কিরীটী নির্নিমেষে বসন্ত সেনের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল। ওষ্ঠপ্রাতে আবার তার সেই ক্ষণপূর্বের বঙ্কিম হাসি জেগে ওঠে।
১৮. পর পর দুটি প্রভাত
পর পর দুটি প্রভাত দুটি আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে প্রমোদভবনের উপরে যেন প্রচণ্ড আঘাত হেনে গেল।
কানাইয়ের মার অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্টা হওয়া, নায়েব বসন্ত সেনের লক্ষ্মীকান্ত কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়া।
বসন্ত সেন কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারটা আদৌ একটা গুরুতর ঘটনা বলে ধরেননি। ঘর হতে বের হয়ে বারান্দায় দণ্ডায়মান সত্যজিৎ ও সবিতার ব্যাকুল সপ্রশ্ন দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো।
সত্যজিৎ সবিতা দুজনেই যেন একটু বিস্মিত হয়। বসন্ত সেনের মুখের কোথাও উদ্বেগের বা চাঞ্চেল্যের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই যেন। প্রশান্ত মুখ এবং ওষ্ঠপ্রান্তে নিশ্চিন্ত একটি হাসির স্পষ্ট আভাস। কোন বাক্যবিনিময়ই হলো না পরষ্পরের মধ্যে, কেবল নির্বাক দৃষ্টির মধ্যে দিয়েই যেন বসন্ত সেন বুঝিয়ে দিলেন চিন্তার উদ্বেগের কোন কারণ নেই।
অন্দর অতিক্রম করে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বসন্ত সেন হাঁক দিয়ে দারোয়ানকে ডাকলেন।
ভোজপুরী দারোয়ান সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়াল, জি!
লছমনকে বোলনা টমটম তৈয়ার করকে তুরন্ত ইধার আনেকে লিয়ে! নায়েবের হকুমে দারোয়ান সহিস লছমনকে সংবাদ দিতে চলে গেল।
অদূরে গেটের পাশে দারোগার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেদিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, আপনার সঙ্গে ঘোড়া আছে দেখছি দারোগাবাবু-আপনি বরং তাহলে এগোন, আমি টমটমে থানায় আসছি।
আমিও আপনার সঙ্গেই টমটমে যাবোখন—
কিন্তু আপনার ঘোড়া?
সে থানায় গিয়ে একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
দারোগার কথায় বসন্ত সেন মুচকি একটু হাসলেন। বুঝতে পারছিলেন, অতঃপর লক্ষ্মীকান্ত সাহার আর সাহসে কুলোচ্ছে না তাঁকে একলা ছেড়ে যেতে।
বস্তুতঃ কতকটা তাই বটে। বসন্ত সেনকে ঘাঁটাবারও এখানে এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে যেমন আর তাঁর সাহস ছিল না তেমনি তাঁকে এখানে একা ছেড়ে থানায় ফিরে যেতেও ভরসা পাচ্ছিলেন না। যেমন করে হোক যত শীঘ্র সম্ভব এখন বসন্ত সেনকে নিয়ে থানায় নিজের এলাকার মধ্যে গিয়ে তুলবার জন্য মনে মনে সত্যিই তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।
ক্ষণপূর্বে কক্ষের মধ্যে বসন্ত সেনের উচ্চারিত তাঁর সদম্ভোক্তিগুলো লজ্জায় অপমানে আক্রোশে যেন তাঁর ভিতরটা পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল, কিন্তু এখানে একাকী অসহায়ভাবে তাঁরই চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড়িয়ে হুমকি ছাড়বার মত দুঃসাহস আর তাঁর ছিল না।
কিন্তু তার কোন প্রয়োজন নেই দারোগাবাবু! স্বেচ্ছায় যখন আপনার হাতে নিজেকে ধরা দিতে চলেছিই, আর যাই হোক বসন্ত সেন কথার খেলাপ করবে না। বেশ, তাহলে না হয় একটু অপেক্ষাই করুন—টমটমটা আসুক।
বারান্দার উপরেই দুজনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লছমন টমটম জুতে নিয়ে এল।
বসন্ত সেন এগিয়ে যেতেই লছমন নায়েবের হাতে লাগামটা তুলে দিল সসম্ভ্রমে।
বসন্ত সেন বরাবরই টমটম নিজেই চালান।
পাদানীর উপরে পা দিয়ে টমটমে উঠে বসে লাগামটা জুত করে ধরে চাবুকটা হাতে নিচ্ছেন বসন্ত সেন, লক্ষ্মীকান্ত এগিয়ে এলেন পাদানীর দিকে টমটমে উঠে বসবার জন্য। কিন্তু ঠিক সেই মুহর্তে যেন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। চকিতে ঘোড়াটার লাগামটা টেনে উদ্ধত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে লক্ষ্মীকান্তকে সম্বোধন করে বসন্ত সেন বললেন, উহ! এ টমটমে নয়, এ ঘোড়াটা নতুন, বড় তেজী। কখন কি বিপদ ঘটায় বলা যায় না, আপনি আপনার ঘোড়ায় চেপেই বরং আমার পিছনে পিছনে আসুন-বলতে বলতে হাতের মুঠোয় ধরা চাবুকটা শূন্যে আন্দোলিত হয়ে হুস করে একটা শব্দ তুলতেই শিক্ষিত তেজী ঘোড়া নক্ষত্রবেগে ছুটে যেন টমটমটাকে টেনে নিয়ে সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতভম্ব লক্ষ্মীকান্ত স্তব্ধ হয়ে গেটের সামনে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সমস্ত অন্তরটা তখন যেন একটা ভীষণ অগ্নুৎপাতের মত জলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল তাঁর।
দাঁতে দাঁত চেপে অদূরে গাছের সঙ্গে বাঁধা রোগ-জীর্ণ ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে সমস্ত শরীর যেন তাঁর কাঁপছে, পা টলছে।
ঘোড়াটার উপরে উঠতে গিয়ে দুদুবার উঠতে পারলেন না লক্ষ্মীকান্ত! এখনো অশ্ব ব্যাপারে লক্ষ্মীকান্ত খুব বেশী রপ্ত হননি।
তিনবারের বার উঠে বসলেন তিনি ঘোড়ার পিঠে।
ধীরে ধীরে দুলকি চালে ঘোড়া চলতে লাগল। রাস্তায় পড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেবল একটা ধুলোর চক্র সম্মুখের পথটাকে ধুম্রজালের মত আচ্ছন্ন করে আছে—টমটমের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
***
কক্ষের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিরীটী। ক্ষণপূর্বের হাসির যে বঙ্কিম রেখাটি ওষ্ঠপ্রান্তে তার দেখা দিয়েছিল সেটা একসময় মিলিয়ে গিয়েছে, কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ পদশব্দে চোখ তুলে তাকাতেই নজরে পড়ল কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছে সত্যজিৎ ও সবিতা।
আসুন সত্যজিৎবাবু, সবিতা দেবী! ওরা চলে গেলেন?
হ্যাঁ, নায়েব টমটমে গেলেন আগে-পিছনে গেলেন দারোগাবাবু। জবাব দিল সত্যজিৎ।
তাই নাকি! কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে আবার সেই বিচিত্র হাসি জেগে ওঠে, বেশ শক্ত পাল্লায় পড়েছেন এবারে আমাদের সাহা মশাই!