কিরীটী মুহূর্তের জন্য যেন বিহবল হয়ে পড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই অন্ধকারে আন্দাজ করে সম্মুখের দিকে লাফিয়ে পড়ে।
অন্ধকারেও কিরীটীর লক্ষ্য ব্যর্থ হয় না। লোকটাকে জাপটে ধরে।
জড়াজড়ি করেই কিরীটী লোকটাকে নিয়ে মেঝেতে পড়েই চেচিয়ে ওঠে, সত্যজিৎবাবু, টর্চটা জালান!
হতভম্ব সত্যজিৎ বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে।
কিরীটীর আদেশে যেন সব্বিৎ ফিরে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কোমরে ঝোলানো টর্চটার বোতাম টিপে আলো জলে।
কিরীটীর বুঝতে বিলম্ব হয় না, যাকে আক্রমণ করেছে তার গায়ে শক্তি প্রচুর। যত করে মাটিতে চেপে ধরে তার বুকের ওপর উঠে বসবার চেষ্টা করে কিরীটী, কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে না প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী বলে।
সহসা সত্যজিতের নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটা মোটা মত হাত দেড়েক কাঠের টুকরো। এগিয়ে গিয়ে কাঠটা তুলে নিয়ে সত্যজিৎ
সুযোগ বুঝে লোকটার মাথায় একটা সজোর আঘাত হানে।
একটা অস্পষ্ট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে এবারে প্রতিপক্ষ এলিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে। হাত-পা এলিয়ে দেয়।
বুঝতে পারে কিরীটী, মাথায় আঘাত পেয়ে ক্ষণেকের জন্য সংজ্ঞালোপ হয়েছে প্রতিপক্ষের।
ঘরের কোণ হতে একটা মোটা দড়ি এনে অতঃপর ভূতলশায়ী সংজ্ঞাহীন লোকটার হাত বেধে তাকে বন্দী করতে ওদের বেগ পেতে হয় না।
প্রতিপক্ষকে বন্দী করে কিরীটী যখন উঠে দাঁড়াল, গুরু পরিশ্রমে তখন সে হাঁপাচ্ছে।
কে লোকটা!
রহস্যের মেঘনাদ—মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাকারী ক্লিষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয় কিরীটী সত্যজিতের প্রশ্নের।
সত্যজিৎ বলে, সত্যি?
হ্যাঁ।
কৌতুহলভরে সত্যজিৎ এগিয়ে গিয়ে বন্দী সংজ্ঞাহীন ভূপতিত ব্যক্তির মুখ হতে কালো রুমালটা খুলে নিয়ে যেন ভূত দেখবার মত চমকে উঠে, এ কি,
এ যে সহিস লছমন!
হ্যাঁ, লছমনই বটে। তবে আসলে ও লছমন নামধারী মাত্র–ছদ্মনাম ওর ওটা।
ছদ্মনাম?
হ্যাঁ। কিন্তু লোকটাকে তো মনে হতো বড়ো অকর্মণ্য!
সে-ও ওর ভেক ধারণ করা মাত্র। দেখতেই তো পেলেন ওর শক্তির বহর। কিন্তু এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক। বাগানে দলবল নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত অপেক্ষা করছেন। এ নাটকের শেষ দৃশ্যের এখনও বাকী।
কিরীটী ও সত্যজিৎ বাগান অতিক্রম করে বারান্দার দিকেই অগ্রসর হতেই অন্ধকার হতে লক্ষ্মীকান্ত সামনে এসে দাঁড়ালেন, কিরীটীবাবু?
মিঃ সাহা! কি ব্যাপার?
চুপ, আস্তে, কানাইয়ের মা
কানাইয়ের মা! এসেছে তাহলে? কিন্তু কোথায়?
সন্তোষ চৌধুরীর ঘরে ঢুকেছে।
২৩. ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে
ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
দরজার ফাঁক দিয়ে ওরা দেখলো ঘরের মধ্যে সন্তোষ চৌধুরী ও কানাইয়ের মা।
তুই আবার ফিরে এলি কেন? রুক্ষ সন্তোষের কণ্ঠস্বর।
তুই বলেছিলি আসবি—আসিসনি বলে—চল, এবার তোকে সঙ্গে করে নিয়ে তবে আমি যাব।
আমার যাবার এখনও সময় হয়নি, তুই যা।
না, তোকে না নিয়ে যাবো না।
যা বলছি হারামজাদী! এখনো ফিরে যা, নইলে তোকে খুন করবো বলছি!
তাই কর, তাই কর। তবু, সবুর অমঙ্গল আমি করতে দেব না।
রাক্ষসী শয়তানী! সবু তোর কে যে তার জন্যই তুই হেদিয়ে মরছিস?
তোর সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। তুই যাবি কিনা বল?
না-না-না। তুই যা।
তুই তাহলে যাবি না? কানাইয়ের মা দৃঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করে
না।
যাবি না?
না।
এক্ষনি তবে আমি চেচিয়ে সকলকে ডেকে তোর আসল পরিচয় দেবো!
খুন-খুন করে ফেলবো তবে তোকে রাক্ষসী। হিংস্র রাগে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি সন্তোষ কানাইয়ের মার গলা টিপে ধরে।
সেই মুহূর্তেই কিরীটীর ইঙ্গিতে লক্ষ্মীকান্ত দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেচিয়ে ওঠেন, দরজা খোল! দরজা খোল!
কিন্তু ভিতর হতে কোন সাড়া নেই।
দরজা খোল! না হলে দরজা ভেঙে ঢুকবো!
তথাপি কোন সাড়া নেই।
ভাঙুন দরজা। কিরীটীই বলে।
তিনজনে মিলে একত্রে ধাক্কা দিতেই ভিতর হতে মড়াৎ করে দরজার খিল ভেঙে গেল। তিনজনেই হড়মড় করে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
সন্তোষবাবু, you are under arrest! লক্ষ্মীকান্ত গর্জন করে ওঠেন।
হতচকিত বিহ্বল সন্তোষ ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই আবক্ষ অবগুণ্ঠন টেনে নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।
কি, ব্যাপার কি! কি ব্যাপার? খোলা দ্বারপথে ঠিক ঐ সময় সান্যালের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
এই যে সান্যাল মশাই! আসুন আসুন—ঠিক সময়েই আপনি এসেছেন। সহসা অত্যন্ত উচ্ছসিত কণ্ঠে যেন সাদর আহ্বান জানাল কিরীটী দ্বারপ্রান্তে উপনীত নিত্যানন্দ সান্যালকে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই চমকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে। এবং সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ-চমকের মতই অবগুণ্ঠনবতী কানাইয়ের মা তার দীর্ঘ অবগুণ্ঠন সহসা মাথার উপরে তুলে দিয়ে তাকাল সান্যালের মুখের দিকে।
এ কি, সেই কানাইয়ের মা না? আকস্মিক উত্তেজনায় অসতর্ক কণ্ঠ হতে নিত্যানন্দের উচ্চারিত হলো কথাগুলো।
হ্যাঁ, আমি। ফিরে আসতে হলো আমাকে।
ব্যাপারটা যেন আদৌ কিছুই নয় এমনি একটা উদাসীন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিত্যানন্দ বললেন, হঠাৎ তুই কাউকে না বলে চলেই বা গেলি কেন, আবার ফিরেই বা এলি কেন? এদিকে তোর জন্য সকলে আমরা ভেবে মরি!
কানাইয়ের মা নিত্যানন্দ সান্যালের কথার কোন জবাব দিল না, কেবল তার ওষ্ঠপ্রাতে অদ্ভুত হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠলো মাত্র।