বিলের মধ্যেই দোতলা পাকা ইটের গাঁথুনি বাড়িটাই প্রমোদভবন, বর্তমান জমিদারের বসতবাটি।
প্রমোদভবনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
সহিসের হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে বসন্তবাবু, টমটম থেকে নেমে ওদের দুজনকেও নামতে বললেন।
সামনেই একটা টানা প্রকাণ্ড বারান্দা রেলিং দিয়ে ঘেরা।
বারান্দার ঝোলানো বাতিটা জেলে দেওয়া হয়েছে। বাইরে বাতাস ছেড়েছে, বাতিটা দুলছে বাতাসে।
সবিতা প্রমোদভবনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।
সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে সমগ্র প্রমোদভবনের উপরে যেন একটা বিষাদের করুণ ছায়া নেমে এসেছে।
ক্রমেই বাতাসের বেগ বাড়ছে।
সকলে এসে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।
তোমরা হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করো মা—আমি ততক্ষণ হাতে-মুখে একটু জল দিয়ে আহ্নিকটা সেরেই আসছি।
সারাটা পথ একেবারে কঠিন মৌনব্রত অবলম্বন করে থেকে এই সর্বপ্রথম বসন্তবাবু ওদের সঙ্গে কথা বললেন।
এবং ওদের জবাবের কোনরূপ প্রতীক্ষা মাত্রও না করে সোজা তাঁর মহলের দিকে চলে গেলেন।
বনমালী ও কানাইয়ের মা।
বনমালী চৌধুরী-বাড়ির বহুদিনকার পুরাতন ভৃত্য।
আর দাসী কানাইয়ের মাও চৌধুরী-বাড়িতে আছে—তাও আজ পঁচিশ বছর হবে বৈকি।
কানাইয়ের মা-ই কোলে-পিঠে করে সবিতাকে মানুষ করেছে।
বনমালী আর কানাইয়ের মা দুজনেই একসঙ্গে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
বনমালীর হাতে একটা লণ্ঠন।
কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে ঢুকেই সবিতাকে লক্ষ্য করে বোধ হয় কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু সহসা সবিতার পাশে সত্যজিৎকে দেখে সে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল।
বনমালীর চোখেও জল আসছিল, সেও কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সবিতাকেই সম্বোধন করে ভাঙা গলায় বললে, ভিতরে চল দিদিমণি।
হ্যাঁ, আপনি যান সবিতা দেবী, হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন গে। আমি এই ঘরেই বসছি ততক্ষণ–
আপনিও আসুন সত্যজিৎবাবু। বলে কানাইয়ের মার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, কানাইয়ের মা, দোতলায় আমার পাশের ঘরটাতেই এই বাবুর থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। বনমালী, তুমিও যাও—ঘরটা কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটু গুছিয়ে দাও গে।
সত্যজিৎ বাধা দেয়, আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন সবিতা দেবী। ওসব হবেখন।
বাবা থাকলে কোন কিছুর জন্যেই অবিশ্যি আমাকে ভাবতে হতো না সত্যজিৎবাবু! বলতে বলতে সবিতার চোখের কোল দুটো জলে চকচক করে ওঠে।
রাত বোধ করি দশটা হবে। কিছুক্ষণ আগে কালবৈশাখীর একপশলা ঝড়জল হয়ে গিয়েছে। খোলা জানালা-পথে ঝিরঝির করে জলে ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরের মধ্যে।
সবিতার কক্ষের মধ্যেই বসন্তবাবু, সত্যজিৎ ও সবিতা তিনজনে বসে কথা হচ্ছিল।
ঘরের এক কোণে কাঠের একটা ত্ৰিপয়ের উপরে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া কেরোসিনের টেবিল-বাতিটা কমানো, মৃদুভাবে জ্বলছে। বাতির শিখাটা ইচ্ছে করে কমিয়ে রাখা হয়েছে। মৃদু আলোয় কক্ষের মধ্যে একটা আলোছায়ার স্বপ্ন যেন গড়ে উঠেছে।
বসন্তবাবু, বলছিলেনঃ
ব্যাপারটা শুধু, আশ্চর্যই নয়, রহস্যময়! পরশুদিন সকালে বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দনকাননে বকুল গাছটার তলায় চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহটা যখন আবিস্কৃত হলো–
সত্যজিৎ বাধা দিল, মৃতদেহ প্রথম কে আবিষ্কার করে?
আমি। আমিই প্রথমে মৃতদেহ দেখতে পাই। সাধারণত চৌধুরী মশাইয়ের ইদানীং মাসখানেক ধরে শরীর একটু খারাপ যাওয়ায় বেলা করেই ঘুম থেকে উঠছিলেন।
তাহলেও সাতটার মধ্যেই তিনি শয্যাত্যাগ করতেন। পরশু সকালে আটটা বেলা পর্যন্তও যখন চৌধুরী মশাই শয়নঘর থেকে বের হলেন না, বনমালীই চৌধুরী মশাইকে ডাকতে গিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে ঘর খালি। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। বনমালী এদিক ওদিক বাড়ির মধ্যে খোঁজাখুজি করে আমাকে সংবাদ দেয়। আমি তো আশ্চর্যই হলাম বনমালীর কথা শুনে। কারণ এত সকালবেলা বেড়ানো বা বাড়ি থেকে কোথাও বের হওয়া তো তাঁর কোন দিনই অভ্যাস নেই। যাহোক সমস্ত বাড়িটা খুঁজেপেতেও যখন তাঁকে পেলাম না তখন বাড়ির চারপাশে খোঁজাখুজি শুরু করলাম। তারপর আমিই খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মৃতদেহ বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দন কাননে গিয়ে দেখতে পেলাম।
কি অবস্থায় দেখলেন? সত্যজিৎ প্রশ্ন করল আবার।
দেখলাম বকুল গাছতলায় দেহটা লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে। পরিধানে সেই আগের দিনেরই ধুতিটা, খালি গায়ে একটা মুগার চাদর জড়ানো। এক পায়ে চটিটা আছে, অন্য পায়ের চটিটা একটু দূরে পড়ে আছে।
মৃতদেহে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল? সত্যজিৎ আবার প্রশ্ন করে।
না, তেমন কোন বিশেষ আঘাতের চিহ্নই দেহের কোথায়ও ছিল না, তবে নাকে ও মুখে রক্তমিশ্রিত ফেনা জমে ছিল।
আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ বোধ হয় throttle–শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। তাই কি?
সত্যজিতের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকালেন বসন্তবাবু, এবং বললেন, এখানকার সরকারী ডাক্তারের তাই অভিমত। মৃতদেহ ময়না-তদন্তের ফলে নাকি তাঁকে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে, এইটাই প্রমাণ হয়।
সত্যজিৎ তাকাল বসন্তবাবুর মুখের দিকে। সবিতা নিজের অজ্ঞাতেই একটা অর্ধস্ফুট আর্তকাতর শব্দ করে ওঠে।
বসন্তবাবুর বুকখানা কাঁপিয়েও একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
বললেন, মৃতদেহ কালই প্রত্যুষে সৎকার করা হবে।