কানাইয়ের মার অতর্কিত অন্তর্ধানের ব্যাপারটা যেন সকলকেই একেবারে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিয়েছে।
রাতারাতি কোথায় যেতে পারে কানাইয়ের মা?
শহর এখান থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে। সে যদি নিজের ইচ্ছাতেই চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এই পাঁচ মাইল পথ রাত এগারটার পর কোন এক সময় এখান থেকে বের হয়ে অতিক্রম করে গিয়েছে।
কালকের সেই বৃষ্টি-বাদলের অন্ধকার রাত্রে যদি সে স্বেচ্ছায় গিয়েও থাকে, তাহলেও খুব বেশী দূর এখনও যেতে পারেনি নিশ্চয়ই।
আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহলে!
অত্যন্ত দ্রুত কিরীটী আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে একবার চিন্তা করে বিশ্লেষণ করে নেয় বোধ হয়।
এ কথা অবশ্য ঠিকই, হয় কানাইয়ের মা স্বেচ্ছায় এ-বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে, নচেৎ হয়ত যেতে হয়েছে। অথবা এবাড়ি থেকে তাকে কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
চলে গিয়েই যদি থাকে সে এ-বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায়! কিন্তু কেন যাবে? কি এমন কারণ থাকতে পারে তার যাবার?
যদি যেতে বাধ্য হয়ে থাকে! হয়ত সেটা অসম্ভব নয়।
আর যদি তাকে এখান থেকে সরানো হয়ে থাকে! সেটাও অসম্ভব নয়। কারণ এ বাড়ির সে বহুদিনকার পুরাতন দাসী। এ পরিবারের সঙ্গে সে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। তার পক্ষে অনেক অতীত ঘটনার সাক্ষী হওয়া মোটেই তো অস্বাভাবিক নয়। এবং সেটা সকলের পক্ষে বাঞ্ছনীয় তো নয়ই, অভিপ্রেত বা সুখকরও নয়।
ধরেই যদি নেওয়া যায় তাকে সরিয়েই ফেলা হয়েছে কোন বিশেষ কারণে, তাহলে কত দূরে কোথায় তাকে সরানো হল?
রাতারাতি কত দূরে তাকে সরিয়ে ফেলা সম্ভবপর?
কিরীটী সহসা লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় দারোগাবাবু, কানাইয়ের মার ব্যাপারটা?
মাগী নিশ্চয়ই কোথাও চলে গিয়েছে।
চলে গিয়েছে কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, খুঁজে আর দেখতে হবে না। অনেক খোঁজা হয়েছে, তাকে পাওয়া যায়নি।
খোঁজেন খোঁজেন—ভাল কইরা খুজিয়া দেখেন, পাইবেনখন। যাইবো কনে! যাওনের জায়গা থাকলি তো যাইবো! পোড়াকপাইলা বুড়ীর চালচুলো কোথাও কি আছে নাকি! বেবাক গিইলা বইসা আছে না মাগী! ওই যা, ওদিকে ডাল বসাইয়া আইছি! সব বোধ হয় পুইড়া ছাই হইয়া গেল! নির্বিকার যোগেশ বোধ হয় রন্ধনশালার দিকে যাবার জন্যই দরজার দিকে পা বাড়ায়।
এই হারামজাদা, যাচ্ছিস কোথায়, দাঁড়া! সহসা যেন অতর্কিতে বাঘের মতই গজিয়ে ওঠেন লক্ষ্মীকান্ত দারোগা।
থমকে দাঁড়িয়ে যায় যোগেশ। এবং ফ্যালফ্যাল করে লক্ষমীকান্তর মুখের দিকে তাকায়।
যাচ্ছিস কোথায়? বাবু, যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দে!
যোগেশ কিন্তু লক্ষ্মীকান্তর কথার কোন জবাব দেয় না, কেবল তাকিয়ে থাকে নিশ্চপ হয়ে তাঁর মুখের দিকে।
শালার চোখমুখের চেহারা দেখেছেন কিরীটীবাবু? পাক্কা শয়তান! লক্ষ্মীকান্ত কথাটা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে।
গালিগালাজ দেন ক্যান? কি করছি আমি? যোগেশ দারোগা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
না, গালাগালি দোব না, তোমায় পাদ্যার্ঘ্য দেব!
কি কইলেন? যোগেশ আবার প্রশ্ন করে।
যোগেশ, তুমি তো পাশের ঘরেই কাল রাত্রে শুয়েছিলে? এ ঘরে কাল রাত্রে কোন শব্দ শুনেছ? প্রশ্ন করে এবারে কিরীটী।
আইজ্ঞা শব্দ শুনুম ক্যামনে? ক্ষেন্তীর মায় কয়, আমি একবার নিদ্রা গেলে নাকি ঢাকের বাদ্যিও কানে আমার যায় না! তা আপনাগোর ছিচরণের আশীর্বাদে নিদ্রাটা আমার একটু গাঢ়ই।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও।
যোগেশকে অতঃপর বিদায় দেওয়া হল।
এখন আমার কি মনে হচ্ছে জানেন কিরীটীবাবু?
কি?
বুড়ী নিশ্চয়ই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে জড়িত ছিল। কোন কারণে বেগতিক দেখে পালিয়েছে; কিন্তু আমিও আপনাকে বলে রাখছি কিরীটীবাবু, আমারও নাম লক্ষ্মীকান্ত সাহা, চোদ্দ বছর দারোগাগিরি করছি। —ও হাঁ করলেই বুঝতে পারি। থানায় ফিরে গিয়েই চারিদিকে আমি লোক পাঠাবো। বেটী পালাবে কোথায়, হাতে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে এনে হাজতে ভরবো না! দেখুন না
কানাইয়ের মাকে ধরতে পারলে অবশ্য মন্দ হত না, তবে তাকে এত সহজে ধরা যাবে বলে মনে হচ্ছে না মিঃ সাহা!
এটা আমার এলাকা কিরীটীবাবু—আপনি নিশ্চিত থাকুন।
সহসা এমন সময় পাশের ঘর থেকে উগ্র কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল, গোবিন্দ! এই গোবিন্দ গোবিন্দ! এখনো চা দেবার সময় হল না বেটা তোদের?
লক্ষ্মীকান্ত নায়েবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে?
সন্তোষ চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় এডেন থেকে এসেছে। জবাব দিলেন। বসন্ত সেন।
লোকটা কে? আবার জিজ্ঞাসা করেন লক্ষ্মীকান্ত।
পরিচয় দিচ্ছে কর্তার জাঠতুত ভাইয়ের ছেলে—ভাইপো।
ভাইপো! কই, এর সম্পর্কে কোন কথা তো সেদিন আপনার মুখে বা সবিতা দেবীর মুখে শুনিনি।
আপনিও ওর আসবার পূর্বে ওর সম্পর্কে কোন কথাই শোনেননি? এবারে প্রশ্ন করে লক্ষ্মীকান্তই সবিতাকে।
না।
আপনার বাবা কোন দিন যে তাঁর জাঠতুত ভাই এডেনে থাকেন সে সম্পর্কে কোন কথাই আপনাকে বলেননি মিস চৌধুরী? প্রশ্ন করল এবারে কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে।
না। সবিতা এবারেও ঐ একই ছোট্ট সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়।
নায়েব মশাই, আপনি? আপনিও কোনদিন তাঁর মুখে শোনেননি তাঁর কোন জাঠতুত ভাই আছেন এডেনে, এ কথা? কিরীটী বসন্ত সেনের মুখের দিকে তাকিয়েই আবার প্রশ্ন করল।