ঐ একই কারণেই হয়ত, কিরীটী আবার বলে।
কিন্তু এতে করে কি লাভ হল?
তাঁর লাভ হোক আর নাই হোক, অন্ততঃ আমার লাভ হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়ে তাঁর একান্ত অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতেই তিনি আমাকে এই হত্যা-রহস্যের তদন্তের ব্যাপারে কিছু সময় দিয়েছেন যেটার প্রয়োজন আমার একান্ত ভাবেই হয়েছিল। কিন্তু আর একটা কথা সত্যজিৎবাবু
বলুন?
আপনার ও কল্যাণী দেবী সম্পর্কে
আজ নয়। আর একটা দিন আপনার কাছে সময় চাই মিঃ রায়। কাল আগামী কাল সব কথা কল্যাণী সম্পর্কে আপনাকে খুলে বলব।
হয়ত তার আর কোন প্রয়োজন হবে না। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়। কিরীটী চেয়ার হতে উঠে এগিয়ে গিয়ে বিলের দিককার জানলার কবাট দুটো আরো ভাল করে খুলে দেয়।
রাতের আকাশ অত্যাসন্ন প্রভাতের প্রথম আলোর স্পর্শে ক্রমে ক্রমে লালচে হয়ে উঠছে।
ভোর হয়ে এলো।
মৃদুমন্দ রাত্রি-শেষের স্নিগ্ধ বায়ু কিরীটীর জাগরণ-ক্লান্ত চোখে একটা ঝাপটা দিয়ে গেল।
সত্যজিৎ এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো এক এক করে মেঝের উপর থেকে কুড়িয়ে একটা কাগজের উপরে তুলতে লাগল।
দিগন্তপ্রসারী বৌরাণী বিলের বুকের উপর হতে রাত্রিশেষের ঘোলাটে পর্দাটা একটু একটু করে কে যেন টেনে তুলে নিচ্ছে।
অদূরে নন্দনকাননে গাছপালাগুলোও ক্রমে দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো কাগজের মধ্যে জড়ো করে সত্যজিৎ ঘরের বাইরে চলে গেল।
থানায় গিয়ে একবার দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহার সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন।
কিরীটী আশা করেছিল, গত সন্ধ্যায়ই লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের ব্যাপারে হয়ত প্রমোদভবনে আসবে, কিন্তু আসেনি।
কিরীটী একটু যেন আশ্চর্যই হয়েছে লক্ষ্মীকান্ত আসেনি দেখে।
সন্তোষ চৌধুরীকে থানায় নিয়ে যাবার পর কি এমন সে লক্ষ্মীকান্তকে বলেছে যাতে করে সেই রাত্রেই লক্ষ্মীকান্তকে বসন্ত সেনের সঙ্গে দেখা করতে আসতে হয়েছিল?
অবশ্য লক্ষ্মীকান্ত গতকাল সকালে বলেছিল সে থানায় গেলে নাকি অনেক interesting ব্যাপার জানতে পারত।
লক্ষ্মীকান্তর কথায় কিরীটী বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি এই কারণেই যে সে অনুমান করেছিল নিশ্চয়ই সে সব সন্তোষের কাছে শোনা কোন ঘটনা বা তার কাছে প্রাপ্ত চিঠিপত্রের মধ্যে কোন সংবাদ পেয়েছে, যাতে করে লক্ষ্মীকান্ত উত্তেজিত হয়ে এখানে ছুটে এসেছিল।
লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে এখন একবার দেখা করা প্রয়োজন।
প্রথম ভোরের আলো খোলা জানলাপথে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।
হঠাৎ কিরীটীর খেয়াল হয়, ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো ফেলবার অছিলায় সেই যে কিছুক্ষণ পূর্বে সত্যজিৎ এ ঘর হতে বের হয়ে গেল আর ফিরে আসেনি।
সহসা একটা কথা কিরীটীর মনে পড়ে যায়, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ড্রয়ারের মধ্যে প্রাপ্ত দেবনাগরী অক্ষরে লেখা চিঠির বাণ্ডিলটা।
চিঠিগুলো সব পড়া হয়নি।
ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে কিরীটী চিঠির ফিতে বাঁধা বাণ্ডিলটা সুটকেসের ভিতর হতে টেনে বের করল।
চেয়ারে বসে চিঠির বাণ্ডিলটা খুলল কিরীটী।
বহুদিন আগেকার লেখা। কাগজগুলো লালচে হয়ে গিয়েছে। কালিও যেন অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
প্রত্যেকটি চিঠির শুরুতে সম্বোধন করেছে বাবুজী বলে এবং চিঠির শেষে নাম দস্তখত করেছে কোন এক লক্ষণ।
আটখানা চিঠি। হাতের বাঁকা লেখা ও নাম দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না প্রত্যেকটি চিঠির লেখক একই ব্যক্তি এবং চিঠিগুলো দুএক মাস তো বটেই, কোন কোন চিঠি আবার ছ মাস বা এক বৎসরের ব্যবধানে লেখা হয়েছে।
একটা চিঠিতে লেখা–
সে মরেছে। আমিও মরবো। কিন্তু মরতে পারছি না কেবল একজনের মুখ চেয়ে। ওর যাহোক একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত মরতে পারছি না। তাছাড়া চেৎ সিং, সেও তোমাকে নিষ্কৃতি দেবে না।
কে এই চেৎ সিং! আর একখানা চিঠিঃ
চেৎ সিং তোমাকে একদিন খুঁজে পাবেই, কারণ আমার স্থির ধারণা চেৎ সিং তোমারই খোঁজে মুলক ছেড়েছে। চেৎ সিংয়ের বুকের পাঁজরা তুমি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ। হায়, কেন সেদিন তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম! লোভের উপযুক্ত শাস্তিই আমার মিলেছে।
আরো পরের একখানা চিঠি এবং সর্বশেষ চিঠিই বোধ হয়–
এইবার আমি নিশ্চিন্ত। চেৎ সিং আমায় জানিয়েছে সে তোমার সংবাদ পেয়েছে, কিন্তু এই দুঃখ আমার থেকে গেল—তোমার সংবাদটা শোনা পর্যন্ত আর হয়ত আমার বাঁচা হবে না।
বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল, মিঃ রায়!
কিরীটী চমকে ওঠে, কে?
দরজাটা খুলন মিঃ রায়। আপনার চা এনেছি। কল্যাণীর গলা।
ক্ষিপ্রহস্তে চিঠিগুলো কোনমতে গুছিয়ে কিরীটী বাণ্ডিলটা সুটকেসের মধ্যে ভরে ফেলে।
দরজাটা খুলতেই দেখা গেল ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে প্রসন্ন হাস্যমুখে দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে কল্যাণী।
ঘুমোচ্ছিলেন নাকি এখনো? প্রশ্ন করে কল্যাণী চায়ের কাপ হাতে ঘরে প্রবেশ করতে করতে।
না। আসুন, সুপ্রভাত!
চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে কল্যাণী বলে, কাল রাত্রে আমাদের ঘরে কেউ বোধ হয় এসেছিল মিঃ রায়!
চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে কিরীটী সবেমাত্র চুমুক দিয়েছিল, কল্যাণীর কথায় চকিতে ওর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই এবং বোধ হয় বিশ্বাস করতে চাইছেন না আমার কথা?
দুটোর একটাও নয় কল্যাণী দেবী। কিন্তু কিসে বুঝলেন আপনি?