রাজপুত! বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে, আপ রাজপুতনাকে রহনেওয়ালে?
হ্যাঁ। রাজপুতনার এক গাঁয়ে আমার বাড়ি।
এখানে কতদিন আপনি আছেন? আপনার নাম কি?
আমার নাম সূরযমল সিং, জাতিতে আমরা রাজপুত চৌহান। মাস দেড়েক হলো এখানে এসেছি। কিন্তু কেন বলুন তো?
না, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।
সূরযমল অতঃপর চুপ করেই থাকে।
এখানে কোন কাজ ছিল বুঝি আপনার সিংজী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
কিরীটীর প্রশ্নে সুরযমল একটু যেন থমকে গিয়ে ইতস্ততঃ করে, তারপর মৃদু হাস্যের সঙ্গে মোলায়েম কণ্ঠে জবাব দেয়, কাজ না থাকলে কি সাধ করে নিজের মুলক ছেড়ে এত দূর দেশে কেউ আসে বাবাজী! তা বাবাজী, আপনাকে তো এদিকে কখনও দেখিনি!
না, আমিও মাত্র কয়েকদিন হল এদিকে এসেছি, এখানকার লোক আমি নই। জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। বড় পিপাসা পেয়ে গেল, হঠাৎ এই বাড়িটা চোখে পড়ায়—
পিপাসা লেগেছে বাবুজী আপনার, দাঁড়ান, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সূরযমল চীৎকার করে ডাকল, আরে এ চন্দ্রা, চন্দ্রা বিটিয়া হো?
মিহি মেয়েলী কণ্ঠে জবাব এল, যাইলোটামে থোড়া পানি আউর থোড়ি মিঠাই তো লাও বিটিয়া
না, মিঠাই নয় সূরযমলজী, শুধু পানি। কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।
এ কি কোন একটা বাত হলো বাবাজী। মেহমান, আপনি আমার কুটীরে। প্রৌঢ় হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
অপূর্ব!
মুহূর্তে যেন কিরীটীর দুটি চোখের তারা বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।
কিরীটী সম্মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
কোন একটি শান্ত রাগিণী যেন মূর্তিময়ী হয়ে নিঃশব্দে সঙ্গীতের মত চারিদিক মর্মায়িত করে এগিয়ে আসছে। কি অপুর্ব সুঠাম দেহবল্লরী। চপলা চঞ্চলা।
একটু লম্বাটে ধরনের মুখখানি।
হাতের মুঠির মধ্যে যেন ধরা যায় সরু কটিদেশ। পেলব সুকোমল দুটি বাহু।
পরিধানে যদিও রক্তিম পশমের ঘাঘরা ও আঁটসাট কাঁচলি, তথাপি যেন প্রস্ফুটিত কমলের মতই সৌন্দর্য ঢলঢল করছে কমনীয়তায় মাধুর্যে। এক হাতে লৈটা ও আর এক হাতে রেকাবিতে দুটো নাড়ু নিয়ে এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল তরুণী।
হরিণের মত সরল দুটি চোখের চাউনি তুলে তাকাল তরুণী।
চোখের নিচে কাজলের সক্ষম কালো রেখা। মাথার চুলে বেণী সংবদ্ধ।
খালি পা দুটিতে অলক্তরাগ চিহ্ন।
এই আমার নাতনী চন্দ্রলেখা বাবাজী। আমার ভাইয়ের বিটির বিটি।
ওর মা?
ওর মা! আমাদের বিটি প্রৌঢ়ের চোখের কোল দুটি ছলছল করে এল।
অনুমানেই বুঝতে পারে কিরীটী, প্রৌঢ়ের মেয়েটি আর ইহজগতে নেই।
কিরীটী চন্দ্রলেখার প্রসারিত হাত হতে মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা নিল। নাড়ু ঠিক নয়, লাড্ডু। এবং ওদের দেশীয় প্রথায়ই তৈরী। কোনমতে একটা লাড্ডু গলাধঃকরুণ করে কিরীটী এক লোটা পানিই ঢকঢক করে পান করে নিল।
চন্দ্রলেখা কিরীটীর হাত হতে লোটা আর পাত্রটি নেবার জন্য এবার এগিয়ে আসতেই কিরীটীর স্মৃতির পৃষ্ঠায় একটা বিদ্যুৎচমক খেলে যায় যেন।
অবিকল ঠিক এমনি না হলেও এই মুখখানিরই আদলটা যেন ওর চেনা চেনা।
তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে একবার তাকাল কিরীটী চন্দ্রলেখার মুখের প্রতি।
কোথায় কবে যেন অমনি একখানি মুখে সে দেখেছে। কিন্তু কোথায়!
মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা কিরীটীর হাত থেকে নিয়ে চলে গেল চন্দ্রলেখা অন্দরের দিকে।
কিরীটী তাকিয়ে থাকে মেয়েটির ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহের দিকে। কি দেখছেন বাবাজী?
কিরীটী মৃদু হেসে প্রৌঢ় সূরযমলের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, আপনার নাতনীর ঠিক রাজরাণীর মতই রূপ সিংজী!
রাজরাণী! সবই ওর কপালের লিখন, প্রৌঢ় সূরযমলের বুকখানা কাঁপিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন বের হয়ে আসে।
কথাগুলো অস্পষ্ট আত্মগতভাবে উচ্চারণ করেছিল সূরযমল। কিরীটী সঠিক বুঝতে পারে না।
কিন্তু বললে না তো সিংজী, এ দেশে কেন তুমি এসেছো?
ঐ যে বল্লাম বাবুজী, ভাগ্যের লিখন! ভাগ্যই টেনে এনেছেন আমাদের এই দেশে-নইলে, কথাটা সরযমল আর শেষ করে না। হঠাৎ যেন কথার মোড়টা ফিরিয়ে দিয়ে সূরযমল বলে, এই ধূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন বাবাজী, চল ওপাশের আমবাগানের বিলের ধারে চমৎকার একটা জায়গা আছে।
চল।
সত্যিই অপূর্ব জায়গাটা।
নিবিড় আম্রকানন। সম্মুখেই দিগন্তপ্রসারী বিলের জল। বৌরাণীর বিল।
দ্বিপ্রহরের খর সূর্যালোকে বিলের বুকে মন্থর বায়ুর তাড়নে জেগে-ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউগুলো যেন হীরার কুচির মতই জলজল করছে।
পত্রান্তরাল হতে একটা হরিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে শিস দিয়ে উঠছে একটা বুলবুলি।
কিরীটী ভাবছিল এমন নিরিবিলি জায়গাটিতে এমন একখানা বাড়ি কে তৈরী করল!
প্রশ্নটা সরযমলকে জিজ্ঞাসা না করে পারে না সে।
লোকালয়ের বাইরে এই নির্জন জায়গায় এই বাড়িটার খোঁজ তোমাকে কে দিল সিংজী?
যে বাবুজী আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি এই বাড়িতে এনে তুলেছেন আমাদের।
বাবুজী! কি নাম তার?
উহ; বাবু, শুধাবেন না দয়া করে। ঐ কথাটি বললে বেইমানি করা হবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি—
হ্যাঁ
কিরীটী মনের মধ্যে একটা জাল বুনে চলে।
একটা কাহিনীর ছিন্নসূত্র। কিছুতেই এ কয়দিন ধরে যার কোন হদিসই সে মনের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিল না, সেই ছিন্ন সূত্রটিই যেন সহসা মনের মধ্যে এসে উকিঝুকি দিচ্ছে।
চিন্তার জাল নীহারিকার মত এখনও দ্রুত ঘুর্ণমান আকারহীন। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে।