একটা চাপা পদশব্দ অন্ধকারে যেন মর্মরিত হয়ে উঠলো। কিরীটী প্রস্তুতই ছিল সত্যজিৎকে নিয়ে। চকিতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যেও অন্ধকার। আলোটা আগেই নিবিয়ে রাখা হয়েছে।
পা টিপে টিপে কিরীটী এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে কিরীটী বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দার দিকে দৃষ্টিপাত করল।
শুনতে সে ভুল করে নি।
কালো আংরাখায় আবৃত সেই দীর্ঘ মূর্তি, মুখের নিম্নাংশে কালো একটা রুমাল বাঁধা। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের দিকেই।
কিরীটী আর মুহূর্তও বিলম্ব করে না। ক্ষিপ্র ত্বরিৎপদে ছাদের দরজা দিয়ে বের হয়ে ছাদ দিয়েই সবিতার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। সবিতার ঘর ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে যেমন সে হাতের টর্চের আলো ফেলেছে ঘরের মধ্যে এবং চাপা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছে, হাত তোল বন্ধু your game is up. আংরাখা-আবৃত মূর্তি শয্যাটার উপরে সবে ঘুমন্ত সবিতার উপরে দুই হাত প্রসারিত করে ঝুঁকেছিল, চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একলাফে দক্ষিণ দিকে সরে গেল এবং বিদ্যুৎগতিতেই যেন পরমুহূর্তে আর এক লাফে ছাদের দরজা দিয়ে বাইরে অদৃশ্য হলো।
কিরীটী ও সত্যজিৎও লাফ দিয়ে মূর্তিকে অনুসরণ করে ছাদের দরজার দিকে ছুটে যায়। ছাদে এসে কিরীটী দেখলে মূর্তি ছাদের প্রাচীরের উপরে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং চক্ষের পলকে নীচে লাফিয়ে পড়ল।
দুজনেই ছুটে প্রাচীরের কাছে এল এবং প্রাচীরের উপরে উঠে নীচে ঝুঁকে দেখতে পেল, আবছা ছায়ার মত মূর্তিটা তখন নন্দনকাননের পথ ধরে ছুটছে।
কিরীটী ও সত্যজিৎ কালবিলম্ব না করে পর পর দুজনেই নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আশ্চর্য, পায়ে তাদের এতটুকু লাগলো না, যেখানে তারা লাফিয়ে পড়েছে সেখানকার মাটি ঝরঝরে নরম ধুলোর মত।
এ ব্যবস্থা তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে পূর্বাহ্নেই করা ছিল।
কিরীটী আগে আগে এবং পশ্চাতে ছুটলো সত্যজিৎ নন্দনকাননের দিকে। হঠাৎ মনে হলো যেন ঝপ করে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বার অস্পষ্ট একটা শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা কিরীটীর সতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়াল না।
কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল। পশ্চাতে সত্যজিৎও।
কেউ যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো বলে মনে হল না? সত্যজিৎই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। কিন্তু চুপ! আস্তে! কিরীটী সত্যজিৎকে সতর্ক করে দেয় চাপা কণ্ঠে, চেয়ে দেখুন ঐ
সত্যি! সত্যজিৎ কিরীটীর চাপাকণ্ঠের সতর্ক নির্দেশে সামনের অন্ধকারে জলের দিকে তাকিয়ে দেখল, নিঃশব্দ সাঁতারে কেউ একটা কালো সর্পিল রেখার মত এগিয়ে চলেছে প্রমোদভবনের প্রাচীরের দিকে।
ওদিকে যাচ্ছে যে নিশ্চয়ই ওদিকে কোন গুপ্ত দ্বারপথ আছে—wait and see!
অনুমান মিথ্যা নয়। দেখা গেল কে একজন প্রাচীর ঘেষে উঠে দাঁড়িয়েছে অন্ধকারেই ছায়ার মত জল থেকে।
পরমুহর্তেই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল যেন প্রাচীরের মধ্যে আশ্চর্য মন্ত্রবলে!
Now quick, follow me! বলেই কিরীটী জলে নামল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে দুজনে সাঁতরিয়ে প্রাচীরের সামনে এসে পৌঁছল। এবং ঐখানে জলের গভীরতা বুঝবার জন্য নিচে পা দিতেই জলের নিচে মাটি পায়ে অনুভব করে। এক কোমরও জল নয় ওখানে।
সামনেই একটা ছোট দ্বারপথ-কপাটটা এখনও উন্মুক্ত আছে।
সিক্ত অবস্থাতেই আগে আগে কিরীটী ও পশ্চাতে সত্যজিৎ সেই ছোট দ্বারপথ দিয়ে নিচু হয়ে কতকটা হামাগুড়ি দেবার মত করেই ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলে সরু একটি অপ্রশস্ত গলিপথ সামনে—অন্ধকার।
বদ্ধ বায়ুর ভ্যাপসা গরমে গলি-পথটা যেন কালো মুখব্যাদান করে আছে।
কোথায় গেছে এই গুপ্ত গলি-পথ! প্রমোদভবনের কোন অংশের সঙ্গে নিশ্চিত যোগাযোগ আছে এই গোপন গলি-পথের!
সতর্ক পদসঞ্চারে দুজনে অগ্রসর হয়।
কিছুটা অগ্রসর হবার পরই ক্ষীণ একটা আলোর শিখা অন্ধকারে যেন অনিশ্চিতের মধ্যে আশার হাতছানি জানায়।
আরো অধিক সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলে কিরীটী।
অগ্রসর হয় দুজনে। একটা কটু অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধ যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে আসছে। নাক জালা করে।
অশ্বের হ্রেষাধনি শোনা গেল। তবে কি ওরা আস্তাবলের দিকেই এগিয়ে চলেছে?
হ্যাঁ, কয়েক পদ আর অগ্রসর হতেই দুজনে—প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে সত্যজিৎ প্রমোদভবনের আস্তাবলের মধ্যে এসেই প্রবেশ করল।
সামনেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অদূরে সেই মূর্তি। এক কোণে একটা আলো জ্বলছে। মূর্তি তার গা হতে ভিজে জামা-কাপড়গুলো খুলতে ব্যস্ত।
চোখের ইশারায় কিরীটী সত্যজিৎকে বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে ডান দিকে এগিয়ে যায়।
হঠাৎ অসতর্ক সত্যজিতের পায়ের নিচে ঘরের মেঝেতে ইতস্তত ছড়ানো ঘোড়ার আহার্য চানার দানা পিষ্ট হবার মচমচ শব্দে চকিতে মূর্তি ফিরে ঘুরে দাঁড়ায়।
গায়ের জামাটা খুলেছে মাত্র, মুখের রুমালটা এখনো খোলা হয়নি।
ধকধক করে হিংস্র বাঘদের মতই লোকটার চোখের তারা দুটো জলে ওঠে একটা নিষ্ঠুর ক্রোধে।– আকস্মিক পরিস্থিতিটা কিরীটী মুহূর্তে উপলব্ধি করে নেয় এবং আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হবার পূর্বেই লোকটা চকিতে পা বাড়িয়ে ঠিক তার পায়ের নাগালের মধ্যেই অশ্বটায় প্রচণ্ড একটা লাথি মারে। ঝনঝন করে আলোর চিমনিটা ভেঙে গড়িয়ে যায়, মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে অবলুপ্ত হয়ে যায়।