ছোটবাবু স্টেশনে যাচ্ছেন সাইকেল চেপে। তোমরাও যাও। নায়েব বসন্ত সেনকে ধরে আনতে হবে।
সমশের আর ইসমাইল।
লক্ষ্মীকান্তর দুটি যমদুত-সদৃশ সাকরেদ। এ সব ব্যাপারে এক পায়ে তো ওরা দাঁড়িয়েই আছে সর্বদা।
সমশের ও ইসমাইল দুজনের আবার নায়েব বসন্ত সেনের উপরে রাগও ছিল।
জমি সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে মাস দুই আগে ওরা একটা চাষী জোতদারকে সায়েস্তা করতে গিয়েছিল, আচমকা পূর্বাহ্নেই সংবাদ পেয়ে তীরের মত ঘোড়া ছুটিয়ে নায়েব বসন্ত সেন অকুস্থানে এসে হাজির হয়।
বসন্ত সেনের হাতে ঘোড়া হাঁকাবার সময় বিনুনী-কর চামড়ার একটা চাবুক ধরা থাকত। চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই বসন্ত সেন ঘোড়া থেকে ঘর্মাক্ত কলেবরে লাফিয়ে ভূমিতে এসে দাঁড়াল, কি ব্যাপার সেপাই?
চাষী জোতবার পরাণ মণ্ডল নায়েবকে দেখে কেদে পড়ল, দেখেন কত্তা, সেপাইদের অত্যাচারটা একবার দেখেন। মিথ্যে মিথ্যে ওরা আমায় থানায় নিয়ে যেতে চায়।
বসন্ত সেন বললেন, সেপাই, তোমরা থানায় যাও। আমি দারোগা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যাবোখন। বলো সাহেবকে ওর জামিন আমি রইলাম।
সমশের আর ইসমাইল দুজনেই খিঁচিয়ে উঠেছিল কটুকণ্ঠে, সরে যান নায়েব মশাই! এ সব থানা-পুলিসের ব্যাপারে আপনি মোড়লি করতে এসেছেন কেন?
বাঘের মতই অকস্মাৎ গর্জে উঠেছিলেন বসন্ত সেন, এই শুয়ারকি বাচ্চা! জানিস কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস? চাবকে একেবারে পিঠের চামড়া তোদের তুলে নেবো।
ইতিমধ্যে গোলমাল ও চেঁচামেচিতে প্রায় শখানেক চাষী সেখানে চারপাশে এসে ভিড় করেছে। লোহার মত কঠিন শক্ত দেহের বাঁধনি তাদের।
রাগে গর্জাতে গর্জাতে সমশের আর ইসমাইলকে থানায় ফিরে আসতে হয়েছিল।
সেযাত্রায় অবশ্য থানার দারোগাকে বসন্ত সেন শপাঁচেক টাকার নোট গুজে দিয়ে তার রোষবহ্নি হতে পরাণ মণ্ডলকে বাঁচিয়েছিল।
সমশের আর ইসমাইলকে দারোগা সাহেব চোখ রাঙিয়েই বলেছিল, জমিদারের এলাকায় বাস করতে হলে একটু সাবধান হয়ে বুঝে-সুঝে কাজ করতে হয়।
কিন্তু রৌপ্য চাকতির একটি ভগ্নাংশও তাদের পকেটে যায়নি, অতএব তাদের রাগটা বসন্ত সেনের উপরে প্রশমিত হবার সুযোগ পায়নি। তারা এতদিন সুযোগের অন্বেষণেই ফিরছে। আজ মিলেছে সুযোগ। মহা উল্লাসে তারা বসন্ত সেনের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী সাইকেলবাহী পাণ্ডের পশ্চাতে পশ্চাতেই বের হয়ে পড়তে দেরি করে না এতটুকুও।
আর ঠিক ঐ সময়ে প্রমোদভবনের মধ্যে কোথাও একটা সাইকেল পাওয়া যায় কিনা অনুসন্ধান করে ফিরছিল কিরীটী।
বনমালী বললে, কাছারীর পাইক রামশুরণের একটা ভাঙা সাইকেল আছে। বেচারা ঘোড়ায় চড়তে জানে না বলে কর্তাবাবু তাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, জরুরী সংবাদ কখনো দেওয়া-নেওয়া করতে হলে রামশরণকে দ্রুত যাওয়া-আসার জন্য। মাস দুই হলো রামশরণ ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। নিচের যে ঘরে সে থাকত সে ঘরেই সাইকেলটা আছে। আনবো সেটা?
