একটা জলজ্যান্ত মানুষ রাতারাতি কোথায় উধাও হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই কৈাথাও না কোথাও আছে। আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখতে বলছি মা গোবিন্দকে। জবাব দিলেন বসত সেন।
এতক্ষণ কিরীটী একটা কথাও বলেনি। একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে কথা বললে, কানাইয়ের মা কোন ঘরে শুতো?
নীচের তলায় চাকরদের ঘরের পাশের একটা ঘরে। জবাব দিল সবিতা।
চলুন তো, একবার ঘরটা ঘুরে দেখে আসি। কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টিতে তাকে অনুসরণ করতে বলে খোলা দরজার দিকে সর্বপ্রথম এগিয়ে গেল। এবং দরজার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে লক্ষী কান্তকে সম্বোধন করে বললে, আসুন লক্ষ্মীকান্তবাবু, চলুন আপনিও এক বার দেখবেন না ঘরটা?
হ্যাঁ চলুন। লক্ষ্মীকান্তও অতঃপর তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন।
বসন্ত সেনও অনুসরণ করলেন ওদের।
বারান্দাটা অতিক্রম করে প্রশস্ত একটা বাঁধানো আঙ্গিনা। আঙ্গিনার দক্ষিণ প্রান্তে পর পর তিনটে ঘর। তারই একটা ঘরে কানাইয়ের মা সবিতারা এখানে আসবার পর থেকে রাত্রে শুচ্ছিল। ওদের এখানে আসবার পূর্বে অবশ্য কানাইয়ের মার জিনিসপত্র ঐ ঘরের মধ্যে থাকলেও, উপরের তলার একটা ঘরেই শুতো সে। পাশের দুখানা ঘরের একটায় থাকে বনমালী, অন্যটায় গোবিন্দ ও ঠাকুর!
নাতিপ্রশস্ত ঘরখানি। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। সবিতাই ঘরের সামনে এসে ঘরটা দেখিয়ে দিতে সর্বাগ্রে কিরীটীই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র বিশেষ কিছু তেমন নেই! একধারে একটা টিনের পুরাতন রং-চটা ট্রাঙ্ক, ছোট একটা মিলারের চ্যাপ্টা তালা লাগানো। তারই পাশে একটা মাটির কলসী ও তার উপরে পরিষ্কার কাঁসার লাস উবড় করা।
দেওয়ালের গায়ে গায়ে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টানিয়ে খানকয়েক সাদাকাপড় পরিষ্কার শাড়ি ঝোলানো আছে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একবার চারিদিকে তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে পর পর যে দুটি বদ্ধ জানালা ছিল সে দুটি খুলে দিল।
এক ঝলক হাওয়া ও আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। জানালা দুটো বিলের দিকে। জানালা খুললেই দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিলের জল চোখে পড়ে।
কিরীটী শয্যাটার দিকে এগিয়ে গেল। শয্যার মলিন চাদরটা জায়গায় জায়গায় কুচকে আছে এবং মাথার বালিশটা বিছানার একধারে পড়ে আছে।
অতঃপর কিরীটী ঘরের মেঝেটা তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে এক জায়গায় বসে পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেটার সাহায্যে কি যেন দেখতে লাগল।
অন্যান্য সকলে কৌতুহলী হয়ে কিরীটীর পশ্চাতে এসে দাঁড়ায়।
মিনিট দেড়েক বাদে কিরীটী আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সবিতার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, কানাইয়ের মা তো বিশেষ করে আপনার কাজ-কর্মই দেখাশোনা করত, তাই না?
হ্যাঁ। ইদানীং বয়স হওয়ায় তাকে বিশেষ কাজকর্ম তো করতে দেওয়া হতো না। নিজের খুশিমত যা টুকটাক কাজ একটু-আধটু করত।
কাল রাত্রে শেষবারের মত তাকে কখন আপনি দেখেন?
রাত এগারটার কিছু পরে সে আমার কাছ থেকে চলে আসে।
আজ সকালে কখন সর্বপ্রথম জানতে পারেন যে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না?
এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। রোজ সকালে সে আমার জন্য চা নিয়ে যেত, আজ যায়নি দেখে খোঁজ করতেই তো বনমালী এসে আমাকে বললে কানাইয়ের মাকে পাওয়া যাচ্ছে না খুঁজে।
বনমালী কোথায়?
বনমালীকে ডেকে আনা হল ঘরের মধ্যে।
এই যে বনমালী, তুমি কোন্ ঘরে গতকাল রাত্রে শুয়েছিলে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
এই ডানদিককার পাশের ঘরটাতে বাবু।
আজ সকালে তোমার দিদিমণি খোঁজ করবার আগে কানাইয়ের মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, জানতে না?
আজ্ঞে না। খুজতে এসেই তো দেখলাম এ ঘরে সে নেই।
কাল রাত্রে শেষ কখন তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?
খাওয়ার সময় রাত্রে, তখন সাড়ে দশটা হবে—
তারপর?
আজ্ঞে তারপর আমি ঘুমোতে চলে আসি ঘরে, আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি কাল রাত্রে।
রাত্রে কোন রকম শব্দ শুনেছিলে এ ঘরে?
না।
খুব ঘমিয়েছিলে বুঝি?
আজ্ঞে। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল—
ঠাকুর কোথায়? তাকে একবার ডেকে আন তো! বনমালী গিয়ে রন্ধনশালা হতে ঠাকুরকে পাঠিয়ে দিল।
বছর ত্রিশ-পয়ত্রিশ বয়সে হবে লোকটার। ঢ্যাঙা রোগা চেহারা। গায়ের। রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। গালের হনু দুটো বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। পুরু কালো ঠোঁট। উপরের পাটির দাঁত বিকশিত হয়েই আছে। লোকটার স্বভাব বোধ হয় বেশ পরিচ্ছন্ন। পরিষ্কার একটা খাটো ধুতি পরিধানে। গলায় লম্ববান ধবধবে একগুচ্ছ পৈতা।
তুমিই এ বাড়িতে রান্না কর? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আইজ্ঞা কর্তা।
কি নাম তোমার?
আইজ্ঞা অধীনের নাম যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাঢ়ী শ্রেণী।
বাড়ি কোথায়?
আইজ্ঞা সোনারাং।
কত দিন আছ এ বাড়িতে?
তা আপনাগোর আশীর্বাদে ধরেন গিয়া এক বৎসর তো হইবই।
তুমি এই পাশের ঘরেই শোও তো?
আইজ্ঞা।
কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কাল রাত থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জান?
আইজ্ঞা কি কইলেন? কানাইয়ের মায়েরে খুইজা পাওয়া যাইতেছে না। কন কি! যাইবো কনে? এহানেই কোথায় হয়ত হইবো। খুইজা দেখুম?
১৩. সকলে আবার নায়েবের ঘরে
সকলে আবার নায়েবের ঘরে ফিরে এলো।