাগাদ কিছুক্ষণের জন্য সীতার জ্ঞান হল।
কিরীটী ও আমি এবং নির্মলশিববাবু তিনজনেই সীতার বেডের সামনে ছিলাম। কিন্তু বিশেষ কিছুই বলবার ক্ষমতা তখন আর ছিল না সীতার।
নিদারুণভাবেই সে আহত হয়েছিল, মারাত্মক ছুরির আঘাতে। তার উপরে অতিরিক্ত, রক্তস্রাব।
সীতাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই কিরীটী তার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে।
কিছু বলবেন সীতা দেবী?
ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে সীতা কিরীটীর মুখের দিকে।
কোন কথাই যেন বলতে পারে না।
ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপতে থাকে কেবল।
বলুন কিছু যদি বলতে চান? কিরীটী আবার বলে।
আর্থার—
হ্যাঁ বলুন, আর্থার কি?
তাকে-তাকে! বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না মিঃ রায়।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, হি ইজ সেভড।
বেঁচেছে? সে-সে-
হ্যাঁ, সেই অক্ষতই আছে।
অক্ষত আছে? হি ইজ সেভড়? থ্যাঙ্ক গড।
শেষের কথাগুলো যেন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।
দুচোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
আমারও চোখে জল এসে যায়।
ঐদিনই।
থানায় বসে কিরীটী বলছিল, বেচারী সীতার ঐ করুণ পরিণতির ব্যাপারে কোন দিনই বোধ হয় নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না!
নির্মলশিববাবু প্রশ্ন করে, কেন ও কথা বলছেন মিঃ রায়?
কারণ সীতার ঐ পরিণতির জন্য আমিই বোধ হয় দায়ী।
আপনি?
নিশ্চয়ই সীতার ব্যাপারে অতবড় মারাত্মক ভুলটা যদি না করতাম।
ভুল?
ভুল বৈকি। সীতাকে যদি আমি কাল রাত্রে একাকী না ছেড়ে দিতাম তবে তো তাকে ঐ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না। হ্যামিলটনকে বাঁচাতে পারবে ভেবেই সীতাকে আমি যেতে দিয়েছিলাম এবং সেটা যে আমার কত বড় ভুল–
কিন্তু একটা কথা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি নি মিঃ রায়!
কি?
শেষ পর্যন্ত স্কাউন্ট্রেলটাকে বাঁচানোর জন্য আপনারই মাথাব্যথা হয়েছিল কেন?
ঐখানেই তো আপনি ভুল করছেন নির্মলশিববাবু!
ভুল করেছি মানে?
নিশ্চয়ই, কারণ সত্যি সত্যিই লোকটা স্কাউন্ট্রেল নয়। বরং বলতে পারেন হতভাগ্য!
হতভাগ্য?
হ্যাঁ। অমন স্ত্রী আর তার ভালবাসা পেয়েও নচেৎ লোকটার আজ এই পরিণতি হয়? তাকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কি বলব বলুন?
লোকটার প্রতি দেখছি এখনও আপনার মমতার অন্ত নেই। একটা ডায়বলিক্যাল মার্ডারার!
মার্ডারার?
নিশ্চয়ই। খুনী—
কে খুনী? হ্যামিলটন? কিন্তু সে তো খুনী নয়।
খুনী নয় মানে?
অতি প্রাঞ্জল, সে হত্যা করেনি সীতাকে।
কথাটায় এবারে আমিও চমকে উঠি।
কি বলছিস কিরীটী?
কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলে, ঠিকই বলছি—সে খুন করে নি।
কিন্তু–
লোকটা হ্যামিলটনের মত দেখতে তাই তো? বলতে বলতে মৃদু হাসে কিরীটী।
অতঃপর প্রশ্নটা না করে পারি না।
শুধাই, কে—কে তবে ঠিক হ্যামিলটনের মতই অবিকল দেখতে লোকটা?
হ্যামিলটনের ছদ্মবেশে আসল খুনী।
ছদ্মবেশে!
হ্যাঁ, হাজতঘরে গেলেই তোমাদের ভুল আমি ভেঙে দিতে পারব।
কিরীটীর কথায় সঙ্গে সঙ্গে নির্মলশিব উঠে দাঁড়ায় এবং বলে চলুন, এক্ষুনি চলুন। আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়!
