সৌদামিনী চুপ করে রইলেন।
কিরীটী আবার তার বক্তব্য শুরু করে, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুরহস্যটা আমার কাছে খোলসা হয়ে যায়, যে রাত্রে সৌদামিনী দেবী এখান হতে চলে যান সেই রাত্রে ওঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আলোচনা করবার পরই। এবং যে মুহূর্তে বুঝলাম হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর সাক্ষাৎ কোন যোগাযোগ নেই, পরোক্ষে থাকলেও তখনই ভাবতে লাগলাম এতকাল পরে তাহলে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হলেন কেন? এইখানে একটা ব্যাপার প্রথমটায় সত্যিই আমাকে বিশেষভাবে delimma-র মধ্যে ফেলেছিল—অকুস্থানটি। একই স্থানে বকুলবৃক্ষতলে দুটি মৃতদেহ কেন আবিষ্কৃত হল! পরে অনেক ভেবে দেখেছি এবং সৌদামিনী দেবীর মুখে একটা কথা শুনে বুঝেছি, তাঁরও সম্ভবত, মানে হেমপ্রভা দেবীর বকুলতলে আত্মহত্যা করবার দুটি কারণ ছিল। ১নং সৌদামিনী দেবী বলেছিলেন প্রমোদভবনে আসা অবধি তো বটেই, তারও পূর্বে দুএকবার হেমপ্রভা দেবী নাকি প্রমোদভবনে বেড়াতে এসেও ঐ বৃক্ষতলটিতে গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। স্থানটি নাকি তাঁর বড় প্রিয় ছিল, শুনেছি বৌরাণীর বিল বলা হত ঐ বিলটিকে—এই চৌধুরী বংশেরই নাকি কোন বৌরাণীর ইচ্ছাতেই বিলের মধ্যে ঐ বিরাম-কুটিরটি তৈরী হয়েছিল বলে এবং পরে ঐ বিলের জলে সেই বৌরাণী সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে যান আর ওঠেন না। সেই হতেই বিলটিকে লোকে বৌরাণীর বিল নাকি বলত। এবং সেই হতেই চৌধুরীবংশে একটা প্রবাদের মতই শেষে দাঁড়িয়েছিল ঐ বিল এ বাড়ির বৌদের পক্ষে নাকি অভিশপ্ত। যাক যা বলছিলাম, ২নং কারণ হয়ত হেমপ্রভা দেবীর ইচ্ছা ছিল ঐখানে গিয়েই আত্মহত্যা করবার, নিজের মৃতদেহটা যাতে আদরিণী একমাত্র কন্যার চোখে না পড়ে। অবশ্য সবই আমার অনুমান। সে যাই হোক, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু রহস্যটা মীমাংসিত হবার পরই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুরহস্যে আমি মন দিই। একটা ব্যাপার অবশ্য—গোড়া হতেই সব ইতিহাস শুনে বুঝেছিলাম, চৌধুরী মশাইয়ের নিহত হবার পশ্চাতে কোন একটা পারিবারিক জটিল কাহিনী আছে এবং আর অকুস্থান যে রাজপুতানায়—তাও বুঝতে পারি, তাঁর ড্রয়ার হতে যে অ্যালবামটি উদ্ধার করি তারই ফটোগুলো দেখে। সেই ফটোগুলোর মধ্যে একটা ফটো ছিল এক নবযৌবনা অপরুপ সৌন্দর্যময়ী এক নারীর। বুঝলাম মিঃ চৌধুরীর জীবনের কয়েকটি ছিন্ন পৃষ্ঠা সুদূর ঐ রাজপুতানাতেই ছড়িয়ে রয়েছে যার সাক্ষ্য দিচ্ছে আজও তাঁরই সযত্নরক্ষিত অ্যালবামটি। কিন্তু কে ঐ তরুণী? কেন তার ফটো অ্যালবামের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত? তার পরই কুড়িয়ে পেলাম নন্দনকাননে একটি স্বর্ণঅঙ্গুরীয়। যার উপরে খোদাই করা ছিল একটি দেবনাগরী অক্ষর ল। কার অঙ্গুরীয়? অঙ্গরীয়টি দেখেই বুঝেছিলাম সদ্য না হলেও