কথাটা যেন কোনমতে জানিয়ে দিয়ে নিজের দায় থেকে মুক্তি পেলেন বসন্তবাবু।
পাষাণের ভারের মত যে ব্যথাটা এ দুদিন তাঁর বুকের মধ্যে জমাট বেধে ছিল, সবিতার কাছে সব খুলে বলবার পর থেকে যেন কতকটা লাঘব বোধ করলেন।
আচ্ছা নায়েব মশাই, এই মৃত্যুরহস্য তদন্ত করে কোন কিছুই কি আপনারা জানতে পারেননি?
না। কিছুই আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। দারোগা সাহেব এ বাড়ির চাকর-বাকর ঝি দারোয়ান সহিস সকলকেই যতদূর সম্ভব জেরা করেছেন, কিন্তু
বনমালী ও কানাইয়ের মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কারা আছে?
আমি, সরকার রামলোচন, দারোয়ান ঝোটন সিং, সহিস লছমন, ঠাকুর শিবদাস
এরা কেউ কিছু বলতে পারলে না?
না।
এরা সকলেই বিশ্বাসযোগ্য?
হ্যাঁ, তা বৈকি। অনেকদিন ধরেই তো ওরা এ বাড়িতে কাজ করছে। তাছাড়া চৌধুরী মশাইকে গলা টিপে হত্যা করে এদের কারই বা কি লাভ হতে পারে!
লাভালাভের কথাটা কি অত সহজেই বিচার করা চলে নায়েবমশাই। মানুষের লাভক্ষতির তুলাদণ্ডটি এত সূক্ষ্ণ ভারবৈষম্যেই এদিক-ওদিক হয় যে ভাবতে গেলে যেন অনেক সময় বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। অবশ্য আপনি আমার চাইতে অনেক বেশী প্রবীণ ও বিচক্ষণ, শেষের দিকের কথা কটা সত্যজিৎ যেন কতকটা ইচ্ছে করেই যোগ করে দেয় নিজের বক্তব্যের সঙ্গে; কারণ সত্যজিৎ কথা বলতে বলতেই লক্ষ্য করেছিল ওঁর শেষের কথাগুলি শুনে, বসন্তবাবুর মুখের রেখায় একটা চাপা বিরক্তি ভাব যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সত্যজিতের শেষের কথাগুলোতেও কিতু বসন্তবাবুর মুখের বিরক্তি ভাবটা গেল না। এবং সত্যজিতের কথার উত্তরে তিনি যখন কথা বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা বিরক্তির আভাস স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিল, তোমার কথাটা যে মিথ্যে তা আমি বলছি না সত্যজিৎ। তবে এ বাড়িতে যারা আজ ৮/১০ বছর ধরে কাজ করছে তাদের সম্পকে আর যে যাই ধারণা করুক না কেন, আমি জানি অন্ততঃ তারা সকল প্রকার সন্দেহেরই অতীত।
নিশ্চয়ই তো। কিন্তু এটাও আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে probabilityর বা সম্ভাবনার দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে এক্ষেত্রে একটা কথা আমরা না ভেবে পারছি না যে, চৌধুরী মশাইয়ের হত্যার ব্যাপারে সব কিছু বিবেচনা করে দেখতে গেলে একটা কথা আমাদের স্বতই মনে হবে এ বাড়িতে ঐ সময় যে বা যারা ছিল তাদের মধ্যে কেউই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যায় না বা যেতে পারে না।
সহসা বসন্তবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সত্যজিতের কথার জবাব মাত্রও না দিয়ে এবং সোজা একেবারে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাত অনেক হয়েছে মা, কাল সারা রাত ট্রেনে জেগে এসেছো, এবারে শুয়ে পড়। আমিও অত্যন্ত পরিশ্রান্ত—আমি শুতে চললাম।
বসন্তবাবু, সোজা ঘর থেকে চলে গেলেন।
ক্রমে তাঁর পায়ের চটিজুতোর শব্দটা সিঁড়ি-পথে মিলিয়ে গেল।
০৩. অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে
অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই হঠাৎ কথার মধ্যে একপ্রকার জোর করেই যেন পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে বসন্তবাবু ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ায় সত্যজিৎ যেন নিজেই অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।
এ বাড়ির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি সে। তাছাড়া বসন্তবাবু এই পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট তো বটেই, এ পরিবারের একজন পরম হিতৈষীও বটে। বলতে গেলে একদিক থেকে এ পরিবারের আত্মীয়েরও অধিক বসন্তবাবু। এবং সেদিক দিয়ে সবিতার পিতার হত্যার ব্যাপার নিয়ে এরূপ স্পষ্টভাবে মতামত প্রকাশ করাটা হয়ত তার উচিত হয়নি।
বসন্তবাবুর চটির শব্দটা ক্রমে মিলিয়ে যাওয়ার পরও সত্যজিৎ ও সবিতা কেউই কোন কথা বললে না কিছুক্ষণ ধরে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
সত্যজিৎ মনে মনে ভাবছিল হয়ত সবিতাও তার কথায়বার্তায় অসন্তুষ্ট হয়েছে।
তাই সে ভাবছিল কিভাবে সমস্ত পরিস্থিতিটাকে সহজ করে আনা যেতে পারে।
হঠাৎ এমন সময় সবিতার ডাকে সত্যজিৎ মুখ তুলে তাকাল।
সত্যজিৎবাবু!
বলুন? সাগ্রহে সত্যজিৎ সবিতার মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা আপনাকে আমি বলে রাখি। যে বা যারা আমার দেবতার মত বাপকে এমন নিঠুরভাবে হত্যা করেছে তাকে বা তাদের আমি কোনমতেই ক্ষমা করব না এবং এই নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের মীমাংসার জন্য যতপ্রকার চেষ্টা সম্ভব সবই আমি করব। তার জন্য বাবার জমিদারীর শেষ কপর্দকটি পর্যন্তও যদি আমাকে ব্যয় করতে হয় তাতেও আমি পশ্চাৎপদ হবো না।
ঠিক এমনিটিই আমি আশা করেছিলাম সবিতা দেবী আপনার কাছ থেকে। দেখুন আপনার বুঝবার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যে স্নেহময় পিতাকে আপনি হারিয়েছেন, হাজারবার চোখের জল ফেলে বুক চাপড়ে কাঁদলে বা হা-হুতাশ করলেও আর তাঁকে জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে না। এবং এও আমরা সকলেই জানি মা বাপ কারো চিরদিন বেঁচে থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে ব্যক্তিকে মেনে নিয়েও চুপ করে থাকতে আমরা পারব না, কারণ তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণেই যেমন করে যে উপায় হোক এই হত্যা-রহস্য আপনাকে উৎঘাটন করতেই হবে। আমি নিশ্চিত যে এর মধ্যে কোন foul play রয়েছে।
সবিতার মনের মধ্যেও একটা প্রতিজ্ঞা সত্যজিতের কথায় ক্রমে ক্রমে দানা বেধে উঠছিল। বাপকে সে আর ফিরে পাবে না ঠিকই। কিন্তু সেও সহজে নিশ্চিত হবে না। পিতার হত্যাকারীকে সে খুঁজে বের করবেই। কিন্তু কোন পথ ধরে সে এই রহস্যের মীমাংসায় অগ্রসর হবে?