বেশ, চলুন।
সকলে আমরা হাজতঘরের দিকে অগ্রসর হলাম।
থানার লকআপেই লোকটা তখনও ছিল এবং লকআপে থাকলেও কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত তার হাতে হাতকড়া দেওয়া ছিল।
আমরা সকলে এসে থানার সেই লকআপের মধ্যে তালা খুলে ঢুকলাম। দিনের বেলাতেও ঘরটার মধ্যে আলো না জ্বাললে ভাল করে সবকিছু দৃষ্টিতে আসে না।
আমাদের পদশব্দে সে ফিরে তাকাল।
লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেন যেন বুকটার মধ্যে শিরশির করে ওঠে। রুদ্ধ আক্রোশে পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘের মতই যেন চোখ দুটো তার জ্বলছিল তখন।
কিন্তু কিরীটী একটু আগে কি বলল? এ তো আর্থার হ্যামিলটনই।
কিরীটী।
আমার ডাকে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও মনে হচ্ছে আর্থার হ্যামিলটনই, তাই না।
আমি এবং নির্মলশিব দুজনাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাই, কিন্তু ভাল করে ওর চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবি সে নয়। তোদের কেন, সকলেরই ঐ ভুল হওয়াটা একান্তই স্বাভাবিক। তবে হ্যামিলটনের অপূর্ব ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই গতকাল বুঝতে পেরেছিলাম-চিনতে পেরেছিলাম ও আসলে কে? ওর ঐ দুটো চোখই আমাকে ওর সত্যকারের পরিচয় দিয়েছিল—ওর ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও। হ্যাঁ, তোমাদের সকলকে ফাকি দিতে পারলেও ও আমাকে ফাকি দিতে পারে নি Now you see–
বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি ধরে একটা হেঁচকা টান দিতেই স্পিরিটগামের সাহায্যে লাগানো ফলস্ মেকআপের দাড়ি গোঁফ কিরীটীর হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি চমকে উঠলাম এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পেরে। আর্থার হ্যামিলটন নয়। কাঞ্জিলাল।
অস্ফুট কণ্ঠ দিয়ে আমাদের বের হয়ে এল। একি! কাঞ্জিলাল।
হ্যাঁ, কাঞ্জিলাল। চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল।
.
২৪.
আশ্চর্য।
চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল!
কিরীটী মৃদু হেসে অদূরে দণ্ডয়মান চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ, আপাতত তাই মনে হলেও ঐ নামটিও কিন্তু ওর আসল আদি ও অকৃত্রিম নাম বা পরিচয় নয়। ছদ্মবেশের মত ওটিও আর একটি ছদ্মনাম!
ছদ্মনাম?
হ্যাঁ। মহৎ ব্যক্তি ও গুণীজন কিনা—তাই ভদ্রলোক অনেক নামেই পরিচিত।
আরও নাম ওর আছে? শুধাল এবারে নির্মলশিববাবুই।
আছে। আমি অবিশ্যি আর দুটি নাম জানি।
আরও দুটি নাম ওর জানেন?
জানি। বোম্বাই শহরে বৎসর-চারেক পূর্বে উনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন, মিঃ রাখন নামে। এবং তার পূর্বে বছর সাতেক আগে ছিলেন মাদ্রাজে-সেখানে নাম নিয়েছিলেন মিঃ অবিনাশলিঙ্গম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তিন-চারটি ভাষা ওঁর আয়ত্তে।
তবে ওর আসল নামটা কি? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।
আসল নামটি যে কি একমাত্র বলতে পারেন উনিই! বলেই চিরঞ্জীববের দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করল, বলুন না মিঃ কাঞ্জিলাল, আপনার আসল, আদি ও অকৃত্রিম নামটা কি?
বলাই বাহুল্য কাঞ্জিলাল নিরুত্তর রইল।
কেবল কুদ্ধ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে আমাদের দিকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বোবার শত্রু নেই নির্মলশিববাবু। এতএব উনি বোবা, মৌনী। যাকগে—এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
.
আমরা পুনরায় নির্মলশিবের অফিসঘরে ফিরে এলাম।
একটা চেয়ারে বসে একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগে মনোনিবেশ করে কিরীটী।
আমিই এবারে শুধোই, ওকে তাহলে তুই পূর্ব হতেই সন্দেহ করেছিলি?
