বলছিলাম বসন্তের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কাছারী ও অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে বিশ্রী একটা সন্দেহ জেগেছে। মৃদুকণ্ঠে বললেন সান্যাল।
সেটা তো খুব স্বাভাবিক মামাবাবু। এ ধরনের ব্যাপারে ওরকম একটুআধটু গোলমাল হৈচৈ হয়েই থাকে। এজন্য বিচলিত হলে তো আমাদের চলবে না। কালকে আপনার সঙ্গে আমিও একবার কাছারী ও অফিসে যাবো।
তুমি? তুমি যাবে? না, না—তার কোন প্রয়োজন হবে না। শক্ত হতে আমিও জানি। আমি দেখছিলাম কেবল আজ ব্যাটাদের দৌড়। বিকেলের দিকে গিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছি। মুহূর্তে নিত্যানন্দের কথার ধাঁচ পর্যন্ত পাটে গেল। কণ্ঠের সুর গেল বদলে।
ইতিমধ্যে সকলের পশ্চাতে সন্তোষ চৌধুরী যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে এবং ওদের সকল আলাপ-আলোচনাও শুনেছে ধৈর্যের সঙ্গে নিঃশব্দে, ওরা কেউ টেরই পায় নি, এমন কি ওর উপস্থিতিটা পর্যন্ত। এতক্ষণে সন্তোষ চৌধুরী কথা বললে, সবিতা, তোমার যদি আপত্তি না থাকে—তুমি যদি আমার সম্পর্কটা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা না করো—
উপস্থিত সকলেই বক্তা সন্তোষ চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকাল। সন্তোষ চৌধুরীর কথা তখনও শেষ হয় নি, সে বলছিল, আমিও নায়েব ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত থেকে সব দেখাশোনা করতে পারি।
না, না—তোমার মানে আপনার এখন এসব ব্যাপারে না যাওয়াই ভাল সন্তোষবাবু। প্রতিবাদটা জানালেন নিত্যানন্দ সান্যাল।
কেন? ক্ষতি কি তাতে? ভ্রূকুটি-কুটিল দৃষ্টিতে তাকায় সন্তোষ চৌধুরী সান্যালের দিকে।
বুঝলেন না এটা? এখনও তো এ বাড়ির সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্কই প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এতে করে আরো হয়ত ব্যাপারটা জটিল হয়েই উঠবে।
আমি এই বাড়িরই ছেলে। এখন আমিই বলতে গেলে সবিতার সব চাইতে নিকটতম আত্মীয়-ঝামেলার কোন কথাই তো এতে উঠতে পারে না।
আহা, আপনি ঠিক বুঝছেন না! আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
বক্তব্যের শেষাংশটুকু সান্যাল পার্শ্বেই দণ্ডায়মান কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।
আপনাদের ঘরোয়া পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে আমার মতামত দেওয়াটা ঠিক শোভন হবে না সান্যাল মশাই। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কারোরই কিছু করতে হবে না মামাবাবু। নায়েব কাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত—যতদিন না সব গোলমাল মেটে, দেখাশোনা সব আমিই, হ্যাঁ-আমিই করবো। দৃঢ় সতেজ কণ্ঠে সবিতা বলে।
তুমি দেখবে! পাগলী! এসব ব্যবসা জমিদারীর ব্যাপার কি তুমি বুঝবে? কিছু তোমায় ভাবতে হবে না মা। আমি যখন এসে উপস্থিত হয়েছিই
না মামাবাবু, আপনাকে আর কষ্ট দেব না। বুড়ো মানুষ আপনি কটা দিন এখানে থাকলেই মনে বল-ভরসা পাব। যা দেখবার আজ থেকে আমি দেখবো। বলে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিল, বনমালী-বনমালী!
সবিতার ডাকে সাড়া দিয়ে বনমালী এসে হাজির হল, আমাকে ডাকছিলেন দিদিমণি?
হ্যাঁ, লছমনকে স্টেশনে পাঠিয়ে দে, টমটমটা নিয়ে আসুক। বিকেলে আমি কাছারীতে যাবো–
বনমালী চলে গেল।
এবার সবিতা কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, মিঃ রায়, দয়া করে যদি আপনি এখন আমার ঘরে একবার আসেন উপরে। আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা ছিল।
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে অতঃপর দৃঢ় সংযত পদবিক্ষেপে রাজেন্দ্রণীর মতই অন্দরের দিকে এগিয়ে গেল। সকলে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবিতার গমনপথের দিকে।
আড়চোখে এবার তাকাল কিরীটী সান্যালের মুখের দিকে, প্রশান্ত মুখমণ্ডল প্রসন্ন হাসিতে যেন ঝলমল করছে।
কোথায়ও মুখের মধ্যে এতটুকু বিরাগ বা আক্রোশের চিহ্নমাত্রও নেই। কিরীটী অগ্রসর হলো ভিতরে যাবার জন্য।
প্রভু! তোমার লীলা দয়াময়। মা কল্যাণী, উপাসনার একটু আয়োজন করে দেবে চল তো মা জননী! নিরাকার পরম ব্রহ্ম কোন পথে যে কখন আমাদের চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন তা তিনিই জানেন। ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম।
নিত্যানন্দ ভিতরের দিকে পা বাড়ালেন। কল্যাণী অনুসরণ করল পিতাকে।
কেবল স্তব্ধ নির্বাক সন্তোষ একাকী পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সবিতা তার নিজের ঘরে একটা আরামকেদারার উপরে হেলান দিয়ে। অর্ধশায়িত ভাবে চোখ বুজে নিঃশব্দে পড়েছিল, কিরীটীর পদশব্দ দোরগোড়া পর্যন্ত এলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল না। টের পায় না সে।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, সবিতা দেবী!
চোখ মেলে তাকাল সবিতা, ওঃ মিঃ রায়, আসুন ভিতরে আসুন— বলতে বলতে সবিতা কেদারাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই সবিতা ভিতর থেকে ঘরের দরজাটায় খিল তুলে বন্ধ করে দিল।
বসুন মিঃ রায়। দুজনেই উপবেশন করে মুখোমুখি দুটো কেদারায়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা।
কিরীটী পকেট হতে একটা সিগার বের করে অগ্নিসংযোগ করল।
নায়েব কাকার চিঠিটা পড়লেন তো মিঃ রায়?
কিরীটী সবিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললে, হ্যাঁ। শুধু, চিঠিতেই আপনাকে বসন্তবাবু, আমাকে এ ব্যাপারে নিবৃত্ত করতে বলেননি, আজ সকালে যাবার সময় নিজেও আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ফিরে যাবার জন্য।
হুঁ। আপনি—আপনি তাতে কি জবাব দিয়েছেন?
বলেছি আপনি আমাকে নিযুক্ত করেছেন, আপনি বললেই আমি চলে যেতে পারি। এখন আমার থাকা না-থাকাটা অবশ্য আপনার উপরেই নির্ভর করছে। তা আপনি কি বলেন?
আমি!
হ্যাঁ।
শুনুন মিঃ রায়, যত বড় দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপারই হোক না কেন, এর শেষ আমি দেখতে চাই। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।