দুদশ দিনের মধ্যে কোন এক সময় কারো হাত হতে ঐ অঙ্গুরীয়টি ওখানে খসে পড়েছে। আর একটা জিনিস ঐ জায়গায় জলের ধার ঘেষে পাড়ে ঘাসের অবস্থা দেখে বুঝেছিলাম নিয়মিত কিছুদিন ধরে ওখানে নৌকা বা বোট জাতীয় কিছু এসে ভিড়বার জন্যেই ঘাসগুলো যেন নিস্তেজ হয়ে আছে। বুঝলাম এখানে বোটে চেপে কারো যাতায়াত ছিল। তারও প্রমাণ পেলাম বিরাম-কুটিরের ঘরে ধুলোর ওপরে জুতোর সোলের ও খালি পায়ের ছাপ দেখে। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল মন। খোঁজ নিতে গিয়ে সরমল সিং ও তার নাতনী চন্দ্র লেখার সন্ধান পেলাম। সরমলের সঙ্গে সামান্য আলাপ করতেই বুঝলাম তারা রাজপুত। এবং চন্দ্রলেখার মুখের আদলটি হবহু, একেবারে মিলে গেল অ্যালবামের ফটোর সেই রাজপুতানী মেয়েটির মুখের সঙ্গে। ছিন্নসূত্র জোড়া লাগল।
হ্যাঁ, ঐ চন্দ্রলেখাই চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে কাঞ্চনমালার বা লছমীর (কাঞ্চনের ডাকনাম) গর্ভজাত কন্যা এবং সবিতার চাইতে বছরখানেকের বড়। সূরযমল লক্ষণের ছোট ভাই লছমীর কাকা। জবাব দিল সৌদামিনী।
তাহলে ওই আংটিটা বোধ হয় চন্দ্রার মায়েরই! কিরীটী বলে।
লক্ষ্মীকান্ত তখন হঠাৎ বলেন, কিন্তু ক্রেপসোল দেওয়া কোন জুতো সেখানে পাইনি মিঃ রায়!
প্রমোদভবনের আস্তাবল খুজলেই পাবেন। সেটা লছমনের সম্পত্তি।
লছমনের?
হ্যাঁ, কারণ সে-ই যে সেটা ব্যবহার করতো! জবাব দেয় কিরীটী। কিন্তু
ভয় নেই। মোক্ষম বন্ধনে বাঁধা রয়েছেন শ্রীমান। পালাবার উপায় নেই।
মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়, এ বাড়ির নূপুর-রহস্যের মেঘনাদ ঐ লছমনই। আসলে লছমন ওর ছদ্মনাম মাত্র।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে কিরীটীর দিকে তাকায়।
বসন্ত সেন বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? লছমন যে অনেক দিনকার পুরাতন সহিস এ বাড়ির!
সে পুরাতন সহিস আসল লছমন এতদিন বন্দী হয়ে বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিকের বাড়িতে সুরযলের হেপাজতে ছিল। তাই না মিঃ সাহা?
হ্যাঁ, তাকে মুক্তি দিয়ে থানায় রেখে এসেছি। জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত।
বৃদ্ধ লছমনকে গায়েব করে তার ছম্মবেশ ধারণ করে চেৎ সিং, একদা যে প্রথম যৌবনে কাঞ্চনমালার পাণিপ্রার্থী ছিলেন। তাঁর এখানে এসে সকলের চোখে ধুলো দিতে কষ্ট হয়নি। প্রথমে নানারূপ ভয় দেখিয়ে নুপুরের শব্দ শুনিয়ে চৌধুরী মশাইকে চেৎ সিং সন্দিগ্ধ করে তোলে। এবং খুব সম্ভবত হয়ত কৌতুহলী হয়ে অদৃশ্য নূপুরের শব্দ অনুসরণ করতে করতে কোন এক রাত্রে ঘটনাচকে যখন হতভাগ্য চৌধুরী মশাই নন্দনকানন পর্যন্ত চলে যান, সেই সময় সুযোগ পেয়ে চেৎ সিং তাকে আক্রমণ করে কৌশলে অজ্ঞান করে, পরে গলা টিপে হত্যা করে। ঐ কারণেই হয়ত চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহ বকুলবৃক্ষতলে পাওয়া যায়। সব ব্যাপারটাই আকস্মিক এবং নিষ্ঠুর নিয়তি চালিত।