হ্যাঁ, চায়না টাউন হোটেলে ওকে যেদিন প্রথম দেখি, বলা বাহুল্য আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠেছিলাম, কারণ ওর ঐ দুটি চোখ মনের পাতায় আমার অনেকদিন থেকেই গাঁথা ছিল।
ওকে তুই পূর্বে দেখেছিলি?
চাক্ষুষ নয়-ফটোতে।
ফটোতে।
হ্যাঁ, ক্রিমিনাল রেকর্ড সেকশনের দপ্তরে ওদের মত বহু চিহ্নিত গুণীজনদের যেসব নানাবিধ পরিচিতি সংরক্ষিত থাকে সেই রকমই একটা ফটোর অ্যালবামে ওর চেহারার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ফটোতে সেই সময় ওরই চোখ দুটি সেদিনই আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল। এবং সেইদিনই ডি.সি.-কে আমি বলেছিলাম, চোখের ঐ দৃষ্টি একজন সাধারণ কালপ্রিটের নয়, রক্তের মধ্যে যাদের ক্রাইমের বিষাক্ত বীজ থাকে ও চোখের দৃষ্টি তাদেরই।
আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর বিশ্লেষণ শুনতে থাকি।
কিরীটী বলতে থাকে, সেই সময় ডি. সি.-র কাছে লোকটার কিছু পরিচয় আমি পাই। কারণ লোকটা সম্পর্কে জানতে আমার সত্যিই আগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু ডি. সি. আমাকে বিশেষ কোন ইনফরমেশন লোকটার সম্পর্কে দিতে পারলেন না, বোম্বাই এবং মাদ্রাজের ব্যাপারটুকুই কেবল আমাকে সে সময় তিনি বললেন। মামলাটা ছিল সোনার চোরাই কারবার ও নোটজালের ব্যাপার। কিন্তু সে সময় লোকটিকে ধরেও স্থানীয় পুলিসের কর্তারা জোরালো প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওকে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।
তারপর বেশ কিছুদিন লোকটার আর কোন পাত্তাই পাওয়া যায় না এবং শ্রীমান যে ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে এসে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল নাম নিয়ে তার কর্মের জাল বিছিয়েছে পুলিসের কর্তৃপক্ষ এতদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তারপর?
তারপর সেদিন যখন ওকে আমি হ্যামিলটনকে অনুসরণ করতে করতে গিয়ে চায়না টাউন হোটেলে প্রথম দেখলাম, আমি আর কালবিলম্ব করিনি। সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের দৃষ্টি ওর ওপরে আমি আকর্ষণ করাই এবং অনুসন্ধানের ফলে বিচিত্র এক ইতিহাস আমরা জানতে পারি।
ইতিহাস?
হ্যাঁ, সেই ইতিহাসই এবার বলব। প্রথমে মাদ্রাজ এবং পরে বোম্বাই থেকে পুলিসের তাড়ায় কারবার গুটিয়ে সম্ভবত চিরঞ্জীব—ঐ নামেই বলব, কলকাতায় চলে আসে সোজা। কলকাতায় এসে তার পরিচয় হয় ঘটোৎকচ—অর্থাৎ আমাদের পিয়ারীলালের সঙ্গে। পিয়ারীলাল লোকটা দুর্ধর্ষ ও শয়তান কিন্তু চিরঞ্জীবের মত তার কূটবুদ্ধি ছিল না। পিয়ারীলাল তখন চায়না টাউন হোটেলটি একজনের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে বাগিয়ে নিয়ে সবে হোটেলটির মালিক হয়েছে। পিয়ারীলালের সঙ্গে দোস্ত পাতিয়ে চিরঞ্জীব ঐ চায়না টাউন হোটেলই আস্তানা নিল। তারপর পিয়ারীলালের মাথায় হাত বুলাতে কাঞ্জিলালের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। অতি সহজেই সে হোটেলটি গ্রাস করে নিল। এবং তার একটা পাকাপাকি নিশ্চিন্ত আস্তানাও হল। আস্তানা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরঞ্জীব আবার পুরাতন কারবার অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবারে মন দিল। একে একে সোনার লোভে লোভে চিরঞ্জীবের দলে লোক এসে জুটতে লাগল।
কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন ও তার স্ত্রী সীতা!
সেই কথাই এবারে বলব। ঘটোৎকচের পিয়ারীলালও আসল নাম নয়।
তবে?
ওর আসল নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস মূর। নেটিভ ক্রিশ্চান। ফ্রান্সিস আর আর্থার ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধু।
বন্ধু!
