তুমি দেখ তো কল্যাণী, সত্যজিৎবাবু, কোথায়? কল্যাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে সবিতা কথাটা বললে।
সকাল থেকে কই সত্যজিতের সঙ্গে তো আমার দেখাও হয়নি!
কিরীটী চকিতে একবার কল্যাণীর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললে, চলুন দেখা যাক, নিচেও হয়ত তিনি থাকতে পারেন।
নিচে বাইরের ঘরেই সত্যজিতের দেখা পাওয়া গেল।
নিত্যানন্দ সান্যাল একজন সাহেবী পোশাক পরিহিত সুশ্রী গৌরবর্ণ হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল সত্যজিৎ রায়।
ওদের সকলকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে নিত্যানন্দ সান্যালই আহ্বান জানালেন, এই যে সবি মা, এসো! ইনি অতীনলাল বোস তোমাদের সলিসিটার। এবং উপবিষ্ট মিঃ বোসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, মিঃ বোস এই সবিতা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে।
নমস্কার মিস চৌধুরী বসুন। বসন্তবাবুরই জরুরী চিঠি পেয়ে আমি আসছি, কিন্তু এখানে এসে ওঁর মুখে বসন্তবাবু সম্পর্কে সব কথা শুনে তো
বিরক্তি ও ভ্রূকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে সবিতা সম্মুখেই উপবিষ্ট নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকাল এবং পরক্ষণেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অতীনলালের দিকে তাকিয়ে বললে, কি আপনি শুনেছেন নায়েবকাকার সম্পর্কে মিঃ বোস আমি জানি না—তবে আমি বলতে পারি, ব্যাপারটা সম্পূর্ণই একটা misunderstanding বা দারোগা লক্ষ্মীকান্তবাবুর misjudgement! যাক, সে আলোচনা বর্তমানে আমাদের না করলেও চলবে। আর আমার ইচ্ছাও নয়। আপাতত ঐ বিষয় নিয়ে আর আলোচনা করবার। আপনি বোধ হয় বাবার উইল এনেছেন?
সবিতার অদ্ভুত সংযত কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত কথাগুলি কিরীটীকে বিস্মিত করে। গতকাল দ্বিপ্রহরের দিকে জমিদারী দেখাশোনার ব্যাপারে সবিতার যে অদ্ভুত দৃঢ়তা ও সংযমের পরিচয় পেয়েছিল, আজও সবিতার কণ্ঠে যেন ঠিক সেই সুরটিই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।
অকস্মাৎ কক্ষের মধ্যে যেন একটা অপ্রিয় পরিস্থিতি ঘনিয়ে ওঠে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কিছু ক্ষণের জন্য একটা স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে বিরাজ করে।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সলিসিটার অতীনলালই আবার কথা বললেন, হ্যাঁ, উইলটা আমি সঙ্গেই এনেছি বসন্তবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী। পূর্বের অপ্রিয় আলোচনাটা যেন কতকটা ইচ্ছা করেই সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, একেবারে অন্য ধারায় বক্তব্য শুরু করলেন, তা সে যাই হোক, তিনি উপস্থিত যখন নেই-ই, আপনাদের সকলের সামনে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উইলটা পড়তে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু উইল পড়বার আগে সবিতা দেবী আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন আছে এবং যে প্রশ্নের উপরে উইল এখন আর পড়া না-পড়াটা সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছে। অতীনলাল সবিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন।
বিস্মিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবিতা তাকায় অতীনলালের দিকে, প্রশ্ন?
হ্যাঁ। যে শিলমোহর-করা খামটা আপনার নামে তাঁর আয়রন-সেফে ছিল। সেটা খুলে আপনি আপনার বাবার শেষ চিঠিটা পড়েছেন কি?
অতীনলালের প্রশ্নে মনে হল সবিতা যেন অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়েছে এবং বিস্ময়সন্দিগ্ধভরা কণ্ঠে কোনমতে বললে, বাবার আয়রন-সেফে আমার নামে শিলমোহর করা খামের মধ্যে তাঁর শেষ চিঠি?
হ্যাঁ, কেন পাননি আপনি সে চিঠি? আমার প্রতি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর শেষ নির্দেশ ছিল, যে নির্দেশ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে জরুরী রেজিস্টার্ড একটা চিঠির মারফৎ পাই যে, এ চিঠি যেটা তিনি তাঁর সেফে রেখে গেলেন, আপনি খুলে না পড়া পর্যন্ত উইল যেন সর্বসমক্ষে তো নয়ই আপনাকে পর্যন্তও যেন পড়ে না শোনানো হয়।
কিন্তু বাবার আয়রন-সেফ এবং যে টেবিলে বসে তিনি সাধারণতঃ লেখাপড়া করতেন, সব আমি বসন্তকাকার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে এখানে আসবার পরদিনই তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখেছি যদি কোন চিঠি বা এ ধরণের কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় যাতে করে বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন হদিস পাওয়া যায়, কিন্তু কিছুই তো পাইনি!
সবিতার কথায় অতীনলাল কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে কি যেন ভাবলেন। অতঃপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, এ অবস্থায় তাহলে নায়েববাবু, ফিরে না আসা পর্যন্ত বা তাঁর কাছ হতে ঐ চিঠি সম্পর্কে সব না জানা পর্যন্ত তো উইলটা আমি পড়তে পারবো না সবিতা দেবী!
নিত্যানন্দ সান্যাল এবারে কথা বললেন, একটা কথা মিঃ বোস ক্ষমা করবেন, অবশ্য না বলে এক্ষেত্রে আমি পারছি না। ধরুন যদি সে লেফাপাটার কোন হদিসই না পাওয়া যায়, তাহলে সবি মা কি তার উইলটা সম্পর্কেও জানতে পারবে না?
পারবেন। তবে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
অপেক্ষা করতে হবে মাত্র ঐ সামান্য একটা কারণে?
কারণটা যে সামান্য, সে কথা আপনি জানলেন কি করে, মিঃ সান্যাল? ঐ চিঠির বিষয়বস্তুর সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উইলেরও এমন একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে যে, যাতে করে ঐ চিঠিটা পূর্বে না পড়া থাকলে উইলের বিষয়বস্তু সঠিকভাবে উপলব্ধিই করতে পারবেন না অন্ততঃ সবিতা দেবী।
তার মানে?
ক্ষমা করবেন মিঃ সান্যাল। বর্তমানে এর বেশী কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ যেটুকু আমি বলেছি ঐটুকুই চিঠিতে মৃত্যুর আগে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আমাকে জানিয়েছিলেন। ঐ শিলমোহর করা লেফাপার মধ্যে চিঠিতে তিনি তাঁর মেয়েকে কি লিখেছিলেন বা না লিখেছিলেন, সে সম্পর্কে আমিও কিছু জানি না বিশ্বাস করুন।