সত্যজিৎ ও কল্যাণী। এবং পরস্পর ওরা হাত-ধরাধরি করে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে।
কল্যাণী ও সত্যজিৎ! এত রাত্রে দুজনে নিচে ওরা কোথায় ছিল?
সবিতা দেবী! সবিতা দেবী কোথায়?
তুমি ঠিক দেখেছ তো কল্যাণী, তুমি যখন বিছানা ছেড়ে উঠে আস সবিতা ঘুমিয়েই ছিল? কল্যাণীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে সত্যজিৎ।
হ্যাঁ। মৃদু চপল হাসি কল্যাণীর ওষ্ঠপ্রান্তে, নাক ডাকাচ্ছিল।
এর মধ্যে যদি সে উঠে থাকে বা ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে?
দিন চারেক তো শুচ্ছি ওর সঙ্গে। গাঢ় ঘুম—এক ঘুমে রাত কাবার করে। কিন্তু কিরীটীবাবু
এতক্ষণে তিনিও হয়ত নাক ডাকাচ্ছেন। চাপা হাসির সঙ্গে জবাব দেয় সত্যজিৎ।
বারান্দার ওয়াল-ক্লকটা এমন সময় ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করল। রাত্রি চারটে। শেষ হয়ে এলো রাত। উঃ রাত চারটে, চলি! ত্বরিতপদে কল্যাণী তার ঘরের দিকে চলে গেল।
কিরীটীও আর মুহূর্ত মাত্র দেরি করে না। সোজা ক্ষিপ্রপদ অন্ধকারেই গিয়ে শয্যার উপরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
চোখ বুজেই পড়ে থাকে অন্ধকারে কিরীটী কান দুটো সজাগ রেখে। একটু পরেই ভেজানো কপাট খুলে গেল। নিঃশব্দে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল সত্যজিৎ। ওর পায়ের শব্দেই কিরীটী টের পায়।
কিরীটী যে অবস্থায় ছিল ঠিক সেই অবস্থায়ই শয্যায় শুয়ে পড়েছে। ভাল করে জলও মোছবার অবকাশ পায়নি, বেশটাও বদলাতে পারেনি।
সত্যজিৎ পকেট হতে টর্চ বের করে বোতাম টিপল। টর্চের আলোয় ঘরের চারিদিক একেবার দেখে নিল। শায়িত কিরীটীর মুদ্রিত চোখের পাতায় টর্চের তীব্র আলোর রশ্মিটা মুহূর্তের জন্য এসে পড়ে, কিরীটী বুঝতে পারে।
কিরীটীকে ঐ অবস্থায় শুয়ে ঘুমোতে দেখে সত্যজিৎ একটু অবাকই হয়।
এগিয়ে গেল সত্যজিৎ টেবিলের উপরে রক্ষিত আলোটা ফিরে আবার জ্বালাবার জন্য। টেবিলের উপরেই দিয়াশলাইটা ছিল।
দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠি জালিয়ে হাত বাড়িয়ে আলো হতে চিমনিটা খুলে হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তপ্ত কাঁচের চিমনির স্পর্শে উঃ করে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সত্যজিতের হাত হতে চিমনিটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
যেন হঠাৎ চিমনি ভাঙার শব্দেই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে, ধড়ফড় করে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি নিয়ে কিরীটী অন্ধকারেই শয্যার উপরে উঠে বসে প্রশ্ন করল, কে কি হলো?
অপ্রতিভ সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, আমি। কিরীটীবাবু, আমি। আলো জালতে গিয়ে হাত হতে হঠাৎ চিমনিটা পড়ে ভেঙে গেল।
দাঁড়ান, নড়বেন না। ভাঙা কাঁচের টুকরোতে পা কাটবেন। আমার একটা ছোট হ্যারিকেন আছে, জালাচ্ছি। কিরীটী শয্যা হতে নেমে ঘরের কোণে রক্ষিত একপাশে তার সঙ্গে আনা ছোট দামী লণ্ঠনটি তুলে নিয়ে বললে, দিয়াশলাই আছে—দিন তো দিয়াশলাইটা! ছুড়ে দিন এদিকে।
হাত বাড়িয়ে অন্ধকারেই টেবিলের উপর থেকে দিয়াশলাইটা খুঁজে নিয়ে কিরীটীর দিকে অন্ধকারে ছুড়ে দিল সত্যজিৎ, অল্প চেষ্টাতেই কিরীটী আলোটা জালল।
ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল উজ্জ্বল আলোয়।
বাতিটা ছোট হলেও প্রচুর আলো হয়।
হাতের বাতিটা টেৰিলের উপরে নামিয়ে রেখে এতক্ষণে কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সম্মুখে স্থির দণ্ডায়মান সত্যজিতের দিকে।
বাইরের দেওয়ালে ওয়াল-ক্লকটা বাজতে শুরু করে—ঢং-ঢং- এক দুই তিন চার পাঁচ
রাত শেষ হয়ে এলো, এই ফিরছেন বুঝি? ফিরতে এত দেরি হলো যে সত্যজিৎবাবু।
কিরীটীর প্রশ্নে বারেকের জন্য মুখ তুলে তাকাল সত্যজিৎ কিরীটীর দিকে, কিন্তু ওর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর হতে সিগারকেসটা তুলে নিয়ে তা থেকে একটা সিগার বের করে সিগারটায় অগ্নিসংযোগ করল।
জলন্ত সিগারটায় গোটাকয়েক টান দিয়ে কিরীটী আবার সত্যজিতের দিকে তাকাল।
সত্যজিৎ তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির নির্বাক।
বসুন সত্যজিৎবাবু। আপনার সঙ্গে কয়েকটা আমার কথা আছে।
সত্যজিৎ তথাপি নির্বাক।
বসুন!
এবার সত্যজিৎ চেয়ারটার ওপরে উপবেশন করল।
শুনেন সত্যজিৎবাবু, সবিতা দেবীর ব্যাপারে এখানে আমি এলেও এখানে আমার আসবার যে যোগাযোগ সেটা আপনার দ্বারাই হয়েছে। বলতে গেলে আপনিই সেদিন আমাকে এখানে এনেছেন।
সত্যজিৎ কিরীটীর দিকে চোখ তুলে তাকাল।
এখানে আসবার পর এই কদিনের অনুসন্ধানে—কিরীটী মৃদুভাবে বলতে লাগল, যতটকু আমি জেনেছি বা বুঝেছি, সবিতা দেবীর পিতা মৃতুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারটা অতীতের একটা অত্যন্ত জটিল কাহিনীর সঙ্গে জড়িত আছে এটা স্পষ্টই বোঝা গেছে এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তাহলে দুচার দিনের মধ্যেই আর একটা বড় রকমের দুর্ঘটনাও যে ঘটবে সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। অবশ্য আমি যাতে এই অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনাটা না ঘটে সে চেষ্টাই করছি। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমি বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছি, যে অবস্থায় সবিতা দেবীকে বাদ দিয়ে আমি আশা করছিলাম। অন্ততঃ আপনার সাহায্য আমি পাবই, এই জটিল রহস্যের পাক খাওয়া সূত্ৰগুলোর
কিরীটীর কথা শেষ হলো না, সত্যজিৎ কথা বললে, আমি তো সর্বদাই প্রথম হতে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত মিঃ রায়।
তাই যদি হবে তাহলে গত কদিন হতেই লক্ষ্য করছিলাম আমি, আপনি আমাকে avoid করেই চলেছেন। এবং শুধু তাই নয়, সব কথাও আপনি আমাকে খুলে বলছেন না!