তারপর?
তারপর তোমার দাদা নিত্যানন্দ উজ্জয়িনীতে গিয়েছিল বেড়াতে। কেমন করে জানি না কাঞ্চনের বাপ লক্ষণ সিংয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং বোধ হয় সে সব কথা জানতে পারে এবং বুঝতে পারে আমিই সেই।
কেমন করে বুঝতে পারলেন তিনি?
কাঞ্চনের কাছে আমার একটা ফটো ছিল সেই ফটোটা দেখে। ফটোটাই এখন তার সম্পত্তি এবং তারই জোরে গত কয়েক মাস ধরে সে আমাকে শোষণ করছে। মাথা নীচু করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
দাদার এতদূর অধঃপতন হয়েছে।
মাঝে মাঝে ভাবি কি জান সৌদামিনী, কলঙ্কসাগরে তো ডুবেছিই। কাঞ্চনের মেয়ে সে তো আমারই, তাকে এখানে নিয়ে আসি।
আপনি কি পাগল হলেন? ও চিন্তাও মনে স্থান দেবেন না। একবারটি ভাবুন তো, এ সংবাদ হেম জানতে পারলে সে কত বড় দুঃখ পাবে? কিন্তু আমার একটা কথা শুনবেন?
বল? দাদাকে এখানে একবার আসতে লিখুন, আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।
তাতে কি কোন ফল হবে সৌদামিনী, বরং টাকা যেমন সে নিচ্ছে নিক। এতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে তো
সন্তুষ্ট! জানেন না চৌধুরী মশাই, লোভ বেড়েই চলে ক্রমে, ওর হাঁ সামলাতে আপনাকে সর্বস্বান্ত হতে হবে। তার চাইতে লিখে দিন দাদাকে এখানে আসতে।
বেশ।
মাসখানেক বাদে নিত্যানন্দ এলেন। সৌদামিনী ভুল করেছিল। নিজের মায়ের পেটের ভাই হলেও নিতানন্দ-চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারেনি। যাবার আগে বরং সে শাসিয়েই গেল উল্টে সৌদামিনীকে।
নিত্যানন্দ চলে গেল বটে, তবে মনে মনে যাবার আগে সে নতুন এক ফন্দী মাথায় নিয়ে ফিরে গেল এবং তারপর দেখা গেল, ঘন ঘন সে কাঞ্চনপুরে যাতায়াত শুরু করেছে। হেমপ্রভার প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসা যেন উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন।
বৎসর দুই এইভাবে নিয়মিত মৃত্যুঞ্জয়ের ওখানে আসা-যাওয়া করে করে এবারে সে আর এক মর্মঘাতী তীর নিক্ষেপ করল মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে।
দুর্বলচিত্ত সন্দিগ্ধ-চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় সহজেই সেই নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে কাবু হয়ে পড়লেন, হেমপ্রভা মধ্যে মধ্যে একমাত্র নিত্যানন্দকেই পত্র দিত। হঠাৎ একবার দুদিনের জন্য এসে নিত্যানন্দ হেমপ্রভা ও তার শিশুকন্যাকে সঙ্গে করে লুধিয়ানায় নিয়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের অবর্তমানেই। সেই সময় কিছুদিন ধরে হেমপ্রভার সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের মন-কষাকষিটা একটু বেশীই চলছিল। বাড়ী ফিরে মৃত্যুঞ্জয় হেমপ্রভাকে না দেখতে পেয়ে মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। স্ত্রীকে চিঠিও দিলেন না। হেমপ্রভাও অভিমানভরে একখানি চিঠিও স্বামীকে লিখল না। সৌদামিনী এসবের কিছুই জানত না। দীর্ঘ ছয় মাস পরে হেমপ্রভা আবার ফিরে এল স্বামীর গৃহে এবং শরীর তার তখন খুবই খারাপ। মনে যার ঘুণ ধরে, দেহ তার ভাঙ্গতে দেরি হয় না। হেমপ্রভারও হয়েছিল তাই। হেমপ্রভা ফিরবার দিন পাঁচেক বাদেই মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রমোদভবনে উঠে এলেন এবং ওখানে আসবার দিন চারেক বাদে এক রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড বচসা হয়ে গেল। নিত্যানন্দকে নিয়ে হেমপ্রভার চরিত্রে সন্দেহ করে স্পষ্টাস্পষ্টিই মৃত্যুঞ্জয় অভিযোগ জানালেন এবং বললেন, নিত্যানন্দ নিজে নাকি চিঠিতে অনেক দিন আগেই তাকে ও সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল। ঘৃণায় লজ্জায় হেমপ্রভা একেবারে পাথর হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা! এর চেয়ে যে মৃত্যুও ছিল ভাল।
এবারে কিরীটী বললে, এবং সেই দুঃখ ও অপমানেই তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন নিশ্চয়ই! কেউ তাঁকে হত্যা করেনি!
