বিস্মিত নির্বাক কিরীটী কানাইয়ের মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ তার পূর্ব-পরিচিতা এ বাড়ির পুরাতন দাসী কানাইয়ের মা নয় যেন। ভীরু সঙ্কোচে দৈন্যবিলুণ্ঠিতা কানাইয়ের মাও নয়।
দাঁড়াবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত যেন পাল্টে গিয়েছে। মাথার উপরে অবগুণ্ঠন স্খলিত। মাথার সম্মুখের দিকে কাঁচা-পাকায় মিশানো চুলগুলো। ছোট ললাট। ধোপদুরস্ত একটা সাদা থানকাপড় পরিহিতা। গায়ে একটা সাদা খদ্দরের মোটা চাদর।
ওর সর্বাঙ্গ দিয়ে, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীতে পর্যন্ত যেন একটা আভিজাত্য ফুটে বের হচ্ছে।
সেই চিরপরিচিত কানাইয়ের মা যেন দাসীর পদ হতে অভিজাত বংশের এক নারী-পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছে হঠাৎ। গৌতম-অভিশাপে পাষাণী অহল্যা যেন অকস্মাৎ রাঘবের রতুল চরণস্পর্শে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।
আর কেন, এবার ক্ষান্ত হও দাদা। মাথার উপরে ভগবান আছেন, এত পাপ তিনি সহ্য করবেন না। অবিচলিত শান্ত কণ্ঠ হতে কানাইয়ের মার কথাগলো বজ্রের মতই উচ্চারিত হল।
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ কানাইয়ের মার নিত্যানন্দ সান্যালকে সম্বোধিত কথাগুলো উচ্চারিত হল।
নিত্যানন্দ সান্যালের সমস্ত মুখে যেন কে একপোঁচ কালি বুলিয়ে দিয়েছে। কালো মুখখানা থমথম করছে একটা হিংস্র উত্তেজনায়।
কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিলেন নিত্যানন্দ সান্যাল নিজেকে, কানাইয়ের মা! অনেক দিনের চাকরানী তুই আমাদের বাড়ির। বালবিধবা হেম তোকে বড় স্নেহ করত। হেম আমাকে দাদা বলে ডাকত, তুইও তার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দাদা বলে ডাকতিস। দাসী হলেও তোকে আমি চিরদিন ছোট বোনের মতই দেখেছি। বুঝতে পারছি, কোন কারণে তুই মনে বড় ব্যথা পেয়েছিস। তাই বোধ হয় মাথারও ঠিক নেই তোর। চল, পাশের ঘরে চল, বুঝতে পারছি তোর বিশ্রামের প্রয়োজন—আর, বলে নিজেই সান্যাল ঘর ছেড়ে যাবার জন্য পা বাড়ান।
কানাইয়ের মা কোন কথা বলার পূর্বেই কিরীটী গমনোদ্যত নিত্যানন্দ সান্যালকে বাধা দিল, দাঁড়ান সান্যাল মশাই! ঘর ছেড়ে যাবেননা!
নিঃশব্দে ফিরে দাঁড়ালেন সান্যাল এবং চোখ তুলে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীও তাকিয়ে আছে সান্যালের মুখের দিকে।
যুধ্যমান দুটো শাণিত তরবারি যেন পরস্পরের প্রতি উদ্যত।
সহসা কানাইয়ের মার কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, মাথা আমার ঠিকই আছে দাদা। দেখছি গোলযোগ ঘটেছে আপনারই, নইলে মায়ের পেটের বোনকে চিনতে পারছেন না।
তবে রে হারামজাদী ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই যেন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে কানাইয়ের মার কণ্ঠদেশ টিপে ধরলেন সান্যাল।
মুখোশটা খুলে গেল সান্যালের।
ঘটনাটা এত দ্রুত ও আকস্মিক ভাবে ঘটে গেল যে, ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে পড়ে।
নিষ্ঠুর পেষণে কানাইয়ের মার গলা দিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ কেবল বের হচ্ছে।
তোকে খুনেই করে ফেলবো হারামজাদী, গর্জাতে থাকে ক্রোধান্ধ সান্যাল, আর পেষণ আরো কঠিন করেন হাতের মুষ্টির।
কিরীটী সর্বাগ্রে এগিয়ে বলিষ্ঠ দুই বাহুতে সান্যালের কাঁধ টিপে ধরে প্রবল এক ঝাঁকুনি দেয়, ছাড়ন, ছাড়ুন!