হ্যাঁ। কিন্তু বন্ধুত্বটা যে কিভাবে এত গাঢ় হয়েছিল সেটাই বিচিত্র। কারণ আর্থার তার বন্ধুর মত শয়তান ছিল না। তবে মনের মধ্যে লোভ ছিল অর্থের এবং আমার মনে হয় ঐ লোভই হয়েছিল তাদের পরস্পরের বন্ধুত্বের বাঁধন। যাই হোক যা বলছিলাম তাই বলি। চিরঞ্জীব কলকাতায় স্থিতি হবার পর তার ওভারসিজ লিঙ্ক কোম্পানি গড়ে তুলল। এবং বরাবর যেমন সে করে এসেছে এবারেও তেমনি ওভারসিজ লিঙ্কই নয়–সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে এবং তার আসল কারবারকে পুলিসের শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্য আরও কয়েকটি উপঘাঁটি গড়ে তুলল। অবশ্যই প্রত্যেকটি উপঘাঁটিই কাছাকাছি গড়ে তুলল, কেবল বিশেষ দুটি ঘাঁটি ছাড়া—প্রথম তার নিজের বাসস্থানটি ও দ্বিতীয় নোটজালের কারখানাটি দূরে দূরে রইল।
হস্তধৃত সিগারটা ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে নিভে গিয়েছিল।
সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে গোটা দুই টান দিয়ে কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর পুনরাবৃত্তিতে ফিরে এল।
কিরীটী বলতে লাগল, চায়না টাউন হোটেল ও বারুইপুরের ঘাঁটি বাদে অন্যান্য ঘাঁটি হল তার, ওভারসিজ লিঙ্ক, পান্থ পিয়াবাস রেস্তোরাঁ ও লাটুবাবুর গ্যারাজ এবং নিজেকে ও সেই সঙ্গে নোট জালের কারখানাটি আড়াল করে রাখবার জন্য আমদানি হল উর্বশী সিগারেট।
.
২৫.
কিরীটী বলতে লাগল, চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সর্বপ্রথম ফ্রান্সিস–আমাদের ঘটোৎকচ বা পিয়ারীলাল। তারপর এল, পানওয়লা ভিখন ও পান্থ পিয়াবাসের মালিক কালীকিঙ্কর সাউ। এবং সর্বশেষ আমাদের হ্যামিলটন ও তার সুন্দরী স্ত্রী সীতা হ্যামিলটন।
আর্থার হ্যামিলটনের মনের মধ্যে অর্থের প্রতি লোভ থাকলেও দুবুদ্ধি ছিল না আগেই বলেছি। এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার নেশার ব্যাপারে প্রায়শই খিটমিটি লেগে থাকলেও কেউ তারা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে সেপারেশনের কথাও বোধ হয় ভাবতে পারে নি।
এমন সময় চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের আগমন ঘটল অকস্মাৎ একদিন ঘটোৎকচের সঙ্গে বর্ধমানে হ্যামিলটনের রেলওয়ে কোয়ার্টারে কোন এক নিদারুণ অশুভক্ষণে। এবং এবারের ইতিহাস যা আমাকে কিছু কিছু বলেছিল আর্থার হ্যামিলটন এবং বাকিটা আমার অনুমানের উপরে নির্ভর করে আমি গড়ে তুলেছি।
এতক্ষণে যেন কিরীটীর কথায় অকস্মাৎ আমাদের সকলেরই আর্থার হ্যামিলটনের কথাটা মনে পড়ল।
বর্তমান নাটকে বিশিষ্ট একটি স্থান নিয়েও আর্থার হ্যামিলটনকে যেন আমরা সীতার করুণ ট্রাজেডির সঙ্গে জড়িত হয়ে ও চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের প্রসঙ্গে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম।
তাই হ্যামিলটনের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বললাম, আর্থার এখন কোথায় তুই জানিস কিরীটী?
জানি।
কোথায়?
বর্তমানে সে আসানসোলে তার এক আত্মীয়ের বাসায় পুলিসের সতর্ক প্রহরায়। রয়েছে।
আসানসোলে?
হ্যাঁ।
কবে সেখানে গেল?
কাল রাত্রের ট্রেনে। আমিই অবিশ্যি ডি. সি.-কে বলে ব্যবস্থা করেছি।
সীতার ব্যাপারটা আর্থার জানে না বোধ হয়?
না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কিরীটী–
কি?
