অন্ধকারে কে যেন পায়ের নূপুর রুণু-ঝুনু বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে।
অদৃশ্য অশরীরী কোন মায়াবিনী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে নূপুরসংকেতে সম্মুখের ঐ নিচ্ছিদ্র রহস্যময় অন্ধকার থেকে।
নিজের অজ্ঞাতেই সত্যজিৎ সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এ কি সত্যি কোন মায়াবিনীর মায়া, না তারই শোনবার ভুল!
সবিতার চোখেও ঘুম আসছিল না। চোখ দুটো যেন জ্বালা করছে।
সবিতা তার শিয়রের কাছের জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল, হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিল জানালার কবাট দুটো।
অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল অন্ধকার আকাশের দিকে।
দীর্ঘ ছমাস পরে সে বাড়িতে এল অথচ যার স্নেহসিক্ত মধুর ডাকটি শোনবার জন্যে তার বিদেশে সমস্ত অন্তর তৃষিত হয়ে থাকে সেই স্নেহময় পিতা আজ তার কোথায়?
আর কেউ আদর করে ডাকবে না সাবি মা আমার। বিদেশ যাত্রাকালে আর কেউ তার মাথায় হাতটি রেখে স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বলবে না, গিয়েই কিন্তু চিঠি দিস মা। ভুলিস না যেন তোর বুড়ো বাপ আবার ছুটি হলে একদিন তুই ফিরে আসবি সেই দিনটির আশায় দিন গুনছে এখানে বসে একলাটি।
ওর নাকি যখন চার বছর বয়স তখন মা মারা যান।
ভাল করে সঠিকভাবে জানে না বটে তবে কানাঘুষোয় শুনেছিল একদিন ওর মার মৃত্যুর সঙ্গেও যেন কি একটা রহস্য জড়িয়ে আছে।
অবশ্য সে সম্পর্কে কোন দিনই তার মনে কখনো অকারণ কৌতূহল দেখা দেয়নি।
বাবাও তার মার সম্পর্কে কখনো কোন কথা বলেননি এবং তারও কোন দিন বাবাকে মার কথা জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি।
সাত বছর বয়সের সময় ও দেশ ছেড়ে কলকাতার বোর্ডিংয়ে গিয়ে থেকে পড়াশনা শুরু করেছে।
আজ পনের বৎসর সে কলকাতাতেই আছে। কেবল বৎসরে দুবার ছুটিতে মাসখানেকের জন্য এখানে এসে থেকে গিয়েছে, তাও প্রতি ছুটিতেই যে এসেছে তা নয়।
মধ্যে মধ্যে ছুটিতে এদিক-ওদিক বেড়াতেও গিয়েছে। দুখানা ঘরের পরের ঘরটাতেই বাবা শতেন।
কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ ওকে যেন সেই ঘরটার দিকেই টানতে থাকে।
নিজের ঘর থেকে বের হয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে চলল সবিতা সেই ঘরটার দিকে।
ঘরের দরজা ভেজানোই ছিল। বাঁ হাতে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল।
ঘরটা আজ শূন্য। কিন্তু ঘরের মধ্যে বাবার ব্যবহৃত প্রত্যেকটি জিনিস যেখানকারটি যেমন তেমনই আছে।
একধারে ঘরের প্রকাণ্ড সেই কারুকার্যমণ্ডিত মেহগনি কাঠের পালঙ্কের উপর এখনও তেমনি শয্যাটি বিস্তৃত।
মাথার ধারে চৌকির উপরে দেওয়ালে সেই লোহার সিন্দুকটি তেমনই আছে বসানো।
শয্যার ঠিক শিয়রে মাথার উপরে দেওয়ালে টাঙানো মায়ের এনলার্জড তৈলচিত্রটি। ঘরের দক্ষিণ কোণে আয়নাবসানো কাঠের আলমারিটা। তারই পাশে কাপড়ের আলনা।
আলনায় এখনো বাবার ব্যবহৃত ধুতি, চাদর ও জামা রাখা রয়েছে।
পূর্ব কোণে লিখবার টেবিলটি ও বসবার চেয়ারটি। এবং তারই পাশে বেতের আরাম কেদারাটা ও তার পাশে বাবার নিত্যব্যবহার্য গড়গড়াটা।
অনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীনভবে ঘরের এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ সবিতার নজরে পড়ল, তার ও বাবার ফটোটা দেওয়ালে পাশাপাশি টাঙানো।
হাতের মোমবাতিটা উঁচু করে তুলে ধরে মোমবাতির আলোয় বাবার ফটোটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সবিতা।
চিরদিনের বাবার সেই সুন্দর হাসিটি ওষ্ঠপ্রান্তে যেন সজীব বলেই ছবির মধ্যেও মনে হয় এখনো।
সহসা চোখের কোল দুটি জলে ছলছল করে ওঠে।
বাবা! সত্যি কি তুমি আর নেই! আর কি সত্যিই এ জীবনে কোন দিনও তোমার ডাক শুনতে পাব না!
