দেখ মা, সবিতাকে লক্ষ্য করে নিত্যানন্দ সান্যালই আবার কথা বললেন। এবং সকলেই নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকায়।
নিত্যানন্দ বললেন, তুমি মনে হয়ত দুঃখ পাবে মা আমার কথাটা শুনে, কিন্তু কথাটা আমি না বলেও পারছি না। জীবনে কোন দিন মিথ্যার আশ্রয় নিইনি-চিরদিন সত্যকেই জীবনের লক্ষ্য করে এসেছি এবং অপ্রিয় হলেও সত্য যখন মনে হচ্ছে, বলতে বাধ্য হচ্ছি কথাটা—আমারও এখন স্থিরবিশ্বাস হচ্ছে, এ কাজ বসন্ত ভায়ারই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবিতা তাকাল নিত্যানন্দ সান্যালের দিকে,
না, না, না—
স্থিরভাবে বিবেচনা করে দেখো, সে ছাড়া আর কারো পক্ষেই
মামাবাবু?
মা রে! চুলে পাক ধরেছে, বয়সও আমার অনেক হলো। এ বয়সে দেখলামও অনেক, অবশ্য বসন্ত ভায়াও আমার বহুদিনের এবং যথেষ্ট পরিচিত। এ কাজ তার দ্বারা সম্পন্ন হয়নি প্রমাণ হলে আমার চাইতে এ জগতে আর কেউ বেশী সুখী ও আনন্দিত হবে না হয়ত, তবু চক্ষুলজ্জার খাতিরে অপ্রিয় ও কষ্টকর বলে সত্যকে যদি আমরা অস্বীকার করি, তার চাইতে দুঃখ ও গ্লানি আর বেশী কিছু থাকবে না মা। তাই বলছিলাম, আমার মনে হয় এ কাজ তারই। ভেবে দেখো মা, তোমার পিতার আকস্মিক অপঘাতে মৃত্যুর পর একমাত্র এ বাড়িতে সে-ই তো এ কটা দিন ছিল। এবং তার হাতেই চাবি ছিল। বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে দেখতে গেলেও স্বভাবতই কি মনে হবে না যে, লেফাপাটা সরানো তার পক্ষে যতটা সহজ ও সুবিধা ছিল তেমন আর কারো পক্ষেই সুবিধা ছিল না। শুধু, সেই নয় মা, আরো একটা কথা আমাদের এক্ষেত্রে ভাবতে হবে, মিঃ বোস যখন বলছেন মৃত্যুঞ্জয়ের মতুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ওঁকে ঐ লেফাপার সংবাদ দিয়ে একটা জরুরী পত্র দিয়েছিলেন, তখন নিশ্চয় তাঁর Iron-safe-এ লেফাটা ছিল। এবং ছিলই যখন, তখন সেটা গেল কোথায়? চাবিবদ্ধ Iron-safeএর ভিতর থেকে পাখা মেলে তো কিছু আর লোপাটা উধাও হয়ে যেতে পারে না!
