শুনেছিলাম একবার কয়েক বছর আগে। কথায় কথায় একদিন তিনি বলেছিলেন, তাঁর এক জাঠতুত ভাই বিবাহের পর হঠাৎ বাপের সঙ্গে নাকি কি নিয়ে গোলমাল বাধায় কাউকে কিছু না জানিয়েই রাতারাতি বৌকে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান।
তারপর?
তারপর নাকি আর তাঁদের কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। চৌধুরীরাও তখন জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলেন। রামশঙ্কর চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিতা পরষ্পর সহোদর ভাই ছিলেন। রামশঙ্করও তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র ছিলেন এবং মৃত্যুঞ্জয়ও ছিলেন তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র। রামশঙ্করের গৃহত্যাগের পর দীর্ঘ এগার বৎসরেও যখন গৃহত্যাগী নিরুদিষ্ট পুত্র আর গৃহে ফিরে এলো না এবং হাজার চেষ্টা করেও বহু অর্থব্যয় করেও তাঁর বা তাঁর স্ত্রীর কোন সংবাদই পাওয়া গেল না তখন তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ভাগের সম্পত্তি স্বেচ্ছায় তাঁর একমাত্র ভ্রাতুষ্পত্র মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকেই দান করে যান কেবল একটি শর্তে যদি কোনদিন তাঁর গৃহত্যাগী পুত্র বা তাঁর বংশের কেউ ফিরে আসে, তাহলে তাঁর ভাগের সম্পত্তি তাকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেও আজ দীর্ঘ চৌত্রিশ বৎসর আগেকার ঘটনা।
এই ভদ্রলোক বলছেন তিনি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠভ্রাতার পুত্র? লক্ষ্মীকান্ত প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
কিন্তু তার প্রমাণ কিছু দিয়েছেন?
প্রমাণের কথা জিজ্ঞেস করায় বললে, প্রয়োজন হলে সে সব প্রমাণই কোর্টে দাখিল করবে। আমাকে সে কিছুই দেখাতে রাজী নয়। বসন্ত সেন লক্ষমীকান্তর প্রশ্নের জবাব দিলেন।
হুঁ। ডাকুন তো একবার ভদ্রলোকটিকে?
লক্ষ্মীকান্তর নির্দেশে নায়েব বসত সেন কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। এবং সোজা গিয়ে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন। নিদ্রাভঙ্গের পর সন্তোষ চৌধুরী শয্যার উপরে বসে আপন মনে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে মধ্যে মধ্যে সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ধূমোদগীরণ করছিল; নায়েবের পদশব্দে ভৃত্য বোধ হয় চা এনেছে ভেবে বললে, কই, চা এনেছিস?
কিন্তু কথাটা বলে সামনের দিকে তাকিয়ে ভৃত্যর বদলে স্বয়ং নায়েবকে দেখে ভ্ৰকুঞ্চিত করে বললে, এই যে, নায়েব মশাই যে! ব্যাপার কি বলুন তো, সত্যিই আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়াবার মতলব নাকি আপনার? সকালবেলা যে ভদ্রলোককে এক কাপ চা দিতে হয়, তাও কি এ বাড়িতে চাকররা জানে না?
ঠিক এমনি সময় কল্যাণী হাতে এক কাপ ধুমায়িত চা নিয়ে কক্ষের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
কল্যাণীকে সহসা চায়ের কাপ হাতে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখে উভয়েই কম বিস্মিত হয় না।
এ কি! আপনি চা নিয়ে এলেন কেন? চাকররা কোথায়? প্রশ্নটা করল সন্তোষই।
কল্যাণী মৃদু হেসে জবাব দিল, আপনার মেজাজের ভয়ে গোবিন্দ চা নিয়ে আসতে সাহস পেল না, তাই আমিই নিয়ে এলাম আপনার চা।
কল্যাণীর হাত হতে চায়ের কাপটা নিতে নিতে সন্তোষ যেন একটু লজ্জিতভাবেই বলে, হ্যাঁ, সকালবেলা চা না পেলে মেজাজটা আমার যেন কেমন বিগড়ে যায়।
কল্যাণী কিন্তু সন্তোষের কথায় আর কোন জবাব না দিয়ে অতঃপর ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল।
এইবারে নায়েব বসন্ত সেন বললেন, একটু তাড়াতাড়ি চা-টা শেষ করে নিন সন্তোষবাবু। আপনাকে ওঁরা পাশের ঘরে ডাকছেন।
কে ডাকছেন?
এখানকার থানার বড় দারোগা সাহেব।
দারোগা সাহেব! কিন্তু তাঁর সঙ্গে কি প্রয়োজন?
তা তো জানি না, তবে এখনি একবার আপনাকে ডেকেছেন।
আমি ডাকাতও নই, খুনীও নই। I have got no. business with any দারোগা সাহেব!
আপনার কোন বিজনেস না থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে। সহসা খোলা দ্বারপথে লক্ষ্মীকান্তর কণ্ঠস্বর শোনা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ বসন্ত সেন ও সন্তোষ সামনের দ্বারপথের দিকে তাকাল।
শুধু একা লক্ষ্মীকান্ত সাহাই নয়, কিরীটী সবিতা ও সত্যজিৎও সঙ্গে আছে।
লক্ষ্মীকান্ত কথা বলতে বলতে সোজা একেবারে ঘরের মাঝখানে সন্তোষের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।
সন্তোষ রুক্ষ বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল আগন্তুক লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কর্কশকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কে আপনি? ভদ্রলোকের ঘরে সাড়া দিয়ে পারমিশান নিয়ে ঢুকতে হয়, এইটুকু জানেন না?
জানি কিনা সে পরে বিবেচনা করা যাবে মশাই। আপাততঃ আপনাকে আমার সঙ্গে এখুনি একবার থানায় যেতে হবে। বেশ সতেজ নির্দেশপূর্ণ কণ্ঠ লক্ষ্মীকান্তর।
থানায় যেতে হবে কেন? বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় সন্তোষ লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে।
কারণ আপনি আমার এলাকায় বিদেশী, আমাকে না জানিয়ে প্রবেশ করেছেন।
তাই নাকি? বাংলাদেশের মধ্যেও গ্রামে ও ছোটখাটো শহরে পাসপোর্ট সিস্টেমের প্রচলন হয়েছে এ কথা তো কই শুনিনি?
দেখুন সন্তোষবাবু, কার সঙ্গে রসিকতা করছেন একটু ভেবে করবেন। আপনি আমার সঙ্গে এখনি থানায় যেতে রাজী কিনা বলুন?
যদি না যাই?
কেমন করে যাওয়াতে হয় আমি তা জানি। থানা থেকে কনেস্টেবল পাঠিয়ে দেব কি?
সন্তোষ গুম হয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন কোথায় যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখবেন দারোগা সাহেব, এ অপমান আমিও এত সহজে হজম করে নেব না।
এখন তো চলুন, তারপর যা করবার করবেন। বলতে বলতে কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্মীকান্ত বললেন, কিরীটীবাবু, আপনিও আসুন। আপনার সঙ্গে আমার অনেক পরামর্শ আছে।