হঠাৎ সে সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সত্যজিৎবাবু আপনার কি সত্যি-সত্যিই মনে হয় এ বাড়িতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যেই কেউ
কথাটা যেন কেন সবিতা শেষ করতে পারে না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে।
চারিদিক ভেবে দেখতে গেলে ওদের কাউকেই তো আমরা সন্দেহের তালিকা থেকে বর্তমানে বাদ দিতে পারছি না সবিতা দেবী! কথাটা আপনিই চিন্তা করে দেখুন না!
কিন্তু
অবশ্য এও ঠিক যে, এ কথা ধরে নিচ্ছি বলেই যে তাঁদের মধ্যেই কেউ একজন এক্ষেত্রে হত্যাকারী সুনিশ্চিতভাবে তাও তো নয়। কিন্তু যাক সে কথা, এদিকে রাত অনেক হল। আজকের মত আপনি বিশ্রাম নিন গিয়ে। কাল এদিককার কাজ মিটে গেলে আমি এখানকার থানার দারোগার সঙ্গে একটিবার দেখা করব। তাঁর কাছে হয়ত আরো অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব সবিতা দেবী
কিন্তু তিনি যদি আপনাকে সাহায্য না করেন?
সেও আমি ভেবে দেখেছি; পুলিসের লোকদের আমি জানি তো। পথ আমাদেরও আছে সেক্ষেত্রে—
কি? সবিতা তাকায় সত্যজিতের মুখের দিকে।
কলকাতার সি. ডির সুব্রত রায়কে আমার এক বন্ধু চেনে। শুধু চেনে নয়, সুব্রতবাবু তার বিশেষ বন্ধুও বটে। কাল সকালেই তাঁকে সব কথা জানিয়ে চিঠি দিতে আমি চাই। অবিশ্যি এতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে—
আপত্তি! কেন আপত্তি থাকবে? নিশ্চয়ই তাঁকে আপনি চিঠি লিখবেন।
বেশ, তবে সেই কথাই রইল।
এরপর পরস্পর পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে সত্যজিৎ সবিতার কক্ষ হতে বের হয়ে এল।
রাত্রি প্রায় দেড়টা। সত্যজিতের চোখে ঘুম আসছিল না।
ঘরের মধ্যে গরমও খুব বেশী। দরজা খুলে ঘরের সংলগ্ন ছাতে এসে দাঁড়াল সত্যজিৎ। সন্ধ্যার কালবৈশাখীর ছায়ামাত্রও আর এখন আকাশের কোথাও অবশিষ্ট নেই। তৃতীয়ার ক্ষীণ চাঁদও আকাশে অস্তমিতপ্রায়। রাত্রির কালো আকাশটা তারায় যেন ছেয়ে আছে। ছাতটা বেশ ঠাণ্ডা। অস্তমিতপ্রায় চাঁদের ক্ষীণ আলো সমস্ত প্রকৃত জুড়ে যেন পাতলা একটা পর্দার মত থিরথির করে কাঁপছে।
ছাতের চারিপাশে প্রায় বুক-সমান উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের গা ঘেষে দাঁড়াল সত্যজিৎ। প্রমোদভবনের তিন দিক বৌরাণীর বিল বেষ্টন করে রেখেছে। খুব প্রশস্ত বিল, এপার-ওপার নজর চলে না।
স্তিমিত চন্দ্রালোকে বিলের কালো জলে যেন অদ্ভুত একটা চাপা রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে। বিলের এপারে ঝাউগাছের সারি। ঝাউয়ের সরু চিকন পাতাগুলো হাওয়ায় দলে দলে যেন একটা চাপা কান্না কাঁদছে।
জনমানবের বসতি থেকে অনেক দূরে নির্জন এই বৌরাণীর বিলের ধারে এই জমিদারের কোন পূর্বপুরুষ যিনি এই প্রমোদভবন তৈরী করেছিলেন, কালের অদৃশ্য কালো হাত তাঁকে নিশ্চিহ্নভাবে গ্রাস করতে পারেনি—অতীতের সাক্ষী হয়ে আজও সে দাঁড়িয়ে আছে।
