ও কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় সবিতা কিন্তু অতীতে ধরেই যদি নিই একটা পারিবারিক কলঙ্ক থেকেই থাকে এবং সেই জন্যই শুধু, তুমি তোমার জন্মদাতা অমন স্নেহময় পিতার হত্যাকারীকে এমনি করে নিষ্কৃতি দাও তাহলে তুমিই কি মনে শান্তি পাবে? পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে কোন দিন?
কিন্তু তুমি— সবিতা আর নিজেকে রোধ করে রাখতে পারে না। গত কয়েক দিন ধরে যে প্রশ্নের কাঁটাটা নিরন্তর তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছিল, তার মা ও বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয়ই একটা অতীতের পারিবারিক কলঙ্ক কোথায়ও আছে এবং সেটা একদিন যখন সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়বে দিনের আলোর মত সেদিন তখন সত্যজিৎ কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে?
এত বড় শোক ও দুঃখের মধ্যেও যে সদ্যজাত প্রেম তার সমগ্র হৃদয়কে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, শেষ পর্যন্ত যদি তারই পারিবারিক একটা অতীত কলঙ্কের জন্য তাকে আবার ভুলে যেতে হয়, সে ব্যথাকেই বা সে ভুলবে কেমন করে কি সানায়!
সত্যজিৎ! সত্যজিৎ! না, না—তাকে আজ আর সে হারাতে পারে না! কিন্তু পিতার প্রতি কন্যার কর্তব্য
আজ দুদিন ধরে ঐ দ্বন্দ্বেই সে অহর্নিশি পীড়িত হচ্ছে।
১৯. লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে রুদ্ধ আক্রোশে ফুলতে ফুলতে লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন। থানার দুজন চৌকিদার এসে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরল।
ঘন ঘন চাবুকের ঘায়ে জর্জরিত করে ও দুই পা দিয়ে পেটে ক্রমাগত লাথি মেরেও অশ্বের গতি তিনি বাড়াতে পারেননি। ঘোড়াটার মুখ দিয়ে ফেনী গড়াচ্ছিল। আশেপাশে চেয়ে দেখলেন লক্ষ্মীকান্ত, কিন্তু টমটম বা বসন্ত সেন কাউকেই নজরে পড়ল না। ঘোড়া হতে নেমে ঘর্মাক্ত কলেবরে থানার বারান্দায় এসে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত। সেখানেও বসন্ত সেন নেই।
থানার বারান্দায় এ. এস. আই. পাণ্ডে দুজন চাষীর এজাহার নিচ্ছিলেন। চাষী দুটো সানুনাসিক কণ্ঠে পাণ্ডেকে কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল, সহসা ওদের দিকে নজর পড়ায় যেন বোমার মতই ফেটে পড়লেন লক্ষ্মীকান্ত, হাজতঘরে নিয়ে শুয়েরিকা বাচ্চাদের বেশ করে ঘাতক দাও, তবেই সব স্বীকার করতে পথ পাবে। যেমন কুকুর তার তেমনি মগের চাই।
অকস্মাৎ বড়বাবুকে আক্রোশে ফেটে পড়তে দেখে বিস্মিত পাণ্ডে মুখ তুলে তাকাল তার দিকে।
চাষী দুজন অপরাধী নয়, একটা চুরির ব্যাপারে থানা থেকেই সাক্ষী হিসাবে ওদের এজাহার নেওয়া হচ্ছিল। অকারণে ওদের হাজতঘরে পরে ঠ্যাঙাবার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
নায়েব বসত সেন এসেছিল পাণ্ডে? প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত।
কে, নায়েববাবু! হ্যাঁ, তিনি তো প্রায় মিনিট পনেরো আগে এসেছিলেন টমটমে করে। একখানা জরুরী চিঠি আপনার নামে লিখে রেখে গেছেন। বলে গেলেন আপনি এলেই আপনাকে দিতে।
কি বললে? সে চিঠি লিখে রেখে চলে গেছে? কর্কশ কণ্ঠে শুধোলেন লক্ষ্মীকান্ত সহকারী পাণ্ডেকে।
হ্যাঁ—এই যে চিঠি স্যার!
বলতে বলতে একটা ভাঁজকরা চিঠি এগিয়ে দিলেন পাণ্ডে বড়বাবুর দিকে।
চিঠি! কে চায় সে বদমায়েশের চিঠি! যেন একেবারে খেকিয়ে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত, সে বেটাকে আমি গ্রেপ্তার করেছিলাম। আর সে বেটা কিনা দিব্যি তোমাকে একটা চিঠি গছিয়ে দিয়ে ভেগে গেল! আহাম্মক! গদভ কোথাকার! কি করো? ঘাস খাও? যত সব অপদার্থ অকর্মার দল!
ব্যাপারটা যেন এতটুকুও বোধগম্য হয়নি এমনি হাঁ করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে পাণ্ডে লক্ষ্মীকান্তর দিকে কিছুক্ষণ, তারপর ঢোক গিলে বলে, গ্রেপ্তার! নায়েবজীকে গ্রেপ্তার করেছেন স্যার?
হ্যাঁ। ঐ বেটা ঘুঘুই তো জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে হত্যা করেছে।
বলেন কি!
চিঠিটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন লক্ষ্মীকান্ত!
সংক্ষিপ্ত চিঠি।
লক্ষ্মীকান্ত,
ভয় নেই আমি পালাচ্ছি না। দুচার দিনের মধ্যেই আমি আবার ফিরে আসছি, বিশ্বাস
করতে পারো আমার কথায়। কতকগুলো জরুরী কাজ আছে আমার হাতে, সেগুলো শেষ না করা
পর্যন্ত কিছুতেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমার কথায় যদি বিশ্বাস করো তাহলে আমার
জামিন আমি রইলাম। আর একটা কথা, এ নিয়ে আবার সবিতাদের উপর কোন হামলা করো না।
কথাটা বলতে হলো এই জন্যে যে তোমার পক্ষে বিচিত্র কিছুই নেই। বুদ্ধিটা আবার তোমার একটু
বেশী মাত্রায় প্রখর কিনা। সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, যেন প্রমোদভবনের কারো উপরে
এতটুকুও কোন জুলুম না হয়, তাহলে ফিরে এসে তোমাকে জীবন্ত রাখবো না।
নায়েব বসন্ত সেন।
আক্রোশে হতাশায় অপমানে যেন লক্ষ্মীকান্তর সমস্ত অন্তরটা অগ্ন্যুৎপাতের মত দাউ দাউ করে জ্বলছে। পঠিত চিঠিটা আক্রোশে হাতের মুঠোর মধ্যে দুমড়াতে দমড়াতে রোষকষায়িত লোচনে পাণ্ডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দিকে গেছে সে?
মনে হল স্টেশনের দিকেই যেন গেলেন স্যার!
এই মুহূর্তে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়ুন—যেমন করে হোক তাকে গ্রেপ্তার করে আনা চাই বা তার সংবাদ আনা চাই। যান।
যাচ্ছি স্যার। তাড়াতাড়ি পাণ্ডে উঠে দাঁড়ালেন। লক্ষ্মীকান্ত চীৎকার করে উঠলেন, সমশের-ইসমাইল!
থানার দুই জাঁদরেল ষণ্ডামাকা সেপাই। থানার যত অপকর্ম ওদের দিয়েই করানো হয়। হতদন্ত হয়ে তারা বড়বাবুর ডাক শুনে ছুটে এলো, হোজুর