কল্যাণী বোধ হয় লক্ষ্য করলে না যে কিরীটী তাকে তুমির বদলে আবার আপনি বলে কথা বলছে।
ঘুম ভেঙেছে প্রথমে আমারই উঠেই দেখি ঘরে কতগুলো জুতোর অস্পষ্ট ছাপ।
ঘুম ভেঙেছে! কতটুকু সময় তাহলে ঘুমিয়েছিলেন?
মানে? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল কল্যাণী কিরীটীর প্রশ্নভরা দুই চোখের দিকে।
আমার চাইতে সে কথাটা কি আপনি ভাল জানেন না কল্যাণী দেবী!
কল্যাণী কিন্তু নিরুত্তর। তার কণ্ঠে কোন ভাষাই যোগায় না যেন।
ঘরে তো গেলেন ভোর পাঁচটায়। ঘুমোবার সময় পেলেন কখন?
এবারে কিরীটী লক্ষ্য করে, কল্যাণীর সমস্ত মুখখানা যেন একটা চাপা রক্তিমাভা ধারণ করেছে।
কল্যাণী দেবী! মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবার ডাকে।
কল্যাণী তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে। ঠিক এমনি সময় সবিতা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল,
মিঃ রায়!
আসুন সবিতা দেবী। সুপ্রভাত। রাত্রে নিশ্চয়ই কাল খুব গভীর নিদ্রা দিয়েছিলেন!
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সবিতা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
যাক, আপনার সৌভাগ্য বলতে হবে, গতরাত্রে আপনার কোন ক্ষতি হয়নি!
আপনি
হ্যাঁ। এইমাত্র কল্যাণী দেবীর মূখেই শুনলাম আপনার শয়নঘরের দরজা খোলা পেয়ে সেই সুযোগে কে নাকি আপনার শয়নঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন। এবং এও বোঝাই যাচ্ছে যিনিই গতরাত্রে আপনার শয়নঘরে প্রবেশ করে থাকুন না কেন, সুযোগের অভাবে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি।
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, কেউ যে গতরাত্রে কোন এক সময় আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল সন্দেহ নেই সত্যি, কিন্তু কি করে সেটা আদৌ সম্ভব হলো? আমি ও কল্যাণী শোবার আগে, নিজে হাতে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ঘরের, সবিতা বিহ্বলভাবে কথাগুলো বললে।
কিরীটী কৌতুকোজ্জল দৃষ্টিতে বারেকের জন্য কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে সবিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, বন্ধ থাকলেই বা! কারো খুলতে তো সেটা কষ্ট হতে পারে না!
কিন্তু আমি বা কল্যাণী কেউই তো রাত্রে আমরা উঠিনি! সবিতা আবার বলে।
আপনি ওঠেননি এটা ঠিকই, কিন্তু কল্যাণী দেবী? কিরীটী প্রশ্ন করল।
না, কলিও ওঠেনি। আমাদের দুজনের ঘুম প্রায় একই সঙ্গে ভেঙেছে। সবিতা জবাব দেয়।
সে প্রশ্নের মীমাংসা পরে করলেও চলবে। আগে একবার চলুন দেখি, দেখে আসি আপনার ঘরটা। কল্যাণী দেবী বলছিলেন আপনার শয়নঘরের মেঝেতে নাকি কার জুতোর অস্পষ্ট ছাপ রয়েছে!
আলোচনাটা যেন কতকটা ইচ্ছে করেই বন্ধ করে দিয়ে কিরীটী চেয়ার হতে উঠে সবিতাকে নিয়ে অগ্রসর হল তার ঘরের দিকে।
শ্লথ মন্থর পায়ে কল্যাণীও ওদের অনুসরণ করল।
অষ্পষ্ট জুতোর ছাপই বটে।
এবং সেই পূর্বের ক্রেপসোল দেওয়া জুতোরই ছাপ কয়েকটা ঘরের মেঝেতে তখনও রয়েছে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ছাপগুলো পরীক্ষা করে দেখে আর একবার ঘরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল।
সবিতার নিদ্রিত অবস্থায় যে সময়টা কল্যাণী ঘরে ছিল না এবং ঘরের দরজা খোলা ছিল সেই সুযোগেই কেউ এসেছিল এই ঘরে সুনিশ্চিত।
কিন্তু কেন? কি উদ্দেশ্যে এসেছিল সে?
নিশ্চয়ই একেবারে বিনা উদ্দেশ্যে কেউ গতরাত্রে কল্যাণীর অবর্তমান ঘরে আসেনি এবং সম্ভবতঃ রাত্রে ঠিক এ সময় কল্যাণী যে ঘরে থাকবে না এবং দরজা খোলাই থাকবে তাও তো নিশীথ আগন্তুক জানত না!
কিন্তু
পরক্ষণেই যেন কিরীটীর সন্দিগ্ধ মন প্রশ্নে আবর্তিত হয়ে ওঠে।
অপাঙ্গে একবার অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান কল্যাণীর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারে না কিরীটী।
আবার কিরীটী মেঝের উপরে জুতোর ছাপগুলোর দিকে তাকাল। সবিতার পালঙ্কের একেবারে কাছবরাবর ঘেষে জুতোর ছাপগুলো।
ঘরের দক্ষিণ দিক ঘেষে দুটো শয্যা, একটা সবিতার দামী পালঙ্কের উপরে, অন্যটা হাত দুই ব্যবধানে কল্যাণীর, ছোট একটা তক্তপোশের উপরে।
দুটি খাটের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় মেঝেতেই জুতোর ছাপগুলো রয়েছে।
সহসা কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনাদের মধ্যে কে প্রথম ঐ ছাপগুলো দেখতে পান মিস চৌধুরী?
কল্যাণী। ওই আমাকে পরে দেখায়।
দরজার বাইরে এমন সময় ভৃত্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দিদিমণি?
কে রে?
কলকাতা থেকে উকীলবাবু এসেছেন। মামাবাবু, আপনাকে একবার এখনি নিচে ডেকে দিতে বললেন।
যান মিস্ চৌধুরী। বোধ হয় কলকাতা থেকে আপনাদের সলিসিটার অতীনলাল বোস এসেছেন। কিরীটীই এবারে সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে।
মিঃ বোস সলিসিটার! তাঁর আসবার কথা ছিল কই
হ্যাঁ, নায়েব বসন্তবাবুই তাঁকে আসতে লিখেছিলেন আপনার বাবার উইল সংক্রান্ত ব্যাপারেই। কিরীটী জবাব দিল।
বাবার উইলের ব্যাপারে?
হ্যাঁ। যদিও সাধারণভাবে বিচার করে দেখতে গেলে আপনিই আপনার পিতার যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী, তাহলেও সকলের অজ্ঞাতে যদি উইলের মধ্যে অন্য কোন ব্যবস্থা বা এমন কোন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে গিয়ে থাকেন যেটা জানা দরকার, সেদিক দিয়েও তো উইলের মধ্যে কি লেখা আছে বা না আছে আপনার জানা দরকার সবিতা দেবী। যান নিচে যান।
আপনিও আসুন মিঃ রায়!
কিন্তু আমার সেখানে থাকাটা কি উচিত হবে সবিতা দেবী? আমি তো আপনাদের ফ্যামিলির কেউ নই, সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি!
তা হোক, আপনি চলুন। সত্যজিৎবাবু কোথায়?
তিনি তো অনেকক্ষণ ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন, জানি না তো! কিরীটী জবাব দেয়।