চকিতে কিরীটী আধো আলো আধো অন্ধকারে পশ্চাতের দিকে তাকিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল। একটা অস্পষ্ট আবছা মূর্তি এগিয়ে আসছে। পদভারে তার শুকনো ঝরা পাতাগুলো মচমচ শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে।
মূর্তি ক্রমে আরো এগিয়ে আসে। অষ্পষ্ট আলোছায়াতেও কিরীটীর এবারে চিনতে কিন্তু কষ্ট হয় না।
সূরযমল সিং
সূরযমল এগিয়ে বাড়ির মধ্যেই গিয়ে প্রবেশ করল। কিরীটী তথাপি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে।
অপেক্ষাই করবে সে।
বোধ হয় মিনিট পনের বাদে আকাশে চাঁদের সামান্য অবশিষ্ট আলোকটুকুও যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
চাঁদ অস্তমিত।
চারিদিক একটা অস্পষ্ট ধূসর আবহাওয়ায় যেন রহস্যঘন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কিরীটী সচকিত হয়ে উঠল। পূর্বের সেই আগন্তুক ও সূরযমল প্রায় পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে বাড়ির ভিতর হতে বের হয়ে এলো।
নিম্নকণ্ঠে দুজনে তখনও যেন কি কথা বলছে পরস্পরের মধ্যে হিন্দী ভাষাতেই। প্রথমটায় ওদের কারো কোন কথাই কিরীটী বুঝতে পারে না। ক্রমে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে যখন কিরীটী যেখানে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল আত্মগোপন করে তার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে, ওদের দুএকটা শব্দ খাপছাড়া অসংলগ্ন ভাবে ওর কানে এলেও সঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
এগিয়ে যেতে যেতে একসময় দুজনেই কিরীটী যে গাছ দুটোর আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তার হাত দেড়েক তফাতে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
এবারে ওদের কথাও স্পষ্ট শুনতে পেল কিরীটী।
সূরযমল বলছিল, তোমাকে তো বললাম বাবুজী, আর এভাবে এখানে আমি দেশ মুলক ছেড়ে থাকতে পারব না।
চাপা ভারী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এলো, শোন সূরযমল, তোমারই ভালর জন্য এ ব্যবস্থা করেছি আমি।
কিন্তু
আর বেশীদিন থাকতে হবে না। কাজ শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।
ঝুটমুট তুমি এখানে আমাকে ধরে রেখেছ বাবুজী। এতদিন তো হয়ে গেল তোমার কথায় কথায়—
সুরযমল, ছেলেমানুষী করো না।
বাবুজী, অর নয়। সামনের শনিবারই চলে যাবো।
পাগলা, তা হতে পারে না।
আমি যাবোই। মিথ্যেই তুমি আমাকে অনুরোধ করছে।
সুরযমল শোন, আমার বিনা হকুমে এখান হতে যদি এক পা-ও নড়, তাহলে
বাবুজী, ভুলে যাচ্ছো সূরযমল রাজপুতের বাচ্ছা। ও চোখরাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে।
দ্বিতীয় বক্তার কণ্ঠস্বর সহসা এর পর যেন একেবারে খাদে নেমে এলো, এতদূর এগিয়ে এসে এভাবে সব নষ্ট করো না সূরযমল। তোমারই ভালর জন্য বলছি আমি। আর একটা সপ্তাহ তুমি অপেক্ষা কর। এতদিনই তো অপেক্ষা করলে।
সুরযমল কোন প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করেই থাকে।
কাল আবার দেখা হবে। আর মনে থাকে যেন যা বলে গেলাম। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে গিয়েছে এইভাবে জামার ভিতর হাত চালিয়ে একমুঠো নোট বের করে সূরযমলের দিকে এগিয়ে দিল, এই নাও, এই টাকাগুলো রাখো। আমি চললাম।
সূরযমল হাত বাড়িয়ে নোটগুলো নিল।
অতঃপর আগন্তুক এগিয়ে অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহী হয়ে নিমেষে অশ্বকে ছুটিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। দুর হতে বিলীয়মান অশ্বক্ষুরধ্বনি ভেসে আসে খট খট খট। ক্রমে মিলিয়ে যায়। সূরযমল আরো কিছুক্ষণ স্থাণর মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
২১. বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে
পুনর্বার বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে যখন পৌঁছল কিরীটী, রাত তখন প্রায় তিনটে হরে। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর অবসন্ন।
প্রমোদভবনটা মনে হচ্ছে যেন ঘুমে একেবারে পাথর হয়ে আছে।
বাতাসে ঝাউগাছের সর সর চিকন পাতাগুলো সোঁ সোঁ করুণ একটা শব্দে নিশীথের স্তব্ধতাকে একঘেয়ে ভাবে বিদীর্ণ করে চলেছে।
আর কোন শব্দ শোনা যায় না।
পূর্বের পথেই কিরীটী প্রমোদভবনে প্রবেশ করে আঙ্গিনা অতিক্রম করে। ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল।
সিঁড়ি-পথের দেওয়ালে আলোটা টিমটিম করে জ্বলছে। ঘোলাটে আলোয় সমস্ত সিঁড়ির পথটা যেন কেমন ছমছম করছে।
সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠেছে কিরীটী, নিচের বারান্দায় যেন কার পদশব্দ পাওয়া গেল। সিঁড়ির দিকেই কেউ এগিয়ে আসছে।
মুহূর্তে যেন কিরীটী সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিঃশব্দ অথচ অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে বাকী সিঁড়িগুলো কতকটা লাফ দিয়ে দিয়েই অতিক্রম করে কিরীটী দোতলার বারান্দায় উঠে সোজা একেবারে নিজের ঘরের দরজাটা ঠেলে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল। ঘরের আলোটা তেমনি কমানো, পিট পিট করে জ্বলছে। শয্যার দিকে তাকিয়ে দেখলো পাশাপাশি দুটি শয্যা তার ও সত্যজিতের, দুটিই শূন্য।
কিন্তু অত ভাববারও সময় নেই কিরীটীর। চকিতে ফু দিয়ে চিমনির উপর ঘরের একটিমাত্র আলো নির্বাপিত করে দিল সে।
নিমেষে নিচ্ছিদ্র আঁধার যেন সমস্ত কক্ষটি গ্রাস করে নিল। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দ। কেবল শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি সজাগ। উৎকর্ণ। চোখের দৃষ্টিতে ঘরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ক্রমে সহ্য হয়ে আসে।
সতর্ক নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে অতঃপর কিরীটী এগিয়ে গেল কক্ষের ভেজানো দরজাটার দিকে।
কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দায় দৃষ্টিপাত করলে কিরীটী। শুনতে ভুল করেনি। পদশব্দই। কে যেন সিঁড়ি-পথে উপরেই উঠে আসছে।
পদশব্দ ক্রমেই উপরের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু একজোড়া তো নয়, জোড়া পায়ের শব্দ যে শুনেছে কিরীটী!
আশ্চর্য! এত রাত্রে কারা উপরে আসছে?
আরো আশ্চর্য হলো কিরীটী যখন দেখলো শুনতে তার ভুল হয়নি দুজনই!