চিঠি? হ্যাঁ, এই দেখুন। কিরীটী চিঠিটা সান্যালের হাতে তুলে দিল।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সান্যাল চিঠিটা পড়লেন।
কিন্তু বুঝতে পারছি না এরকম আহাম্মকের মত কাজ ওঁর মত একজন স্থির বিবেচক লোক করতে গেলেন কেন? পুলিশ তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না, আর লক্ষ্মীকান্ত দারোগা অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের লোক, সে তো কোনমতেই বিশ্বাস করবে না।
কেন?
এই সাধারণ সহজ কথাটা বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়। পুলিশ বিশ্বাস করবেন না এ ব্যাপারে আমাদের কোন হাত বা যোগসাজস নেই। তাদের ধারণা আমরাই বসন্ত ভায়াকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছি। সে কোথাও যায়নি।
কিন্তু বাবা, লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকেও নায়েবমশায় আলাদা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন, লিখেছেন, কথাটা বললে কল্যাণী।
চিঠি লিখে রেখে গিয়েছে– পুলিশের জাতও এমনি, ওসব চিঠির কথা বিশ্বাস করবে মনেও স্থান দিও না। সন্দিগ্ধ মন ওদের সবেতেই ওরা সন্দেহ করে। স্টেশন পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। সেখানে স্টেশন মাস্টার পর্যন্ত নাকি বলেছে কলকাতাগামী ঐ সময় একটা ট্রেন ছিল কিন্তু ট্রেনটার স্টেশনে stoppage পর্যন্ত নেই, প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জার এবং বিশেষ জরুরী প্রয়োজন বলিয়ে স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে আগের জংশনে ফোন করিয়ে গাড়ি থামিয়ে সেই গাড়িতে নাকি বসন্ত সেন চলে গেছেন। লক্ষ্মীকান্ত সাহা স্টেশন মাস্টারের কথা পর্যন্ত বিশ্বাস করেনি, ছুটে ঐখান থেকেই কাছারীতে গিয়ে হাজির হয়েছে। কাছারীতে সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
হুঁ। তাহলে দারোগা সাহেবের ধারণা বসন্তবাবুর কলকাতায় যাওয়ার জন্য ট্রেনে চাপাটাও চোখে ধূলো দেবার জন্যই? কথাটা যেন আবার বলে কল্যাণীই।
তা না হলে আর বলছি কি! এখানেও সে আসবে না ভাব! এলো বলে!
তা সেজন্য এত চিন্তারই বা কি আছে সান্যালমশাই। আসুন না তিনি। স্বচক্ষে এসে দেখেই যান না হয়। মনের মধ্যে সন্দেহ একটা পুষে রাখার চাইতে সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়াই তো ভাল। জবাব দেয় কিরীটী মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে।
এদিকে আরো একটা মুস্কিল হয়ে গিয়েছে যে মা সবিতা! এবারে সান্যাল এতক্ষণ নির্বাক স্থাণুর মত দণ্ডায়মান সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছারীতে গিয়ে আমি সব কাজকর্ম দেখতে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন সব শুরু হল। বাধ্য হয়েই কতকটা তাই আমাকে প্রকাশ করতে হল, বসন্তকে থানায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছে। যেই না ওই কথা আমার মুখ থেকে শোনা, সঙ্গে সঙ্গে অমনি চারিদিক থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। কেন, কি বৃত্তান্ত, সাত-সতের। দয়াময় এ বৃদ্ধ বয়সে কি যে ঝামেলার মধ্যে এনে আমাকে ফেললেন! জীবনে মিথ্যার আশ্রয় আজ পর্যন্ত নিইনি। মিথ্যা বলি কি করে! বাধ্য হয়েই সব খুলে বলতে হল। আর কি বলবো, শুরু হয়ে গেল কর্মচারীদের মধ্যে যত কল্পনা আর জল্পনা। নানা ধরনের প্রশ্ন, মিথ্যা কথা তো বলতে পারবো না, পালিয়ে এলাম। কি করি এখন বল তো মা?
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন সান্যাল সবিতার মুখের দিকে।
সবিতার কানে কিন্তু সান্যালের অত বড় দীর্ঘ বক্তৃতার কিছুই প্রবেশ করেনি।
সে তখন হতে বসন্ত সেনের পত্রটা পাওয়া অবধি পত্ৰমধ্যে বসন্ত সেন লিখিত কথাগুলোই ভাবছিল। মনের মধ্যে তার তোলপাড় করে ফিরছিল চিঠির কথাগুলোই।
কিরীটীকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানাতে বিশেষ করে লিখেছেন বসন্ত কাকা। লিখেছেন তিনি, সেই মহাত্মার প্রতি যদি তার এতটুকু সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য থাকে তাহলে যেন তাঁর পিতার মৃত্যু-রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপার হতে সে নিবৃত্ত হয়। কয়েকদিন ধরে তার মনের মধ্যে যে একটা সন্দেহের বিশ্রী কাঁটা খচখচ করছে, তারপর পারিবারিক ইতিহাসে কোথায় যেন একটা জটিলতা জড়িয়ে আছে সেটা স্বভাবতই একদিন সকলে ভুলে গিয়েছিল, অতীতের অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এইভাবে খোঁচাখুচি করতে গেলে হয়ত অতীতের সেই বিস্মৃতিপ্রায় জটিল কাহিনী দিনের আলোয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। কেচো খুড়তে গিয়ে হয়ত গোখরো সাপ ফণা তুলে বের হয়ে আসবে—হানবে মৃত্যু ছোবল।
তবে কি সে কিরীটীকে বিদায় দেবে?
কিন্তু কেমন করে? কেমন করে এখন সে বলবে কিরীটীবাবুকে যে আপনি ফিরে যান মিঃ রায়?
কিন্তু কিরীটীবাবু এখন ফিরে গেলেই কি সব চাপা যাবে? সবাই সব কথা যাবে ভুলে? না, তা আর তো হবে না। কেউ কোনদিন ভুলবে না, ভুলতে পারে না। মুখে না বললেও ইঙ্গিতে হাবেভাবে প্রকাশ করবে। প্রকাশ না হলেও আড়ালে মুখ টিপে হাসাহাসি করবে, তার চাইতে সত্য যা প্রকাশ হোক। সংশয়ের এ পীড়ন থেকে মুক্তি হোক। সত্যিই যদি পারিবারিক কোনও কলঙ্ক তাদের থেকেই থাকে জানুক সকলে। ধনী জমিদারদের বংশে অমন কত কলঙ্ক থাকে। অপমানের ভয়ে লজ্জার ভয়ে আজ তাকে এড়িয়ে গেলেই তা থেকে মুক্তি মিলবে না। পাপের, অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত যে করতেই হবে পূর্বপুরুষদের পরবর্তী বংশধরদের। হ্যাঁ, যদি কোন পাপ থেকেই থাকে তার পিতার, কন্যা সে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে। ভয় পাবে না সে। সত্যকে সে অস্বীকার করবে না। বংশের কোন অজ্ঞাত পাপ যদি তাকে স্পর্শ করেই থাকে, ফলভোগ তাকে করতে হবে বৈকি। কিন্তু সত্যজিৎ, সত্যজিৎকে যদি হারাতে হয়? হারাতে হয় হারাবে। সত্যের জন্য কর্তব্যের জন্য দিতে যদি হয়ই, যদি হয়ই আবশ্যক, দেবে সে তার প্রেমকে বলিদান। কঠিন প্রতিজ্ঞায়। সবিতা নিজেকে দৃঢ় করে তোলে। এবং এতক্ষণে কতকটা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সান্যালের দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি বলছিলেন মামাবাবু?