আর্থারের ব্যবস্থা যখন তুই করেছিলিই, সেরাত্রে সীতাকে চায়না টাউনে যেতে দিলি কেন?
না যেতে দিলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালকে আজ তো হাতেনাতে ধরতে পারতাম না। কিন্তু তাকে যেতে দিয়ে আমি ভুল করি নি-ভুল করেছি তাকে একা যেতে দিয়ে। কারণ আমার ধারণা ছিল—
কি?
কাঞ্জিলাল হয়তো শেষ পর্যন্ত হত্যা করবে না!
হঠাৎ অমন বিদঘুটে ধারণাটা কেন হল আপনার মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলে নির্মলশিববাবু।
কারণ আমি জানতাম, সীতাকে সত্যি ভালবাসে কাঞ্জিলাল।
কিসে বুঝলেন সেটা?
শেষ মুহূর্তে যে কাঞ্জিলাল সীতাকে চরম আঘাত হেনেছিল, সেই একটিমাত্র ঘটনা থেকেই। যাকে ভালবসেছি বলে আগাগোড়া জেনে এসেছি এবং সেও আমাকেই ভালবাসে বলে জেনে এসেছি হঠাৎ যখন কোন এক মুহূর্তে সেই জানাটা মিথ্যা হয়ে যায়—অর্থাৎ জানতে পারি আমার জানাটা ভুল, সেই মুহূর্তে যে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে তা বড় ভয়ঙ্কর। কাঞ্জিলালেরও হয়েছিল ঠিক তাই। কাঞ্জিলাল যে মুহূর্তে জানতে পারলে সীতা আজও আর্থার হ্যামিলটনকে ভুলতে পারে নি, যতই দূরে যাক সে আজও তার সমস্ত বুকটা জুড়ে রয়েছে তার ভূতপূর্ব স্বামী হ্যামিলটনই, খুব সম্ভবত চিরঞ্জীবের বুকের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল হিংসার ভয়াবহ আগুন, যে আগুনে সীতাকে তো সে ধ্বংস করলই, নিজেরও চরম সর্বনাশকে ডেকে আনল। যে পুলিশ গত এই কয় বছর ধরে তার বহুবিধ দুষ্কৃতির সন্ধান পেয়েও তাকে ধরতে বা ছুঁতে পারে নি, সেই পুলিসের হাতেই ধরা পড়ল আজ সে।
চিরঞ্জীব যে সীতাকে ভালবাসে জানলেন কি করে মিঃ যায়? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।
কেন, আপনার লোকরা চায়না টাউনের প্রোপাইটার চিরঞ্জীবের ঘর সার্চ করে যেসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল সেদিন, তার মধ্যে আপনি কোন উল্লেখযোগ্য বস্তু না পেলেও তার ঘরে যে বাঁধানো বাইবেলটি আপনার লোকরা এনেছিল তার মধ্যে একটি ফটো আমি পেয়েছিলাম—বলতে বলতে কিরীটী ছোট একটা ফটো বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরল।
ফটোটা চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের।
নির্মলশিব ফটোটার দিকে তাকিয়ে বললে, এ তো চিরঞ্জীবের ফটো দেখছি, মিঃ রায়। হ্যাঁ তারই, তবে
তবে আবার কি? এর পিছনের লেখাটা পড়লেই আপনার ঐ তবের উত্তর পাবেন। এই দেখুন–কিরীটী ফটোটা উলটে ধরল।
দেখলাম তার পিছনে ইংরাজীতে লেখা আছে কালি দিয়ে
To my darling Sita
Chiranjib
এবং তার নিচে যে তারিখটা রয়েছে সেটা এক বৎসর পূর্বের।
কিরীটী বলতে লাগল, ফটো এবং এই লেখাটুকুই চিরঞ্জীব-সীতা-রহস্য আমার কাছে। পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
কিন্তু এ ফটো চিরঞ্জীবের ঘরে বাইবেলের মধ্যে এল কি করে? প্রশ্ন করল নির্মলশিববাবু।
খুব সম্ভবত–আমার অনুমান, পরে দুজনার মধ্যে আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় হয় সীতাই চিরঞ্জীবকে ফটোটা ফিরত দিয়েছিল, না হয় চিরঞ্জীবই চেয়ে নিয়েছিল সীতার কাছ থেকে। সে যাক, হ্যামিলটন পর্বটা এবারে শেষ করি। হ্যামিলটনকে দলে সম্ভবত চিরঞ্জীব টেনে নিয়েছিল সীতার আকর্ষণে। যদিচ চিরঞ্জীবের জীবনে সেটাই সর্বাপেক্ষা বড় ভুল হয়েছিল।
কেন? নির্মলশিব আবার প্রশ্ন করে।
কারণ চিরঞ্জীব যে মারাত্মক খেলায় মেতেছিল—অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবার, তার মধ্যে দুর্বল প্রকৃতির নারীর স্থান নেই। এবং সীতা যদি তার জীবনের সঙ্গে ঐভাবে জড়িয়ে না পড়ত, চিরঞ্জীবের আজকের এই পরাজয় ঘটত কিনা সন্দেহ।
.
