কি বলছো তুমি জিত! জান না উনি আমাদের কতখানি! বাবা যে ওঁকে কতখানি স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন আর কেউ তা না জানলেও আমি তো জানি। আর উনিও বাবাকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন তেমনই ভালবাসতেন।
সবিতার কথাটা শেষ হল না, ঘরের বাইরে চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল না অথচ নিত্যানন্দ সান্যাল ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখেমুখে উদ্বেগের একটা কালো ছায়া যেন ঘনিয়ে আছে। ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, এই যে তোমরা সব দেখছি এই ঘরেই আছো, এত সক্কালে দারোগাবাবুই বা এসেছিলেন কেন আর টমটম করে বসন্তই বা অত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল?
নিত্যানন্দ সান্যালের প্রশ্নে সবিতার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, রুদ্ধকণ্ঠে সে-ই জবাব দিল, নায়েব কাকাকে দারোগা লক্ষ্মীকান্ত arrest করে নিয়ে গেলেন।
Arrest করে নিয়ে গেলেন? বসন্তকে? মানে, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন সান্যাল।
বাবার হত্যার ব্যাপারে, কথাটা সবিতা শেষ করতে পারল না।
দয়াময়! প্রভু! বসন্ত শেষ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয়কে, উহু না—না! তা হতে পারে না—নিঃশব্দে আপন মনেই মাথা দোলাতে লাগলেন সান্যাল, বিচিত্র বিচিত্র! বসন্ত কিনা মৃত্যুঞ্জয়কে
কিরীটী আর দাঁড়ায় না, একসময় নিঃশব্দেই পাশ কাটিয়ে ঘর হতে বের হয়ে আসে।
কিরীটীকে ঘর ত্যাগ করে যেতে দেখে সান্যাল সবিতাকে সম্বোধন করে বলেন, উহু এ তো ভাল কথা নয় মা সবি! এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।
আমিও তাই কিরীটীবাবুকে একটু আগে বলছিলাম।
কিরীটীবাবু তো চলে গেলেন দেখছি। তা উনি কি বললেন?
এখন ওঁকে জামিনে খালাস করতে হলেও নাকি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাদের যেতে হবে।
বেশ তো। সত্যজিৎবাবু, তুমিই হয় একটিবার তাহলে আজ সুদূরে চলে যাও—আমি চিঠি দিয়ে দেবোখন। কিন্তু তা যেন হলো, এদিকে এদিককার জমিদারীর ব্যাপারই বা কে সব দেখাশোনা করবে? কাছারীতে গিয়েও তো একজনের বসা দরকার? সাকসেশন সার্টিফিকেট উইলের প্রাবেট এসবও তো কিছু এখনও নেওয়া হয়নি!
কাকাবাবু, ফিরে না আসা পর্যন্ত কাছারী বন্ধই থাক মামাবাবু! সবিতা জবাব দিল।
পাগলী মেয়ে! তাই কি হয় রে! এত বড় জমিদারী, এত বড় ব্যবসা। মাথার উপরে একজন শক্ত হাতে লাগাম না ধরে থাকলে কর্মচারীরা চুরিডাকাতি করেই যে সব দুদিনে ফাঁক করে দেবে।
তাহলে কাকাবাবু, যতদিন না ফিরে আসেন আপনিই না হয় সব দেখাশোনা করুন মামাবাবু।
না, না—মা। এই বৃদ্ধ বয়সে ওসবের মধ্যে আর আমাকে জড়িয়ে ফেলবে কেন মা!
কিন্তু মামাবাবু, আপনি ছাড়া এসব আর তাহলে দেখবেই বা কে? আমি তো ওসবের কিছুই জানি না, বুঝিও না!
তাই তো! তুমি যে আমাকে বড় বিপদে ফেললে মা! অগত্যা চোখের উপরে আমি বেঁচে থাকতে হেমের একটিমাত্র সন্তানের সব ভেসে যাবে তা তো আর দেখতে পারবো না। যাই তাহলে, আমিই না হয় কাছারীতে যাই। তারপরই উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিলেন, বনমালী! এই বনমালী!
ডাক শুনে বনমালী এসে হাজির হল। সে বোধ হয় ঘরের আশপাশেই কোথাও ছিল।
আমায় ডাকছিলেন মামাবাবু?
হ্যাঁ, এই যে বাবা বনমালী! যাও তো বাবা, টমটমটাকে জুততে বল তো! কাছারী যেতে হবে।
টমটম, তো নায়েবজী নিয়ে বাইরে গেছেন, এখনও ফেরেননি।
ও হ্যাঁ। দেখেছো কি ভুলো মন আমার! সত্যিই তো, টমটমটা তো বসন্ত ভায়াই নিয়ে গেছেন—তা ঘোড়া আছে তো?
তা আছে।
তা ঘোড়াতেই জিন করিয়ে আনতে বলগে।
যে আজ্ঞে।
বনমালী চলে গেল। সান্যালও বোধ হয় কাছারিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হতেই চলে গেলেন।
ঘরের মধ্যে কেবল সবিতা ও সত্যজিৎ।
সবিতা? সত্যজিৎ ডাকে।
বল? সত্যজিতের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকলি সবিতা।
মনে হচ্ছে আজকের ব্যাপারে তুমি যেন অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছো?
কালকের ও আজকের ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা জাগছে জিৎ। আমার সত্যি বলছি কেমন যেন ভয়-ভয় করছে।
কিন্তু এখন তো বুঝতে পারছো সবিতা, তোমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই প্রকাণ্ড একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ক্রমে ক্রমে এখন সব একটু একটু করে জানা যাচ্ছে অনুসন্ধান করতে গিয়ে।
সবিতা সত্যজিতের যুক্তিকে খণ্ডনও যেমন করতে পারে না তেমন ও সম্পর্কে কোন কথাও যেন বলবার স্পৃহা পর্যন্ত বোধ করে না।
কি শান্তিই ছিল তাদের এই বাপ ও মেয়ের সংসারে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার আবির্ভাব কেন? কেন এ কালো মেঘ?
সত্যিই জিৎ, আমার কি মনে হচ্ছে জান? এই বাড়ি-ঘর দুয়ার সমস্ত সম্পত্তি ফেলে রেখে কলকাতার হস্টেলেই আবার ফিরে যাই।
তাতেই এই সঙ্কটকে কি তুমি এড়াতে পারবে সবি?
কিন্তু এখানকার হাওয়াই যেন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। আমার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।
আর কটা দিন অপেক্ষা করো, কিরীটীবাবু, তোমার বাবার হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা করতে পারেন ভালো, নচেৎ আমি তো
সত্যি কথা বলতে কি তোমায় জিৎ, তাতেও যেন আর আমার খুব বেশী উৎসাহ বা রুচি নেই।
সে কি! এ তুমি কি বলছে সবি?
হ্যাঁ। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানবার পর থেকে, বাবার ও মৃত্যুর ব্যাপারে কোথায় যেন একটা পারিবারিক জটিলতাই জড়িয়ে আছে, যেটা এতদিন হয়ত কালের অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল সকলে ভুলেও গিয়েছিল, এখন আবার এই মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে হয়ত সেই সব অতীতের কাহিনী মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।