বেশ।
কিন্তু একটা কথা মিঃ রায়—
বলুন?
সত্যিই কি আপনি মনে করেন এ রহস্য আপনি উঘাটন করতে পারবেন?
আমি আপনার এখানে এসেছি দিন পাঁচেক মাত্র। আর পাঁচটা দিন আমাকে সময় দিন সবিতা দেবী।
আর পাঁচ দিনের মধ্যেই? বিস্মিতা সবিতা তাকাল কিরীটীর মুখের প্রতি।
হ্যাঁ। পাঁচদিন বলছি, হয়ত তা নাও লাগতে পারে। তবে তার বেশী প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। ভাল কথা, সত্যজিৎবাবুকে দেখছি না যে?
সদরে তিনি ম্যাজিস্টেটের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।
আপনার একটু আগেকার দৃঢ়তায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি সতি দেবী। এবং আপনি জানেন না, অজ্ঞাতেই সম্পূর্ণভাবে আপনি সমস্ত পরিস্থিতিরই একটা আকস্মিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তারপর কতকটা যেন অস্ফুট আত্মগতভাবে বলে, I wanted this! I wanted_now I am to see and wait!
কি বললেন?
না, কিছু না। আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি। কিরীটী ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। এবং সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অস্ফুটভাবেই পূর্বের মত বলতে থাকে, I hear the foot-steps! আসবে—এবারে সে আসবে।
স্বপ্লেখিতের মতই যেন অকস্মাৎ কিরীটীর সমস্ত চেতনা, অনুভূতি সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চিন্তার ঘন কুজ্ঝটিকা-জাল একটু একটু করে মুক্তির আলোকসম্পাতে দূরীভূত হতে শুরু করেছে।
আর দেরি নেই।
রাত্রি কত হবে? হাত-ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল কিরীটী, পৌনে এগারটা।
অত্যন্ত ক্ষিপ্তহস্তে কিরীটী সুইমিং কস্টিউমটা পরে নিয়ে তার উপরে ধুতিটা মালকোঁচা দিয়ে পরিধান করে নিল।
মাথায় এঁটে নিয়েছে সাঁতার দেবার একটা কালো রঙের রবারের তৈরি সুইমিং ক্যাপ। পায়ে রবার-সু।
ঘরের আলোটা কমিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে কক্ষ হতে বের হয়ে এলো কিরীটী দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে।
সত্যজিৎ সদর হতে ফেরে নি। ঘরের মধ্যে সে তাই একাই ছিল।
এর মধ্যেই সমগ্র প্রমোদভবন যেন ঘুমের নিঃসীম অতলে তলিয়ে গিয়েছে। পা টিপে টিপে সিঁড়ি-পথ অতিক্রম করে ভিতরের আঙ্গিনা পার হয়ে পূর্বদিনের ঘরের মধ্যেকার সেই পথ দিয়েই নন্দনকাননে যাবার পথে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
মাথার উপরে রাত্রির আকাশে শুক্লাত্রয়োদশীর চাঁদ। ক্ষীণ চন্দ্রালোকে অদূরে নন্দনকানন, দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিল কেমন যেন স্বপ্ন-বিহ্বল।
দ্রুতপদে কিরীটী নন্দনকাননে এসে পৌঁছল। পুবদিনের সেই স্থানটি চিনে নিতে কিরীটীর কষ্ট হয় না। তারপর ধীরে ধীরে জলের মধ্যে গিয়ে নামল।
গ্রীষ্মের রাত, বেশ গরম বোধ হচ্ছিল, বিলের শীতল জলে আকণ্ঠ ড়ুবিয়ে শরীর যেন জড়িয়ে গেল। কিরীটী সন্মুখদিকে দৃষ্টি রেখে দ্রুত হস্ত-সঞ্চালনে জল কেটে সাঁতরে চলল।