২৬.
কিরীটী বলতে লাগল, যাই হোক হ্যামিলটনকে দলে নিলেও চিরঞ্জীব কোনদিন তার উপরে সম্ভবত পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে নি। তাই দলের মধ্যে তাকে সক্রিয় হতে দেয় নি।
তবে?
কিন্তু সীতার জন্য তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার প্রয়োজন ছিল, তাই হাতে রেখেছিল তাকে নেশার খোরাক যুগিয়ে।
নেশা।
হুঁ, নেশা। মদের নেশা। এবং বোকা সরল প্রকৃতির আর্থার হ্যামিলটনকে সেইভাবে নেশাগ্রস্ত করে হাতের মুঠার মধ্যে নিতে কাঞ্জিলালকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। যাই হোক ঐভাবে চলছিল, এমন সময় দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল করল কাঞ্জিলাল।
কি?
হ্যামিলটনকে নেগলেকটেট করে। সীতাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়ার পর চিরঞ্জীব হ্যামিলটনের আগের মত নেশার খোরাক যোগানোর ব্যাপারে যখন হাত গুটিয়ে নিল তখনই শুরু হল গোলমাল। তা ছাড়া আর একটা গোলমাল ইতিমধ্যে শুরু হয়েছিল।
কি?
লাভের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গোলমাল। যার ফলে দলের কেউ হয়তো আক্রোশের বশেই পুলিশকে উড়ো চিঠি দেয়। এবং যার ফলে একজনকে ইহজগৎ থেকে সরতে তো হলই, সেই সঙ্গে মোহিনীমোহনকেও চিরঞ্জীরের ব্যাপারে মাথা গলানোর জন্য সরতে হল। এবং শেষ পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে যা হয়, দলপতির সন্দেহটা তখন ক্রমশ এত তীব্র হয়ে উঠতে থাকে দুচারজনকে সেই সন্দেহের আগুনে পুড়ে মরতে হয়—ভিখনকে সেই কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে।
একটা কথা মিঃ রায়। নির্মলশিব প্রশ্ন করে ঐ সময়।
কি বলুন?
সীতা কি চিরঞ্জীবের সব ব্যাপার জানত?
সীতা ভিতরের ব্যাপরটা পুরোপুরি প্রথম দিকে না জানতে পারলেও শেষটায় বোধ হয় সন্দেহ করেছিল।
আর হ্যামিলটন?
হ্যামিলটন বোধ হয় তা জানতে পেরেছিল। তবে জানতে পারলেও বেচারীর তখন আর মুখ খুলবার শক্তি নেই, কারণ রেসের ময়দান ও মদের বোতল তখন তাকে গ্রাস করেছে। ঐ দুটি মারাত্মক নেশায় কাঞ্জিলালই হ্যামিলটনকে মজিয়েছিল ক্রমে ক্রমে এবং সেই নেশার সুযোগেই তাকে একদিন সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিল সে কথা তো আগেই বলেছিল।
তারপর?
তার পরের ব্যাপারটাই শেষোক্ত ট্রাজেডির মূল।
কি রকম?
নেশায় ও অর্থের দৈন্যে এবং সীতাকে হারিয়ে পর্যদস্ত ও নিষ্পিষ্ট আর্থার হ্যামিলটন এসব ক্ষেত্রে যা হয় শেষ পর্যন্ত তাই করেছিল।
কি?
সেও শেষ পর্যন্ত মাত্র দশদিন পূর্বে মরণ কামড় দিল।
কি রকম?
