হেমের স্বামী মৃত্যুঞ্জয় বিবাহের পর একটা বছর ঘন ঘন আমাদের ওখানে আসত। প্রথম প্রথম মৃত্যুঞ্জয়কে এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদের ওপরে একাকী দাঁড়িয়ে আছি, সহসা কার পদশব্দে ফিরে তাকালাম। যাকে দেখলে আমার এত ভয়, যার চোখের দিকে তাকাতে বুকে কেঁপে ওঠে, নিজেকে যেন আর কোনমতেই ধরে রাখতে পারি না—সেই মৃত্যুঞ্জয়! আমার দেবতা! আমার সব!
***
ভয় পেলে সৌদামিনী?
না, সৌদামিনীর বুক তখন কাঁপছে দুরু দুরু। তুমি আমাকে এড়িয়ে চল কেন মিনি? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? কেন তুমি আমায় ভয় কর বল তো?
কই, না তো! ভয় করি কে বললে? মনে মনে বলে সে, ওগো দেবতা, আমার ভয় নয় গো, ভয় নয়—আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই।
চাও তো দেখি আমার চোখের দিকে? কই, চাও? সহসা হাত বাড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয় সৌদামিনীর একটা হাত ধরে ফেলেন।
না, ছাড় কেউ এসে যাবে এখুনি লক্ষীটি!
এত ভয় তোমার সৌদামিনী?
না না! ছিঃ!
সমস্ত যৌবন সৌদামিনীর তৃষিত হয়ে উঠেছিল কিন্তু সে তৃষ্ণা তার মিটল না। বরং দিনকে দিন যে বেড়েই চলে। শেষ পর্যন্ত যেদিন তার খেয়াল হল, সারা দেহ ছাপিয়ে এসেছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব সেদিন ভয়ে সে নীল হয়ে গেল।
নীলকণ্ঠ সারা বিশ্বের গরল ধারণ করে যেখানে কলকল্লোলকান্তি জাহ্নবীবেষ্টিত হয়ে অন্নপূর্ণার দুয়ারে ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়েছেন, সৌদামিনী সেখানে ছুটে এলো তার কলঙ্কিত দেহের যৌবনমথিত গরলটুকু নিয়ে; সেই গরলে নীলকণ্ঠ দেবাদিদেবের চরণেরই আশ্রয়ে।
ধনঞ্জয় সেখানেই জন্ম নিল এক সেবাশ্রমে।
সৌদামিনী যেদিন সেবাশ্রম হতে দুই মাসের শিশুপুত্রকে বুকে করে ফিরে এলো, নিত্যানন্দ তখন দুয়ার রোধ করে দাঁড়ালেন, যাও, এখানে নয়।
কলঙ্কিনী! লজ্জা করে না তোর! দূর হ!
কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? অনন্যোপায় সৌদামিনী আবার কাশীতেই ফিরে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে এক পত্র দিল।
মৃত্যুঞ্জয় পত্র পেয়ে কাশীতে এলেন এবং বললেন, এখানে এভাবে তোমার সন্তানকে তুমি, মানুষ করতে পারবে না মিনি। তার চাইতে ওকে কোন অনাথ আশ্রমে দাও, আমি সব ব্যয়ভার বহন করবো, আর তুমি আমার ওখানেই চলো।
কি জানি কেন, সৌদামিনী তাতেই রাজী হলো। ধনঞ্জয়কে এক আশ্রমে রেখে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের গৃহেই এসে উঠলো।
কিন্তু পরিচয় দিল তার সৌদামিনী নয়-দাসী কানাইয়ের মা বলে।
কানাইয়ের মা পরিচয়েই সৌদামিনি চৌধুরী-গৃহে থেকে গেল। সৌদামিনী মরেছে।
হেমপ্রভার ব্যাপারটা আদৌ মনঃপুত না হলেও, মুখে সে কিছু বললে না বটে তবে দুঃখ পেল স্বামীর ব্যবহারে।
সৌদামিনীর মাতৃত্বের সংবাদ না পেলেও সৌদামিনীর সম্পর্কে তার স্বামীর দুর্বলতার কথাটা তার অবিদিত ছিল না।
কিন্তু ক্রমে সৌদামিনীকে হেমপ্রভার সহ্য হয়ে গিয়েছিল, যখন সে দেখলে সৌদামিনী তার গৃহে এলেও সত্যি-সত্যিই দাসীর মতই সে দিন কাটাচ্ছে। সে তার অধিকারের সীমাকে কোন অজুহাতেই লঙ্ঘন করে না বা করবার চেষ্টাও করে না। সবিতা এলো হেমপ্রভার গর্ভে এবং ঐ সময় হতেই হেমপ্রভা স্বামীর ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগল। স্বামী যেন তার সদাই গম্ভীর, চিন্তাকুল।