কিন্তু মরীয়া হয়ে উঠেছেন সান্যাল। চীৎকার করে ওঠেন, না না—খুনখুন করবো ওকে আমি। বাধ্য হয়ে কিরীটী তখন যুযুৎসর প্যাঁচে সান্যালের কঠিন মুস্টি শিথিল করে কানাইয়ের মাকে মুক্তি দেয়।
কানাইয়ের মা ঢলে পড়ে যাচ্ছিল, সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলে। এলিয়ে পড়ে কানাইয়ের মা চেয়ারটার উপরেই।
বাইরে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। সকলেই সোৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় খোলা দরজার দিকে। ঘরে প্রবেশ করলেন নায়েব বসন্ত সেন।
হ্যাঁ, আমি। কিন্তু এসব কি ব্যাপার লক্ষ্মীকান্ত?
জবাব দিল কিরীটী, আসুন নায়েব মশাই। আজকের ঘটনার you were the missing link,হারানো সূত্র!
কিরীটী তখনও নিত্যানন্দ সান্যালকে দুই হাতে ধরে আছে। নিত্যানন্দকে অতঃপর অন্য একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, সুবোধ বালকের মত এবারে বসুন তো সান্যাল মশাই! Dont try to play any more dirty tricks! আপনার খেলা শেষ হয়েছে।
চোখের জলের মধ্যে দিয়েই কানাইয়ের মা—হতভাগিনী সৌদামিনী তার জীবনের কলঙ্ক-মাখা ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো একের পর এক মেলে ধরতে লাগল।
নির্বাক সকলে বসে ঘরের মধ্যে। কিরীটী, সত্যজিৎ, নিত্যানন্দ সান্যাল, সন্তোষ চৌধুরী, বসন্ত সেন, কল্যাণী, সবিতা, সৌদামিনী দেবী, লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও অতীনলাল।
রাত শেষ হয়েছে। ভোরের প্রথম আলো পূর্বাকাশ রাঙিয়ে তুলছে।
.
সৌদামিনীর কথা
হতভাগিনী কলঙ্কিনী সৌদামিনীর কথা কি আর নতুন করে শুনবেন কিরীটীবাবু! বাংলাদেশের ঘরে ঘরেই তো এমনি কত ইতিহাস আছে, কিন্তু কজনা তার খোঁজ রাখে! তিলতিল করে কত হতভাগিনীর জীবন-প্রদীপ যে নিভে যায়—তুষানলে ধিকিধিকি জলে নিঃশেষ হয়ে যায় কত সৌদামিনী, সে সংবাদই বা কজনে এ সংসারে পায়!
তের বৎসর বয়সের সময় বিবাহ হল আমার। স্বামী কেমন চিনলামই না। খেলাঘরের মতই স্বামীর ঘর আমার নিষ্ঠুর পদাঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে গেল। হাতের নোয়া, সিথির সিদূর মুছে এক বৎসরের মধ্যেই ফিরে এলাম বাপের ঘরে; রাক্ষসী পোড়াকপালী আমি।
হেম আমার তিন বৎসরের ছোট হলেও আমার খেলার সাথী সে ছিল। সে-ই ছিল আমার সঙ্গী। ফিরে এসে আবার হেমের সঙ্গেই খেলাঘর পাতলাম। তিনটি বছর কেটে গেল, হঠাৎ একদিন শিউরে উঠলাম নিজের দিকেই তাকিয়ে। দেহের দুকূল ভেঙে নেমেছে কখন জোয়ারের জলোচ্ছাস। টেরও পায়নি। অসংবৃত দেহকে যেন কোনমতেই আর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে পারি না। এমন সময় হেমের হল বিয়ে।