সৌদামিনী আবার বলে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে হতেই প্রায় চৌধুরী মশাই আমাকে বলতেন হেম নাকি প্রত্যহ রাত্রে তাঁকে ডাকে। তার পায়ের নূপুরে তিনি স্পষ্ট শুনেছেন। হেম নূপুর পরতে খুব ভালবাসত।
তাহলেই দেখুন, অনুমান আমার মিথ্যা নয়। এবারে আসা যাক আসল পরিকল্পনাকারীর রহস্যে। নিত্যানন্দ সান্যাল সমস্ত ঘটনাটির তিনিই ছিলেন মূল। প্রথমে তিনি কাঞ্চনমালার ব্যাপার নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করেছেন, পরে নিজেকে হেমপ্রভার প্রেমিক প্রতিপন্ন করে সন্দিগ্ধ চৌধুরীর মনে সংশয় এনে দিয়ে further blackmail করেছেন। শেষ পর্যন্ত যখন চৌধুরী মশাই সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌচেছেন, তখন তিনিই সূরযমল প্রভৃতিকে এখানে আনিয়ে চেৎ সিংকে চৌধুরীর সংবাদ দিয়ে তার নৃশংস প্রতিশোধস্পৃহার অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে তাকে দিয়েই হত্যা করিয়েছেন চৌধুরীকে। উনি যখন বুঝেছিলেন, লেবু তেতো হয়ে গিয়েছে টিপতে টিপতে, গাই আর দুধ দেবে না, তখন ওদের দিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে সমস্ত সম্পত্তিটা বাগাবার চেষ্টায় ছিলেন। প্রত্যক্ষ না থেকে পরোক্ষে বসে কলকাঠি ঘুরিয়েছেন। আর ঐ হতভাগ্য ধনঞ্জয়—আমাদের সন্তোষবাবু, সৌদামিনী দেবীর বখে যাওয়া-পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয় এখানে এসেছিল সম্পত্তির লোভে। কিন্তু সন্তোষবাবু তো আজ দুবছর মৃত, তবে পরিকল্পনাটি উনি পেলেন কোথায়? সন্তোষের সংবাদ জানলেনই বা কেমন করে? বলুন ধনঞ্জয়বাবু, অন্যথায় আপনি কিন্তু প্রতারণার চার্জে পড়বেন।
সন্তোষ নিত্যানন্দের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেচিয়ে উঠলো, ঐ—ঐ নিত্যানন্দই প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে এখানে এনেছে। আমার-আমার কোন দোষ নেই। আমি কিছু জানি না।
কিরীটী মৃদু হাসে, চমৎকার! একেবারে আটঘাট বেধেই নেমেছিলেন সান্যাল মশাই। এবং এত করেও শেষ বজায় রাখতে পারলেন না। ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে। Really I pity you!
উঃ, কি শয়তান উনি! আপনি জানেন না মিঃ রায়, ওঁর আরো কীর্তি আছে। সত্যজিৎ বলে।
কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে জবাব দেয়, জানি। শেষ পর্যন্ত মেয়ে কল্যাণীকে আপনার পিছনে লাগিয়েছিলেন, force করে আপনার ও সবিতা দেবীর মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে, তাই না?
কিন্তু আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
জানাটাই যে আমার কাজ সত্যজিৎবাবু! কিরীটী জবাব দেয়। কল্যাণীর মাথাটা লজ্জায় নুয়ে আসে।
লক্ষ্মীকান্তবাবু, আমার যা বলবার ছিল বললাম। কেবল একটা কথা বসন্তবাবুকে জিজ্ঞাস্য আছে—সেই শীলমোহর করা লোফাপাটা, আয়রণ সেফে যেটা ছিল, কিরীটী বসন্তবাবুর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, আমিই সেটা সরিয়ে ফেলেছিলাম, সবিতার নামে লেখা আছে দেখে এবং কৌতূহলের বশে খুলে পড়তে গিয়েই চৌধুরীর অতীত জীবনের ইতিহাস আমি সব জানতে পারি। আমার ইচ্ছা ছিল না সবিতা আর ওসব জানতে পারে, তাই আমি আপনাকে ফিরে যেতে বলেছিলাম। সবিতাকেও নিবৃত্ত হতে বলেছিলাম। শেষকালে যখন বুঝলাম, আমরা কত অসহায় নিয়তির হাতে তখনই বাধ্য হয়ে লক্ষ্মীকান্তর হাতে না ধরা দিয়ে উজ্জয়িনীতে ছুটেছিলাম ব্যাপারটার শেষ জানতে, কিন্তু গিয়ে তাদের সন্ধান পেলাম না। তখনও বুঝিনি সান্যাল মশাই এমন জঘন্য খেলায় নেমেছেন।
সে চিঠি কোথায় কাকা? সবিতা প্রশ্ন করে।
সে চিঠি ছিড়ে আমি বৌরাণীর বিলেই ভাসিয়ে দিয়েছি। বাপ যত অপরাধীই হোন না কেন, তাঁর পদস্খলনের কথা সন্তানের শোনা বা জানাও মহাপাপ মা। ভুলে যাও সে কথা। বসন্ত সেন বললেন।
তাহলে এবারে আমার উইলটা পড়তে আর আপত্তি নেই, বলে অতীনলাল খাম ছিড়ে উইল পাঠ করলেন। নতুন উইলে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সন্তোষ মৃত জেনে সমান তিন অংশে ভাগ করে দিয়েছেন তাঁর তিন পুত্র-কন্যাদের মধ্যে। সবিতা, চন্দ্রলেখা ও ধনঞ্জয় সম্পত্তির সকলেই সমান অংশীদার।
সবিতা সকলের নিকট হইতে দূরে এসে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। পূব আকাশকে রাঙা করে সূর্যোদয় হচ্ছে। দিগন্তপ্রসারী বৌরাণী বিলের জলে কে যেন মুঠো মুঠো রাঙা আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। চৌধুরীবংশের সমস্ত পাপ স্খলিত করে সর্বপাপঘ্ন দিবাকর যেন উদয়াচল থেকে শান্তির মন্ত্র আকাশে মাটিতে জলে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন দিক হতে দিগন্তে।
সবিতার দু চোখের কোলে জল।
মৃত পিতাকে স্মরণ করে দুটি হাত একত্র করে সে প্রণাম জানায়, তার পিতার আত্মা যেন শান্তি পায়। হে সর্বপাপঘ্ন সবিতা—সবিতাকেও ক্ষমা করো।