সৌদামিনী বললে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
আপনার বর্ণিত কাহিনী প্রথমে সত্যজিৎবাবুর ও পরে আপনার মুখে শুনেই বুঝেছিলাম, আসল ও সত্যি কথাটা আপনি গোপন করেছেন। আপনার বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে অনেকটা ফাঁক ছিল। তাছাড়া যে মুহর্তে বুঝেছিলাম দীর্ঘ উনিশ বৎসরের ব্যবধানে দুটো মৃত্যুর কারণ এক নয় এবং শেষেরটা যখন অবিসংবাদিত ভাবেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল সত্য বলে, তখনই বুঝেছিলাম আগের ব্যাপারটা আত্মহত্যা ভিন্ন আর কিছুই হতে পারে না। অবশ্য এরূপ ভাববার আমার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত হেমপ্রভা দেবীকে একমাত্র হত্যা করা সম্ভব ছিল তাঁর স্বামীর পক্ষেই, কিন্তু তা তিনি যে করেননি সেটা বুঝেছিলাম সাত দিন বাদে কলকাতা হতে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারেই। তিনি প্রথম হতেই সন্দেহ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী গৃহত্যাগ করেছে এবং গেছে নিত্যানন্দবাবুর ওখানেই। তাই তিনি অসুস্থা স্ত্রীর একটা কল্পিত চিকিৎসার ভান করে মেয়ে ও আপনাকে নিয়ে কলকাতায় যান, কিন্তু আসলে কলকাতা থেকে নিত্যানন্দবাবুর ওখানে গিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল—
ঠিক তাই। চৌধুরীমশাই লুধিয়ানাতেই দাদার ওখানে হেমের খোঁজে গিয়েছিলেন। জবাব দেয় সৌদামিনী।
কিন্তু সেখানে স্ত্রীর খোঁজ না পেয়ে গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে জন্মের মত ত্যাগ করবেন এই মনস্থ করে ও নিজের বংশমর্যাদা ও সম্মান বাঁচাতে রটনা করে দিলেন তার মৃত্যুর কথা। ফিরে এলেন তিনি এখানে। কিন্তু চরম দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি তিনি যতই সন্দিহান হন আসলে হয়তো স্ত্রীকে সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই স্ত্রীকে অমন করে চলে যেতে দেখে মর্মান্তিক যাতনায় ছটফট করে বেরিয়েছিলেন, এমন সময় মতো স্ত্রীর দেহ আবিষ্কৃত হল নন্দনকাননে। তার পরের ব্যাপারটাও স্বাভাবিক গতিই নিয়েছে। এ ছাড়া হেমপ্রভা যে নিহত হয়নি কারো দ্বারা সন্দেহ করেছিলাম দ্বিতীয় অন্য একটি কারণে হেমপ্রভা দেবীকে যদি তাঁর স্বামী না হত্যা করে থাকেন আর কারো পক্ষে যেমন তাঁকে হত্যা করবার কোন কারণই থাকতে পারে না, তেমনি নিহত হলে অন্তত কানাইয়ের মা অর্থাৎ আপনি সর্বদা যখন তাঁর পাশের ঘরে শুতেন ও সর্বদা প্রাণ দিয়ে তাঁর দেখাশুনা করতেন, আপনি নিশ্চয় সেটা জানতে পারতেন। আপনার কাছে সে ধরা পড়তই এবং সেক্ষেত্রে অন্তত আপনি এতদিন পরে বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর পরে আর সে কথা গোপন করে রাখতেন না।