তাছাড়া বাবাজীর বোধ হয় ইচ্ছাও ছিল না কারো সঙ্গে এ দেশে আমি আলাপ-পরিচয় করি বা কথা বলি। কিন্তু দেড় মাস একটা লোকের মুখে দেখি না। এই প্রথম এখানে বাইরের লোক তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি
তোমার খাওয়াদাওয়া, বাজার-হাট করতে হয় না?
না। বাবুজীর লোক হপ্তায় দিন করে সব পৌঁছে দিয়ে যায়।
প্রৌঢ় সূরযমল ও তার অপূর্ব সুন্দরী তরুণী নাতনীর এখানে বাস করা হতে সব কিছুই যেন একটা ঘন রহস্যের জালে ঘেরা।
কিন্তু অদৃশ্য পরিচয় দানে অনিচ্ছুক সব ব্যাপারে সদা সতক প্রৌঢ়বর্ণিত বাবু-জীটি কে?
কি সম্পর্ক সেই বাবুজীর এই প্রৌঢ় রাজপুত ও তার তরুণী সুন্দরী নাতনীটির সঙ্গে? কেনই বা সে এদের সদর রাজপুতানা হতে এই নির্জন স্থানটিতে এনে লুকিয়ে রেখেছে? কি উদ্দেশ্যে?
কথায় বোঝা গেল, প্রৌঢ়ের নিকট হতে তার বাবুজীর কোন সংবাদই পাওয়া যাবে না। কিন্তু সংগ্রহ করতে হবে সংবাদটি।
কেন হঠাৎ দেড় মাস যাবৎকাল রাজপুতানা হতে ঐ প্রৌঢ় সরমল সিং ও তার তরুণী নাতনী চন্দ্রলেখা বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ প্রান্তে এই নির্জন কুটিরে বাসা বেধেছে?
বিলের অপর প্রান্তে প্রমোদভবনের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই তো?
এ বাড়িটা কার জানো সিংজী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না বাবুজী।
কিরীটী যখন প্রমোদভবনে এসে পৌঁছল সূর্য তখন ঠিক মধ্যগগনে। তাম্রপাত্রের মত সমস্ত আকাশটা প্রখর তাপে যেন গনগন করছে। প্রচণ্ডঅগ্ন্যুত্তাপ যেন মাথার উপরে আকাশ হতে ঝরে পড়ছে।
বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবিতা ও কল্যাণী। কল্যাণীর হাতের মধ্যে ধরা একটা চিঠির কাগজ। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে নীল কোর্তা গায়ে কুলী শ্রেণীর একটা লোক। লোকটা বোধ হয় স্টেশনের কুলীই হবে।
সাইকেলটা বারান্দার এক পাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বারান্দার উপরে উঠে এলো কিরীটী।
সবিতার সমস্ত মুখখানা যেন উদ্বেগে থমথম করছে। কল্যাণীর চোখমুখেও চিন্তার ছায়া।
ব্যাপার কি মিস সান্যাল? কিরীটীই ওদের দিকে অগ্রসর হতে হতে প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে।
এই দেখুন, কল্যাণী হাতের কাগজটা কিরীটীর সামনে এগিয়ে দেয়।
কি এটা? কাগজটা কিরীটী তার কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে তুলে ধরল। চিঠি। সংক্ষিপ্ত চিঠি একখানা। লিখেছেন নায়েব বসন্ত সেন। কৌতুহলভরেই চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে কিরীটী।
সুচরিতাসু মা সবিতা,
কয়েকটা বিষয়ে জরুরী কাজে একান্ত বাধ্য হইয়াই আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাইতে হইতেছে। এবং সেই কারণেই আপাততঃ লক্ষ্মীকান্ত দারোগার কথা অগ্রাহ্য করিয়া যাইতে হইল। তুমি কোনরুপ চিন্তা করিও না। পার তো এবং সর্বদিকে মঙ্গল চাও তো কিরীটীবাবুকে বিদায় দিও তাহার যথাযোগ্য প্রাপ্য মিটাইয়া। বৃদ্ধ চিরমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তোমার কাকাবাবুর এই অনুরোধটি রাখিও মা। এটা আমার একান্ত অনুরোধ। তোমার পিতাঠাকুর আজ মৃত। সেই মহাত্মার প্রতি যদি তোমার এতটুকুও সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য থাকে তাহা হইলে তাহার মৃত্যুরহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত হও। লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকেও পৃথক পত্ৰ দিয়া গেলাম। টমটমটা স্টেশন-মাস্টারমশাইয়ের জিম্মায় রহিল, সেটা লইয়া যাইবার ব্যবস্থা করিবে।
চিরআশীর্বাদক তোমার নায়েব কাকা
বসন্ত সেন।
কিরীটীই কুলীটার দিকে চেয়ে বললে, তুই যা। মাস্টারবাবুকে বলিস গাড়িটা বিকেলে লোক গিয়ে নিয়ে আসবে। বলতে বলতে পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে কিরীটী লোকটাকে বকশিশ দিল।
কুলীটা হাসিমুখে সেলাম জানিয়ে চলে গেল।
বসন্তবাবু এভাবে চলে গেলেন, এটা কি ভাল হলো মিঃ রায়? কথাটা বললে কল্যাণী।
বিশেষ কোন কারণেই তাঁকে যেতে হয়েছে, চিঠিতেই তো তিনি জানিয়েছেন কল্যাণী। এ ব্যাপারে এত চিন্তার কি আছে?
কিতু লক্ষ্মীকান্ত দারোগা!
কল্যাণীর মুখের কথা শেষ হল না দেখা গেল ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে এক অশ্বারোহী প্রমোদভ্রমণের দিকে আসছে।
দ্রুতধাবমান অশ্বের লৌহক্ষুরের খট খট শব্দ ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে।
কিরীটী সবিতা ও কল্যাণী তিনজনেই সোৎসুক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে অশ্বারোহীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কে অশ্বারোহী! বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ক্ৰমে অশ্বারোহী স্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং তাকে চেনাও গেল।
ঝড়ের গতিতেই অশ্বারোহী সোজা একেবারে প্রমোদভবনের গেটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে অভ্যস্ত দক্ষ অশ্বচালকের মতই মুহূর্তে অশ্বের বল্গা টেনে এক লহমায় যেন অশ্বের সমস্ত গতিকে রোধ করে জিনের পা-দানে পা দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়ালেন।
অশ্বের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত ও মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে।
অশ্বারোহীও ঘর্মাক্তকলেবর। বৃদ্ধ বয়সে পরিশ্রমে তখনও তিনি হাঁপাচ্ছেন। নিত্যানন্দ সান্যাল।
২০. নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে
নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে বারান্দায় এসে উঠে দাঁড়ালেন।
সবি মা তুমি আছ, কিরীটীবাবু, আপনি আছেন—ব্যাপার বড় সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসন্ত ভায়া থানায় ধরা না দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। দারোগাতো একেবারে অগ্নিশর্মা। কাছারীতে কাজ করছিলাম, একেবারে মারমূর্তিতে গিয়ে হাজির
সংবাদ আমরাও পেয়েছি। ধীরকণ্ঠে কেবল কিরীটী কথাগুলো বলে।
পেয়েছেন? শুনেছেন সব?
হ্যাঁ, বসন্তবাবু সবিতা দেবীকেও স্টেশন থেকে একটা চিঠি দিয়েছেন সব ব্যাপার জানিয়ে।