লাঠি হাতে পেলে এখনো দুজন লোকের মহড়া অনায়াসেই নিতে পারেন।
বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে চাকরিতে তিনি এসে ঢুকেছিলেন, আজ দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর এই জমিদারীতে তিনি চাকরি করছেন।
এই চৌধুরী-বাড়িতে তাঁর একটা যুগ কেটে গেল।
জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বয়সে তাঁর চাইতে বছর তিনেক মাত্র বড় ছিলেন।
একটু বেশী বয়সেই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বিবাহ করেছিলেন এবং বিবাহের প্রায় বছর দশেক বাদে সবিতার জন্ম হয়।
সবিতার যখন চার বছর বয়স তখন সবিতার মা হেমপ্রভা মারা যান। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর বিবাহ করেননি।
বসন্তবাবু, অকৃতদার। এবং যতদূর তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, ত্রিসংসারে তাঁর সত্যিকারের আপনার বলতে কেউ নেই এবং কোনদিন কেউ তাঁর আত্মীয়স্বজন আছে বলেও তিনি স্বীকার করেন না।
দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে মাত্র বারচারেক তিনি তীর্থভ্রমণের নাম করে মাস-দুই করে ছুটি নিয়ে বাইরে গিয়েছেন।
ঐ চারবার ছাড়া কেউ তাঁকে কোনদিন ঐ জায়গা ছেড়ে একটা দিনের জন্যও বাইরে যেতে দেখেনি।
যত বড় বিপদই হোক—বিপদে ভেঙে পড়া বা বিমূঢ় হয়ে পড়ার মত লোক নন বসন্তবাবু।
সবিতা ও সত্যজিৎকে পাশাপাশি ট্রেন থেকে নেমে আসতে দেখে বসন্তবাবু, আর অগ্রসর না হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে ছিলেন সত্যজিতের দিকে।
সত্যজিৎ কিন্তু নিজেই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয়টা দিল, আমি রেঙ্গুনের সত্যভূষণবাবুর ছেলে সত্যজিৎ।
সত্যজিৎ সম্পকে সকল ব্যাপার জানা থাকলেও ইতিপূর্বে বসন্তবাবু, সত্যজিৎকে দেখেননি।
নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, এসো। তোমার আসবার কথা ছিল আমি বাবুর মুখেই শুনেছিলাম।
অতঃপর সবিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন, চলো মা, বাইরে টমটম দাঁড়িয়ে আছে।
মালপত্র সামান্য যা সঙ্গে ছিল সহিস লছমনের সাহায্যে টমটমের পিছনে তুলে দিয়ে তিনজন পাশাপাশি টমটমে উঠে বসলেন।
বসন্তবাবু নিজেই টমটম হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছেন।
জায়গাটা আধা শহর আধা গ্রামের মত।
বেলা প্রায় পড়ে এলো।
আজ গাড়িটা প্রায় ঘণ্টা আড়াই লেট ছিল।
নিঃশেষিত দ্বিপ্রহরের ম্লান বিধুর আলোয় উঁচু কাঁচা মাটির সড়কের দুপাশের গাছপালা, গৃহস্থের ক্ষেতখামার, ঘরবাড়িগুলো কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
সারাটা দিনের অসহ্য গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপে সব কিছু যেন ঝলসে গিয়েছে বলে মনে হয়। বসন্তবাবু একধারে বসে নিঃশব্দে টমটম চালাচ্ছেন, অন্য পাশে ওরা সবিতা ও সত্যজিৎ নিঃশব্দে বসে আছে গা ঘেষে পাশাপাশি।
তিনজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। স্টেশন থেকে বর্তমান জমিদারবাড়ি প্রায় দীর্ঘ পাঁচ মাইল পথ হবে।
স্টেশন থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে ছোট শহরটি গড়ে উঠেছে হাজার দশেক লোকজন নিয়ে, জমিদারের বর্তমান বাসভবন শহর থেকেও প্রায় তিন মাইল দূরে নির্জন একটা বিলের ধারে।
বর্তমান জমিদারদের বাসভবনের আশেপাশে কোন বসতবাটিই নেই।
প্রথম দিকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বাপের আমলের পুরাতন যে জমিদার বাটি একটা ছিল তাতেই বাস করতেন।
প্রমোদভবনে এসে বসবাস করছিলেন তাও আজ দীর্ঘ উনিশ বৎসর হয়ে গেল।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পূর্বপুরুষেরা বছরের কিছুটা সময় এই দূরবর্তী নিরালা প্রমোদভবনে এসে আনন্দ ও স্ফুর্তি করে কাটিয়ে যেতেন মাত্র।
প্রমোদভবনের ব্যবহারটা ক্রমে কমে আসতে থাকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিতার আমল থেকেই।
দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর প্রমোদভবন অব্যবহার্য হয়ে পড়ে থাকবার পর আবার একদা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী প্রমোদভবনের সংস্কার সাধন করে পুরাতন পৈতৃক আমলের জমিদার-বাটি থেকে অসুস্থ স্ত্রী হেমপ্রভা ও একমাত্র চার বৎসরের কন্যা সবিতাকে নিয়ে কিছুকাল বাস করবেন বলে এসেছিলেন। কিন্তু প্রমোদভবনে আসবার চারদিনের মধ্যেই হেমপ্রভা অকস্মাৎ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় অসুস্থা স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলেন এবং ফিরে এসে পুরাতন জমিদার-ভবনে গিয়ে উঠলেও একটা বেলাও সেখানে কাটাতে পারলেন না।
হেমপ্রভার সহস্র স্মৃতিবিজড়িত বিরাট প্রাসাদের কক্ষগুলো দিবারাত্রি যেন মৃত্যুঞ্জয়কে পীড়িত ও ব্যথিত করে তুলতে লাগল। সন্ধ্যার দিকেই আবার পালিয়ে এলেন ঐ দিনই তিনি পুরাতন জমিদার-ভবন ত্যাগ করে প্রমোদ ভবনেই।
সবিতার বাল্য ও শৈশব ঐ প্রমোদভবনে কেটেছে।
জমিদারী আর মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর চাল ও পাটের ব্যবসা ছিল। পরিত্যক্ত বিরাট প্রাসাদটা জুড়ে মৃত্যুঞ্জয় তাঁর কাছারী করলেন।
প্রত্যহ টমটমে চড়ে দ্বিপ্রহরের আহারাদির পর মৃত্যুঞ্জয় পুরাতন প্রাসাদে আসতেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে সমস্ত কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করে, ব্যবস্থাপত্র করে রাত্রে একেবারে ফিরতেন।
ঘোড়ার গলার ঘন্টিটা ঠুং ঠুং করে সায়াহ্নবেলার মন্থর বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বৈশাখের করুণ রিক্ততা।
আজও আকাশের পশ্চিম প্রান্তে মেঘের ইশারা দেখা দিয়েছে। গতকালের মত এবং আজও হয়ত কালবৈশাখী দেখা দিতে পারে।
ক্রমে আদালত, স্কুলবাড়ি, বাজার ছাড়িয়ে টমটম শহরকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে।
এর পর মাঝখানে সরু কাঁচামাটির অপ্রশস্থ সড়ক এবং দুপাশে চষা ভূমি।
শহর ছাড়িয়ে প্রায় মাইল দুই গেলে বৌরাণীর বিল।
বৌরাণীর বিলের ধার দিয়ে প্রায় সোয়া ক্রোশটাক পথ এগিয়ে গেলে রাস্তাটা যেন বিলের জলের মধ্যে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হঠাৎ।