কোথায় গেলে তুমি এমনি করে আমায় না জানিয়ে?
সত্যিই কি কেউ তোমাকে হত্যা করল?
বলে দাও বাবা! তাই যদি হয়, আমি তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেব।
প্রতিজ্ঞা করছি আমি, যে তোমাকে হত্যা করেছে কোনোমতেই তাকে আমি নিষ্কৃতি দেব না।
প্রতিশোধ আমি নেব! নেব! নেব!
সত্যজিৎ হাতের টর্চের বোতামটা টিপে আলোটা জ্বালল। সম্মুখের অন্ধকারে হস্তধৃত টর্চের আলোর রশ্মিটা ছড়িয়ে গেল। একটা অপ্রশস্ত সরু গলিপথ সম্মুখে। সত্যজিৎ হাতের টর্চের আলো ফেলে ফেলে দেখল পথটা বেশ লম্বা। এগিয়ে গেল সত্যজিৎ আলো ফেলতে ফেলতে সেই অপ্রশস্ত গলিপথে।
আশ্চর্য! চারিদিকেই ঘেরা দেওয়াল পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে, কোথাও কোন নির্গমনের পথই নেই।
অন্ধ গলিপথ।
তার ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেউ যে এই গলির মধ্যে এসে অন্য কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাবে তারও কোন রাস্তা নেই। তবে?
সবই কি তাহলে তার ভ্রম!
কেউ তার ঘরে যায়নি বা কেউ নূপুর পায়ে হেঁটে যায়নি!
কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যজিৎ কোনোমতেই যেন বুঝে উঠতে পারে না, যদি এই গলিপথ দিয়ে অন্য কোথাও নিষ্ক্রমণের কোনও রাস্তা নাই থাকে তবে ঐ গোপন সিঁড়ি-পথ ও এই গলি-পথের তাৎপর্য কি?
অনাবশ্যক নিশ্চয়ই এ গলির পথ তৈরী করা হয়নি।
নিশ্চয়ই এই গলি-পথ থেকে অন্য কোন ঘরে বা বাইরে যাবার কোন পথ বা দ্বার আছে যেটা নজরে পড়ছে না।
কোন গুপ্ত-পথ বা গুপ্ত-দ্বার!
সত্যজিৎ আবার আলো ফেলে ফেলে চারিদিককার দেওয়ালে অনুসন্ধান করতে লাগল।
দেওয়ালের গায়ে ঠুকে ঠুকে দেখতে লাগল।
কিন্তু আশ্চর্য! কোন কিছুরই হদিস ও পেল না। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পূর্বশ্রুত সেই নূপুরের শব্দও আর কই ও শুনতে পেল না।
কতকটা যেন বিফলমনোরথ হয়েই সত্যজিৎ তার ঘরে আবার ফিরে এল এবং সিঁড়িপথের সঙ্গে সংযুক্ত দরজা বন্ধ করে দিল শিকল তুলে।
০৪. পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল
পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায় সবিতার ডাকে।