এখন কেবল বিসর্পিল ইস্পাতের লাইনগুলো ইয়ার্ডের উজ্জ্বল আলোয় চিক চিক করছে—এক-আধটা ট্রেন এদিক ওদিক যাতায়াত করছে—চাকার শব্দ-ইঞ্জিনের শব্দ।
দূরে দূরে ইয়ার্ডের লাইটগুলো আলো ছড়াচ্ছে।
ওরা আবার একসময় করিডোর দিয়ে নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হলো। দরজাটা টেনে দিয়ে গিয়েছিল সুব্রত; এখন দেখলে দরজাটা খোলা আর নীচের একটা বার্থে বসে আছে দুজন।
অতি আধুনিকা একটি তরুণী। রূপ যত না থাক, রূপের জৌলুসকে বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রসাধন ও পোশাকের পারিপাট্যটা সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
পরনে দামী সিল্কের শাড়ি-ডিম মেরুন কালারের অনুরূপ জামা গায়ে-বগল পর্যন্ত কাটা হাতা। হাতে ছগাছি করে সোনার চুড়ি আর রিস্টওয়াচ। বয়স তিরিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। কপালে একটা সিঁদুরের বা কুমকুমের টিপ থাকলেও সিঁথিতে এয়োতির কোন চিহ্ন নেই অথচ দেখলে বাঙালি বলে মনে হয়। হাতে ধরা একটা ইংরাজী ফিল্ম ম্যাগাজিনে দৃষ্টিপাতে নিবদ্ধ। পাশে একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে আছে। ম্যানিকিওর করা আঙুলের দীর্ঘ নখগুলো। পাশে সামান্য ব্যবধানে বসে যে ভদ্রলোকটি পরনে তার দামী গরম স্যুট। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। বেশ হৃষ্টপুষ্ট লম্বা চেহারা। চোখে চশমা।
মুখটা গোলগাল। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যেই বলে মনে হয়। পায়ের নীচে গোটা-দুই সুটকেস। একটা বড় ফ্লাস্ক ও ছোট একটা বাস্কেট।
ওদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে মহিলাটি তাকালেনও না কিন্তু পাশের ভদ্রলোকটি চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালেন এবং হিন্দিতেই বললেন, আপলোগ এহি কামরামে যা রহে হেঁ?
সুব্রত বললে, জী!
আমার নাম রঞ্জিৎ কাপুর-কানপুর যাচ্ছি—আপনারা কতদূর? পুনরায় প্রশ্ন করলো।
কিরীটী এবারেও কোন কথা বললে না—পাশে একটা বই ছিল, সেটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণ।
সুব্রতই আবার বললে, জী দিল্লী
রঞ্জিৎ কাপুর আবার বললেন, আমার কানপুরে ট্যানারীর বিজনেস আছে— আপনারা দিল্লীতে কি বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি?
সুব্রত বললে, হ্যাঁ।
রঞ্জিৎ কাপুর বললেন, কিন্তু এখন তো ওদিকে ভীষণ ঠাণ্ডা।
তা তো হবেই–
তা দিল্লীই যাবেন–না আরো দূরে?
দেখি—এখনো কিছু ঠিক নেই। বেড়াতে বের হয়েছি।
আর উনি? কিরীটীর দিকে ইঙ্গিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন রঞ্জিৎ কাপুর।
উনিও আমার সঙ্গে চলেছেন।
পার্শ্বে উপবিষ্টা মহিলা কিন্তু একবারও তাকালেন না ওদের দিকে। আপনমনে বই পড়েই চলেছেন, যেন ওদের কথাবার্তা তার কানে প্রবেশই করছে না।
সুব্রতই আবার জিজ্ঞাসা করে, উনি?
উনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন না—তবে আমার পরমাত্মীয়া অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বহিন।
কিরীটী ঐ সময় সুব্রতর আলাপে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে ডাকল, এই সু—
কি রে?
একটু চলে আয় না। এই যে—
সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে উপরের বাঙ্ক থেকে বাস্কেটটা নামিয়ে তার থেকে দুটো গ্লাস, সোডার বোতল ও ওল্ড স্মাগলারের শিশিটা বের করল।
দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সোডা মিশিয়ে একটা গ্লাস কিরীটীকে দিল, অন্যটা নিজে নিল। তারপর হঠাৎ কি ভেবে কাপুরের দিকে তাকিয়ে বললে, মিঃ কাপুর–লাইক টু হ্যাভ সাম ড্রিঙ্ক!
অফ কোর্স।
সুব্রত আর একটা গ্লাস বের করছিল কিন্তু মিঃ কাপুর নিজেই তার বাস্কেটটা টেনে খুলে একটা গ্লাস ও ভ্যাট ৬৯-এর বোতল বের করলেন, তারপর গ্লাসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিলেন।
সুব্রত কাপুরের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে গ্লাসটা কাপুরের দিকে তুলে শুধালে, দিস্ মাচ!
ইয়েস।
হাউ মাচ সোডা?
একটু বেশী দেবেন।
সুব্রত গ্লাসে সোডা মিশিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে কাপুরের দিকে।
০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন
কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন, তারপর নিজে একটা সিগারেট নিয়ে কেসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরলেন, সিগ্রেট–
নো, থ্যাংকস।
হোয়াট অ্যাবাউট ইউ? কাপুর কেসটা এবারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরলেন।
নো, থ্যাংকস।
আপনার চলে না?
চলে, তবে সিগার—বলে কিরীটী পকেট থেকে একটা চামড়ার সিগার কেস বের করে তা থেকে একটা সিগার নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে উদ্যত হলো। তখন সে তার গ্লাসে ওষ্ঠ স্পর্শ করেনি।
ভদ্রমহিলা কিন্তু একই ভাবে তার হাতের ম্যাগাজিনটা পড়ে চলেছিলেন। এতক্ষণ ওদের দিকে তাকানওনি।
হঠাৎ কিরীটী ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, আমরা আপনার কোন অসুবিধা করছি না তো?
ভদ্রমহিলা চোখ তুললেন—চোখে-মুখে একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন। না, না–ক্যারি অন!
পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরাজী ও বাংলা উচ্চারণ।
বাংলা শুনেই কিরীটীর মনে হলো ভদ্রমহিলা বাঙালী।
তাছাড়া ওসবে আমি খুবই অভ্যস্ত—আবার হাসলেন ভদ্রমহিলা।
হঠাৎ সুব্রতর কি হলো, বললে, কিন্তু কেমন যেন বিশ্রী লাগছে–
না, না তাতে কি হয়েছে? আপনাদের কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই—আমাদের ঐ কাপুর সাহেবটির জন্য আমরা ও-ব্যাপারে রীতিমত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি—স্মিতকণ্ঠে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা; কিন্তু চোখে-মুখে তার সেই চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছিল।
ইয়েস—শকুন্তলা ইজ কোয়ায়েট হ্যাভিচুয়েটেড! কোন উন্নাসিকতা নেই-হাজার হলেও এ যুগের তরুণী তো। হাসতে হাসতে বললেন মিঃ কাপুর।
একটু কটাক্ষ হেনে শকুন্তলা বললেন, এ যুগের তরুণীদের যেন একেবারে সব আদিঅন্ত জেনে ফেলেছেন মশাই