কিরীটীর আদেশে রামশুরণের সাইকেলটা এনে দিল বনমালী। কিরীটী সাইকেলটা চেপে বের হয়ে পড়ল।
বৌরাণীর বিলটার ধার দিয়ে যতদূত বাঁধানো সড়ক ছিল চালিয়ে শেষে কাঁচা রাস্তায় এসে পড়ল কিরীটী। কাঁচা সড়কে গত দুদিনের বৃষ্টির ফলে কাদা জমে আছে। কোনমতে তার মধ্যে দিয়েই সাইকেল চালিয়ে সন্তর্পণে এগুতে লাগল কিরীটী।
বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিক ওটা। জনহীন, মানুষের বসতি বড় একটা নেই এদিকে। বেশীর ভাগই জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে কেবল দুএকটা চালাঘর এদিকটায় চোখে পড়ে।
এই জঙ্গলই অস্পষ্ট রেখায় গত সন্ধ্যায় নন্দনকানন হতে দেখা গিয়েছিল। মাথার উপরে বৈশাখের জলন্ত সূর্য। পিপাসায় কণ্ঠতালু কাঠ হয়ে উঠেছে। কোথাও একটু তৃষ্ণার জল পাওয়া যায় কিনা এদিক ওদিক তাকাতে লাগল কিরীটী।
সহসা নজরে পড়ে ছোট একটা বাড়ি। চালাঘর বললে ভুলই হবে। মেঝে ও দেওয়ালের পাকা গাঁথুনির উপরে খড়ের ছাউনি। আশেপাশের খানিকটা স্থানও পরিচ্ছন্ন। তবে সংস্কারের অভাবে ও অযত্নে জঙ্গলাকীর্ণই হয়ে আছে।
এমন নির্জনে একেবারে জঙ্গলের প্রান্তে এমন একটা বাড়ি দেখে একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল সে।
বাড়িটায় কোন লোকজন আছে বলেও মনে হয় না। কোথাও কোন পত্রান্তরালে বসে একটা ঘুঘু কূজন করছিল।
কিরীটী সাইকেল হতে নেমে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। সহসা এমন সময় বাড়ির পশ্চাৎ দিক হতে একটি প্রৌঢ় বাড়ির সামনে এসে কিরীটীকে অদূরে সাইকেলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।
লোকটার সাজ-পোশাকে ও চেহারায় এ দেশীয় বলে মনে হয় না।
উঁচু লম্বা চেহারা। মুখে সাদা-পাকা চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি রঙিন কাপড়ের। পরিধানে রাজপুতদের ধরনের পায়জামা, গায়ে একটা রঙিন পাতলা পাঞ্জাবি, পায়ে নাগরা।
মনে হয় লোকটা কোন রাজপুত-বংশীয়ই হবে। কিরীটী হাতের ইশারায় লোকটিকে ডাকল।
প্রৌঢ় ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করে বোধ হয় কি ভাবলে, তারপর ধীরে মন্থর পায়ে নাগরা জুতোর মচমচ শব্দ তুলে কিরীটীর সামনে এগিয়ে এল এবং অত্যন্ত রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, কেয়া? কেয়া মাংতেছে আপ ইধার?
নমস্তে জী, অপিকো দেখনেসে মালুম হোতা হ্যায় কি আপ ইধার বাঙ্গলকা আদমী নেহি হো।
বেশখ বাবাজী, ম্যায় রাজপুত হু। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর মোলায়েম হয়ে আসে।