ক্ষীণ চন্দ্রকিরণস্নাত বিলের জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কিরীটীর মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা জাগে। মনে পড়ে বঙ্কিমের চন্দ্রশেখরের প্রতাপ ও শৈবলিনীর চন্দ্রালোকিত রাত্রে গঙ্গার বুকে সাঁতার দেবার কথা।
কিরীটী এগিয়ে চলে।
স্বপ্নের চাইতেও বর্তমানে যে চিন্তা তাকে এই রাত্রে বৌরাণীর বিলের জলে এনে ফেলেছে, ঐ অস্পষ্ট দূরবর্তী অন্ধকার বৃক্ষ-সমাকুল তটরেখা—সেই দিকে লক্ষ্য রেখে কিরীটী সাঁতরে চলে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে।
অনেকটা পথ চলে এসেছে কিরীটী।
সহসা তার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল অষ্পষ্ট ক্ষীণ সঙ্গীতের সুরে। উৎকর্ণ হয়ে ওঠে কিরীটী সন্তরণ দিতে দিতেই। জলের মধ্যে গানের সুর! হ্যাঁ, সত্যি কে যেন গান গাইছে অল্প দূরে কোথাও। গানের সুরকে অনুসরণ করে কিরীটী আরও খানিকটা দ্রুত নিঃশব্দে সাঁতরিয়ে এগিয়ে যায়।
ক্ৰমে স্পষ্ট—আরো স্পষ্ট শোনা যায় এবার গানের সুরলহরী।
কি মধুর! কিবা অপরূপ কন্ঠ! চন্দ্রালোকিত এই নিশীথ রাত্রি যেন বীণাবাদন করছে। গানের সুর-মুর্ছনায় যেন আকাশ বাতাস দিগন্ত প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে।
আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর সহসা এতক্ষণে কিরীটীর নজরে পড়ে তীরের সন্নিকটে একটি ছোট ভাসমান নৌকা জলের মধ্যে। ভাসমান সেই নৌকার উপরে বসেই ধীরে ধীরে বৈঠা দিয়ে জল কাটতে কাটতে আপন মনে সম্বিৎহারা হয়ে কে যেন গান গেয়ে চলেছে।
আরো একটু এগিয়ে গেল কিরীটী সন্তর্পণে।
চন্দ্রালোকে এবারে গায়িকা নৌকার উপরে উপবিষ্টা চন্দ্রলেখাকে চিনতে কিরীটীর কষ্ট হয় না।
গায়ে একটা পাতলা জরির ওড়না চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। বৃক্ষের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে পাকানো মত দুটি বেণী।
আশ্চর্যই হয়ে যায় কিরীটী এত রাত্রে নৌকায় বসে চন্দ্রলেখাকে গান গাইতে শুনে।
কে জানে ওর দাদু হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে! সেই ফাঁকে চন্দ্রা নৌকা নিয়ে বিলের জলে ভেসে পড়েছে এই রাত্রে।
কি একটা উর্দু গান গাইছে চন্দ্রা। গানের ভাষা না বুঝলেও ভারি মিষ্টি কিন্তু লাগে কিরীটীর গানের ভাব।
কিরীটী এবারে একটু অন্ধকার দেখে তীরের এক অংশে সাঁতরে গিয়ে ওঠে এবং উঠে ভিজে কষ্টিউমটা গা হতে খুলে ধুতিটা পরে নিল।
চন্দ্রা তখনও আপন মনে গান গাইছে। কিরীটী আলোছায়া-খচিত পথ দিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল।
দিনের বেলায় আজ যখন প্রৌঢ় সূরযমলের সঙ্গে এই দিকে এসেছিল তখনি বেশ ভাল করে চারিদিক দেখে রেখেছিল। বাড়ির পশ্চাৎভাগে পৌছাতে তার কষ্ট হয় না।
এদিককার দরজাটা ভেজানো ছিল মাত্র। বোধ হয় চন্দ্রলেখাই ভেজিয়ে রেখে গিয়েছে।