উপস্থিত নিত্যানন্দ সান্যালের যুক্তিকে কেউ যেন অস্বীকার করতে পারে না, করবার উপায়ও নেই।
অতীনলালই বলেন, মিঃ সান্যাল ঠিকই বলেছেন সবিতা দেবী। কথাটা ভেবে দেখবার মত।
ভাবতে আর হবে না মিঃ বোস। অতর্কিত কণ্ঠস্বরে সকলেই একসঙ্গে চমকে বক্তার দিকে ফিরে তাকায় ঘরের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন। বক্তা সন্তোষ চৌধুরী।
কেউই ঘরের মধ্যে উপস্থিত ইতিমধ্যে টের পায়নি কখন একসময় সন্তোষ চৌধুরী সবার পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার উপস্থিতিটা না জানলেও ক্ষণপূর্বে ঘরের মধ্যে যে আলোচনাটা চলছিল সেটা সে শুনছে।
সন্তোষ চৌধুরী বক্তব্যটা শেষ করে, সেই শয়তানের কাজ! এখন সময় বুঝে ধরা পড়ে কৌশলে গাঢাকা দিয়েছে।
আপনি! আপনাকে তো চিনতে পারছি না? কথাটা বললেন মিঃ অতীনলাল সন্তোষকে লক্ষ্য করে।
আমি। আমার নাম সন্তোষ চৌধুরী, সবিতার জাঠতুতো ভাই আমি। ওর বাবা ও আমার বাবা আপন জাঠতুতো ভাই ছিলেন। দিন তিনেক হলো আমি এডেন থেকে এসে পৌঁছেছি।
অতীনলাল সন্তোষ চৌধুরীর কথা শুনে তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটি কথাও বললেন না।
এতক্ষণ পর্যন্ত কিরীটী একটিও কথা উচ্চারণ করেনি। একান্ত নির্লিপ্তভাবেই চক্ষু কর্ণকে সজাগ রেখে এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে সকলের কথা শুনছিল এবং এখনও কোন কথাই বলল না—কেবল অতীনলালের সন্তোষ চৌধুরীর মুখের প্রতি নিবন্ধ স্থিরসন্ধানী দৃষ্টিটাই তাকে যেন বিশেষভাবেই কৌতুহলী করে তুলল।
স্পষ্টই বুঝতে পারছিল কিরীটী, এবারে অতীনলাল কিছু একটা বলবেন। প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে ওঠে কিরীটী।
আপনি সন্তোষ চৌধুরী? এডেন থেকে এসেছেন? ধীরকণ্ঠে অতীনলাল সন্তোষের মুখের দিকে স্থির-নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলেন।
হ্যাঁ।
অদ্ভুত যোগাযোগ তো! এত আস্তে অতীনলালের কণ্ঠে কথাটা উচ্চারিত হল যে, একমাত্র কিরীটীর অতিমাত্র সজাগ শ্রবণেন্দ্রিয় ব্যতীত ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্য কারোরই শ্রবণে কথাটা প্রবেশ করল না। এমন কি সন্তোষ চৌধুরীও কথাটা শুনতে পেল না।
কি বললেন মিঃ বোস?
না, কিছু না! অতীনলাল শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন।
তাহলে উইলটা পড়বার কি হবে মিঃ বোস? প্রশ্নটা এবারে নিত্যলাল সান্যালই করলেন।
উইল! আরো দুটো দিন বসন্তবাবুর জন্য আমি অপেক্ষা করবো এখানে। পরশু সকালে উইল পড়ে শোনাব সকলকে। জবাব দিলেন অতীনলাল।
তুমি কি বল মা সবি? প্রশ্ন করলেন সান্যাল সবিতাকে।
ক্ষতি কি, তাই হবে। আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
কালকের দিনটা তো মধ্যে, তাই হবে না হয়। কিরীটী জবাব দিল।
প্রভু হে, দয়াময়! মা কলি, আমার উপাসনার আয়োজন করে দেবে চল মা বহুক্ষণ সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
নিত্যানন্দ সান্যাল অতঃপর কক্ষত্যাগ করবার জন্যই বোধ হয় চেয়ার হতে গাত্রোখান করে, দুয়ারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে মিঃ অতীনলালের থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও মা। পথশ্রমে উনি ক্লান্ত চায়ের ব্যবস্থা করো।
প্রশান্ত পদক্ষেপে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন সান্যাল। পশ্চাতে পশ্চাতে তাঁকে অনুসরণ করে কল্যাণী।
চাকর বেটারাই বা সব গেল কোথায়? ভদ্রলোককে যে এক কাপ চা দিতে হয়, সে হুঁশও কি বেটাদের নেই? এই বনমালী! বলতে বলতে সন্তোষ চৌধুরীও কক্ষ ত্যাগ করলেন।