পুলিসের কর্তাকে বেনামী চিঠি দিল। কিন্তু ধূর্ত কাঞ্জিলাল ব্যাপারটা জেনে ফেলল। এবং সঙ্গে সঙ্গে হ্যামিলটনকে একেবারে দুনিয়া থেকে সরাবার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হতে লাগল।
কিন্তু হ্যামিলটনকে সরানো কি কাঞ্জিলালের মত লোকের পক্ষে খুব কষ্টসাধ্য ছিল? প্রশ্ন করলাম আমি।
ছিল না নিশ্চয়ই, তবে সে পারেনি দুটো কারণে!
দুটো কারণে?
হ্যাঁ, প্রথমত কাঞ্জিলাল খুব ভালবাবেই জানত আর্থার হ্যামিলটনের সঙ্গে সীতার সেপারেশন হয়ে গেলেও সীতা আজও তাকে ভুলতে পারে নি। দ্বিতীয়ত হ্যামিলটনকে। সরালে সীতাকে হারাতে হবে তার। সীতাকে কাঞ্জিলাল সত্যিই ভালবেসেছিল সে তো আগেই বলেছি। মদনের ফুলশর নয়, এখানে রতির বঙ্কিম কটাক্ষই শেষ পর্যন্ত অঘটন ঘটাল। তবে একটা কথা এখানে স্বীকার না করলে অন্যায়ই হবে।
কি? প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।
সারা দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা জুড়ে যদি মোহিনীমোহনের লাসটা অতিরিক্ত দম্ভে কাঞ্জিলাল টুকরো টুকরো করে না ছড়িয়ে দিত তো বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার উপরেই দৃষ্টি আমার আকর্ষিত হত না। এবং সেদিনও রাত্রে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে আর নজর পড়ত না। এবং ওভারসিজ লিঙ্কে নেহাত কৌতূহলের বশে প্রবেশ করার পর সেখানে ঘটোৎকচ ও সীতা দেবীর দর্শন না পেলে ও সেদিনকার সেই ঘটনাটা না ঘটলে হ্যামিলটনকে ঘিরে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে সন্দেহটা আমার ঘনীভূত হত না।
কিন্তু এসব কথা তুই জানলি কি করে?
কিছুটা অনুমান, কিছুটা অন্তদৃষ্টি, কিছুটা অনুসন্ধান ও বাদবাকি আর্থার হ্যামিলটনের মুখে।
আর্থার হ্যামিলটনের মুখে!
হ্যাঁ।
কি আশ্চর্য! তাহলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালই সব রহস্যের মেঘনাদ! শুধালেন নির্মলশিববাবু।
হ্যাঁ, তবে আর একটা মাস দেরি হলে চিরঞ্জীব ঠিক নাগালের বাইরে চলে যেত, কারণ যে সোনা সে চুরি করে হস্তগত করেছিল তার বোধ হয় সবটাই সে মোটা মুনাফা রেখে বিদেশে পাচার করে দিতে পেরেছিল। ওভারসিজ লিঙ্কের কারবার। সে হয়তো এভাবে শীঘ্রই গুটিয়ে নিত। কিন্তু কথায় বলে-ধর্মের কল। ঠিক সময়েই ঘটনাচক্রে যোগাযোগটা এমন হয়ে গেল যে চিরঞ্জীবের আর পালানো হল না।
পালাত মানে? পালালেই হল নাকি? নির্মলশিব সদম্ভে বলে ওঠে।
পালাত? আর একবার জাল গুটিয়ে নিলে স্বয়ং কিরীটী রায়েরও সাধ্য ছিল না চিরঞ্জীবের চুলের ডগাটি স্পর্শ করে।
সত্যি বলছেন মিঃ রায়?
এতটুকুও অত্যুক্তি নয়। ও যে কত বড় শয়তান আপনারা জানেন না এখনও, কিন্তু আমি তার সম্যক পরিচয় পেয়েছি। তবে দুঃখ রয়ে গেল, শেষ পর্যন্ত সীতাকে
বাঁচাতে পারলাম না।
কি আশ্চর্য! তার জন্য আর দুঃখ কি? গিয়েছে ভালই হয়েছে—যেমন ও পথে পা দিয়েছিল।
হ্যাঁ, সবই সত্যি, তবু কখনও বোধ হয় ভুলতে পারব না শেষ পর্যন্ত যে আমার শেষ মুহূর্তে ঐ ভুলটা না হলে বুঝি তাকে অমন করে কাঞ্জিলালের হাতে প্রাণ দিতে হত।
নির্মলশিব শেষবারের মত বললে, কি আশ্চর্য।