কত রজনীর প্রমোদ-বিলাসের কত কাহিনী না জানি এই প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে অশ্রুত আনন্দ বেদনায় গমরে উঠেছে।
যারা একদা এই ভবনের কক্ষে কক্ষে বিলাস আনন্দ করে গিয়েছে তারা কি এখানকার স্মৃতি ভুলতে পেরেছে? অদেহী অশীরীর দল আজও হয়ত প্রতি রাত্রে এখানে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় পাশাপাশি হাত-ধরাধরি করে।
আসর জমায়। কান্না-হাসির দোল দোলানো অতীত স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো উল্টে যায় হয়ত।
কালো আকাশের বুকে চাঁদ হারিয়ে গিয়েছে।
সত্যজিৎ কক্ষের দিকে এগিয়ে চলল। ঘরের ভেজানো দরজাটার সামনে এসে কিন্তু সত্যজিৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল! ঘরের মধ্যে স্পষ্ট পদশব্দ।
সত্যজিৎ কান পেতে শোনবার চেষ্টা করে।
শুধু পদশব্দ কি! সেই সঙ্গে যেন আসছে একটা মিষ্টি নূপুরের আওয়াজ।
অত্যন্ত মৃদু পদবিক্ষেপে কে যেন হাঁটছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ রুণু-ঝুনু রুণু-ঝুনু। ধীরে অতি সন্তর্পণে দরজার কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক করতেই সঙ্গে সঙ্গে যেন পদশব্দ ও নূপুরের ধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে গেল, হারিয়ে গেল মুহর্তে।
ঘরের আলোটা কমানোই ছিল। অদ্ভুত একটা আলো-আঁধারিতে ঘরটা রহস্যময়।
কিন্তু কোথায় কে! ঘর শূন্য, কেউ নেই।
ভারী আশ্চর্য তো! সত্যজিৎ যেন বেশ বিস্মিতই হয়। ঘরের ওপাশের অন্য দরজাটা হা হা করছে খোলা।
বিস্মিত সত্যজিৎ খোলা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল, সামনেই একটা ছোট অলিন্দ মত, তারপরই নেমে গেছে অন্ধকার সিঁড়ি নিচের দিকে।
কোথায় গিয়েছে এই সিঁড়ি?
কোন ঘন অন্ধকারের রহস্যের মধ্যে এই সিঁড়িপথ গিয়ে মিশেছে কে জানে?
একটু পূর্বে এই ঘরের মধ্যে যে পদশব্দ, যে নূপুরের ধ্বনি শোনা গিয়েছিল সেই কি এই সিঁড়ি-পথ দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল?
সত্যজিৎ মুহূর্তের জন্য সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবল, তারপর ঘরের মধ্যে আবার প্রবেশ করে সুটকেস থেকে টর্চটা নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে দাঁড়াল সিঁড়ির মাথায়।
প্রথম সিঁড়ির উপর পা দিতেই সত্যজিৎ তার সমস্ত শরীরে যেন একটা অহেতুক শিহরণ অনুভব করে।
কে যেন তার কানে কানে অশ্রুত সাবধান-বাণী উচ্চারণ করে : কোথায় চলেছ সত্যজিৎ?
নাগিনীর মায়ায় ভুলো না।
নাগিনী!
তা হোক, তবু সত্যজিৎ এগিয়ে যাবে।
সত্যজিৎ এগিয়ে চলল।
ধাপের পর ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে সত্যজিৎ নেমে চলল।
সিঁড়ির প্রায় শেষ ধাপে এসে পৌচেছে, সহসা আবার কানে এসে বাজল যেন সেই মিষ্টি নূপুরের ধ্বনি।