আরো দেখলে, প্রতি মাসে স্বামী তার দাদা নিত্যানন্দকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ইনসিওর করে পাঠায়।
একদিন প্রশ্ন না করে আর পারে না, কিন্তু স্বামীর কাছে কোন জবাবই পায় না।
কথাটা একদিন সৌদামিনীর কাছে কিন্তু প্রকাশ হয়ে গেল।
সৌদামিনী ঐ বাড়িতে থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর কোন ব্যাপারেই থাকত না।
কিন্তু হেমের মুখের দিকে চেয়েই একদিন রাত্রে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে এসে প্রবেশ করল, ওখানে আসবার দীর্ঘ আট মাস পরে।
দীর্ঘদিন পরে সৌদামিনীকে নিজের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করেন, সৌদামিনী, তাহলে তুমি আজও বেঁচে আছো?
সৌদামিনী তো অনেকদিন আগেই মরে গেছে চৌধুরী মশাই-এ কানাইয়ের মা সৌদামিনীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে, যে পাপ সে তার নিজের কাছে করেছিল। কিন্তু সে কথা যাক, আমি একটা কথা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম চৌধুরী মশাই!
বল?
প্রতি মাসে আপনি লুধিয়ানায় দাদাকে টাকা পাঠান, এ কথা কি সত্য?
সৌদামিনীর প্রশ্নে মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ সত্য। কিন্তু একান্তই শুনতে চাও কি কেন?
হ্যাঁ বলুন।
হেমও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে অনেকবার, কিন্তু বলতে পারিনি। দুঃখের ও লজ্জারই কথা, তোমাকে বলছি তবু হেমকে বলতে পারিনি, এবং কেন পারিনি হেম না বুঝতে পারলেও তুমি বুঝবে। হেমকে বিবাহ করবার মাস আষ্টেক আগে একবার দেশভ্রমণে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে উজ্জয়িনীতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চৌহান রাজপুতের মেয়ে কাঞ্চনমালার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করি।
চৌধুরী মশাই! একটা আর্ত চীৎকার যেন সৌদামিনীর কণ্ঠ চিরে বের হয়ে আসে।
ভাবছো আমি মহাপাষণ্ড, না! তাই। আমারও পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়েছে। মুক্তি পাইনি। কিন্তু যা শুনতে চাইছিলে শোন। বিবাহের পর মাস তিনেক কেটে গেল, ভাবছি বাবাকে সব লিখে জানাব এবং বৌকে নিয়ে দেশে আসব, এমন সময় কাঞ্চনের এক বন্ধু ছিল রাজপুত যুবক চেৎ সিৎ, তারই সঙ্গে একদিন রাত্রে বাগানে কাঞ্চনকে দেখে হিংসায় বুক আমার জ্বলে গেল। ওদের উপর নজর রাখতে লাগলাম। বুঝলাম কাঞ্চন চেং সিং কে ভালবাসে। মাঝখানে আমি এসে না পড়লে ওদের বিবাহও হত একদিন। হিংসায় ক্রোধে অন্ধ হয়ে কাঞ্চনকে ফেলে এক রাত্রে চুপে চুপে পালিয়ে এলাম। ওরা আমার ঠিকানাও জানত না। পরে ফিরে এসে মাস আষ্টেক বাদে হেমকে বিবাহ করি। ওদের আর খোঁজ নিইনি। মাস পাঁচেক পূর্বে তোমার দাদা নিত্যানন্দর চিঠিতে জানতে পারি, যখন চলে আসি কাঞ্চন তখন নাকি অন্তঃসত্বা ছিল। এবং একটি মেয়ের জন্মদান করেই সে মারা গিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় চুপ করলেন।