সন্তর্পণে ভেজানো দরজাটা ঠেলে ফাঁক করে কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল, সামনেই অপ্রশস্ত একটি আঙ্গিনা।
অস্তগামী চন্দ্রালোকে চারিদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখে নেয় কিরীটী।
ঘরের প্লিন্ত মাটি হতে প্রায় হাতখানেক উঁচু। তারপরেই একটা বারান্দা মত। বারান্দার উপরে এসে উঠলো কিরীটী।
পর পর তিনটি ঘর। দুটি ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। একখানা ঘরের ঈষদুন্মক্ত দ্বারপথে আসছে মৃদু আলোর একটুখানি আভাস।
পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল কিরীটী প্রথমেই সেই কক্ষের দিকে।
আলগোছে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপরে ভর করে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়েই ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেষে মাটির প্রদীপাধারের উপরে একটি মৃৎপ্রদীপ জ্বলছে মিটমিট করে।
প্রদীপের সেই ক্ষীণালোকেই তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কিরীটী কক্ষের চতুঃপার্শ্ব দেখে নিল। শুন্য কক্ষ।
এক কোণে একটা খাটিয়ার উপরে শুন্য শয্যা। তারই পাশে একটা মাটির কলসী, একটা গ্লাস। দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে খানকতক শাড়িকাপড় ঝোলানো।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না এই ঘরেই শোয় চন্দ্রলেখা। এটা তারই শয়নকক্ষ নিশ্চয়ই।
এইটা যদি চন্দ্রলেখার শয়নকক্ষ হয় তো ওর দাদু সুরযমলের ঘর কোনটা? কোন ঘরে তাহলে সূরযমল থাকে?
বাকী দুটো ঘর তো দেখছে ও তালাবদ্ধ। তবে কি সুরযমল এই দুটো ঘরেরই কোন একটাতে থাকে। এখন নেই, কোথায় গিয়েছে! কিন্তু এত রাত্রে সে কোথায়ই বা যাবে বা যেতে পারে তার বয়সের তরুণী নাতনীকে একাকিনী এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একা বাড়িতে রেখে?
তবে রাজপুত এরা, এদেশের লোকদের মত ভীতু তো নয়। তাছাড়া রাজপুতের মেয়ে আত্মরক্ষা করতেও হয়ত জানে।
সহসা এমন সময় অস্ফুটকাতর একটা শব্দে ও যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই থমকে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠে। শিকারী বিড়ালের মতই সজাগ হয়ে ওঠে।
অস্ফুট কাতরোক্তি। স্পষ্ট ও শুনেছে।
উৎকর্ণ হয়ে আছে কিরীটী, অসম্ভব কিছুর একটা প্রতীক্ষায় ওর সমস্ত দেহটা যেন কঠিন ঋজু হয়ে উঠেছে।
আঙ্গিনার উপরে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। কোথায় অন্ধকারে একটা তক্ষক টক টক করে শব্দ করে উঠলো, নিস্তব্ধ রজনী যেন ককিয়ে উঠলো। কুৎসিত শব্দটা যেন নিস্তব্ধ রজনীর বুকে একটা ভয়াবহু ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোন আশু অশুভ অমঙ্গলের। আবার শোনা গেল অস্পষ্ট কাতরোক্তি। ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠের যন্ত্রণাকাতর শব্দ যেন। মনে হয় বুঝি একটা বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস নিশতি রাতের স্তব্ধতায় মর্মায়িত হয়ে উঠেছে।
কাতর শব্দটা আবার কানে ভেসে এলো। এবারে কিরীটীর মনে হলো যেন পাশেরই কোন ঘর থেকে শব্দটা অস্পষ্টভাবেই ভেসে আসছে।
সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী আধো আলো আধো ছায়া ঘেরা বারান্দার চারদিকে।
কোথা হতে আসছে শব্দটা শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে বোঝবার চেষ্টা করে।
ঐ তালাবন্ধ দুটো ঘরের একটা ঘর হতে কি? পায়ে পায়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যায় কিরীটী প্রথম ঘরটার দিকে।
আবার সেই অস্পষ্ট কাতরোক্তি।
সহসা আবার কিরীটী থমকে দাঁড়াল। বহুদূর হতে যেন ভেসে আসছে দ্রুত ধাবমান অশ্বক্ষুরধ্বনি।
খট খটখট খটখট– ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোন অশ্বারোহী হয়ত এই দিকেই আসছে।
ঘরের দিকে আর যাওয়া হল না। অষ্পষ্ট কাতরোক্তি ক্ষণপূর্বে কোথা হতে আসছে তার আর সন্ধান করা হল না কিরীটীর। মুহর্তে সে নিজের সংকটময় পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করে কর্মপন্থা স্থির করে ফেলে। অত্যন্ত দ্রুত ক্ষিপ্রপদে কিরীটী আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে বাড়িটার সম্মুখভাগে এসে দাঁড়াল। সকালবেলাতেই ঐদিন কিরীটী লক্ষ্য করেছিল একটা বড় শিমুল গাছ ও তেতুল গাছ পাশাপাশি একটা জায়গায় বাড়িটার সামনে দক্ষিণ দিকে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া বিস্তার করে।
কিরীটী দ্রুতপদে সেই দুটি বৃক্ষের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।
অশ্বক্ষুরধ্বনি এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে এই দিকেই অশ্ব ছুটিয়ে আসছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অশ্বারোহী বাড়ির সামনে এসে বেগবান অশ্বের রাশ টেনে অশ্বের গতি রোধ করল। অষ্পষ্ট চাঁদের আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিরীটী দেখল দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি অশ্ব হতে অবতরণ করল।
কিন্তু অশ্বারোহীকে চিনবার উপায় নেই। সর্বাঙ্গ একটা কালো মুখমলের আংরাখায় আবৃত। মুখাবয়বেরও প্রায় সবটাই কালো একটা রুমালে টাকা।
অশ্বারোহী ধীর মন্থর পদে চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।
দৃঢ় বলিষ্ঠ পদবিক্ষেপ। চলার মধ্যে কোন সঙ্কোচ বা দ্বিধামাত্রও যেন নেই।
স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো দ্রুত কিরীটী উল্টে যায়, মনে করবার চেষ্টা করে আগন্তুকের চলার ভঙ্গীটা—কোন পরিচিতজনের চলার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে কিনা।
কিরীটী কিন্তু বৃক্ষের আড়াল হতে বের হয়ে আসে না বা আগন্তুককে অনুসরণ করবার চেষ্টা করে না। নিশ্চেষ্ট হয়েই অপেক্ষা করে।
সে স্পষ্ট দেখতে পেল এক সময় আগন্তুক বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বৃক্ষের আড়াল থেকে বের হয়ে আবার বাড়ির দিকে অগ্রসর হবে কিনা ভাবছে এমন সময় অতর্কিতেই কিরীটী যেন চমকে ওঠে আবার পদশব্দে।
শুকনো ঝড়া পাতা গড়িয়ে যাচ্ছে মচমচ করে, কে যেন ধীর মন্থর পদে পশ্চাতের গাছপালার দিক থেকে হেঁটে আসছে।