মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেন থেমেছে।
কিরীটী বাইরে গিয়ে দুজনের মতো চায়ের অর্ডার দিয়ে যখন কামরার মধ্যে ফিরে এলো-দেখলো কাপুর আর শকুন্তলা বসে চা পান করছে।
সুব্রত তখনো ঘুমোচ্ছে।
শকুন্তলা আর রঞ্জিত কাপুর দুজনাই বললে, গুডমর্নিং, মিঃ রায়।
গুড মর্নিং।
চা চলবে নাকি? শকুন্তলা শুধায়।
আপনারা খান—আমি চায়ের কথা বলে এসেছি।
সুব্রত কম্বলের তলা থেকেই কথা বলে ওঠে, বলেছিস?
হুঁ। তোর ঘুম ভাঙল? কিরীটী প্রশ্ন করে।
সুব্রত বললে, অনেকক্ষণ!
বেলা দুটো নাগাদ ট্রেন কানপুরে এসে পৌঁছায়।
কথা ছিল শকুন্তলা একাই কানপুরে নেমে যাবে কিন্তু রঞ্জিত কাপুরও নেমে গেল।
সুব্রত প্রস্তুত হয়েই ছিল। ওরা গাড়ি থেকে নামার কিছু পরেই সুব্রতও সুটকেসটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
কিরীটী একাই গাড়ির কামরায়—আর কোন যাত্রী ছিল না।
ট্রেন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ কিরীটী চলন্ত গাড়ির জানালা-পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে-তারপর সকালে এলাহবাদে স্টেশনে কেনা সংবাদপত্রটা টেনে নেয় আবার নতুন করে চোখ বুলাবার জন্য।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা ওল্টাতেই হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের হয়ে পড়লো। একটু। কৌতূহলের বশেই ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ধরতেই কিরীটী যেন একটা চমক অনুভব করে।
ভাঁজ করা কাগজ মাত্র নয়, একটা চিঠি।
সংক্ষিপ্ত ইংরাজীতে লেখা। বেশ পরিষ্কার করে গোটা গোটা ইংরাজীতে লেখা। লেখাগুলো সামান্য যেন কেঁপে কেঁপে গিয়েছে।
মিঃ রায়,
যারা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তারা যেমন আলেয়ার পিছনে ছুটছেন— আপনাকেও ঠিক তেমনি ছুটে মরতে হবে। আপনার ক্ষমতা আছে আমরা জানি, কিন্তু পেনিট্রেশন করার চেষ্টা করলে বিপদকেই ডেকে আনা হবে জানবেন। আর তাছাড়া যে কাজের জন্য আপনি যাচ্ছেন সেটা এখন সকলেরই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।
–এক্স
কিরীটী বার দু-তিন আগাগোড়া চিঠিটা পড়লো।
হাতের লেখা থেকে ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না—হাতের লেখাটা মেয়ের না পুরুষের; খানিকটা মেয়েলী ধাঁচের লেখা বটে আবার পুরোপুরি মেয়েলীও নয়—পুরুষের হাতের লেখা হওয়াও আশ্চর্য নয়।
বেশ তাড়াতাড়ি লেখা হয়েছে।
কিন্তু লেখাটা কখন কাগজের মধ্যে এলো?
চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল কিরীটী।
এখন আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সত্যিই খুব সহজ নয়। দপ্তর থেকে যে গোপনীয় দলিলটা চুরি গিয়েছে সেটার মূল্য বা গুরুত্ব সম্পর্কে এখনো বিশেষ কিছু জানে না কিরীটী। তবে দলিলটার যে বিশেষ একটা মূল্য আছে সেটা সে বুঝেছিল, নচেৎ অন্তত সে-ব্যাপারে দিল্লীতে তার ডাক পড়তো না এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরও অতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো না।
বিশেষ কোন আলোচনারই সুযোগ পায়নি গতবারে কিরীটী।
এবং এটাও সে বুঝতে পারছে, দলিলটা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে সরকার-পক্ষ যে তার সাহায্যের জন্য তাকে আহ্বান জানিয়েছেন সেটা অন্তত প্রতিপক্ষের অজানা নেই আর।
অতএব তাকে এবার খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হবে।
সকালের দিকে কিরীটী দিল্লী স্টেশনে অবতরণ করল।
তাকে নিয়ে যাবার জন্য হয়ত গাড়ি এবং তোক এসেছিল, কিন্তু কিরীটী সে সম্পর্কে কোন খোঁজখবরই নিল না—স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, সোজা রায়সিনহা রোডে যেতে।
মনে মনে স্থির করেছিল সে, সোজা গিয়ে আপাতত তার বন্ধু দেবেশের ওখানেই উঠবে।
তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
০৪. কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল
কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল দেবেশ তখনো অফিসে বের হয়নি। নিজের বাংলোতে তার অফিস-ঘরে বসে কাজ করছিল।
গেটের ভিতর দিয়ে ট্যাক্সি ঢোকার শব্দে দেবেশ বের হয়ে আসে।
কিরীটীকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে দেবেশ রীতিমত বিস্মিতই হয়।
কিরীটী তুই!
আমি এলাম বেড়াতে, কটা দিনের জন্য। চল্ ভিতরে যাওয়া যাক।
বলতে বলতে দুজন এসে দেবেশের অফিস-ঘরে ঢুকল।
তারপর কি ব্যাপার? এই শীতের সময় হঠাৎ রাজধানীতে!
চেয়ারে বসতে বসতে কিরীটী বললে, কেন, শীতের সময় তোদের রাজধানীতে আসা বারণ নাকি
তা নয়—তবে—
কি?
সত্যি বল্ তো ব্যাপারটা কি? তুই সত্যি সত্যি বেড়াতে এসেছিস?
বিশ্বাস করতে পারছিস না?
ঠিক তাই।
এসেছি কেন নিশ্চয়ই তুই জানবি তার আগে একটু চায়ের ব্যবস্থা কর—তোর গিন্নী কোথায়?
সে তো এখানে নেই।
নেই!
না, মাসখানেকের জন্য কলকাতা গিয়েছে। বলতে বলতে দেবেশ কলিংবেল বাজাল। বেয়ারা রামলাল এসে ঘরে ঢুকল।
রামলাল!
জী সাব—
চা নিয়ে আয়—
রামলাল চলে গেল।
দু-একদিন থাকবি, না আজই চলে যাবি? দেবেশ শুধায়।
দিন দশ-বারো হয়ত থাকবে।
সঙ্গে মালপত্র কিছু নেই?
একটা সুটকেস আর একটা হোলডল।
একটু পরে রামলাল চা নিয়ে এলো।
দুই বন্ধুতে চা-পান করতে করতে আবার কথা কয়। এবং তখুনি কিরীটী সংক্ষেপে তার দিল্লী আগমনের কারণটা দেবেশকে খুলে বলে।
কিন্তু ব্যাপারটা টপ সিক্রেট
ভয় নেই তোর, এখান থেকে তোর সিক্রেট বের হবে না। হাসতে হাসতে দেবেশ। বললে।
জানি। শোন্ তোকে একটা কাজ করতে হবে।
কি বল্?
প্রতাপ সিংকে তুই জানিস নিশ্চয়ই!
একজন প্রতাপ সিংকে জানি, প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারী–কিন্তু কেন বল্ তো? লোকটা কিন্তু বিশেষ সুবিধার নয়।
আর কোন প্রতাপ সিং কেউ কোন দপ্তরে সেক্রেটারী আছে নাকি!
আর একজন সিং আছে তবে সে প্রতাপ সিং নয়।
প্রতাপ সিং রামস্বামীর সেক্রেটারী তো?